অসংখ্য প্রশ্নের মুখে বাংলাদেশ
শাহেদ শুভো
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন আমার পাড়ার পুরনো চার্চে বড়দিনের আয়োজন চলছে। মানুষের কোলাহল, শিশুদের আনন্দময় পদচারণা— এই গভীর রাতেও। তাই লেখার শুরুতেই সকলকে জানাই 'শুভ বড়দিন'।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে 'জুলাই অভ্যুত্থান' পরবর্তী সময় নিয়ে আমি একাধিক লেখা লিখেছি। চেষ্টা করেছি পাঠকের সামনে একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ হাজির করতে। এই আলাপ এখান থেকে শুরু করছি একটি কারণেই— বাংলাদেশ আজ অসংখ্য যদি-কিন্তু প্রশ্নের মধ্যে আটকে গেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে তবেই হয়তো আমরা একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশে পৌঁছতে পারব।
জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে মানুষের একটি বড় অংশের আকাঙ্ক্ষা ছিল— গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় অভ্যস্ত এবং ন্যায়ের ওপর দাঁড়ানো একটি সমাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি সেই বাংলাদেশ পেয়েছি? এই প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের জনপরিসরে প্রবলভাবে উপস্থিত।
এই লেখা লিখছি এমন এক সময়, যার কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে একের পর এক প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যম তথাকথিত 'মব ভায়োলেন্স'-এর শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা 'প্রথম আলো' ও 'ডেইলি স্টার'-এর অফিসে হামলা, ইংরেজি দৈনিক 'নিউ এজ'-এর সম্পাদক নুরুল কবীর'কে (সম্পাদক পরিষদের নেতা) প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা, 'উদীচী' ও 'ছায়ানট'এর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেওয়া— এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত আক্রমণের অংশ। তথাকথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুড়িয়ে হত্যা করা হল শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাশকে। ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরের ভেতর আগুনে পুড়িয়ে মারা হল বিএনপি কর্মীর শিশু কন্যা রাফিয়াকে। বাংলাদেশ আজ ভয় ও আতঙ্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তবু, এই অন্ধকারের মধ্যেই মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন পরিসরে এই নারকীয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। গতকাল (২৩ ডিসেম্বর) 'ছায়ানট'এর উদ্যোগে প্রতিবাদ ও সংহতির সঙ্গীতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল সহ প্রতিবাদী বাংলা গান গেয়েছেন। এই আয়োজনে যুক্ত হয়েছিলেন ব্যান্ড মিউজিশিয়ান, র্যাপার ও হিপহপ শিল্পীরাও।
এই দৃশ্য দেখে পুরনো এক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। ৯০'এর দশকে আমাদের প্রখ্যাত ব্যান্ড মিউজিশিয়ান মাকসুদুল হক রবীন্দ্রনাথের 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়' গানটি আধুনিক জ্যাজ অনুষঙ্গে গেয়েছিলেন। দেশ জুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। সেই বিতর্কের একদিকে ছিলেন মাকসুদ ভাই, অন্যদিকে 'ছায়ানট'এর প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক ওয়াহিদুল হক। পাল্টাপাল্টি লেখা, আলোচনা নিয়মিত পত্রিকায় ছাপা হত, আমরা সেগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। এই স্মৃতিটি টানলাম একটি কারণে। এই মতবিরোধ ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও বহুত্ববাদী। তখন পরমতসহিষ্ণুতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে চিৎকার করে বলার প্রয়োজন পড়েনি। এই বৈচিত্র্য ও বিতর্কের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নাস্তিক ঘোষণার মাধ্যমে ব্লগারদের হত্যাযোগ্য ঘোষণা দেওয়া হয়। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাজীব হায়দার, অনন্ত বিজয় দাস, অভিজিৎ রায়। এরও আগে আক্রান্ত হন লেখক হুমায়ুন আজাদ।
৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে 'শাহবাগ' শব্দটি ইসলামপন্থীদের চোখে যেন নিষিদ্ধ শয়তানের নাম। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের লক্ষ্য— শাহবাগী, বাম, ভিন্নমতালম্বী চিন্তাধারার মানুষ, সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ও স্বাধীন মিডিয়া। এই ঘৃণা এতটাই গভীর যে তারা প্রকাশ্যে এসব মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে হত্যাযোগ্য করার বাসনা প্রকাশ করছে। তাদের একটি সংগঠিত অনলাইন বাহিনী আছে: 'বটবাহিনী'। আওয়ামী লীগের সময় যেমন ‘সিপিগ্যাং’ বিরুদ্ধচারীদের জঙ্গি, জামাত বা পাকিস্তানের দালাল বানাত, আজ একই কৌশলে এই 'বটবাহিনী' তাদের প্রতিপক্ষকে বানাচ্ছে নাস্তিক, শাহবাগী, বাম, ভারতের দালাল। দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি'ও আজ তাদের অনলাইন আক্রমণের শিকার। মিথ্যা প্রচারণার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী এখন তারাই। অথচ জুলাইয়ের উত্তাপে যখন কয়েকটি টিভি চ্যানেলে হামলা হল, ফ্যাসিবাদের দোসর ঘোষণায় আক্রমণ চলল, তখন অনেকেই নীরব ছিলেন।
'প্রথম আলো' ও 'ডেইলি স্টার'এ হামলার পর বিএনপি'র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের ওপর আঘাত। নুরুল কবীরের ভাষায়, এই হামলাকারীরা মধ্যযুগীয় কায়দায় সাংবাদিকদের পুড়িয়ে মারার ইচ্ছা নিয়ে এসেছিল। প্রশ্ন হল, কেন?
