Monday 16 September 2024

সাপলুডো

'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে'

শ্রেয়া ঘোষ



আমাদের সমাজে দুর্নীতির শিকড় গভীরে প্রোথিত। ঘুষ দিয়ে, পদমর্যাদার প্রভাব খাটিয়ে সুবিধে নেওয়ার জালের বিস্তার সর্বব্যাপী। 

বাচ্চাকে তথাকথিত ভালো স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করতেও, এমনকি বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময় বা কেউকেটা কোনও ব্যক্তিকে ধরা-করা এক পুরনো প্রথা। আমাদের একবারও মনে হয় না, যে স্কুল একটি তিন বছরের শিশুকে বেআইনিভাবে টাকা নিয়ে বা নিয়ম-বহির্ভূত আর কোনও উপায়ে ভর্তি করছে, সেখানে কী শিক্ষাই বা পাবে আমাদের সন্তান; আর অভিভাবক হিসেবে আমরাও সন্তানের জীবনের প্রথম পদক্ষেপকেই কালিমালিপ্ত করছি অকারণ।

সামান্য একটু বাড়তি সুবিধা পাবার জন্যও আমরা নীতিবোধ জলাঞ্জলি দিই। রাজদ্বারে, শ্মশানে চ - সর্বত্রই ঘুষের খেলা। দেবস্থানে পুজো দেব, ঈশ্বরের কৃপাভিক্ষা করব, কিন্তু বেশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে পারব না। টাকা দিয়ে, লাইন টপকে, তাড়াহুড়ো করে ধর্মপালন করে বেরিয়ে আসব। এমনকি শ্মশানে পর্যন্ত লাইন ভেঙে পরে এসে আগে মৃতের (যিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  নিকটজন) দেহ দাহ করতে অন্ধিসন্ধির সন্ধান করি। হৈ চৈ লাগিয়ে দিই। যে মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলেই গেছে, যে কোনওদিনই আর আমাদের এক মুহূর্ত সময়ও দাবি করবে না, তাকে পুড়ে যাওয়ার সময়টুকুও দিতে পারি না। তারপর বেশ অহমিকা নিয়ে বলে বেড়াই, গিয়ে তো দেখি আমাদেরটা তের নম্বরে, একটা ফোন করিয়ে দিলাম 'দাদা'কে দিয়ে। ব্যাস, বাপ বাপ করে এসে গেল আমাদের নম্বর।

বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে সন্তানকে ডাক্তারি বা এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির প্রথা তো সেই কবে থেকেই। তখন এই বেআইনি লেনদেনকে বলা হত ক্যাপিটেশন ফি। পরে ম্যানেজমেন্ট কোটা বলে বেশ আপাত আইনসঙ্গত একটা ব্যবস্থা চালু হল। বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়ে যে কোনও শিক্ষায়তনে ভর্তি শিক্ষার দুর্নীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কারণ, যে এভাবে ভর্তি হয়, সে পাশ করে প্রথম থেকেই চাইবে বেআইনি পথে নিজের উপার্জনকে বাড়িয়ে নিতে। আর এই বিপুল অঙ্কের টাকার ওপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও কোনও কর দিতে হয় না। তাছাড়া এটি এমনই এক কুপ্রথা যেখানে শিক্ষায় মেধার থেকে ছাত্রের পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অধিক গুরুত্ব পায়। 'রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট' অনুসারে স্কুলে বা কলেজে ভর্তির সময়ে (প্রাইভেট স্কুল-কলেজ হলেও) ক্যাপিটেশন ফি নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে। উপরন্তু এই বিশাল টাকা দেওয়ার ক্ষমতা অনেকেরই নেই, অতএব এই প্রথা সংবিধান বিরোধী। এই সবই অতি সরল যুক্তি, না জানা বা বোঝার কোনও হেতু নেই। অথচ আমরাই বছরের পর বছর এই অন্যায় করে আসছি, বিন্দুমাত্র বিবেক দংশন ছাড়া। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, এইসব ছাত্ররা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিশেষ স্নেহও পেয়ে থাকে। ভর্তি হবার পরেও স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশনের সুবাদে প্রশ্ন জেনে আর বিষয়বস্তু না জেনে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার ব্যাপারও নতুন নয়।

আমরা এইসব অভ্যেস পালন করে দিব্যি কাটিয়ে এসে আজ এত যুগ পরে 'বিবেক' নামক একটি বায়বীয় বস্তুকে টানাটানি করতে লেগেছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে ডাক্তারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট, ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট থেকে মিথ্যে ডাক্তারি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে এসেছি অবলীলায় মসৃণ এক বিনিময় প্রথার সুবাদে। সুদীর্ঘকালের সহজ প্রচলনে এই সব অন্যায় প্রথা এত স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধও জাগে না মনে।

এই অবধি লিখে একটু থমকে গেলাম। আমরা টাকা দিয়ে, ধরা-করা করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করছি, কিন্তু এর বৃহত্তর অভিঘাত সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না। স্কুল-কলেজে জাল সার্টিফিকেট দিচ্ছেন একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসক। অনুপস্থিত হওয়ার কারণ হিসেবে এই মিথ্যে কাগজ সংগ্রহ করে স্কুলে জমা দিচ্ছেন অভিভাবক যেখানে তাঁর সন্তান সুস্থ এবং হয়তো বেড়াতে যাওয়া বা অন্য কোনও কারণে স্কুলে যায়নি। চিকিৎসক তাঁর ডিগ্রির অপব্যবহার করছেন অবলীলায়। চিকিৎসক এই প্রকারে, তাঁর ওপর যে সামাজিক বিশ্বাস আর সম্মান ন্যস্ত করা হয়েছে, তা মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই নবীন প্রজন্ম মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হচ্ছে।  উল্টোদিকে পুরোপুরি রোগ নিরাময়ের আগেই কেউ  মিথ্যে কাগজ ব্যবহার করে সুস্থ মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করছেন। এইসব আমাদের মনে হয় না। তাৎক্ষণিক কার্যসিদ্ধি হলেই আমরা খুশি। অসৎ উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করে সহনাগরিকদের জীবনকে বিপজ্জনক করে তুলছি। যিনি বা যাঁরা ঘুষ নিয়ে এই অনুমতিপত্র বিলোচ্ছেন আর নিরীহ মানুষের জীবনহানির কারণ হচ্ছেন, তাঁরা কি কখনও অনুতপ্ত হয়েছেন? আচ্ছা, এইসব অনুতাপ-টাপের মতো অস্তিত্বহীন অনুভূতি বাদ দিয়েই বলি না হয়, দুর্ঘটনা ঘটলে এই মিথ্যে শংসাপত্র প্রদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে খুনের চার্জ আনা হয়?

