Friday 24 December 2021

পরিবর্তিত সময়

মহানগরের পৌরসভার গল্প

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

গত ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের দিন যখন বেলা করে ভোট দিতে যাচ্ছি, পথে একটি চায়ের দোকানে সিপিএমের বর্ষীয়ান এক সমর্থক (এক সময়ে কিছুটা সক্রিয়) এমন দুটি কথা বললেন যা আমাকে চিন্তার খোরাক জোগাল।

কথা ১: ‘আমরা জার্সি বদল করি না। যে দলকে ভোট দিয়েছি সেই দলকেই ভোট দেব, সে হারুক বা জিতুক।’

 

কথা ২: ‘মধ্যবিত্তদের জন্য কোনও পার্টি নেই। (ক্ষমতাসীন পার্টিগুলি) হয় গরিবকে দ্যাখে, নয়তো বড়লোকদের।’

হরে দরে প্রথম কথাটি আমি সম্প্রতি আরও দু-একজন সিপিএম সমর্থকের মুখে শুনেছি। এতে করে আমার ধারণা হচ্ছিল, সিপিএম কর্মী ও সমর্থকদের যে ভোটগুলি গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি’র বাক্সে পড়ছিল, তার একটা কমবেশি অংশ এবার যাতে সিপিএমের ঝুলিতে ফিরে আসে সে জন্য পার্টি থেকে একটা সচেতন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কথায় বলে, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।

দ্বিতীয় কথাটিতে হতাশার সুর। মনে মনে আমি ওই প্রশ্নের একটা উত্তর দিয়েছিলাম। আমার উত্তরটা ছিল এই: বামপন্থী পার্টিগুলিকেই তো আমরা গরিবের পার্টি বলে জানতাম; এখন কি সেই প্রস্তাবে বদল এসেছে! মুখ ফুটে কিছু বলিনি, কারণ, হতাশায় বিদ্ধ মানুষজনকে তাঁদের ভাবনার বিপরীতের কথাগুলি সোজাসাপ্টা বলতে নেই।

কিন্তু পাশাপাশি এও তো দেখলাম, তৃণমূল এ রাজ্যে যখন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি এবং কলকাতা পৌরসভায় অন্তত ১৩০টা আসন পাওয়া তাদের প্রায়-সুনিশ্চিত বলে মিডিয়া থেকে নির্বাচনী-সমীক্ষা সকলেই আস্থার সঙ্গে বলছে (গত বিধানসভা ও উপনির্বাচনগুলির প্রবণতাও তাই), তখন নির্বাচনের দিন তাদের সকাল থেকেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হয় কেন? যখন, এই ধরনের হুজ্জোতিতে জড়িয়ে না পড়ার বার্তা পার্টির শীর্ষমহল থেকে বেশ জোরের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে! এই সন্ত্রাস কয়েকটি মাত্র বুথে হয়েছে নাকি আরও বহু জায়গায় চলেছে- এই তর্কেরও আর কোনও অবকাশ থাকে না যখন শাসকের তরফে দায় ছিল এই ধরনের একটিও ঘটনা না ঘটার। যদি বা সত্যিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েই এমনতর কিছু ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে পার্টির তরফে কি উচিত ছিল না এ ব্যাপারে কড়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করা? তা তো দেখা গেল না। 

এই ব্যাপারটার তত্ত্ব-তল্লাশে পরে আবার আসব, আপাতত একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিতের দিকে তাকানো যাক।

আসলে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জুড়েই রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার ফলে (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল ভুবন, ক্রিপ্টো দুনিয়া ইত্যাদির প্রভাবে) আমাদের দেশের রাজনীতির জগতেও এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার অভিঘাত আমরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছি। এ নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়, কিন্তু এখানে তার অবকাশ কম, তাই দু-একটি মোদ্দা কথা উত্থাপন করব মাত্র।

