Tuesday 29 August 2023

কৃষিতেও গিগ শ্রমিক

'পূবে কাজে যাওয়া'

বিনয় কৃষ্ণ পাল



সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে গিগ শ্রমিক অত্যন্ত আলোচিত বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। গিগ  শ্রমিক বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাইক বা নিজস্ব যানবহনে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘড়ির কাটা ধরে ছুটে চলা আপাত স্বাধীন ডেলিভারি বয়রা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শহর-ভিত্তিক গিগ কাজের অগণিত কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং যথেষ্ট আয়ের সুযোগ-সুবিধার সাথে সাথে গ্রামীণ এলাকার কৃষকেরাও আয়ের বিকল্প উৎসের সন্ধানে প্রচুর পরিমাণে স্থানান্তরিত হতে শুরু করেছেন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এটি কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে ও ভবিষ্যতেও করবে। 

কৃষির সঙ্গে জড়িত উৎপাদকদের জন্য অতিরিক্ত আয় তৈরি করা এবং আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা যাতে ভেঙে না পড়ে তা নিশ্চিত করার জন্যই একটি গ্রামীণ গিগ অর্থনীতি গড়ে উঠছে। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে স্থানান্তরী শ্রমিকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই লেখাটি মূলত দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিম জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পূর্বের জেলা বর্ধমান, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলাগুলিতে কৃষি শ্রমিকদের স্থানান্তর নিয়ে। এই জেলাগুলির যোগাযোগে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দুটি লাইন- পুরুলিয়া-হাওড়া ও বাঁকুড়া-মসাগ্রাম (পূর্বতন BDR বা বাঁকুড়া দামোদর রেলওয়ে) এবং এই রেল লাইনের প্রায় সমান্তরালে সড়কপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। 

কৃষিতে গিগ

প্রচলিত কথায় বলা হয়ে থাকে, সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমুলক প্রকল্পের কারণে গ্রামাঞ্চলে কৃষি শ্রমিক প্রাপ্যতার সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে এই কথার ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়। গত প্রায় দু' বছর ধরেই একশো দিনের প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন ফের বাড়ছে এবং জীবিকার তাগিদে আঞ্চলিক স্তরেও ব্যাপক স্থানান্তর দেখা যাচ্ছে। 

এলাকা ভিত্তিক গিগ শ্রমিকদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম লোকাল বা প্যাসেঞ্জার ট্রেন, লোকাল বাস এবং ইঞ্জিন ভ্যানের মতো যানবাহন। রোজকার যাত্রায় তাঁরা ভাগ করে নেন নানা সুখ-দুঃখের কথা ও বেঁচে থাকার গল্প। এলাকার শ্রমিকদের কাছে এখন খুবই প্রচলিত হয়েছে ‘পূবে কাজে যাওয়া’ এই বাক্যবন্ধটি। যাতায়াত ব্যয় কমাতে এই এলাকায় রেল যোগাযোগ এই স্থানান্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঁকুড়া-মশাগ্রাম ও পুরুলিয়া-খড়গপুর রেলপথ এই পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। লোকাল বা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের অতি স্বল্প ভাড়া, দ্রুত ও সহজ যোগাযোগ এই স্থানান্তরে খুব কার্যকরী। দক্ষিণ-পূর্ব রেল এবং পূর্ব রেলের যোগাযোগের মাধ্যমে মূলত দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে মানুষ কাজের জন্য স্থানান্তর করেন, যা দৈনিক বা পাক্ষিক অথবা ঋতুকালীন নানা পর্যায়ের হয়। সাধারণভাবে লোকাল ট্রেনের ভাড়া কম হওয়ায় এই শ্রমিকেরা খুব সহজেই পশ্চিমাঞ্চলের স্টেশনগুলির পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে অত্যন্ত ভোরে বা তাঁদের সুবিধামতো সময়ে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলাগুলিতে কাজের জন্য আসেন। তুলনামূলকভাবে বেশি মজুরি হওয়ার ফলে এই শ্রমিকেরা খুব সহজেই বেশি রোজগারের আশায় আকৃষ্ট হন। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের কিছু অংশ ও ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি এলাকায় স্বল্পবৃষ্টি এবং কোনও কোনও মরসুমে খরা প্রকৃতির কারণে ঐ এলাকায় কৃষি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কাজ পাওয়া যায় না এবং তার ফলেই তারা কাজের সন্ধানে পার্শ্ববর্তী জেলা এমনকি পার্শ্ববর্তী বা সুদূর রাজ্যে পাড়ি দেন। 



