মনের আর্তিই শিল্পীর চৈতন্য
অয়ন মুখোপাধ্যায়
ইতালির ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'এর নাম উচ্চারণ করলেই সিনেমাপ্রেমীদের চোখে অন্য আলো জ্বলে ওঠে। কারণ, এই উৎসব শুধু সিনেমা নয়, শিল্পের মর্যাদার প্রতীক। এখানে দাঁড়ানো মানে দুনিয়ার সিনেমার রাজপথে নাম লিখে দেওয়া। আর সেই মঞ্চেই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে পুরুলিয়ার মেয়ে অনুপূর্ণা রায় (মাত্র ৩১ বছর বয়সী) ইতিহাস লিখলেন। তাঁর প্রথম ছবি 'Songs of Forgotten Trees' Orizzonti সেরা পরিচালক পুরস্কার পেল। বাংলার এক প্রান্তিক জেলা থেকে উঠে আসা এক তরুণী, যে নিজেই নিজের ও সমাজের পূর্ব-ধারণার বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, তিনি আজ ভেনিসে দাঁড়িয়ে সারা দুনিয়ার সামনে বললেন নিজের মাটির কথা, বললেন প্যালেস্টাইনের যুদ্ধাহত শিশুদের কথা, আর বিশ্বশান্তির বার্তা ছড়ালেন।
মনে পড়বে, ১৯৫৭ সালে এই ভেনিসেই আরেক বাঙালি আদায় করেছিলেন সেরা ছবির ('অপরাজিত') পুরস্কার (Golden Lion)।
অনুপূর্ণা'র খবর যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোড়ন তুলছে, তখন এ দেশের বড় বড় বাংলা টিভি চ্যানেল বা পত্রিকার পাতায় সে আলো নেই। কারণ, আমাদের সংবাদব্যবস্থা এখন কর্পোরেট-বাণিজ্যের এক্সটেনশন। তাদের চোখে খবর মানে বাজারি গসিপ, ফটোশ্যুট আর বক্স অফিসের অঙ্ক। অনুপূর্ণা রায়ের মতো এক স্বাধীন পরিচালকের স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি তাদের কাছে বড্ডই 'বোরিং'। দেব'এর ছবির নায়িকা বদলানো, বিবেক অগ্নিহোত্রীর নতুন স্লোগান, কিংবা রঘু ডাকাত সিরিয়ালের খলনায়ক হওয়া— এসবই তাদের হেডলাইন। দিনে পঞ্চাশবার এইসব খবরের আপডেট চলে।
এ আসলে ভারতীয় চলচ্চিত্র রাজনীতিরই প্রতিচ্ছবি। আমাদের ছবির মেইনস্ট্রিম এতটাই কর্পোরেটাইজড যে, শিল্প সেখানে কেবল এক প্রোডাক্ট। বড় প্রযোজনা সংস্থা, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, বিজ্ঞাপনদাতা— সবাই মিলে ঠিক করে কোন সিনেমা চলবে, কোনটা চলবে না। সিনেমা তৈরি এখন প্রায় কর্পোরেট পণ্য লঞ্চের মতো। নায়ককে সুপার-হিরো ও গানকে টিকটক-রিল বানাতে হবে, আর মুক্তির আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডে তুলতে হবে। এখানে স্বাধীন ছবি নির্মাণের জায়গা কোথায়? পুরস্কার গ্রহণ-অনুষ্ঠান ভাষণে অনুপূর্ণাও তাই জানিয়েছেন, তাঁর ছবিটি নির্মাণে তিনি কোনও প্রযোজক পাননি, কারণ, সকলেরই অভিমত ছিল যে এই ছবি বক্স অফিস সাফল্য পাবে না।
অনুপূর্ণা'র ছবি, তাই, এই মূলধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এক প্রস্তাবনা। তাঁর ছবিতে কর্পোরেটের চকচকে স্পনসরশিপ নেই, নেই বাজারি কোনও ফর্মুলা। আছে প্রান্তিক অভিবাসী মহিলাদের জীবন, শহরের অন্ধকার কোণে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, আর নারীর স্মৃতি ও পারস্পরিক ভরসার গল্প। এই নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখালেন, ছবি মানে নিছক বিনোদন নয়; ছবি মানে সমাজের অন্দরমহলের কথা বলা। তাই তাঁর নির্মিতি ও স্বীকৃতি আসলে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, কর্পোরেট-চালিত ছবির মতাদর্শের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ।
Songs of Forgotten Trees ছবিটির মূল বিষয়বস্তুর কেন্দ্রে রয়েছে দুই পরিযায়ী মহিলার জীবন, যেখানে তারা একে অপরের সঙ্গে এক অপরিচিত পরিবেশে নিজেদের টিকে থাকার লড়াই ও একাকীত্বকে ভাগ করে নেয়। ছবিটি তল্লাশ করে মানবিক সম্পর্ক, বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও নারীত্বের গভীর দিকসমূহ। ছবিটির দুটি মাত্রা অতীব গুরুত্বপূর্ণ:
