Sunday 7 June 2020

ঘনায় নিকষ আঁধার

কোভিডের নাগপাশ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

কোভিড আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে ভারত গতকাল স্পেনকে ছাপিয়ে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। নিঃসন্দেহে বলা যেতেই পারে, ভারতবর্ষে কোভিডের দাপট সত্যি এক মহামারীর রূপ নিয়েছে। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমদিকে বিষয়টিকে খুব হাল্কা ভাবে নিয়েছিলেন এবং পরে তার কিছুটা গুরুত্ব বুঝলেও, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে দেশবাসীর কাছে আবেগের ছলনায় ১৮ দিনের বদলে ২১ দিনের সময় চেয়ে সকলকে মোমবাতি ও দিয়া জ্বালাতে বলেছিলেন। ধর্মভীরু দেশবাসীর এক বড় অংশ সে কথা বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে সাড়াও দিয়েছিলেন। তারপর আরও দু-এক দফা ২১ দিন ও  দু’ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, কোভিডের তাণ্ডব সমস্ত আবেগতাড়িত ‘ইচ্ছাশক্তি’ ও ‘দিয়ার আলো’কে ম্লান করে উত্তরোত্তর আরও প্রবলতর হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২,৪৬,৫৪৯ (এই লেখাটি ব্লগে পোস্ট করার সময়)। চতুর্থ স্থানে পৌঁছতে আমাদের এরপর ধরতে হবে বৃটেনকে যাদের গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২,৮৬,২৯৪। এই দৌড়ে ভারত এখন ঘোড়ার মতোই সবল ও অচিরেই প্রথম কি দ্বিতীয় স্থানের জন্য মার্কিন দেশের সঙ্গে তার লড়াই দেখতে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। (সূত্র: জন হপকিন্স)।

দেশে শহরগুলির মধ্যে আমেদাবাদ সব থেকে বেশি বিপন্ন, যেখানে হু’র সতর্কবাণীকে অগ্রাহ্য করে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামক এক সার্কাস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তা যে সত্যিই সার্কাস ছিল তা আরেক ক্লাউন ট্রাম্পের দেশের অবস্থা দেখেও মালুম হচ্ছে সবিশেষ। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডে উত্তাল আমেরিকার মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের সদম্ভ হুঙ্কারে বোঝাই যাচ্ছে তার মনোভাব কেমন ও কোথায়। ব্রাজিলের একনায়ক বোলসোনারো’ও কম যান না এবং ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের পদানুসরণ করে তিনিও হু’র থেকে সরে আসার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। ব্রাজিলে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা তাই স্বভাবতই এখন ৬,১৪,৯৪১। বরিস জনসন’ও প্রথম দিকে কোভিডকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ছেলেখেলা করায় নিজের ও দেশের সমূহ বিপদ ডেকে এনেছেন। তিনি নিজে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরেছেন এবং একদা স্বাস্থ্যে গৌরবান্বিত তাদের এ বাবদ মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৩৪,৪৬৬। অর্থাৎ, নার্সিসিস্ট ধরনের রক্ষণশীল নেতাদের বেয়াদপি, চালিয়াতি ও বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ায় আজ কোভিড আক্রান্ত দেশগুলির শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বৃটেন, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশগুলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো ইতিমধ্যে ছারখার হয়ে গেছে যেখানে কোভিডে আক্রান্তের বৃদ্ধির শতকরা হার ১৬.২ ও এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ১৯,০৬,০৬০।

এই ছন্নছাড়া পরিস্থিতিতে ভারতে জনজীবন উন্মুক্ত (আনলক ১.০) করে দেওয়ায় আগামী কয়েক দিনে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হতে চলেছে। মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে প্রধানমন্ত্রী যখন লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন তখন যেমন তার পিছনে কোনও ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল না, অনুরূপ, তাঁর সরকার যখন ১ জুন থেকে আনলক প্রক্রিয়া চালু করল তখনও কোনও আগাম পরিকল্পনা কিছু নেই। একে বলা যায়, পাগলের উদ্ভ্রান্ত অবস্থা। আর এই প্রখর উন্মত্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে সরকারের হাতে এখন ‘একটিই নির্দয় উপায়’ মজুত আছে। তা হল, যতটা সম্ভব পরীক্ষা কমিয়ে এনে আক্রান্তের সংখ্যাকে কম করে দেখানো। তা শুরুও হয়ে গেছে। ৩ জুন থেকে গুজরাতে কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে। পর পর হিসেবে তা দাঁড়াচ্ছে: ৩ জুন- ৬২৮৮ জন, ৪ জুন- ৬০২৩ জন, ৫ জুন- ৫৯৯০ জন, ৬ জুন- ৫৬৯৫ জন। (সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৭ জুন ২০২০)। দিল্লি সরকারও ঘোষণা করেছে, অ্যাসিম্পোটেমিটিক রোগীদের ক্ষেত্রে আর কোনও পরীক্ষা নয়। অর্থাৎ, হু যেখানে নিদান দিয়েছিল- পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা, সেখানে বীরপুঙ্গবেরা তাকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজ মতে চলে বিপদকে শতগুণ করাই সাব্যস্ত করেছেন। অথচ, এদের সকলের সামনে ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের উদাহরণ ছিল, নিদেনপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন বা জাপান থেকেও কিছু শিক্ষা নেওয়া যেত। এই দেশগুলি কোভিড নিয়ন্ত্রণে যথাযম্ভব কমবেশি পারদর্শিতার নজির রেখেছে।

