Monday, 30 June 2025

কলেজ চত্বরে কাদের মাস্তানি

কলুষিত শিক্ষা অঙ্গন

আবু সঈদ আহমেদ



স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবনে পা রাখার সময়টা ছাত্রছাত্রীদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর মোড়। তবে একে ঘিরে মানসিক অস্থিরতাও একেবারে কম নয়। এই সময় তারা একাধিক মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে-- একইসঙ্গে পায় উত্তেজনা ও স্বাধীনতার অনুভব, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ, নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা— এসব এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। কেউ কেউ হোস্টেল বা বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করে, জীবনের প্রথম স্বাধীনতা অনুভব করে। তবুও সব কিছু এত রঙিন নয়। যেমন, মনে আসে নানা উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। নতুন পরিবেশ, অপরিচিত বন্ধু-বান্ধব, কঠিন একাডেমিক চ্যালেঞ্জ— সবই একটা উদ্বেগ তৈরি করে। ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার নিয়ে চাপ তৈরি হয়, 'ঠিক পথে হাঁটছি তো?', এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।

কেউ কেউ আবার হতাশায় ভোগে, নিজের জায়গাটা খুঁজে পেতে সময় নেয়। আর জীবনের এই সময়েই নারী জীবনের সব থেকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল কসবার আইন কলেজের এক ছাত্রী। যেখানে অপরাধী হিসেবে নাম উঠে এসেছে সেই কলেজেরই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের, যাদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ওই কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র, যে কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে আর যুক্ত না থাকলেও কলেজ চত্বরে দিনের পর দিন অবাধে মাস্তানি চালিয়ে গেছে। 

আমরা জানি, ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠস্বর ছাত্র ইউনিয়ন মারফত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হওয়াটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গণতান্ত্রিক ও সচেতন শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এখানেই ছাত্ররা সরাসরি জানাতে পারে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে তারা পড়ছে— হোক তা একাডেমিক, প্রশাসনিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়। নীতিমালায় পরিবর্তনের আগে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক মতামত উঠে আসে। যখন ছাত্রছাত্রীরা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তখন তারা সিদ্ধান্তগুলিকে আরও দায়িত্ব নিয়ে গ্রহণ করে। এতে দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে ওঠে। একজন ছাত্রনেতা হয়ে ওঠা মানে সমস্যার সমাধান, জনসংযোগ ও সময় ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন। ছাত্রছাত্রীদের ইউনিয়ন কার্যকলাপে যুক্ত করা মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও শোধনযোগ্য হয়। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল করা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত হয়। অতএব, একজন ছাত্র প্রতিনিধি হওয়াটা শুধু একটা পদ নয়, বরং এটাও শেখা, কীভাবে নিজের কথা বলা এবং অন্যের কণ্ঠস্বরকেও গুরুত্ব দেওয়া যায়।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলোতে বহুদিন ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। সর্বত্র একদলীয় তৃণমূলি রাজনৈতিক দাপট। যার ফল হয়েছে, ক্লাসরুম, গ্রন্থাগার বা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চলাফেরার জায়গাগুলো রাজনৈতিক দখলদারিতে পরিণত। পড়াশোনা ও গবেষণার পরিবেশে ভয়, চাপ ও হুমকির ছায়া। আগের শাসনামলগুলোতেও এসবের অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সবই মাত্রাছাড়া চলছে। হঠাৎ হুমকি, মারপিট বা সংঘাতের মাঝে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মানসিক উদ্বেগে ভুগছে। কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছে বা শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখেই সরে দাঁড়াচ্ছে। কলেজে ছাত্র ভর্তিও কমে যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে অস্ত্রও ব্যবহার করছে। এইভাবে তারা টাকাও তোলে।ফলে, 'ছাত্রনেতা' শব্দটা নেতিবাচক অর্থ পেতে শুরু করেছে। যখন দুর্বৃত্তরা বিচারহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তখন ছাত্রদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। নৈতিক শিক্ষার জায়গা দখল করে নেয় ক্ষমতার রাজনীতি। প্রকৃত নেতৃত্ব গুণ থাকা ছাত্ররা পেছনে পড়ে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে, অথবা দূরে সরে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিন্তাশীল সমাজনেতারা হারিয়ে যাচ্ছে সহিংসতার কোলাহলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। দেশের বাইরে পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার তৈরির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। দেশে বা বিশ্বে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

যখন ছাত্র রাজনীতি আদর্শ, নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক চর্চার বদলে দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটে, তখন তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে। ছাত্র রাজনীতি যদি আদর্শভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে তা সমাজ পরিবর্তনের এক মহৎ মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু যখন সেটাই দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে যায়, তখন স্বপ্নের ক্যাম্পাস রূপ নেয় আতঙ্কের প্রান্তরে। এই চক্র থেকে বেরনো উচিত।

সঠিক ছাত্র প্রতিনিধিত্ব না থাকলে আরেকটি ব্যাধি অবাধে চলতে থাকে। তা হল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষপাতিত্ব। কিছু তোষামোদকারী ছাত্রছাত্রীদের সামনে রেখে তৈরি করা হয় এক ক্লেদাক্ত পরিবেশ। এখানে শিক্ষককে আর 'নিরপেক্ষ' গাইড বা মেন্টর হিসেবে দেখা যায় না। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে ভাঁটার টান পড়ে, ফলে ক্লাসের নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দেয়। পক্ষপাত শিক্ষাকে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও জটিল খেলায় পরিণত করে, যেখানে গুণ নয়, পরিচয় বা প্রভাব প্রাধান্য পায়। এখানে যারা পক্ষপাতের বাইরে থাকে, তারা নিজেদের অবমূল্যায়িত বা অবহেলিত মনে করে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে 'পছন্দের' ও 'অপছন্দের' গোষ্ঠী তৈরি  হয়। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। পক্ষপাতিত্ব'র ফলে ছাত্রছাত্রীরা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে নিজের প্রকৃত উন্নতির চেষ্টা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, অবহেলিত ছাত্ররা নিজের দক্ষতা প্রমাণের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।

রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় ক্ষমতা ধরে রাখা যে কোনও মূল্যে, তাহলে তা মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আত্মাকে আঘাত করে। অপরাধীরা যখন রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, তখন তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ মানুষ 'ন্যায় পাব কি না' সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। নীতিনির্ধারকরা দুর্বৃত্তদের স্বার্থরক্ষার জন্য নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, সে সবও মানুষ দেখছে। দেশ জুড়েই প্রশাসনের মধ্যেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী মত দমন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিও বাড়ছে।

গোটা দেশেই দেখা যাচ্ছে, কখনও ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলা হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের পক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল বেরচ্ছে। দুষ্কৃতিপূর্ণ আচরণ যদি রাজনৈতিক ছায়ায় সুরক্ষা পায়, তাহলে তা সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ন্যায়ের প্রতি আস্থা— সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। নারী নির্যাতন যদি সমাজে 'নিয়মিত', 'সহনীয়' কিংবা 'সংস্কৃতির অংশ' হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তাহলে তা শুধুই একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং পুরো সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধেই ফাটল ধরায়। নির্যাতনকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা মানে অপরাধী আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, নারীর আত্মসম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়। নির্যাতনে আক্রান্তরা মনে করেন, নালিশ করেও কিছু হবে না। ফলে, তাঁরা চুপ করে যান আর অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার নারী নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করে। উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, হীনম্মন্যতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এসবের ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে— 'এমনই তো সবসময় হয়' ধরনের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। যখন অন্যের কষ্টকে 'নিয়মিত ব্যাপার' হিসেবে দেখা হয়, তখন সামগ্রিকভাবে সমাজের সহানুভূতি হারিয়ে যায়। যখন দেখা যায় অপরাধীরা পুরস্কৃত হচ্ছে, আর সৎরা বঞ্চিত, তখন তরুণ প্রজন্ম মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্যগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। পাশাপাশি, আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আন্তর্জাতিক মহলে যাওয়াতে দেশের আর্থিক বিনিয়োগ, শিক্ষা বিনিময় বা পর্যটন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সহিংসতার চক্র আরও গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। 

নির্যাতনের ঘটনা যতই 'নর্মাল' করার চেষ্টা হোক না কেন, সচেতন কণ্ঠই পারে সেই অস্বাভাবিকতাকে দৃঢ়ভাবে চিহ্নিত করতে। সচেতনতা ও প্রতিবাদই পাল্টে দিতে পারে এই সংস্কৃতি।


Sunday, 22 June 2025

নিছক দুর্ঘটনা?

বিপর্যয়ের অতল খাদে দেশ

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



রাজনৈতিক সমাজে কোনও দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা থাকে না। ঠিক মতো কাটাছেঁড়া করলে দেখা যায়, প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনে রাজনীতির লোকজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ঘটনার যখন কারণ আপাত প্রত্যক্ষ করতে পারি না, তখনই তো তাকে আমরা দুর্ঘটনা বলি। তাই তো আহমেদাবাদে সাধের এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ ভেঙে পড়লে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলে দেন, দুর্ঘটনাকে তো কেউ আটকাতে পারে না! বাহ! বাত খতম পয়সা হজম। ফলে, দুর্ঘটনা নানান প্রলেপে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তো এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান ভেঙে পড়া নয়, প্রতিদিনই সড়ক পথে, রেলপথে, জলপথে দুর্ঘটনা ঘটছেই। তার সঙ্গে আছে সেতু ভেঙে পড়ার গপ্পো। 

দিল্লি পুলিশের একটি হিসেব বলছে, এ বছরের মে মাসের মধ্যেই দিল্লিতে ২২৩৫টি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৫৭৭ জন মারা গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হিসেবে, এই বছরের মে মাসের মধ্যে ১৩ হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৭৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা নিহিত বাতিক, আমরা নথিভুক্ত করি না। ফলে, সর্বগ্রাহ্য পরিসংখ্যান পাওয়া রীতিমতো কঠিন। অর্থাৎ, সেকেন্ড হ্যান্ড উপাত্ত নিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। আর প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহ করার মতো টিম আমাদের হাতে নেই। তাই শুধু দিল্লি আর উত্তরপ্রদেশের হিসেবটাই রাখতে পারলাম। আর মজার, এই দুটো রাজ্যেই মোদীর অতিপ্রিয় ডাবল ইঞ্জিন সরকার। আর ভারতীয় রেল! 

আমাদের মনে রাখতে হবে, রেলে দুর্ঘটনা যেন এক বাঞ্ছিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও দুটি ট্রেন মুখোমুখি একই লাইনে এসে পড়ছে, কোথাও লাইনচ্যুত হচ্ছে, কোথাও ২টি ট্রেনের বীভৎস ধরনের সংঘর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ আকস্মিক প্রাণ হারাচ্ছেন। এমনকী, রেল কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো হিসেবটাও দেয় না। তবু রেলের পুনে ডিভিশন জানাচ্ছে, এ বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৫১ জন রেল দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে যার মধ্যে দুজন মারা গিয়েছে। 

আর সেতু! একটা করে সেতু ভাঙে আর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার তোড়জোড় শুরু হয়। ২০২৫ সালের চলতি মাস অর্থাৎ জুন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সেতু ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহারাষ্ট্রর পুনেতে ইন্দ্রায়ণী নদীর ওপর একটি সেতু ভেঙে পড়া, যেখানে বেশ কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। কারও মতে সংখ্যাটা ১৫-২০, কারও মতে ৩০ জন। পুরনো লোহার সেতু দিয়ে যান চলাচল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্ষার সময় নদী ও এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা ছবি বা নিজস্বী তুলতে অনেকেই সেতুতে জড়ো হন। আগেই স্থানীয় বাসিন্দারা সেতুর হাল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ৪-৫ বছর আগে সেতুটির মেরামতি হয়। উদ্ধারকারীদের মতে, বর্ষার সময় নদী ছিল খরস্রোতা। জলস্তর বেড়েছিল, তাই বহু মানুষ ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

ঘটনা ঘটে গেলে রাজনীতিকরা আসবেন না, তা হয় নাকি? ফলে, অকুস্থলে যান শরদ পাওয়ারের মেয়ে তথা এনসিপি (শরদ পাওয়ার গোষ্ঠীর) সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে। ওদিকে এক্স হ্যান্ডেলে মুখ্যমন্ত্রী  দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। এসব তো ঘটে যাওয়ার পরের কাহিনি ও বাকতাল্লা! কথা হচ্ছে যে এমন একটা লবেজান সেতু না মেরামত করে বা ভেঙে না ফেলে মৃত্যুসেতু সাজিয়ে রাখার মানেটা কী? এরপরও কি বলতে হবে, 'দুর্ঘটনা কেউ আটকে রাখতে পারে না'। আসলে এগুলো apolitical disaster নয়, হাইলি political।  

এছাড়াও, কদিন আগে মধ্যপ্রদেশের শিবপুরীতে একটি নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে পড়ে, যাতে কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। একইসঙ্গে অসমেও গত ১৮ জুন বুধবার একটি সেতু ভেঙে পড়ে। অসমের কাছাড় জেলায় হারাং নদীর উপর ব্রিজটি ভেঙে পড়ায় ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুরের সঙ্গে সড়কপথে বাকি দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ব্রিজ ভেঙে নদীর জলে তলিয়ে যায় পাথরবোঝাই ডাম্পার ৷ তবে ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি ৷ তবে আশ্চর্যের, মেরামতির এক মাসের মধ্যেই ভেঙে পড়ে এই সেতুটি। এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায়, সেতুগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং নির্মাণের গুণগত মান কোন স্তরের। বিশেষ করে, পুরনো সেতুগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি প্রকট। ভঙ্গরপারের সঙ্গে শিলচর-কালাইনের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় হারাং নদীর ওপর এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ৷  অসমের বরাক উপত্যকার দুই প্রধান শহর গুয়াহাটি ও শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল এই ব্রিজ ৷ এই দুর্ঘটনার ফলে বরাক উপত্যকা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি রাজ্য— ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুরের সঙ্গে সড়কপথে বাকি দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ১ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা খরচ করে মেরামতির ১ মাসের মধ্যে সেতুর ভবলীলা সাঙ্গ! কই এবার তো মোদী বা শাহ হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা মোহন যাদবকে বলছেন না, 'ইয়ে অ্যাক্ট অফ গড নেহি অ্যাক্ট অফ ফ্রড হ্যায়'। কেন বলছেন না? কারণ মধ্যপ্রদেশ ও অসম, দুটোতেই ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। 

শুধু কি এই? গত রবিবার সকালে কেদারনাথ মন্দির থেকে তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি কপ্টার গুপ্তকাশির কাছে বিধ্বস্ত হয়, এতে পাইলট এবং দুই বছরের একটি শিশু সহ সাতজনই নিহত হন। দুর্ঘটনাগ্রস্ত কপ্টারটি আরিয়ান সংস্থার। পুলিশ ও দমকল সূত্রের খবর, রবিবার উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গৌরীকুণ্ডর কাছে গৌরী মাঈ খার্ক এলাকায় জঙ্গলের ওপর ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ ভেঙে পড়ে চপারটি। দুর্ঘটনাস্থলের কাছে স্থানীয় মহিলারা  ঘাস কাটছিলেন, তাঁরাই প্রথম দুর্ঘটনার খবর পান। এক্স হ্যান্ডেলে উত্তরাখণ্ড'র মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি শোকপ্রকাশ করেছেন, 'রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ভয়াবহ খবর পেয়েছি। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকারী দল ব্যস্ত উদ্ধারকাজে। কপ্টারের সওয়ারিদের সুস্থতার জন্য বাবা কেদারের কাছে কামনা করি।' দেখুন, গোটা ব্যাপারটা কেদারের হাতে ছেড়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিরুদ্দেশ। অথচ ৩০ এপ্রিল তীর্থযাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তরাখণ্ডে ছয় সপ্তাহে চারধাম যাত্রা রুটে এটি পঞ্চম হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা এবং দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা। ৮ মে উত্তরকাশীতে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ছয়জন নিহত হন। ১২ মে বদ্রীনাথে একটি দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। ১৭ মে ঋষিকেশের এইমস'এর একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কেদারনাথে বিধ্বস্ত হয় তবে দুর্ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ৭ জুন কেদারনাথ যাওয়ার পথে একটি হেলিকপ্টার উড়ানের সময় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ার পরে হাইওয়েতে জরুরি অবতরণ করে, যেখানে পাইলট আহত হন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে প্রাথমিকভাবে  দুর্ঘটনাটি কন্ট্রোলড ফ্লাইট ইনটু টেরেন (সিএফআইটি)'এর ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে, যেখানে দৃশ্যমানতা কম এবং উপত্যকার প্রবেশ এলাকায় বিস্তৃত মেঘ থাকা সত্ত্বেও হেলিকপ্টারটি আকাশে উড়েছিল। বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি) কর্তৃক বিস্তারিত তদন্তর মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা হবে। মজার ব্যাপার, উত্তরাখণ্ডেও চলছে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার।  

