Tuesday 23 July 2024

বাজেট নিয়ে অযথা হৈচৈ

সরকারের দিন গিয়াছে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

বাজেট নিয়ে বেশ কিছু বছর লেখালিখি-বলাবলি বন্ধ করেছি। কারণ, বাজেটে কিছু যায় আসে না। এবারও কিছু লেখার কথা নয়! বরং কেন এইসব আলোচনা অযথা এবং এবারেও যে তাই, সেইসব কথাই ঈষৎ বলার চেষ্টা করব। 

গতকাল (২২ জুলাই) সংসদে যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০২৩-২৪) পেশ করা হল (প্রতি বছরই বাজেটের আগের দিন তা হয়), তার আলোচনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই সমীক্ষার সঙ্গে বাজেটের কোনও সম্পর্ক নেই, যে সম্পর্ক থাকাটা বাঞ্ছনীয়, সেইজন্যই তা বাজেট-বক্তৃতার আগের দিন সংসদে পেশ হয়। সে সম্পর্ক নেই বলেই বাজেট নিছকই গেরস্তের আয়-ব্যয়ের আনুমানিক হদিশের মতো নিতান্তই এক বাঁদিক ও ডানদিকের অঙ্কের হিসেব মেলানোর ব্যর্থ প্রয়াস। গেরস্তের হিসেব যেমন মাসের শেষে মেলে না, তেমনই সরকারের হিসেবও বছর শেষে উলটপুরাণ!

কিন্তু এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ কথা পেড়েছে:

কথা ১) দেশের বেকারত্বের সমাধানের প্রশ্নটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে- সে চ্যালেঞ্জ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই প্রথম বেশ জোরের সঙ্গে সমীক্ষায় স্বীকার করা হল যে, ‘The biggest disruption for the future of work is the accelerated growth in AI, which is poised to revolutionise the global economy, India would not remain immune to this transformation.’। অতএব, সমীক্ষার মতে, এই সম্ভাব্য ব্যাপক অভিঘাতকে সামলানোর জন্য সরকার ও কর্পোরেট দুনিয়াকে ভাবতে হবে;

কথা ২) ক্রমবর্ধমান শ্রমবাহিনীর বোঝা সামলাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অ-কৃষি ক্ষেত্রে প্রতি বছর গড়ে ৭৮.৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করতে হবে;

কথা ৩) ২০২৯-৩০ সালে দেশে ২.৩৫ কোটি গিগ শ্রমিক তৈরি হবে যা মোট শ্রমবাহিনীর ৪.১ শতাংশে দাঁড়াবে। এই বিপুল শ্রমবাহিনীর জন্য যথাযথ সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজন;

কথা ৪) সিংহভাগ কর্মসংস্থান যেহেতু বেসরকারি ও কর্পোরেট ক্ষেত্রেই হয় এবং কর্পোরেট দুনিয়াও গত ১৫ বছরে আজ সব থেকে বেশি মুনাফা করেছে (২০১৯-২০’এর তুলনায় এই মুনাফা ২০২২-২৩’এ চার গুন বৃদ্ধি পেয়েছে), তাই পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে যথাযথ বিভাজন ও নিয়োজন তাদেরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমীক্ষার মতে, যদিও এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি কর্পোরেটদের এক অসীম মুগ্ধতা রয়েছে, কিন্তু তা বলে কর্মসংস্থানের প্রশ্নকে তারা এড়িয়ে যেতে পারে না, কারণ, এর সঙ্গে সামাজিক সুস্থিরতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে।

এত স্পষ্ট করে আজকের বাস্তবতাকে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তুলে ধরা গেলেও এবারের বাজেটে তার কোনও প্রতিফলন নেই। কারণ, সমস্যাটাকে সরকার বড়জোর চিহ্নিত করতে পেরেছে, তার সমাধানের যাদুকাঠি তার হাতে আর নেই। অর্থনীতির ভার চলে গেছে এক নৈর্ব্যক্তিক নিয়ন্তার হাতে, যার দুটি হাতের একটি ধরে রেখেছে সর্বৈব প্রযুক্তি-নির্ভর এক দানব কর্পোরেট দুনিয়া ও অপরটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সরকারের দিন গিয়াছে।

সরকার আপাতত যেটা করতে পারে তা হল, জনকল্যাণ। কর্মসংস্থানের ক্ষমতা তার নেই। অল্পবিস্তর স্থায়ী-অস্থায়ী সরকারি চাকরি তৈরি করা যেতে পারে, তাতে চিঁড়ে ভিজবে না। ফলে, এবারের বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ল্যাজেগোবরে হলেন। তিনি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন: ১) স্কিম এ – নতুন নিযুক্ত কর্মচারীর প্রথম মাসের মাইনে (১৫,০০০ টাকার উর্ধ্বে নয়) সরকারের তরফ থেকে নিয়োগকর্তাকে দিয়ে দেওয়া হবে; ২) স্কিম বি – ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মনিয়োজনে ইপিএফও মাধ্যমে অর্থ সহায়তা ও ৩) স্কিম সি – মালিকদের সহায়তা (এই স্কিমটি এখনও স্পষ্ট নয়)। বোঝাই যাচ্ছে, এইগুলি সব তালেগোলে মার্কা উদ্ভট স্কিম। নতুন নিয়োজিত প্রার্থীকে এক মাসের মাইনে সরকার দিয়ে দিলে বাকী মাসগুলি মালিকপক্ষ কেন সেই কর্মচারীকে মাইনে দিয়ে যাবে যদি না তাকে ৬ মাস পরে তাদের কোনও কাজে লাগে? অনেকটা ‘উজলা গ্যাস’ স্কিমের মতো, প্রথমবার ফ্রি সিলিন্ডার সহ গ্যাস ওভেন পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু পরের বার সিলিন্ডার কেনার টাকা কে জোগাবে সেইসব গরিব পরিবারে তার কোনও উত্তর নেই! সেই সঙ্গে বাজেটে আগামী পাঁচ বছরে ৫০০টি কোম্পানিতে ১ কোটি ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১ বছরের এই ইন্টার্নশিপে সরকার ৫০০০ টাকা করে ইন্টার্নদের মাসিক স্টাইপেন্ড দেবে। তারপর? এ তো অনেকটা ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের মতো!

