Monday 15 June 2020

পিএম কেয়ার্স

স্বচ্ছতার প্রশ্নে উত্তর নেই
সুমন কল্যাণ মৌলিক

এ কথা বোধহয় কেউই অস্বীকার করবেন না যে করোনাজনিত অপরিকল্পিত লকডাউন ভারতে যে ভয়ংকর আর্থিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে তা পূরণে সাধারণ মানুষ নানান ধরনের ত্রাণের কাজের মাধ্যমে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে এই ত্রাণের কাজের লক্ষ্যে গঠিত পিএম-কেয়ার্স নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। একদিকে তথ্যের অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের একাধিক মামলা, অন্যদিকে সরকারের তরফে তথ্য দেবার অনীহা পরিস্থিতিকে আর‌ও জটিল করে তুলেছে। যে কোন‌ও জীবন্ত গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হল স্বচ্ছতা। কিন্তু পিএম-কেয়ার্স সংক্রান্ত আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ইস্পাত কঠিন নীরবতা নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গত ২৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ ফান্ড ঘোষণার পর থেকে এই ফান্ডের বিধি ব্যবস্থা ও পরিচালনা নিয়ে নানান প্রশ্ন ও অসংগতির অভিযোগ উঠেছে।

প্রথমত, ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলের অস্তিত্ব রয়েছে। এই তহবিলের ঘোষিত লক্ষ্য হল, ভূমিকম্প-বন্যা-খরা-ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনজীবন যখন ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন পরিস্থিতির মোকাবিলায় জনগণের সাহায্যকে কাজে লাগানো। একই ভাবে রাজ্যগুলিতে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ৩৮০০ কোটি টাকা মজুত রয়েছে। বহুল প্রচলিত এরকম একটি ফান্ড থাকা সত্ত্বেও কোভিডের মতো বিপর্যয়ের মোকাবিলায় আরেকটা ফান্ড (যা চরিত্রগত ভাবে পূর্ববর্তী ফান্ডের মতো কাজ করবে) তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা কেন হল তা নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া গেল না।

দ্বিতীয়‌ত, এই ফান্ডের নামকরণটি খুবই সুপরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ফান্ডটি যদি কোভিড উপলক্ষ‍্যে হয়ে থাকে তবে তার নাম পিএম কোভিড ফান্ড বা পিএম হেল্‌থ ফান্ড হতে পারত। কিন্তু তার বদলে পিএম-কেয়ার্স (Prime Minister's Citizen Assistance and Relief in Emergency Situation Fund) আসলে জনগণ ও কর্পোরেটদের টাকায় প্রধানমন্ত্রীর ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির চেষ্টা বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ স্পষ্ট ভাষায় পিএম-কেয়ার্সকে অগণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধী এবং নিম্নরুচির পরিচায়ক বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর‌ও বড় কথা হল, এই ফান্ডে জমা পড়া সমস্ত টাকা অন্তত আক্ষরিক অর্থে জনগণের তাদের সহনাগরিকদের বিপন্নতার সময় সহমর্মিতার প্রতীক। তাহলে এটার নাম সহজেই হতে পারত ইন্ডিয়া কেয়ার্স বা সিটিজেন কেয়ার্স। তার বদলে তা হয়ে উঠল প্রধানমন্ত্রীর জয়ঢাক।

তৃতীয়ত, নরেন্দ্র মোদি সরকারের গত ছয় বছরের কাজকর্মের ব্যাপারে যাঁরা মোটের উপর খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন যে এই সরকারের ঘোষিতভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হল বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। নানা ভাবে তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য সরকার সদা সচেষ্ট। কিন্তু পিএম-কেয়ার্স তৈরি করতে সরকার সেই এনজিও পদ্ধতি অবলম্বন করল। আদতে এটা একটা ট্রাস্ট। আইনের ধারণায় – Historically a Trust as a legal entity is used by private actors to benefit the public। তাই সরকার  থেকে বলা হচ্ছে, ট্রাস্ট বানানোর দলিল দেখার অধিকার জনগণের নেই। একই ভাবে জনগণের কল্যাণের জন্য ট্রাস্ট তৈরি হলেও তার পরিচালকদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক নেই। আবার এই ট্রাস্টের অছি হলেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্যরা। কিন্তু কিছুতেই জানা যাচ্ছে না যে মন্ত্রীসভার সদস্যরা কোন যোগ্যতায় ট্রাস্টের মধ্যে রয়েছেন– ব্যক্তিগত পরিচয়ে, নাকি মন্ত্রী পদমর্যাদায়! একই ভাবে এই প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক যে সরকারি মন্ত্রীদের নিয়ে একটি পাবলিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট তৈরির সিদ্ধান্ত কখন কীভাবে নেওয়া হল? এখানে আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাহলে এই ট্রাস্ট চরিত্রগত ভাবে কী? অনেকে ব্যঙ্গ করে এই ট্রাস্টকে 'Political Public Charitable Trust' আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ট্রাস্টের ধরন নিয়ে ধোঁয়াশা এখন‌ও বর্তমান।