এখন আহমেদাবাদে জমে উঠেছে নানান কিসিমের তরজা। একদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ প্রসঙ্গ, অন্যদিকে দুর্ঘটনার পিছনে কোনও গভীর রহস্য আছে কিনা। বিতর্ক শুরু হয়েছে একটি ভিডিও-কে ঘিরেও। ১২ জুন যেদিন এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমানটি ভেঙে পড়ল, সেদিন ভেঙে পড়ার দৃশ্য সেকেন্ড কয়েক ক্যামেরাবন্দি করেছিল এক ১৭ বছরের তরুণ। বহু মানুষ সেই ভিডিওটি তাঁদের সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। সব টিভি চ্যানেল, ডিজিটাল মিডিয়া ওই ভিডিওটিই সম্প্রচার করেছিল-- কীভাবে এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ উড়ানটি ওড়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বি জে মেডিক্যাল কলেজ ও সিভিল হাসপাতালের ছাত্রাবাসের ওপর ভেঙে পড়ে। ওই আঁখে দেখো হাল ভিডিওটি করে ১৭ বছরের তরুণটি পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। শনিবারের বারবেলায় রীতিমতো বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে যায় গুজরাতের পুলিশ। জানি না কেন গুজরাত পুলিশের এই সক্রিয়তা! কেন তরুণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে কি গ্রেফতার করেছে না আটক করেছে, এসব নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে, ওই  তরুণটির জন্যই এই বিমানটি ভেঙে পড়েছে। বিমানের যন্ত্র সংক্রান্ত কোনও সমস্যার জন্য ওই তরুণ দায়ী। গুজরাতের পুলিশ মোদী-শাহ'র বড় ভক্ত। তবে পুলিশ পরে জানিয়েছে, ওরা তরুণটিকে গ্রেফতার বা ডিটেইন করেনি, বয়ান রেকর্ড করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, তা করে ছেড়ে দিয়েছে। 

১৭ বছর বয়সি ওই তরুণটি উত্তর গুজরাতের সবরকণ্ঠ জেলার ইদারের বাসিন্দা। নাম আরিয়ান আসারি। প্রথমবারের জন্য আহমেদাবাদ এসেছিল বই কিনতে। সেখানেই নিজের বাবার ভাড়া বাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ একটি বিমানকে খুব কাছ দিয়ে যেতে দেখে মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করে। তখন সে বুঝতেও পারেনি যে এরপরেই ঘটে যাবে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ভিডিও তোলার মাত্র ২৪ সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানটি আগুনের গোলায় পরিণত হয়। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আরিয়ান ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ভিডিওটা প্রথমে তার দিদিকে দেখায়। আরিয়ানের পরিবার সম্পর্কে জানা যায়, সে তার মা ও দিদির সঙ্গে ইদারে থাকে। তার বাবা আহমেদাবাদে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আগে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এই প্রাক্তন সেনা জওয়ান এখন নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। যাক, গেরুয়া শিবিরের সুদূর প্রভাবশালী আইটি সেল এখনও পর্যন্ত আরিয়ানকে বিঁধতে পারেনি। 

বিমান ভেঙে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছু পরই সমাজমাধ্যমে পোস্ট: 'প্রাইভেটাইজেশন মৃত্যুকে আহ্বান করে।' মানে গোড়া ধরে টান। ২০১৭ সালের ২৮ জুন মোদী সরকার এয়ার ইন্ডিয়া বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া সরকারিভাবে সম্পন্ন হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে একেবারে জলের দরে মাত্র ১৮,০০০ কোটি টাকায় এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটার কাছে বেচে দিয়েছিল মোদী সরকার। আক্ষরিক অর্থেই ছিল ‘ফ্রি গিফট’! আর এটা বেচে কেন্দ্রীয় কোষাগারে এসেছিল মাত্র ২,৭০০ কোটি টাকা! বাকি ১৫,৩০০ কোটি টাকার ঋণের দায় নিয়েছিলেন 'টাটাবাবুরা'। অথচ এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ ছিল ৬১,৫৬২ কোটি টাকা। তাহলে বকেয়া ৪৬,২৬২ কোটি টাকা কে মেটাবে? কেন গৌরী সেন কেন্দ্রীয় সরকার! ফলে, বছর-বছর এয়ার ইন্ডিয়ার দেনা শোধ করবে কেন্দ্র। আর মুনাফা যাবে টাটার ঘরে। প্রায় মুফতে সেই সঙ্গেই টাটা পেয়েছিল একশোরও বেশি বিমান, হাজার হাজার প্রশিক্ষিত পাইলট ও ক্রু, দেশের বিমানবন্দরগুলিতে ৪,৪৪০টি অন্তর্দেশীয় আর ১,৮০০টি আন্তর্জাতিক অবতরণ ও পার্কিং স্লট ব্যবহারের সুযোগ; এখানেই শেষ নয়, এর পাশাপাশি পেয়েছিল, হিথরো, নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং'এর মতো বিদেশের বিমানবন্দরগুলোতে এমন ৯০০টি স্লট ব্যবহারের সুযোগ। একে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ লুঠ ছাড়া আর কী বলা যায়! সরকার পক্ষের যুক্তি, ওসব ছাড় না দিলে শিল্পপতিরা নেবে কেন? আর দুর্ঘটনা? সরকারি সংস্থা হলেও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত, যেমন রেলে ঘটে। তবে রেলের দুর্ঘটনার মূল কারণও রাজনৈতিক। সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রেলে কর্মী সঙ্কোচন, জনসংখ্যার অনুপাত ও যাত্রী পরিষেবার বিচারে পরিকাঠামো উন্নত না করা।  

উড়ান দুর্ঘটনার সন্ধেতে মোদী তাঁর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট অমিত শাহকে পাঠিয়ে দিলেন অকুস্থলে। প্রাথমিক ভাবে শাহ সবটা সালটে দেওয়ার পর শুক্রবার মোদীর পা পড়ল মেঘানিনগরে। লোকটার ফটোগ্রাফি সেন্সটা দারুণ! আর সঙ্গে করে যে সব ফটোগ্ৰাফারদের নিয়ে ঘোরেন তাঁরা প্রচণ্ড পরিশ্রমীও বটে। প্রয়োজনে তাঁরা রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েও ওঁকে সঠিক অ্যাঙ্গেল থেকে ধরেন। কারণ, ছবিতে ওঁর উপস্থিতির যে প্রয়োজনীয়তা, সেটাও বোঝাতে হয়। নিন্দুকরা বলছেন, উনিজী কোনও বড় ঘটনা ঘটলে সেখানে ক্যামেরা নিয়ে যান, নিজের ছবি তুলিয়ে তা ফেসবুক, এক্স'এ পোস্ট করে নিজের প্রচার করেন। তবে নিন্দুকরা এ প্রশ্নও তুলছেন, কই মোদীমশাই তো মণিপুরে যাননি এখনও? লে হালুয়া! মণিপুরে তো পলিটিক্যাল ক্রাইসিস, বিজেপি তার স্পনসর, ফলে সেখানে যাবেন কেন? উনি সন্দেশখালিতে আসবেন সন্দেশ দিতে। সব ছেড়ে আলিপুরদুয়ারে আসবেন জঙ্গি তাড়াতে! এসবই ওঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি, যেমন গেলেন আহমেদাবাদ। 

বলি শাহজী, এই বিমানটা যদি পশ্চিমবঙ্গে ভেঙে পড়ত তবে আপনি কী বলতেন? বলতেন, 'দিদি কা সরকার খতম হোনে কি সন্দেশ অ্যা রেহি হে। আপ বহুমত ভাজপা সরকার গঠন কর দিজিয়ে।' পাল্লা দিয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলতেন, 'এর জন্য দায়ী তোলাবাজ ভাইপো ও চটি পিসি। বিমানবন্দর চত্বরে তোলামূলের জামাত বাহিনীদের বসিয়ে রেখেছে। সময় এসেছে হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই।'


Friday, 13 June 2025

গাজার পাশে বিশ্ববাসী

ইজরায়েলের পৈশাচিক ধ্বংসলীলা

সোমা চ্যাটার্জি



গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের মধ্যেই ১৩ জুন ইজরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কেন্দ্রস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং পশ্চিম এশিয়ায় আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল'এর যে একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে তার মূল উদ্দেশ্য, পশ্চিম এশিয়ার সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলিকে দমন করে লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও অন্যান্য দেশগুলিতে সংঘাত সম্প্রসারিত করা। 

ইজরায়েল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ মদতে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একটি দুঃশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী গাজা উপত্যকা। গত কয়েক দশক ধরে  ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সংঘর্ষে এক সময়ের সবুজ উপত্যকা আজ একটি মৃত্যুপুরী, একদা কোলাহল মুখর জনপদ আজ এক ধ্বংসস্তূপ। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে গাজায় নিহতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি, আহত লক্ষাধিক। প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু ১৪৮ জনের। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ নারী ও শিশু এবং ১০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক। বিশ্বের বাকি অংশ থেকে গাজা কার্যত বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা সব কিছুর জন্যই ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল। তাই, ইজরায়েল গাজার জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় গাজার জনজীবন কার্যত বিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তার উপর গত আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় কারও কোনও ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইজরায়েলি সেনারা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গত ৯ জুন সারা বিশ্বে আমানবিকতার চূড়ান্ত নজির সৃষ্টি করেছে ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর সরকার।

আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা 'ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন'এর 'ম্যাডেলিন' নামে একটি ত্রাণ সরবরাহকারী জাহাজকে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটকে দেয় ইজরায়েলি সেনারা। ওই জাহাজটিতে সুইডেনের বিখ্যাত পরিবেশবাদী গ্রেটা থানবার্গ সহ আরও ১২ জন মানবাধিকার কর্মী ছিলেন, যাদের মধ্যে ফ্রান্সের বিখ্যাত আইনজীবী ও ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় সংসদের ফরাসি সদস্য রিমা হাসান, দুই ফরাসি নাগরিক এবং স্পেন, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ব্রাজিল ও জার্মানির আরও অনেকে ছিলেন যারা সবাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা পরিবেশবিদ হিসেবে পরিচিত। গ্রেটা থানবার্গ একজন জলবায়ু রক্ষার প্রচারক কিন্তু গাজার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে ত্রাণ পৌঁছনোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি ৩ জুন শিশুর ফর্মুলা, খাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী পণ্যসম্ভার নিয়ে 'ম্যাডেলিন'এ যাত্রা করেন। জাহাজটি ইজরায়েল সীমানার কাছাকাছি আসতেই ইজরায়েলি সেনারা ড্রোনের মাধ্যমে কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক নিক্ষেপ করে গাজা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজটিকে আটক করে। সেই সময়ে গ্রেটা থানবার্গের একটি ভিডিও রয়টার্সের মাধ্যমে এক্স হ্যান্ডেলে দেখা যায়, যেখানে লাইফ জ্যাকেট পরিহিত জাহাজের যাত্রীরা রয়েছেন এবং গ্রেটা বলছেন যে তাঁদের জাহাজটি ইজরায়েলের সেনারা অপহরণ করতে চলেছে। তিনি সুইডিশ সরকার, তার নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাদের কাছে অনুরোধ জানান তাদের মুক্ত করার জন্য। ইজরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রক এটিকে স্টান্টবাজি ও লোকদেখানো হিসেবে অভিহিত করলে বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ইজরায়েলি সরকার গ্রেটা সহ অন্যান্যদের  ফ্রান্সে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে কথা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা দিয়ে প্রকাশ করে। রিমা হাসানকেও ইজরায়েলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, কারণ, তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইজরায়েলি নীতির বিরোধিতা করেছিলেন।

রাষ্ট্রসংঘের মতে, আজ পর্যন্ত ২ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে যা গাজার মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশ। গত দু' মাসে শুধু আনাহারেই মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫০০ জনের। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্কগ্রস্ত গাজার শিশু ও নারীদের করুণ আর্তনাদের ভিডিও। চতুর্দিকে উঠেছে নিন্দার রব। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়ে ইজরায়েল মে মাসের শেষের দিকে সামান্য সাহায্যের অনুমতি দিতে শুরু করে। সম্প্রতি ঈদের দিন ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও'তে গাজায় এক মাকে তার সন্তানের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মাটি থেকে ময়দার গুড়ো কুড়িয়ে নিতে দেখা যায়। ক্ষুধা, অনাহার আর মৃত্যুতে যখন প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির জীবন বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময়েই জুনের প্রথম সপ্তাহে খাবার, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সরবরাহ নিয়ে ইতালির সিসিলির কাতানিয়া থেকে রওনা দেয় থুনবার্গ'দের জাহাজ, কিন্তু প্রথম থেকেই এই প্রশ্ন ছিল যে তা আদৌ গাজায় ত্রাণ পৌঁছতে সফল হবে কিনা! কারণ, মাত্র এক মাস আগে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের আরেকটি সাহায্যকারী জাহাজকে ইজরায়েল ড্রোন দিয়ে আঘাত করার ফলে জাহাজটিতে আগুন লেগে যায় এবং চারজন বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক আহত হন। 

আমরা জানি, ২০০৬ সালে নির্বাচনের পর হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২০০৭ সালে ফাতা'র সঙ্গে গৃহযুদ্ধের পর থেকে গাজা উপত্যকা ও ইজরায়েলের মধ্যকার সংঘাত জটিল হতে শুরু করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গাজায় ৫০০'রও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে এখন মাত্র ১০টি আংশিকভাবে কার্যকর; এলাকার ৮৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়াও, ইজরায়েল সাংস্কৃতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য ভবন ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি গ্রন্থাগার যেখানে হাজার হাজার বই ছিল; ছিল গাজার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮০ শতাংশ স্কুল, বেশ কয়েকটি মসজিদ, তিনটি গির্জা এবং দুটি জাদুঘর। রাষ্ট্রসংঘের মতানুযায়ী, গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনের জন্য ৫৩০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

১৯৪৮ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ দিয়ে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ শুরু হলেও আজ ৭৫ বছরেও তা শেষ হয়নি, বরং দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিয়ে বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে নরওয়ের ওসলো'তে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন দুই পক্ষ শান্তি চুক্তিতে সম্মত হলেও ইজরায়েলের পাশে আরেকটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইজরায়েল রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া এই দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত জেরুসালেম কার অধীনে থাকবে, বা ফিলিস্তিনের মধ্যে বসবাসকারী ইজরায়েলি ইহুদিরা কোথায় যাবে, এবং ফিলিস্তিনে শরণার্থীদের জন্য নতুন বাসস্থান কোথায় হবে প্রভৃতি বিষয়গুলিও পরে আলোচনায় ঠিক করা হবে বলে কথা হলেও ভবিষ্যতেও অনালোচিতই থেকে গেছে। এরপর জেরুসালেমে ইজরায়েলি রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর এবং পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় ইজরায়েল সরকার স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেয়। বস্তুত, এই কারণই জন্ম দেয় হামাস বা ফাতা'র মতো গোষ্ঠী যাদের দাবি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন।