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, রাজ্যে কিছু চটকল শিল্পে কর্মসংস্থান কেন্দ্র থেকে কয়েকশো মাধ্যমিক অনুত্তীর্ণদের পাঠানো হয়েছিল বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য যেখানে প্রশিক্ষণ শেষে সফল কর্মপ্রার্থীদের চাকরিতে বহাল করার কথা। কিন্তু দেখা গেল, বহু কর্মপ্রার্থীই এই প্রশিক্ষণে যোগ দেননি। ঘটনাটি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য! আমরা জানি, বিশ্ব জুড়ে ও এ দেশেও ‘গ্রেট রেজিগনেশন’এর আবহে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে কাজ ছেড়ে দেবার হিড়িক পড়েছে, যখন মজুরি বৃদ্ধি করেও অনেককে কাজে ফেরানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন, অল্প টাকায় অথবা কাজের নিম্নমানের কারণে বহু মানুষ আর কাজ করতে চাইছেন না। কিন্তু আমরা তো জানি, কর্মের আকালের যুগে পেটের দায়ে মানুষ যে কোনও কাজ করতে চান এবং সামান্য মজুরিতেও তাঁরা রাজী হয়ে যান। কিন্তু কী এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে মানুষ কাজ ছেড়ে পালাচ্ছে অথবা বহু কাজই গ্রহণ করতে রাজী হচ্ছে না! তাহলে কি কাজের জোগান এখন কাজের চাহিদা থেকে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই প্রশ্ন নিয়ে সকলেই মাথা চুলকোচ্ছেন।

বাস্তবতা হল, ডিজিটাল ভুবনের অসীম প্রসারে এমন এক পরিবর্তনশীল কাজের জগৎ গড়ে উঠছে যেখানে মানুষের সামনে নানাবিধ দুয়ার খুলে যাচ্ছে। এর সত্যাসত্য নিয়ে আমাদের দেশে এখনও তেমন সমীক্ষা হয়নি বটে কিন্তু আমরা যে এক গভীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছি সে ব্যাপারে কোনও সংশয় রাখার অবকাশ আর নেই। সে আলোচনা আমি নানা জায়গায় করেছি, আবারও অন্যত্র করা যাবে। আপাতত বলার কথা এই যে, এই স্বতঃস্ফূর্ত আঙ্গিকগত পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক পরিসরে এক প্যারাডাইম শিফট হতে চলেছে। তা হল, রাজনৈতিক দলগুলির ওপর মানুষের যে বাধ্যত নিত্য নির্ভরশীলতা তার অবসান হয়ে চলেছে। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলির চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত এবং অন্যদিকে উদ্ভুত গিগ অর্থনীতি নানা ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ (যদিও তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্থায়ী ও স্বল্প চরিত্রের) তৈরি করে চলেছে যার হদিশ আজকের তরুণ-তরুণীরা বেশ ভালমতো ধরে ফেলেছে। বরং, এই অযূত ধরনের অস্থায়ী কাজগুলির জন্যই কর্মরত ও কর্মপ্রার্থী মানুষজনেরা দর কষাকষির একটা অবাধ সুযোগও পেয়ে গেছেন। তাঁরাও কোনও একটি কাজে স্থিত হয়ে বেশি দিন থাকতে চাইছেন না, কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে নতুন কাজে বেশি মাইনে বা মজুরিতে ঢুকে পড়ছেন। এছাড়াও কাজের নানারকম আউটসোর্সিং ও বিকেন্দ্রীকরণের কারণে অনেকেই স্বাধীন উদ্যোগপতি (ছোট ছোট) হয়ে উঠেও সফলতা পাচ্ছেন।

এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বোঝা যাবে, কেন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি আজ মতাদর্শের প্রশ্নটিকে সরিয়ে রেখে অনেক বেশি পরিমাণে সর্বজনগ্রাহ্য ‘কর্মসূচি ভিত্তিক’ দল হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ, রাজ্য সরকারই হোক কি পৌরসভা অথবা পঞ্চায়েত- সকলেই কাজের পারদর্শিতা, নব নব প্রকল্প এবং গরিব মানুষের হাতে অর্থ তুলে দেওয়ার কর্মসূচি রূপায়ণেই এক ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। একটি প্রাচীনপন্থী মতাদর্শগত দল হিসেবে বিজেপিও এই আবহটিকে আর অস্বীকার করতে পারছে না। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলন ও তার সামনে কেন্দ্রীয় সরকারের নতজানু হয়ে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া এই প্রখর আবহের দিকেই ইঙ্গিত করছে। যদিও তারা এখনও তাদের সাবেক হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে পুরোপুরি সরিয়ে রাখতে পারেনি। মনে হয়, এ কারণেই তাদের পতন আরও ত্বরান্বিত হবে। এই পরিবর্তনের তোড় এত তীব্র যে, ২০১৪ সালের কথা বাদই দিলাম, এমনকি ২০১৯ সালের থেকেও আমরা বহু দূর এগিয়ে চলে এসেছি।