তিরিশ-বত্রিশ বছরের পুরনো কথা মনে পড়ছে। নার্সারি স্কুলের ছুটির সময়ে বাচ্চাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুল গেটের বাইরে অভিভাবকদের ভীড়ে জমজমাট রাস্তায় এক শিশুর মা গর্বের সঙ্গে বলছেন, আমার হাজব্যন্ডের তো মাইনের টাকায় হাতই পড়ে না...। সে ভদ্রলোক বেলতলা রোডের মোটর ভেহেকিল্স'এ কর্মরত ছিলেন। অপরাধ করে, কারও তোয়াক্কা না করে বুক ফুলিয়ে জাহির করার মতো ভয়ঙ্কর মানসিকতা নিতান্ত ছাপোষা লোকজনের মধ্যে কেমন পুষ্ট হয়ে এসেছে বরাবর।

ছোট থেকে দেখে এসেছি টেলিফোন লাইন খারাপ হলে BSNL'এর যে কর্মী সারাতে আসেন, তাঁকে কিছু টাকা দিতে হত। যদিও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের মাস মাইনে পাওয়া কর্মী। তবু মা মাসের খরচের বাক্স থেকে টাকা বার করে তাঁকে দিতেন। মা ভয় পেতেন, টাকা না দিলে লাইন আসতে অহেতুক দেরী হবে। এখন BSNL ল্যান্ডলাইনের সংযোগ প্রায় উঠেই গেছে। পরিবর্তে মোবাইলে আরও বেশি লোক ঠকানোর ছক। বস্তুর সঙ্গে ছায়ার মতো, জীবনের সঙ্গে ঘুষ ও যাপনের সঙ্গে ভয় অবিচ্ছেদ্য হয়ে জুড়ে আছে।

আমরা সকলেই একদিন প্রথম জেনে ফেলি, 'পয়সা দিয়ে সবই পাওয়া যায়'। বিচার থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ, সব। প্রভাব খাটিয়ে আরও বেশি পাওয়া যায়, আরও সহজে। ধর্ষণের অপরাধে কারাবাসের  শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীর প্যারোলে মুক্তি থেকে নকল বা জাল ওষুধের ব্যবসার ছাড়পত্র। ভয় পেয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি কিন্তু। আইন ব্যবসায়ী উকিল রসিদ ছাড়া নগদ টাকা দাবি করছেন, পাছে মামলায় হেরে যাই সেই ভয়ে দিয়েও দিচ্ছি। চিকিৎসক যা খুশি তাই দক্ষিণা দাবি করছেন তো প্রিয়জনের জীবনের ঝুঁকি নিতে না পেরে বিনা প্রতিবাদে সেই অন্যায়কে মেনে নিচ্ছি। প্রতিবাদ কি কখনও করি না? করি, কালেভদ্রে, হাওয়া বুঝে আর অবশ্যই ভিক্টিমের সামাজিক অবস্থান বুঝে। আমর সকলেই জানি সমীকরণের দুই দিকের রাশির মাঝের দুটি রেখা কখনই সমান্তরাল নয়। রেখা দুটি হয় অভিসারী, নতুবা অপসারী হয়ে একটা গিলে খাওয়ার মতো চেহারা নেয়। খাদ্য-খাদক যেন। ভয়ানক এই সম্পর্কের কথা স্বতঃই মনে আসে।

বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছি, জল দিয়েছি, সার দিয়েছি, হাওয়া দিয়েছি। আমরা কি অমৃত ফলের আশা করেছিলাম? বিন্দু বিন্দু জলকণা জমিয়ে জমিয়ে আমরাই তৈরি করেছি মারের সাগর।

'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে' আজ শুধু হাতে উঁচিয়ে রাখা পোস্টারে।


Tuesday 10 September 2024

সাবির মালিক হত্যার বিচার চাই

অনেকেই নিশ্চুপ কেন?

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



পরিযায়ী শ্রমিক আজ বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের মাথাব্যথা। ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাদী অর্থনীতি শ্রমের এই মুক্ত যাতায়াত সহ্য করতে পারছে না; যদিও গতরের মুক্ত দাম নির্ধারণ ছিল পুঁজিবাদের মুক্ত অর্থনীতির প্রাথমিক শর্ত। ইউরোপিয় ইউনিয়ন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিক উদ্ভূত সংকট একটি অন্যতম ভিত্তি ছিল বৈকি। কিন্তু বেকার সমস্যা ও অসাম্যকে মোকাবিলা করতে অক্ষম পুঁজিবাদ এই সমস্যা মেটাতে তো পারেইনি, ক্রমেই তা এক বিস্ফোরণের চেহারা নিয়েছে। জেল ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল নামছে। পুঁজিবাদী কায়দায় মোকাবিলা হচ্ছে এই ঢলের, অর্থাৎ, পরিচিতি সত্তাকে হাতিয়ার করে মৌলবাদের বিস্তার হচ্ছে দেশে দেশে।

পশ্চিমবঙ্গ যখন তিলোত্তমার ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে প্রতিবাদে সরব, ঠিক তখন অগস্টের শেষ সপ্তাহে সাবির মালিক নামে এক বছর পঁচিশের মুসলিম বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে হরিয়ানার দুষ্কৃতিরা। তারা নিজেদের গোরক্ষক বাহিনী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছিল। সাত জন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানা গেছে, যার মধ্যে দু' জন আবার প্রাপ্তবয়স্কই নয়। 

হরিয়ানার ভান্ডওয়া গ্রামে সাবির সপরিবারে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। বাড়ি বাড়ি থেকে লোহালক্কর বা স্ক্র্যাপ কিনতেন তিনি। সাড়ে তিন বছর হল সাবির সেখানে গেছেন, বাড়ির বড় ছেলে। কলকাতার উপকণ্ঠে বাসন্তী অঞ্চলের মেয়ে তাঁর স্ত্রী, একটি আড়াই বছরের কন্যাও আছে তাঁদের। এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে তাঁদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন সাবিরের শ্বশুর আর শ্যালক। ওই এক চিলতে ঘরেই তাঁদের দিন কাটছিল, অভাব, অনটন আর স্নেহ ভালবাসায়। মেয়েটিকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা মায়ের, পয়সা জমানোর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা তাঁর। 

হঠাৎ একদিন সব স্বপ্ন চুরমার করে একদল গোরক্ষকের আগমন। সামনে হরিয়ানায় ভোট যে! ওই পাড়ায় যত মুসলমান পরিযায়ী থাকেন, তাদের বাড়িতে বাড়িতে হানা আর হুমকি চলল। তাদের কাছে নাকি খবর আছে গরুর মাংস খাওয়া হচ্ছে সেখানে। দিনটা কেটে গেল, কিন্তু মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এল। দু' দিনের মাথাতেই সাবির সহ আরও তিন-চারজন অহমিয়া মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাওয়া হল, ব্যবসার জিনিস কেড়ে নিল গোরক্ষা বাহিনী। জামাইবাবুর সাথে দৌড়ল তাঁর শ্যালকও। পুলিশ ধমকালো, চমকালো, তারা নাকি গরুর মাংস খেয়েছে এবং এসব এখানে আর চলবে না। যদিও সাবির'রা বারবার বলেছিলেন যে ওই অঞ্চলে কোনও গরুর মাংস বিক্রি হয় না, তবু পুলিশ হুমকি দেওয়া থামায়নি। কিন্তু আজ শ্যালক আর স্ত্রীর আফশোস, যদি পুলিশ সেদিন গ্রেফতার করে নিত, তাহলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন সাবির। পুলিশ ছেড়ে দিল, এবার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু গোরক্ষা বাহিনী ওই অহমিয়া পরিযায়ী শ্রমিক আর সাবিরকে ছাড়তে চাইল না। তাদের বক্তব্য ছিল, অনতিদূরে সাবিরের মাল রাখা আছে, সেখানে ওদের সঙ্গে গিয়ে সে মাল নিয়ে আসুক। গোরক্ষা বাহিনী দু' ভাগ হয়ে একদল সাবিরকে নিয়ে চলে গেল, অহমিয়া দুই জনকে নিয়ে গেল আরেক দল। কেউ আর ফিরল না। চব্বিশ ঘণ্টা অধীর অপেক্ষার পর সাবিরের স্ত্রী আর শ্যালক যখন খোঁজ নিতে আবার গেলেন থানায়, তখন তাঁদের জানানো হল যে সাবির হাসপাতালে আছে; আসলে ছিল মর্গে। অনেক কাকুতিমিনতির পর কোনও এক সদয় পুলিশ আধিকারিক এফআইআর করলেন, যদিও তাতে লেখা হল মারপিট করে মৃত্যু। অহমিয়াদের জন্য কেউ কিছুই বলল না, তাদের খবর সম্পূর্ণ চেপে দেওয়া হল (ডবল ইঞ্জিনের দৌলতে হয়তো)। স্ত্রী আর সাবিরের বাবার অভিযোগ যে ওখানে গত তিন বছর ধরে বিজেপির লোকেরা বারে বারে তাঁদের জিজ্ঞেস করত যে তাঁরা কি বাংলাদেশী? ওরা কি মোদিকে ভোট দেয় নাকি মমতাকে?

