Tuesday 1 February 2022

একটি অন্তর্ঘাতী বাজেট

‘তুমি নেই আমি নেই, কেউ নেই কেউ নেই’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


বহু দিনের অভ্যেস খানিক মন দিয়ে বাজেট শোনা। যেন, আগামী এক বছরে অর্থনীতির চলার পথটি কিঞ্চিৎ আগাম ভেসে ওঠে মনে। একেবারে কান খাড়া করে শুনি। এবারে মাঝপথে ঘুম পেল। অথচ এই অর্থমন্ত্রীর বাজেটই গত চার বছর ধরে শুনছি; কই আগে তো ঘুম পায়নি? চোখ-টোখ কচলে সবটা শোনার পর একদম শেষে কেন জানি মনটা গুন গুন করে উঠল: ‘হরি, দিন তো গেল/ সন্ধ্যা হল…’। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখলাম খুব ব্যাজার মুখ করে বসে আছেন। উত্তরপ্রদেশে হিন্দু মেরুকরণের আস্ফালন মোটে কাজে দিচ্ছে না। অতএব, অর্থমন্ত্রী কী পড়লেন আর সব শেষে কী দাঁড়াল, সম্ভবত তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী নামকরণে ওস্তাদ। কতশত নাম আমরা পেয়েছি- ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্ট্যান্ড-আপ ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্টআপ ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণের গোড়াতেই তাই আরেক নতুন নাম শোনালেন: প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি। সেটি কী? না, সাতটি ইঞ্জিনে সওয়ার হওয়া এমন এক পরিকাঠামো-পরিকল্পনা যা নাকি আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে! এতদিন ওনাদের ‘ডবল ইঞ্জিন’ শুনেছি, বছরে ২ কোটি চাকরির গুলগাপ্পাও উপভোগ করেছি, কিন্তু একেবারে সাতটি ঘোড়ায় চড়ে সপ্ত সাগর পার? মনে পড়ল সুকুমার রায়কে:

 ‘একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত।তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।’

সে যাক গে।

অর্থমন্ত্রী শুরু করলেন মহামারি আক্রান্ত মধ্যবিত্ত ও অন্যান্য দুর্বল শ্রেণিগুলিকে ভরসা ও সুবিধা জোগানোর কথা বলে। সাতকাণ্ড রামায়ণ শেষে বাজেট ভাষণে মূলত পেলাম:

        বেসরকারি বিনিয়োগকে সহায়তা দিতে সরকারি বিনিয়োগের আশ্বাস;

        ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ঘোষণা;

        SEZ’এর রকমফের;

        নীলাচল ইস্পাত নিগম, এলআইসি ও আরও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ;

        কর্পোরেট সারচার্জ ১২ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা;

        ৫জি স্পেকট্রামের নিলাম ঘোষণার প্রতিশ্রুতি;

        সরকারের মূলধন খরচকে ৩৫.৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা;

        এবং

        ব্যক্তিগত আয়করে কোনও পরিত্রাণ না দেওয়া;

        জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে কোনও ব্যয় বৃদ্ধি না করা;

মোদ্দা কথায়, করে খাও গে যাও। এমনকি কৃষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি পালনেরও কোনও ঘোষণা নেই। অর্থাৎ, ধ্বস্ত অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির কোনও পরিকল্পনা নেই, অথচ ঝাঁপি উপুড় করে কর্পোরেট ক্ষেত্রের হাতে দেশের মূল্যবান সম্পদ ও সরকারি কোষাগার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা। এমন নির্লজ্জ ও নগ্ন বাজেট স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এই প্রথম।  

অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দ্বারা ব্লকচেইন প্রযুক্তি নির্ভর ‘ডিজিটাল টাকা’ প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু ডিজিটাল সম্পদের লেনদেনের ওপর ৩০ শতাংশ কর ধার্য করেছেন। কী আশ্চর্য স্ববিরোধ! তিনি যে ব্লকচেইন প্রযুক্তির অন্তর্জগৎ’কে জানেনই না। দুর্ভাগ্য, কেউ তাঁকে এ বিষয়ে ব্রিফ করেননি। কারণ, ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি’র যে লেনদেন হয় তা যতক্ষণ না আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় টাকায় রূপান্তরিত হয়ে জমা পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নাগাল পেতে কর ব্যবস্থা অক্ষম। একমাত্র ছোট বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষ, যারা ব্লকচেইনে ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে পণ্য ক্রয় করছেন বা তার লেনদেনে নিযুক্ত, তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তা টাকায় রূপান্তরিত করে নিজেদের দৈনিক সংসার চালাতে হয়। এইসব মানুষদের অর্জিত অর্থের ওপরেই ৩০ শতাংশ করের আঘাতটা পড়বে। অর্থমন্ত্রী কি জানেন না যে গত এক-দু বছরে আমাদের দেশে ছোট বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বহু গুন বেড়ে এখন ৩ কোটির কাছাকাছি। এঁরাই এখন মূলত শেয়ার বাজারের কারিগর। অথচ, যারা আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়, বড় বিনিয়োগকারী, তাঁরা কিন্তু ৩০ শতাংশ কর এড়াতে ভারতীয় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় ক্রিপ্টোকারেন্সি’কে রূপান্তর করবেন না, বিদেশের ব্যাঙ্কে জমা করবেন যেখানে করের হার সামান্য অথবা একেবারেই নেই।

অর্থমন্ত্রী আরও একটি শব্দ চয়ন করেছেন: blended finance। এ ভারী মজার। যেখানে সরকারি অর্থ ও সম্পদ কর্পোরেটওয়ালাদের অর্থ ও সম্পদের সঙ্গে blended হয়ে এমন খিচুড়ি হবে যে ‘তুমি নেই আমি নেই, কেউ নেই কেউ নেই’, ওড়ে শুধু মোদি-শাহ আদানি-আম্বানি।

এমনিতে বাজেট নিয়ে বেশি কিছু বলার থাকে না। কারণ, তা আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব মাত্র, যা আবার সারা বছর ধরে বদলে বদলে যায়। এবারে কিছু বলতেই হল। কারণ, খুব গায়ে লেগেছে। কয়েকটি লোক দেশ দখল করছে মিথ্যা ও পেশির জোরে।

প্রতিরোধ করুন।  

6 comments:

  1. কি হবে মন্তব্য করে? প্রতিরোধের রাস্তা কি সাধারণ মানুষের কাছে?

    ReplyDelete
  2. বাজেট যা হয়েছে, সেটার নির্যাস পেলাম।

    ReplyDelete
  3. সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিরোধী বাজেট ৷ শিল্পপতি ও
    ধনিক শ্রেণীদের স্বার্থে সরকারী বাজেট রূপায়িত হয়েছে ৷ সারা ভারতবর্ষে ভোট বাকেস তার প্রতিফলন হচ্ছে না কেন?

    ReplyDelete
  4. অনর্থ মন্ত্রী অর্থহীন বাজেট। জনগণের মাথায় হাত।

    ReplyDelete
  5. নিম্ন মেধার সরকারের জনগণ বিমুখ দলিল।

    ReplyDelete
  6. দেশের মানুষ যখন এদের ভোট দিয়েছে (বিশেষ করে পাঁচ বছর দেখার পরেও) কর্মফলও ভোগ করতে হবে।

    ReplyDelete