Monday 6 July 2015

গ্রিস বলছে 'না'



গ্রিসের 'না' আমাদের আশা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
 
অবশেষে গ্রিসে ৬১.৩ শতাংশ মানুষ ‘না’ বলেছেন। এ এক ঐতিহাসিক রায়। গ্রিস ও ইউরোপ জুড়ে যা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে নিঃসন্দেহে। গ্রিস এখন ইউরোজোনে থাকবে না বেরিয়ে যাবে, কীভাবেই বা অর্থনৈতিক সংকটকে কাটিয়ে উঠবে, বেকারত্বের সমস্যাকে কীভাবে মোকাবিলা করবে – সবই এখন নির্ভর করছে সে দেশের মানুষ ও বাম্পন্থী সরকারের উপর। তবে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা বিশ্ব ব্যাংক জাতীয় সংস্থাগুলির মুখে যে গ্রিস ঝামা ঘষে দিতে পেরেছে, তাই এখন অনেক। একেবারে মহাজনী প্রথায়, ‘উন্নয়ন’এর কিছু গৎ বাঁধা নিদান দিয়ে একেকটি দেশের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে তারপর সেই টাকা কর্পোরেট’দের কোলে পাচার করে সাধারণ মানুষের পেটে গামছা বেঁধে টাকা আদায়ের যে পুরনো খেলা এইসব অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি চালিয়ে এসেছে, তা এবার সপাটে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে গণভোটে। সারা পৃথিবীর কাছে এটা এখন দৃষ্টান্ত এবং এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনও দেশের শাসকেরা আর সাহস করবে না তথাকথিত কৃচ্ছ্রসাধনের কথা পাড়তে।

সাধারণ মানুষকে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলে কর্পোরেট সংস্থাগুলির ফুলেফেঁপে ওঠা – এই রাজনীতিই এতদিন চালানো হয়েছে উন্নয়নের নাম করে। এর রাজনৈতিক অর্থনীতিটা অনেক গভীরে। বহুজাতিক কর্পোরেটের শুধু বাজার হলেই চলে না, তার চাই সস্তা শ্রম ও পরিকাঠামো। যেমন ভারতে, তার বাজার দরকার, সঙ্গে সস্তা শ্রমও। সবাই কর্পোরেট পণ্যের ক্রেতা হয়ে উঠলে সস্তায় শ্রম মিলবে না। আবার সবাইকে সস্তায় পাওয়া গেলে ক্রেতা তৈরি হবে না। তাই, একইসঙ্গে তার দরকার - একদিকে একটা পণ্যের বাজার আর অন্যদিকে সস্তা শ্রমের বাজার। দুটোই পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে কিন্তু তাদের বর্গ দুটি মৌলিক ভাবে ভিন্ন।

ভারতে যেমন ২৫ থেকে ৩০ কোটি ক্রেতা বাজারের ওপরেই কর্পোরেটরা নির্ভর করে আছে। বাকী ৯০ থেকে ৯৫ কোটি মানুষ সস্তার শ্রমিক বা বেকার। এই সবটাই তার দরকার – অর্থাৎ একটা স্থায়ী বৈষম্যের অর্থনীতি না হলে তার পক্ষে টিকে থাকাটা মুশকিল। সস্তার শ্রম বাজার তাকে কম খরচে ও অধিক মুনাফায় পণ্য তৈরি করে দেবে যা ক্রেতা বাজারে বিক্রি হয়ে তার ঘরে জমা পড়বে। এই সস্তার শ্রমের বাজারের কোনও মুক্তি নেই – ৯০ কোটি সস্তা শ্রম না থাকলে ৩০ কোটি ক্রেতা থাকবে না। এই বিভাজনের অর্থনীতিটাকে মাথায় রেখেই নীতিকারকেরা অগ্রসর হন।

আর এই মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে ও তা আরও বাড়িয়ে তুলতে তার দরকার ‘পরিকাঠামো’, মানে, সস্তায় জমি, জল, বিদ্যুৎ, রাস্তা। এই পরিকাঠামোয় অনেক বিনিয়োগ লাগে এবং তার সুরাহার জন্য পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থাগুলি প্রভূত পরিমাণে অর্থের সংস্থান নিয়ে। সেই অর্থ তারা দেশের সরকারের হাতে তুলে দেয় ঋণ হিসেবে যা আবার চলে যায় বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির খপ্পরে, এইসব পরিকাঠামো তৈরির কাজের বরাত হিসেবে। তারপর ঋণ পরিশোধের যখন সময় আসে তখন সরকারগুলির ওপর আদায়ের চাপ দেওয়া হয়। সরকার তার দায় চাপায় সাধারণ মানুষের ওপর – মজুরি ও পেনশন হ্রাস, জনপ্রকল্পগুলোয় বরাদ্দ ছাঁটাই, কর বৃদ্ধি, সরকারের হাতে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি। আদপে, মুল চাপটা গিয়ে পড়ে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরে, মানুষ সর্বস্বান্ত হয়।

এই সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বারেবারে মানুষ পথে নেমেছেন, চীৎকার করেছেন। গত দশকে এ রাজ্যেও এমনতর কর্পোরেট বেয়ারাপনাকে মানুষ অনেকটাই রুখে দিতে পেরেছেন। গ্রিসের গণভোটের রায় এই চলমান আন্দোলনকে আরও এক দফা অক্সিজেন দিল।       
   

No comments:

Post a Comment