বর্তমান ইজরায়েল সরকার চায় পশ্চিম তীরকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যাতে ফিলিস্তিনিরা দুর্বল হিসেবে সবসময়ই ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। তাই, এই দখলদারি রাজনীতির জন্য গাজা থেকে সাময়িক ভাবে ইজরায়েল সরে আসলেও তারা পশ্চিম তীর ছাড়েনি বরং আমেরিকার মদতপুষ্ট হয়ে শান্তি চুক্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে লাগাতার বোমা বর্ষণ ও নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে গাজার উপর। ঘৃণা এতদূর ছড়িয়েছে যে ইহুদি বিদ্বেষী হিটলারও যে কথা প্রকাশ্যে বলেনি তা সাম্প্রতিককালে একজন ইহুদি ইজরায়েলি রাজনীতিবিদ মশে ফেলিন বলে ফেলেছে-- 'গাজায় বসবাসকারী প্রতিটি শিশুর মৃত্যুই কাম্য', কারণ, তারা সবাই ইজরায়েলের শত্রু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বেশি  বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত ও রাজনৈতিক ভাবে আলোচিত হলেও গাজা নিয়ে পৃথিবীর কোনও দেশই আজ পর্যন্ত কোনও একটি সঠিক ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গাজাবাসীদের পাশে দাঁড়ায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনের নিন্দা করেছে, যদিও  কিছু আরব ও মুসলমান দেশ সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সমর্থনে ইজরায়েলি দখলদারিত্বকে দায়ী করেছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইজরায়েলের বন্ধু’ হিসেবে পাশে থেকে ইজরায়েলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সামরিক খাতকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে যাচ্ছে, অন্যদিকে সম্প্রতি ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে ভারত, বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। ইজরায়েলের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মোদির কিছু অনুসারীরা অনুপ্রেরণা হিসেবেও গ্রহণ করেছে। মস্কোর পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে ইজরায়েল ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমি কতটা বদলে গেছে এবং পরাশক্তিগুলোর পারস্পরিক রশি টানাটানি কতটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠেছে, তা চলমান গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধটি শুধু দুই দেশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।  সারা পৃথিবীর রাজনীতিবিদরা যখন জাতিসংঘে তীব্র কূটনৈতিক ঝগড়া এবং ইহুদি, মুসলিম বা আরবদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়াতে ব্যস্ত তখন গ্রেটা থানবার্গের মতো মাত্র ২২ বছর বয়সী এক তরুণীর গাজার অবরুদ্ধ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার এবং ত্রাণের দাবিতে লড়াই করার মানসিকতা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং এই রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

কিন্তু হামাস নিধনের নামে যে পৈশাচিক ধ্বংসলীলা ইজরায়েল  চালাচ্ছে, সেই মানবাধিকারের কলঙ্ক  মোছার জন্য অন্য দেশ এবং নেতারা কি দায়িত্বশীল হবে নাকি এখনও চুপ করে এই সশস্ত্র সন্ত্রাসকে আরও  ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দেবে সেটাই দেখার বিষয়।



Tuesday, 10 June 2025

'প্রধান শত্রু' কে?

ডুবন্ত মানুষ যাকে ধরবে তাকেই ডোবাবে

মালবিকা মিত্র



'হাত আছে কাজ দাও, নইলে বেকার ভাতা দাও'-- এই স্লোগান একসময়ে ছিল সিপিআইএমের ছাত্র-যুব আন্দোলনের অন্যতম মূল স্লোগান। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ভাবে বক্তৃতার সময় বলা হত, বেকার ভাতা দেওয়া কোনও স্থায়ী সমাধান নয়, কিন্তু এই ভাতা দেওয়ার অর্থ বেকারের কাজের অধিকারকে আইনগত ভাবে মেনে নেওয়া। এর ফলে কাজের দাবিটা অধিকার হিসেবে অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর ১৯৭৭ সালে দল ক্ষমতায় এলে বেকার ভাতা চালু করা হয় (যদিও বছর কয়েক যেতে না যেতেই তা নিঃশব্দে অপসৃত হয়)। বলা হত, বেকার যুবক-যুবতীদের এই স্বীকৃতি রাজ্যের বাইরে সারা দেশের ছাত্র-যুব আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক জোয়ার নিয়ে আসবে। মানে আমি বলতে চাইছি, ভাতাকে ভিক্ষাই বলি অথবা নাকের বদলে নরুণ, এই ভাতার দাবিটা সিপিআইএম দলের ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল। 

বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের মাসিক রিলিফ বা ভাতা প্রদান, বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের মাসিক ভাতা প্রদান, বার্ধক্যকালীন ভাতা, বিধবা ভাতা, এসব তো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে অঙ্গীভূত ছিল। আমি যতক্ষণ না তোমার সমস্যার কোনও নির্দিষ্ট সমাধান করতে পারছি, ততক্ষণ আপৎকালীন হিসেবে এই ভাতা প্রদান করব। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও নতুন পে-কমিশন গঠনের পর রিপোর্ট প্রকাশের আগে পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ভাতা দেওয়া হয়। ঠিক সেই যুক্তি থেকেই এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও কর্মচ্যুতির আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মচারীদের আপৎকালীন একটি ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তখন নিশ্চিতভাবে এই ভাতার প্রশ্ন আর থাকবে না। কারণ, মনে রাখতে হবে, এই কর্মচারীরা কেউ ছ' বছর কেউ সাত বছর চাকরি করেছেন, নতুন ছকে জীবনযাপন করেছেন, গৃহঋণ নিয়েছেন, কেউ শিক্ষা ঋণ নিয়েছেন সন্তানের জন্য। তাদের জীবনযাত্রায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। আজ হঠাৎ করে 'তোমার আর চাকরি নেই' বলে দেওয়াটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। তাদের জীবনের সঙ্গে এখন বহু কিছু প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে। সেই কারণেই এই আপৎকালীন ভাতার মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। একটি সরকার কখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে বলতে পারে না, আজ থেকে তোমার চাকরি শেষ, এবার তুমি যাও, সপরিবারে রেললাইনে গলা দাও। 

সিপিআইএমের পণ্ডিত ও আইনজীবী নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, জনস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ক্ষেত্রে এ ধরনের ভাতা দেওয়া যায় না। আসলে এনারা নিজেদের অতীত বিস্মৃত হয়েছেন। সিঙ্গুরে বড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এক প্রধান শিক্ষক (কৃষক নেতা) দীর্ঘদিন ধরে জেনেশুনে অন্যায় ভাবে উচ্চ হারে হায়ার স্কেলে বেতন ভোগ করলেন। অতঃপর অবসরের সময় তাঁর ঘাড়ে বিপুল পরিমাণ ওভারড্রয়ালের বোঝা। তিনি তৎকালীন নেতা বিধায়ক মলিন ঘোষ, মণীন্দ্র জানা, বলাই ব্যানার্জি এদের সুপারিশ সহ একটি মার্জনার আবেদনপত্র পাঠালেন রাজ্যপালের কাছে। রাজ্যপাল প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ওভারড্রয়াল ক্ষমা করে দিলেন মাত্র এক টাকার বিনিময়। হ্যাঁ, এটা বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালের ঘটনা। পার্থক্য একটাই, কোনও একজন ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে নয়, বর্তমান সরকার একটি সমগ্র প্যানেলের গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মচারীদের সকলের জন্য সমভাবে এই আপৎকালীন ভাতা দিয়েছে। অথচ, সেই ভাতা বন্ধ করার জন্য আদালতে এখন সেই বাম নেতারাই উকিলের পোশাকে সরগরম। প্রকৃত প্রস্তাবে, এনারা যে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকারের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নেমে গেছেন, সে বোধটুকু কি বাকী বাম নেতাদেরও লোপ পেয়েছে? চোখে আঙুলদাদা হলে বলতেন, আরে বাপু, এরপরে ওই পড়ে থাকা ৬-৭ শতাংশ ভোটও কি আর আপনাদের জুটবে? 

অথচ, সিপিআইএম দলের কর্মসূচি ও কর্মনীতি এই রিলিফকে অনুমোদন করেছে। কর্মনীতির ১১২ নম্বর অনুচ্ছেদটি লক্ষ করুন-- 'Paragraph 112 of the CPIM's party programme outlines the party's approach to forming governments, emphasizing the importance of using all opportunities to bring into existence governments that implement a modest program of immediate relief for the people.'। এরপরে অবশ্য বিপ্লবীয়ানা বজায় রাখতে বলা হয়েছে যে 'such governments can strengthen the revolutionary movement of the working people and aid in building a democratic front. Essentially, it's about strategically using state power to advance the cause of the working class and broader democratic movements.'। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রাম কতটা প্রবলভাবে শক্তিশালী হয়েছে তার বিচার করবেন জনগণ। সেই আলোচনায় যাব না। কিন্তু যাদের পার্টি কর্মসূচিতে 'ইমিডিয়েট রিলিফ' একটি ঘোষিত নীতি, তারা কী করে ৫-৬ হাজার গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মীর পেটে অনায়াসে লাথি মারে! আর শুধু তো ৫-৬ হাজার নয়, এদের পরিবারগুলিকে হিসেব করলে সংখ্যাটি ২৫ হাজার হতে পারে। আর এই ২৫ হাজারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে যুক্ত মানুষের সংখ্যাটি আরও হাজার খানেক হবে নিশ্চয়ই। এটাই কি আজকের সিপিআইএম? তবুও তাদের গায়ে এখনও 'বামপন্থী তকমা'?

এই দলটিই এ রাজ্যে নাকি বাম ঐক্যের নেতৃত্বে আসীন, যারা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি-আরএসএস শক্তির চরিত্রকে গোপন করতে আপ্রাণ সচেষ্ট। 'মেইনস্ট্রিম' পত্রিকায় ঐতিহাসিক ও বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নলিনী তানেজা সিপিআইএমের পার্টি কংগ্রেসের দলিল সম্পর্কে বলেন, 'nowhere in the document does one get the sense of degree of suffering of people as a result of the actions of this regime, an idea of what the Muslims go through in their daily lives, attacks and lynchings, and threats to physical existence, the NRC and potential denial of citizenship, the detention camps, or the war on tribals and smaller nationalities: in short, the fascist conditions to which certain regions of the country and certain categories of our people are subjected.'। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় যে বৃহত্তর বাম জোটটি গড়ে উঠছে তার ভিত্তি আর যাই হোক ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা নয়। মৌলালি যুব কেন্দ্র থেকে আসন্ন কালীগঞ্জের উপনির্বাচন, দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই এই জোট সক্রিয়। কিন্তু প্রধান প্রশ্নেই তো এরা ঐক্যবদ্ধ নয়– বিজেপি জোট পরিচালিত সরকারগুলির চরিত্র ফ্যাসিবাদী নাকি আধা-ফ্যাসিবাদী, নাকি তা নিছকই এক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা! শোনা যায়, এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ। তাহলে এই বাম ঐক্যের ভিত্তি কী? আর প্রধান শত্রুই বা কীভাবে একই সময়ে দুটি আলাদা রাজনৈতিক শক্তি হয়? 

দেখলাম, 'এই সময়' পত্রিকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, 'বাংলার বুকে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস যুদ্ধ উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ধ্বংস করতে চাইছে।' এ থেকে খুব স্পষ্ট মনে হয়, ঐক্যের ভিত্তি হল ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট চরিত্র নিয়েই তো বাম দলগুলির মধ্যে জোর বিতর্ক। তাহলে? তথাপি, কালীগঞ্জে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোটের কথা শুনে একটু পরিসংখ্যান দিতেই হচ্ছে। ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১ সালে তৃণমূলের ভোট এখানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮৩৮৯৮, ৯৯৮০৯ ও ১১১৬৯৬। উল্লিখিত তিনটি নির্বাচনে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ১০৩৭৩, ৬২৬১১ ও ৬৪৭০৯। অথচ, সিপিএম-কংগ্রেসের ওই তিন নির্বাচনে যুক্ত ভোট ছিল ৮৫১২৫, ২৫৪২৪ ও ২৫০৭৬। আমি বলতে চাইছি যে, কালীগঞ্জ আসনটিতে বিজেপি যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা অবস্থায় আছে। এখানে বিজেপির যে বাড়বৃদ্ধি তার সমস্ত কৃতিত্বটাই সিপিএম ও বামফ্রন্টের, কারণ, তাদের ভোটগুলিই এক লপ্তে বিজেপির ঝুলিতে জমা হয়েছে। অতএব, এক কথায় বলতে গেলে, কালীগঞ্জ কেন্দ্রে বাম ঐক্যের সামনে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে হারানোর প্রশ্নই নেই, তদুপরি, ফ্যাসিবাদ প্রশ্নে তারা নিজেরাও ঐক্যবদ্ধ নয়। 

এবার তাহলে সিপিআইএমের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অভিমুখ সম্পর্কে কোনও দ্বিধা থাকতে পারে না। সবটাই লাইনে আছে, কোথাও বেলাইন হয়নি। শত্রু হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যের তৃণমূল সরকার। সমালোচনা হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য সরকারের নানাবিধ আর্থিক ভাতা, রিলিফ, যা তাদের ভাষায় 'ভিক্ষা'। নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতিগ্রস্তদের যথাযথ বিচার ও শাস্তি নয়, দুর্নীতির ফলে ভুক্তভোগী সাধারণ চাকুরিজীবী ও চাকুরী প্রার্থীদের আরও জটিলতর অসমাধানযোগ্য অন্ধগলিতে দিশাহীন করা, যার ফলে রাজ্য সরকার বিরোধী একটা গণ অসন্তোষ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি, যে বামপন্থী ভোটের ৬-৭ শতাংশ এখনও বামের ঝুলিতেই আছে এবং অন্তত এক শতাংশ বামপন্থী ভোট 'নো ভোট টু বিজেপি' সিদ্ধান্তের কারণে তৃণমূলের পক্ষে আছে, এই সমস্ত ভোটটাকে যদি একত্রিত করে অন্তত এর অর্ধেকটা বিজেপির ঝুলিতে হস্তান্তর করা যায়, তবে নিশ্চিত ভাবে এ রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন রোধ করা এবং বিজেপিকে ক্ষমতাসীন করা যাবে। আর সেই কারণেই গা বাঁচাতে বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলা যাচ্ছে না।

বিজেপি'র বাংলা-বিহার জয় সম্পূর্ণ হলে আরএসএস-বিজেপি'র চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হবে। তখন নিশ্চয়ই সিপিআইএম দল একটি বিশেষ প্লেনারি অধিবেশন আহবান করে বলতে পারবে– কমরেড, কমিউনিস্টরা ভুল করতে ও ভুল স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। সমস্যা হল, সিপিআইএমের এই চরিত্র সাধারণের কাছে স্পষ্ট। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন যে হঠাৎ এই ভুলের অংশীদার হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হচ্ছে না। 


Saturday, 7 June 2025

বাঙালি মানেই 'বাংলাদেশি'!

