Sunday, 7 September 2025

বামপন্থার ভূত হইতে ভবিষ্যৎ

কী করিতে হইবে?

কৃশাণু মিত্র



নিজেকে বামপন্থী ভাবার স্পর্ধা আমার নেই। এই পথ একই সঙ্গে তপস্যা এবং যুক্তিবোধের পথ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এর প্রয়োগের ভূমি।

'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবির অর্জুনের হাতের ছুরি আসলে বিঁধছিল জটায়ু নয়, প্রদোষ মিত্র'র মরমে। কারণ, তার ভুলেই উক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। জটায়ুকে ভুগতে হয়েছিল। প্রতিনিয়ত নিজেকে কাটাছেঁড়া করে দেখতে হবে। সদর দফতরে কামান দাগতে হবে। সদর দফতর এখানে পার্টি বা সরকার নয়, আপন সত্তা। বিদ্যাপতির লেখায়, 'তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা...' (যে সাধক তৃণ অপেক্ষা নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেন, যিনি তরুর মতো সহিষ্ণু...)। নিজেকে দাগিয়ে বিশ্লেষণ করার নাম বামপন্থা। তা না হলে তুমি রাবণ, লঙ্কার অধিকার পেলেই খসে পড়বে ছদ্মবেশ।

এখন বিপ্লব বিদ্রোহ প্রতিবাদ দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেছে-- শান্তিপূর্ণ মার্কসবাদী ও গান্ধীবাদী। প্রথম দলে থাকা মানুষজন শতধা বিভক্ত। দ্বিতীয় দল গণতন্ত্র রক্ষায় বেনারস থেকে দিল্লি হাঁটছে, এখন সংবিধান বাঁচাও, ভারত জোড়ো, ভোটার অধিকার সহ বহু আন্দোলনে সামিল। বহু বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ যুক্ত হয়েছেন দ্বিতীয় দলে। আরেক দলও সংবিধান রক্ষার্থে বিহারে হাঁটছে। তারা আপাত গণতন্ত্র প্রকাশের মাধ্যম ভোটচুরি হয়তো আটকাতে সম্ভব হবে, কিন্ত দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের হদিশ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। 

শ্রম ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষজন হাঁটছেন বা বলা উচিত দৌড়চ্ছেন জোম্যাটো বা ব্লিংকিটের বাইকে, পেটের জন্য। পরিষেবা ক্ষেত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে 'আরবান কোম্পানি' বা অন্য কারও হাত ধরে। পাড়ার কলের মিস্ত্রি জয়, নিজস্ব পরিধি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। আর বড় হাউজ বা সরকারি কর্মীরা নিরলস ভাবে অলস যাপনে লজ্জাহীন। বামপন্থা এই মধ্যবিত্তদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত, এআই এসে গেছে। তলিয়ে যাবে ভুলভাল বহু কাজ। যেমন, খাটা পায়খানা থেকে মাথায় করে মাটি বইতে আসে না এখন কেউ। খাটা পায়খানাই উধাও হয়ে গেছে। আজও যদি মার্কসবাদী বীক্ষণে ধরা না পড়ে প্রকৃত পথের নতুন রূপ, তাহলে নেতৃত্বের কারণেই মার্কস এ পোড়া দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। 

যে দল মানুষের জমি, জঙ্গল, বাঁচার উপায় ধ্বংস করছে সে দলই মানুষকে কলাটা মূলোটা দিয়ে লোভাতুর, বশীভূত করছে। কোথাও লাডলি বহিন, কোথাও পাঁচ কেজি আনাজ। যারা বিরোধী তক্তে নেই, তারা টাকা দেওয়া ভালো চোখে দেখছে না অথচ নিজেদের প্রচারের সময় বলছে আমরা অনুদান বাড়িয়ে দেব। যদি অনুদান ভালো হয় তাহলে অধিষ্ঠিত দলকে সমালোচনা করলে চলবে না, কেন কতটা হলে ভালো বলতে হবে। আর যদি খারাপ হয় তাহলে বললে চলবে না যে আমরাও দেব। ভোটের রাজনীতিতে এই ঠকবাজি, দ্বিচারিতা চলছে চলবে ভাবলে বামপন্থীরা নিজেদের ঠকাবে। 

রাজনীতির সামনে অন্য কোনও পথ খোলা আছে কী? 

কেন, যে পথ গান্ধীবাদীরা দেখাতে পারল সেই পথ মার্কসবাদীরা দেখাতে পারল কই? এখানেই লুকিয়ে আছে সমাজে আজ বামপন্থীদের অনাদরের মূল কারণ। গান্ধীবাদ আজ পথ দেখাচ্ছে সকল অবউন্নয়ন বিকাশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে। তাদের মোক্ষ নয় রাজ্যপাট। তাদের লক্ষ্য গণতন্ত্র। আর রাজ্যে একদা ক্ষমতায় থাকা বাম দল আজও টাটা'র ন্যানো (যে ন্যানোই আজ উঠে গেছে) নিয়ে হা-হুতাশ করে যাচ্ছে। এই অটোমেশন, এআই'এর যুগে বৃহৎ কারখানা কোনও সমাধান নয়, তা বুঝতে হবে। আজ বড় কারখানায় কর্মসংস্থান অতীব সীমিত। অতীতে প্রযুক্তিকে ফিরিয়ে দিয়ে আমরা ভুল করেছি, এই সত্য যত তাড়াতাড়ি মানা যায় ততই ভালো। আমাদের দেশে মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথ হল তক্তে বসার কৌশল। যারা জীবন বাজি রেখে বন্দুক সহযোগে নেমেছিলেন, তারা বিলুপ্তপ্রায়। অন্যরা ভোট সহযোগে মোক্ষ লাভে ক্ষমতায় পৌঁছনোর আশে বসে। 

কিন্তু তারপর?

ভারতবর্ষে বর্তমানে ফ্যাসিস্ট শক্তি কায়েম হয়ে গণতন্ত্রের অপলাপ ঘটিয়ে যা খুশি করে যাচ্ছে। একইভাবে রাজ্যে স্বৈরাচারী শক্তি বিকশিত হচ্ছে, কারও কিছু বলার নেই। বামপন্থীরা সরকারে এলেও একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। ইতিহাসের শিক্ষা তেমনই।

তাহলে বামপন্থা কি কফিনে?

আপাতত টুকিটাকি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে কীভাবে এরা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারে:

এক) এক কেন্দ্রীয় দফতরের সরকারি ইউনিয়ন, যাদের গায়ে বামপন্থার তকমা লাগানো আছে, তারা একটি মিটিং করছে। ওয়ার্কশপে মাল যাতায়াত করার রাস্তায় ওপর দিয়ে ইলেকট্রিকের তার গেছে, বক্তব্য রাখছেন যিনি তাঁর স্ট্যান্ড মাইক্রোফোনে। লোডেড লরি আটকে আছে, নেতা নড়বেন না জায়গা ছেড়ে। কেউ কেউ অনুরোধ করল। গবুচন্দ্র কমরেডরা বলল, মিটিং শেষ হলে গাড়ি বের হবে। মানুষ যখন নিজে ক্ষমতার প্রতিভ হয় তখন ভবিতব্য লেখা হয়ে যায়। 

দুই) ইংরেজি তুলে দেওয়া হল, আবার চালু হল। কেন? মধ্যবিত্ত পোলাপান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। শ্রেণি সমঝোতার প্রকৃষ্ট উদাহরণে সাফার করল তারা, যাদের কোনওকালে ইংরেজি লাগবে না কোনও প্রয়োজনে। গণতন্ত্রকে আঘাত করা বামপন্থী মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের চেতনায় মাখো-মাখো। এই সুযোগে গড়ে উঠল ছাতারে পাখির মতো হাজারও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, যেখানে না আছে যোগ্য শিক্ষাব্রতী না পরিকাঠামো। কিউবা তৃতীয় বিশ্ব থেকে ডাক্তারি পড়ুয়া নিত এবং ছয় মাসে স্প্যানিশ শিখিয়ে ওই ভাষায় শিক্ষা দিত। যার দরকার সে শিখে নেবে, এই সত্যই পরম। 

তিন) যে কোনও গণতান্ত্রিক নির্মাণকে নস্যাৎ করে দিতে মুহূর্ত সময় নেয়নি। মরিচঝাঁপি যার প্রমাণ।

আত্মীকরণ না হওয়া এবং অজ্ঞানতার কারণেও নতুন পথের সন্ধান করার সাহস নেই বামপন্থীদের। দক্ষিণ আমেরিকার বহু উদাহরণ আমরা কাজে লাগাতে পারি। পাথরপ্রতিমাতেও আমাদের সেরকম অভিজ্ঞতা আছে। ব্রাজিলে অগস্ট বোয়াল (এক নাট্য ব্যক্তিত্ব) প্রসিডেন্ট লুলা'র সময় কাউন্সিলর ছিলেন। তাঁর নিজস্ব নির্বাচনী কেন্দ্রে তিনি আঞ্চলিক আইন প্রণয়ন করেছিলেন গণতন্ত্রকে জোরদার করতে। আসলে গণতন্ত্র ছাড়া এই সময়ে কোনও রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয়। কিছুদিন আগে শ্যামল মুখার্জি, পথসেনা দলের এক সৈনিক-সেনাপতি যখন লিখলেন, বুদ্ধবাবু কীভাবে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আদান-প্রদানে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি জোর করে কিছু করেননি। বুদ্ধিজীবীরা তাকে মান্যতা দিয়েছিলেন। আমি প্রতিপ্রশ্ন রেখেছিলাম, এই আলোচনা জমি অধিগ্রহণের আগে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেন করা হয়নি? আসলে বুদ্ধিজীবী বুদ্ধদেব অপর এক ক্ষমতার সমর্থন ও মান্যতা চেয়েছিলেন। সেখানে সাধারণ মানুষ গৌণ। বুদ্ধিজীবীদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল কিন্তু শ্রমজীবীদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কেন রেফারেন্ডাম নেওয়া হয়নি? কেন জমির মালিককে তার ভালো কীসে জানতে চাওয়া হল না? গণতন্ত্রের ঠিকাদার কেবলমাত্র মানুষই হতে পারে, কোনও রাজনৈতিক দল নয়। বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার অর্থ হবে মানুষের দাবি, মানুষের মতামতকে মূল্য দেওয়া। 'সর্বহারার একনায়কত্ব' আজ গণতন্ত্র বিরোধী। উল্টোদিকের দলগুলিকে ভোটাররা ভোট দেবে, অনুদান নেবে, কখনও যুদ্ধের কখনও ধর্মের বড়ি খেয়ে।  

তাহলে শূন্য থেকে শুরু করা যাবে কীভাবে? 

১.০) অবশ্যই বিচার ব্যবস্থার দোরে দোরে ঘুরে ও তাদের নজরে পড়ে নয়। সরাসরি কাজে নেমে পড়ার মাধ্যমে। করোনার সময় যে ভাবে কাজ শুরু করা গিয়েছিল। মুশকিলটা অবশ্য এখানেও। করোনার সময় শুধুমাত্র 'রেড ভলেন্টিয়ার্স' কাজ করেনি। কাজ করেছিল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সাধারণ সমাজ বন্ধু। যাদের কাজটাই উদ্দেশ্য ছিল, তক্তের খুড়োর কল তাদের সামনে ছিল না। বালি অঞ্চলে নির্ভীক সংগঠনের পল্টু করোনার সময় কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে। কাজ শেষ হয় না, পুরুলিয়াতে চলেছে পল্টুর নামে পাঠশালা। অথচ শ্রমজীবী ক্যান্টিন শুরু হল আর সেই ক্যান্টিনের দায়ভার গেল কন্ট্রাকটরের কাছে। ব্যাস, প্রায় সব ক্যান্টিনের আঁচই নিবু নিবু। অর্থাৎ, দলে একজনও শ্রমিক নেতা নেই যিনি এই কাজে নিজে হাত লাগিয়ে পরিচালনা করতে পারেন, অথচ আমি বলছি আমার পার্টি শ্রমিক কৃষকের প্রতিভূ। একটু খোঁজ নিলে জানা যাবে, সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে কীভাবে কত ক্ষেত্র রাজনৈতিক দর্শনকে শিরোধার্য করে অরাজনৈতিক জায়গা থেকে উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছে। তার নির্যাস নিতে আমরা ব্যর্থ। আমরা দল হিসেবে কোনও লাগাতার নির্মাণের সঙ্গী হচ্ছি না। শংকর গুহ নিয়োগী একটি দর্শনের জন্ম দিয়ে গেছেন: 'সংঘর্ষ এবং নির্মাণ'। অথচ কোনও বামপন্থী দল এই দর্শনকে বুকে টেনে নিতে পারল না। অর্ধ শতাব্দী ধরে এই দর্শনের ফলিত রূপ দল্লি-রাজহারায় শহিদ হাসপাতালের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে বেঁচে আছে। সেই মডেলের নির্যাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করে চলেছে বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি; যারা শ্রমকেই পুঁজি ধরে পাঞ্জা কষে চলেছে ক্রোনি পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। 

শুরু হবে কীভাবে? ধরাধাম আজ ক্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্যে। দল বেঁধে বাজার দোকানে অহিংস প্রচার চলুক। দরকার মতো চাঁদা তুলে ডিগ্রেডেবল মেটিরিয়ালে অভ্যস্ত হোক মানুষ। এই ইন্ডাস্ট্রি বিকাশ লাভ করুক। রাসায়নিক সার, কীটনাশকহীন চাষ হবে, ক্ষেত্র প্রস্তত আছে। শুধু চাই রাজনৈতিক ইচ্ছা। 

২.০) গণতন্ত্রের প্রহরী হিসেবে থাকব, সরকারে যাব না। সরকারি দল চাইবে মদত। নির্বিকার পূজারী হব প্রকৃতির। অধিকারের দাবি সামনে আনব। লক্ষ থাকবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। আইনানুগ কাজ না হলে প্রতিবাদ করব। যে মানুষ কাঁদছে তার পাশে দাঁড়াব। মানুষ হয়তো একদিন দাবি করবে, ক্ষমতায় এসো। তোমাদের চাই আমরা। 

৩.০) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাই অভিনিবেশ। ইউরোপের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, ভাবনাতেও আমাদের দেশিয় বামপন্থীরা কত পিছিয়ে। সেখানে ডাক্তারের ছেলের ডাক্তার হওয়ার মানসিক চাপ নেই, স্বচ্ছন্দে সে সেলসম্যান হয়ে রোজগার করে বেহালা কিনে বাজায়। হয়তো কেউ সরকারি অনুদান নিয়ে বেঁচে আছে আর মনের মতো কাজ করছে। এই পরিস্থিতি-কাল এখানেও আসবে। কারণ, এআই কর্মহীন করে দেবে মানুষকে। কেরানি নেই, ওপিডিতে ডাক্তার লাগছে না, আদালতে বিচার হবে অতীত জাজমেন্টের ভিত্তিতে। ব্রিজ ডিজাইন করবে এআই। যখন প্রযুক্তি উদ্বৃত্ত দেবে তখন রাষ্ট্রীয় অনুদানকে কে হ্যাটা করবে? তখন দাবি উঠবে অনুূদান বাড়ানোর। তখন মূল্যায়ন হবে, কোন্‌ মানুষকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে হচ্ছে, তাকে দিতে হবে বেশি অনুদান। চাষের কাজ আধুনিক পদ্ধতিতে হবে সমবায় করে। তখন কৃষি ক্ষেত্রে শ্রম দেওয়া মানুষকে দিতে হবে বেশি অনুদান। নজরদারি  চলবে সব ক্ষেত্রে। বামপন্থীরা ছাড়া কে করবে এই নজরদারি? আর অনুদানের সমবন্টন চাই কর্ম অনুযায়ী, 'ফসলের সমবন্টনের' প্রকৃত রূপ হয়ে । কারণ, সরকারকে ফসলের জোগান দিতে হবে তার জনগণকে।   

বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই।


Friday, 5 September 2025

ছাত্রাভাবে বিদ্যালয়ের কক্ষ আর...

এত কালি মেখেছি দুই হাতে

মালবিকা মিত্র



বিগত ৪০-৫০ বছরে চারপাশে দোকানপাট হাট বাজার শপিং মল বিস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রসাধনী সামগ্রী জামাকাপড় আর ওষুধের দোকান তো ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু খেয়াল করবেন, একটি ব্যবসা লাটে উঠেছে। তা হল বইয়ের দোকান। রেল স্টেশনগুলোতে বইয়ের স্টল বিদায় নিয়েছে। আমি যে অঞ্চলের বাসিন্দা সেখানে একদা ছ'টি বইয়ের দোকান ছিল। সেই সব দোকানে ভালো ভালো বই শো'কেসে শোভা পেত। আর শিক্ষাবর্ষের শুরুতে দোকানে স্কুলের পাঠ্য বই বোঝাই থাকত। এখন সেই বইয়ের দোকানের সংখ্যা ঠিক দুটি। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, একটি। এই বইয়ের দোকানে গল্প উপন্যাস বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় ছাতা, স্কুলের ব্যাগ, ওয়াটার বোতল, টিফিন বক্স, বইয়ের মলাটের সিনথেটিক রোল, নানাবিধ ফ্যান্সি রাবার, ছুরি, হস্তশিল্পের উপকরণ, বার্থডে সাজানোর উপকরণ, গ্রিটিংস কার্ড ইত্যাদি। তবে অর্ডার দিলে আনিয়ে দেয়। আমি এমনই একটি দোকানে বইয়ের অর্ডার দেব বলে দাঁড়িয়েছি। 

শিক্ষক দিবসের আগের দিন (৪ সেপ্টে) এই দোকানে বেজায় ভিড়, কমবয়সী ছাত্রছাত্রীরা প্রধান ক্রেতা। বেলুন, নানা রঙিন ফিতে, ঝিকমিকি নানাবিধ রাংতা ও ফয়েলের উপকরণ, এসব কিনছে। আর আছে ছোট বড়, বেশি দামী, কম দামী গ্রিটিংস কার্ড। একটি বাচ্চা গ্রিটিংস কার্ড কিনছে, সঙ্গে তার মা। 

-- আমার আটখানা কার্ড লাগবে। 

-- আটখানা! সবাইকে কেন? তোমার সবচেয়ে প্রিয় দু' তিনজনকে দাও। আটখানা টু মাচ! 