সাধারণভাবে কাজের নিয়ম অনুযায়ী, একজন শ্রমিক কোনও একটি ক্ষেতে একদিনের কাজে নিযুক্ত হন। কিন্তু স্বল্প সময়ে অধিক রোজগার এবং বেরোজগারের মৌসুমগুলিতে আয়কে সুরক্ষিত রাখতে এঁরা মালিকের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজে নিযুক্ত হন এবং দেখা যায়, অনেক সময়ই তাঁরা একদিনে তিন-চারজন শ্রমিকের কাজ করে দেন এবং তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দৈনিক আয় করেন। বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমাঞ্চল থেকে বর্ধমানে এ কাজ করতে আসা অধিকাংশ কৃষি শ্রমিক দৈনিক সাতশো থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন, যেখানে নিজেদের জেলা বা এলাকায় এই কাজ করে সর্বসাকুল্যে হয়তো আয় হত পাঁচশো টাকা। ফলে, শহরের শ্রমিকেরা যেমন দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে ছুটে নিজেদের আয়কে বাড়ানোর চেষ্টা করেন, একইভাবে গ্রামীণ কৃষি শ্রমিকরাও সকাল থেকে রাত্রি অথবা এক এক মরসুমে জেলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কাজ করতে গিয়ে অধিক আয়ের চেষ্টা করেন। এঁদের এলাকাভিত্তিক কাজ ও কাজের তথ্য পেতে সাহায্য করেন কমিশন ভিত্তিক কাজ করা কিছু কন্ট্রাক্টর বা সুপারভাইজার- এরাই জমি মালিক ও কৃষি শ্রমিকদের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। অনেক ক্ষেত্রে এই কন্ট্রাক্টররাই অসুস্থতা বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সহজ সুদে বা অন্য কোনও শর্তে ঋণ দেন। 

যন্ত্রায়ন ও মহিলাদের শ্রমের স্বীকৃতি

ইতিহাস জুড়ে নারীরা কৃষি শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণ, বৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মহিলারা অস্পষ্ট শ্রমশক্তি হিসাবে টিকে থাকেন, তাদের অবদান প্রায়শই অস্বীকৃত থেকে যায়। কৃষি প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলি লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আরও প্রচেষ্টা করছে। তারা যে প্রযুক্তি-চালিত প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার করে তা প্রযুক্তি, ডিজিটাইজেশন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৃহত্তর সংখ্যক নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার সুবিধা দেয়। ফলস্বরূপ, এই উদ্যোগগুলি নারীদের সক্রিয়ভাবে কর্মশক্তিতে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করে। 

বর্তমান কৃষি ক্ষেত্রে যন্ত্রায়ন মহিলাদের কাজের ক্ষেত্র ও স্বীকৃতিকে ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। যেমন, আগে লাঙ্গল দেওয়ার কাজে মহিষ বা বলদের ব্যবহার হত এবং তা চালনা করত পুরুষ শ্রমিক। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই কৃষি ক্ষেত্রে শারীরিক শ্রমের সাপেক্ষে পুরুষ শ্রমিকের স্বীকৃতি সবচেয়ে প্রথমে আসত। কিন্তু এখন লাঙ্গল দেওয়ার কাজ ট্রাক্টর বা হারভেস্টার'এর মাধ্যমে করার ফলে কায়িক শ্রমের মাত্রা কমেছে এবং একই ধরনের কাজ নারী ও পুরুষ উভয়ই করছে। তাই এখন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিশেষত পুরুষ শ্রমিকদের চাহিদা কমে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিকের চাহিদা ও স্থানান্তর বাড়ছে। 

একদিকে সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প, অন্যদিকে কৃষি শ্রমিক হিসেবে নারীদের ব্যাপক নিযুক্তি সমাজের নিম্নস্তরে মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ফলত, জন্মহার, খাদ্যাভাস, পোশাক, মনোরঞ্জনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে মহিলাদের পছন্দ প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই, প্রত্যেক বর্ষার শুরুতে এবং শীতের শুরু ও শেষে পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি-নির্ভর এই শ্রমিকেরা মুখিয়ে থাকেন পূবে যাবেন বলে। তাই, সামগ্রিক ভাবেই পূবে যাওয়া এই মানুষগুলোর কাছে চুক্তি ভিত্তিক কর্মপ্রাপ্তি সূর্যোদয়ের মতোই এক ঘটনা যা আরেকদিকে গ্রামীণ গিগ শ্রমিকদের জন্ম দিচ্ছে।


3 comments:

  1. Add more data and analysis
    Number of worker area wise and their economic condition, graphical representation

    ReplyDelete