ভয়ঙ্কর এক রাজনৈতিক-সংস্কৃতির আক্রমণ  

সোমা চ্যাটার্জি



আজ বিশ্ব জুড়ে পরিচয়ের রাজনীতি আশ্চর্যজনকভাবে জোরদার হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ পুনরুত্থিত হয়েছে। আটলান্টিক জুড়ে পরিচয়বাদের ঢেউ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে উদ্বিগ্ন করছে। এই অবস্থায় এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনে আসে, বাঙালি বা বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? কারণ, ভারতীয় জনতা পার্টি ‘হিন্দু’ পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে যে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শুরু করেছে তাতে বাঙালি জাতি তথা পুরো বাংলা ভাষা আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে; ধর্মের গৈরিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে চলছে ভাষার গৈরিকীকরণ।

বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য 'হিন্দু ঐক্য', অর্থাৎ, ভারতের হিন্দুদের (যারা দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ) তাদের দলের পতাকাতলে এনে যূথবদ্ধভাবে তাদের পক্ষে ভোট দেওয়ানো। সেই সঙ্গে 'ইসলাম বিদ্বেষকে' উস্কানি দেওয়া এবং হিন্দু ধর্মের ভেতর জাতপ্রথার বাস্তবতাকে চাপা দিয়ে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রের গুরুত্ব প্রচার করা। আর এই সংকীর্ণ 'হিন্দু ঐক্যের' রাজনীতির চাপে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় কথা বলা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র সময় থেকে বাংলা ভাষী মুসলমানদের সবাইকে 'অনুপ্রবেশকারী' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, বাংলায় কথা বলা মানেই বাংলাদেশি, এই ধারণাকে তীব্রতর করা হচ্ছে দিনের পর দিন। বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলা ভাষী মুসলমানদের নির্বিচারে আটক ও অবৈধ নির্বাসন চলেছে, যার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি সরব হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের শ্রম মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলার বাইরে ভিন রাজ্যে বাংলার শ্রমিক রয়েছে প্রায় ২২ লক্ষ। অসংগঠিত ক্ষেত্র ধরলে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে এবং এদের প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু, মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য যদি তাদের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হয় তাহলে এটি কেবল অমানবিকই নয়, বেআইনি এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। এই মুহূর্তে ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য নানা ভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে। রাজস্থান, অসম, উত্তরপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড় জুড়ে দরিদ্র বাঙালি মুসলমান শ্রমিকদের (ভারতীয় নাগরিক) কেবল তাদের মাতৃভাষায় কথা বলা বা একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ের জন্য আটক, লাঞ্ছনা এবং অপমানিত করা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি ২৯ মে হুগলি জেলা থেকে যাওয়া কুড়ি জনেরও বেশি বাংলা ভাষী মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের শুধুমাত্র 'বাংলাদেশি' সন্দেহে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে পুলিশ আটক করে রাখে, কারণ, তাঁরা বাংলায় কথা বলছিলেন, যদিও সকলের বৈধ ভারতীয় পরিচয়-নথি ছিল। পরে যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলেও তাঁরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। প্রায় সর্বত্র, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে পুলিস বাংলা ভাষী পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারকে আটকে রাখছে। কোথাও পুলিশ ঝুপড়ি ভেঙ্গে ফেলছে, কোথাও তাতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। চারিদিকে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। ফলে, তাঁরা সবাই নিজের রাজ্যে ফিরে আসতে চাইছেন, তাঁদের রুটি-রুজি বিপর্যস্ত হচ্ছে।

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র বিষয়টি নিয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মন্তব্য করেছিলেন, 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা 'উইপোকা' এবং তারা আমাদের দেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে।' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের নির্মূল করার জন্য নাৎসি জার্মানি ইহুদি সম্প্রদায়কে 'ইঁদুর' বলে অভিহিত করেছিল। একই অনুরণন এই শাসকের সুরে এবং তারই সুপরিকল্পিত প্রতিফলন এইভাবে বাংলা ভাষীদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার প্রচেষ্টায়।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিষয়টিকে মূল ইস্যু করেই বিজেপি ২০১৬ সালের অসম বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। ২০১৪ সালে নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর অসম সফরের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন। ফলত, ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি)'র প্রথম খসড়ায় অসমের ৪০ লক্ষ বাসিন্দাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখানেও উল্লেখ্য যে, আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রের অনুপস্থিতি এবং পারিবারিক নথিতে ত্রুটি, আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং দরিদ্র পরিবারগুলির মধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ সহ আমলাতান্ত্রিক কৌশলে বহু প্রকৃত নাগরিককে 'অবৈধ অভিবাসী'তে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং শাসক দল তার ফায়দা নিয়েছে। এমনকি প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক এবং যাঁরা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বা উচ্চতর আদালতে আইনি আবেদনের অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁদেরও যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের কোনও আদালতে পর্যন্ত হাজির করা হচ্ছে না, ফলে তাঁদের আইনি সুরক্ষার মৌলিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন 'সিটিজেনস অফ জাস্টিস অ্যান্ড পিস'এর তথ্য অনুযায়ী, সারা অসমে প্রায় ৩০০ জন এরকম নথিভুক্ত বাসিন্দা আছেন যাঁদের বিনা কারণে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আজও পর্যন্ত  তাদের মধ্যে ১৫০ জন নিখোঁজ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি), বিচার বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে 'অনিবন্ধিত অভিবাসীদের মোকাবিলায় সরকারকে  ধর্মীয় পরিচয় নয়, আইনের শাসন মেনে চলতে হবে।'

গত ২৭ মে অসমে ১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে বিএসএফ দ্বারা বাংলাদেশে নির্বাসিত করা হলে বিশিষ্ট আইনজীবী ও শিক্ষাবিদদের একটি দল সরকারের কাছে এই ধরনের বহিষ্কার বন্ধ করা এবং সীমান্তে পুশ-ইন করা ব্যক্তিদের ফিরে আসার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে অসমে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিদেশি ঘোষিত বেশ কয়েকজনকে আটক ও বাংলাদেশে বহিষ্কারের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং কিছু ন্যায্য দাবি জানানো হয়, যেমন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নির্বাসন ও ভোটাধিকার বাতিলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নির্বাসিতদের পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা, ডিটেনশন সেন্টার থেকে জামিনে মুক্তিপ্রাপ্তদের গ্রেফতার ও নির্বাসন দেওয়া বন্ধ করা এবং যে নাগরিকদের ইতিমধ্যে জোরপূর্বক বাংলাদেশে নির্বাসিত করা হয়েছে তাদের প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেওয়া যতক্ষণ না উক্ত ব্যক্তির জাতীয়তা ও ঠিকানা বাংলাদেশ দ্বারা যাচাই করা হয়।

গুজরাত ও অসমের মতো রাজ্যগুলি যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাঙালি মুসলমানদের আটক করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি তাদের অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় ১২ জন বাঙালি শ্রমিককে গোলাঘাট জেলার নুমালিগড় এলাকায় দৈনিক মজুর হিসাবে কাজ করার সময় অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে অসম পুলিশ গ্রেফতার করে এবং আধার ও ভোটার আইডি যাচাইয়ের পরও পরিচয়পত্র এবং মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে রাখে। প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী একাধিক হয়রানির ঘটনা সামনে আসার পরে ওড়িশা ও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে বলেছেন, 'বাংলার দরিদ্র, নির্দোষ শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে, এমনকি নির্বাসনের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এটি তাদের জীবন ও জীবিকার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে।' সাম্প্রতিক এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা ভাষী অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানির তীব্র নিন্দা করে তাকে 'বাংলার বাইরের বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক ও অপরাধীকরণের বিজেপি ষড়যন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন। 

বিজেপি'র 'হিন্দু ও হিন্দি' বলয়ে বাংলা তথা বাঙালি জাতিই আজ চাপের মধ্যে, কারণ, খোদ এ রাজ্যেই বাংলা মানুষের কথ্য ভাষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দির আগ্রাসনে বিপন্ন। বাঙালির এক অংশের রক্তে এখন সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ বিষ। রাষ্ট্র ও সমাজে ক্ষমতাবান শ্রেণি বাংলা চর্চা ত্যাগ করে ইংরেজি-হিন্দিমুখী হচ্ছে। সুপরিকল্পিত ভাবে মাতৃভাষার জায়গা দখল করছে হিন্দি ও ইংরেজি। টিভি, রেডিও, রাস্তাঘাট এমনকি সরকারি দফতরেও বিকৃত বাংলায় বিজ্ঞাপন। অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যের ভাষাগত পরিচয়ের রাজনীতির কোনও ইতিহাস নেই, তাই তামিলনাড়ুর মতোই এ রাজ্যে এবং ভিন রাজ্যের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া চলেছে।

বাঙালি সংস্কৃতির মানবিক গুণগুলিই তার স্বাতন্ত্র্য; যেমন, সামাজিক প্রীতি, ধর্মে-বর্ণে অসাম্প্রদায়িকতা। কোনও মানুষই সাম্প্রদায়িক থাকতে চায় না। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আজ সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পড়ছে সংস্কৃতির আনাচে কানাচে। সাম্প্রদায়িক পরিচিতির উপর নির্ভরশীল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্ল্যাটফর্মকে মোকাবিলা করার জন্য চাই সমাজের সব স্তরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এবং তার সঙ্গেই রাষ্ট্রকে আঞ্চলিকতা মুক্ত রাজনীতির জন্য চাপে রাখা।



Monday, 26 May 2025

'নিস্তার নাহি কাহারও সটকে'

কারা যুদ্ধ চায়?

তরুণ লালা



গত ৭ মে ভারতীয় সময় রাত ১:০৫ থেকে ১:৩০-এর মধ্যে, ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে নয়টি স্থানে বিমান হামলা চালায়। এই অভিযানটি 'অপারেশন সিন্দুর' বলে প্রচারিত হয়, যা পহেলগাঁও'এ সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার সরাসরি প্রতিক্রিয়া। সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, 'এই হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী, যেমন জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তইবা'র সঙ্গে জড়িত অবকাঠামোগুলি। এই অভিযান শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে এবং পাকিস্তানি সামরিক বা বেসামরিক স্থানগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।'

তবে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, এতে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং অসামরিক স্থাপনা, যেমন মসজিদের, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খুব স্বাভাবিক, একে অপরকে আড়াল করতে এই ধরনের কিছু বিতর্ক থাকবেই।

ভারতের এই বিমান হামলার পর পাকিস্তান জম্মু অঞ্চলে মর্টার শেল ছুঁড়ে প্রতিশোধ নেয়। কথিত, তাতে ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং গুরুতর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। পরবর্তী কয়েক দিনে এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যার ফলে ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি 'যুদ্ধ'বিরতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের দেশে বেশ কিছু মানুষ এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং দেশের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি ও সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সোফিয়া কুরেশি'র ওপর ভয়ঙ্কর ট্রোল শুরু করে দেয় (অথচ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছেন, সেই সরকার-প্রধানদের বিরুদ্ধে কিন্তু টুঁ শব্দটিও নেই)। এতে সামিল হয়ে পড়ে শাসক দলের কিছু নেতা-মন্ত্রীরাও, যাদের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থা সরব হলেও শাসক দল বা প্রশাসনের তেমন কোনও হেলদোল দেখা যায় না। ফলে, কোন অংশের মানুষ এই যুদ্ধ উন্মাদনার সমর্থক ও প্রচারক তা বেশ স্পষ্ট বোঝাও যায়! 

যদিও এই 'সিন্দুর অভিযান' ভারতের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করে— এটি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তানি ভূখণ্ডে ভারতের সবচেয়ে গভীর অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে আমার সাদা মনে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। এই যে এত রক্তপাত, বিপুল খরচ (যার বোঝা পড়ছে আপনার, আমার এবং সকল করদাতাদের উপর) এবং অসংখ্য প্রাণহানি (আমাদের দিকের)— ওদের দিকের কয়েকজন নিরীহ মানুষকে যদি ছেড়েও দিই— এর আসল ও শেষ উদ্দেশ্যটা আপনার মতে ঠিক কী? তা কি

১) পাকিস্তানকে পুরো দখল করা? 

২) নাকি বালুচিস্তানকে মুক্ত করা? 

৩) নাকি পাক-অধিকৃত কাশ্মীর (POK) অধিগ্রহণ?

৪) নাকি শুধু জঙ্গি/সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করা (তাও কীভাবে? সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে?) 

৫) নাকি পাকিস্তানকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা?

৬) না অন্য কিছু? (দুই দেশেরই কর্ণধারের উদ্দেশ্য হতে পারে এই সুযোগে গদি আঁকড়ে থাকা বা দখল করা। From power (which corrupts) to absolute power (which corrodes)??!)

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, কেবল প্রতিবেশীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার কল্পিত আত্মতৃপ্তির বাইরে গিয়ে সত্যিই জানতে চাই, এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তার ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে। বলাই বাহুল্য, পহেলগাঁও'এর ওই অপরাধ ছিল জঘন্য, বর্বর এবং বীভৎস। কিন্তু, আমরা যদি সেই পাঁচজন হত্যাকারীকে এখনও চিহ্নিতই না করতে পারি, গ্রেফতার বা নিকেশ করা তো দূরের কথা, তাহলে আমরা ঠিক কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি? আর সেইজন্যই জানতে চাই, এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? ওপরের যে বিকল্পগুলো বললাম, তার কোনটি?

কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনও সদুত্তর পেলাম না। উল্টে আমার এক প্রতিবেশী, যিনি একজন প্রথিতযশা CA, তাঁর এমন এক প্রতিক্রিয়া পেলাম (অনুরূপ কথা আরও কেউ কেউ বলেছেন) যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়: 

'আমি এখনও মনে করি যে ভারত একটি বিশাল ভুল করেছে, যখন পাকিস্তানের ওপর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও আমরা পিছিয়ে এসেছি। আমাদের উচিত ছিল পাকিস্তানকে পাঁচটি ভাগে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা— বেলুচিস্তান ও সিন্ধকে স্বাধীন করে দিয়ে, এবং PoK ও গিলগিট-বালতিস্তানকে ভারতের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করে নেওয়া। এখন PoK ও গিলগিট অংশ খুব শীঘ্রই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) দ্বারা দখল হয়ে যাবে এবং ভারতের নাগালের বাইরে চিরতরে চলে যাবে।'

তিনি আরও যোগ করেন:

'বাংলাদেশ সীমান্তেও একই অবস্থা। আমাদের উচিত ছিল, এবং এখনও সম্ভব, আমাদের 'চিকেনস নেক'-এর পাশের ওপরের অংশ (রংপুর অঞ্চল) কেটে আলাদা করা এবং তাদের 'চিকেনস নেক' কেটে চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়া। কিন্তু আমাদের সরকার পাছে সারা বিশ্ব কী বলবে, সেই চিন্তায় জর্জরিত। আমরা খুবই বেশি ‘গণতান্ত্রিক’। খুব শীঘ্রই চীন লালমনিরহাটে (আমাদের চিকেনস নেক-এর একেবারে গায়ে) একটি বিশাল বিমানঘাঁটি গড়ে তুলবে এবং কিছু অর্থের বিনিময়ে দরিদ্র বাংলাদেশের থেকে চট্টগ্রাম বন্দরও নিয়ে নেবে। এরপর আমাদের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ ধীরে ধীরে চীনের দখলে চলে যাবে। আর সমতল ভূমিতে, বিশেষ করে বাংলার ফ্রন্টে, আমরা তাদের আটকানোর মতো শক্তি রাখি না। আমাদের সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে আমাদের পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব তিন দিকেই বিষ ফল মেনে নিয়ে আমাদের দেশকে আরও ছোট হয়ে যেতে দিতে হবে।'

উপরের এইসব প্রলাপ সম্পর্কে বক্তব্য পরে রাখব, আগে সামান্য ভাবা যাক, সত্যিই যদি যুদ্ধ বাঁধত তাহলে পরিস্থিতি কী হত:

১) সামরিক প্রভাব

ব্যাপক প্রাণহানি:  হাজার হাজার সৈনিক ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার আশঙ্কা, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, রাজস্থান ও জম্মু-কাশ্মীরে। কিছু নিরীহ প্রাণহানি তো ঘটেওছে;

পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি: উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা উভয় দেশের জন্যই ধ্বংসাত্মক। একে আষাঢ়ে গল্প বলে ফেলে দেওয়া যাবে না;

সামরিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি: অপরিসীম আর্থিক ক্ষতির বিনিময়ে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস হওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা;

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ঝুঁকি: যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সেনাবাহিনী অতিরিক্ত চাপে পড়বে এবং অন্য সীমান্ত (যেমন চীনের সঙ্গে) দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

২) অর্থনৈতিক প্রভাব

শেয়ার বাজারে ধস: যুদ্ধ শুরু হলে বাজারে ব্যাপক পতন হবে, যার ফলে কোটি কোটি টাকার আর্থিক সম্পত্তির ক্ষয় হবে (যা সংঘর্ষ শুরু হতেই বেশ মালুম হয়েছে);

বৈদেশিক বিনিয়োগ স্থগিত: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বাজারে চলে যাবে, উভয় দেশের প্রতি আস্থা হারাবে;

বাণিজ্য ব্যাহত হবে: শিল্প রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বিশেষত আইটি, ফার্মা, গার্মেন্টস ইত্যাদিতে;

মুদ্রার মূল্যের পতন: ভারতীয় টাকার মূল্য অবশ্যই পড়ে যাবে, যার ফলে আমদানির খরচ এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে;

তেলের দামের উর্ধ্বগতি: যুদ্ধজনিত অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়বে, যা ভারতের আর্থিক ভারসাম্যে বড় ধাক্কা দেবে;