এখন বঙ্গে তিলোত্তমার নৃশংস মৃত্যুকে ব্যবহার করে ভোট ছাড়াই ডবল ইঞ্জিন সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি। রাজ্য সিপিআইএম এবং কংগ্রেস তাদের সাগরেদ। এখনও ডবল ইঞ্জিন সরকার এ রাজ্যে নেই, তাই হরিয়ানার প্রত্যুত্তরে এখানে পরিযায়ী শ্রমিক খেদাও অভিযান শুরু হয়নি। বিজেপির কাছে পরিযায়ী মানে অবশ্য অন্য রাজ্যের হিন্দু শ্রমিক নয়। তাদের কাছে পরিযায়ী হল এ রাজ্যেরই মুসলমান মানুষ। সাবিরের প্রতিবাদ আমরা করছি কিন্তু প্রতিশোধের স্পৃহা প্রকট হয়নি। 

ডবল ইঞ্জিন সরকার হল বিজেপির বাল্কানাইজেশনের প্রাথমিক শর্ত। রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা তাদের লক্ষ্য। পরিচিতি সত্তাকে ব্যবহার করে দেশটাকে টুকরো টুকরো করতে চায় তারা। মেহনতী মানুষের ঐক্যকে ধ্বংস করতে চায় তারা। বিজেপি খুব ভাল করেই জানে যে হরিয়ানার সাধারণ মানুষের বাড়িতেই সাবির'রা ভাড়া থাকত। শুধু সাবির নয়, অসম থেকে যে পরিযায়ী শ্রমিকরা গিয়েছিল, তারাও। হরিয়ানার অধিবাসী বাড়ির মালিক কিন্তু ভাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের, বাঙালি বলে কোনও বিদ্বেষ ছিল না হরিয়ানার বাসিন্দাদের মনে। অর্থাৎ, ঘৃণা জন্মগত নয়, হরিয়ানার সাধারণ মানুষ বাঙালি বা বাংলাদেশি বলে ভারতের পূর্ব প্রান্ত থেকে যাওয়া পরিযায়ীদের বিতাড়ন করেননি, এটা জানে বিজেপি-আরএসএস আশ্রিত এই গোরক্ষক বাহিনী। জনগণের এই ঐক্য মেনে নিতে তারা রাজি নয়। তাই তারা শুধু পরিযায়ীদের হত্যা করেছিল তাই নয়, বাড়ির মালিকদের এসেও শাসিয়ে গেছে।

তবে সমস্যা হল, শুধু পুলিশ নয়, আইন আদালত যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই সামাজিক মুখোশ পড়া রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিত তবে তা থেমে যেত অনেক আগেই। পুঁজিবাদের রক্ষাকবচ এই অনির্বাচিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং তার মাথায় বসে থাকা মহামান্যগণ জেগেও ঘুমিয়ে আছেন। আমাদের দেশের আইন আজও স্বৈরতান্ত্রিক, বৃটিশ ছায়ায় ঢাকা। তাই এ হেন হত্যার কোনও শাস্তি পাওয়া যায় না। একটা বা দুটো ঘটনার পর আদালত সুয়োমোটো মামলা গ্রহণ করলে আজ মহামারীর মতো পরিযায়ী শ্রমিক পিটিয়ে হত্যা এভাবে ছড়িয়ে পড়ত না। একে কেন্দ্র করে যে পারস্পরিক পরিচিতি সত্তার হিংস্রতা তৈরি হয় তাকে মোকাবিলা করা যেত সহজে। এই পরিচিতি সত্তাই হল ফ্যাসিবাদী উত্থানের উর্বর ভিত্তি, যা পুঁজিবাদের আজ বড়ই প্রয়োজন।

পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য সুরক্ষা কবচ এ দেশে রয়েছে। রাজ্যের মধ্যেই কাজের সন্ধান, অন্য রাজ্যে গেলেও চিকিৎসা, রেশনের সুবিধা আছে, কিন্তু অন্যান্য ঘোষণার মতো এই সব ঘোষণাও টাকা আর সদিচ্ছার অভাবে বিশ বাঁও জলে। যদিও অভাব হওয়ার কথা ছিল না। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমানোর জন্য কৃষিকে লাভজনক করা প্রথম কাজ। কর ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন যদি নাও হয়, একচেটিয়া কালো সম্পদ যদি বাজেয়াপ্ত নাও হয়, তবু কৃষিকে লাভজনক করার জন্য কর ব্যবস্থায় সামান্য অদলবদল করলেই চলত, যা অনেক ক্ষেত্রেই পরিযায়ী শ্রমের ঢল কমাতে পারত। তাছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষার খরচ তো নামমাত্র। সম্পদ করের অদলবদল করলে অন্তত বাড়তি দু' লাখ কোটি টাকা উঠতে পারে, এদিকে কর্পোরেট কর আগের ৩০ শতাংশ হারে ফিরিয়ে আনলেই আরও ৪ লাখ কোটি উঠবে। এই বাড়তি ছয় লাখ কোটিতে দেশ জুড়ে মোট ১২ কোটি মেট্রিক টন ধান আর ১১ কোটি মেট্রিক টন গম কুইন্টাল পিছু ২৫০০ টাকায় কেনা সম্ভব। এর ফলে সাবিরদের পারিবারিক কৃষি কাজ এতটাই লাভজনক হবে যে তাদের হয়তো হরিয়ানায় যেতেই হত না।   

