Friday 5 May 2023

বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বদেশি বোধ

প্রতিবেশী নাগরিকেরা যখন আপনজন

অর্ণব



রোমের ট্রেভি ফাউন্টেইন- ইতালিয়ান ভাষায় ফন্টানা ডি ট্রেভি। দীর্ঘ তিরিশ বছর (১৭৩২-১৭৬২) ধরে নির্মিত। নিকোলা সালভি ছিলেন এর প্রধান নকশা নির্মাতা। ৮৬ ফুট উঁচু ও ১৩১ ফুট ব্যাস যুক্ত ঝর্ণাধারা। এটি ইতালির বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত। এখানে হাজার হাজার পর্যটক জড়ো হয়। একাধিক ফটোগ্রাফার কিছু ফুল সমেত ব্যস্ত পায়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। নব্য প্রেমিক যুগল থেকে শুরু করে বৃদ্ধ দম্পতি এখানে এসে ছবি তোলে, পরস্পর পুষ্প অর্পণের ছবি । ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে সুপ্রশস্ত ফন্টানা ডি ট্রেভি। 

ভদ্র পরিশীলিত মার্জিত লোকজনের ভিড়ে কোথাও বুঝি ছন্দ পতনের শব্দ। বয়স্ক এক দম্পতির অনুমতি ছাড়াই এক ফটোগ্রাফার তাদের হাতে ফুল ধরিয়ে ছবি তুলে এবার টাকা চাইছে। 

'আমি তো ছবি তুলতে বলিনি। তুমি কেন তুললে?' দম্পতির যুক্তি। 

'এখানে সবাই এই ছবি তুলে নিয়ে যায়। এটাই রেওয়াজ।' ফটোগ্রাফারের আত্মপক্ষ সমর্থন।

আসলে অতিরিক্ত সমস্যা হল ভাষা সমস্যা। কে বুঝবে কার কথা। বেগতিক বুঝে আমি দোভাষী হিসেবে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে গেলাম। এই সুযোগে বলে রাখি, আমি ইউরোপিয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে এসেছি। তদুপরি ফটোগ্রাফার-কাম-ফুল বিক্রেতাকে নির্ভেজাল বাঙাল বলেই বুঝতে পারলাম। আর ওই দম্পতি ডাচ। ডাচ ভাষায় আমি মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারি। হল্যান্ডে গ্রনিংগেন ইউনিভার্সিটিতে আমি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি। আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম, ডাচ ভাষায় ওই দম্পতিকে থামতে বলে আমি যেই বাঙাল উচ্চারণে ফটোগ্রাফারকে সম্বোধন করলাম, 'ভাইডি, ব্যবসা করতে আইছেন, মাথা খান ঠান্ডা রাখোন লাগব তো?' ব্যাস, ধাঁআআ। ফটোগ্রাফার পয়সা কড়ি না নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ল। আমি আমার স্বজন কাঠবাঙাল পেয়ে কোথায় একটু মনের সুখে গল্প করে নেব, সেই সুযোগ হাতছাড়া। 

'ভাইডি, শোনেন শোনেন খাড়ান, আমি আপনের স্বজাতি, বাঙাল, দ্যাশ ফরিদপুর।' ভাইডি আর ত্রিসীমানায় নাই। এই ঘটনা কাঁটার মতো ফুটতে থাকল। প্রবাসে দৈবের বশে স্বভাষী মেলে। সে কেন আমাকে দেখে মুখ ফেরালো! বলা যায়, পালিয়ে বাঁচল। এই অপমান হজম করা সহজ নয়। 

বিদেশে থাকলে বন্ধু'র ধারণা পাল্টে যায়। 'বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা' কথাটার যথার্থ উপলব্ধি বিদেশেই সম্ভব। সেই সাথে দ্বিতীয় সত্য জানা 'বিনা স্বদেশী খানা মন ভরে না'। তবে স্বদেশি শব্দটি আর আক্ষরিক থাকে না। বাঙালির দেখা মিললে সর্বোত্তম। হিন্দি ভাষী, পাঞ্জাবী এমনকি পাকিস্তানিকেও মনে হয় স্বদেশি। ভাষায় ও খাদ্যে নিকটজন। বাংলাদেশ হলে তো কথাই নেই। গ্যাটিংগেনে পড়তে এসে আমার এমনই নিকটজন পাকিস্তানি স্বজন মোস্তাক আফ্রিদি। ওর সাথে আলাপ হবার আগে জাতি হিসেবে আফ্রিদি ইউসুফজাই নাম শুনেছি মাত্র। যোদ্ধা জাতি। ও হ্যাঁ, শাহিদ আফ্রিদির নামও শুনেছি ক্রিকেটার হিসেবে। 

