এই দৃশ্যমালার মধ্যেই
লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এক পাঠ
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
নিজের ‘জীবনস্মৃতি’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “জীবনের প্রভাতে যে-সকল শহর এবং মাঠ, নদী এবং পাহাড়ের ভিতর দিয়া চলিতে হইয়াছে, অপরাহ্নে বিশ্রামশালায় প্রবেশের পূর্বে যখন তাহার দিকে ফিরিয়া তাকানো যায়, তখন আসন্ন দিবাবসানের আলোকে সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে।”
যথার্থই তা ছবি আঁকা, ‘ইতিহাস লেখা নয়’।
তখনও (গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশক) পাঠশালার গণিতের ক্লাসে দশমিক প্রথার চল হয়নি; শতকিয়া, কড়াকিয়া, গন্ডাকিয়া, বুড়িকিয়া ইত্যাদির পর সব শেষে নামতা অভ্যাস ও মুখস্থ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে “আমাদের কোনও উর্বরমস্তিষ্ক পূর্বসূরির সৃষ্ট এবং দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকা কুড়ির সংক্ষিপ্ত নামতা বলতে বলতে আমাদের সোল্লাস যাত্রা হত। ছয় ছত্রের সেই কৌতুকাবহ নামতার ছড়াটি ছিল এইরকম— ‘কুড়ি একে কুড়ি, কুড়ি দু-গুণে মুড়ি, তিন কুড়ি ছোলাভাজা, চার কুড়ি খেতে মজা, পাঁচ কুড়িতে শ, ছ-কুড়িতে নেচে নেচে ঘরের পথে চ।’ গৃহে অপেক্ষমান বৈকালিক জলযোগের ছোলামুড়ির সাদর আহ্বান আমাদের নৃত্যপর অবস্থায় গৃহপ্রত্যাবর্তনে প্রবুদ্ধ করত।” যে শান্ত ও অনাহত বাংলার অংশভাক সে অর্থে বাংলা সাহিত্যে তেমন কোনও চিত্তচাঞ্চল্যের উদ্রেক ঘটাতে পারেনি বলে যেন ইতিউতি আক্ষেপ বিশেষ শুনি, সেই রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে (পশ্চিম বর্ধমানের বালিজুড়ি) বেড়ে ওঠা এক বালক ও কিশোর তার ‘অপরাহ্নে বিশ্রামশালায়’ পৌঁছে এইভাবেই আমাদের সন্ধান দেন অজানা আকরের। আমরা ‘ইতিহাস’ পাই না বটে, কিন্তু এক অত্যাশ্চর্য ছবি আমাদের ইতিহাস-বোধে হানা দেয়। বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি: রাঢ়বাংলার একটি গ্রামের আত্মকথা’ পড়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আমার তেমনই মনে হল।
আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে অবিশ্রান্ত শব্দ-তালুকে আমাদের যাপন, যেখানে শব্দ-বাক্যের অনর্গল বিষাক্ত উদ্গীরণ ও জালি বয়ান নির্মাণে সকলেই শুধু স্বঘোষিত কবি, লেখক বা বিশ্লেষক নয়, হন্তারকও বটে, বইমেলায় অর্থহীন ঘোরাঘুরি শেষে খালি হাতেই বাড়ি ফিরি, সেখানে আচম্বিতে কখনও কখনও এমন দুর্লভ কিছু বই হাতে এসে পড়ে! আবডালে থাকা এক অসীমালোক যেন ধীরে ধীরে ধরা দেয়; যেন বলে, এইভাবে কি তুমি জানতে? এইভাবে কি কখনও দেখেছ?
অভিশপ্ত সেই ৪৩’এর মন্বন্তরের সময় বীরেন্দ্রকুমারের বয়স মাত্র দশ। কী সমাহিত ছত্রে তিনি বিধৃত করেছেন সে স্মৃতি: “ভালোবাসার অভাবে নয়, সম্ভবত অন্নের এবং অর্থের অভাবেই প্রায় বিনা চিকিৎসায় বাংলা ১৩৫০ সালের মাঘ মাসে (ইংরেজি ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারি) সরস্বতী পূজার ছ-দিন পরে ভৈমী একাদশী তিথিতে অপরাহ্ন বেলায় আমার মা চলে গেল তার সাধের সংসার আর ভবিষ্যতের সোনার স্বপ্নের মায়া ত্যাগ করে। একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষের জীর্ণ বিছানা ছিল মায়ের শেষশয্যা।” শুধু কি মা? “... মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোটোভাইটিও ক্রমশ শীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। মাতৃহীন এই অবোধ শিশুকে নিজের এই শীর্ণতার বোঝা মাত্র তিন দিন বইতে হয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর চতুর্থ দিনের ভোরে সে মায়ের কাছে চলে গেল। ... তিন মাস পরে বৈশাখের এক প্রত্যুষে মাতৃহীনা অনাদৃতা অবহেলিতা আমাদের ছোটোবোন লুদিও মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে মা-ভাইয়ের অনুগামিনী হল।” কিন্তু তবুও, জীবন কেন থমকে থাকবে! তা থাকে না, কিন্তু এক অন্তর্লীন বিষাদ কি রয়ে যায় না সারা জীবন? যদি বলি, এ বই রাঢ় বাংলার এক অনাস্বাদিত ছবি, সে বলা সম্পূর্ণ হয় না। এক গভীর বিষণ্ণতাও যেন ছেয়ে থাকে এর পল-অনুপলে। আসলে, বিষাদ ছাড়া তো ইতিহাসের পাঠ অসম্পূর্ণ! ছবিও কি তাই?