অর্থ বরাদ্দের পুনর্বিন্যাস: বিশাল পরিমাণ অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করতে হবে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিকাঠামোর বরাদ্দ থেকে কেটে নিতে হবে।

৩) সামাজিক ও নাগরিক প্রভাব

মানুষের স্থানচ্যুতি: সীমান্ত এলাকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হবে।

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ধর্মীয় বিভাজন বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর সন্দেহ বাড়তে পারে, যা হিংসা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে;

সন্ত্রাসী প্রতিক্রিয়া: জঙ্গি সংগঠনগুলো এই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বড়সড় হামলা চালাতে পারে।

৪) রাজনৈতিক প্রভাব

উগ্র জাতীয়তাবাদ বাড়বে: প্রাথমিক ভাবে চলতি সরকার 'দেশপ্রেমে'র জোয়ারে অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা পেতে পারে;

দীর্ঘমেয়াদে অসন্তোষ: যদি যুদ্ধ দীর্ঘ হয় এবং প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতি হয়, জনরোষ বাড়বে;

গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস: সেন্সরশিপ, কারফিউ, নজরদারির মতো পদক্ষেপ বাড়বে। অভ্যন্তরীণ 'ইমারজেন্সি' ঘোষিত হতে পারে। তার বিরূপ ফলে আমরা আগেই ভুক্তভোগী;

নির্বাচনে প্রভাব: যুদ্ধের ফলাফল রাজনৈতিকভাবে সরকারকে সাহায্য বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৫) আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রভাব

ভারতের ভাবমূর্তিতে ধাক্কা: ভারত শান্তিপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে উপস্থাপন করতে চায়—যুদ্ধ সেই ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে;

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মিত্রদের চাপ: যুদ্ধ হলে কৌশলগত অংশীদারিত্বগুলো প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে;

চীনের সুযোগ: চীন কূটনৈতিক বা সামরিকভাবে সুযোগ নিতে পারে, বিশেষ করে লাদাখ সীমান্তে;

জাতিসংঘের চাপ: মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে ভারত আন্তর্জাতিক চাপ বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে।

৬) মানবিক বিপর্যয়

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ: গোলাবর্ষণ, বিদ্যুৎ বিপর্যয়, খাদ্য ও জলের সংকট, ঘরবাড়ি ধ্বংস ও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে;

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধসে পড়বে: হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব হবে;

মানসিক আঘাত: যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হবে।

আমরা শেষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ দেখেছি ১৯৭১ সালে। পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হতে পারে সেটা আজকের জমানার কেউ ভাবতেও পারবে না। আজ রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে দুই দেশের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আমরা সকলেই অবগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা ইউরোপের কী ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল তা আমরা কেউ ভুলিনি। যে সমস্ত রাজনৈতিক লোকেরা ঘরের নিশ্চিন্ত কোণে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের গর্জন শোনাচ্ছে ও প্রলাপ বকছে, তারা বা তাদের সন্তান-সন্ততিরা কখনই কোনও যুদ্ধে যায় না, এমনকি সমাজে সংঘটিত কোনও ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে রাস্তার জলে-রোদে নেমে প্রতিবাদটুকুও করে না, মজার ব্যাপার, সেই তারাই আজ যুদ্ধের সব থেকে বড় প্রচারক।

আমরা আশ্বস্ত যে, ভারত-পাক সংঘর্ষ তিনদিনের বেশি গড়ায়নি ও যে ভাবেই হোক আপাত বিরতি ও শান্তি ঘোষিত হয়েছে। 


Saturday, 24 May 2025

মধ্যবিত্তের পড়তি আয়

মধ্যবিত্ত কি প্রায়-বিলোপের পথে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

সারা বিশ্বে যেমন, তেমন আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে, কাজ অনেক মিলছে বটে, যদিও অধিকাংশ কাজগুলিই অস্থায়ী চরিত্রের, কিন্তু আয় নামছে নিচের দিকে। একমাত্র ব্যতিক্রম ঠিকা মজদুর ও সরকারি চাকরির কর্মক্ষেত্র। ঠিকা মজুরদের দৈনিক আয় বাড়ছে, কারণ, সেখানে চাকরির অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বালাই নেই, বরং, তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারলে মজুরি বাবদ খরচ সর্বমোটে কমই পড়ে। আর অন্যদিকে সরকারি কর্মক্ষেত্রে ডিএ বাড়ে, না বাড়লে মামলা করে আদায়ও করা যায়, নতুন বেতন কমিশন বসে; লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন যখন সরকারি কোষাগার ঋণ করেও টানা যায়।

আসলে, মধ্যবিত্ত সমাজই পড়ে গেছে এক মহা ফ্যাসাদে। এই যে ফুরফুরে আইটি সেক্টর, যাদের কর্মীদের ঠাটবাটে এক সময়ে সরকারি কর্মচারীরাও লজ্জা পেতেন, দেখা যাচ্ছে, গত ২০১১ সালে আইটি সেক্টরে নতুন কর্মীর বার্ষিক আয় যেখানে শুরু হত ৩.২ লক্ষ টাকা থেকে, ২০২৪’এ এসে তা শুরু হচ্ছে ৩.৫ থেকে ৩.৭ লক্ষ টাকায়। ১৩ বছরে আয় বৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ, বছরে ১ শতাংশেরও কম। অথচ, মুদ্রাস্ফীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৪ থেকে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১ সালে আইটি সেক্টরে কাজ করতে ঢোকা কর্মীটি যতটুকু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতেন, আজ যিনি কাজে ঢুকছেন তাঁর সে স্বাচ্ছন্দ্য অনেক অনেক কম।  

এক সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজের এক বৃহৎ অংশ ছিল সরকারি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের কর্মচারীরা, যেমন বড় বড় রাষ্ট্রীয় ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, ব্যাঙ্ক, বীমা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রের শ্রমিক, বাবু ও আমলারা। গত তিন দশকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বিদায় হয়েছে, সরকারও কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে, ফলে, এক বড় অংশের জনতা মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আর বেসরকারি ক্ষেত্রেও কর্মী নিয়োগ বেশ সংকুচিত, যারা আছে তাদের আয় পড়তির দিকে, অতএব, এই অংশের মধ্যবিত্তরাও এখন বিলোপের পথে। হিসেব নিয়ে দেখুন, আইআইটি’এর মতো প্রিমিয়ার প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২৪ সালে পাশ করা ছাত্রদের ৩৮ শতাংশ কোনও চাকরিই পায়নি। তাহলে বাকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কী অবস্থা তা তো বোঝাই যাচ্ছে! আর যারা চাকরি পায়, তাদের একটা বড় অংশের মাইনেপত্রের অবস্থা কিন্তু যথেষ্ট করুণ। রইল বাকী কিছু পেশাদারি কাজ, যেমন, ডাক্তারি, ওকালতি, শিল্পকর্ম, পরামর্শ-প্রদান প্রভৃতি সহ শিক্ষকতা, স্বাস্থ্যকর্ম, মাঝারি দোকানদারি বা ব্যবসা, গবেষণা, যেখানে রীতিমতো লড়ে জায়গা তৈরি করতে হয়, সকলের নিশ্চিত ভালো রোজগার যে হয় তাও নয় এবং জনসংখ্যার অনুপাতেও এরা নগণ্য।

কেন এই পরিণতি? আর আমরা যাচ্ছিই বা কোন পানে?

এর পিছনে সর্বপ্রধান কারণ দুটি: এক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে বহু কাজের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, যা যন্ত্রসমাজ আরও নিপুণ ভাবে করে দিতে সক্ষম। তাই, মনুষ্যশ্রমেরও নিয়োগ পূর্ণ ও আংশিক উভয় মাপেই ক্রমশ কমছে। যারা এখনও কাজে থাকছেন তাদেরও বিদায় যেহেতু নিকটবর্তী তাই মজুরি বা মাইনে বাড়ার প্রশ্নও আর নেই; দুই, খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে লাগামছাড়া খরচ, অতি-উচ্চ বাড়ি ভাড়া, তার ওপর ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ-সুবিধা প্রশস্ত হওয়ায় গাড়ি-বাড়ি-পণ্য ক্রয়ে ঋণের চাপ— এইসব বিবিধ জাঁতাকলে মধ্যবিত্ত সমাজ আরও বিপদগ্রস্ত। ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, আমাদের দেশে গৃহস্থালী ঋণ বেড়ে এখন জিডিপি’র ৪২.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আয়ের পতন অন্যদিকে খরচের ভার, তারপর যদি তা লাগামছাড়া ঋণের জালে আটকে পড়ে, তাহলে আত্মহনন। দেখা যাবে, গত কয়েক বছরে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্তের আত্মহত্যার সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে।

যদিও তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ মধ্যবিত্ত, যাদের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা, এবং কারও কারও অনুমান, ২০৩১ সালে গিয়ে তা পৌঁছবে ৩৮ শতাংশে। কিন্তু তা কি সত্যি পৌঁছবে? প্রথমত, পড়তি আয়ের নিরিখে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ যে নিম্নবিত্ত হয়ে পড়ছে ও দ্বিতীয়ত, সর্বত্র স্থায়ী চাকরির সংকোচন ও যেটুকু বা নিয়োজন তাও খুব কম মাইনেতে, ফলে, মধ্যবিত্ত সমাজে নতুন জনসংযোজন কিন্তু অপ্রতুল।

তাই, সমাজটা ক্রমেই অতি ধনী ও নিম্নবিত্ত— এই দুই বর্গেই ভাগ হয়ে পড়ছে, যেখানে মধ্যবর্তী এক বিশাল মধ্যবিত্ত সমাজের যে অস্তিত্ব গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছিল তার বাস্তবতা আর থাকছে না। যেটুকু যতটা এখনও আছে, তা রেশ মাত্র, কতকটা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে আগের প্রজন্মের গচ্ছিত অর্থ ও সম্পদের জেরে আরও কিছুকাল বয়ে চলা। অথচ নতুন বাস্তবতা হল, অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও কমছে— নিম্নবিত্ত মানুষ কিন্তু দরিদ্র নয়, আবার মধ্যবিত্তও নয়, কারণ, তাদের বার্ষিক আয় আমাদের দেশের নিরিখে ৫ লক্ষ টাকার নিচেই।

দাঁড়াচ্ছে এই, গড়ে উঠতে থাকা বিশাল এই নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষেরা বেঁচে থাকবে নানাবিধ খুচরো ও অস্থায়ী কাজে যুক্ত থেকে এবং সরকারি জনকল্যাণ প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে। এই জনকল্যাণের প্রকল্পই তাদের দরিদ্র হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে। তাই আজ অর্থনৈতিক ভাবে জনকল্যাণের রাজনীতির এতটাই গুরুত্ব। নিম্নবিত্তদের মধ্যে থেকে বিশেষ কেউ কেউ পেশাদারি সাফল্যে মধ্যবিত্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারে, কেউ বা অতি ধনীও হতে পারে, কিন্তু দুই বর্গের আয়ের তুমুল বৈষম্যই হবে সাধারণ ভাবে কঠিন বাস্তবতা। এটাই পুঁজিবাদের আজকের নতুন ধরন। কারণ, সমাজটাই পরিচালিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন এক যন্ত্রসমাজের দ্বারা যারা একদিকে সামাজিক উদ্বৃত্ত উৎপন্ন করতে ও অতি মুনাফার পাহাড় জমাতে সক্ষম, অন্যদিকে সেই উদ্বৃত্তের কিছুটা ভাগ দিয়ে সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্য মোচনেও ওস্তাদ।

তাই, পুঁজিবাদের আজ আর বহু মানুষ সম্বলিত মধ্যবিত্ত সমাজের দরকার নেই, কারণ, ‘white-collar job’ বলে যে মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক কাজগুলি এতদিন তারা করে এসেছে, তা আজ যন্ত্রসমাজ আরও নিপুণ, নিখুঁত ও ত্বরিৎ গতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম।

                

Friday, 23 May 2025

বানু মুশতাক

'সাহিত্য এখনও সেই পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি...'

আবু সঈদ আহমেদ



কন্নড় লেখিকা, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী বানু মুশতাক তাঁর ছোটগল্প সংকলন 'হার্ট ল্যাম্প'এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার (২০২৫) জিতে কন্নড় ভাষায় এই প্রথম ইতিহাস তৈরি করেছেন। বিচারকরা তাঁর গল্পের চরিত্রদের প্রশংসা করেছেন এই ভাষায়, 'astonishing portraits of survival and resilience.'। তাঁর এই সম্মাননার আগে আমরা বাঙালিরা কজন তাঁকে চিনতাম বা তাঁর কাজ সম্পর্কে জানতাম? সত্যিই কি আমরা এই বৈচিত্র্যময় দেশে পরস্পরকে এখনও চিনি?

তাঁর নিজের কাজ সম্পর্কে এই বিরল সম্মাননার অধিকারী মুশতাক বলেন, 'এই বইটির জন্ম এই বিশ্বাস থেকে যে, কোনও গল্পই কখনও ছোট হয় না; মানুষের অভিজ্ঞতার ছন্দে প্রতিটি সূত্রই সমগ্রের ওজন ধারণ করে। ... যে বিশ্ব প্রায়শই আমাদের বিভক্ত করার চেষ্টা করে, সাহিত্য এখনও সেই শেষ পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে আমরা একে অপরের মনের ভিতরে বাস করতে পারি, এমনকি কয়েক পৃষ্ঠার জন্যও।'

বানু মুশতাক ১৯৪৮ সালের ৩ এপ্রিল কর্নাটকের হাসানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বেড়ে ওঠা কর্নাটকের পাহাড়ি মালনাড় অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রামে। পরে তিনি ব্যবসায়ী মহিয়উদ্দিন মুশতাকের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তাঁর লেখালেখির শুরু ১৯৭০-এর দশকে এবং ১৯৭৪ সালে 'প্রজামাথা' নামে একটি সাময়িকীতে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে তিনি কবি ও লেখক পি লঙ্কেশ (নিহত সমাজকর্মী ও সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের পিতা) সম্পাদিত ট্যাবলয়েড 'লঙ্কেশ' পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি কন্নড় সাহিত্যের বান্দায়া আন্দোলনের সঙ্গে  জড়িয়ে পড়েন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য এই আন্দোলন প্রতিবাদের ঐতিহ্যে চিহ্নিত হয়েছিল, যা মুসলমান ও দলিত সহ প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে সে আন্দোলনে স্থান দেয়। ১৯৮৩ সালে তিনি হাসান সিটি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন; দুটি মেয়াদে এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে মুশতাক সাংবাদিকতা ছেড়ে তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আইনজীবী হিসেবে জীবিকা শুরু করেন।

বছরের পর বছর ধরে মুশতাকের লেখা অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ স্থানীয় ও জাতীয় পুরস্কার জিতেছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্নাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং দানা চিন্তামণি আত্তিমব্বে পুরস্কার। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রকাশিত মুশতাকের পাঁচটি ছোটগল্প সংকলনের অনূদিত ইংরেজি সংকলন - 'হাসিনা এবং অন্যান্য গল্প' - ২০২৪ সালে PEN অনুবাদ পুরস্কার জিতেছে। ২০০০ সালে 'মুসলমান মহিলাদের মসজিদে প্রবেশের অধিকারের পক্ষে' তাঁর প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় মুশতাক এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তিন মাসের 'সামাজিক বয়কট' ঘোষণা করা হয়। সেই সময় তিনি ভয়ঙ্কর সব টেলিফোন কল পান এবং একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করে কিন্তু তাঁর স্বামীর সাহায্যে সেদিন তিনি বেঁচে ফেরেন। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে চিকমাগালুর জেলার বাবা বুদানগিরিতে মুসলমানদের একটি সমকামী মাজারে যেতে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে মুশতাক নাগরিক সমাজের দল 'কোমু সৌহার্দ বেদিক'এ যোগ দেন। মুশতাক স্কুলে মুসলমান শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার অধিকারকে সমর্থন করেছেন, যা কর্নাটকের আদালতে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