-- সবাইকে তো দিচ্ছি না। আমাদের ক্লাস নেন যে টিচাররা শুধু তাদের দিচ্ছি। 

-- এই কার্ডগুলো নাও, পাঁচ টাকা করে। 

-- না, এগুলো একেবারেই বাজে। কাগজগুলো বাজে। ওইগুলো নেব। 

-- ওগুলো কুড়ি টাকা করে দাম, ভাবতে পারছ আটখানা কার্ডের কত দাম হবে? অত দামের দিতে হবে না। 

-- না আমাকে ওই ভালো কার্ডগুলোই দিতে হবে।

বাচ্চা নাছোড়। 

মোদ্দা কথা, শিশুর দিক থেকে কী ভয়ঙ্কর পীড়ন চলে অভিভাবকের উপর। আর অভিভাবকের কী চরম অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য ভাব। এই দুইয়ের ফলশ্রুতি, অবশেষে চাঁদ সওদাগরের বাঁ হাতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন মহান শিক্ষক দিবসে। অথচ এমনটা আমার ছাত্র জীবনে, এমনকি আমার শিক্ষকতার প্রথম জীবনে ছিল না। তখন অনেক সময় উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা শিক্ষকদের বিশ্রাম দিয়ে নিজেরাই ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষক হত। কখনও ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে কোনও খেলাধুলোর আয়োজন হত। কখনও কিছু সাধারণ খাবারদাবার আয়োজন করে ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিত আহার হত। এই ছিল শিক্ষক দিবস।

কালে কালে এল পরিবর্তন। পৃথক পৃথক ক্লাসে প্রতিযোগিতা শুরু হল ক্লাসের সাজসজ্জা আয়োজনে। প্রতিটি ক্লাস পৃথকভাবে শিক্ষকদের সম্বর্ধনা দিতে শুরু করল। ক্লাসে বেলুন ফাটানো, বেলুনের মধ্যে নানাবিধ চাকচিক্যের উপকরণ ছড়িয়ে পড়ল ক্লাসময়, সকলের শরীরে। উদ্দাম আনন্দ হই-হল্লা। মনজিনিস গাঙ্গুরাম ডোমিনো'স বা নামী মিষ্টির দোকানের প্যাকেট, সঙ্গে দামী উপহার দিয়ে সম্বর্ধনা। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসে এই প্যাকেট ও উপহারের বহর বেড়ে চলল। ফলে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিগ শপার নিয়ে যেতে শুরু করলেন। এলাহী আয়োজন চলতে লাগল। যে একজন বা দুজন শিক্ষক এই বিপুল বৈভব প্রদর্শনে আপত্তি করতেন, তাঁরা সহকর্মী শিক্ষকদের মহলে এবং ছাত্রছাত্রীদের কাছেও খুবই অপ্রিয় হয়ে উঠলেন। কোনও এক শিক্ষক বলতেন, দামী দামী কার্ড না কিনে নিজের হাতে বানিয়ে একটা কার্ড দাও। যে কোনও কাগজে বানাও। একটা মনে রাখার মতো চিঠি, ছবি আঁকতে না পারো তো একটা প্যারাগ্রাফ লিখে বা দু' লাইন ছড়া লিখে দাও। সেটাই হবে দুর্লভ প্রাপ্তি। এত ব্যয়বহুল আয়োজন করে কেন পিতা-মাতার বিড়ম্বনা বাড়াও? 

আজ আট বছর হল অবসর নিয়েছি। ফলে, এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ আমাকে চেনে না। তাই অতি সহজেই পিতা-মাতার ওপর ছাত্র-ছাত্রীদের চাপ সৃষ্টির দৃশ্যটি ও অভিভাবকের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের মনোভাব সহজে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। এই তাচ্ছিল্য তো আমাদের পাওনা ছিল। অবসর গ্রহণের আগেই আমি দেখেছি, 'ছাত্র-ছাত্রীরা মোদের সন্তান সম' ঘোষণা দিয়ে তাদের হাতে দুটি একলেয়ার্স ধরিয়ে ও ব্যাগ ভর্তি গিফট নিয়ে তাদের ছুটি করে দিয়েছি। তারপর বিরাট ভোজের আয়োজন হয়েছে। সেই আয়োজন সন্তান সম ছাত্র-ছাত্রীরা স্বচক্ষে দেখেও গেছে। আমি নিজেই দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। প্রচণ্ড চড়া সাজসজ্জা করে দিদিমণিরা স্কুলে এসেছেন, আর ছাত্র-ছাত্রীদের বলেছি স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে আসতে। শুধু তো শিক্ষক দিবস নয়, সরস্বতী পুজো, বাৎসরিক স্পোর্টস, বাৎসরিক অনুষ্ঠান, সর্বদাই ছাত্রীরা স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে বিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আর শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্বাধীনভাবে নায়ক-নায়িকা সুলভ সাজে হাজির থেকেছি। 

শিক্ষক হিসেবে আমি আদর্শহীনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। আমি নিজের বিদ্যালয়ে কখনই আমার নিজের সন্তানকে পড়াই না। আমার নিজের বিদ্যালয় আমার কাছে উপার্জনের ক্ষেত্র। অতএব, এখানে সবাই পরের ছেলে। আমার নিজের ছেলে মেয়ে অন্যত্র বেসরকারি নামীদামী এলিট শিক্ষা কেন্দ্রে পড়ে। ফলে, পরের ছেলের দায়িত্ব আমি কখনও গ্রহণ করিনি। একে একে এই পরের ছেলেরা বুঝেছে, এখানে পড়াশোনা করে কিছু হয় না। অভিভাবকরা তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। বিদ্যালয় শিক্ষক কালিদাসের মতো যে জমিতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই জমিটাই খুঁড়ে চলেছেন।

একদা এই স্কুলগুলো ছিল আমার বাড়ির কাজের মেয়ে এবং আমার মেয়ে দুজনেরই স্কুল। আমি আমার মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছি গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি বিদ্যালয়ে। এগুলোকে পরের ছেলের গোয়াল বানিয়েছি। আমার চোখে এগুলো শুধুই উপার্জন ক্ষেত্র। ফলে, এখন আমার বাড়ির কাজের মেয়ে তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের এই স্কুলে আর পাঠায় না। স্কুলগুলোকে ছাত্র-ছাত্রীহীন করেছি। এখন ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে একটা একটা করে স্কুল উঠে গিয়ে পরস্পর মার্জিং চলছে। ওদিকে আমার সন্তান পোস্ট গ্রাজুয়েশন করে, বিএড করে বেজার মুখ করে বলে, কতদিন হয়ে গেল কোনও শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন হয় না। কী করে হবে? আমরাই তো এই স্কুলগুলোর উপরে মানুষের আস্থা নষ্ট করেছি। কেউ কেউ বলেন, এটা সরকারি নীতির ফল। আমি বলি, সরকার তো একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে একটি নীতির প্রস্তাব চালু করে। কিন্তু এই সরকারি স্কুলটায় হাতে-কলমে কাজ করেন যে শিক্ষক (জন হেনরি), তিনি ডিসপোজ করেন। মালিক সরকার যাই প্রপোজ করুক ডিসপোজ করেন শিক্ষক। তার মধ্যে সেই মরাল এবং ফিজিক্যাল লড়াইটাই আমরা দেখলাম না। ব্রিটিশ সরকার কত না শিক্ষানীতি চালু করল, দফতর বানালো, সিলেবাস বানালো, শিক্ষক শিক্ষণ চালু করল, যাতে সরকার তার লক্ষ্যে শিক্ষাকে বাঁধতে পারে। কিন্তু বাস্তবে পেরেছিল কী? স্বাধীনতা আন্দোলনে যে বিপুল সংখ্যায় আবেগ তাড়িত ছাত্র সমাজ যোগদান করল, তাদের পেছনে কোনও না কোনও মাস্টারদা বা শিক্ষক মহাশয়ের অবদান ছিল। শিক্ষককে নিয়মে বাঁধবে, সেই বাঁধন শাসকের ছিল না। 

এ বছরেই আমার বিদ্যালয়ে এক সহকর্মী অবসর নিলেন ৩১ আগস্ট। ওইদিন ছিল রবিবার, তাই তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানটি করা হল আগের দিন, শনিবার। খুবই অনুরোধ করেছিল, তাই গিয়েছিলাম। দেখলাম যথারীতি এখনও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চড়া মাত্রায় সাজগোজ, বিপুল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন অব্যাহত। কোনওমতে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ করে সব ছাত্রীদের হাতে একটি করে মিষ্টি ধরিয়ে বিদায় করা ও তারপর ভুরিভোজের সূচনা। বুঝলাম, স্কুলগুলো উঠে যাবার মুখেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে আত্মসমালোচনা নেই। আমাদের কি কিছু করার ছিল, কিছুই কি করার ছিল না-- এই আত্মজিজ্ঞাসা নেই। লোকগানে বলা আছে, মৃত্যুকালেও পাপী কৃষ্ণ বলে না। 

আমি আমার সন্তানের বেঁচে থাকার উপায় যে লাইফবোট, সেগুলোকে ডুবিয়েছি নিজেই। সরকারি নীতিকে আমি আরও ত্বরান্বিত করেছি। স্কুলগুলোর দুরবস্থায় সরকার বিরোধী সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছি। ক্লাসে না গিয়ে টিচার্স রুমে বকেয়া ডিএ নিয়ে সোচ্চার হয়েছি। বলেছি, বকেয়া ডিএ'র অনুপাতে ক্লাসের সময় কমিয়ে দিতে হবে। পরপর তিনটি ক্লাস থাকলে চিৎকার করে রুটিন প্রস্তুতকারকের পিতৃ শ্রাদ্ধ করেছি। সারাদিনে চারটির বেশি পাঁচটি ক্লাস হলে টিচার্স রুম ফাটিয়ে চিৎকার করেছি। সেই আমি শিক্ষক, বারবার সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলেছি। কিন্তু বাকি তিনটি আঙুল কোনদিকে তা খেয়াল করিনি। এই আমি হলাম মানুষ গড়ার কারিগর। আজ আমার জয়গানে মুখরিত হবে বিদ্যালয়। শিক্ষক দিবসে মহান শিক্ষকের আত্মত্যাগের কাহিনী। কিন্তু একটু বোধহয় ভুল বলছি, ছাত্রাভাবে বিদ্যালয়ের কক্ষ আজ আর মুখরিত হবার কথা নয়। বরং আমার স্বঘোষিত মহানুভবতার বক্তৃতা প্রতিধ্বনিত হয়ে আমারই কানে ফিরে আসবে।

এত কালি মেখেছি দুই হাতে যে এখন লজ্জায় মুখ ঢাকার উপায় নেই। মুখে কালি লাগার ভয়। তাই লজ্জাহীনের মতো মুখ না লুকিয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়াই।


Tuesday, 2 September 2025

হায় জাভেদ! তোমার দিন গিয়াছে!

জাভেদ'জীকে শুনতে চাই

আবু সঈদ আহমেদ



খবরে প্রকাশ, কলকাতায় বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ উর্দু একাদেমি'র তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ১ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কলকাতার কলামন্দিরের কলাকুঞ্জ প্রেক্ষাগৃহে। অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল: হিন্দি সিনেমায় উর্দু।

প্রথম কথা, পশ্চিমবঙ্গে এত কিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সরকারি খরচে কেন 'হিন্দি সিনেমায় উর্দু' বিষয়ক অনুষ্ঠান করতে হবে তা আমার বোধগম্য হয়নি।

দ্বিতীয় কথা, জাভেদ আখতার এখানে সরকারি আতিথ্যে এসে কী বলতেন জানি না। তবে এই মওকায় আমার নিজের কিছু কথা একটু শুনিয়ে দিতে চাই। বহুদিন পর্যন্ত উর্দু শব্দ ও ভঙ্গিমা বলিউডি হিন্দি সিনেমার আত্মা ছিল। আজ তা 'ইশ্ক‌ সুভানাল্লা' বা 'তুঝ মে রব দিখতা হ্যায়' কিংবা 'সাজদা, প্যায়ার কা সাজদা' জাতীয় প্রেমের গানেই সীমাবদ্ধ। বাকি অংশে উর্দুকে ঝেঁটিয়ে দূর করে হিন্দি ভাষার শুদ্ধিকরণ হয়েছে, ‘জরুরত’, ‘ওয়াক্ত’এর বদলে 'আবশ্যকতা', ‘স্যম্যয়’ এসেছে। যেরকমটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিতদের হাত ধরে বাংলা ভাষার ‘ফোর্ট উইলিয়ামীকরণ’ হয়েছিল। 

সেলিম-জাভেদ জুটির অনবদ্য চিত্রনাট্য 'শোলে' যে 'তাজিরাত-এ-হিন্দ'এর মাধ্যমে গব্বর সিং'এর ৩০ বছর কারাবাসের শাস্তি শুনিয়েছিল, কালের চক্রে সেই ‘তাজিরাত-এ-হিন্দ’এর বদলে ‘ভারতীর ন্যায় সংহিতা’ এসেছে। জাভেদ আখতারের বাসস্থান যে রাজ্যে, সেখানে এসব বলার সুযোগ পাবেন না সেটা বলাই বাহুল্য। তাই হয়তো এখানে এসে এই দুঃখের বয়ান রাখতেন। তবে এসব আমার অনুমান মাত্র।

তৃতীয় কথা, এবার আসা যাক যে সব সংগঠনগুলি এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেছে তাদের প্রসঙ্গে। প্রথম সংগঠন 'জমিয়তে উলেমা'র ব্যাপারে অনেকেই শুনেছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুফতি কিফায়াতুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ, মাহমুদ হাসান মাদানী বা হুসাইন আহমাদ মাদানীর মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা এই সংগঠন থেকেই এসেছেন। এই সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার কর্ণধারের এক পত্রাঘাতে নাকি উর্দু একাডেমির উদ্যোক্তারা পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছেন বলে শোনা গেছে। কয়েকদিন আগে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরাই গরু ব্যবসায়ী নিগ্রহে কোক-অভেন থানায় গিয়ে গুজব না ছড়ানো আর শান্তিরক্ষার বার্তা দিয়ে ভিডিও করেছিলেন। কিন্তু ঠিক এমন কী ঘটল, যে জমিয়তের দেশ-বিদেশের নেতারা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসেন, সেই জমিয়তে জাভেদ আখতারকে নিয়ে এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে একেবারে পত্রাঘাত করে বসল! আরও কৌতূহল হয়, যখন ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে অনিয়ম হয়, একের পর এক যোগ্য প্রার্থীকে ভুগতে হয়,  কিংবা গঙ্গা ভাঙন চলে, তখন ওনারা এরকম জবরদস্ত পত্রাঘাত করেছেন কী? নিদেনপক্ষে সেই সংগঠনের স্মরণীয়-বরণীয় মানুষেরা আজ যে বিস্মৃতির কবলে চলে গেছেন, তা নিয়েও কিছু করেছেন কিনা জানা যায়নি। করে থাকলেও তাতে যে অভীষ্ট ফল লাভ হয়নি তা বাস্তব পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

আরেকটি সংগঠন 'ওয়াহিয়াইন ফাউন্ডেশন'এর ব্যাপারে বিশেষ জানা নেই। একটি ওয়েবসাইটে দেখলাম তারা বিভিন্ন রকমের কোর্স করায়। তা তারা আরও বৃহত্তর জনগণের মধ্যে তাদের এলেম বিতরণ করুন, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি। সংবাদে প্রকাশ, তাদের হয়ে মুফতি শামাইল নাদভি সাহেব জানিয়েছেন, তাঁরা নাকি জাভেদ'জীকে ব্যক্তি হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তাঁর কিছু কথা সম্প্রদায়কে আঘাত করেছে, এ জন্য সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা উচিত নয়। তা বেশ, তবে একটি প্রশ্ন। অন্তত ওয়েবসাইট থেকে যেটা জানা যাচ্ছে, তাঁদের দফতরটি যে অঞ্চলে সেখানে এখন বিধায়ক রাজ্যের শাসক দলের বাবুল সুপ্রিয়, যিনি কেন্দ্রের শাসক দলে থাকার সময় এই একই সম্প্রদায়কে আঘাত করে অনেক কিছুই করেছেন। তার ওপর নির্বাচনের সময় একটি বেসুরো গান সম্প্রচার করে বাঙালির কৃষ্টিতে এক চিরকালীন বিভীষিকা তৈরি করে রেখেছেন। এ হেন সুপ্রিয়বাবু তাঁদের এলাকার বিধায়ক হওয়াতে তাঁরা কতটা আহত বা আদৌ কিছু আঘাত পেয়েছেন কিনা, আমার জানতে বিশেষ আগ্রহ হচ্ছে।

