মরালী নদীর পুনরুজ্জীবন চাই
বিবর্তন ভট্টাচার্য
মৃত নদী বুড়িগঙ্গা প্রাণ ফিরে পেতেই চাকদহ ব্লকে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছে। মৃত নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলছে দেখে এলাকার মানুষ দারুণ ভাবে উৎসাহিত। হরিণঘাটা ব্লকের প্রাক্তন এমএলএ একদিন আমাকে অনুরোধ করলেন, বুড়িগঙ্গা তো অনেকটা সংস্কার হল, এবার মরালী নিয়ে একটু ভাবুন। আসলে নদিয়া জেলা হল নদীর জেলা। এই জেলায় প্রধান নদী ছয়টি; যেমন, গঙ্গা, ইছামতী, চূর্ণী, মাথাভাঙা, জলঙ্গী, অঞ্জনা। এছাড়াও প্রচুর মৃত নদী আছে; এগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, মরালী, যমুনা উল্লেখযোগ্য। তাই শুরু হল পর্যবেক্ষণ।
চাকদহ ব্লক অঞ্চলে অবলুপ্ত নদীগুলোর মধ্যে মরালী একটি। মরালীর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া এতটাই কঠিন আর কোন দশকে এই নদী একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে তা' অনুমান করাও বেশ শক্ত। রেনেল সাহেব কৃত ১৭৬৪ সালের একটি মানচিত্রে মরালী নদীর প্রবাহপথ হিসেবে চাকদহ শহরের দেড় মাইল উত্তরে সামান্য এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি সরু সংকীর্ণ জলরেখা দৃষ্ট হয়। এছাড়া ১৯১৭-২১ সালে সার্ভেকৃত ও ১৯৩১ সালে প্রকাশিত চাকদহ থানার মানচিত্রে ওই গতিপথ বরাবর সর্পাকৃতি একটি জলরেখা হিসেবে চিহ্নিত আছে। তবুও পূর্বদিকে বনগ্রাম থানার মানচিত্রেও ওই গতিপথ অঙ্কিত আছে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে ওই নদীকে মরাইল (MORAIL) বিল নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে যেমন অঞ্জনা নদীকে সরকার খাল বানিয়েছে, কারণ, খাল-বিল-বাঁওড় বিক্রি করা অত্যন্ত সহজ। তাই নদীকে খাল বানাও।
মরালী নামের উৎপত্তি কোথা থেকে তা' বলা কঠিন। এমন কত অজানা অখ্যাত নদী স্নেহময় সুধায় পলি দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্যাণ সাধন করে গিয়েছে অথচ তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া ভার। আজও জগৎ সংসারে কত মানুষ নীরবে জগতের হিতসাধন করে থাকেন কিন্তু তাঁদের কথাই বা কজন মনে রাখে? তেমনই এককালের মঙ্গলদায়িনী মরালীও হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের অতল তলে।
মরাল থেকে মরালী নাম হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মুরলীগঞ্জ থেকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব দিয়ে ভাগীরথী পর্যন্ত একটি সহজ জলপথ ছিল। সেই জলপথই মরালী। মরালীর যে বৃহত্তর অংশটুকু এখন নদীর আকারে আছে, তার বুকে চড়া পড়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ। এই মরালীর ওপর রাজ্য হাইওয়ে এবং বড় বড় ইমারত গড়ে উঠেছে। নদীটি ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে যে যমুনাতে গিয়ে মিশেছে, তা' খানিকটা বোঝা গিয়েছিল ২০০০ সালের বন্যার সময়। বর্তমানে তা হেড়ের খাল ও পূর্ব বিষ্ণুপুর হয়ে শ্রীনগর, হিঙনাড়া, বল্লভপুর, বৈরামপুর, বৃদ্ধপাল্লা, পাল্লা, গোপালনগর দিয়ে যমুনাতে মিশেছে। কিন্তু মরালীতে জল সরবরাহকারী ১৭টি বিল-বাঁওড়ের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গাঙ্গরা বিল, ধর্মদহ বিল, নেউলিয়া বিল, সাতশলাকি বিল, ট্যাংরা খাল, মরালী বিল, পারুলিয়া বিল, শ্রীরামপুর খাল, কচুয়া বিল, বড় বিল, কামডোব বিল, গা বিল, হাতিবাঁধা বিল, চেতলা বিল, চুমুকদহ বিল, মাতলা বিল, ঢাকা বিল-- এগুলো সবই মরালীর জল সরবরাহকারী খাল বিল।
আনুমানিক ১৫ কিমি হেজে ও মজে যাওয়া এই নদীতে কোনও এক সময় কুমীরের বাস ছিল। আর এই মরালী নদীর মৃত্যুর ফলে যমুনা নদীরও মৃত্যু ঘটেছে। যমুনা নদী ভাগীরথী থেকে বিরহীর পাশ দিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক পার হয়ে হরিণঘাটা হয়ে গোবরডাঙা রেল স্টেশনের তলা দিয়ে ইছামতীতে গিয়ে মিশেছে।
২০০০ সালের প্রবল বন্যার পর এলাকার মানুষ মরালী নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। বুড়িগঙ্গার মতো হেজে যাওয়া নদী যদি প্রাণ ফিরে পায় তবে মরালীতে কেন প্রাণসঞ্চার হবে না? প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর পাড়ে অন্তত ২ লক্ষ মানুষের বসবাস। এখনও প্রচুর মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী মানুষ মরালী নদীর ওপর নির্ভরশীল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয় এই মরালী নদী। তিনি এই নদীপথেই সপ্তগ্রাম পর্যন্ত যাতায়াত করতেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এই নদীর উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামগুলোতে। মরালী নদী সংস্কার হলে যমুনার জল বৃদ্ধি পাবে। ফাঁসতলা, খেদাইতলা, সাতশলাকি গ্রামের মানুষ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মরালী নদীর সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন।
দীর্ঘ দশ বছর নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে চাকদহ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম'এর উদ্যোগ ও আন্দোলনে বুড়িগঙ্গাতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে তাই এবার মরালী নদীর পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা। ২০২৪'এর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে একাধিকবার সরেজমিন পর্যবেক্ষণে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মরালী নদীর ছয়টি অবস্থা দেখা গেছে:
১) মহানালা, মসরা ও মথুরাপুর এলাকায় নদী অত্যন্ত সংকীর্ণ অবস্থায় হিউম পাইপ বা কালভার্ট'এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত;
২) ইছাপুর এলাকায় নদীর বুকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে;
৩) পারাই গ্রামে নদীতে কোথাও শৈবাল দাম আবার কোথাও কালচে জল;
৪) মথুরাগাছি এলাকায় নদী অন্তঃসলিলা;
৫) সাতসলাকি, খেদাইতলা এলাকায় নদী দিগন্ত বিস্তৃত বিলের মধ্যে হারিয়ে গেছে;
৬) সাতাশী ও নহাটা এলাকার কয়েকটি জায়গায় নদীর খাত দখল হয়ে গেছে।
বস্তুতপক্ষে, মরালী নদী তিনটি ব্লকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত-- চাকদহ, হরিণঘাটা ও বনগ্রাম। ফলে, এই নদীর পুনরুজ্জীবনের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রামের মানুষের উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন। আমাদের ধারণা, ১০০ দিনের কাজের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাজ সম্ভব। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবিত হবে, মৎস্য চাষের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, মানুষ খেয়েপরে বাঁচবে এবং এলাকার মানুষের অন্যত্র কাজের খোঁজে চলে যাওয়া হ্রাস পাবে।