Thursday 2 July 2015

গ্রিস কী করবে?

গ্রিস 'না' বলুক
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



এমন তো নয় যে এই প্রথম কোনও দেশ ঋণের দায়ে দেউলিয়া হল। গ্রিসের ঘটনার তাৎপর্য হল, এই প্রথম কোনও তথাকথিত ‘উন্নত’ বা ‘শিল্পোন্নত’ দেশ এমনতর অবস্থায় পড়ল। সামনে দুটো পথ খোলা – এক, আইএমএফ’এর ১.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ থেকে আপাত মুক্তি পেতে গেলে কিছু ভয়ঙ্কর শর্তাবলীতে সম্মত হতে হবে; নয়তো, দুই, দেশের জনগণ ঋণ করেননি, সে বোঝা তাঁরা নেবেন না, তাই ঋণ পরিশোধ করা যাবে না, এমনতর কোনও অবস্থানে থিতু হতে হবে। এই দ্বিতীয় অবস্থানটির তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তাই, সকলের দৃষ্টি এখন গ্রিসের দিকে। প্রধানমন্ত্রী তিপ্রাস ৫ জুলাই গণভোটের ডাক দিয়েছেন – গ্রিসের মানুষ কোন পথে এগোতে চাইছেন তা তাঁরা নিজেরাই ঠিক করবেন। এইরকম এক পরিস্থিতি আইসল্যান্ড’এর সামনে এসেছিল – সেখানে গণভোটে মানুষ ‘না’ জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ, ঋণের দায় আমাদের নয়, ঋণ পরিশোধের অজুহাতে আমরা নিজেদের উৎসর্গ করতে পারব না।
সারা পৃথিবী জুড়ে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জাতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্যই হল বিকাশের নাম করে বিভিন্ন দেশগুলিকে যথেচ্ছ ঋণ গছানো এবং সেই ঋণ পরিশোধের প্রস্তুতির নামে এক গুচ্ছ নিদান সাব্যস্ত করা। বিশাল বিশাল পরিকাঠামো গড়ে তোলার নাম করে এইসব ঋণ গছানো হয়, দেশে তো বটেই এমনকি বিদেশ থেকেও আমদানিকৃত কিছু সুবেশী দালাল সুবিশাল পুঁজি বিনিয়োগে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি এঁকে নেমে পড়ে বৃহৎ মিডিয়া পুষ্ট প্রচারের আঙ্গিনায়, কিনে ফেলা হয় তাবড় রাজনৈতিক নেতা ও নীতিনির্ধারকদের। এই ঋণের টাকাগুলো কোথায় যায়? যে সব কোম্পানি ওইসব বড় বিনিয়োগের বরাত পায়, তাদের ঘরে। এইভাবে ঋণের যে টাকাটা একটি দেশের প্রাপ্তি হল তা টেন্ডার মারফত বা ক্রয় বাবদ সরকারের ঘর থেকে চলে গেল কর্পোরেটের ঘরে। অর্থাৎ, দেশের নামে ধার করা টাকা চলে যাচ্ছে বড় কর্পোরেটের ঘরে আর ঋণ পরিশোধ করছে দেশের সরকার সাধারণ মানুষের পকেট কেটে। সরকারের ঋণ পরিশোধের উপায়? যেমন, অহরহ মন্ত্রী ও কর্পোরেট মিডিয়ার তরফ থেকে শোনা যায়, সরকারি ব্যয় সংকোচন করতে হবে, জনমুখি প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দিতে হবে, সুদের হার কমাতে হবে, পেনশনকে বাজারজাত করতে হবে, ‘ক্ষতি’তে চলা সরকারি উদ্যোগগুলো বিক্রি করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এইভাবে মানুষের প্রাপ্ত অধিকারকে কাটছাঁট করে সরকারের ঘরে যে টাকাটা জমা করা যাবে, তা দিয়ে শোধ হবে ঋণ। আর সে ঋণ কখনও শোধ হয় না, চক্রাকারে ঘুরতে ও বাড়তে থাকে। কেউ কেউ একে বলেন ‘কর্পোরেটক্রেসি’।
আজকাল কেউ কেউ বলছেন, শেষ বিচারে অর্থনীতির কোন পথ অনুসৃত হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব জনগণের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। গ্রিস হয়তো সে পথেই এগোচ্ছে। কোনও সরকারই ঋণ নেওয়ার আগে দেশের মানুষের মতামত নেয় না। তবে তার পরিশোধের দায়িত্ব কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্য দিয়ে কেন দেশের মানুষ নেবেন? গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে আইএমএফ’এর সঙ্গে দর কষাকষির কথা ভেবেছিলেন। এখন তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, জনগণ সিদ্ধান্ত নিক। উপরন্তু, তিনি ‘না’ ভোটের জন্য জনগণের কাছে আপিল রেখেছেন। ‘উন্নয়ন’এর নামে জোরজবরদস্তি ঋণ দেওয়া, তারপর ঋণের টাকা কর্পোরেটের হাতে পাচার - না হলে বন্ধ হওয়ার নয়। গ্রিসের দিকে সারা বিশ্ব তাই এখন তাকিয়ে আছে।     

No comments:

Post a Comment