মোস্তাককে দেখে যোদ্ধা জাতি হাসবে। সুন্দর লম্বা ছিপছিপে গড়ন। একটা পিঁপড়ে মারতেও কষ্ট পায়। বলে, আমি তো স্রষ্টা নই, আল্লাহ হলেন স্রষ্টা। তাহলে আমার কোনও অধিকার নেই কোনও সৃষ্টি বিনাশ করার। 'কিসিকো কোই হক নেহি এক ভি জানকো ছিন লেনে কা'- যোদ্ধা জাতি এ কথা শুনলে হাসবে না? 

'সব আফ্রিদি ক্রিকেট খেলবে, আফ্রিদি হলেই যুদ্ধ করবে এরকমই তোমরা ভাবো, তাই না?' মোস্তাক বলে আর হাসে। ওর কাছে শুনলাম কত কথা। আইয়ুব আফ্রিদি- মাদক সম্রাট ও আফগানিস্তান হেরোইন ব‍্যবসার প্রতিষ্ঠাতা আন্ডারওয়ার্ল্ড বস্। রিয়াজ আফ্রিদি- পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার; এছাড়াও উমর গুল, শাহিদ আফ্রিদির নাম সকলের জানা। এগুলোর সাথে আফ্রিদি মানানসই, তাই না? 

এরপর মোস্তাক শোনাল কবি খাতির আফ্রিদির নাম। অসংখ্য প্রেমের কবিতার স্রষ্টা। দশ বছর টিবি রোগে ভুগে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। পাশতুন কবি, পাশতুন ভাষায় গজলের স্রষ্টা।

'যে মানুষটা কথার ছলে

মান অভিমান জেনে নিত রোজ। 

তাকে কখনও যায় না ভোলা

হারিয়ে সাকিন আজ সে নিখোঁজ।'

আমি এই দুটি পঙক্তি শুনে অভিভূত। এ তো নিছক প্রেমের কাব্য নয়। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে উপেক্ষিত সেই চরিত্র, যার একমাত্র সমব্যথী বাল্যবিধবা ঠাকুমার মৃত্যু যন্ত্রণা। বুঝি বা ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর পর দুর্গার এমনই সকরুণ আর্তি। মন ছুঁয়ে গেল। শুনলাম এমনই প্রেমের কবিতা কিন্তু বিষাদময় আরও দুই পঙক্তি -

'ভেবে বলো দেখি, 

আমি এই দুনিয়ায়

যদি কোনওখানে না থাকি

কার কিবা আসে যায়?' 


সময় সুযোগ পেলেই মোস্তাক খাতির'এর কবিতা শোনাতো। খাতির একটি স্কুলে বাগানের মালির কাজ করতেন। কোনওদিন স্কুলে পড়াশোনা করেননি। প্রথম জীবনে কিছু অসাধারণ গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এরপরে তিনি 'পোয়েট্রি সোসাইটি'র সদস্য হয়ে হামজা শিনোয়ারি ও নাজির শিনোয়ারির সাহচর্যে আসেন। এরা দুজনেই পাশতুন কবিতার প্রাণপুরুষ। এরপর খাতির আফ্রিদি অসংখ্য স্মরণীয় গজল রচনা করেন। হামজা শিনোয়ারি তাঁর গজলের পরম ভক্ত ছিলেন। কবির একমাত্র সন্তান ও এক সম্পর্কিত ভাই তাঁর দুর্লভ সৃষ্টি একত্রিত করে সংকলিত করেন। 