চতুর্থ কথাটি বহু পুরনো। বারবার নানা দিক থেকে বহু বিতর্ক হয়, আবার নতুন করে বলতে হয়। অনুষ্ঠানের বিরোধীদের তরফ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, জাভেদ আখতারের ব্যক্তিগত বিশ্বাস অর্থাৎ নাস্তিকতার জন্য উর্দু একাডেমিতে তাঁর অনুষ্ঠান করা উচিত নয়। এর মানে, প্রকারান্তরে, উর্দুকে মুসলমানের ভাষা, এমনকি ‘মুসলমানের একমাত্র ভাষা’ বলে চালিয়ে দেওয়া হল, যা পাকিস্তানের স্বৈরশাসক থেকে দক্ষিণবঙ্গের বাবুসমাজ প্রত্যেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করে গেছে। আমাকে কলকাতায় এসে বহুবার শুনতে হয়েছে, 'মুসলমান? আমি তো ভাবছিলাম বাঙালি!' যা, ছোটবেলায় যেখানে বড় হয়েছি সেখানে আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। অনেকে আমার নাম শুনে ভাঙাচোরা হিন্দি দিয়েই বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে চেয়েছেন। এঁরা ভুলে যান, ১৯৫২'র রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর ১৯৫৪'র ভোটে হেরে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ 'মারী চুক্তি' অনুযায়ী বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মেনে নেওয়ায় 'উর্দুই মুসলমানের একমাত্র ভাষা' তত্ত্বটির চিরকালীন সমাধি হয়ে গেছে।

জাভেদ আখতারকে ছেড়ে এবার উর্দু সাহিত্যের অন্যান্য কবিদের দিকে যদি দেখা যায়, যাঁদের মধ্যে মির্জা গালিবের মতো বিশ্বনন্দিত কবিরাও আছেন, তাঁদের লেখনিতে যে ভাবব্যঞ্জনা ফুটে উঠত তাতে শরাবঢালা চ্যাংড়া শাকি আর কষকে বাঁধা জুলফের ইস্কের যত ছড়াছড়ি, তা দেখে উলেমারা যুগ যুগ ধরে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ে গেছেন। কিন্তু সাহিত্য-অনুরাগীদের কাছে সে সব রচনার কোনও সমাদর কমেনি। অন্যদিকে নাস্তালিক হরফে লেখা উর্দুতেই দিব্যি স্বচ্ছন্দ ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী ভগৎ সিং থেকে গান্ধীবাদী কৈলাসনাথ কাটজু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রত্যেকেই নিজেদের কাজে উর্দুর ব্যবহার করেছেন। 

জাভেদজী তাঁর বক্তব্যে কী বলতেন জানি না, তবে মনে করিয়ে দিতে চাই, বলিউডে 'ফিরাক গোরখপুরী' নাম নিয়ে কলমের জাদু দেখিয়েছেন রঘুপতি সহায়। আজও 'হুমা কানপুরি' ছদ্মনামে শ্রোতাদের 'মস্ত্‌' করে দিচ্ছেন কবি হৃদয়েশ নারায়ণ শুক্লা। যাঁরা জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিলের প্রতিবাদ করেছেন, সেই মুদার পাথারেয়া, রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা, অভয় ফাদনীস প্রমুখের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস উর্দু প্রেমে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

পঞ্চম কথা, জাভেদ আখতার যে ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে এসেছেন সেই ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে থাকেন। সেগুলো সব সময় সবার কাছে যে সমাদরে গৃহীত হয় না, তা আপনারা তাঁর অনুষ্ঠান নিয়ে এই সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝে থাকবেন। তবে জাভেদ আখতার, শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দীন শাহ প্রমুখ কিংবদন্তী অভিনেতারা সর্বভারতীয় বিনোদন জগতে যে প্রগতিশীল বলয় তৈরি করেছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব আজ কতটা তা নিয়ে ওনারা কী ভাবেন তা জানা যায়নি। হয়তো ঘনিষ্ঠ মহলে কিছু বলে থাকবেন। এসব নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা তাঁর আপামর অনুরাগীদের সঙ্গেও ভাগ করে নিন, এটাই  গুজারিশ রইল।

ষষ্ঠ কথা, এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগে ভারতীয় ভাষা পরিষদ ভবনে হজরত মহম্মদ(সঃ)'এর ওপর একটি অনুষ্ঠান রহস্যময় কারণে শেষ মুহুর্তে বাতিল হয়ে যায়। আরও রহস্যময়  ভাবে তা নিয়ে মিডিয়াতে কোনও হইচই হয়নি। কদিন আগে আবার ধর্নার অনুমতি বাতিলের জেরে এক বিধায়ক সহ ৯৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শোনা যায়, একবার উৎপল দত্ত তাঁর নাটকের শো বাতিল হয়ে যাওয়ার পর বলেছিলেন, 'যে নাটকটা আপনারা দেখতে এসেছিলেন, তা বিনামূল্যেই দেখে নিলেন।' গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যদি এরকম অনুষ্ঠান আর কর্মসূচি বাতিলের নাটক চলতে থাকে তাহলে মানুষ তামাশা দেখার জন্য জলসাঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবেন আর অভিনেতা-টেকনিশিয়ানদের পেট চালাতে শ্যুটিং'এর সেট ছেড়ে তামাশা দেখতে আসা ভিড়ের মধ্যেই বাদাম বেচতে হবে।

ঘটনা প্রসঙ্গে জাভেদজী জানিয়েছেন, তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সংগঠনের কাছ থেকেই ঘৃণা পেয়ে থাকেন। হিন্দু সংগঠনগুলো তাঁকে পাকিস্তান চলে যেতে বলে। সম্প্রতি তিনি লাহোর গিয়ে সমাদরই পেয়েছিলেন বলে জানি। বিভিন্ন ছবিতে দেখেছি, পাকিস্তানের বড় বড় তারকারা তাঁর পায়ের কাছে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর বাণী অবগাহন করছেন। এরকম দৃশ্য কলকাতায় দেখতে পাওয়া গেল না। বরং কলকাতায় এসে হেনস্থা হয়েছেন অনেক শিল্পী ও খেলোয়াড়। এই তালিকাটা একটু বাড়ল।

আশা রাখি, জাভেদ আখতারকে শীঘ্রই আবার রাজ্য সরকারের তরফ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। উর্দু একাডেমি'র মতো ছোটখাটো নয়, 'ধনধান্যে'র মতো বড় কোনও সভাগৃহে তাঁকে বলতে দেওয়া হবে। সেখানে আমরা তন্ময় হয়ে শুনব, কীভাবে গুরু দত্তের সময়ের বলিউডে বাঙালি শিল্পী থেকে বাঙালি কৃষ্টির কদর হত, আর এখন বাঙালি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর নামও বিকৃত করা হয়; তাঁর কর্মমন্দির বলিউডের এই যাত্রাপথকে তিনি কীভাবে দেখেন।


Monday, 1 September 2025

উন্নত জীবন সূচকে ভারত পিছিয়ে

জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের অবনমন

রাজীব ভট্টাচার্য



বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে সবসময়ই মনে হয় যে অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্পদ একশ্রেণির মানুষকে জীবনের মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে পরিণত করেছে আদ্যোপান্ত ভোগ বিলাসী ও ক্ষমতালোভী যন্ত্রমানবে। একদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, আবাস, প্রতিরক্ষা, ক্রীড়া ও প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতি আর অন্যদিকে প্রকৃতি তার প্রলয় রূপে নিজের উপর হওয়া অত্যাচারের জবাব দিচ্ছে। আর তাই সবচাইতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন। এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দেয় যে মানব সভ্যতা ভবিষ্যতে ঠিক কোনদিকে ধাবিত হতে চলেছে। প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন টুকরো টুকরো ছবি প্রমাণ দেয় নৃশংসতার কুৎসিত রূপ। সাম্প্রতিককালে শিশু, নারী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উপর শারীরিক নির্যাতন ক্রমেই আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রমাণ দিচ্ছে। অসহিষ্ণুতা, সীমাহীন লোভ ও বর্বরতা ক্রমেই সমাজকে নিম্নগামী করে তুলেছে, জন্ম দিয়েছে অস্থিরতা ও মানসিক ক্লেশের।

উল্লেখ্য, ৩৮টি গণতান্ত্রিক দেশকে নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা OECD (Organisation for Economic Co-operation and Development) মানব জীবনের প্রকৃত উন্নয়ন পরিমাপের জন্য একটি উন্নত জীবন সূচক (OECD Better Life Index) সৃষ্টি করেছে । ১১টি বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই সূচক, যার মধ্যে রয়েছে বাসস্থান, আয়, কর্মসংস্থান, সমাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, জীবনের সন্তুষ্টি, সুরক্ষা ও চাকরি এবং জীবনের ভারসাম্য। যদিও ভারতবর্ষ এই OECD দেশগুলির মধ্যে পড়ে না, তথাপি উপরিউক্ত বিষয়গুলির উপর ভিত্তি করে এই সূচক ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে তা কেমন জায়গায় দাঁড়াতে পারে তার একটি প্রয়াস নেওয়া যাক।

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল জাতীয় আয়কে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনযাত্রার উন্নয়নের প্রকৃত পরিমাপ হিসেবে গণ্য করার যথেষ্ট অসুবিধা রয়েছে। ১৯৭৩ সালে নর্দাস ও টবিন্স প্রথমবারের জন্য এ প্রসঙ্গে 'Measure of Economic Welfare' (MEW) অবতারণা করেন। ১৯৯১ সালে UNDP প্রথম মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পরিমাপ মারফত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এক তালিকা প্রস্তুত করে। ২০০৮ সালে ফ্রান্সে একটি কমিশন গঠিত হয় যার মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক উন্নয়নের পরিমাপ করা, অর্থাৎ, জাতীয় আয়ের গণ্ডির বাইরে গিয়ে জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়নের এক মাপকাঠি গড়ে তোলা। ২০০৯ সালে জোসেফ স্টিগলিটজ, অমর্ত্য সেন ও জাঁ পল ফিতুসি এই কাজে ব্রতী হন এবং পরে ২০১১ সালে OECD Better Life Index সৃষ্টি হয়। 

এই সূচকের প্রথম বিষয়টি হল বাসস্থানের অবস্থা ও তার উন্নয়ন। বাসস্থান ও তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপরেই নির্ভর করে মানুষের বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা গ্রহণের সুযোগ। ভারত সরকার দরিদ্র শ্রেণির মানুষের উন্নতির জন্য দুটি আবাস যোজনা শুরু করে-- প্রথমটি, সবার জন্য ঘর এবং পরে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের অসহযোগিতা ও মতানৈক্য লক্ষ্যে পৌঁছনোর মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাসস্থানের ক্ষেত্রে গ্রাম অথবা শহর কোনওটিতেই দরিদ্র মানুষের প্রকৃত উন্নতি ঘটেছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। 

দ্বিতীয় বিষয়টি আয় ও সম্পদ, যা গৃহস্থালীর ভোগের খরচের মূল চালিকাশক্তি। কর বর্জিত আয় ও হস্তান্তর মানুষের ভোগ ব্যয় নির্ধারণ করে। স্টিগলিট্জ‌, পিকেটি ও সাম্প্রতিককালে মৈত্রীশ ঘটক প্রমুখদের লেখায় ভারতে আয়, সম্পদ ও ভোগ-- এই তিন ক্ষেত্রেই বৈষম্য গত কয়েক দশকে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। 

তৃতীয় বিষয়টি কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব, যা একটি পৃথিবীব্যাপী সমস্যা এবং ভারতবর্ষ এর ব্যতিক্রম নয়। সন্তোষ মেহরোত্রা, অমিত বাসোল প্রমুখদের লেখায় দেখি, ২০১২ সাল থেকেই ভারতবর্ষে বেকারত্বের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। যে পরিমাণ স্বল্প কিছু কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে তা সবই বেসরকারি অসংগঠিত ক্ষেত্রে। কিন্তু এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ চাকরির স্থায়িত্ব ও সুরক্ষা। শুধু তাই নয়, কাজের গুণমান ও পরিবেশ দুইই নিম্নগামী। এর উপর চেপে বসেছে কর্মক্ষেত্রে চাহিদা ও জোগানের দক্ষতার অসামঞ্জস্য ও অসম প্রতিযোগিতা, যা মজুরির তারতম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর রাহুর দৃষ্টির মতো দেখা দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কালো ছায়া, যা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সঙ্কুচিত করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা অনুযায়ী, আগামী দু' দশকে ভারতবর্ষে ৬৯ শতাংশ চাকরি অটোমেশনের ঝুঁকির মুখে পড়বে। নিম্ন দক্ষতা সম্পন্ন পুনরাবৃত্তিমূলক নিত্যকর্ম যেগুলি মূলত অসংগঠিত শ্রমিক দ্বারা সম্পন্ন হয় সেগুলি বেশি মাত্রায় ঝুঁকির সম্মুখীন। এর অবশ্য একটি মূল কারণ অসংগঠিত শ্রমিকেরা সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (ILO, ২০২৪)'এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতবর্ষে বেকারত্ব ২.৩ শতাংশ (২০০০ সালে) থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৮ শতাংশে (২০১৯ সালে), ২০২২ সালে যা কিছুটা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ৪.১ শতাংশে। CMIE'এর সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতবর্ষে বেকারত্বের হার এপ্রিল ২০২৫'এ ৭.৭ শতাংশ থেকে কমে জুলাই ২০২৫'এ দাঁড়িয়েছে ৬.৮ শতাংশে। তাই বিভিন্ন এজেন্সির সংখ্যাতত্ত্বের তারতম্যের বিচার করলে বেকারত্বের হার যে মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়, তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে মূলধন নিবিড় প্রযুক্তির কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিনে দিনে আরও হ্রাস পাচ্ছে। 

চতুর্থ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ। বিশ্ব সামাজিক উন্নয়ন সূচক (Global Social Progress Index) ২০২৪'এ ১৬৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১০তম যা বিশ্বের গড় সূচক ৬৫.২'এর নিচে। অর্থাৎ, ব্যক্তি, পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ও তার মাধ্যমে মানসিক ও অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ভারত বেশ পিছিয়ে। 

পঞ্চম বিষয় জ্ঞান ও দক্ষতা। বিশ্ব জ্ঞান সূচক (Global Knowledge Index, GKI)'এর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৪১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯২তম যা বিশ্বের গড় ৪৭.৮'এর তুলনায় নিচে। বিশ্ব মানব সম্পদ সূচক (Global Human Capital lndex) ২০২৫'এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩০তম। তবে একটি আশার দিক হল, QS World Future Skill Index ২০২৫ অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান প্রস্তুতিতে ভারতের স্থান দ্বিতীয়। 

ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল পরিবেশের গুণগত মান, যা নির্ভর করে বাতাস, জল ও মাটি দূষণের মাত্রা ও গুণগত অবস্থাৱ উপর। Environmental Performance Index ২০২৪'এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষের স্থান ১৭৬ (মান ২৭.৬)। অর্থাৎ, দূষণমুক্ত পরিবেশ ও তার ভারসাম্য রক্ষায় ভারতবর্ষের স্থান অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। তবে এ ক্ষেত্রে Energy Transition Index, ETI বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল কারণ, এই সূচক নির্দেশ দেয় একটি দেশ কত দ্রুত তার সনাতনী জ্বালানি পদ্ধতি বিসর্জন দিয়ে নবতম নবায়নযোগ্য শক্তিতে (Renewable Energy) রূপান্তর ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন কর্মক্ষমতা সূচকের (Climate Change Performance Index,CCPI) ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে ২০২৫'এর CCPI রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬৪টি দেশের মধ্যে ভারত দশম স্থানে রয়েছে। এর প্রধান কারণ, মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যবহারে হ্ৰাস টানা ও নবতম শক্তির উদ্ভাবনে জোর দেওয়া। 

সপ্তম বিষয়টি নাগরিক সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণ। এ ক্ষেত্রেও ভারতের অবস্থা অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক নয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত নাগরিক সমাজ অংশগ্রহণ সূচকে (Civil Society Participation Index) ভারতের মান ০.৬০৬ যা বিশ্বের অন্যান্য ১৭১টি দেশের গড় ০.৬৯০'এর চাইতে নিচে। এটি তৈরি হয় নির্বাচনী গণতন্ত্র, উদার গণতন্ত্র, অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্র, বাক্‌ স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দুর্নীতি, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়গুলির উপর ভিত্তি করে। তাই এই সূচকও ভারতের অগ্রগতির সুবার্তা বহন করছে না। 

অষ্টম বিষয়টি নির্দেশ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিকাঠামোর দিকে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে ১৯৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৬৬তম। এর মূল কারণ অবশ্যই দেশের জাতীয় আয়ের অতি সামান্য অংশই সামাজিক উন্নয়ন, অর্থাৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় হয় যা সরকারি পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও উন্নততর পরিষেবা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আত্মগত কল্যাণ (subjective well-being) যা মূলত আনন্দ ও সন্তুষ্টির অনুভূতিকে বোঝায়, তার পরিমাপের একটি উল্লেখযোগ্য সূচক হল বিশ্ব সুখী সূচক (World Happiness Index, WHI)। ২০২৫ সালের WHI পরিসংখ্যান বলছে, ১৪৭টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষের স্থান ১১৮, অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রেও ভারতকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় সুখী দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যথেষ্টই কষ্টসাধ্য। 

দশম বিষয়টি সুরক্ষা, যা মূলত নির্দেশ করে সমাজে অপরাধ প্রবণতা, সংঘর্ষ, হিংসা, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি বিষয়গুলির দিকে। বিশ্ব শান্তি সূচক (Global Peace Index) ২০২৫ অনুযায়ী ভারতবর্ষের স্থান ১১৫তম, যা ২০২৩ ও ২০২৪'এর তুলনায় কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। তবে এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন রকম অপরাধ প্রবণতার বৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের কারণে সুরক্ষার দিক থেকেও ভারতের স্থান অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। 

সর্বশেষ বিষয়টি কর্ম ও জীবনের ভারসাম্য। বিশ্ব কর্মজীবন ভারসাম্য সূচক ২০২৫'এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৪২তম।

তাই, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির বিচারে ভারতবর্ষ পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দেশ হলেও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানুষের সামাজিক, মানসিক ও আত্মিক মানোন্নয়নের কথা বিচার করলে তা যে খুব ভালো জায়গায় রয়েছে সেটা হলফ করে বলা চলে না। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের যে দিকগুলি OECD তাদের Better Life Index'এ তুলে ধরতে চেয়েছে, যা আয়ের গণ্ডি পার করে কর্মসংস্থান, সমাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, জীবনের সন্তুষ্টি, সুরক্ষা ও চাকরি জীবনের ভারসাম্যের কথা বলে, অর্থাৎ, জীবনযাত্রার মান সত্যিই কতটা উন্নততর হয়েছে তার সর্বাঙ্গীন বিচার করার চেষ্টা করে, সেইসব ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে আরও বেশি গুরুত্ব আরোপ করা ভীষণ জরুরি। এগুলির দিকে মনোযোগ না দিলে ভবিষ্যতে আমাদের আর্থিক উন্নতি হয়তো যথেষ্টই বাড়বে কিন্তু সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, সামাজিক উন্নয়ন, শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব হবে না।


Sunday, 31 August 2025

'গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই'

'জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে'

বাংলাদেশের বিশিষ্ট দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার'এর সঙ্গে সাম্প্রতিক এক দীর্ঘ কথোপকথনে যে মূল প্রশ্নগুলি উঠেছিল, তারই লিখিত উত্তরে ফরহাদ ভাই আমাদের যা জানালেন। কথোপকথন ও প্রশ্ন উত্থাপনে অনিন্দ্য ভট্টাচার্য।  



প্র: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন?