তাঁর একটি গল্প 'কারি নাগরাগালু' (কালো গোখরো) যা 'হার্ট ল্যাম্প'-এ অন্তর্ভুক্ত, গিরিশ কাসারাবল্লির পুরস্কারপ্রাপ্ত কন্নড় ছবি 'হাসিনা'-তে (২০০৪) চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। প্রধান অভিনেত্রী তারা হাসিনা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন। এই গল্পের কাহিনি এক ভারতীয় মুসলমান মহিলাকে নিয়ে যে তার স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। গল্পে হাসিনা তার মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অটোচালক ইয়াকুবকে বিয়ে করে। এই দম্পতির তিন মেয়ে: দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মুন্নি, শুব্বি ও হাবিবা। তাদের চতুর্থ সন্তান যখন গর্ভে, তারা সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য গর্ভাবস্থা স্ক্যান করে। যখন ইয়াকুব জানতে পারে যে সেটি আরও একটি মেয়ে, তখন সে পালাক্রমে নির্যাতনকারী ও অবহেলাকারী হয়ে ওঠে। অবশেষে হাসিনাকে পরিত্যাগ করে।

বানু মুশতাক তাঁর ছয় দশকের দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে ৬০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পগুলি ইতিমধ্যেই ছয়টি সংকলনে প্রকাশিত। ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মুশতাকের লেখা ১২টি ছোটগল্প সম্বলিত 'হার্ট ল্যাম্প' দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মুসলমান নারীদের কষ্টের কথা মর্মস্পর্শী ভাবে তুলে ধরেছে। তাঁর এইসব অসাধারণ গল্পগুলির মধ্যে সেরা কয়েকটি হল: হেজ্জে মুদিদা হাদি (১৯৯০), বেঙ্কি মালে (১৯৯৯), এদেয়া হানাতে (২০০৪), সাফিরা (২০০৬), হাসিনা মাত্তু ইতারা কাঠেগালু (২০১৫) ও হেন্নু হাদিনা স্বয়ম্বরা (২০২২)। গল্পগুলি কর্নাটকে কথিত কন্নড় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জেতা প্রথম ভারতীয় অনুবাদক ভাস্তি বলেন, তিনি আশা করেন যে এই পুরস্কার কন্নড় ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ভাষার সাহিত্য এবং অনুবাদের কাজকে বিপুল ভাবে উৎসাহিত করবে।

ভারতে বইটির প্রকাশক পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া'র প্রধান সম্পাদক মানসী সুব্রহ্মণ্যম বিবিসিকে বলেন যে এই পুরস্কার আঞ্চলিক সাহিত্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য জয়। তাঁর ভাষায়, '২০২২ সালে 'টম্ব অফ স্যান্ড'এর ঐতিহাসিক জয়ের পর (গীতাঞ্জলি শ্রী'র বইটি হিন্দি থেকে ডেইজি রকওয়েল অনুবাদ করেছিলেন) এই বছর 'হার্ট ল্যাম্প'এর সম্মান এমন একটি শক্তিশালী স্মারক যে তা ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের প্রতি আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে।'


Sunday, 18 May 2025

এবার বলতে বাকী 'জয় শ্রীট্রাম্প'

সেনাবাহিনীকেই আক্রমণ?

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



কুঁয়ার বিজয় শাহ'র পর জগদীশ দেবড়া! ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অসম্মান করতে বেপরোয়া। কুরুচিকর মন্তব্যে এঁরা কেউ কম যান না।

যে সেনাবাহিনী সন্ত্রাস ও তার মদতদারদের চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রতি কু বা অবমাননাকর মন্তব্য করা কেন? আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এসব অপকর্ম হঠাৎ করে বা মুখ ফসকে নয়, এটা দীর্ঘ লালিত এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ম্যানিফেস্টেশন। কারণ, দেখাই যাচ্ছে, আদালতের কড়া ধমকের পরেও প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিজয় শাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও হেলদোলই নেই। মনে রাখতে হবে, উগ্র জাতীয়তাবাদ হয়তো রাজনৈতিক দলের জন্য সাময়িক ডিভিডেন্ড এনে দিতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় তা রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হয়ে উঠলে সাড়ে সর্বনাশ। বিপন্ন সময়ের সেই ধ্বনিই এখন শুনতে পাচ্ছি। আমার বলতে দ্বিধা নেই, সেই গোধরা পর্ব থেকে এখন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহযোগীরা কোনও রাজধর্ম পালন করেননি, কুর্শি'তে বসে স্রেফ সেলফ-মেড 'হিন্দুধর্ম'এর রাজনীতি করে চলেছেন। 

আচ্ছা বলুন তো, মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী দফতরের মন্ত্রী কুঁয়ার বিজয় শাহ কেন হঠাৎ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে টার্গেট করলেন? আগে দেখে নেওয়া যাক বিজয় ঠিক কী বলেছেন। তিনি বলেন, 'ওরা আমাদের হিন্দু ভাইদের পোশাক খুলে ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীজী ওদের বোনকে ওদের বাড়িতে হামলার জন্য পাঠিয়েছেন। ওরা আমাদের বোনকে বিধবা করেছে, তাই মোদীজী ওদের সম্প্রদায়ের বোনকেই ওদের পোশাক খুলে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন।' এই মন্তব্যে কোথাও কর্নেল সোফিয়া কুরেশির নাম না নিলেও মন্তব্য যে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অপারেশন সিঁদুরের পর দেশকে সেই ঘটনার ব্রিফ করেছিলেন সেনাবাহিনীর তরফে কর্নেল কুরেশি। তাঁকে 'জঙ্গিদের বোন' বলে উল্লেখ করাটা শুধু সোফিয়াকে নয়, গোটা সেনাবাহিনীকে অসম্মান। কেননা, এই ব্রিফিং করতে কেউ নিজের ইচ্ছে মতো এসে বসে পড়তে পারেন না। সেনাকর্তাদের কম্যান্ডেই এটা হয়।

ফলে, আদতে সেনাবাহিনীকেই ছোটো করা। আর সেটাই যে বিজেপির একাংশের মানসিকতা, তা পরমূহুর্তেই প্রমাণ করে দিলেন জগদীশ দেবড়া। মধ্যপ্রদেশের এই উপমুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমি অপারেশন সিঁদুরের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আজ গোটা দেশ, দেশের সেনাবাহিনী ও প্রত্যেক জওয়ান ওঁর চরণে মাথা নত করেছে। ওনার চরণে নতমস্তক হয়েছে গোটা দেশ। কারণ, উনি যোগ্য জবাব দিয়েছেন। যা বলেছিলেন তাই করেছেন।' এই বক্তব্যের ভিডিও দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। দেশপ্রেমী মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদবের ডেপুটির এই মন্তব্যকে সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত অসম্মান বলে মনে করছেন। সেনার গায়ে রাজনীতির রঙ লাগিয়ে ভোট রাজনীতিতে সাফল্য কুড়োতে চাইছে বিজেপি। অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যকে ব্যক্তি মোদীর সাফল্য বলে তুলে ধরতে চাইছে। তবে এর চেয়েও মারাত্মক, এই সাফল্যর ধুনিতে মুসলিম বিরোধী জিগির তোলা হচ্ছে। 

বিজয় শাহদের মতো বিজেপিওয়ালাদের সেনার ওপর সবচেয়ে বেশি ক্ষোভের কারণ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে এগিয়ে দেওয়ায়। এই লড়াকু ভারত কন্যা ইসলামাবাদের মসজিদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হানার প্রতিবাদ করে স্পষ্ট  বলেছেন, 'ভারত কোনও ধর্মস্থানে আঘাত করেনি, কেননা, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।' আমার ধারণা, সোফিয়ার মুখে  'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটা শুনেই তাদের মাথায় আঘাত লেগেছে। আরএসএস থেকে বিজেপি, এরা সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি বাদ দিতে বহুদিন থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদের একটি অতিপ্রিয় গালি হল, 'সেকু'। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেই তাকে 'সেকু' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক এখান থেকেই যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলের ওপর বিজেপি চড়াও হচ্ছে। খাস কলকাতার বুকে এ কাণ্ড ঘটেছে। গত বুধবার রাতেও বারাসতের টালিখোলার আরিফবাড়ি এলাকায় মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী বাপ্পা ভূঁইয়ার বাড়িতে এদের একটি বড় দল চড়াও হয়। মৌলালিতে যুদ্ধ-বিরোধিতার পক্ষ নিয়ে পথে নামা লোকজনের দলে ছিলেন বাপ্পার মেয়ে। অভিযোগ, তাঁর পোস্টকে দেশ বিরোধী বলে দাবি করে হামলাকারীরা শাসানি দিয়ে গেছে যে, মেয়েকে ক্ষমা চাইতে হবে। কোনও সহনাগরিক যদি ওদের পঙক্তিতে না পড়ে, তবে তার অসীম দুর্বিপাক। একজন সহনাগরিকের যে প্রশ্ন করার অধিকার থাকতে পারে, ভিন্ন মত থাকতে পারে, এ কথা তারা বিশ্বাসই করে না। শুধু তাই নয়, আমাদের মতো যারা যুদ্ধবিরোধী, তাদের ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার করে বিচার চায় তারা।

মানে আমি-আপনি কেউ বলতে পারব না, আমরা যুদ্ধ চাই না। বলতে পারব না, যুদ্ধ কোনও সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে পারে না। অথচ নরেন্দ্র মোদী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বলতে পারেন যে, 'যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়, আলোচনা করেই সঙ্কট মেটাতে হবে।' ঠিক আছে, মোদীর বেলা ছাড়। তিনি বিশ্বগুরু, তাই তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতা আর আমার মতো এলিতেলি গুজরালির ব্যক্তি স্বাধীনতা কখনই এক মাত্রার নয়। 

ওহে ভক্তকুল, আমি না হয় আপনাদের মতো যুদ্ধবাজই হলাম। দুর্যোধনের মতো বললাম, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। কিন্তু তারপরেই যে প্রশ্নটি আমার মাথায় আসছে, অপারেশন সিঁদুর লঞ্চ করে আমরা যখন 'পাকিস্তানকে পেড়ে ফেলেছিলাম', 'গুঁড়িয়ে দেওয়া' হয়েছিল পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জঙ্গি ঘাঁটি আর সেই অবস্থায় গোটা দেশবাসী যখন পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দাবিতে ফুঁসছিলেন, যখন আমরা যুদ্ধবাজ ভক্তরা ভাবতে শুরু করেছিলাম (গোদি মিডিয়াও ভিডিও গেমসে সে সব দেখাচ্ছিল), দু'-একদিনের মধ্যে ঘুম থেকে উঠে দেখব লাহৌরের রাজপথে শিস দিতে দিতে ভারতীয় সেনা ঘুরে বেড়াচ্ছে, করাচি বন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের নৌসেনা, ঠিক তখনই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সেই স্বপ্নভঙ্গ করে দেওয়া হল কেন? আরও আশ্চর্য, যুদ্ধবিরতি বা সংঘর্ষ বিরতি ঘোষণা করলেন ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! তাঁর নিজের 'ট্রুথ' সোশ্যাল হ্যান্ডলে সিজফায়ারের ব্রেকিং দিয়েছিলেন তিনি! সমাজমাধ্যমে তাঁর ঘোষণায় সারা বিশ্ব জেনে গেল সংঘর্ষ বিরতির কথা। এরপর মুখ রাখতে আমাদের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি সংক্ষিপ্ততম সাংবাদিক সম্মেলনে সিজফায়ার ঘোষণা করলেন বটে, কিন্তু এমন কাণ্ডে ৫৬ ইঞ্চি কি এক ধাক্কায় ২৬-এ নেমে এল না! যদিও ভারত গত কয়েক দিনে সরাসরি ট্রাম্পের নাম না করলেও ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে সংঘর্ষ বিরতির সিদ্ধান্ত ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক। কিন্তু তারপরও অন্তত আরও তিনবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি ছিল, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনিই।

এমনকি বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও ট্রাম্প নিঃসংশয়ে বলেন, 'পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। হঠাৎ করে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দেখা দিতে শুরু করল। আমরা এটিকে থামাতে পেরেছি। দু’দিন আগেও আমার মনে হচ্ছিল, হয়তো এটির সমাধান হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সমস্যা মিটে গিয়েছে। আমরা ওদের (ভারত এবং পাকিস্তান) সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমরা বলেছিলাম যুদ্ধের বদলে ব্যবসা করার কথা।' আর কিছুটা হুমকির সুরেই ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রশাসন ভারত এবং পাকিস্তানকে বলেছিল সংঘর্ষ বন্ধ না-করলে আমেরিকা দুই দেশের সঙ্গে কোনও বাণিজ্য করবে না। ভারত-পাকিস্তানকে একাসনে বসিয়ে যেন তিনিই সবক শেখালেন, ভাবখানা তেমনই। ট্রাম্পের এই ঔদ্ধত্য বহু দেশপ্রেমী ভারতীয়কে আঘাত দিলেও দিল্লির শাসকদের যে কিছু এসে যায়নি তা তাদের নীরবতা দেখেই সকলে বুঝেছেন।

অবশ্য আমাদের বিদেশমন্ত্রক সাংবাদিক সম্মেলন করে জানায় যে, গত ৭-১০ মে'র (ভারত-পাক সংঘর্ষের সময়) মধ্যে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আলোচনাতেই বাণিজ্যের প্রসঙ্গ আসেনি। যদি নাই আসে তবে অ্যাপেল নিয়ে ট্রাম্প কেন পরোক্ষ থ্রেট দেবেন? বাণিজ্য মহলের খবর, অ্যাপলের সিইও টিম কুকের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে ট্রাম্প নাকি তাঁকে স্পষ্ট চেতাবনি দেন, 'তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু শুনছি তুমি নাকি গোটা ভারত জুড়ে আইফোনের উৎপাদন বাড়াতে চাইছ। আমার কিন্তু সেটা মোটেই পছন্দ নয়। চাইলে তুমি ভারতে অ্যাপেলের পণ্য তৈরি করতেই পার। কিন্তু ভারতে শুল্কের হার খুব বেশি। তাই ভারতে অ্যাপেলের পণ্য বিক্রি করা খুব কঠিন হবে।' ট্রাম্পের দাবি, ভারত নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এমন নীতি গ্রহণ করবে যেন মার্কিন পণ্যে কোনও শুল্কই না থাকে। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প চান না ভারতে অ্যাপেলের কারখানা হোক। 

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হল, সাংসদ-অভিনেত্রী তথা মোদীভক্ত কঙ্গনা রানাউত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে এক্স হ্যান্ডেল'এর পোস্টে লেখেন, 'ভারতের প্রতি ট্রাম্পের ভালোবাসা হারানোর কারণ হল, প্রথমত, তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় রাষ্ট্রনেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী; দ্বিতীয়ত, এটা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ কিন্তু নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদ এবং তৃতীয়ত, ট্রাম্প নিঃসন্দেহে একজন আলফা মেল হলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন সব আলফা মেলদের বাবা। আপনাদের কী মনে হয়? এটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা নাকি কূটনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা?’ কিন্তু বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা অভিনেত্রীকে কড়া ধমক দিলে কঙ্গনা রানাউত বিস্ফোরক পোস্টটি ডিলিট করে দেন। আরও হাস্যকর, সে কথা জানিয়ে কঙ্গনা লিখেছেন, ‘সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডাজী আমাকে ফোন করে ট্রাম্প-টিমকে নিয়ে করা পোস্টটি মুছে ফেলতে বলেন। তাই ডিলিট করে দিলাম। আমার ইনস্টাগ্রাম থেকেও সেই পোস্ট ডিলিট করলাম। ধন্যবাদ।’

তার আগে গত ১০ এপ্রিল নিয়ম মতো ভারতের তরফে সংবাদমাধ্যমের কাছে যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করেন বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি। আর যায় কোথা! সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা গেরুয়া শিবির ঝাঁপিয়ে পড়ে মিস্রি'র ওপর। রবিবার সকাল থেকে এক্স-হ্যান্ডলে দেশের বিদেশ সচিবকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শুরু করে ভক্ত বাহিনী। গেরুয়া শিবিরের ট্রেনিং প্রাপ্ত এই ট্রোল-বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাননি বিক্রম মিস্রি'র কন্যা ও তাঁর গোটা পরিবার। কতটা অসহায় অবস্থায় পড়লে শেষ পর্যন্ত সমাজ মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টটি লক করে দিতে বাধ্য হন বিদেশ সচিব। ভাবুন, মোদী সরকারের বিদেশ সচিব যদি এই 'ফ্যাসিস্ত' বাহিনীর হাত থেকে রেহাই না পান, তবে আমার-আপনার হাল কী? দেশের বিদেশ সচিবের পারিবারিক ছবির নীচে ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে কুৎসা করার পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করায় বিদেশ সচিবের আইনপড়ুয়া মেয়েকেও আক্রমণ করা হয়। এমনকী, বিক্রম-কন্যার ফোন নম্বরও ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ তো সরাসরি যুদ্ধবাজ নাৎসি বাহিনীর গুন্ডাদের কাজ! তার আগে এই ভয়ঙ্কর ট্রোল বাহিনী পহেলগামে সদ্য নিহত জওয়ানের স্ত্রী হিমাংশী নারিওয়ালকে পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলেনি। আমাদের কি এক গৃহযুদ্ধের পথে ঠেলে দিতে চাইছে এই নাৎসি বাহিনী? 