তাই, এবারের কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে মূল এজেন্ডা ছিল পরিষেবাগত কর্মসূচি। আর এ কথা খোলা মনে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, গত এক-দু বছরে কলকাতা পৌরসভার পরিষেবা আগের তুলনায় নানা ভাবে উন্নত হয়েছে, বহু ওয়ার্ডে জনগণের সমস্যাগুলিকে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত, ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানটি মানুষজনকে প্রয়োজনে কাউন্সিলারকে অতিক্রম করে এলাকার সমস্যাগুলিকে শীর্ষ স্তরে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এইভাবে কাজের একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়েছে যার ওপর শহরের অধিকাংশ মানুষ আস্থা রাখতে চেয়েছেন। তার ওপর ‘দুয়ারে সরকার’ এবং ‘পাড়ায় সমাধান’ উদ্যোগে দেখেছি, নিম্নবিত্ত এলাকায় দলে দলে মানুষ এইসব শিবিরে গিয়ে নিজেদের সমস্যাগুলিকে নথিবদ্ধ করেছেন ও বহু ক্ষেত্রে সমাধান পেয়েছেন। সবটা মিলিয়ে এমন একটা আস্থা গড়ে উঠেছে যে, ছোট ছোট কাজগুলি দ্রুত হয়ে যাবে, বড় কাজগুলি ধীরে হলেও হতে শুরু করেছে।

এই যে এলাকার কাউন্সিলরকে অতিক্রম করে মানুষকে পৌরসভার শীর্ষ স্তরে যোগাযোগ গড়ে তুলতে শাসকেরা বাধ্যত অনুমোদন দিয়েছে, তার একটা ব্যুমেরাং হয়ে যাওয়ার ভয় হয়তো অনেকের মনে ছিল। তাই, সব সময় মানুষের মনের হদিশ পেতেও অনেককে হয়তো কালঘাম ছোটাতে হয়েছে। এই উদ্যোগে হয়তো মহানাগরিক অথবা মুখ্যমন্ত্রী বাহবা পেয়েছেন কিন্তু অকর্মণ্য কাউন্সিলররা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত হয়েছেন। হয়তো বা, সেই আশঙ্কা থেকেই জেতার ব্যাপারে ষোলআনা নিশ্চিত হতেই কোনও কোনও অঞ্চলে এবারের কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে হিংসার ঘটনা দেখা গেল।

তবে সবটা মিলিয়ে প্রশ্ন এই- কলকাতার আরও তীব্র সমস্যাগুলি কি যাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় মিলিয়ে গেল? একেবারেই না। কলকাতার বহু অঞ্চলে জল জমার তীব্র সমস্যা এখনও বিদ্যমান। প্রমোটারি বাড়বাড়ন্ত বহু জায়গায় ঘোরতর বাস্তব। তা নিয়ে গোলাগুলি চলাও তেমন বন্ধ হয়নি। জলাভূমি, পুকুর বুজিয়ে বহুতল তুলে ফেলাও কম কিছু ঘটেনি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নটিও সমান সদর্থক। ওয়ার্ড কমিটি গড়ে ওয়ার্ডের কাজকে আরও গণমুখি করার উদ্যোগ এখনও বিশ বাঁও জলে। অবশ্য নতুন বোর্ডের ভাবী মহানাগরিক দুটি প্রাথমিক আশ্বাস দিয়েছেন: এক, কলকাতা পৌরসভার তরফে বছরওয়ারি এবার থেকে রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ পাবে; দুই, প্রায় সমস্ত পরিষেবাকে অনলাইন ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হবে

দেখা যাক।

 

 

1 comment: