Wednesday 23 August 2017

প্রসঙ্গ তিন তালাক

কিছু উষ্মা কিছু প্রশ্ন
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

তালাক-ই-বিদ্দাতকে শীর্ষ আদালত অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করেছে। চোখের পলকে তিন তালাক উচ্চারণ করে যে কোনও বিবাহিত মুসলমান মহিলাকে ঘরছাড়া করার প্রায় ১৪০০ বছরের রীতি এই রায়ে নিকেশ হল। সারা দেশ জুড়ে এই প্রথার বিরুদ্ধে যেভাবে মুসলমান মহিলারা গর্জে উঠেছেন ও সুপ্রিম কোর্টে যারা মামলা চালিয়েছেন শত হুমকি, ধমকানি ও চোখ রাঙানি এড়িয়ে, তা দেশবাসী মনে রাখবে। গত শতকের ৮০'র দশকে শাহবানু কিছুটা এমন ধরনেরই এক মামলা চালিয়ে শীর্ষ আদালতে জিতলেও, তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নির্মম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও 'ধর্ম নিরপেক্ষতার' জোরে সংসদে নতুন আইন পাশ করে রাষ্ট্র অসহায় এক নারীর বিরুদ্ধে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখায়। তারপরেই বাবরি মসজিদের তালা খোলা আর কার হাত ধরে ধর্মীয় বিভাজনের কোন উদ্দেশ্যে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাও আবার এক তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ পার্টির তরফে, তা আজ অবশ্য অনেকের কাছেই পরিষ্কার। ধর্ম নিয়ে কংগ্রেসের ছলচাতুরীও আজ ধরা পড়ে গেছে এবং এখন তাদের অবস্থা হয়েছে ধ্বংসস্তূপের মতো। ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ যে সব ধর্মকে তা দেওয়া নয়, বরং ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে দূরে রাখা - এই প্রতিপাদ্যটিকেই কৌশল করে এতদিন আড়াল করা ছিল। যারা ধর্মীয় রাজনীতি করে তারা তো ধর্মের নামেই তাদের এজেন্ডা ঠিক করবে, তারা চিহ্নিত, কিন্তু যারা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করে তাদের ধর্মীয় রাজনীতিটা আরও গোলমেলে।

দেশের স্বাধীনতার পর পরই প্রস্তাব উঠেছিল ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি নীতি চালু কর। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বলেছিলেন, এখনও উপযুক্ত সময় আসেনি। অর্থাৎ, তিনি এই ধরনের নীতির বিরোধী ছিলেন না, দাঙ্গাদীর্ণ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের আস্থা ফেরাতে তিনি তাদের ধর্মীয় আইনগুলিতে তখুনি হস্তক্ষেপ করতে চাননি, আরও কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। তা মানা যায়। কিন্তু ৭০ বছর পরেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার ব্যাপারে যদি কারও আপত্তি থাকে তাহলে বুঝতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষতা নয়, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মকে তা' দেওয়া হচ্ছে। ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অনুশীলনের জায়গায়। তার সঙ্গে দেওয়ানি অভিন্ন বিধি থাকলে সমস্যা কোথায়? ফৌজদারি বিধির ক্ষেত্রে তো আছে! কোনও ধর্মই একমাত্রিক বা একবগগা নয় যে তার মধ্যে কোনও মতান্তর বা ভিন্ন ধারার স্থান নেই। কীভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে অভিন্ন বিধির ব্যাপারে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে একমত একসুর বাজে? যেমন, ভোপালের প্রাচীন শরিয়তি আদালত দার-উল-কাজা দীর্ঘদিন ধরেই তালাক-ই-বিদ্দাতকে মান্যতা দেয়নি। পরন্তু, তারা 'খুলা' প্রথা বজায় রেখেছে যেখানে মহিলারা ডিভোর্স চাইতে পারেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও তালাক-ই-বিদ্দাতকে মানা হয় না। এমত বহু ধারা ও প্রথা একেক জায়গায় একেকরকম ভাবে বহমান অথচ স্বঘোষিত ধর্ম নিরপেক্ষবাদীরা একটি একমাত্রিক, হোমোজেনাস ধর্মীয় গোষ্ঠীর কল্পনা করে নিয়ে কিছু ধর্মীয় মাতব্বরদের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে পরিস্থিতিকে বিষাক্ত করেছেন। এই কাজ উগ্র ধর্মীয় কারবারীদের আরও মদত যুগিয়েছে।

আম্বেদকার গণ পরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি গ্রহণ করার জন্য মত দিয়েছিলেন। তা যখন গ্রহণ হল না তখন তিনি সংবিধানের ৪৪ ধারায় নির্দেশক নীতিতে অভিন্ন দেওয়ানি নীতি গ্রহণ করার প্রস্তাবকে সঙ্কল্প হিসেবে রাখলেন। কোনও ধর্মীয় বা জাতি গোষ্ঠীকেই ভেড়ার পাল হিসেবে ভাবার কারণ নেই যে তাদের মাতব্বররা যা বলবে সেটাই তারা অন্ধের মতো অনুসরণ করবে। এই ভাবনা তথাকথিত আধুনিকতার জনকদের, যারা 'অপর'কে এইরকম ভেড়ার পাল হিসেবে দেখে বলেই, তাদের মাতব্বরদের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতির ফায়দা লোটে। আশ্চর্য লাগছে, যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের এক ব্যাপক সংখ্যক মানুষ, বিশেষত মহিলারা, দু হাত তুলে শীর্ষ আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন তখন এ রাজ্যের শাসক দল এক অদ্ভুত নীরবতা অবলম্বন করে সন্দেহজনক অবস্থান নিয়েছে। উপরন্তু, তাদেরই এক মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী তিন তালাকের পক্ষে মত দিয়ে ও শীর্ষ আদালতের রায়কে সমালোচনা করে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। এইসব বার্তা ধর্মীয় বাতাবরণকে আরও বিষাক্ত করে তুলছে। কারা আসলে প্রকারান্তরে বিজেপি'র অবস্থানকে শক্তিশালী করছেন একটু ভাবতে পারেন। খেয়াল রাখা উচিত, উওরপ্রদেশের নির্বাচনে এই তিন তালাকের প্রশ্নটিকে ধরেই বিজেপি কিন্তু বহু মুসলমান মহিলাদের ভোট অর্জন করেছেন। তাই ভাবার কোনও কারণ নেই যে কিছু ধর্মীয় মুসলমান নেতা কী বললেন সেটাই সমগ্র মুসলমান সমাজের বক্তব্য।এমনটা হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই সর্বতোভাবে, ধর্মকে রাজনৈতিক অনুশীলন থেকে দূরে না রাখলে রাজনৈতিক দলগুলির বিপদ আরও বাড়বে। সে যে দলই হোক না কেন! আজ যার সুদিন তার দুর্দিন আসতে ক'দিন? অন্ততপক্ষে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত যেখানে যথেষ্ট!

No comments:

Post a Comment