পঞ্চাশ পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে বসেছিলেন, কিন্তু জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরের আশেপাশেই সে স্মৃতি ছিল আবদ্ধ। বীরেন্দ্রকুমার সম্ভবত ষাটের মধ্যবর্তীতে এসে ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’ লিখতে শুরু করেন, কিন্তু তিনিও ওই নিজের কুড়ি বছরের ধারেকাছেই এর ইতি টেনেছেন। মনে হয়, যৌবনের প্রারম্ভে পৌঁছে আত্মকথার ইতি হয়। সমাজের বহমান স্রোতে মিশে গেলে আলাদা করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া কিছুটা দুষ্কর। আর স্মৃতির কোটায় বাল্য ও কৈশোরবেলা যতটা স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন থাকে ততটা যেন বড়বেলা ধূসর হয়ে যায়। মান্দারবনি কোলিয়ারিতে দৈনিক এক টাকা চার আনা’র বিনিময়ে চুক্তি ভিত্তিক যে কাজে বীরেন্দ্রকুমার তাঁর উনিশ বছর বয়সে নিয়োজিত হয়েছিলেন, সেখানে কাজে কয়েকদিন দেরিতে আসায় (আর্থিক অনটনের কারণে তাঁকে টিউশনি সহ আরও অন্যান্য কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজে সময় দিতে হত) কোলিয়ারির পাঞ্জাবী ম্যানেজার পাঠক সাহেব তাঁকে একদিন ডেকে হিন্দিতে বলেছিলেন, “... তোমার কোলিয়ারির ডিউটির সময় (আসা-যাওয়ার সময় সহ) কোম্পানির কাছে বিক্রিত। তোমার সান্ধ্য টিউশনের সময় ছাত্রদের কাছে বিক্রিত। তোমার নিজের সময় বলতে শুধু রাত্রের ঘুমোবার সময়টুকু। অতএব পড়ার জন্য সময় বাঁচাতে হলে তোমাকে একমাত্র ঘুমোবার সময় থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে। ডিউটির সময় থেকে পাঁচটি মিনিটও নয়।” তারপর লেখক নিজেই লিখেছেন, “শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও বলি, এর পর শুধু ডিউটিতে নয়, জীবনের কোনও কাজে পাঁচ নয়, এক মিনিট দেরিও করিনি কোনোদিন। আমার সাতটা ওই দিন থেকে কখনও ছ-টা বেজে একষট্টি মিনিট হয়নি সারাজীবনে।” এখানে এসে আত্মকথনে ছেদ পড়ে। কারণ, তিনি এবার সততই মিশে গেলেন সমাজের বৃহত্তর স্রোতে। কিন্তু তাঁর বালক-কিশোরবেলার বিস্ময়, পর্যবেক্ষণ, গড়ে ওঠা, চারপাশ তাঁকে নিষ্কৃতি দেবে কেন?