অবশ্যই ভাল। ভেবে দেখুন, আমরা একটা জগদ্দল পাথর সরাতে পেরেছি। ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই কঠিন, কিন্তু সে লড়াইয়ে প্রাথমিক রাজনৈতিক বিজয়টা ঘটে গিয়েছে; অপূর্ণ বটে, কারণ ৫ তারিখের গণঅভ্যুত্থানের পর ৮ তারিখে একটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটে গেল। কিন্তু গণসার্বভৌমত্ব কায়েম বা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন আমাদের রাজনীতির প্রধান ধারা হিসাবে জনগণের রাজনৈতিক চেতনায় এসে গিয়েছে। তরুণদের রণধ্বনি ও কর্মসূচির মধ্যে তার প্রতিফলন পাবেন। ফলে, নির্বাচনী রাজনীতি বনাম নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতি আমাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রে চলে এসেছে। 

নির্বাচনী রাজনীতি বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বহাল রেখে আবার লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির হাতে বাংলাদেশ লুটপাট করবার ব্যবস্থা করে দেয় এবং পুরানা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে রক্ষা করে – সে ব্যাপারে জনগণ সচেতন হয়ে উঠছে। নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন মানে একদিকে সাম্রাজ্যবাদ সহ পুরানা ঔপনিবেশিক আইন ও রাষ্ট্র কাঠামো উপড়ে ফেলা এবং সকল প্রকার সেকুলার ও ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট মতাদর্শকে মোকাবিলা। যেমন ধরুন জাতিবাদের বিকৃত ধর্মীয় রূপ – হিন্দুত্ববাদ ও ফ্যাসিস্ট ইসলামি জাতিবাদ, ইত্যাদি। ফলে, ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তি আমরা মোকাবিলা করছি। অন্যদিকে ধর্মের প্রশ্নে আমরা ধ্রুপদী মার্কসীয় ধারা অনুসরণ ও তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারছি। মার্কস বলেছিলেন, ধর্মের পর্যালোচনা ছাড়া সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটে না। অতএব, ধর্মের প্রশ্নকে আমরা সামনে নিয়ে এসেছি, যেন ধর্মের সার্বজনীন মর্মশাঁস আমাদের দর্শন, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বিকাশের শক্তি হয়ে উঠতে পারে। পাশ্চাত্য, অর্থাৎ, খ্রিস্টিয় ইউরোপ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সভ্যতার মানদণ্ড আর আমরা সব বর্বর জাতি – আধুনিকতার এই দাবি আমরা নাকচ করি। সেই দিক থেকে বলতে পারেন, ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটি শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে গড়ে তুলবার শর্ত তৈরি হয়েছে। এটা বিশাল ব্যাপার। 

এখন আমরা বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ (constitute) করবার কথা বলছি, যা আগে আমরা বলতে পারি নি। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের  সরাসরি ভোটে নির্বাচিত গণপরিষদে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের কথা এখন আমরা ভাবছি, সাধারণ মানুষ ভাবছে, ভাবতে পারছে। ভেবে দেখুন, বিশ্ব ব্যাপী নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসি বা কাছাখোলা অবাধ বাজার ব্যবস্থা জারি রেখে এবং বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক শোষণের বেড়াজালে আটকে রেখেও বাংলাদেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষকে আটকে রাখা যায় নি। এটা বিশাল ঘটনা। হয়তো এর জেরে  পুরা উপমহাদেশ ইতিবাচক ভাবে বদলে যেতে পারে। উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির শর্ত তৈরি করেছে বাংলাদেশ। ঠিক যে, আমরা যেমন চেয়েছি, তেমন ঘটেনি। প্রচুর বাধা ও প্রতিবন্ধকতা আছে। কিন্তু উল্লম্ফন ঘটেছে বিশাল। তাই লড়াই আছে, কিন্তু আমরাও লড়ে যাচ্ছি। ইতিহাস সৃষ্টি তো গোলাপ ছিটিয়ে রাখা রাস্তা কিংবা ‘বকুল বিছানো পথ’ নয়। 

আমরা কার্যত একটা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। একটা জগদ্দল পাথর বাঙালি জাতিবাদের নামে আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছিল এবং জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি হিসাবে সংগঠিত হতে সক্ষম হয়েছিল। সেটা একই সঙ্গে ছিল দিল্লির আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সম্প্রসারণ – অর্থাৎ, উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূল রাজনীতির অংশ। দেখুন, হিন্দুত্ববাদী জাতিবাদ ভূ-রাজনৈতিক ভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত ‘ওয়ার অন টেরর’ নামক সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত। আমরা তাকে মোকাবিলা করছি। 

প্র: আপনি বলেন, নির্বাচনেই সমস্যার সমাধান হবে না; তাহলে এই মুহূর্তে করণীয় কী?

নির্বাচন দিয়ে তো আপনি কলোনিয়াল উত্তরাধিকার হিসাবে যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তাকে ধ্বংস ও নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে পারবেন না। তাছাড়া নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির নাম। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেখানে আমাদের প্রধান সমস্যা সাম্রাজ্যবাদ – বিশেষত নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসির যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে এসে অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করা, সেখানে নির্বাচন মানে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণিকে নির্বাচিত করা। কারণ, ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা যাদের নাই তাদের পক্ষে নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। আর লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণিই নির্বাচনে বিনিয়োগ করবে। রাষ্ট্র তাদের লুটপাটের ক্ষেত্র। তাহলে নির্বাচন দিয়ে কী করব? 

তাছাড়া কীসের নির্বাচন? গণপরিষদ? জাতীয় সংসদ? স্থানীয় সংসদ? কোন নির্বাচন? লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণি – আপনাদের দেশেও শক্তিশালী – তারা নির্বাচনকে একটা বিমূর্ত ব্যাপারে পর্যবসিত করে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন মানে তো গণতন্ত্র নয়। 

গণঅভ্যুত্থান আমাদের গাঠনিক ক্ষমতা দিয়েছে— আইন, প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিকে জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী গঠন করবার ঐতিহাসিক অধিকার আমরা চাইছি। নদী বিধৌত বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। আমরা প্রকৃতি-সম্মত সমৃদ্ধি, প্রাণের সুরক্ষা ও প্রাণবৈচিত্র্যের বিকাশ চাই। নদী-বন-সমুদ্র-আকাশের রক্ষক হয়ে সবুজ-শিল্পায়ন/ রফতানি-বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে চাইছি। এতে রাজনৈতিক নৈতিকতা যাকে আমরা গণসার্বভৌমত্ব (popular sovereignty) বলি সেটা রয়েছে। একই সঙ্গে প্রকৃতি সুরক্ষার বৈধতাও আমরা নিশ্চিত করতে চাইছি (rights of nature)। সর্বোপরি, আমরা চাইছি দ্রুত ও ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটুক, যেন জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করা যায় এবং সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক উন্নতির সুফল পায়। 

প্র: বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্রটি এখন কেমন? এ বিষয়ক ভাল ও খারাপ দিকগুলি কী কী?

পুরা উপমহাদেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের সকলের জন্য বড়সড় চ্যালেঞ্জ। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বড় কোনও সমস্যা হয় নাই। বাংলাদেশের সমাজ উপমহাদেশের বাইরে তো নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে বিশেষ ভাবে নষ্ট হয়েছে, কারণ সেকুলার বাঙালি জাতিবাদের মহিমা প্রমাণ করবার জন্য নিয়মিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার হত আর তার দোষ চাপিয়ে দেওয়া হত ইসলামপন্থীদের ওপর। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় প্রচারণা তাতে ক্রমাগত ইন্ধন জুগিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেকুলার বাঙালি জাতিবাদের পশ্চাদপসরণের ফলে ধর্মবাদী জাতিবাদ বা সাম্প্রদায়িক ইসলামপন্থার সাময়িক তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। মাজার ভাঙা ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ীঘর, উপাসনালয় আক্রমণের চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু জনগণ সেটা রুখে দিয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের সংগঠিত প্রচার দেখে মনে হয়, এর পক্ষে সীমান্তের ওপার থেকে ইন্ধনও ছিল প্রচুর। তবে এটা সত্য যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে সন্ত চিন্ময় মহারাজকে গ্রেফতার ড. ইউনুসের কলঙ্কজনক কাজ হিসাবে ইতিহাসে বিবেচিত হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপে তিনি এটা করেছেন। চিন্ময়কে এখনও মুক্তি দেওয়া হয় নি। এটা খুবই গর্হিত কাজ হয়েছে। 

প্র: বিপ্লবের আগামী কর্তব্যকর্ম কী?

বাংলা ভাষায় ‘বিপ্লব’ অভিধাটি সাধারণত বলশেভিক বা চিনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্যোতনা বহন করে। গণঅভ্যুত্থান অবশ্যই রাজনৈতিক বিপ্লব। অর্থাৎ, যাকে আমরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে থাকি। তবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়। বলা বাহুল্য, আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার আমাদের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য বটে, তবে ধ্রুপদী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এই মূহূর্তে আমাদের লক্ষ্য নয়। আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের  রূপান্তরের রাজনৈতিক শর্ত প্রতিষ্ঠাই আমাদের এখনকার প্রধান কাজ। 

আমরা গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে আগে গঠন করতে চাই। সেটা হবে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের ভিত্তি। আমরা এখনও ব্যক্তির বিকাশ ও ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য সম্পন্ন করতে পারি নি। সেটা আগে সম্পন্ন করতে হবে। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রতিহত করবার প্রধান রণধ্বনি হচ্ছে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত করা। 

৫ অগস্ট গণঅভ্যুত্থান হলেও ৮ অগস্ট একটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটেছে। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে পুরানা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই বহাল রাখা হয়েছে। আমাদের এখনকার কাজ প্রতিবিপ্লবকে রুখে দেওয়া, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে সামষ্টিক অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে তাকে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করা এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বাস্তবায়িত করা। গণতন্ত্র বলতে আমরা গণসার্বভৌমত্ব কায়েম বুঝি – অর্থাৎ, জনগণের কাছে জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। আমরা যে রাষ্ট্রের কল্পনা করি সেটা প্রাচীন ওয়েস্টফিলিয়ান রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব নয়। এই ধারণার দ্বারা ইংরেজ কলোনিয়াল রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক চরিত্র ও কাঠামো বহাল রাখা হয়। একই কারণে আমরা ব্রিটিশ সংসদীয় সার্বভৌমত্ব বা নির্বাচনের মাধ্যমে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণি দ্বারা গঠিত জাতীয় সংসদও চাই না। তার মানে গণসার্বভৌমত্বকে অবশ্যই রাষ্ট্র কিংবা সংসদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। তাই আমরা তিনটা দাবিকে সামনে রেখে লড়ছি ও জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ও শিক্ষিত করে তুলছি। । 

এক) আমরা এমন কোনও রাষ্ট্র চাই না যে রাষ্ট্র তথাকথিত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নামে ব্যক্তির অধিকার ও ব্যক্তির মর্যাদা হরণ করবার তথাকথিত সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে; অর্থাৎ, রাষ্ট্র এমন কোনও আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না যা ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা হরণ করে; 

দুই) আমরা এমন কোনও রাষ্ট্র চাই না যে রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার নামে প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করে। কর আদায় ও জনগণকে দমন করবার জন্য ইংরেজ যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছে এখনও তা বহাল রয়েছে। আমরা ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে আমাদের নদীমাতৃক ভূগোল, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। সার্বভৌম ক্ষমতার নামে আমরা রাষ্ট্রের হাতে এমন কোনও ক্ষমতা দিতে চাই না যার দ্বারা আমাদের অর্থনীতির প্রাকৃতিক ভিত্তি ভূগোল, প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ইত্যাদি নষ্ট বা ধ্বংস হয়; 

তিন) রাষ্ট্র কখনই এমন কোনও আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না যার দ্বারা জনগণের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হয়। 

গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে আমরা কীভাবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বিপরীতে নিজেদের গঠন এবং আঞ্চলিক আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলা করতে পারি সেই দিকেই এখন আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছি। 

আমরা জনগণকে সচেতন করে চলেছি। আমরা এগিয়ে যাব। অবশ্যই।


Saturday, 30 August 2025

আবেগগত বুদ্ধিমত্তাই সাফল্যের ভিত্তি

বিস্ময়হীন শিশুকাল ও আমরা

সোমা চ্যাটার্জি



'বাড়ি থেকে পালিয়ে' ছবির সেই দৃশ্যটা মনে আছে? যখন কিশোর কাঞ্চন গ্রাম থেকে শহরে এসে হাওড়া ব্রিজ দেখতে পায়! বা গঙ্গায় ধোঁয়া ওঠা ছোট জাহাজের চলাচল! কিংবা 'তারে জমিন পর' ছবির ছোট ঈশান যখন স্কুল থেকে পালিয়ে মুম্বই'তে আকাশছোঁয়া অট্টালিকার রঙ করা দেখতে উপরের দিকে বড় বড় চোখ তুলে তাকায়! অথবা, 'পথের পাঁচালি'র সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য, যা আমাদের মনে শিশু বয়সের একটি চিরন্তন ধারণাকে গেঁথে দেয় -- কাশে ভরা মাঠের মধ্যে, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে এগিয়ে আসছে দৈত্যরূপী রেলগাড়ি আর অপার বিস্ময়ে তা দেখছে বালক অপুর চোখ।

এক শিশু মনের এই বিস্ময়ই তাকে বাঁচিয়ে রাখে, জন্মলগ্ন থেকে বড় হওয়া, আমৃত্যু এই কৌতূহলই তার জীবন সঞ্জীবনী। তিন-চার থেকে বারো বছর পর্যন্ত একটি শিশু যা কিছু দেখে, সেই দেখার সঙ্গে তার নিজের বোঝাপড়া ও বিস্ময়কে মিলিয়ে নেয়। সেই দেখা তার মনের মধ্যে গেঁথে থাকে। মানবশিশু শৈশবে যা দেখে, বোঝে, সব কিছুতে শুধু বিস্ময় আর বিস্ময়! ফলে, পুরো জীবনের রঙ, রূপ, রস, গন্ধ  সব কিছুই তৈরি হয় বিস্ময়ের আবহে।

কিন্তু আজ আমাদের শিশুদের মধ্যে এই বিস্ময়-নিবিষ্টতা সত্যিই কি আর আছে? আজ সত্যিই কি আমরা প্রাত্যহিক ইঁদুর দৌড়ে শিশুর এই কৌতূহলী মনকে সঠিক মাত্রায় বুঝতে পারি… বা তার কল্পনাশক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে তার সৃজনশীল মনকে গড়ে ওঠার সুযোগ দিই? পাহাড় কেন অত উঁচু, আকাশ নীল কেন বা সাগরের জল কেন নোনা-- এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে নিজেদের এড়াতে আমরা নিজেরাই কি যন্ত্রচালিতের মতো তাদের প্রযুক্তিভিত্তিক বা গতানুগতিক তথাকথিত সুশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত করে তুলছি না?

