Wednesday 16 November 2022

ক্রিপ্টোমুদ্রার বাজারে ধস?

আরও বহু পথ বাকী

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 



অতি সম্প্রতি, বাহামায় অবস্থিত FTX নামে একটি ক্রিপ্টোমুদ্রা এক্সচেঞ্জ প্রায়-দেউলিয়া হয়ে গেছে। এ নিয়ে শুধুমাত্র ক্রিপ্টো বাজার নয়, সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক দুনিয়া সরগরম। ক্রিপ্টো ব্যবস্থার যারা ঘোর বিরোধী, তারা এবার খুব সোচ্চার হয়েছেন এই দাবিতে যে, অবিলম্বে হাইপার-আচরণে সিদ্ধ ক্রিপ্টো ব্যবস্থাপনাকে কঠিন নিয়ন্ত্রণের অধীন নিয়ে আসাটাই সমীচীন।

ঘটনাটা কী?

২০১৯ সালে বাহামায় প্রতিষ্ঠিত FTX হল বিশ্বের চতুর্থ সর্ববৃহৎ ক্রিপ্টোমুদ্রার এক্সচেঞ্জ। মাত্র তিন বছরেই এর বাজার মূল্য খুব দ্রুত বেড়ে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল। এই এক্সচেঞ্জ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ লক্ষ ছাপিয়ে যায় এবং গত বছর এরা লেনদেনের উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছে ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্য করে। এ হেন দানব-সম একটি সংস্থা, যা আবার ক্রিপ্টো-ভিত্তিক, তা গত ১০-১১ নভেম্বর একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। কেউ কেউ এই ঘটনাকে অভিহিত করেন ‘লেহম্যান ব্রাদার্স মুহূর্ত’ বলে (২০০৮ সালের সাব-প্রাইম সংকটে লেহম্যান ব্রাদার্স’এর মতো সুবৃহৎ সংস্থা এইভাবেই আচম্বিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল)। FTX’এর প্রধান ৩০ বছর বয়সী স্যাম ব্যাঙ্কমেন ফ্রিড (সংক্ষেপে যাকে ‘এসবিএফ’ নামে সম্বোধন করা হয়) পদত্যাগ করেছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার রাজ্যে FTX দেউলিয়া হিসেবে ঘোষিত হওয়ার জন্য পিটিশন জমা করেছে। আশ্চর্যের কথা, বাহামায় অবস্থিত একটি সংস্থা আমেরিকায় গিয়ে ‘দেউলিয়া পিটিশন’ জমা করছে।

হঠাৎ এই পতন কেন? তাহলে কি ক্রিপ্টো মুদ্রার ‘ফানুস’টাই আসলে ফেটে গেল? ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেন ও তার মূল্য নির্ধারণ আসলে যে এক ‘ফাটকা কারবার’, সেই কথাই কি অতএব সাব্যস্ত হল? এমনতর কথাও কেউ কেউ বলছেন।

কিন্তু তথ্য কী বলছে?