গ্রামীণ অনুষঙ্গে যাত্রাপালার সরব উপস্থিতি এমনকি আমাদের নিজেদের ছোটবেলার মফস্বল ও প্রান্ত-কলকাতার জীবনেও দেখেছি। গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে প্রত্যন্ত রাঢ় বাংলায় তা যে অঙ্গে অঙ্গে মাখামাখি ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বীরেন্দ্রকুমারের কাছে তা ছিল প্রাণবায়ু। এই নাট্যপ্রেম ও চর্চা তিনি আজীবন চালিয়ে গেছেন। নিজে সুদক্ষ অভিনেতা ছিলেন। গ্রামীণ পালায় প্রচুর অভিনয় করেছেন। সে সব কথা এ বইয়ে আছে। আসানসোলের বিবি কলেজে আইএসসি পড়ার সময় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সহপাঠী ছিলেন, যিনি সে সময়েও চুটিয়ে নাটক করেছেন কিন্তু দুজনের মধ্যে তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি। তবে কলেজে ছাত্র অজিতেশের নাটক দেখে আপ্লুত এক মাস্টারমশাই তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যদি ভবিষ্যতে বড় নাট্যকার হন তবে তাঁকে যেন গ্রিনরুমের ভেতরটা দেখিয়ে আনেন। বীরেন্দ্রকুমারের ভাষায়, “কৌতুকচ্ছলেই সানন্দে প্রতিশ্রুতি দেয় অজিত। স্যারের এই কল্পনা রূপায়িত হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। তবে এটিকে বিষয় করে আমি ‘গ্রিনরুম’ নামের একটি নাটিকা লিখে, পাণ্ডুলিপিটি অজিতেশকে উৎসর্গ করেছিলাম পরবর্তীকালে।”
রাঢ় বাংলার এই তথাকথিত নিস্তরঙ্গ জীবনে ১৯৪৭’এর ১৫ অগস্ট আসে। তখন বীরেন্দ্রকুমারের বয়স মাত্র চোদ্দ। লিখছেন, “স্বাধীনতা দিবসে তো এক দিনের ছুটি হয়। প্রথম বছর বোধ হয় আনন্দাতিশয্যের প্রাবল্যে বিদ্যালয়ে (অন্তত আমাদের বিদ্যালয়ে) ছিল দশ দিনের ছুটি।” কিন্তু ওই ১৫ অগস্টই সকালবেলায় ‘পতাকা অভিবাদন পর্বটুকু করে’ একদল ছাত্রের “সমবেত সিদ্ধান্ত হল— এই নিদারুণ অপমানের একমাত্র প্রতিষেধক হাঙ্গার স্ট্রাইক।” কেন? স্বাধীনতার প্রত্যুষে কীসের ‘নিদারুণ অপমান’? সে ছেলেমানুষী কাহিনি পড়ে নিতে হবে গ্রন্থটিতে।
আমার ছেলেবেলায় এমন কিছু আত্মীয়বাড়িতে গিয়েছি যেখানে সন্ধ্যের পর কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে কাজকর্ম সারা হত। কুপি থেকে নির্গত কেরোসিনের গন্ধ বহুদিন নাকে লেগে থাকত। সেই আধো আলো-আঁধারিতে বাড়ির সকলেই কেমন জানি বেশি করে আপন হয়ে উঠতেন। মা-মাসি, দিদিমাদের গল্পে যেন এক অকুতোভয় স্বপ্নপুরী তৈরি হত। মনে পড়বে, ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে ইন্দির ঠাকুরণের রাক্ষসের গল্প বলার সময়ে দেয়ালে ছায়া পড়ার দৃশ্যের কথা। ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’তে সেই অম্লান স্বপ্নপুরীকে যেন নতুন করে ফিরে পেলাম। যখন বালক বীরেন্দ্রকুমারের মা তাকে জিজ্ঞেস করেন, “ঠিক পরীক্ষাকালীন সময়টাতে ছেলেরা এত পড়ে কেন? পরীক্ষার দিনগুলিতে যদি জীবন-মরণ পণ করে পড়া করতে হবে, তবে সারাবছর পড়াশোনা করল কীসের জন্য?” প্রথমে কথাটিকে খানিক অবান্তর মনে হলেও পরে এটিই তাঁর মাথায় গেঁথে যায় এবং তিনি যতদিন পরীক্ষা দিয়েছেন সেই দিনগুলিতে আর কখনও পড়েননি। ম্যাট্রিকের অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন এক সিনিয়র দাদার কাছে সন্ধ্যেবেলায় গেলে তিনি ভেবেছিলেন আটকে যাওয়া কোনও অঙ্ক এই কিশোর ওনাকে দিয়ে করিয়ে নিতে এসেছে; কিন্তু তা না করে সবিনয়ে তাঁর কাছে গল্পের বই চাইলে তিনি হতচকিত হয়ে যান।
কিছু কিছু জায়গায় বাক্যের জ্যোতি এতই আলোকময় যে, ছবির মতো তা পর পর দৃশ্য রচনা করে চলে। এত খুঁটিনাটি তার বর্ণনা যে পাঠক সচকিতে অনুভব করবেন তাঁর নিজ উপস্থিতি। এই দৃশ্যমালার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ইতিহাসের পাঠ। এক অজানা বোধও।
পায়ে পায়ে পাঁচালি: রাঢ়বাংলার একটি গ্রামের আত্মকথা। বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। দীপ প্রকাশন। জানুয়ারি ২০২৫। ২৭৫ টাকা।
অনিন্দ্যকে ধন্যবাদ এমন এক ম ন খারাপ করা ব ইয়ের হদিস দেবার জন্য।
ReplyDeleteবাহ! বেশ ভালো বই তো।
ReplyDeleteমুগ্ধতা প্রকাশের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানাই এই বইটি সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্য। বইটি সংগ্ৰহ করার তীব্র বাসনা জাগিয়ে দিলেন!
ReplyDelete