অতিরিক্ত সুরক্ষা, প্রযুক্তির অতি-প্রভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষার কারণে শিশুরা এখন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও কম্পিউটারে এত বেশি সময় কাটাচ্ছে যে তারা বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাদের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, জীবনের ছোট বড় কোনও অভিজ্ঞতাই তাদের কৌতূহল উদ্রেক করছে না, ফলে তারা বিস্ময়রহিত অনুভুতিহীন এক প্রজন্মে পরিণত হচ্ছে, যাদের ভবিষ্যৎ ও কর্মশক্তি সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিহীন। কিন্তু বিজ্ঞান বা মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই জগতে লড়াই করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারই মানুষের সৃষ্টিশীল মন; মানুষের থেকে যন্ত্র অনেক তাড়াতাড়ি শিখতে পারে, কিন্তু মানুষের আবেগ, অনুভূতি আছে যেটা যন্ত্রের নেই; যন্ত্র  সমস্যার সমাধান করতে পারলেও মানুষের সৃজনশীলতাকে কখনই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। অর্থাৎ, আবেগগত বুদ্ধিমত্তাই সাফল্যের ভিত্তি। 

একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্র কখনই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। মানুষ জন্মগতভাবেই এমন বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যা খুব তাড়াতাড়ি শিখতে ও চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। আমরা সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করে সেগুলির সমাধান করি। আমাদের আবেগ আছে, আমরা সহানুভূতিশীল এবং অনুভূতি প্রকাশও করতে পারি। আমরা যুক্তি দিই, প্রশ্ন করি, আশপাশের পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হই এবং আমাদের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তনও করতে পারি। যখন আমরা ভুলবশত একটি গরম জিনিস হাতে ধরি, তাৎক্ষণিকভাবে তা ফেলে দিই, কিন্ত AI এমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। এই অনুভূতিগুলির ভিত্তিই হল মানুষের কল্পনা ও অভিজ্ঞতা।

আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।' কল্পনা হল সম্ভাবনার দরজা। কল্পনাপ্রসূত মনই সৃজনশীল। প্রতিটি শিশুই সৃষ্টিশীল এবং এই সৃষ্টিশীলতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। শিশু যখন ছোটবেলায় খেলনা নিয়ে খেলে, তার মধ্যে খেলনা বিষয়ে কৌতূহল তৈরি হয়, তা জন্ম দেয় এক কল্পনাশক্তির; মাটির বুকে চলা গাড়িকে হয়তো শিশু কল্পনার উড়ান দেয় আকাশে, সেই অদৃশ্য ডানা তার মনের গোচরে তাকে সৃষ্টিশীল করে তোলে, তাকে নানা উপায়ে ভাবনা-চিন্তা উদ্ভাবনের রসদ দেয়। ছোট বাচ্চাদের জন্য বিস্ময় তাই একটি অমূল্য সম্পদ। বিস্ময়ের অর্থ, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল ও আগ্রহের অনুভূতি। তা শেখার একটি শক্তিশালী চালিকা শক্তিও, যা শিশুদের নতুন কিছু অন্বেষণ ও আবিষ্কার করতেও উদ্বুদ্ধ করে।

কিন্তু আমরা অধিকাংশ বাবা-মায়েরাই শিশুর সৃজনশীলতাকে গুলিয়ে ফেলি তার কর্মদক্ষতার সঙ্গে। বুদ্ধিমান শিশুমাত্রই যে কর্মদক্ষ হবে তার কোনও মানে নেই। একটি শিশু খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে, সেটা তার কর্মদক্ষতা। কিন্তু সে যদি তার সৃষ্টিশীল মন দিয়ে একটি কল্পনা-প্রসূত ছবি আঁকে, তার মধ্যে তার মানসিক বিকাশের লক্ষণ আছে, সেটা তার বুদ্ধিমত্তা। আমরা বাবা-মায়েরা এই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার আপেক্ষিক কর্মদক্ষতাকে মিলিয়ে ফেলতে গিয়ে অচিরেই তার ক্ষতি করে দিচ্ছি, তার সহজাত স্বাভাবিক ভাবনাকে বেড়া দিয়ে তার মৌলিক চিন্তার বিষয় থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। এতে তার গড়পড়তা কর্মদক্ষতা বেড়ে সে ভবিষ্যৎ জীবনে হয়তো আপাত সাফল্যর দিকে ধাবিত হবে কিন্তু তার সম্ভাবনাময় চেতনার উন্মেষ কখনই ঘটবে না। একটি শিশু যখন নিজে কিছু তৈরি করতে শুরু করে, তা যতই অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, সেটি তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগায়। সে বুঝতে পারে যে কিছু অর্জন করতে সময় ও প্রচেষ্টা লাগে এবং একবারেই সব কিছু ঠিকঠাক তৈরি হয় না, সে বুঝতে পারে সৃষ্টি একটি প্রক্রিয়া, সৃজনশীল হওয়া অনেক উত্থান-পতন ও ব্যর্থতার ঝুঁকি নিয়ে আসে।

কোন্‌ শিশুর ভিতর কোন্‌ প্রতিভা লুকিয়ে আছে তা আমাদের অজানা। শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ অবারিত হলেই বিকশিত হবে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সৃজনশীলতা বিকাশে শিশুর বেড়ে ওঠার সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টিতে শিশু যেন তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের সুযোগ পায়, সে দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ দায়িত্ব আমাদের পরিবার ও সমাজের। বাবা-মাকে তাই শিশুর মনোজগতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তাদের অনুসন্ধিৎসু মনকে যতটুকু পারা যায় সন্তুষ্ট করার প্রয়াস চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জল পড়ে পাতা নড়ে' এই পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির ব্যাপক সাড়া থেকে তাঁর কবিত্ব শক্তির উন্মেষ। তাই উৎসাহ ও উদ্দীপনা সর্বদাই সৃজনশীলতাকে উজ্জীবিত করতে পারে।

অনেকে মনে করেন, শিল্প, সঙ্গীত, লেখালিখি, অভিনয়ের মতো শৈল্পিক প্রচেষ্টার মধ্যেই সৃজনশীলতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু যে কোনও কিছুই শেখার আধার হল সৃজনশীল মন; তা অঙ্ক, বিজ্ঞান বা অন্য কিছুও হতে পারে, কারণ, যে কোনও সমস্যা সমাধান সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগেই হয়। একটি শিশু খুব সহজেই এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় বিচরণ করতে পারে, মৌলিক কোনও ধারণায় পৌঁছতে পারে এবং সেখান থেকেই আরোপিত খোপের বাইরে তার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তাই কল্পনা করা, নতুন নতুন উপায়ে কিছু চেষ্টা করা এবং পরীক্ষা করা, শিশুদের মধ্যে আত্মমূল্যায়নে সহায়তা করে, শিশুদের সামাজিক-আবেগগত বিকাশ গড়ে তোলে।

ছোট বাচ্চারা সব সময় শিখছে। যখন তারা খেলে, সেটি তাদের জীবনে দক্ষতা তৈরি করে, তাদের এবং অন্যদের অনুভূতি কেমন তা বোঝায়। খেলার মাধ্যমে তারা আপস করতে শেখে, সহমর্মিতা শেখে। কল্পনাপ্রসূত  খেলা, যেমন একটি  ট্রেন মহাকাশে উড়তে পারে, আজগুবি লাগলেও তাদের নতুন ধারণা প্রকাশ করতে শেখায়। তাই শিশুদের জন্য এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেখানে সে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই উদ্ভাবনী আচরণ ও খেলাধুলা করতে পারে, অন্যান্য শিশুদের ধারণাগুলোকে আত্মস্থ করতে পারে; আমাদের ধারণাগুলোই শুধু তাদের উপর চাপিয়ে না দেওয়া, তাদের অস্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা ও ধারণাগুলোকে গ্রহণ করা এবং স্বাভাবিক সমাধানে উৎসাহিত করা। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই তাদের মস্তিষ্কের যথাযথ বিকাশ হয়। 

আজকের অধিকাংশ শিশুর জীবনই অতিশৃঙ্খলা বা দৈনন্দিন রুটিনের আবর্তে বন্দী। প্রাক-কৈশোর  বয়স থেকেই তারা স্কুল, তারপর টিউশন বা অন্য যে কোনওরকমের নিয়মিত পড়াশোনা বা খেলাধুলার  কোচিং'এ ব্যস্ত। ফলে, তাদের মুক্ত চিন্তা গড়ে ওঠার পরিসর নেই, নেই সময়। চাইলেও তারা তাদের  কল্পনাপ্রসূত মনের চর্চা করতে পারে না। আবার অন্যদিকে মা-বাবা'রাও নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা সামাজিক অবস্থান বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেন শিশুটির উপর, ফলে, তার মন বা বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। আমরা নিজেরা যা করতে পারিনি বা অসফল হয়েছি, তা সম্পূর্ণভাবে উশুল করে নিতে চাই আমাদের সন্তানদের মধ্য দিয়েই। রিয়ালিটি শো'এর রমরমা দেখলে বোঝা যায়, অভিভাবকদের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা শিশুদের কোথায় নিয়ে ফেলছে! কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় জন্মলগ্ন থেকেই একটি শিশুর না-ফোটা বুলি বা অমলিন হাসিও পণ্য হয়ে আনন্দ, হাততালি বা 'লাইক' কুড়োচ্ছে, অভিভাবকরা বুঝে কিংবা না-বুঝে শিশুদের হাতে অত্যধিক শক্তিশালী মোবাইল যন্ত্রটি তুলে দিচ্ছেন।

অথচ, বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো, সৃজনশীল কাজ, যেমন, ছবি আঁকা, গল্প করা, নাচ-গান ও শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প করলে তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়াও অত্যন্ত আবশ্যক, কারণ, প্রাকৃতিক জগৎ শিশুদের চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে, অনুমান করতে ও সৃজনশীল মন তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে। শিশুরা বালিতে আঁকতে পারে, নুড়িপাথর সাজিয়ে নকশা বানাতে পারে, বালি দিয়ে দূর্গ তৈরি জানে অথবা আকাশে একটি দৃশ্যকল্প উদ্ভাবন করতে পারে। সৃজনশীলতা শিশুবেলা থেকেই ফুটে ওঠে শিশুর আচার, আচরণ ও কাজেকর্মে। তবে সে জন্য চাই যোগ্য পরিবেশ। তাই বাবা-মাকেও সমান ভাবে শিশুর সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। খুঁজে নিতে হবে বিস্ময়-- বৃষ্টির ফোঁটায়, সাদা মেঘের পালে, বা রেলগাড়ির ধোঁয়ায়…।


Tuesday, 26 August 2025

সুখী কারা?

সুখ আর প্রকৃতির সম্পর্ক

সুব্রত কুণ্ডু



কোন দেশের মানুষজন কতটা সুখী তা জানা যায় 'ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস' রিপোর্টে। গত মার্চ মাসের ২০ তারিখে এ বছরের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। বসন্তে প্রকাশিত এই রিপোর্ট কিন্তু ভারতের নাগরিকদের খুশিতে রাঙিয়ে দিতে পারেনি। কারণ, সুখের তালিকার ১৪৭টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১১৮ নম্বরে। প্রায় শেষের দিকে। কিছু মানুষদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লেগেছে, যখন তারা দেখেছে যে, চিন (৬০) নেপাল (৯২), পাকিস্তান (১০৯) আমাদের থেকে ‘বেশি সুখে’ আছে। যদিও গত বছরে ১৪৩টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ছিল ১২৬। সে তুলনায় আমরা এ বছর একটু বেশি সুখে আছি। অন্যান্য সব সূচক বা তালিকার মতোই ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘উন্নত’ দেশগুলি সুখের তালিকারও ওপরের দিকে রয়েছে।

রাষ্ট্রসংঘের 'সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক' এই রিপোর্টটি পেশ করে। রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা সুখী কি না। পাশাপাশি হিসেবনিকেশ চলে সমীক্ষাধীন দেশগুলির আর্থিক বৃদ্ধির হার, দেশবাসীর গড় আয়ু, সামাজিক সহায়তা, কাজ করার স্বাধীনতা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে। এছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা, সরকারের উপর আস্থা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশার মতো মাপকাঠিও রাখা হয় সুখ মাপতে। উল্লেখযোগ্য হল, এসব মাপকাঠিই অন্যান্য ‘উন্নতি’র তালিকাতেও ব্যবহার করা হয়। আর তাই ‘উন্নত’ দেশই সুখী দেশ হয়ে যায়। পরোক্ষে বলা হয়, দেখ বাপু বর্তমান ভোগের উন্নয়ন মডেলেই তোমার সুখ লুকিয়ে রয়েছে।

নিউ ইকনমিক ফাউন্ডেশন নামে লন্ডনের একটি সংস্থা 'হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স' নামে আরও একটি সুখের সমীক্ষা করে। ২০০৬ সাল থেকে তিন বছর অন্তর এই সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালে শেষ হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এর সুখী দেশের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এই তালিকায় কিন্তু প্রথম সারিতে রয়েছে ভানুয়াটু, সুইডেন, এল সালভাদোর, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, ডেনমার্ক, স্পেন, পানামা, ফ্রান্স, চিলে। তবে এখানেও ভারতের স্থান নীচের দিকে - ১৪৭টি দেশের মধ্যে ১২১। আরও অবাক করা বিষয় হল, অন্যান্য এবং ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস তালিকায় এগিয়ে থাকা দেশগুলি যেমন ফিনল্যান্ড রয়েছে ১৭ নম্বরে, আইসল্যান্ড ৫৮, নেদারল্যান্ড ১৪, নরওয়ে ১৫, ইসরায়েল ২২, কানাডা ৭৯, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০২ নম্বরে। 

হ্যাপি প্ল্যানেট ইনডেক্স (HPI) হল দীর্ঘস্থায়ী ভালো বা আনন্দে থাকার একটি মাপকাঠি যাকে ইংরেজিতে ‘সাস্টেনেবল ওয়েলবিয়িং’ বলে। এটা মাপা হয় তিনটি সূচকের মাধ্যমে:

১) পরিতৃপ্ত জীবন - লোকেরা তাদের জীবন নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট (এটা মাপা হয় গ্যালপ ওয়ার্ল্ড পোল পদ্ধতির মাধ্যমে);

২) গড় আয়ু - মানুষ সাধারণত কতদিন বেঁচে থাকে (এই তথ্য নেওয়া হয় রাষ্ট্রসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি সংগৃহীত তথ্য থেকে);

৩) ইকলজিক্যাল ফুট প্রিন্ট বা পরিবেশ পদাঙ্ক - বিভিন্ন দেশের আয়তন এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর যে চাপ বা প্রভাব তৈরি হয় তার মাপকাঠি। এটা মাপা হয় গ্লোবাল হেক্টর দিয়ে। আর এই তথ্য নেওয়া হয় গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক থেকে।

পরিতৃপ্ত জীবন মানের সঙ্গে গড় আয়ু দিয়ে গুণ করে সেই গুণফলকে পরিবেশ পদাঙ্ক দিয়ে ভাগ করে 'হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স' তৈরি হয়। উল্লেখ্য, পরিতৃপ্ত জীবন মানের মধ্যে সাম্য বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। আর এই গুণভাগের প্রক্রিয়াটি জটিল। বোঝার জন্য একটি সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক ফিনল্যান্ড, যে দেশটি ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সের ১ নম্বরে রয়েছে তার পরিতৃপ্ত জীবন মান এবং গড় আয়ুর গুণফল ৯০ আর কোস্টারিকার ৭০। কিন্তু পরিবেশ পদাঙ্ক অনুযায়ী ফিনল্যান্ডের প্রকৃতির ওপর প্রভাব বা চাপ ৯ এবং কোস্টারিকার ৫ গ্লোবাল হেক্টর। এবারে ভাগ করলে ফিনল্যান্ডের নম্বর হবে ১০। আর কোস্টারিকার নম্বর হবে ১৪। অর্থাৎ, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স অনুযায়ী কোস্টারিকা এগিয়ে।

হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এ জীবনধারণের গুণগত মান কতটা ভালো তার ওপর নির্ভর করে সুখী দেশের তালিকা তৈরি হয় না। এই সূচকে দেখা হয়, পরিবেশের ওপর সব থেকে কম চাপ বা প্রভাব ফেলে কোন দেশ সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষকে দীর্ঘ এবং পরিতৃপ্ত জীবন দিতে পারছে। উল্লেখ্য, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স হল প্রথম সূচক, যেখানে সুখে থাকার সঙ্গে এত ব্যাপকভাবে পরিবেশকে যুক্ত করা হয়। আর মজার ব্যাপার হল, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এ থাকা দেশ কোস্টারিকা এবং ভানুয়াটু'র কোনও সেনাবাহিনী নেই। সেনাবাহিনী নেই পানামারও।

সব সুখের সূচক নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে বিস্তর। তার মধ্যে অন্যতম হল, সুখের মতো বিমূর্ত অনুভবকে কীভাবে মূর্ত জিনিস দিয়ে মাপা যাবে। তবে এ কথাও সত্যি, অসম্ভব লাভ এবং লোভের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য প্রকৃতি শোষণ চললে, প্রকৃতি মানুষের জীবনকে ক্রমশ দুর্বিষহ করে তুলবে। তুলবেই।


Sunday, 24 August 2025

এক ব্যক্তি এক দল এক সরকার

ফ্যাসিজমের চূড়ান্ত মহড়া?