বাজেট পড়া যত এগিয়েছে, সেনসেক্স ও নিফটি’র সূচক তত নিম্নগামী হয়েছে। আপাত ভাবে মনে হবে, কর্পোরেট দুনিয়াও তেমন কিছু এ বাজেট থেকে পায়নি। কিছু পাওয়ারও নেই। নতুন এয়ারপোর্ট নির্মাণের ঘোষণা আছে। নির্মাণের পর লাভজনক হলে সেই এয়ারপোর্টগুলি প্রিয় কর্পোরেটরা হয়তো পেয়ে যাবে। এর জন্য বাজেটে লেখাপড়ার কোনও দরকার পড়ে না! দুই বেয়াদপ শরিককে তুষ্ট করতে অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহারকে ঢেলে সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এই রাজনৈতিক সিদ্ধিপূরণ শাসকের দিক থেকে ‘কাজের কাজ’ বটে! বাজেটে এইসবই হতে পারে! যেমন, এই অস্থির ও অনিশ্চিত অর্থনৈতিক সময়ে জনকল্যাণের পরিধি ও বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেটে এক নতুন দ্বার খুলে দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু সে সব কাজে শাসকের মন নেই। তারা সরকারি অর্থে সম্পদ তৈরি করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার স্কিম বানাতে ওস্তাদ। অথচ, ২০২৩-২৪ সালের বৃটেনের বাজেটের দিকে যদি একবার তাকান- ৩৪১ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করা হয়েছে জনকল্যাণের খাতে, যা বাজেটে মোট অর্থ বরাদ্দের ২৯ শতাংশ; স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ২৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড (২০ শতাংশ) ও ১৩১ বিলিয়ন পাউন্ড (১১ শতাংশ)।

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার; একপ্রকার অনন্যোপায় হয়ে কর্পোরেটপতিদের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কিছুটা পাশে সরিয়ে সংবেদনশীল ভাবে কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে দেখতে। অথচ, বাজেটে এর বটিকা হিসেবে উপযুক্ত জনকল্যাণের কোনও প্রকল্পের হদিশ নেই; গোঁজামিল দেওয়া কর্মসংস্থানের কিছু উদ্ভট পদক্ষেপের প্রস্তাব আছে মাত্র। কেন? ভাবনায় উঁকি দিলেও তার প্রয়োগে সাহসের অভাব? কারণ, বিভাজনের রাজনীতিই যাদের ক্ষমতা-সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি, তারা কী উপায়ে সর্বজনীন জনকল্যাণের রাজনীতির বাহক হতে পারে? জনকল্যাণ প্রকল্পের সুফলগুলি যে বিভাজন-রেখার পরোয়া করে না! ধর্ম বা জাতপাতের রঙ দেখে না! মনে পড়ছে, ২০১৬ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মহাশয় তাঁর অংশের একটি পরিচ্ছেদে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ প্রণয়নের কথা লিখেছিলেন। কিন্তু তিনিও বাজেটে সে কথা উত্থাপন করেননি। পরে আর সে কথা শোনাও যায়নি।

তাই, বাজেট যদি ‘প্রত্যক্ষ জনকল্যাণে’ অর্থ বরাদ্দ না করতে পারে, তাহলে তা অর্থহীন এক প্রলাপ মাত্র। সামান্য এ-ধার ও-ধারে কর বাড়া-কমা’র জন্য বাজেটের দরকার নেই, তা বছরভরই চলতে পারে। বলাই বাহুল্য, বাজেট এখন গেরস্তের হিসেব রাখার খাতার মতো; যার তেমন বিশেষ কোনও কার্যকারিতা নেই।

 

6 comments:

  1. ভালো লেখা, সুস্পষ্ট দিকগুলো ধরাপড়েছে। এই সরকার জনকল্যান বেকারত্ব কোনটাতে হাত দেবে না।

    ReplyDelete
  2. Tiny but solid analysis

    ReplyDelete
  3. Good Analysis

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগলো তোমার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তবে AI অপ্রতিরোধ্য এবং তার প্রয়োগ অপরিহার্য বলে বেড়ে- চলা বেকারত্বের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব কার্যত অস্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী।

    ReplyDelete
  5. আজকের আনন্দবাজার পত্রিকায়(24 জুলাই) অচিন চক্রবর্তী ('গণতন্ত্রের অন্তিম গন্তব্য') একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হল আজ থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে রিজার্ভ ব্যাংক জানায় যে, গত দশ বছরে ভারতে নাকি 18 কোটি মানুষ কাজ পেয়েছে! অর্থাৎ বেকারি নিম্নগামী। পরে তলিয়ে দেখা গেল এই হিসাবে স্বনিযুক্তি এবং কৃষি পরিবারে পরিবারিক উদ্যোগে অংশগ্রহণকে চাকরি বলে দেখানো হয়েছে! লেখায় আমাদের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান 'ইনফরমালাইজেশন' একটু আলোকপাত করা হলে ভাল হত।

    ReplyDelete
  6. অল্প কথায় চমৎকার সারাংশ ফুটে উঠেছে । দারুণ!

    ReplyDelete