আসলে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে না পারলে এই পরিযায়ী শ্রমিকের যাতায়াত বন্ধ করা যাবে না, বা দেশকে টুকরো টুকরো করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের স্তম্ভ জনপ্রতিনিধিত্বমুলক ব্যবস্থা, যাকে ঘিরে রেখেছে আমলাতন্ত্র, আদালত, সামরিক ব্যবস্থা। জনপ্রতিনিধিত্বকে ক্রমাগত দমানোর প্রক্রিয়া চলছে, দুর্নীতিতে রঞ্জন গগৈরা ইডির আওতায় আসেন না। অথচ দেশের যে কোনও জনপ্রতিনিধি, মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রীদের বাড়ি ঢুকে গ্রেফতার করে আনছে ইডি। তাদের কোনও রক্ষাকবচ নেই, যদিও আদালত থেকে রাজ্যপাল, এমনকি সরকারি আমলাদেরও রক্ষাকবচ আছে।

এখনও এই রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন নেই। তাই সাবিরকে নিয়ে লিখতে পারছি। তাই পরের ভোটে বিজেপি'কে দেশ ছাড়া করার স্বপ্ন দেখতে পারছি।


Sunday 8 September 2024

এই ক্রোধকে প্রণাম

কিন্তু শুশ্রূষাহীন রাষ্ট্র  

যশোধরা রায়চৌধুরী 



শুশ্রূষা অর্থ সেবাযত্ন বা সুস্থ করে তোলা, এ হল বাইরের মানে। আসল ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'শুনিবার ইচ্ছা'। যে কোনও সমস্যায়, রাজদ্বারে সংকটকালে, আজও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাজা হয়েই থাকল। তার শুনিবার ইচ্ছা বেমালুম অনুপস্থিত। 

অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে, প্রায় যেন রকেট স্পিডে, ‘অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪,’ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হল ৩ সেপ্টেম্বর।  মাত্র এক দিনের মধ্যে পাশ করানো এই বিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে একটা হাতিয়ার। তারা আরজিকর কাণ্ডে অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত পথে নামায় আতঙ্কিত, এবার বলা যাবে, ওই তো ধর্ষণ বিরোধী আইন তো আমরা এনেছি। আমরা আমাদের কথা রেখেছি। বাকি কাজ তো সিবিআই আর সুপ্রিম কোর্টের হাতে। বিচার তাদের কাছে চাও। 

প্রেক্ষিতটা কী? 

সদ্য ঘটে যাওয়া আরজিকর ঘটনার অভিঘাতে, মেয়েরাই প্রথম ডাক দিয়েছিলেন রাত দখলের। তারও পৃষ্ঠপট ছিল একটা। মেয়েরা রাত দখল করো। এক বা একাধিক পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল সমাজ মাধ্যম। প্রথমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ইনটার্ন ডাক্তারদের মধ্যে থেকে, ২৪ সালের এই কালো আগস্টের ৯ তারিখের রাত্রিতে ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর নিজের হাসপাতালের সেমিনার রুমে ঘুমোতে যাওয়া আরজিকরের ইনটার্ন ডাক্তার, ৩১ বর্ষীয়া তরুণীটির ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের নিরিখে যা ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। অগ্নিসংযোগ হয়েছিল একটি মন্তব্যে। চেনা ঢঙের মন্তব্য। আরজিকরের তৎকালীন প্রধানের প্রথম প্রতিক্রিয়ার ঝোঁক এইই যে, মেয়েটিকে রাতে ওখানে কে থাকতে বলেছিল?

তারপরে দেওয়া হল নিদান। ১৭ দফা 'সুরক্ষা বিধান'এর শলাপরামর্শ। আবারও সেই ইতিমধ্যেই একপেশে বৈষম্যমূলক কর্মক্ষেত্রটিকে আরও বেশি দাগিয়ে দিয়ে পশ্চাৎপদতার নতুন নজির সৃষ্টি করল। এবার এল এই নতুন আইন। অপরাজিতা আইন। 

কী কী সমস্যা আছে এ আইনে? 

মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই বিল পাশ করা হল। যে কোনও আইন পাশ করার আগে তার খসড়া প্রকাশ করা, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করার দীর্ঘ প্রথা চলে আসছে। রাজ্য সরকার তা করেনি, যা অগণতান্ত্রিক। এই বিল-এর নামে ‘অপরাজিতা’ শব্দটির প্রয়োগ কাব্যিক ও অসঙ্গত। হিংসাকে লঘু করে দেখাতে পারে। আইনের নামকরণের একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রথা রয়েছে। নামকরণে এমন বিভ্রান্তির পরেও এই বিল-এ ধর্ষিত মেয়েদের জন্য ‘ভিক্টিম’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে, ‘সারভাইভার’ শব্দটির উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি যাঁরা ধর্ষণের পর ন্যায়ের জন্য লড়াই করছে, সেই মেয়েদের জন্যেও নয়। 

এই আইনের নামকরণে ‘মহিলা ও শিশু’ একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মেয়েদের স্বাধীন সত্তা ব্যাহত হয়েছে, মাতৃত্বকে নারীত্বের প্রধান আধার বলে দেখানো হয়েছে। 

এই বিল-এ রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (২০২৩) ট্রান্স ও কুইয়র মানুষদের উপর যৌন আক্রমণ বিষয়ে নীরব, এবং রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইনে (ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অব রাইটস অ্যাক্ট, ২০১৯) এই ব্যক্তিদের উপর যৌন অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ দু’ বছরের কারাদণ্ড। এই সময়ে রাজ্যের সংশোধনে এ বিষয়টি আনলে রূপান্তরকামীদের উপর হিংসার যথাযথ প্রতিকারের সম্ভাবনা ছিল। এই বিল ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় রূপে প্রধানত গ্রহণ করেছে শাস্তির কঠোরতার বৃদ্ধিকে। প্রতিটি অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন, শাস্তি যত কঠোর হয়, অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে। 

এই বিল-এ ধর্ষণ ও হত্যার (অথবা আঘাতের ফলে চেতনা হারিয়ে জড় অবস্থায় চলে যাওয়ার) একমাত্র শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে প্রাণদণ্ড ও জরিমানা। এটা অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৮৩ সালের একটি রায়ে বলেছে যে, কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই ফাঁসি একমাত্র সাজা হতে পারে না। ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের বিচারের জন্য স্পেশাল কোর্ট তৈরির প্রস্তাবও প্র্যাক্টিকাল নয়। পকসো-সহ বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল কোর্টের অনেকগুলিরই পরিকাঠামো, অর্থবল এবং লোকবল সাধারণ আদালতের চাইতে কম। প্রায়ই আইনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বিচার শেষ হয় না। তেমনই, স্পেশাল টাস্ক ফোর্সও কার্যকর হবে না, যদি না যথেষ্ট সংখ্যায় দক্ষ কর্মী এবং যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংহতির অভাব থাকবে কি না, সে চিন্তাও থাকছে। জেলা স্তরে এক একজন ডিএসপি এখনই অতিরিক্ত মামলায় ভারাক্রান্ত। কাজের ভার আরও বাড়ালে অভিযোগ নথিভুক্তি কমার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এই বিল (ধারা ২৯সি, ৩ ও ৪) বলছে, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তে নেমে মৌখিক বা লিখিত ভাবে যে ব্যক্তির কাছে সহায়তা চাইবে, তাকেই অবিলম্বে সাহায্য করতে হবে। না হলে তার জেল, জরিমানা হবে। কে সহায়তা দানে বা সাক্ষ্য দানে ‘অনিচ্ছুক’ - তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কেন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের মতো একটি তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া হবে? কেবল আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সমন পাঠানোর এবং তা অগ্রাহ্য করলে শাস্তি দেওয়ার।