সোমা চ্যাটার্জি



কথায় বলে 'তুঘলকি' শাসন! তুঘলকি শাসন বলতে মধ্যযুগীয় ভারতে তুঘলক রাজবংশের অধীনে দিল্লি শাসনকে বোঝালেও, সাধারণত কোনও রাজা বা শাসকের অদূরদর্শী ও অদ্ভুত সিদ্ধান্তগুলি যখন প্রজাদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়, তখন তা বোঝাতে এই শব্দটি আমরা ব্যবহার করি। 'গোদী' রাজ্যে  যে বাস্তবিকই তুঘলকি শাসন চলছে তার প্রমাণ মিলল আরও একবার।

'বিশেষ নিবিড় সংশোধন' বা SIR'এর বিশৃঙ্খলা আর সাধারণ মানুষের হয়রানির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট'এর নির্দেশের পর এক সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ২০ অগস্ট লোকসভায় সংবিধান (১৩০তম সংশোধনী) বিল, ২০২৫ পেশ করলেন; যার অধীনে প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলির মন্ত্রীরা দোষ-প্রমাণ ব্যতিরেকেই যদি কমপক্ষে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনও অপরাধে টানা ৩০ দিন জেল হেফাজতে থাকেন তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ হারাবেন। নতুন বিধান অনুযায়ী, পাঁচ বছর বা তার বেশি শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য টানা ৩০ দিন আটক থাকা কোনও মন্ত্রী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে অপসারিত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে, হেফাজতের ৩১ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদত্যাগের ঘটনা ঘটবে। তবে সংশোধনীটিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা হেফাজত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল দ্বারা পুনরায় নিযুক্ত হতে পারেন।

জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (২০১৯) (সংশোধনী) বিল ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সরকার (সংশোধনী) ২০২৫ বিলেও একই কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অপসারণের সুপারিশ পাঠাবেন আর মুখ্যমন্ত্রী সুপারিশ পাঠাবেন রাজ্যপালকে। বিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করবেন, রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীদের অপসারণ করবেন এবং লেফটেন্যান্ট-গভর্নর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীদের অপসারণ করবেন। 

বিলগুলি পেশ করার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা অমিত শাহের আসনের সামনে প্রস্তাবিত আইনের অনুলিপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ দেখাতে শুরু করেন। ক্রমাগত শোরগোলের মধ্যে সেদিন সংসদ দুপুর ৩টে পর্যন্ত মুলতুবি করা হয়। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অধিবেশন পুনরায় শুরু হলে শাহ বলেন, বিলগুলি ৩১ সদস্যের যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে যা সংসদের পরবর্তী অধিবেশনের আগে তার প্রতিবেদন পেশ করবে। এআইএমআইএম'এর আসাদউদ্দিন ওয়েইসি (যিনি নিজেও একজন আইনজীবী), কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি ও কে সি ভেনুগোপাল সহ বিরোধী সাংসদরা বিলগুলি প্রবর্তনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন এবং প্রস্তাবিত আইনটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে, এর অর্থ প্রধানমন্ত্রী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের অপসারণের পরোক্ষ ক্ষমতা পাচ্ছেন। নতুন বিল নিয়ে রাহুল গান্ধীর মন্তব্য, 'আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছি যখন রাজা ইচ্ছে করলে যে কাউকে অপসারণ করতে পারতেন।' তিনি বলেন, যেহেতু দোষ প্রমাণের দরকার নেই, তাই প্রস্তাবিত আইনটির মাধ্যমে যে কেউ ইডিকে একটি ভুয়ো মামলা দায়ের করতে বলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন ব্যক্তিকে ৩০ দিনের মধ্যে সরিয়ে দিতে পারে। এই ধরনের বিল ফৌজদারি বিচারের আইনশাস্ত্রের বিরুদ্ধে যায় এবং সংসদীয় গণতন্ত্রকে বিকৃত করে। ইডি, সিবিআই, আইটি, এনআইএ'র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির যথেচ্ছাচার এবং সংকীর্ণ পক্ষপাতমূলক স্বার্থে রাজ্যপালদের সাংবিধানিক পদের অপব্যবহার, যা কিনা সুপ্রিম কোর্টও  নিন্দা করেছে-- এই বিলটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনি বৈধতা অর্জন করবে। 

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটিকে 'এক ব্যক্তি-এক দল-এক সরকার'এরই একটি রূপকল্প হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, এটি সুপার-ইমার্জেন্সির চেয়েও ভয়ঙ্কর, কারণ, বিচার ব্যবস্থা বলে আর কিছুই থাকবে না; এই ধরনের বিল রাজনৈতিক অপব্যবহারের একটি চূড়ান্ত অস্ত্র। বিচার ব্যবস্থা, সেশন কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এগুলোর প্রয়োজনীয়তা বা ক্ষমতাও হ্রাস পাবে, কারণ, সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, আইনের চোখে যে কোনও ব্যক্তিই অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ। কিন্তু এই বিল আইনে পরিণত হলে আর অভিযোগ প্রমাণের কোনও জায়গাই থাকছে না। অর্থাৎ, এটি হবে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে চিরকালের মতো শেষ করার একটি পদক্ষেপ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছর আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল মদ নীতি মামলায় জামিন পাওয়ার আগে ছয় মাস জেলে ছিলেন। এই ছয় মাসে তিনি কারাগার থেকে সরকার পরিচালনা করেন। জামিন পাওয়ার পরই তিনি পদত্যাগ করেন। নতুন বিলগুলি কার্যকর থাকলে গ্রেফতারের পর তাঁকে হেফাজতের ৩১তম দিনেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হত। 

কেন এই বিলের বিরোধিতা?

বিরোধীদের আশঙ্কা ভিত্তিহীন নয়। সিবিআই ও ইডি'র মতো প্রতিষ্ঠানগুলির উপর কেন্দ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ইডি'র দায়ের করা মামলাগুলিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার অদ্যাবধি মাত্র ১ শতাংশ। বহু রাজ্যপাল সাংবিধানিক ভাবে নির্দেশিত তাঁদের নিজ নিজ রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শকে মান্য করার পরিবর্তে কেন্দ্রের নির্দেশাবলী মেনে চলেন। এই প্রেক্ষাপটে বিলটি বিপজ্জনক। তাছাড়াও আইনত ও প্রযুক্তিগতভাবেও এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে একতান্ত্রিক ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দেয়। এটি আইন-শৃঙ্খলাকে রাজ্যের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে এসে কেন্দ্রের হাতে তুলে দেবে এবং অনির্বাচিত সংস্থাগুলিকে নির্বাচিত নেতাদের ভাগ্য নির্ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। অভিষেক মনু সিংভি ট্যুইট করেছেন, 'বিরোধীদের অস্থিতিশীল করার সর্বোত্তম উপায় হল, তাদের নির্বাচনী ভাবে পরাজিত করতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও নির্বিচারে গ্রেফতার করে অপসারিত করা!'

'দ্য ওয়্যার'এর সুত্র অনুযায়ী, বর্ষাকালীন অধিবেশন শেষ হওয়ার দু' দিন আগে অমিত শাহ যখন হঠাৎ করে বিলগুলি পেশ করার প্রস্তাবের বিষয়ে মহাসচিবের কাছে অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন, তখন লোকসভা সচিবালয় উল্লেখ করেছিল যে এতে নিয়ম ১৯এ এবং ১৯বি-র লঙ্ঘন হতে পারে। বিধি ১৯এ অনুযায়ী, একজন মন্ত্রীকে লোকসভায় একটি বিল পেশ করার জন্য পূর্ব বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়, অন্যদিকে বিধি ১৯বি-তে বলা হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট বিলটির পর্যালোচনা ও প্রস্তুতির সুবিধার্থে তা আনুষ্ঠানিক ভাবে পেশ করার আগে লোকসভার সমস্ত সদস্যের কাছে বিতরণ করা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। শাহ একটি পৃথক চিঠিতে বর্তমান অধিবেশনে দুটি সংশোধনী বিল পেশ করার জন্য 'সময়ের অভাব' উল্লেখ করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু কেন এই তাড়াহুড়ো? কারণ, বিহারে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন'এ ব্যাপক কারচুপি ও কংগ্রেসের 'ভোট চুরির' অভিযোগ নিয়ে বিরোধীরা সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। 

দুর্নীতি দমন না ক্ষমতায়ন?

বিজেপি'র বক্তব্য, এই বিলের উদ্দেশ্য হল রাজনীতিতে দুর্নীতির উপর আঘাত হানা। রাজনীতিকে অপরাধমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত করাই নাকি তাদের উদ্দেশ্য। তাঁরা বলেন, গ্রেফতারের পরেও দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তামিলনাড়ুর মন্ত্রী ভি সেন্থিল বালাজি তাঁদের পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। কিন্তু আশ্চর্যের হলেও সত্যি, ২০১৪ থেকে ২০২৫'এর সময়কাল ধরলে বিজেপি শাসিত কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে বা তাদের জেলে রাখা হয়েছে, এরকম উদাহরণ তো নেইই, তদুপরি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের থেকেও যারা দলবদল করে বিজেপি'তে যোগদান করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধেও সব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি তেমন অধিকাংশ নেতা-নেত্রীদের ক্লিন চিট দিয়েছে, যার অন্যতম উদাহারণ মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার যার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ২৫,০০০ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল। অজিত পাওয়ার ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই যেদিন এনসিপি থেকে বেরিয়ে বিজেপি'র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, সেদিনই তাঁদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার হয়ে গেছে। এছাড়া সংবাদ সূত্র  ও তথ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪'এর মধ্যে সব কটি বিরোধী দল যেমন এনসিপি, টিডিপি, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি থেকে বিজেপি'তে যুক্ত হওয়া ২৫ জন রাজনীতিবিদদের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে যত বড় বড় হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা ছিল সেগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, এমতাবস্থায় এরকম একটি বিল প্রণয়ন করলে বিজেপি'র কোনও নেতা বা মন্ত্রীর পদ হারানোর কোনও ভয় নেই। 

বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গত শুক্রবার গয়ায় গিয়ে নতুন বিল নিয়ে মন্তব্য করেছেন মোদী। বলেছেন, 'যদি কোনও সরকারি কর্মচারী ৪৮ ঘণ্টা জেলে থাকেন, তাঁর চাকরি চলে যায়। তা তিনি গাড়ির চালক হোন, কেরানি হোন কিংবা পিয়ন। কিন্তু মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও জেল থেকে সরকার চালাতে পারেন! নেতারাই যদি এমন আচরণ করেন, তবে আমরা কী ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করব? এনডিএ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন এনেছে। এই আইনের আওতায় প্রধানমন্ত্রীও আছেন।' এটাই সবচেয়ে বড় রসিকতা। আমরা কি কল্পনা করতে পারি যে একজন প্রধানমন্ত্রীকে কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা জেলে পাঠাবে? যেখানে ইডি, সিবিআই সবই তার হাতের পুতুল! এবারে বিজেপির রাজনীতি ও নীতির বিরোধী প্রতিটি রাজ্য সরকার এখন থেকে স্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর হয়ে পড়বে। এনডিএ-র প্রতিটি সহযোগী দলও জেলে যাওয়া ও পদ হারানোর ভয়ে বিজেপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে মরিয়া হয়ে উঠবে। যেমন আমরা দেখতে পাই দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অসম'এর মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার অথবা অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু নাইডু'র ক্ষেত্রে।

এই প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনে বিজেপি এই আইনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রতিবাদকে পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হিসাবে তুলে ধরবে। বিলটি আপাতত ৩১ সদস্যের একটি যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে গেছে। লোকসভার ২১ জন ও রাজ্যসভার ১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত সংসদের একটি যৌথ কমিটিতে পাঠানোর জন্য কণ্ঠ ভোটে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে আহূত শীতকালীন অধিবেশনের মাধ্যমে কমিটিকে সভায় তার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর জন্য লোকসভা ও রাজ্যসভা উভয় ক্ষেত্রেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তা পাস নাও হতে পারে।

কিন্তু কথা হল, ক্ষমতা দখলের এই নির্লজ্জ লড়াইতে বিরোধী কণ্ঠকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এই হঠকারী, অদ্ভুত ও অযৌক্তিক তুঘলকি শাসনই বজায় থাকবে নাকি সংসদীয় গণতন্ত্রের যৌক্তিকতা আবারও জায়গা ফিরে পাবে?


Friday, 22 August 2025

ইথানল-মিশ্রিত জ্বালানির রাজনীতি

বিশেষ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা?

আবু সঈদ আহমেদ



বর্তমানে ইথানল-মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার বা E20 ইস্যু নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে, যা আর্থ-রাজনৈতিক মূলধারার আলোচনায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ এই বিষয়টি আমাদের স্বার্থ এবং ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর যথাযথ বিশ্লেষণ ও সচেতনতা আমাদের নীতিনির্ধারণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই সময়, আমরা এই ইস্যুটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার এবং বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি, কেন এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

ভারত সরকারের ইথানল-মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ, বিশেষত E20 (২০ শতাংশ ইথানল ও ৮০ শতাংশ পেট্রোল) চালুর সিদ্ধান্ত, একদিকে পরিবেশ ও অর্থনীতির উন্নয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যকে সামনে রেখেছে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মধ্যে বাস্তবিক উদ্বেগ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, ভারত ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর আগেই, E20 মিশ্রণের লক্ষ্য পূরণ করে, যা সরকারের দ্রুতগতির নীতিগত অগ্রগতির প্রমাণ। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি তেল আমদানি হ্রাস, কার্বন নিঃসরণ কমানো, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এই নীতির ফলে ₹১.৪০ লক্ষ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে এবং কৃষকরা ইথানল সংক্রান্ত ফিডস্টক বিক্রি করে ₹১.২০ লক্ষ কোটি আয় করেছেন। 

কিন্তু কথিত আছে,  'There are three kinds of lies: lies, damned lies, and statistics.'। এই সাফল্যের সরকারি দাবির বিপরীতে রয়েছে খদ্দেরদের একাধিক উদ্বেগ। ইথানলের শক্তি ঘনত্ব পেট্রোলের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম, যার ফলে গাড়ির মাইলেজ কমে যায়। বিশেষত পুরনো গাড়িগুলিতে ৩ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত মাইলেজ হ্রাস লক্ষ করা গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এইজন্য অতিরিক্ত জ্বালানি কিনতে হচ্ছে যা পরিবেশের জন্য তথাকথিত সুবিধা হওয়ার দাবির বিপরীত। ইথানলের হাইগ্রোস্কোপিক প্রকৃতি অর্থাৎ জল শোষণের ক্ষমতা জ্বালানি সিস্টেমে ক্ষয় সৃষ্টি করে, যার ফলে রাবার সিল, গ্যাসকেট ও অন্যান্য অংশ বারবার বদলাতে হয়। ২০২৩ সালের আগে নির্মিত অধিকাংশ গাড়ি E20-সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ফলে, রেট্রোফিটিং করতে হয় যার খরচ ₹৪,০০০ থেকে ₹৬,০০০ পর্যন্ত হতে পারে। অনেক খরিদ্দার এই অতিরিক্ত খরচকে অন্যায্য বলে মনে করছেন।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হল, E20 জ্বালানির দাম সাধারণ পেট্রোলের সমান হলেও তার শক্তি কম, ফলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ বেড়ে যায়। ভোক্তারা মনে করছেন, তারা কম কার্যক্ষমতার জন্য বেশি দাম দিচ্ছেন। এছাড়া, পাম্পে E0, E10 বা E15-এর বিকল্প না থাকায় E20-কে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করতে হচ্ছে, যা জ্বালানি পছন্দের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। কেন্দ্রীয় সরকার যদিও এই অভিযোগগুলিকে 'অপ্রমাণিত' ও 'স্বার্থান্বেষী মহলের প্রচার' বলে অভিহিত করেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতে, ইঞ্জিন টিউনিংয়ের মাধ্যমে মাইলেজের ক্ষতি 'সামান্য' এবং তা সহজেই সমাধানযোগ্য। নীতি আয়োগ কর ছাড়ের সুপারিশ করেছে, যাতে ভোক্তারা ক্ষতিপূরণ পান। গাড়ি নির্মাতারা ইতিমধ্যে E20-সামঞ্জস্যপূর্ণ গাড়ি বাজারে এনেছে, যেখানে উন্নত উপকরণ ও ইঞ্জিন টিউনিং ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে E20-র সাফল্যের দাবির প্রভাব প্রশ্নবিদ্ধ। ইথানল তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও ইথানল-মিশ্রিত পেট্রোল (যেমন E20) প্রায় একই দামে বিক্রি হয়, কখনও কখনও বেশি দামে। এর কারণ, উৎপাদন খরচ, করের হার এবং ইথানলের কম জ্বালানি ক্ষমতা। ইথানলের শক্তি পেট্রলের তুলনায় প্রায় ৩৩ শতাংশ কম, ফলে গাড়ির মাইলেজ কমে যায় এবং জ্বালানি খরচ বাড়ে। সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যদিও দাবি করেছে ইথানলের ওপর জিএসটি কমিয়েছে, তবুও সাধারণ ভোক্তারা এর সুবিধা তেমনভাবে পাচ্ছেন না।

প্রচার করা হচ্ছে, পরিবেশগত দিক থেকে E20 জ্বালানি নিঃসরণ কমায় এবং ভারতের Net Zero 2070 লক্ষ্যকে সমর্থন করে। তবে চিনির মতো জল-নির্ভর ফসল থেকে ইথানল উৎপাদন করার ফলে খরাপ্রবণ অঞ্চলে জল সংকট ও ভূমি অবক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। এক ফসলি চাষের প্রবণতা ও মরুকরণের ঝুঁকিও রয়েছে। এই বিতর্কের সারমর্মে দেখা যায়, সরকার E20-কে একটি কৌশলগত ও পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরছে, যেখানে বিদেশি নির্ভরতা কমানো ও কৃষকদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। অন্যদিকে, সাধারণ জনগণ পারফরম্যান্স হ্রাস, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, জ্বালানির দাম ও পছন্দের সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই বিতর্কের পাশাপাশি উঠে এসেছে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি দীর্ঘদিন ধরে ইথানলকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে প্রচার করে আসছেন। তিনি একে পরিবেশবান্ধব, কৃষকদের জন্য লাভজনক এবং বিদেশ থেকে পেট্রোল আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর উপায় হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে ইথানল-চালিত যানবাহনের প্রসার এবং ফ্লেক্স-ফুয়েল ইঞ্জিন ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতে ইথানল মূলত তৈরি হয় চিনি উৎপাদনের উপজাত— আখের মোলাসেস থেকে। এই মোলাসেসে থাকা চিনিকে গাঁজন ও পাতনের মাধ্যমে ইথানলে রূপান্তর করা হয়। দেশের বিভিন্ন চিনিকল ও ডিস্টিলারিতে এই প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, যা ইথানল উৎপাদনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে। নীতিন গড়করি নিজে কটি চিনিকলের সরাসরি মালিক তা নিয়ে সরকারি কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই তবে বেশ কিছু সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয় এই সংখ্যা ১৭। তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, এটা বিভিন্ন রেকর্ডেই পাওয়া গেছে। গড়করি প্রতিষ্ঠিত পুর্তি গ্রুপ পরবর্তীতে ভাগ হয়ে মানস অ্যাগ্রো ও সিয়ান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজে রূপ নেয়, যা বর্তমানে তাঁর দুই পুত্র সারাং ও নিখিল গড়করি পরিচালনা করেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মহারাষ্ট্রে চিনিকল ও ডিস্টিলারি পরিচালনা করে। মানস অ্যাগ্রো ও সিয়ান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে সরকারের কাছে ইথানল সরবরাহ করে, যা পেট্রোলের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কোটি লিটার ইথানল উৎপাদন করে এবং নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। 

তাই, E20 নিয়ে সরকারের উৎসাহ বাস্তবেই কি পরিবেশের জন্য নাকি বিশেষ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।


Saturday, 16 August 2025

আশার আলো দেখাল আদালত

নির্বাচন কমিশন ও বিপন্ন গণতন্ত্র

সুজাত ভদ্র



'If the electoral machinery... is worked by the people whose integrity can not be depended upon, democracy will be poisoned at source...