চতুর্থত, এই ফান্ড যুক্তরাষ্ট্রের ধারণারও বিরোধিতা করছে। ফান্ডের ঘোষণায় বলা হয়েছে, এখানে টাকা দিলে তা 'কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি' (সিএসআর) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। ২০১৩ সালের আইন অনুসারে কর্পোরেট সংস্থাগুলো তাদের মুনাফার গড়পড়তা ২ শতাংশ সামাজিক দায়বদ্ধতায় ব্যয় করবে। সে সময় এ কথা স্থির হয়েছিল যে সরকারি কোন‌ও প্রকল্পে টাকা দেওয়াকে সিএসআর বলা যাবে না। এবার দেখা গেল, কর্পোরেটরা কোভিডে রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কোন‌ও টাকা দিচ্ছে না, কারণ তাতে কোনও সিএসআর ছাড় পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের আবেদন নিবেদনে কোনও লাভ হয়নি। অথচ কর্পোরেটরা সিএসআর'এ ছাড় পাবে বলে পিএম-কেয়ার্সে অনুদান দিচ্ছে। ফলে, রাজ্যগুলির ত্রাণ তহবিলে সেভাবে কোম্পানিগুলির টাকা জমা পড়ছে না। একই সঙ্গে সংসদীয় রীতিনীতিও এই ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়ায় লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। কারণ, প্রধান বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এই ব্যাপারে কোনও আলোচনা করা হয়নি এবং ট্রাস্টি বোর্ডে বিরোধী পক্ষের কোন‌ও সদস্য স্থান পাননি।

পঞ্চমত, আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যেহেতু এটা একটা ট্রাস্ট তাই সাধারণ ভাবে কে কত টাকা দিচ্ছে, কত টাকা উঠছে, কীভাবে সে টাকা খরচ হবে সে সম্পর্কে জনগণের প্রশ্ন বা দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ২৮ মার্চ বিকেল ৪-৫১ মিনিটে প্রথম ফান্ড তৈরির কথা ঘোষণা করেন। ১৮ মিনিটের মধ্যে (৫টা-০৯ মিনিট) আইএএস অ্যাসোসিয়েশন ২১ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ৫-১৮ মিনিটে চিত্রতারকা অক্ষয়কুমার ২৫ কোটি টাকা ফান্ডে জমা দেন। ৫-৩৪ মিনিটে ফোন-পে এই ফান্ডে টাকা জমা দেবার জন্য একটা লিঙ্ক প্রকাশ করে। ওয়াকিবহাল সূত্রের খবর, প্রথম সপ্তাহে ৬৫০০ কোটি টাকা সংগৃহীত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত খরচের ব্যাপারে ফান্ডের নীতি কী সে সম্পর্কে কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন ৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে নিরুপদ্রবে বাড়ি পৌঁছে দিতে এই টাকাটা কাজে লাগানো যেতে পারত (শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন বা বাসের খরচ)। কিন্তু তার বদলে রেল দফতর টিকিট বাবদ টাকা হয় শ্রমিক নয় রাজ্য সরকারগুলোর কাছ থেকে আদায় করেছে। আর‌ও আশ্চর্যের ব্যাপার, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তাতে বলা হয়েছে ভেন্টিলেটর কেনার জন্য ২০০০ কোটি টাকা এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ১০০০ কোটি টাকা খরচ হবে পিএম-কেয়ার্স থেকে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠছে, জনগণ ও কর্পোরেটদের দানের টাকা সরকারি প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত হয় কী করে!

ষষ্ঠত, পিএম-কেয়ার্স সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তির কারণ হল তার হিসাব পরীক্ষার পদ্ধতি। যতই চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হিসাবে প্রচার করা হোক না কেন, এই ফান্ডের শরীরে সরকারি ছাপ দৃঢ় ভাবে বসে গিয়েছে। এই ফান্ডের বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রী ও অশোকস্তম্ভের ছবি আছে। প্রধানমন্ত্রীর নামের সঙ্গে সম্পর্কিত তিনটি ফান্ডের মধ্যে এটা একটা; বাকি দুটো হল প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল ও ন্যাশনাল ডিফেন্স ফান্ড। এই ফান্ডে টাকা দিলে ৮০জি অনুসারে আয়করের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়। FCRA (Foreign Contribution Regulation Act) অনুসারে এই ফান্ডে বিদেশি অনুদান নেওয়ার অনুমতি রয়েছে। তাই স্বচ্ছতার স্বার্থে ক্যাগকে দিয়ে এই ফান্ডের হিসাবনিকেশ পরীক্ষা করানো উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে দিল্লির চার্টাড অ্যাকাউনটেন্সি ফার্ম SARC & Associates'কে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলত, পিএম-কেয়ার্স নিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের আপত্তি থেকেই যাচ্ছে।

শেষ বিচারে, এই সার্বিক বিপন্নতার সময় পিএম-কেয়ার্স নিয়ে বিতর্ক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ধারণাকে আঘাত করল এবং এর দায় নিশ্চিত ভাবে বর্তায় ফান্ডের পরিচালকমণ্ডলীর উপর।

No comments:

Post a Comment