এই বিল-এ ধর্ষণের তদন্তের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে ২১ দিন করা হয়েছে। আগের ৬০ দিনের সময়সীমা আইনের সুসংহত ধারণা থেকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ইচ্ছেমতো সময় কমালে তদন্তের গুণমানে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এই বিল-এ অপরাধীর জরিমানা করার কথা বলা হলেও, রাজ্য সরকারের তহবিল (ভিক্টিম কমপেনসেশন ফান্ড) থেকে ধর্ষণ-অতিক্রান্ত মেয়েদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও উল্লেখ নেই। সরকার এই বিলকে কার্যে পরিণত করতে কোনও বাড়তি আর্থিক দায় গ্রহণ করছে না, বাড়তি বরাদ্দ দিচ্ছে না। সুশীল সমাজের একাংশ ওপরের এই প্রশ্নগুলি তুলেছেন। এবং বোঝাই যায়,  এই বিল একটি অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি। আরজিকর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় জনরোষের সামনে ‘অপরাজিতা বিল’ একটা তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি মাত্র। 

আইনটির নির্মাণ ত্রুটিযুক্ত, তা পাশ করানো হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। যথেষ্ট চিন্তা, যথেষ্ট আলোচনা, যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কিছুরই ছাপ নেই। বসা হয়নি মেয়েদের সাথে বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে। অন্তত তেমন কোনও বিষয় আমাদের চোখে পড়েনি। 

আরজিকরের পরেও পাশাপাশি আরও অজস্র নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর অধিকাংশ ঘটছে গ্রামেগঞ্জে। যেখানে মানুষের একজোট হওয়া অসুবিধার। সারা ভারতই নারী নিগ্রহীদের স্বর্গরাজ্য, কিন্তু আমাদের রাজ্য যেন বেশি বেশি করে অগ্রণী! এগিয়ে বাংলার এই রূপ কি আমরা দেখতে চেয়েছি? ১০ অগস্ট থেকে যে প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে, তা তো এই সমস্ত ইস্যুতেই প্রশ্ন তুলেছে। সেই দিন থেকে লাগাতার সমগ্র সমাজ প্রতিবাদ করছে এক বা একাধিক অন্যায়ের। মেয়েরা বলেছে রাত দখল করবে। কেন বলেছে?  কারণ রাতের অধিকার একমাত্র পুরুষের নয়। এবং অবশ্যই ধর্ষক পুরুষের নয়। 

ধর্ষক পুরুষদের জেলখানার কয়েদের শিকের  আড়ালে রাখার বন্দোবস্ত না করে, প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, যে রাষ্ট্রযন্ত্র মেয়েদের সুরক্ষা দিতে অপ্রস্তুত, অক্ষম বলে  স্বীকার করে,  knee jerk reaction বশত এমন একুশে আইন আনে যা আসলে মেয়েদের কাজের জায়গা এবং কাজের সুযোগ খর্ব করে, কাজের সময়ের ওপরে খাঁড়া নামিয়ে আনে, সে রাষ্ট্র অক্ষম। যে রাষ্ট্র তাড়াহুড়ো করে একটা আইন আনে যেখানে না আছে নতুন কোনও ধ্যানধারণা, নতুন টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি বা একটা কোনও কিছু লাগু করার মতো ব্যবস্থা (ইমপ্লিমেন্টেবল), সে রাষ্ট্র আসলে তার নাগরিকদের সঙ্গে কোনও কথোপকথন করছে না। তার ডায়ালগ করার কোনও ক্ষমতা নেই। সে প্যানিক বাটন টিপছে না হলে প্রলাপ বকছে না হলে  ঔদাসিন্যে ছেলে ভোলাচ্ছে। এমন রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দিন ঘনিয়ে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রযন্ত্র কি তার ৫০ শতাংশ নাগরিকের সুরক্ষা দিতে আদৌ ইচ্ছুক? প্রশ্ন জাগে। সুরক্ষা, বিধান, আরাম দেওয়া, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি কোনও কিছুই দিতে ইচ্ছুক না। এমন কি সম্পূর্ণ বধির। তাইই, কোথাও কোনও শুশ্রূষা নেই যে আমাদের।

২০১১'তে 'পরিবর্তন চাই'-এর প্রত্যাশায় মানুষ যে বদল এনেছিলেন, সেই বদলকারীর হাতে পার্টিতন্ত্র আর সরকার একীভূত। পশ্চিমবঙ্গে এখন কোনও স্বায়ত্তশাসন সংস্থাও নেই যা নিজের মতে চলতে পারে। সরকারের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি এতটাই নিজস্ব অভিজ্ঞান চিহ্ন দিয়ে কব্জা করে নিয়েছেন যে তা বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়। এত বছরে দুর্নীতি এক রকমের গা-সওয়া হয়েছে, মানুষ ক্রমশ সহ্য করতে করতে বল্মীকস্তূপে পরিণত হয়েছেন। নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান অর্থকরী বেনিয়ম ও লাগামছাড়া পেশিশক্তির হাতে ক্রীড়নক। সর্বত্র বাহুবলী দলদাসদের বাড়বাড়ন্ত। ইতিমধ্যেই শিক্ষা দুর্নীতির কথা সর্বজনগ্রাহ্য হলেও, বা নারী সুরক্ষার প্রশ্নে একের পর এক প্রশ্নচিহ্ন উঠলেও (পার্ক স্ট্রিট কামদুনি হাঁসখালি) তা আমাদের চোখকান সয়ে এসেছিল যেন। আগস্টের ৯ তারিখ আরজিকর কাণ্ড একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ-খুন শুধু নয় - এটা মনে হয় সমাজের যা কিছু আশাপ্রদ,  ভবিষ্যতের দিকে উৎসারিত - তারই বিনাশ যেন। ফলত নারীদের এবং সাধারণ মানুষকে তা প্রবলভাবে নাড়া নয়। তারপরেও, এটা শুধু একটাই ধর্ষণ নয়। গণতন্ত্রের প্রায় প্রতিটি স্তম্ভের লাগাতার ধর্ষণ। পুলিশি ব্যবস্থার দলদাসত্ব ও নিষ্ক্রিয়তার পদাবলী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সিনিয়র ডাক্তারদের বিশাল অংশের নেক্সাসের কুৎসিত চিত্রাবলী। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম জরুরি দুটো অংশকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিয়েছে এই ঘটনার পূর্বাপর ঘটনাক্রম। প্রমাণ লোপাট করে প্রকৃত দোষীকে জানার পথ আড়াল করা হয়েছে। গোটা বিষয়ে রাজ্যবাসী কেঁপে শুধু ওঠেননি, ঐতিহাসিক ভাবে রাস্তায় নেমে এসেছেন। 

অনেক অন্ধকারের মধ্যে এটুকুই আশা যে, শেষ অবধি আমাদের ঘুম ভেঙেছে। রাত দখলের কর্মসূচিই হোক বা মানববন্ধন, জনজোয়ারে নেমে আসা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ হোক বা তীক্ষ্ণ প্রশ্নে সিস্টেমকে ক্ষতবিক্ষত করা, জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযানের সাফল্য, বহুদিন পর বাঙালি জেগে উঠেছে স্বতোৎসারিত পবিত্র ক্রোধে। এই ক্রোধকে প্রণাম।


Saturday 7 September 2024

ছেলেটিকেও শেখাই...