- H N Kunzru


গত ১২ অগস্ট (২০২৫) 'বিশেষ নিবিড় ভোটার' তালিকা সংশোধন সম্পর্কিত মামলার শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে, 'দেখে শুনে মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের উপর অবিশ্বাস বা বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।' প্রশ্ন হল: তা কেন দেখা দিল? এর প্রধান উত্তরটা নিহিত আছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তিন কমিশনারের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে। 

২০২৩ সালের ২ মার্চ অনুপ বারানওয়াল (Anoop Baranwal) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ এক যুগান্তকারী রায়ে বললেন, সংসদে নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্য নির্বাচন করবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং দেশের প্রধান বিচারপতি। এই রায় বাছাইয়ের পদ্ধতি হিসেবে ২০১৩ সালের লোকপাল আইনের ধারা ৪'এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। উদ্দেশ্য একটাই, সংবিধানের স্পিরিট মেনে কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, পূর্ণ স্বচ্ছতা যেন বজায় থাকে। কোনও চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে, পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সংস্থা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে। এই রায়কে নস্যাৎ করতে ২০২৩ সালের অগস্ট মাসেই মোদি সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে ও বাইরে  প্রবল বিরোধিতাকে যথারীতি উপেক্ষা করে এক নতুন আইন প্রণয়ন করে। তাতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ও সরকারের মন্ত্রীসভার একজন (প্রধান বিচারপতি নয়) মিলে ঠিক করবেন নির্বাচন কমিশনের তিন কমিশনারকে। 

পরিণতি: একেবারে আরএসএস'এর মতাদর্শে লালিত  তিনজনকে বসিয়ে দেওয়া হল। 

স্মরণ করুন শাসক দলেরই ঘনিষ্ঠ এক আমলার পরিণতি: অরুণ গোয়েল'কে সরকার একদিনের মধ্যে স্বেচ্ছা অবসর করিয়ে, তৎসংক্রান্ত ফাইলপত্র সই সাবুদ করিয়ে কমিশনের সদস্য করল। আবার কোনও অদৃশ্য কারণে দু' দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করলেন। ধনকড়ের মতোই গোয়েলের ঝটিকা আগমন, বিদায় আজও রহস্যাবৃত। তারপর SIR'এর নামে বর্তমান নতুন ফুল বেঞ্চের (২৬তম মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার সহ দুজন) নতুন একগুচ্ছ নির্দেশিকার মুখোমুখি হল বিহার তথা ভারতের নাগরিকরা। অবশ্য, ১৪ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টের এক অন্তর্বর্তী আদেশের মাধ্যমে আপাতত এ দেশের চালু গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ -- সর্বজনীন ভোটাধিকার -- রক্ষিত হল কাগজে কলমে। একটা পরিসর তৈরি হল, রাতারাতি ৬৫ লক্ষ নাম বাদ পড়ার সত্যতা যাচাইয়ের।

উল্লেখ্য, সংবিধান রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত গণ পরিষদের দুজন সদস্য -- অধ্যাপক শিব্বান লাল সাক্সেনা ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু (H N Kunzru) -- ১৯৪৯ সালেই বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, অনুচ্ছেদ ৩২৪ অনুসারে কমিশনের স্বাধীনতা বজায় রাখতে গেলে সরকার ও শাসক দলের রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিশনকে 'fully insulated' হতে হবে। ১৯৯০ সালের দীনেশ গোস্বামী কমিশন, ২০১৫ সালের আইন কমিশনের ২৫৫তম রিপোর্ট একই কথা বলেছিল। শাসক দলের নিজস্ব লোক বসালে স্বাধীন সংস্থাটি অচিরেই তার চরিত্র হারাবে, তাঁদের এই আশঙ্কার কথা আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে। 

কমিশনের প্রথম শক থেরাপি ছিল, এপিক কার্ড ও আধার কার্ড নথি হিসেবে বিবেচ্য নয়। যুক্তি: নথি  জাল হয় (ভাবটা এমন, কমিশনের চাওয়া নথি যেন জাল হয় না, বুলেট প্রুফের মতো সব জাল প্রুফ!) এবং আধার নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি নয় (পাসপোর্ট ছাড়া কমিশনের চিহ্নিত বাকি ১০টা নথি যেন নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি!)। তাই, ১১টা নথির একটা (যা ঝাড়খণ্ডের বেলায় ছিল ৭টা) দেখিয়ে খাঁটি নাগরিকত্বও প্রমাণ করতেই হবে, তাহলেই খসড়া নির্বাচনী ভোটার তালিকায় নাম উঠবে। এটা অসাংবিধানিক। কারণ, লাল বাবু হুসেইন মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে যে, একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই নাগরিকত্ব বিষয়টিকে ঠিক করার অধিকারী।

বর্তমান মামলার প্রথম দিনেই সুপ্রিম কোর্টের আধার, এপিক কার্ড'কে নথি হিসেবে গ্রহণ করার অনুরোধ কমিশন হলফনামা দিয়ে বিরোধিতা করে এবং ভারতবাসীর নাগরিকত্ব যাচাই করার অধিকার, ক্ষমতা নাকি কমিশনের রয়েছে বলে দাবি করে (প্রাগুক্ত রায়কে অস্বীকার করে)। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের  প্রয়োজনই হত না আধারকে ১২ নং নথি হিসেবে বিবেচনার করার। কমিশন নিজেই নিজের মুখ পোড়ালো। কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত 'প্রায়শই যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি' কমিশন হয় ও 'তার উত্তর সম্পর্কিত' (FAQ) দলিলের (পৃষ্ঠা ১৮) ৪২ নং প্রশ্নোত্তর দেখুন: তাতে বলা আছে, নাম তোলার ক্ষেত্রে  আধার কার্ড জমা দেওয়া প্রত্যাশিত ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণের জন্য ('for the sake of purification of electoral  roll')। এটাই যদি অবস্থান হয়, তাহলে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধনের' প্রক্রিয়া তো অতি শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া। সেখানে আধারকে নৈব নৈব চ বলাটা কমিশনেরই ঘোষিত নাগরিক-বান্ধব নীতির নির্লজ্জ লঙ্ঘন। 

এপিক কার্ড সম্পর্কে কমিশনের নিজস্ব ঘোষণাটা শোনা যাক: এপিক বৈধ ভোটারের চিরস্থায়ী পরিচয় পত্র ['EPIC, once issued, is valid for lifetime.' (দ্র: কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত Handbook For Electoral Registration Officers/( ২০১২) অধ্যায় ৯, প্যারা ২৪, পৃ ৭৬)]। পংক্তি ২৭ বলছে, '...EPIC Number is designed to act as the permanent unique identity for every elector' (তদেব, পৃ ৭৬-৭৭)। এর অর্থ, এপিক কার্ড বহনকারী বৈধ ভোটার স্বয়ংক্রিয় ভাবে ভারতের নাগরিক। আবার, কোনও অবস্থাতেই এই নথি ফর্ম ভর্তির সময় বাদ যাবে না (তদেব, পৃ ২০-২১)। তাহলে কী উদ্দেশ্যে ও কেন ভোটার তালিকায় নাম তোলার ক্ষেত্রে কমিশন এপিক'কে বাদ দিচ্ছে? আবার কমিশন জানাচ্ছে, ভোটার তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তি মানেই যে তিনি ভারতের নাগরিক নন, তা নয়। এর অর্থ, কমিশন দু' ধরনের নাগরিকত্বের স্তর সৃষ্টি করছে (ভোটাধিকার সহ নাগরিক আর এপিক থাকা সত্ত্বেও ভোটাধিকার বিহীন নাগরিক), যা সংবিধান বিরোধী। প্রশ্নটা এখানেই-- কমিশন এমন কোনও পদ্ধতি আবিষ্কার করে চাপিয়ে দিতে পারে কিনা যার পরিণতি লক্ষ লক্ষ নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ! সমস্ত নাগরিককে সম্ভাব্য সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা যা কদাপি সংবিধান বা জন প্রতিনিধিত্বমূলক আইনের লক্ষ্য ছিল না, আজও নেই।  কমিশনের এই বিষাক্ত বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি বিপুল সংখ্যক নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মূলে আঘাত করছে। ভোটাধিকার থেকে বাদ যাওয়া মানেই অসমের ধাঁচে ডি-ভোটার ক্যাটাগরির সৃষ্টি করা। অমনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সক্রিয় হয়ে উঠবে, তাদের বিদেশি পঞ্জীভুক্ত আইনের আওতায় এনে দেশ থেকে গণ বিতাড়নের প্রকল্প নেওয়া শুরু করবে; নয়তো 'উইপোকা'র মতো মারবে। অনুপ্রবেশ কত ক্ষতি করছে -- সে আওয়াজ তো প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসে লাল দূর্গ থেকে দিয়ে দিয়েছেন।

মনে রাখতে হবে, জন প্রতিনিধিত্বমূলক আইনে এরকম কোনও সংস্থান নেই যে কত বছর পর পর (অর্থাৎ, পাঁচ বা দশ বা পনেরো) সারা রাজ্য জুড়ে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোটার তালিকার 'বিশেষ সংশোধন' কর্মসূচি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। যখন কমিশন বলে, বিহারে ২০০২ সালে বা পশ্চিমবাংলায় ২০০৩ সালে শেষবারের মতো 'বিশেষ সংশোধন' হয়েছিল, তখন কমিশন দু' ভাবে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এক, যেন এসব রাজ্যে 'বিশেষ সংশোধনী' বাকি  আছে। দুই, সেটি আসন্ন নির্বাচনের আগেই শেষ করতে হবে, না হলে নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে করা সম্ভব হবে না। অথচ আইন বলছে, রাজ্য বা দেশ জুড়ে যদি সাধারণ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত সংশোধনী না হয়, তাহলেও নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে হবে। কারণ, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২৫'এর স্পিরিটই হল, ভোটার তালিকাভুক্ত যাবতীয় এন্ট্রিকে সঠিক বলে ধরে নিতে হবে ('presumption of  correctness') [দ্র: লাল বাবু হুসেইন মামলা, ১৯৯৫, AIR, SC, 1189 (paras, 6, 13]; অনুচ্ছেদ ৩২৪'এর ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্ট তিন তিনটে রায়ে জানিয়েছে, আইন অনুসারে ভোটার তালিকা যদি সংশোধনও না হয়, ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে দেশের আদালতও সেই নির্বাচনকে বাতিল করতে পারবে না। আর, রুলস'এর আলোচ্য ২১ নং ধারাটি পরিষ্কারভাবে নন-অবস্ট্রাকশন ক্লজ। বাস্তবে, এই কমিশন অতীত থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের দেশব্যাপী (বিহার সহ) ভোটার তালিকাকে অপমান করছে। কমিশনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, ২০০২'এর পর বিহারে (বা এ রাজ্যে ২০০৩'এর পর) যেন ভোটার তালিকা উন্নীতকরণ হয়নি! প্রাগুক্ত আইনটি ও তৎসংক্রান্ত নিয়মাবলীতে (১৯৫০, ১৯৬০) ভোটার তালিকা কখন কীভাবে, কোন ফর্ম (যেমন ৬, ৭) পূরণের মাধ্যমে  সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে, তার নিয়মকানুন দেওয়া আছে। প্রাগুক্ত হ্যান্ডবুকের অষ্টম অধ্যায়ের নামই হচ্ছে 'ক্রমাগত আপগ্রেডেশন'। অর্থাৎ, বিধানসভা, লোকসভা, এমনকি উপনির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা ঝাড়াই বাছাই অতি স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। এছাড়াও সংশোধনী পদ্ধতির ব্যবস্থা আছে। 

তাহলে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধনের' স্থানটি ঠিক কোথায় নির্বাচনী আইন বা নিয়মাবলীতে?

কমিশন তার ২৪ জুন (২০২৫) তারিখের বিহারের প্রধান নির্বাচনী আধিকারিককে একটি চিঠিতে লিখছে,  ১৯৫০ সালের জন প্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা ২১ অনুসারে বিহারে SIR ২০২৫ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে শুরু হবে। ধারা ২১ হল ভোটার তালিকা প্রস্তুতি ও সংশোধন সংক্রান্ত। এতে তিনটি উপধারা আছে। তিন নম্বর উপধারাতে শুধুমাত্র 'বিশেষ সংশোধনী' করার কথা বলা আছে। লক্ষণীয়, এতে কোথাও 'intensive' (নিবিড়) শব্দটি নেই। সংসদে গৃহীত আইনকে কমিশনের এই ফুল বেঞ্চ বিকৃত করল। উপরন্তু, এই আলোচ্য উপধারাতে স্পষ্ট বলা আছে, বিশেষ সংশোধনী শুধুমাত্র একটি কেন্দ্রে বা সেই কেন্দ্রের অংশে হতে পারে, সমগ্র রাজ্যে নয়। কমিশন জানে তারা বিকৃত করছে। তাই প্রাগুক্ত বিজ্ঞপ্তিতে শুধু ধারা ২১ বলে উল্লেখ করেছে। উপধারাকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করে বিকৃত করেছে উপধারা ২'কে। ১৯৬০ সালের রুলস্'এর ধারা ২৫'এর (১) ও (২) পড়লে পরিষ্কার হয়ে যাবে কমিশনের অসততা। এই ধারা বলছে,  প্রাগুক্ত ২১ (২) মোতাবেক ভোটার তালিকা সংশোধনী [খেয়াল করবেন, শুধু সংশোধনী] প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য [every constituency] যদি করতে হয় তাহলে দু' ভাবে হতে পারে: নিবিড় বা সামারি অথবা আংশিক নিবিড় বা আংশিক সামারি। কোথাও এই ধারাতেও বা অন্যত্র 'বিশেষ নিবিড় সংশোধনী'র কথা বলা নেই। এটা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত শব্দবন্ধ যার মধ্য দিয়ে কমিশন বিজেপির এজেন্ডা পূরণের চেষ্টা করছে। 

আবেদনকারীরা এই দিকটার প্রতি আদালতের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন। আদালতের ১৪ অগস্টের আদেশে 'SIR' ব্যবহৃত হয়নি। উল্লেখ্য, মোহিন্দর সিং গিল মামলায় (১৯৭৮) পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের পক্ষে রায়ে বিচারপতি কৃষ্ণা আইয়ার বলেছিলেন, কমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ  ক্ষমতা থাকলেও তা নিরঙ্কুশ নয়। দেশের আইনের প্রতি, প্রকৃতিগত ন্যায়বিচারের প্রতি কমিশন দায়বদ্ধ থাকবে; কমিশনের আদেশ যদি স্বেচ্ছাচারী ও অবৈধ হয় তাহলে আদালতের হস্তক্ষেপের পূর্ণ অধিকার আছে। [রায়ের চমৎকার তাৎপর্যের জন্য দ্র: S K Mendiratta, How India Votes (4th edn), pp.196-198)]।

আদালতে হলফনামা দিয়ে যেহেতু বলা যাবে না (কারণ কোনও প্রমাণ নেই) যে দেশ রোহিঙ্গায় ভরে গেছে, সর্বত্র গিজগিজ করছে বাংলাদেশি, সেহেতু নির্বাচন কমিশন বিজেপি-আরএসএস'এর ভাষ্যটাকে সামান্য শুধরে নিয়ে বলছে, জনবিন্যাস বদলে গেছে, বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থান পরিবর্তন হয়েছে ইত্যাদি। তাই সংশোধনী দরকার। সাধারণ্যে জানাচ্ছে, অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে হবে, তাড়াতে হবে, তাই শুদ্ধিকরণ  দরকার ইত্যাদি। কিন্তু সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদের নিদানটা একটু খেয়াল করুন: সর্বজনীন ভোটাধিকার যা 'We the People'এর অন্যতম সর্বোচ্চ রূপ যেখানে গরিব, দরিদ্রতম মানুষটি থেকে গৃহহীন, যৌন কর্মী সকলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার আছে, তাই কমিশন এই আদর্শগত অবস্থানের বদল করার অপচেষ্টায় ব্যস্ত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কোনও এন্ট্রান্স পরীক্ষা নয়-- আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে সঠিকভাবেই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর যদি জন্মের কোনও কাগজ না থাকে এবং তারপরেও তিনি ভারতীয় ও প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে লক্ষ কোটি ভারতীয়ের কাছ থেকে জন্ম সার্টিফিকেট চাইবার কোনও অধিকার কমিশনের আছে কী? 