'ইনকিলাব মঞ্চ'এর ওসমান হাদীর ওপর নৃশংস হামলা ও পরবর্তী বিয়োগান্তিক ঘটনার পর একদল অনুসারী— যাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের নেতা— উস্কানি দিতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও প্যারিসে থাকা দুই তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার উদীচী, ছায়ানট, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে আক্রমণের ডাক দেয়। যুক্তি, ওসমান হাদীর তথাকথিত ঘাতক নাকি ভারতে, তাই এইসব প্রতিষ্ঠান ভারতের 'সফট পাওয়ার'! কেউ প্রশ্ন করল না, হাদীর হত্যাকাণ্ডে সরকারের ভূমিকা কী? ঘাতক কীভাবে পালাল, কার সহায়তায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার বদলে প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করা হল। কারণ খুব স্পষ্ট, তাদের কল্পিত বাংলাদেশের পথে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাধা।
পোস্ট-ট্রুথের যুগে একজন বাটন ফোন ব্যবহারকারী শ্রমিককে 'ধর্ম অবমাননাকারী' বানিয়ে হত্যা করা যায়। অথচ পরিবারের ভাষ্যে জানা যায়, কারখানার মালিক-শ্রমিক উৎপাদন দ্বন্দ্ব থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের নাটক সাজানো হয়েছিল। ভয়ঙ্কর সত্য হল, এই হত্যার আয়োজন করেছিল সেই কারখানার শ্রমিকরাই। ধর্মীয় পরিচয়বাদ আমাদের মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে ভয় উৎপাদনই রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কবিগানের বাহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে আবুল সরকারকে গ্রেফতার করা হয় 'ধর্ম অবমাননা'র অভিযোগে। আর যে সব আইনজীবীর তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কথা, তারাই আদালত প্রাঙ্গণে শ্লোগান দেয়— 'একটা বাউল ধর, ধরে ধরে জবাই কর।'
৫ তারিখ পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা এমন এক সমাজ দেখছি, যা আগে দেখিনি। জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনাশাহীর বিরুদ্ধে যে গান মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছিল, আজ সেই গান আর বাদ্যযন্ত্রই আক্রান্ত। ইউনুস সাহেবের 'মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড' রিসেট বাটনের কারিকুরি কী, জানি না। কিন্তু ছোট্ট আনাস, প্রিয়া— তারা কি এই ডিজাইনের বলি নয়? তাঁরা কোনও 'মেটিকুলাস ডিজাইন'এ শহীদ হয়নি, বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনের নিপীড়ণের বলি বাংলাদেশের মানুষ সেই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যখন জনগণের আকাঙ্ক্ষিত সংগ্রাম অন্যপক্ষ লুট করে নেয়, তখন সেখান থেকেই জন্ম নেয় নিও-ফ্যাসিজম। প্রশ্ন হল, সেই জনগণকে আবার কবে খুঁজে পাওয়া যাবে লড়াইয়ে?
বাংলাদেশের অসংখ্য প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বের আপাত উত্তর একটাই— একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু মানুষ কি তার কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে? পরমতসহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা কি সত্যিই পৌঁছতে পারব? এই প্রশ্নগুলোই রেখে গেলাম, ভবিষ্যতের উত্তরের অপেক্ষায়।