মানবতার সূর্যালোকে আমাদের ঘুম ভাঙুক

অনিন্দিতা মণ্ডল



প্রথমেই জানাই আজ কেন কলমটা ধরলাম। একজন ডাক্তার এবং সর্বোপরি একজন মানুষ হিসাবে আজ কিছু কথা না বলতে পারলে নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হবে। বিগত কয়েকদিন ধরে যে আন্দোলন চলছে তা আর কেবল চিকিৎসক সমাজের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই, জনসাধারণের অনুভূতিকেও নাড়া দিয়েছে। 

এই আন্দোলনের সূচনা গত ৯ অগস্ট ২০২৪, এক অভিশপ্ত শুক্রবারে; যেদিন ভোররাতে কর্মরত অবস্থায় নির্মমভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয় আমাদের অভয়া বা তিলোত্তমাকে, তাও আবার এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকেই এক হাসপাতালে। সেদিন সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে জুনিয়র চিকিৎসকরা এক বিপ্লবের সূচনা করে। সেই আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং স্বচ্ছ ময়নাতদন্তের দাবি। অনেক চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে সেদিন তারা একত্রিত হয়েছিল। হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রোদ, বৃষ্টি আর সমস্ত ভয়কে জয় করে তারা ন্যায়ের দাবি জানিয়েছিল। হারিয়ে ফেলা সহকর্মীর জন্য বিচার চাওয়া কি এত বড় ধৃষ্টতা? না হলে কেন কিছু অশুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেদিন লণ্ডভণ্ড করে দিল পুরো হাসপাতাল? স্বাধীনতার মধ্যরাত্রে যখন চিকিৎসক সমাজের ডাকে সাড়া দিয়ে আপামর বঙ্গবাসী পথে নেমেছিল, ঠিক সেই সময় হাসপাতালে চলল তাণ্ডব। 

ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও এই শান্তিপূর্ণ, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলনকে থামিয়ে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল কিছু মানুষ। কিন্তু সেদিনের পর আন্দোলন হল আরও তীব্রতর। পাহাড়ি ঝর্ণাতে বাঁধ দেবার মতোই ব্যর্থ প্রয়াস। আন্দোলন হল আরও খরস্রোতা। ন্যায়ের দাবিতে স্লোগানে মুখরিত হল সারা কলকাতা। 'আমি ভয় করব না ভয় করব না' বলে সবাই এগিয়ে চলল। এই কলকাতা অতীতে কবে দু' বেলা মরার আগে মরেনি তা আমার জানা নেই। জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে থেকে অনবরত আন্দোলন চালিয়ে গেলেন, আর তাদের পাশে ঢাল হয়ে সিনিয়র চিকিৎসকরা রোগীদের পরিষেবা দিতে লাগলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, কোনওদিনই কিন্তু এমারজেন্সি পরিষেবা থেকে রোগীকে বঞ্চিত করা হয়নি। নিন্দুকেরা অবশ্য তা নিয়ে কুৎসা করা থেকে বিরত থাকেননি। কিন্তু আমরা, চিকিৎসকরা, চিকিৎসা না করতে পারলে ততটাই কষ্ট পাই যতটা একজন কৃষক মাঠে যেতে না পারলে পান, যতটা একজন শিল্পী গান না গাইতে পারলে পান, যতটা কষ্ট একজন শিক্ষক পান পড়াতে না পারলে। 

এই লড়াই কেন তারা বেছে নিলেন? এই পথ কি খুব সুখের? একবার ভেবে দেখুন তো, আজ একজন চিকিৎসক যদি কর্মরত অবস্থায় এই জঘন্য ঘটনার শিকার হন, তাহলে আমার আপনার বাড়ির নারীরা সুরক্ষিত তো? কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াই একবার ভাবুন তো, যদি এই অন্যায়ের শাস্তি না হয় তাহলে আমরা পারব তো এই সমাজে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিতে? এই ঘটনার দায় কি আমরা কেউ এড়াতে পারি? আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ই কি এর কারণ নয়? যেদিন দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল তার দায় কিন্তু সমাজ এড়াতে পারেনি। সেই পাপেই ১৮ দিনের মহাযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কৌরবকুল। আজকের ঘটনা কি তার সমতুল্য নয়? 

কিন্তু আজও, ২৬ দিন কেটে গেলেও, আমরা সুবিচারের অপেক্ষায়। এই দীর্ঘ বিচারব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘ করে তুলেছে বিভিন্ন প্রমাণ লোপাটের প্রচেষ্টা। আমরা কি আদৌ নিরাপদ? রাতে কাজ করা না হলেই কি ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে আমরা মুক্তি পাব? তিলে তিলে গড়ে ওঠা নারী স্বাধীনতার পরিসর নির্ধারণের অধিকার কিন্তু এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের হাতে নেই। ধিক্কার এই সমাজকে, যেখানে নারীদের পথে নামতে হচ্ছে রাতের দখল নিতে, নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে। এই আমাদের সভ্যতা? একজন মহিলা চিকিৎসক যদি রাতে কাজ না করেন তাহলে শুধু পুরুষদের দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা চলবে না। আপনার, আমার বাড়ির লোক যখন রাতে অসুস্থ হলে ডাক্তারের অভাবে ছটফট করবেন, তখন আমরা বুঝতে পারব যে এটা কোনও সমাধানসূত্রই নয়। আর শুধু ডাক্তার কেন, যে কোনও পেশার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। তাই আমাদের চিন্তাধারার বদল আবশ্যিক। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আমাদের শেখায় যে কেবল নিজের বাড়ির মা, বোন, স্ত্রী, কন্যার সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ, আর বাকি সকল নারীকে বস্তুবাদিতার নিরিখে মাপা যায়, ধিক সেই সমাজকে। সেই সমাজেরই কিছু উচ্চপদস্থ কর্মী নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাবার জন্য প্রকাণ্ড লৌহকপাট নির্মাণ করেন। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্যের কাছে নতিস্বীকার করতে হয় তাদের। 

এরকম শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অদূর অতীতে আমরা কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না। এসবের পরও কর্মবিরতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি আমাদের সাজে? তবুও যদি এই প্রশ্ন এখনও কারও মনে সংশয় সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তারা জেনে রাখুন যে জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের নির্যাতিতা সহকর্মীর নামে 'অভয়া ক্লিনিক' চালু রেখেছে যেখানে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত টেলিমেডিসিন পরিষেবা দেওয়া হয়, যাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও সঙ্কটমুক্ত হন। তবে সব মানুষ যে কুৎসা রটাচ্ছেন এমনটা বললে অধর্ম করা হবে। লালবাজারের অবস্থান ধর্মঘটে সাধারণ মানুষরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের পাশে থেকেছেন। আমরা ঋণী সেই মানুষটার কাছে যিনি নিজের দৈনিক উপার্জনকে প্রাধান্য না দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে স্যান্ডউইচ আর সিঙ্গারা নিয়ে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন। আমরা ঋণী সেই মানুষটার কাছেও, যিনি অনেকগুলো হাতপাখা সরবরাহ করেছিলেন আমাদের ক্ষণিকের স্বস্তির জন্য এবং যা হয়তো তাঁর সারাদিনের রুটিরুজি। ক্রমাগত অবস্থানের জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করছিলেন কিন্তু ওই সাধারণ মানুষরাই। এনাদের কথা স্বীকার না করলে আমাদের আন্দোলনটাই অপূর্ণ রয়ে যাবে। 