ভোট শুধু একটা কাগজ নয়। ভোটাধিকার ঘোষণা করে আমরা নাগরিক হিসেবে সবাই সমান। সেই অধিকারকে নির্বাচন কমিশন আঘাত করছে। প্রথম দিনের শুনানিতে প্রকাশ্য আদালতে বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া কমিশনের আইনজীবীকে বলেছিলেন, কে নাগরিক কে নয়, তা জিজ্ঞাসা করা কমিশনের এক্তিয়ারে পড়ে না ('none of your business')। তবু, নাগরিকত্ব প্রমাণের দাবিতে কমিশন নতুন ১১টি নথির কথা বলছে যা সংগ্রহ করা দুরূহ এবং তাই বৈষম্যমূলক। 'ফ্রন্টিয়ার' পত্রিকা (অগস্ট ১০- ১৬, ২০২৫  সংখ্যা) চমৎকার ভাবে দেখিয়েছে, নতুন নথিগুলি সংখ্যায় বেশি দেখাতে পারে, কিন্তু মোটেই ভোটার অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। বরং উল্টো। এই কষ্টসাধ্য নথি সংগ্রহ করতে না পারার দরুণ নাম বাদ চলে যাবে, বিদেশি তকমা দিয়ে দেবে। বকলমে অসমের এনআরসি লাগু করে দিতে চাইছে বিজেপি;  নির্বাচন কমিশন তার দোসর। করণ থাপার, যোগেন্দ্র যাদব এই পরিকল্পনাকে নোটবন্দির মতো 'ভোটবন্দি' আখ্যা দিয়েছেন।

আর এই অনিয়ম করা হচ্ছে এ দেশের মৌলিক নিয়মগুলোকে লঙ্ঘিত করেই। অনুচ্ছেদ ১০ অনুসারে ভারতে বসবাসকারী সকল নাগরিককে ধরে নিতে হবে নাগরিক। ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্তকরণের কাজ রাষ্ট্রের, নাগরিকের নয়। কারও নামে কেউ আপত্তি তুললে আধা-বিচারবিভাগীয় পদ্ধতির মাধ্যমে যাচাই হবে। গণ ভোটাধিকার কাড়ার কোনও এক্তিয়ার কোনও সংস্থার নেই। এখন কমিশন বলতে চাইছে, তুমি নাগরিক নও, অতএব নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেখাও, নয়তো ডি-ভোটার করে দেব। ভোটার প্রমাণের দায়িত্ব ব্যক্তি নাগরিকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল, যা ভারতের ইতিহাসে প্রথম। ফর্ম ভরো, না ভরতে পারলে তোমার নাম কাটা যাবে। বাদ যাওয়ার সংখ্যা দেখুন: ৬৫ লক্ষ। মৃতদের ক্ষেত্রে কমিশন  মৃত ব্যক্তির শংসাপত্র যাচাই করবে (প্রাগুক্ত হ্যান্ডবুক)। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, এক বা  দেড় মাসে ২২ লক্ষ মৃতের ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করে নিশ্চিত হয়েছে কমিশন!!

প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আশুতোষ ভার্সনে আমেরিকার অতীত ইতিহাসের নজির টেনে দেখিয়েছেন, ষাটের দশকে জিম ক্রো'এর মতো এ দেশে সর্বপ্রথম গরিব, ক্ষমতাহীন, মুসলিম, দলিত, আদিবাসী সম্প্রদায়কে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। নাগরিকত্বের ইস্যুটাকে গণ বিতাড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত করতে চাইছে বিজেপি ও তাদের নব্য দোসর নির্বাচন কমিশন। 

আশার কথা, দেশ জুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ আদেশ আশার আলোকবর্তিকা হয়েছে। এও আশা করতে দোষ কী যে, দেরিতে হলেও ২০২৩ সালের কমিশনের গঠন সংক্রান্ত সংশোধনীটিও অসাংবিধানিক বলে বাতিল হবে।


Sunday, 10 August 2025

এক পরিকল্পিত ডিজাইন

ভদ্দরজনেরা মজা পাচ্ছেন গরিব বাঙালির লাঞ্ছনায়?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এক ধরনের বামপন্থীরা বলছেন, অমিত মালব্যকে তাঁরা পঞ্চম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বই পাঠিয়ে দেবেন; কারণ, বিজেপি’র লোকজনেরা নাকি বাংলা ভাষাটাই জানে না। অপর এক পক্ষ, যারা ড্রয়িং-রুম বামপন্থী, মূলত ‘আহা আনন্দ’ টিভি চ্যানেল দেখে ও ‘বাজার আনন্দ’ খবরের কাগজ পড়ে দেশ ও দশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন, তাঁরা আরও মজার কথা বলছেন: কই, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের তো পেটাচ্ছে না, যারা মার খাচ্ছেন তাঁরা আসলে ওইসব রাজ্যে লেবরদের কাজে ভাগ বসাচ্ছেন, তাই। এঁদেরই একজন বললেন, ‘labour rate’ নিয়ে ঝামেলা, মানে মজুরি-টজুরি নিয়ে দরাদরি করছে, ফলে, মারধোর খাচ্ছে।

ভাগ্যিস, আপামর বাঙালি আর এদের কথা কেউ শোনেন না। কিন্তু সেই বাসি, পচা কথাগুলি পাড়তে হল, কারণ, কতকগুলি বিষয় আজ স্পষ্ট করে নেওয়ার সময় হয়েছে। দেশ ও রাজ্য এক নতুন বিভাজন-বিন্যাসের কবলে পড়েছে, সেখানে নতুন করে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস নির্মিত হচ্ছে; সেই নবতর বিন্যাসে আজ নিজ নিজ উপলব্ধিতে অবস্থিত হওয়ার পালা।

প্রথমত, এ কথাটা খুব স্পষ্ট করে জেনে নিতে হবে যে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে যে সমস্ত বাঙালি শ্রমজীবী মানুষদের উপরে হামলা ও সন্ত্রাস চলেছে তারা মূলত গরিব এবং প্রধানত নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের। দ্বিতীয়ত, এই হামলাগুলি সেই সেই রাজ্যের বসবাসকারী শ্রমজীবী বা অন্যান্য মানুষেরা করছেন না; করছে পুলিশ, প্রশাসন ও কতিপয় বানর সেনার দল। অতএব, এমন ভাবার কোনও কারণই নেই যে, বহিরাগত ও স্থানীয়দের মধ্যকার অর্থনৈতিক রেষারেষি থেকে এই আক্রমণ। এই হামলা সংগঠিত হচ্ছে এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইন থেকে। সেই ডিজাইনকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের পরে অমিত শাহের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি বলছেন, সেই সাংঘাতিক জয়েও তাঁদের ভারত বিজয় সম্পন্ন হয়নি, তা হবে যখন তাঁরা বঙ্গভূমিকে দখলে নিতে পারবেন। কথাটা খেয়ালে রাখবেন। ঠিক যে ভাবে যুদ্ধের শেষ দিনগুলিতে যখন হিটলার তাঁর গোপন বাঙ্কারে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনও তিনি তাঁর সেনাপতিদের আদেশ দিচ্ছেন, এখনও যে কজন ইহুদী অউশভিৎস কনসেন্ট্রশন ক্যাম্প অথবা এদিক-ওদিক বেঁচেবর্তে আছে তাদের নিকেশ করে দাও। অর্থাৎ, টার্গেট একটা জাতি বা মতাদর্শ, যাকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করতে পারলে হিংস্র একমাত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসনকে কায়েম রাখা যায় না। কারণ, ফ্যাসিবাদের মূল চরিত্রই হল এক বর্ণ, এক রঙ, এক ভাবনা, এক ঢঙ।

বাংলা ও বাঙালি তাহলে কীভাবে অমিত শাহের দলের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে? হচ্ছে বৈকী! আর সে কারণেই গেরুয়া দলবলকে বারবার পিছুও হঠতে হচ্ছে। বঙ্গদেশ হল এমন এক শস্য-শ্যামলা ছয় ঋতুর দেবভূমি যেখানে উদারতাবাদ এর জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে প্রবহমান। তা চৈতন্যদেব ও সুফিতন্ত্রের ভাব-মতাদর্শই হোক কি রামপ্রসাদের ভক্তিসায়রে ডুব, স্বাধীন বাংলা রক্ষায় পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের নেতৃত্বে আত্মবলিদান কিংবা আধুনিক সময়ে রামকৃষ্ণদেব-বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বয়, অথবা রবীন্দ্র-নজরুলের বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধ বা নেতাজী-ক্ষুদিরাম-মাস্টারদার স্বাধীনতার লড়াই ও বিভূতি-মানিক-সত্যজিতের সৃষ্টিকর্ম— এমন এক ব্যাপ্ত পরিধিতে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত জয়গান তো বাঙালির ঐতিহ্যেই রয়েছে। সে বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য মোদী-শাহের দলবলের একবগগা উগ্র হিন্দুয়ানির ঘোর পরিপন্থী। এই ঐতিহ্য যতদিন তার সুললিত ভাষ্যে প্রবহমান থাকবে, ততদিন কোনও উগ্র পাষণ্ড মতাদর্শ এ দেশে সার্বিক ভাবে জায়গা করে নিতে পারবে না, বাংলাতে তো নয়ই। বাংলা ও বাঙালি হল কাউন্টার-পয়েন্ট, এক অপ্রতিরোধ্য ভাষ্য। তাই, বাংলাকে নিশানা।

ফলে, যতক্ষণ না প্রাণচঞ্চল বাংলার জীবনবোধকে উৎপাটিত করা যাচ্ছে, ততক্ষণ বর্ণবাদী বিদ্বেষমূলক ধর্মব্যবস্থাকে কোনওভাবেই জয়ী করানো যাচ্ছে না। তাই, নেতা, দল ও মিডিয়া কিনে, পয়সা ছড়িয়ে, ফেক রিল ও ভিডিও’র রগরগে রমরমায়, গল্পের গরুকে গাছে তুলে নিত্য নতুন বিকৃত ন্যারেটিভ নির্মাণে ও উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের একটা অংশকে কাছে টেনে উদোম চেষ্টা চলেছে বাংলাকে ক্ষতবিক্ষত করে এর দখল নেওয়ার। তবুও সে কাজে যখন সফলতা আসছে না, প্রভূত হিন্দু-উল্লাস চাগিয়ে হিন্দু বাঙালিদের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নামানো যাচ্ছে না, তখন ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ করে, প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের টাকা আটকে ‘শালে বাঙালি লোগো কো’ ভাতে মারো আর আক্রমণ হানো অন্য রাজ্যে বাঙালি গরিবদের উপর যারা কিনা কিছুতেই অমিত শাহের দলকে ভোট দেয় না।

তাই, বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইন। ‘অনুপ্রবেশের’ সেই পুরাতন গল্প ছড়িয়ে একে যতই যাথার্থ্য দেওয়ার চেষ্টা চলুক না কেন, মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। প্রথমত মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে কোনও লব্জ নেই। কারণ, কোনও ব্যক্তির বিদেশে প্রবেশ আইনগত ভাবে অনিয়মিত হতে পারে, কাগজপত্রহীন হতে পারে, কিন্তু তিনি কখনই ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন যা অত্যন্ত অমর্যাদাকর একটি শব্দ, এবং বহু দেশে এই ধরনের প্রবেশকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও দেখা হয় না; তাই, ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটির মধ্যেই অভিবাসীদের মর্যাদা লঙ্ঘনের মাত্রা লুকিয়ে আছে, যা অমানবিক। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রসংঘ নীতি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে, প্রত্যেক মানুষের ‘has a right to have rights.’। তথাপি, তর্কের খাতিরে আমরা যদি বাংলাদেশ থেকে আগত ‘কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের’ও গণ্য করি, তাহলেও নির্দ্বিধায় বলতে হয়, এ বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য পরিসংখ্যান তো নেইই, উপরন্তু বাংলার শহর ও গ্রামকে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কিছুই মিলবে না। কারণ, ১৯৭১-৭২’এর পর বড়সড় কোনও কাগজপত্রহীন অভিবাসন বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশে হয়নি। তবে হতে পারে, অথবা সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে কেউ কেউ কাগজ ছাড়াই সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন। তাদের সংখ্যা নগণ্যই। আসলে, ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ’এর গুজব হল সেই পরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইনের একটি উপাদান মাত্র। এর কোনও বাস্তব তথ্যগত ভিত্তি নেই।

ফলে, বিজেপি শাসিত বহির্রাজ্যে এ দেশিয় গরিব শ্রমজীবী বাঙালিদের উপর এই যে একতরফা আক্রমণ নেমে এসেছে, তার এক সুদূরপ্রসারী অভিঘাত তৈরি হতে চলেছে। বাংলার রাজনীতি এ তাবৎকাল উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের নেতৃত্বেই প্রবাহিত হয়েছে, যদিচ, এখানে বাম রাজনীতির বহু ইতিবাচকতা সেই বর্ণ ও বিত্তের প্রাবল্যকে কিছুটা খাটো করলেও, সে গন্ধ ও দম্ভকে মুছতে পারেনি। যে ভাবে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ুতে নিম্নবর্ণের উত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব দল তৈরি হয়েছে, তারা ক্ষমতায় এসেছে, অনুরূপ ঘটনা এ রাজ্যে ঘটেনি। একমাত্র ১৯৩৭ সালে ভারত আইন অনুসারে অবিভক্ত বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে কোয়ালিশন সরকার তৈরি হয়েছিল তা বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের এক প্রতীক ছিল। সেই ধারা আজ অবলুপ্ত।

কিন্তু প্রতিরোধে-প্রতিশোধে নিম্নবর্গীয় রাজনীতির পুনরুত্থান আবারও বাস্তব। বাংলার সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণ শ্রেণি যে ভাবে গরিব মানুষের উপর আক্রমণে নীরবতা পালন করছে, শুধু তাই নয়, ভাবছে অমিত মালব্য বাংলা ভাষা সম্পর্কে না জেনেই যা খুশি বলছে, অথবা, তারা এইসব কথাবার্তার জবাব দেওয়ার তেমন গুরুত্বই খুঁজে পাচ্ছে না, তারা আসলে বুঝতেই অপারগ যে রাজনৈতিক ঝড়টা এবার কোনদিক থেকে আসছে। যারা টিভি’র টক’শোতে বসে বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে দু-চার বাণী বিতরণ করেন, তাঁরা জানেনই না যে বাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে গড়ে তুলতে পারেন নিজেদের আত্মরক্ষার ঢাল ও মনন, কীভাবে তাঁরা টেনে নিয়ে চলেন জীবনের রথ, কীভাবে তাঁরা ভালোবাসেন পরস্পরকে ও গড়ে তোলেন উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত অধরা এক ধাত্রীভূমিকে। সাবেক বাম বুলি আওড়ানো ভদ্দরলোকেরা আসলে বুঝেই উঠতে পারছে না যে তাদের মাতব্বরির দিন প্রায় শেষ। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর খিস্তি করে, মিম ছড়িয়ে, বক্রোক্তিতে দিনাতিপাত করতে পারে, কলেজ স্ট্রিটে দু-চার নিষ্ফলা চর্বিতচর্বণ বক্তিমে ঝেড়ে ঘরে ফিরতে পারে, কিন্তু মুশকিল হল, তাদের দিকে আপামর বাংলার মানুষ যে কেউ আর ফিরেও তাকাচ্ছে না, সেটা যখনই তারা ধরতে পারছে, তাদের সে পাগলদশায় তাদেরই আরও বিপদ বাড়ছে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'নূতন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষের কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনা ওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ জঙ্গল, পাহাড় পর্বত থেকে।' নতুন বাংলার স্বপ্ন এইভাবেও হতে পারে। হয়তো হচ্ছে। ভদ্দরজনেদের নজরে আসছে না, তাই পিছু হঠছে উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণেরা, তাদের ছড়ি ঘোরানো ও কর্তামশাইয়ের চিরায়ত ভূমিকা থেকে। হয়তো তাই কোণে দাঁড়িয়ে অতীব গোসায় তারা মজাও পাচ্ছে নিম্নবর্ণীয় বাঙালির লাঞ্ছনায়।