এসবিএফ’এর একদা বাণিজ্য-দোসর, বর্তমানে বিনান্স কোম্পানির (আরও একটি ক্রিপ্টো-এক্সচেঞ্জ ও FTX’এর কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বী) প্রধান চ্যাংপেঙ ঝাও (সংক্ষেপে যাকে ‘সিঝি’ নামে সম্বোধন করা হয়) কিছু মাস আগে FTX’কে অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। সে প্রস্তাব FTX’এর তরফে গৃহীত হয়। সিঝি’র দল অধিগ্রহণের প্রাক-প্রস্তুতিতে তাদের লেনদেন ও বুক অফ অ্যাকাউন্টস পরীক্ষা করতে গিয়ে ক্রেতাদের তহবিলে বেশ কিছু গণ্ডগোলের হদিশ পায় এবং আপাত ভাবে অধিগ্রহণের পদক্ষেপ থেকে পিছু হটে। এ নিয়ে দু’ পক্ষের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। এছাড়া আরও একটি বিষয়ে এসবিএফ ও সিঝি’র মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে এসবিএফ অনেক দিন ধরেই সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও বাণিজ্যপতিদের সঙ্গে মাখামাখি করছিলেন। এবার তিনি ওয়াশিংটনে লবি করা শুরু করলেন যাতে ক্রিপ্টোমুদ্রাকে বেশি বেশি করে মার্কিন নিয়ন্ত্রাধীন ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা যায়। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটনের ওপর মহলে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে নানারকম বিরুদ্ধাচরণ করাও শুরু করলেন। স্বভাবতই, এইসব কারণে সিঝি এসবিএফ’এর ওপর এবার শুধু ক্ষেপে গেলেন না, জোর এক ধাক্কা দিয়ে সবক শেখানোরও উপায় ভাবলেন। যেহেতু এসবিএফ ও সিঝি এক সময়ের বাণিজ্য দোস্ত, তাই FTT বলে একটি ক্রিপ্টোমুদ্রার ওপর তাদের দুজনেরই দায় ও স্বত্ব ছিল। অধিগ্রহণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে এবার সিঝি প্রায় ৫৩ কোটি ডলার মূল্যের FTT হঠাৎ করে বিক্রি করে দিলেন। ফলে, আচম্বিতে FTT’র মূল্যে ধস নামল। আর এর প্রকোপ গিয়ে পড়ল FTX’এর ওপর। এবার চোটটা হল দ্বিঘাতী: আগেই, FTX’এর ক্রেতা তহবিলে যে বড়সড় গরমিল আছে তা বিনিয়োগকারীদের রীতিমতো শঙ্কিত করেছিল; পরে, FTT’এর মূল্য অবনমনে FTX থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা শুরু হল। গত ১৪ নভেম্বরের মধ্যে FTX থেকে ৬৫ কোটি ডলার প্রত্যাহৃত হয়ে গেল।

অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে, এই ধসের পিছনে যত না স্বতোৎসারিত বাজারের ভূমিকা ছিল, তার থেকেও দুই বাণিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর শোধবোধের অভিঘাত অনেক বেশি কার্যকরী হয়েছে। বিনান্স হল সিঝি নির্মিত বিশ্বে ক্রিপ্টোমুদ্রা এক্সচেঞ্জের সব থেকে বড় কোম্পানি। ২০১৭ সালে কেম্যান দ্বীপে এর নথিভুক্তিকরণ হয়। পাশাপাশি, FTX ক্রিপ্টোমুদ্রা এক্সচেঞ্জের জগতে তরতরিয়ে উঠে আসছিল। বিনান্স’এর সঙ্গে তাদের সদ্ভাব ভেঙ্গে যাওয়ায় হয়তো আজকের এই পরিণতি। কিন্তু মূল প্রশ্নটা সেখানে নয়। মূল প্রশ্ন হল, FTX’এর এই ধসের ফলে ক্রেতাদের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার যে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে, তা কি কোনওভাবে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে? না, নেই। এই পরিণতি দেখে তাই অনেকেই এখন বলছেন যে, ক্রিপ্টোমুদ্রা এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ন্ত্রণ-বিধি আরোপ করা আবশ্যিক। তা যদি হয়, ক্রিপ্টো দুনিয়া ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির যে অভাবনীয় মুক্ত পরিসরের কথা সগৌরবে বলা হয়ে থাকে, সেই প্রাসঙ্গিকতা কি মলিন হয়ে যাবে না? হয়তো, এ কথার সরাসরি উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি।