এই আন্দোলন ধীরে ধীরে আরও বৃহত্তর রূপ ধারণ করছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। আজ মানুষ খুঁজে নিচ্ছে মিছিলকে। এ কোনও সামাজিক শ্রেণির আন্দোলন নয়, এ আন্দোলন আমাদের হৃদয়ের, আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার আন্দোলন। আসুন, আমরা সবাই জেগে উঠি, এগিয়ে যাই আরও বৃহত্তর মানবতার দিকে। আমাদের ঘরের ৫ বছরের নাবালিকাটি যেন তার চিকিৎসক, পুলিশ, অভিনেত্রী বা আরও বড় হবার স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে না ফেলে কেবলমাত্র নিরাপদ রাতের অভাবে। আসুন, আমরা আমাদের ৫ বছরের ছেলেটিকেও শেখাই সকল নারীকে সম্মান করতে। নারী কোনও আলাদা প্রজাতি নয়, তারা পুরুষের মতোই। এই সমতার শিক্ষাই হয়তো আমাদের নারী-পুরুষ সবাইকেই একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে পারবে। তাই এই আন্দোলন আমার, আপনার সবার আন্দোলন। আমাদের মনুষ্যত্বে উন্নীত হবার পথে যে কোনও বাধাই আসুক না কেন, আমরা তা পার করে ফেলব এই বিশ্বাস আমার আছে। 

কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ, শ্রেণি বৈষম্য বাদ দিয়ে একবার নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে অনুভব করে দেখুন; দেখবেন, আপনিও কখন নিজের অজান্তেই এই আন্দোলনে সামিল হয়ে গিয়েছেন। আশা রাখি, একটা সুস্থ সমাজের ভোরে মানবতার সূর্যালোকে আমাদের ঘুম ভাঙবে।


Thursday 5 September 2024

মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেলা

মেয়েরা যখন রাতের রাস্তা দখলের ডাক দিল

মহাশ্বেতা সমাজদার



জীবনের এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এমন পবিত্র জাগরণ কে কবে দেখেছে? নিশুতি রাতের দখল নিতে পথে নেমেছেন (১৪ অগস্ট ২০২৪) সব বয়সের নারী। তাদের পাশে পাশেই হাতে রামধনু পতাকা নিয়ে হেঁটে আসছেন প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষেরা। অল্প দূরেই আছেন পুরুষরা, যাঁরা মানেন, নারীর যথার্থ স্বাধীনতা এখনও সুদূরপরাহত। এমনকী সে রাতে পুরো ঘরবন্দি ছিলেন না তাঁরাও, যাঁদের বিরুদ্ধেও এই স্বাধীনতার লড়াই। তাঁরাও ঘরের মা-বোনেদের একা রাতে ছাড়তে না পেরে পিছু পিছু এসে জুটে গেছেন বিপুল জনস্রোতে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, শোকের ক্রোধের দ্রোহের সে এক বিপুল জনপ্লাবন।

শুরুটা সবার জানা। আরজিকরের ডাক্তার-ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ-মৃত্যুর খবরে, নিজেরই কর্মক্ষেত্রে মৃতার শেষ মুহূর্তের অসহায়তাটি স্পর্শ করেছিল সকলকেই। এক সর্বব্যাপী শোকের মধ্যেই সবাই নিজের নিজের মতো করে বুঝে নিচ্ছিলেন সবটুকু। কারও বুকে কাঁপন ধরেছিল নিজের সন্তানের মুখটি মনে পড়ে, কারও চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল একটি জীবন ও তার স্বপ্নের এমন নিষ্ঠুর ভয়াবহ পরিণতিতে।কারও কাছে অপমানের বেদনাটি বড় চেনা লেগেছিল। 

ঘটনার অব্যবহিত পরেই শোনা গেল হাসপাতালের অধ্যক্ষের উক্তি: 'ও ওখানে কী করছিল?' অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের সব ভালোমন্দের দায়িত্ব যার স্কন্ধে, তিনি অবলীলায় মৃত্যু ও ধর্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দিলেন মৃতা-নির্যাতিতা-ধর্ষিতা ছাত্রীর উপর। জুনিয়র ডাক্তাররা অধ্যক্ষের পদত্যাগ ও ঘটনার ন্যায্য বিচার চেয়ে আন্দোলন শুরু করে দিলেন। আর অধ্যক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি এক অদৃষ্টপূর্ব মেঘ ঘনিয়ে আনল এ রাজ্যের আকাশে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল অধ্যক্ষের পদত্যাগের চার ঘন্টার মধ্যেই অন্য একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে তাঁকে নিযুক্ত হতে দেখে।

তাই মেয়েরা যখন রাতের রাস্তা দখলের ডাক দিল, তখন সে ডাকে সাড়া পড়ে গেল ঘরে ঘরে। সে ডাকেই গলা মেলালেন ট্রান্স ক্যুইয়ার মানুষেরাও। সে ডাক শহর কলকাতাকে ছাপিয়ে ভেসে গেল সারা রাজ্যের শহর শহরতলি মফস্সল গ্রামে-গ্রামান্তরে। ছাড়িয়ে গেল রাজ্য আর দেশের সীমানাও। বিদেশেরও নানা জায়গা থেকে শোনা গেল 'জাস্টিস ফর আরজিকর'। 

দিকে দিকে গড়ে উঠতে লাগল মানববন্ধন। প্রতিদিন মিছিলে শ্লোগানে প্রতিবাদে শহরের আকাশে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। জাস্টিস ফর আরজিকর। জুনিয়র ডাক্তাররা ন্যায়ের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তার সমান্তরালে আন্দোলন গড়ে উঠল নাগরিক সমাজেও। কোথাও সঙ্গীতশিল্পীরা, কোথাও বাচিকশিল্পীরা, কোথাও সিনিয়র ডাক্তাররা, অভিনয় ও কলাকুশলীরা, কবি লেখকরা, বেসরকারি হাসপাতালের সবাই, শহরের আবাসনে আবাসনে, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রাক্তনীরা, অনলাইন অ্যাপ ডেলিভারি কর্মীরা, যে যেখানে ছিল পা মেলাল, গলা মেলাল মিছিলে, শ্লোগানে। কলকাতার খেলার মাঠের দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান যখন পরস্পরের চিরবৈরিতা ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়াজ তুলল, আমাদের বোনের বিচার চাই, আর তাদের পাশেই এসে দাঁড়াল মহামেডান স্পোর্টিংও, সেদিন শহর সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল এক অভূতপূর্ব দ্রোহ। 

ইতিমধ্যে, কলকাতা পুলিসের থেকে তদন্তের ভার গেছে সিবিআই'এর কাছে। ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত শুনানি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। 

