Monday 12 October 2015

কলকাতার উদ্বাস্তু অঞ্চল



শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র উদ্বাস্তু অঞ্চল
অভিজিৎ রায় 

গোটা ইউরোপ জুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যা কয়েকদিন আগে ফ্রন্ট পেজ নিউজ ছিল। প্রবেশাধিকার থেকে শুরু করে বাসস্থান, খাদ্য-সংকট বৃহৎ আকারে দেখা যায়। এই উদ্বাস্তু সমস্যা আজ যেমন গোটা ইউরোপকে নাস্তানাবুদ করেছে, কিছুটা আগে হলেও আমাদের দেশও ভুক্তভোগী।
ইউরোপে জার্মানি উদ্বাস্তুদের প্রবেশাধিকার দিয়েছে, তাই বাসস্থানের সমস্যা মেটাতে রাতারাতি গড়ে তুলতে হয়েছে অস্থায়ী বাড়ি, পার্কগুলিতে শিবির করে ভিনদেশীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এত গেল ২০১৫ সালের ইউরোপের কথা, ১৯৪৭-এর ভারতে উদ্বাস্তুদের নিয়ে নানা সংকট-সমস্যা ইতিহাসের পাতায় বর্ণিত আছে।
আমাদের শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক উদ্বাস্তু কলোনি১৯৪৭’এর দেশভাগের পর গড়ে ওঠে আদর্শনগর কলোনি, রুবি মোড় থেকে মিনিট ৩০ পথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় এই অঞ্চলে। যাওয়ার পথে দু’ ধারে ফাঁকা জমিতে সদ্য মাথা উচিঁয়ে উঠেছে একের পর এক ইমারত। আদর্শনগর বাজারের অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছে রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে গেলেই ১৯৮৩ সালে এ রাজ্যের বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে ‘সুস্থ পুনর্বাসন’প্রাপ্ত পরিবারগুলির বাস। সরকারি খাতায় অঞ্চলটির নাম LOP 67, Panchanna gram g.s scheme E block, মৌজা নোনাডাঙ্গা। ১৯৪৭’র দেশভাগের পরে ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করা হয়
সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সরকারি ‘খাস’ জমিতে দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সুস্থ পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পুনর্বাসন দেওয়ার ক্ষেএে সরকারি খাস জমি ব্যবহার হয়েছিল। তদুপরি বিভিন্ন ব্যক্তিগত মালিকানার জমি সরকার ক্রয় করে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করেL.D.P Act, 1948/ L.A act I, 1894 অনুযায়ী ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ক্যাম্পভুক্ত শরণার্থীদের স্বোপার্জিত জমিতে প্রায় দশ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। প্রতি পরিবারের জমির পরিমাণ ছিল প্রায় দুই কাঠা করে। প্রথমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আদর্শনগর কলোনি বছরখানেকের মধ্যেই কলকাতা কর্পোরেশনের ওয়ার্ড ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় বর্তমানে অঞ্চলটি কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৮ নং ওয়ার্ড, বোরো ১২ আওতায় পড়ে
আদর্শনগর আগে ধান চাষের জমি হিসেবে ব্যবহৃত হত। সদ্য ধান কেটে নিয়ে যাওয়া জমির উপর শরণার্থীদের জন্য বাসস্থান গড়ে ওঠেএই বাসস্থান তৈরির কাজে সরকারি সহায়তা মিললেও তা অপর্যাপ্ত ছিল। নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ, ত্রিপল, তাদের হাতে দেওয়া হলেও অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯,০০০ টাকা। কিন্তু সেই অর্থ থেকে আবার জমির দাম বাবদ ২১৬৭.৬৭ পয়সা ও এিপলের দাম বাবদ ১৪৭ টাকা কেটে নেওয়া হয়।               
ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে তুলেছেন এই কলোনির মানুষগুলো। সময়ের সাথে উদ্বাস্তু তকমা ঝেড়ে নিজেদের পালটে ফেলেছেন। এই মানুষগুলোকে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেও ছাড়েনি রাজনৈতিক দলগুলি। পশ্চিমবঙ্গের কলোনিগুলিতে বসবাসকারি পরিবারগুলিকে জমির ‘দলিল’ প্রদানের জন্য তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় পার্লামেন্টে দাবি জানাতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে সেই দাবি মঞ্জুর হয় এবং তাদের হাতে নিঃশর্তে দলিল তুলে দেওয়ার কথা সরকারিভাবে ঘোষিত হয় ১৯৮৯ সালে জমি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৯৯ বছরের লিজে্র পরিবর্তে স্থায়ীভাবে জমির মালিকানা দেওয়া হয়।
সাবেক আদর্শনগর আজ অনেকটাই পরিণত। এখানকার মানুষগুলোর ভিতর ভিটেমাটি হারানোর খেদ নয়া জমানার হাওয়ায় অনেকখানি কমেছে। চারিধারের গগনচুম্বী ইমারত অঞ্চলের চিএপটটাই বদলে দিয়েছে। সমাজে প্রায় প্রান্তিক হয়ে যাওয়া মানুষগুলো নতুন সমাজর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এখন তাঁরা নিজেদের ভারতীয় বলেই মনে করেন। সুযোগ পেলে বাংলাদেশে ফিরবেন কিনা প্রশ্ন করায় জনৈক ব্যক্তির সহাস্য জবাব, ‘এ দেশেই জন্ম, আমি ভারতীয়, এ দেশ ছেড়ে যাব কোথায়?’  

No comments:

Post a Comment