মোস্তাকের সাথে বন্ধুত্বের শুরুটাও তো কম আকর্ষণীয় নয়। সেটা ছিল ২০১২ সাল। হঠাৎই মোস্তাক আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, 'আরে ইয়ার, ইঁয়হা তো জার্মানি মে কোই কিরকেট নেহি পহচানতা, কোই তো চাহিয়ে দিল কি বাত শেয়ার করনা। টুডে সিক্সটিনথ্ মার্চ ! ঢাকা মে এশিয়া কাপ কা বড়িয়া ধামাকা, আজ তেন্ডুলকর কা হান্ড্রেডথ সেঞ্চুরি করনে কা গ্রেট মওকা! বইঠ না ইয়ার ইধর, থোরি সি বাত কর না শেয়ার।' আমি বিস্ময়ে হতবাক। আমি মনেই রাখি না শচীন তেন্ডুলকর বা ভারতীয় ক্রিকেটের খবর। আর খোদ পাকিস্তানি সে খবর রাখে। এটাই ছিল হৃদ্যতার শুরুয়াৎ। এরপর মাঝে মাঝেই আমাদের বাটি চালাচালি চলত। আমার রান্না ওর কাছে স্বদেশি, ওর রান্নাও আমার কাছে ঘরোয়া। খাদ্যে, ভাষায়, ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতা বেড়ে চলল। 

ইউনিভার্সিটি প্রায় মাসখানেক ছুটি। অতএব, কোনও 'দ্বিধা' অথবা 'কিন্তু' কিংবা 'যদি' ঝেড়ে ফেলে আমি আমার X-Calibre 8 বাইসাইকেল নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লাম। মোস্তাক বলল, 'আরে দোস্ত, হামে ভি সাথ বুলা লে, হাম ভি হ্যায় আকেলে। দেশওয়ালী নেহি, পড়োশী তো হ্যায় জরুর।' সঙ্গী জুটে গেল। দুজনেই দুটি বাইসাইকেল চেপে ইউরোপ ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লাম। এই সুদীর্ঘ সময়ে কত না অন্তরঙ্গতা, ভাব-ভাবনার বিনিময়। 

প্যারিসে ৮.২ হেক্টর জমিতে বৃটিশ কায়দায় নির্মিত পার্ক মঁসিউ। ছোটদের খেলার সামগ্রী, তার সাথে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ব্রোঞ্জ ও মার্বেল পাথরের মূর্তি বিখ্যাত ভাস্কর নির্মিত, চিনা দূর্গের নকল, করিন্থিয়ান স্তম্ভের নকল, ডাচ উইন্ডমিলের নকল ইত্যাদি নানাবিধ সুদৃশ্য উপকরণে পার্কটি সুসজ্জিত। সেখানে অ্যামব্রোস থমাসের মূর্তির পাদদেশে শ্বেত শুভ্র জ্যোৎস্নালোকে মোস্তাক আর আমার বিনিদ্র রজনী আড্ডা। এই অ্যামব্রোস থমাস ছিলেন কনজারভেটরি ডি প্যারিস'এর মিউজিকের ছাত্র। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ মিউজিক পুরস্কার প্রিঁ ডি রোম লাভ করেন। ১৮৩৭ সালে তিনি তার প্রথম অপেরা কম্পোজ করেন La double échelle- এই স্মরণীয় মুহূর্তে আমরা পাশাপাশি শুয়ে দুই প্রতিবেশী শত্রু দেশের যুবক। মোস্তাক বলে, তোমার দেশের মানুষ ভাবে পাকিস্তানের মানুষ রাঁধে না, খায় না, ঘুমায় না। ভারতের দিকে বন্দুক তাক করে বসে থাকে। তারা হাসে না, কাঁদে না, ভালোবাসে না, কেবলই জেহাদি উল্লাস করে। আমাদের দেশেও ভারত সম্পর্কে এমনই কথা ভাবে। বলা ভালো, ভাবানো হয়। বিদেশে এসে আমাদের দুজনেরই পছন্দ বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। অথচ বাংলাদেশ হল পাকিস্তানের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। 