আমি এই গেরুয়া বাহিনীকে বলব, হিম্মত থাকলে মোদীর প্রিয় বন্ধু ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হও না দেখি! সে বেলা মুরোদ হবে না। কঙ্গনারই হল না, আর তোরা তো কোন ছাড়। দেখবি তখন শাহ'র বাহিনী তোদেরই কী অবস্থা করে! বলিয়ে ছাড়বে 'জয় শ্রীট্রাম্প'।


Friday, 9 May 2025

মুদ্রাস্ফীতির গণনায় খাদ্যপণ্য বাদ!

বৃহৎ পুঁজির একবগগা স্বার্থে সরকার?

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়



এইবার মুদ্রাস্ফীতির গণনায় ব্যাপক ফাঁক রাখতে খাদ্যপণ্যকে মুদ্রাস্ফীতির সূচক তালিকা থেকে বাদ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার; অথচ খাদ্যপণ্যেই দাম বাড়ে গড়ে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ! দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ভালোমন্দ যে সমস্ত জিনিসের দামের ওঠানামার সঙ্গে যুক্ত, তাকেই এরা উপেক্ষা করতে চাইছে। অর্থাৎ, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি কম করে দেখাতে চাইছে। সেই মর্মে প্রস্তাব এসেছে এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে অর্থমন্ত্রক থেকে আবেদন করা হয়েছে, এভাবেই ভেবে দেখার জন্য। কিন্তু তাতে লাভ কার? কীভাবে? পুঁজির স্বার্থ ছাড়া এই সরকার আর কিছু কি ভাবে?   

মুদ্রাস্ফীতি গণনার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সেই নিয়মে এ দেশের প্রায় ২০০টি পণ্যের দাম নিয়ে প্রতি সপ্তাহে তা নিরূপণ করা হয়। খাদ্যপণ্য ছাড়াও ভাড়া এবং নানা পরিষেবা ও উপযোগিতামূলক খরচ,  আবাসন খরচ, পেট্রোলের মতো পরিবহন খরচ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদিকে ধরা হয়। খোলা বাজারে পাইকারি ও খুচরো বিক্রির দাম উভয়কেই ধরে দু'রকম দামের ভিত্তিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হার গোনা হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেশে মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নগদের জোগান কমিয়ে-বাড়িয়ে, তার জন্য ব্যাঙ্কের রেপো রেট কমে-বাড়ে। সেই সূত্রে সুদের হার কমানো বাড়ানো হয়। বাণিজ্যের স্বার্থে শিল্প মহল সর্বদাই চায় এই সুদ কমিয়ে রাখা হোক। তাতে তাদের ঋণের উপর সুদের খরচ কমে। কিন্তু সেই খরচ কমলেই যে জিনিসের দাম কমে তা নয়, ফলে পুঁজির মুনাফা বাড়ে। কম্পাউন্ডিং হিসেবে এই মুনাফা বেশ অনেকখানি হয়। ঠিক ততখানিই চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ এবং আমজনতার পকেট থেকে গুনাগারও যায় ঠিক ততটাই, যদি না মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে ঠিক ঠিক অঙ্ক কষে সুদ বাড়ানো বা কমানো হয়। ভারতের মতো অর্থ ব্যবস্থায় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়িত্ব আমজনতার কথা ভেবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনে সুদের হার বাড়িয়ে নগদের জোগান কমিয়ে নেওয়া। তাতে বড়লোকদের উপর চাপ পড়লেও সাধারণ মানুষ বাঁচে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই রীতি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এই নিয়েই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সরকারের গোলমাল শুরু। পরবর্তীকালে অন্য গভর্নরদেরও ভূমিকা মেনে নিতে পারেনি মোদি সরকার। তারা চায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা খর্ব করে তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে বেশি বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করানোর জন্য সুদের হার কমিয়ে দিতে। এটা চাইলেই হয় না, অত  সোজা কথাও নয়। তা অর্থনীতির জটিল হিসেবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নগদের জোগান বেড়ে গেলে জিনিসের দাম বাড়বে তখন দেশের উৎপাদন খরচ বাড়বে, কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের সঞ্চয় কমবে এবং দেশের রফতানি বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়বে। তাই শিল্পপতিদের বিনিয়োগ খরচ কমাতে সুদের হার কমিয়ে রাখলেই দেশের উন্নয়ন হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয় বরং উল্টোটাই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাতে সর্বনাশ। মোদি সরকার এই ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করে অর্থনীতির ভারসাম্যটা নষ্ট করতে চাইছে শুধুমাত্র পুঁজির স্বার্থে। তাদের বক্তব্য, তা না হলে বিনিয়োগ আসবে না, আর পুঁজির উন্নয়ন না হলে দেশের সর্বনাশ। 

স্বার্থ ও ভাবনাচিন্তার এই মেরুকরণের ফলে বিরক্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নররা। প্রত্যেকেই তাঁদের মতো করে এর বিরোধিতা করেছেন। বস্তুত, সারা বিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, জিনিসের দাম ওঠা নামা, অর্থনীতিতে নগদের জোগান এবং সুদের হার ঠিক রাখার দায়িত্বটা সেই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতেই থাকে। এখানে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে দেশের অর্থনীতি ও আমজনতা ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব কিছু জেনেও মোদি চাইছেন তাঁর মতো করে চলতে। ঠিক যে ভাবে নোট বাতিলের সময় তিনি একরোখা অবস্থান নেন, এই ব্যাপারেও তাঁর মনোভাব তেমনি।

তাই, সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না-- এমন একটি ফর্মুলা তৈরি করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের বক্তব্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে রেপো রেট ঠিক করে তা নির্ধারণের সময় যেন খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে আর বিচার না করা হয়। রঘুরাম রাজন এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালীন তিনি নিজেই রেপো রেট নির্ধারণের সময় উৎপাদকের মূল্য, যাকে বলে প্রোডিউসার প্রাইস ইনডেক্স (বা পিপিআই), তা দেখে এগোতেন। পরবর্তীকালে সরকারের তরফে কেন্দ্রের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরন গত ২৩-২৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ফের একই কথা বলেন। এবারে সরকারের বক্তব্য একটু অন্যরকম: মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির ফলে সুদের ওঠানামা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যা খুশি করছে করুক, তাতে সরকার আর কোনও হস্তক্ষেপ করবে না, তবে মুদ্রাস্ফীতি গণনার ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের দামটা বাদ রাখা হোক। কারণ, দেশে সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ে খাদ্যপণ্যের। আর দাম বৃদ্ধি হলে সুদ কমানোর জায়গা থাকে না। তাই মুদ্রাস্ফীতির হার নিরূপণের ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যকে সরিয়ে অন্য কিছু রাখা হোক যার দাম কমে কিংবা খুব বেশি বাড়ে না। তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কম দেখানো যাবে, ফলে, সুদের হার আরও কম হবে। পুঁজি মহল সন্তুষ্ট হবে।

কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নগদের জোগানের নিয়ন্ত্রণ হবে না। আরও বেশি অসাম্য বাড়বে। যে মুষ্টিমেয় শ্রেণির মানুষ যথেষ্ট নগদ ও ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী, কেবলমাত্র তারাই ভালো থাকবে। আর যারা সীমিত আয়ের মধ্যে দিন গুজরান করেন, তাদের জন্য জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারের টনক নড়ানোর মতো কেউ থাকবে না। এখন যেরকম ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেলে আলোচনা শুরু হয়ে যায় অর্থনীতির শীর্ষ মহলে, কারণ, বর্তমানে পণ্যের খুচরো দরে মূল্যবৃদ্ধি নির্ধারণে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অংশ ৪৬ শতাংশ! স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে সুদের হার বাড়ানো বা কমানোর নীতি। খাদ্যপণ্যকে বাদ দিলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হার কম দেখাবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত দাম বাড়তে থাকবে। রাজনের কথায়, 'খাদ্যপণ্যের দর যদি দীর্ঘ সময় বেশি থাকে তাহলে চাহিদার তুলনায় জোগান কম ধরে নিতে হবে। এর অর্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্য ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি কমাতে হবে। যা শীর্ষ ব্যাঙ্ক করতে পারে'; আর সেটাই যদি শীর্ষ ব্যাঙ্ক না করে তাহলে আমজনতাকে পুড়তে হবে দাম বৃদ্ধির আগুনে, অন্যদিকে সরকার ঘোষণা করবে দাম বৃদ্ধি হচ্ছে না, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। তাতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাতে পথ পাবে।

উদ্যোগপতিদের কথা ভেবে সরকার এই পথেই এগোতে চায়। কিন্তু আমজনতা, যাঁরা সীমিত অর্থে সংসার চালান, তাদের কথা কে ভাববে?


Tuesday, 6 May 2025

'সেই তো মল খসালি...'

হঠাৎ উলটো পথে হাঁটা কেন

সোমা চ্যাটার্জি



পহলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সৌদি সফর বাতিল করে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আট দিন পর যখন দেশের বহু মানুষ, বিজেপি'র ক্যাডারকুল, এমনকি বিরোধী দলগুলি পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী তথা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আশা করেছিল, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী প্রথমে নিজে সর্বদলীয় বৈঠকে অনুপস্থিত থেকে বিহারের নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করলেন, তারপর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে বৈঠক সারলেন। ঠিক তার দু' দিন পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিল যে জাতপাতের আদমশুমারি হবে। এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে অনেকেই হতবাক, কারণ, এ তাবৎ মোদিজী স্বয়ং, অমিত শাহ এবং আদিত্যনাথ সহ সংঘ পরিবার জাতপাতগত গণনার তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে। 

মাত্র এক বছর আগে ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে যারা জাতপাত গণনার জন্য তদ্বির করেছিল, মোদিজী তাদের 'শহুরে নকশাল' বলে নিন্দা করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ 'বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে' এবং 'এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়'— এই স্লোগান দিয়ে জাতপাতগত জনগণনার দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বরং মুসলমান-ভয় দেখিয়ে 'হিন্দু ঐক্য'কে জোরদার করতে বলেছিলেন। ২০২৩ সালে যখন আরজেডি এবং কংগ্রেসের সমর্থনে নীতীশ কুমারের সরকার বিহারে একটি জাতপাত ভিত্তিক আদমশুমারি পরিচালনা করে, তখন মোদী তাকে 'হিন্দু সমাজকে জাতপাতের ভিত্তিতে ভাগ করার পাপ' বলে অভিহিত করেন। উপরন্তু, তিনি বিহারের সরকারি চাকরিতে প্রান্তিক শ্রেণির জন্য কোটা বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেন।

বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপি'র এই হঠাৎ ভোলবদল আপাতভাবে আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের একটি কৌশলগত রাজনৈতিক চাল, কোনও বাস্তব কর্মসূচি নয়। কারণ, এই জনগণনার কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়নি বা ২০২৫-২৬ সালে এর জন্য নির্দিষ্ট কোনও বাজেটও বরাদ্দ হয়নি। সকলেই জানেন, শেষ জাতপাত ভিত্তিক আদমশুমারি হয়েছিল ১৯৩১ সালে। 

ভারতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলিকে উন্নত করার জন্য ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিত্বের প্রচারের জন্য শিডিউল কাস্টস (এসসি), শিডিউল ট্রাইবস (এসটি) এবং পরে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (ওবিসি)-র জন্য সংরক্ষণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়; ১৯৭৯'এর ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের অধীনে সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন সংসদ সদস্য বিপি মণ্ডল। মণ্ডল কমিশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরিতে ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষণ। ১৯৯০ সালে ভিপি সিং সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ আংশিক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের ফলে দেশ জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তখন আরএসএস সমর্থিত বিজেপি 'এক জাতি, এক ধর্ম' এই শ্লোগান তুলে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকার ফেলে দেয়। সেই সময়ই রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল এজেন্ডা'কে সামনে রেখে আদবানি'র নেতৃত্বে বিজেপি রামরথ যাত্রা শুরু করেছিল, যা 'মণ্ডল বনাম কমণ্ডল' রাজনীতির সূত্রপাত বলে অনেকের অভিমত।

আমরা জানি, মণ্ডল কমিশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, সংরক্ষণ অবশ্যই যোগ্যতা ও সমতার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হবে, শুধুমাত্র প্রমাণের মাধ্যমেই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে ওবিসি-র সংরক্ষণ সর্বোচ্চ ৫0 শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। এর ফলে ৫০ শতাংশ সীমা সমগ্র দেশে সংরক্ষণের জন্য একটি নির্দেশক হয়ে ওঠে এবং কয়েকটি রাজ্য এই সীমা অতিক্রম করার সপক্ষে যুক্তি দেয়; যেমন, ১৯৯৪ সালে তামিলনাড়ুতে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি কর্মসংস্থানের ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণ করা হয়, ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রে মোট সংরক্ষণ হয় ৬৮ শতাংশ, তেমনই রাজস্থানেও সরকার গুজ্জর সম্প্রদায় সহ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলির অতিরিক্ত সংরক্ষণ চেয়েছিল, যদিও সেটি তদন্ত সাপেক্ষ। তদুপরি, ২০২২ সালে ঝাড়খণ্ড সরকার ওবিসি, এসসি, এসটি'দের জন্য ৭৭ শতাংশ সংরক্ষণ নীতি প্রস্তাব করেছে, ছত্তিশগড় সম্প্রতি এসটি, এসসি ও ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য ৭৬ শতাংশ সংরক্ষণ করার প্রস্তাব এনেছে। এমনকি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে উপজাতি জনসংখ্যার একটি বড় শতাংশ রয়েছে যা নিয়েও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে। আবার অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্নাটক সুবিধা-বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলিকে অতিরিক্ত সংরক্ষণ প্রদানের জন্য ৫০ শতাংশের সীমাকে চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।  

মণ্ডল কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল ওবিসিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করা। সরকারি চাকরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষণের ফলে ওবিসি'রা একটি বৃহত্তর কণ্ঠস্বর ও ভারতীয় রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছে। সামাজিক ভাবেও আসন সংরক্ষণ ওবিসিদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্মুক্ত করায় তাদের সামাজিক অবস্থানের ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আরএসএস ও বিজেপি প্রথম থেকেই এটিকে নেতিবাচক প্রবণতা হিসেবে চিহিত করে এসেছে। তাদের মতে এটি জাতপাতগত বিভাজনকে শক্তিশালী করে। কারণ, তাদের মূল লক্ষ্যই হিন্দু-মুসলমান বিভাজন। 