এক) অনুপূর্ণা ছবিটি তৈরি করেছেন লম্বা শটে; সে অর্থে, প্রতিটি sequence'এ 'কাট' খুবই কম। এটা হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত স্টাইল বা স্টেটমেন্ট;
দুই) ছবির দুই নারী চরিত্রের মধ্যে কথোপকথনের প্রায় সবটাই গৃহীত হয়েছে মুম্বই'এর একটি ঘুপচি বা জীর্ণ ফ্ল্যাটে যেখানে অনুপূর্ণা বসবাস করতেন তাঁর আইটি কর্মজীবনের সুবাদে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, পয়সার অভাবে এ ভাবে শ্যুটিং'এর খরচ বাঁচানো ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও উপায় ছিল না।
অসম সাহসী অনুপূর্ণা পুরস্কার নেওয়ার সময় বললেন, 'Every child deserves peace, freedom, liberation, and Palestine is no exception.'। এ দেশে যেখানে সামান্য সমালোচনার জন্যই শিল্পীরা ট্রোল্ড ও হয়রানির শিকার হন, সেখানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক ভারতীয় নারী প্যালেস্টাইনের যুদ্ধাহত শিশুদের কথা তুললেন। এবং তারপর এও বললেন, তাঁর দেশ হয়তো তাঁকে এ কথা বলার অনুমোদন দেবে না, কিন্তু তবুও তিনি বলবেন। এ শুধু রাজনৈতিক সাহস নয়, শিল্পের আসল উদ্দেশ্যকেও তুলে ধরা। কর্পোরেট বলিউড এই সাহস দেখাবে না, কারণ, তাদের লোক-ঠকানো বৃহৎ ব্যবসা চালাতে হয়। কিন্তু স্বাধীন পরিচালকদের সে দায় নেই। তাই তাঁরা ইতিহাসে জায়গা করে নেন।
অনুপূর্ণা রায়ের ভেনিস জয় আমাদের সামনে তিনটি বড় শিক্ষা রেখে গেল। প্রথমত, প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও বিশ্বমানের শিল্প তৈরি করা যায়। দ্বিতীয়ত, কর্পোরেট-চালিত মিডিয়া আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে রাখলেও সমকাল সত্যিকারের শিল্পীকেও চিনে নেয়। আর তৃতীয়ত, শিল্পের আসল উদ্দেশ্য চটকদারি নয়, মানুষের অন্তঃস্থলের কথা বলা।
কথা প্রসঙ্গে অনুপূর্ণা তাঁর হারিয়ে যাওয়া এক বাল্যবন্ধুর কথা বলেছেন। ঝুমা নাথ। বালিকাবেলায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। সে বেদনা এখনও তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তাঁকে তিনি এখনও খুঁজছেন। এই মানবিক অনুভূতিগুলিই চলচ্চিত্রের ভাষা ও বিষয় হয়ে ওঠে।
অনুপূর্ণা তাঁর কাজ দিয়ে আমাদের আরও সংবেদনশীল করে তুলুন। তাঁর পরের ছবির অপেক্ষায়।
মূল্যবান দলিল।
ReplyDeleteThanks
Deleteযথাযথ, সুন্দর সমালোচনা। অভিনন্দন অন্নপূর্ণা, সমালোচককেও অভিনন্দন জানাই।
ReplyDeleteখুব সুন্দরভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সমালোচক।ফিল্মের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচালক অনুপূর্ণার জীবনের জড়িয়ে পড়াটাও স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteচিত্র পরিচালক অনুপূর্ণা রায়কে স্যালুট জানাই। খুবই মনোগ্রাহী সমালোচনা। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteখুব সুন্দরভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সমালোচক।ফিল্মের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচালক অনুপূর্ণার জীবনের জড়িয়ে পড়াটাও স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।অনুপূর্ণাকে অফুরান শুভেচ্ছা অভিনন্দন 💐💯👌✌️🤝👏
ReplyDeleteঅনুপূর্ণার বক্তব্য এবং তাঁর আবেগ মর্মস্পর্শী।
ReplyDeleteআমাদের একটা গর্বের মুহূর্ত।
মেনস্ট্রীম মিডিয়া তো এরকমই কারণ তাদের অধিকাংশ ভোক্তারাই স্থুলরুচির।
- শ্রেয়া ঘোষ
মনের আর্তিই শিল্পীর চৈতন্য - খুউব দামী কথা লিখলেন লেখক। কুর্নিশ জানাই তাঁকে এমন সুন্দর ,বিস্তারিত আলোচনার জন্য। অনুপূর্ণার জন্য রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা।
ReplyDelete