FTX বিপর্যয়ের পর সিঝি বলেছেন, এমনতর একটি বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থায় কোনও এক শরিক হয়তো তলিয়ে যাবে, বিপ্রতীপে অন্য কোনও শরিক উঠে আসবে। কিন্তু, এর ফলে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীর যে তুমুল আর্থিক বিপর্যয় হতে পারে, তার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে! এটাই বাস্তবতা। কারণ, ক্রিপ্টোমুদ্রার যে এক্সচেঞ্জগুলি গড়ে উঠছে, তা ব্লকচেইন প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থাপনাকে কার্যত নস্যাৎ করে কেন্দ্রীকৃত সংস্থায় পরিণতি পাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা বিচ্যুতি। ক্রিপ্টোমুদ্রাকে সুরক্ষিত থাকতে হলে কেন্দ্রীকৃত সংস্থা নয়, অযূত বিকেন্দ্রীকৃত ‘silos’ (বা আধার) গড়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এক বড় সংখ্যক ক্রিপ্টোমুদ্রা ব্যবহারকারীদের মধ্যে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার লালসা ক্রিপ্টোমুদ্রার চালচলনে বিপদ ডেকে আনছে। যথা, FTX’এর লেনদেনে নানারকম গোলমালও তার পতনের এক অন্যতম প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। অর্থাৎ, লোভ, লালসা ও ক্রিপ্টোমুদ্রার বিকৃত ব্যবহার কোনও কোনও ক্রিপ্টো দুনিয়ার পরিসরে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে, কিন্তু তার মৌলিক বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোর জন্য সে বিপজ্জনক ক্ষতি সামগ্রিক ভাবে ক্রিপ্টো দুনিয়াকে অচল করে দিতে একেবারেই অক্ষম।

অতএব, ক্রিপ্টোমুদ্রার চালচলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে এবার বিতর্ক শুরু হবে বলে অনুমান। মূলত, ২০০৮ সালের সাব-প্রাইম সংকটের কালে রাষ্ট্র ও বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার থেকে মুক্ত হয়ে এক সমান্তরাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ-ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করতেই ক্রিপ্টোমুদ্রা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির উদ্ভব। এই নতুন ব্যবস্থার জোরের জায়গাটাই ছিল নিয়ন্ত্রণহীন এমন এক বিকেন্দ্রীকৃত আঙ্গিক যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতারা আস্থা ও সুরক্ষার ওপরে ভিত্তি করে মোটামুটি এক সম-পাটাতনে দাঁড়িয়ে বিনিময়ের এক শৃঙ্খল গড়ে তুলতে পারে। যখন দেখা গেল, অতি জনপ্রিয় এই ব্যবস্থায় বহু মানুষ ও সংস্থা একেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় গড়ে তুলে (যেমন ক্রিপ্টোমুদ্রা এক্সচেঞ্জ) প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠে এক কেন্দ্রীকৃত নির্ভরতার বাতাবরণ তৈরি করে ফেলছে, তখনই এর মধ্যে বিপদের সম্ভাবনাও পাওয়া গেল। ক্রিপ্টো স্ক্যাম এখন তাই নতুন এক শব্দবন্ধ। পাশাপাশি, ক্রিপ্টোর বাইরে যে চলমান বৃহৎ পুঁজিবাদী দুনিয়া, সেখানকার প্রবণতাগুলিও ক্রিপ্টোমুদ্রার বাজারে প্রভাব ফেলছে। যেমন, সম্প্রতি সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বহু বিনিয়োগকারী ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিপ্টোমুদ্রার জগৎ থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিরাপদ আস্তানায় ফিরে আসছে। অর্থাৎ, সবটা মিলিয়ে আমরা এখনও এক পর্বান্তরের মধ্যে রয়েছি, যেখানে ক্রিপ্টোমুদ্রার দুনিয়াকে আরও বহু পথ পেরিয়ে, বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তবে এক আপেক্ষিক সুস্থির চিত্রে দেখা যাবে।

তাই, আমাদের আরও বহু কিছু দেখার আছে। এমনটা নয় যে, FTX’এর ধস দেখে ক্রিপ্টোমুদ্রা থেকে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নেবে। statista.com’এর তথ্য বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিপ্টোমুদ্রা ক্ষেত্র থেকে আয় ২০২২ সালের মধ্যে ৩৪.৭২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। অন্য একটি তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে বিশ্বে ক্রিপ্টোমুদ্রা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে; আমেরিকায় ক্রিপ্টোমুদ্রা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪.৬ কোটি যা সে দেশের জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। আগেও বলেছি, আবারও বলতে দ্বিধা নেই- ওয়েব ২.০ থেকে ওয়েব ৩.০ জমানায় উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোমুদ্রা এক নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির সূত্রপাত করেছে যার সামগ্রিক ফলাফলকে অবলোকন করতে হলে আমাদের আরও কিছু বছর অপেক্ষা করতে হবে।  

 

No comments:

Post a Comment