জুনিয়র ডাক্তাররা পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যেতে চাইলে মাঝরাস্তায় পুলিশ তাদের ব্যারিকেড করে থামিয়ে দেয়। তাঁরা সেখানেই বসে পড়েন ও তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। সারা শহর ঝাঁপিয়ে পড়ে হবু ডাক্তারদের দেখভালে। খুলে যায় ইতিউতি দোকান প্রেস বাড়ির বাথরুমগুলি। ইতিমধ্যে কেউ এসে চলমান শৌচালয় বসিয়ে দিয়ে গেছে। জুনিয়ররা সারা রাত অপেক্ষা করে আছে একটি সুসজ্জিত শিরদাঁড়া নিয়ে। পুলিশ কমিশনারের তো সেটারই বড় অভাব। ইতিমধ্যে রাত পেরিয়ে ভোর হয়। চা-বিস্কুট স্যান্ডউইচ পৌঁছে যায় আন্দোলনকারীদের কাছে। রোদ ওঠে, গরম বাড়ে । শহর এসে ত্রিপল টাঙিয়ে দেয়। ছায়া আসে। শহর বলে ওদের অভুক্ত তৃষ্ণার্ত থাকতে দেব না। চলে আসে গ্লুকন-ডি জল দুপুরের খাবার। সারা শহর উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চায়, আর কিছু কি লাগবে ওদের ? 

শহর কলকাতার বুকের ভিতরে যে প্রাণের ধুকপুকুনিটুকু থেমে যায়নি, তা দেখে ভরসা জাগে। বুকের ভিতর কান্না চেপে আন্দোলন কঠিন হয়ে ওঠে। এদিকের এদের অনড়তায় ওদিকের ওদের কাঁপন বাড়ে। খবর আসে ব্যারিকেড খোলা হবে। ২২ ঘন্টা অপেক্ষার পর ২২ জন জুনিয়র ডাক্তার ঢুকলেন লালবাজার। পুলিস কমিশনারকে একটি গোলাপ ফুল সজ্জিত মেরুদণ্ড উপহার দিয়ে তাঁরই ইস্তফা বিষয়ক স্মারকলিপি তাঁরই হাতে জমা দিয়ে তাঁরা আবার ফিরে গেলেন তাঁদের আন্দোলনের মঞ্চে।

রাত দখলের মেয়ে-ট্রান্স-ক্যুইয়াররা ইতিমধ্যে জেলায় জেলায় আর শহর কলকাতায় একের পর এক মিছিল করেছে। মানববন্ধন গড়েছে। রাস্তার ধারের গৃহস্থরা সেই মিছিলকে দু' হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছেন, শ্লোগানে গলা মিলিয়েছেন। মিছিলে আটকে পড়া ট্রাম থেকে যাত্রীরা নেমে এসেছেন মিছিলে। কবিতা গানে নাটকে পথচিত্রে স্লোগানে, পোস্টারে ভরে উঠেছে শহরের রাস্তা।  

এ যেন সেই সারা শহর উথালপাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ চলছে।

প্রতি মুহূর্তের জীবনযাপনের মধ্যেও ভোলা যাচ্ছে না সেই মেয়ের কথা, সম্ভবত যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। সম্ভবত তাকে এমনভাবে যন্ত্রণা নিয়ে চলে যেতে হয়েছে, সম্ভবত এমন ভাবে তার মৃতদেহকে ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে তা ভয়ের সৃষ্টি করে তাদের বুকে, যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা মনে মনেও ভেবেছে কখনও, বা ভবিষ্যতে ভাবতেও পারে।

এর সঙ্গে ক্ষোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যখন জানা যাচ্ছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক কেমন ব্যবহার করেছিল তাঁর মা-বাবার সঙ্গে। কী ভাবে মেয়ের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। মেয়ের মৃতদেহ কীভাবে তড়িঘড়ি দাহ করা হয়। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও'য় দেখা গেছে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিরা মৃতদেহের কাছে ভিড় করে আছেন। প্রমাণ লোপাটের বিবিধ ব্যবস্থা সাধারণ মানুষ সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝতে পারছেন। এমনকী সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই এ কথা স্বীকারও করেছে, যে যথাযথ সংরক্ষিত হয়নি তথ্যপ্রমাণ।

এ যেন সেই মৃত্যু যা জাগিয়ে দিয়ে গেল গোটা সমাজকে। এ জাগরণ এমনই যে অন্যায়ের মূল পর্যন্ত না উপড়ে এ যেন থামবে না। যেহেতু মানুষের ক্রোধের লক্ষ্য রাজ্যের সরকার, তাই সেই রাগের আগুনকে নিজের কাজে লাগাতে যথাসাধ্য তৎপর হয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। কিন্তু আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা এবং রাত দখলের মেয়ে ট্রান্স ক্যুইয়াররা সমাজকে পলে পলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, নারীর প্রতি অনাচার অত্যাচারে বিজেপির স্থান দেশে এক নম্বরে। বিলকিস বানো, উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরাস, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজেপি ধর্ষকের সমর্থক। তাই এই দ্রোহকালে বিজেপিকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া যাবে না।  

মানুষ রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে অন্যায়ের শেষ দেখার অপেক্ষা করছে। চারের রাতের পথের দখলের পোস্টারে লেখা হল, বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, রাত জাগছে সেই জনতা। চারের বিকেলে যখন ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে সন্ধের মানব বন্ধনের স্থানের তালিকা, জানা যাচ্ছে আরজিকরের প্রাক্তনীরাও রাত এগারোটা থেকে শহরের কোনও কোনও স্থানে রাত দখল করবেন, তখনই খবর পাওয়া গেল, ৫ সেপ্টে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি স্থগিত। কিন্তু এক মুহূর্তও আন্দোলনের গতিতে কোনও বিরাম এল না। শুধু বোঝা গেল লড়াই আরও দীর্ঘ হবে, কিন্তু অন্যায়ের শেষ না দেখে এ লড়াই থামবে না। 

চারের রাতে রাজ্য জুড়ে শত শত মানব বন্ধন আর রাত দখল থেকে আওয়াজ উঠল, বিচার যত পিছোবে, মিছিল তত এগোবে। এই সর্বব্যাপী আন্দোলনের অমোঘ বার্তা, মানুষ আর ভয় পাচ্ছে না। যে মানুষ দুদিন আগেও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আন্দোলনে পা মেলায়নি, একটি মৃত্যু তার চোখের সামনে থেকে ভয়ের পর্দাটা যেন একটানে নামিয়ে দিয়েছে। আর এটাই হৃৎকম্প সৃষ্টি করছে শাসকের বুকে। তাই ইতস্তত চলছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া মেয়েদের ভয় দেখানো। থেমে নেই পুলিশি জুলুম।

কিন্তু যারা একবার পথে নেমে পড়ার সাহস পেয়েছে, নিজেদের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে, তারা শুধু আরজিকরের ঘটনার অপরাধীর শাস্তি দেখেই শান্ত হবে না। তারা মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেলতে নেমেছে এই গোটা দুষ্টচক্রটিকেই। তারা পালটে দিতে নেমেছে মেয়ে ট্রান্স ক্যুইয়ারদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটিকেও। তারা আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আর ঘরে ঢোকানো যাবে না।