দেখাই গেছে, গত ৩৪ বছর ধরে বিজেপি সামাজিক ন্যায়বিচারের দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাম, অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, সম্ভল, ঔরঙ্গজেব, বাবর-- এইসব ধর্মীয় বিষয়গুলিকে লাগাতার ব্যবহার করেছে। তবে, পহলগামের ঘটনাকে সামনে রেখে বিজেপি বিভাজনমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা চালালেও মোদী বুঝতে পেরেছেন, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে এবারের ভোট বাক্স দখল করা যাবে না। কারণ, বিজেপি প্রথম থেকেই কংগ্রেসের মতো উচ্চবর্ণের ভোটের উপর নির্ভরশীল এবং কোনও জাতপাতের বিভাজন স্বীকার করে না। বিহারের মতো জায়গায় যেখানে ১৭ শতাংশ মুসলমান ভোটার, সেগুলি সবই আরজেডি-কংগ্রেস-সিপিআই(এমএল) জোটের দিকে যাবে। সে ক্ষেত্রে বিহারে বিজেপি জোটের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা মুশকিল হবে যদি না নিম্নবর্ণের ভোটগুলিকে বিশেষ কোনও উপায়ে টেনে আনা যায়। তাই, এখন সম্পূর্ণ উলটো পথে হেঁটে যুদ্ধের ভানটুকু বজায় রেখে সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে কীভাবে নিজেদের এজেন্ডায় পরিণত করা যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে জাতপাত গণনার ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত।

এছাড়াও ওয়াকফ বিল নিয়ে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে। জাত-গণনার জন্য ইন্ডিয়া জোট ও বিরোধী দলের প্রবল চাপ তো ছিলই এমনকি শরিক দল যেমন জেডিইউ, এলজেপি'র মতো দলগুলির কাছেও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হল মোদি সরকার। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশে বিজেপি'র খারাপ ফলের অন্যতম কারণই ছিল পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোটকে নিজেদের দিকে টানতে না পারা।

আদমশুমারিতে জাতপাত গণনার মূল চ্যালেঞ্জ হবে জাত নির্ধারণ এবং মোট সংখ্যাকে তালিকাভুক্ত করা। এই তালিকায় পৌঁছনোর জন্য আদমশুমারি কমিশনারকে অবশ্যই শিক্ষাবিদ, ব্যক্তি, জাত গোষ্ঠী, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, কারণ, ১৯৩১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ৪১৪৭'টিরও বেশি জাত ও উপজাত গণনা হয়েছিল, যার মধ্যে খ্রিস্টান, ইসলাম, জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দু ব্রাহ্মণরাও ছিল। ১৯৩১ সালে গবাদি পশুর সঙ্গে যুক্ত জাতের একটি গোষ্ঠী নিজেদের 'যাদব' হিসাবে চিহ্নিত করে এবং কিছু উপজাতি ও জাতকে একত্রীভূত করা হয়।

বর্তমানে ৩৬৫১'টিরও বেশি সম্প্রদায়কে ওবিসি, ১১৭০'টি এসসি এবং প্রায় ৮৫০'টি এসটি হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১১ সালে জরিপের সময় জাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেকেই তাঁর উপ-জাত ও গোত্র, কোনও ঋষির নাম উল্লেখ করেছিলেন। সুতরাং, এসইসিসি'র উল্লিখিত ৪৬'টি 'জাত'এর মধ্যে পদবী, উপ-জাত ও গোষ্ঠী আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট জাতের বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন উপাধি থাকতে পারে। সরকার নীতি আয়োগের তৎকালীন সহ-সভাপতি অরবিন্দ পানাগারিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে যাতে এসইসিসি'র বিশৃঙ্খলা দূর করা যায়, কিন্তু কমিটি এখনও তাদের প্রতিবেদন পাঠায়নি এবং সরকার জাত সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেনি।

জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের প্রাক্তন অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি মোহনন বলেন, বিভিন্ন অঞ্চলে একই জাতের বিভিন্ন নাম অথবা একই নাম থাকতে পারে। কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন মানুষ একই জাতের নাম ভিন্নভাবে লিখতে পারে। জনগণনা শুরু করার জন্য মোহনন সরকারকে তাদের রেজিস্টারে নথিভুক্ত সমস্ত জাতের নাম প্রকাশ করার পরামর্শ দেন। মোহনন বলেছেন যে, জাতিগত জনগণনা হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, কারণ, 'মুসলমান, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধরা সমজাতীয় নয়', তাদের মধ্যেও বিবিধ সামাজিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাই তাদের জনসংখ্যাও এই বিভাগ অনুযায়ী গণনা করা উচিত।

বিহারই প্রথম রাজ্য যেখানে ২০২৩ সালে জেডি (ইউ), আরজেডি সহ অন্য সমস্ত দল মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে বিহারে একটি সমীক্ষা করে এবং পরবর্তীকালে তার ভিত্তিতে সংরক্ষণ ৬৫ শতাংশে বৃদ্ধি পায়; এর উপর ছিল EWS'এর জন্য ১০ শতাংশ কোটা। ২০২৪ সালের জুন মাসে পাটনা হাইকোর্ট বিহার সংরক্ষণের সংশোধনী সম্পর্কিত আইন বাতিল করে দেয়। পরে বিহার সরকার সেই আদেশের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেও স্থগিতাদেশ পায়নি। অতএব, ৫০ শতাংশ সীমা সহ পূর্ববর্তী সংরক্ষণই অব্যাহত আছে। এই সিদ্ধান্তকে সংবিধানের নবম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দায়িত্ব এখন মোদী সরকারের। কিন্তু হঠাৎ করে আবার জাত গণনা ঘোষণার মাধ্যমে মোদী সরকার আগের গণনাগুলি বাতিল করে পুরো বিষয়টি অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। 

বর্তমানে জাতগত তথ্য না থাকার কারণে এবং সুপ্রিম কোর্টের ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ সীমার ভিত্তিতে ওবিসি সংরক্ষণ ২৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যা ভারতের ওবিসি জনসংখ্যার আনুমানিক অনুপাতে অনেক কম। এমনকি এই ২৭ শতাংশ সংরক্ষণও ধাপে ধাপে এসেছে— প্রথমে ১৯৯০ সালে সরকারি চাকরিতে এবং পরে ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু একটানা সরকারি চাকরি সংকোচন, আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে সংরক্ষণ এড়াতে ল্যাটারাল এন্ট্রির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সম্প্রতি উচ্চবর্ণদের জন্য আনা অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণের ফলে সংরক্ষণ ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা অনেকটাই হারিয়েছে। তাছাড়াও জাতপাতের গণনা নিম্নবর্ণের সংরক্ষণ আরও বৃদ্ধি করবে, উচ্চবর্ণের কমবে। এই অবস্থায় সমাজবাদী ও বামপন্থী দলগুলি তুলনামূলক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও তা বিজেপির কাছে একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, বহু বছর ধরে বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক উচ্চজাত ভিত্তিক। তাই জাত গণনার জন্য ওকালতি করে তারা কীভাবে ওই ভোট ব্যাঙ্ক টিকিয়ে রাখবে তা দেখার ব্যাপার। অবশ্য, কংগ্রেসেরও উচ্চজাতের ভোট হারানোর ভয় আছে।

কথায় বলে, 'সেই তো মল খসালি/ তবে কেন লোক হাসালি!'


Wednesday, 30 April 2025

'যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু...'

এই বিষাক্ত গহ্বর থেকে বেরতেই হবে

আবু সঈদ আহমেদ



একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছেলে স্কুলের সরস্বতী পুজোয় খাজাঞ্চির দায়িত্ব পাচ্ছে, কারণ সে অঙ্কে ভালো, অতএব, হিসাব রাখার কাজ ভালো ভাবেই করবে। এরকম দৃশ্য আমাদের স্কুল জীবনে খুবই পরিচিত ছিল। কিংবা রমজান মাসে স্কুল বা কলেজ ছুটির পর হস্টেলে গিয়ে কোনও ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে জাঁকিয়ে বসে ঘুগনি রান্না করছে যাতে মুসলমান ছেলেদের সঙ্গে সেই ঘুগনি মুড়িতে মিশিয়ে জমিয়ে 'ইফতার পার্টি' হতে পারে। এ হেন ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন এরকম মানুষও আমাদের সমাজে খুব একটা বিরল নয়। কিন্তু আজ সেরকম কিছু যেন অনেক দূরের কল্পনা বলেই মনে হয়। কীভাবে হারিয়ে গেল সেইসব দিন?

এর কারণ খুঁজতে হলে অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া দরকার। আমরা জানি, আমাদের উপমহাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন ছিল। বিদেশি শাসকদের নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য কিছু যুক্তির দরকার ছিল। তেমনই এক যুক্তি ছিল এই যে, ব্রিটিশ শাসন ভারতকে আগেকার অপশাসন থেকে মুক্ত করেছে। এই একই বয়ান ইংরেজ-শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিতদের মধ্যেও দেখা যায়। সৈয়দ মুজতবা আলি দুঃখ করে বলেছিলেন, বাঙালি ইউরোপ তথা দুনিয়াকে চিনেছে ইংরেজের চোখ দিয়ে। আরও দুঃখের হল, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ বাইরের দুনিয়া কিংবা ইতিহাস শুধু নয়, পড়শিকেও চিনলেন সেই ঔপনিবেশিকতার চোখ দিয়ে। কে না জানে, সাহিত্যসম্রাট ও ঋষি শিরোপা প্রাপ্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরেজদিগকে দিই না। যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেইদিন সে পরামর্শ দিব।' ('বঙ্গদেশের কৃষক')।

এমনকি যে উপন্যাসের জন্য তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সেই 'আনন্দমঠ' উপন্যাসেও বলেছেন, 'আর ফল যাহা হইবে ভালোই হইবে, ইংরাজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।' বাংলার বাকি শিক্ষিত হিন্দু সমাজও, ঠিক ঠিক ভাবে বললে, এই বঙ্কিমী লাইন বা 'ইংরেজ তাঁদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে'-- এই ভাবধারাতেই এগোতে পছন্দ করেছিলেন। অন্যদিকে, সরকারি কাজ থেকে ফার্সী ভাষা লোপ পাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্ম আর জানতে পারেনি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস, কারণ সেই ইতিহাসের এক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ফার্সী-আরবি'তেই লেখা। সে জন্য ইংরেজের লেখা ইতিহাসকেই ধ্রুবসত্য মেনে নিয়ে ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু আর মুসলমানের শত্রুতার আখ্যান হিসেবে প্রচার করে যাওয়া হল। এমনকি টড'এর 'Annals and Antiquities of Rajasthan' বই থেকেও সাহিত্য রচনাকালে রাজপুতদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বা মারাঠাদের সঙ্গে শত্রুতার অংশ বাদ রেখে প্রাধান্য পেয়েছে দিল্লি সুলতানি আর মুঘল আমলের ঘটনাগুলো। অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের মনেও হিন্দু বিদ্বেষ বুনতে আসরে নামেন উইলিয়াম হান্টারের মতো লেখকেরা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের দাঁড় করাতেও চেষ্টার কসুর করেনি ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ। 

এইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে, তখন দুই পক্ষের মনেই অন্য পক্ষ সম্বন্ধে সন্দেহ আর বিদ্বেষ বুনতে সফল হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তপন রায়চৌধুরী এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন, 'মোট কথা, যার চোখ আছে সেই দেখতে পাচ্ছিল যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাঙালিকে এক অজানা সর্বনাশের পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এই অশুভ সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা ছাত্ররা বিশেষ সচেতন ছিলাম।'

এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীনতা আসে। দেশভাগের ভয়াবহতা, তার আগের রাজনীতির অন্তসারশূন্যতা এবং সর্বোপরি হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ভারতের প্রধানতম রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়া ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশকে ধর্মান্ধতার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। তার জন্য ভারতের প্রধান দল মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেস কাজে যাই করুক, মূল রাজনৈতিক বক্তব্য ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পক্ষেই রাখত। কিন্তু গত শতকের সত্তরের দশক থেকে বিশেষত জরুরি অবস্থার পরে কংগ্রেসের মৌরসীপাট্টা অনেকটাই জখম হয়ে যায়। প্রথমে আঞ্চলিক ও বাম দলগুলো মাথা তোলে। এইরকম সময়ে আমরা যারা বড় হয়েছি তাদের কাছে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের সহাবস্থানটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু আশির দশকের সময় থেকে দক্ষিণপন্থী বিজেপি ভারতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হতে শুরু করে। রথযাত্রা, দূরদর্শনে রামায়ণ-মহাভারত, সর্বোপরি বাবরি ধ্বংসের মধ্যে দিয়েও এই অসহিষ্ণু মতবাদ ততটা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারেনি যতটা হয়েছে বামপন্থী শক্তিগুলোর দুর্বল হয়ে পড়া আর প্রচারমাধ্যমের নতুন রূপ তথ্যপ্রযুক্তির আমূল অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে যার ফাঁক দিয়ে গড়ে উঠল গুজব ও মিথ্যাচারের ফানুস। 

এখন কোনও তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের অনেক আগেই সেই তথ্য বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আমলের মতোই ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে গেছে শাসকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল হয়েই। ফলে, আমাদের ইতিহাস চেতনায় মনে হতে থাকে বাংলায় কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তেভাগার সময় থেকে। তার আগে ফজলুল হক সরকারের আমলের পাট অধ্যাদেশ, ঋণ সালিশি সভা ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞই থেকে গেছে। এমনকি 'লাঙল যার জমি তার' স্লোগানের আগে কৃষক প্রজা পার্টি 'ঘাম যার দাম তার' অংশটিও বলত, সে কথাও অনেক প্রগতিশীলদের অজানা। একই ঘটনা ঘটে গেছে সুলতানি-মুঘল আমল থেকে শুরু করে দেশভাগের চেনা বয়ানে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আয়না, মুসলমানরা সাধারণভাবে না হলেও মুসলমান নেতৃত্বকে, তা রাজা-উজির থেকে হাল আমলের রাজনীতিবিদ সকলকেই একতরফাভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অন্যপক্ষের কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত অথবা বিকৃতভাবে প্রদর্শিত। যে শিক্ষাব্যবস্থার আড়ালে আবডালে ঔপনিবেশিক বিদ্বেষ ও সামাজিক ধর্মান্ধতা বাসা বেঁধেছিল সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষদের মন ফলে বিষিয়ে দেওয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে যাচ্ছে এখন। ফলাফল আমরা সামনেই দেখতে পাচ্ছি। 

শিক্ষা-কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সমাজ, তা সে জঙ্গলমহলের আদিবাসীই হোক বা মধ্যবঙ্গের মুসলমান, সকলের ক্ষেত্রেই এক 'অপরায়ন' অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। এই কারণেই কাতার বিশ্বকাপের সময়কার কোরান তিলাওয়াত যতটা চোখে লাগে, দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসের সময় স্তোত্রপাঠ অতটা আপত্তিকর মনে হয় না। এভাবেই প্রায় প্রতিদিন ঘটে চলা মুসলমান-লিঞ্চিং এখন প্রায় গা-সওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে কোনও সন্ত্রাস ঘটলেই তার দায় পাড়ার মুসলমান বিরিয়ানিওয়ালা থেকে অফিসের সহকর্মী সকলের ঘাড়েই পড়তে থাকে। এতে করে যে শুধু আক্রান্ত সম্প্রদায়ের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, ক্রমাগত ঘৃণার চাষে চাপা পড়ে যাচ্ছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-দুর্নীতি-কর্মসংস্থান প্রভৃতি জীবনধারণের জরুরি ইস্যুগুলো। বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ সংকটের মধ্যেও পরিবেশ ইস্যু প্রায় অদৃশ্যই হয়ে পড়েছে। এমনকি ঘৃণার কারবারীরা পরিবেশ ইস্যুকে বানোয়াট দাবি করতেও পিছপা হচ্ছে না। এর ক্ষতি তো সবধর্মজাতির লোকেরই হচ্ছে। 

যে সকল মুসলমান শিক্ষার আলো পেয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা তাঁদের যে মেধা-মনন ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে সমাজকে ঋদ্ধ করতে পারতেন, তাঁদের চিন্তাশক্তিকে ব্যয় করতে হচ্ছে আশেপাশে ঘটে চলা ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবিলার কাজে। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সমাজই। আর এর থেকে বের হয়ে আসার দায় সমাজেরই, রাজনীতির কারবারীদের নয়। অতএব, সমাজের সকলকেই এই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে হবে। নইলে গায়ক নচিকেতার ভাষায় চলতেই থাকবে, 'ঐ ধর্মের বাঘ হেসে, আবার উঠোনে এসে,/ আশ্রয় চেয়ে যায় মানুষেরই কাছে!'