উপরন্তু, দেশের পরিচালকদের এই পরিকল্পনাহীন হাত-পা ছোঁড়ার ফলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা। হঠাৎ করে কাতারে কাতারে তাদের স্ব স্ব রাজ্যে ফেরানোর হিড়িক পড়ে যাওয়ায় এখন গ্রামাঞ্চলেও আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে কোভিডের মারণবিষ। এতদিন অন্তত কৃষিকাজ করোনামুক্ত আবহে যথেষ্ট ভাল করছিল। ধসে পড়া অর্থনীতিকে কতকটা ঠেকা দিতেও এ জরুরি ছিল। এবার সে সুকাজেও চোনা পড়ল। আসলে, সরকারের শীর্ষকর্তারা ভেবেছিলেন, কোনও দৈব যোগবলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণামতো ২১ দিনেই করোনা খতম হয়ে যাবে আর সকলে উদ্বাহু হয়ে মোদির জয়জয়কার করবে। অতএব, কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা কারও মাথাতেই আসেনি। কর্মহীন, নিকৃষ্ট পরিবেশে বাস, বিরূপ সরকার, মানসিক আতঙ্ক, করোনা ত্রাস- এইসব নানাবিধ সন্ত্রাসে যখন শ্রমিকেরা দেখলেন ২১ দিনে করোনা তো গেলই না, উপরন্তু আরও এক দফা লকডাউন ঘোষিত হল, তখন স্বাভাবিক এক আতঙ্কগ্রস্ততা নেমে এল নিকষ আঁধারের মতো। আর এই ভয়ঙ্কর উদ্ভ্রান্ততায় পথেঘাটে, রেল স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে তাদের জমায়েতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল করোনা বিষ।

এদিকে, শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সত্যি সর্বনেশে! আনলক পর্ব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’ বা ‘ফিরতি পরিযান’এর আহ্বান উঠেছে। গুজরাত থেকে কেরালা, পাঞ্জাব থেকে বেঙ্গালুরু সকল মালিক ও নিয়োগকর্তারা বাস, গাড়ি, ট্রেনের টিকিট এমনকি বিমানের টিকিট পাঠিয়ে শ্রমিকদের ফেরত নিতে আবার উঠেপড়ে লেগেছে। বলা হচ্ছে, ফিরে আসা শ্রমিকদের দ্বিগুণ মজুরি দেওয়া হবে, থাকাখাওয়া ফ্রি। তাঁদের ফেরত নিতে বড় বড় কোম্পানির উচ্চপদের পরিচালকেরা শ্রমিকদের গ্রামে গিয়ে পর্যন্ত হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। এ এক অভিনব পরিস্থিতি। মুশকিল হল, এতে অর্থনীতির গাড়িও চলে না, কোভিডের বিষও নামে না।

সম্ভবত, সব মিলিয়ে এক অচিন্তনীয় গহ্বরে আমাদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠছে। কোভিড আমাদের ঘিরে ফেলছে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ যখন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে গোষ্ঠী সংক্রমণের বলয়ে আমরা প্রবেশ করে গিয়েছি তখন তা অসত্য বলে আর সম্ভবত চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। সরকারের কাছে এখন একটিই উপায়, যা বারবার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক বসু বা রঘুরাম রাজনরা বলার চেষ্টা করেছেন- কর্মহীন সমস্ত মানুষের কাছে নগদ জোগান সুনিশ্চিত করা। কারণ, হয় কোভিড নয় অর্থনীতি আপনার সঙ্গে রণে অবতীর্ণ। মনে রাখা উচিত, কোভিডে মৃত্যুহার এখনও আমাদের দেশে ৩ শতাংশের আশেপাশে বলে পার পাওয়ার কোনও উপায় নেই। কারণ, যদি গোষ্ঠী সংক্রমণ প্রবল হতে থাকে তাহলে ১৩০ কোটির দেশে ৫০ কোটি মানুষও যদি কোভিড আক্রান্ত হয় তাহলে তার ৩ শতাংশ কিন্তু ১ কোটি ৫০ লক্ষ এবং তা কম ত্রাসের নয়। এরমধ্যে আমার-আপনার নিকটজনেরা যে থাকবেন না তার নিশ্চয়তা কী?

   

3 comments:

  1. লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো।লেখক কে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. লেখাটির মধ্যে কিছুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই। একদিকে দীর্ঘ লকডাউন এর ফলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে অপরদিকে মানুষ দুটো পয়সা রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যা করো না সংক্রমণকে বাড়াতে সাহায্য করবে। গিমিক সর্বস্ব অপরিণামদর্শী হৃদয়হীন নীতির গুনাগার দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে এবং আরো হবে। বস্তুত ভারতীয় সমাজের হৃদয়হীন চেহারা তো আজকের নয়। যে মুম্বাই বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর সেখানে যুগ যুগ ধরে ধারাবি বস্তি চলছে। সেই ধারাভি থেকেই তো সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। রতন টাটা বলছেন ধারাভি আমাদের কলঙ্ক। সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ জীবনের প্রতি উদাসীনতা সমাজের সুবিধাভোগীর শ্রেণীকে গ্রাস করেছে সেই উদাসীনতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে। সামনের দিনগুলি বিরাট চ্যালেঞ্জ। সর্ব অর্থেই। অনিন্দ্য ভট্টাচার্যকে অভিনন্দন। অল্প কথায় বাস্তব চিত্র বলিষ্ঠ তার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী।

    ReplyDelete
  3. Anindya disclosed the naked truth. Situation is grave. Some netas are propagating herd immunity, which is another unscientific gimmick and people should not be deceived.

    ReplyDelete