গোটা ছুটি চড়কি পাক খেয়েছিলাম ইউরোপের আনাচকানাচ, দিবারাত্রি নিদ্রাহীন। পরম বিস্ময় আর আনন্দ ফূর্তি অপার। তবু কী এক অভাববোধ হয়। কীসের অভাবে সব বিস্বাদ রসহীন মরুময়। দিন কয় পরে, ভাবনা চিন্তা না করেই ভুলক্রমে রোমে ঢুকে গিয়েছি- এরপর মিনেপলিস, মিনেসোটায় একটি রেস্তরাঁয়, নাম দেখে নয়, ঢুকেছি খিদের জ্বালায়। খাবারের স্বাদ, ওয়েটার ম্যানেজারের চেনা ভাষা যত্ন আহ্লাদ বুঝিয়ে দিল এতদিন কোথায় বিস্বাদ ছিল। মিনেপলিস বোধ হল ওয়েসিস। বেরিয়ে দেখি নাম লেখা- শেফ তৌসিফ মেহমুদ 'পাক ইন্ডিয়ান ফুড'। এরপর আর ভুলক্রমে নয়, খুঁজে নিতাম ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানি, একই দেশি ঘরানা।

সেই পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি ফটোগ্রাফারের কথা মনে থেকেই গিয়েছিল। পরে জেনেছি, ইতালিতে সাধারণ বাংলাদেশি মানে জীবিকা সন্ধানীরা সাধারণত লিবিয়া হয়ে ইতালি ঢুকে থাকে। আইনি ও বেআইনি অনুপ্রবেশ এ পথেই ঘটে। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া একটি দালাল চক্র সক্রিয়। বেকার বাংলাদেশি যুবক মোটা টাকা দিয়ে ভাগ্যের দরজা খুলতে চায়। প্রশ্ন হল, লিবিয়া কেন? লিবিয়া ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির উপনিবেশ ছিল। ভূখণ্ডটি আগে অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। ১৯১১'এর পরে ইতালো-তুর্কি যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে তুরস্ক ইতালিকে দুটি অঞ্চল ছেড়ে দেয়। ফলে, ইতালির দুটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল: ইতালিয় ত্রিপলিটানিয়া এবং ইতালিয় সেরেনাইকা। ১৯৩৪ সালে এই দুটি একটি উপনিবেশে একীভূত হয়েছিল: ইতালিয়ান লিবিয়া। ইতালি-লিবিয়া যাতায়াত অনেক পুরনো। 

যারা এখানে কাজ খুঁজে পায়- হোটেল-রেস্তোরাঁ, ট্যুরিস্ট স্পটে ব্যবসা, ফেরি করা, সেলুন পার্লারে, এরা যা উপার্জন করে তা ভারত বাংলাদেশের মুদ্রার সাপেক্ষে অনেক বেশি। এরা ইউরোপে কোনওমতে দিন গুজরান করে অধিকাংশ টাকা বাড়িতে পাঠায়। বাড়িতে বলে, ইউরোপে চাকরি বা ব্যবসা করে। বাড়িতে নিজের বাড়িতে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা জানায় না। এই ছেলেটি যখন কোনও স্বদেশি স্বভাষীকে দেখতে পায়, আতঙ্কিত ও আশঙ্কিত হয়। যদি চেনাজানা সূত্র প্রকাশ পায়। দেশের বাড়িতে ও অঞ্চলে মানুষ যদি তার সত্য জীবিকা জেনে ফেলে! একটা ভয়। 

গণতান্ত্রিক ইউরোপে কর্ম বা জীবিকা নির্বাহের কৌলীন্য বিচার হয় না। তাই কত সহজেই আইনজীবী পিতা সন্তানের মাছের দোকান দেখাতে পারে। কিন্তু ইউরোপের উপনিবেশে শাসক-প্রভুর বাহ্যিক আধুনিকতা সমাদৃত হয়েছে। প্রভুর আদব কায়দা, ঠাটবাট, চালচলন পূজিত হয়েছে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষকের আত্মপরিচয় এবং বিদেশের মাটিতে ফুটপাতের হকার, রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের 'আত্মপরিচয়ে অনেক ফারাক'। স্বভাষী বা স্বজাতি হলেও আমার পরিচয় তাই 'ভাইডি'র চোখে অন্য, অপর।

অনুলিখন: মালবিকা মিত্র।


No comments:

Post a Comment