Monday 18 October 2021

একটি বইয়ের কথা

ভারতের ভূগোলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

শোভনলাল চক্রবর্তী


দুর্গা পুজোর ছুটিতে হাতে পেলাম একটি আশ্চর্য বই। বইয়ের নাম 'ল্যান্ড অফ দ্য সেভেন রিভারস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়াজ জিওগ্রাফি'। বইটির লেখক সঞ্জীব সান্যাল; পেশায় অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ এবং বর্তমানে ভারত সরকারের অর্থ দফতরের মুখ্য উপদেষ্টাদের অন্যতম। ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে নদীর ভূমিকা বহু আলোচিত। সেই আলোচনায় নিঃসন্দেহে এক নতুন সংযোজন 'ল্যান্ড অফ দ্য সেভেন রিভারস'। 

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। পড়তে বসে আফসোস হচ্ছিল, আরও আগে এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি পড়লাম না কেন! কারণ, ভূপ্রকৃতি, নদী ও জলবায়ুর সঙ্গে এই সভ্যতার আন্তঃসম্পর্ক শুধু ইতিহাস নয়, আরও অনেক কিছু নিয়ে সামগ্রিক আলোচনার বিষয়। লেখক তাঁর কথকতা শুরু করেছেন সেই ভূতাত্ত্বিক সময় থেকে, যখন ভারতীয় উপমহাদেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করত। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে উত্তরমুখি সঞ্চরণ, ইউরেশিয় পাতের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে হিমালয়ের উত্থান এবং আরও পরে সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র সহ বহু নদীর জন্ম-বৃত্তান্ত। ভূ-বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলি নিয়ে সাধারণ পাঠকের উপযোগী আলোচনা করেছেন। 

লেখক প্রাক-ইতিহাস থেকে ইতিহাসের সরণিতে হাঁটতে গিয়ে একবারও হোঁচট খাননি, এই কৃতিত্ব নেহাত কম নয়। আটটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত বইটির আলোচ্যসূচিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে এক বিশাল ক্যানভাস। যার বিস্তৃতি নদী পাড়ের হারিয়ে যাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বণিক সমাজ ও তাদের বাণিজ্য এবং ঔপনিবেশিক শাসনের উত্থান, তারপর তার ক্রমবিস্তার ও পতন এবং সব শেষে বাজার অর্থনীতির প্রভাবে বদলে যাওয়া ভারত। 

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ থেকে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল সিন্ধু-সরস্বতী নদীর অববাহিকায়। মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পার নগর নির্মাণশৈলিতে মুগ্ধ হয়েছেন আপামর পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক। কিন্তু সেই সমৃদ্ধি চিরস্থায়ী হয়নি। লেখকের মতে, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই সরস্বতী নদী বিলুপ্ত হয়ে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ অব্দ থেকে এই উপমহাদেশের জলবায়ু বদলাতে শুরু করে। মৌসুমী বায়ুর আরব সাগরীয় শাখাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি, যার ফলে আমূল পরিবর্তন ঘটে উপমহাদেশের বৃষ্টিপাতের আঞ্চলিক বণ্টনে। এই ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলেই ভারতীয় সভ্যতার ভরকেন্দ্র সরে চলে আসে গাঙ্গেয় অববাহিকায়। এই পর্বের সূচনা খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ অব্দ থেকে। 

অতিকথন বাদ দিলে রামায়ণ ও মহাভারত যে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তা কমবেশি অনেক ঐতিহাসিক মেনে নিয়েছেন। লেখক এই বইয়ে আলোচনা করেছেন রামায়ণ ও মহাভারতের ভূগোল নিয়ে। যেমনটা আমরা জানি, রামায়ণের পটভূমির বিস্তৃতি উত্তরে অযোধ্যা থেকে দক্ষিণে সিংঘল পর্যন্ত আর অন্যদিকে মহাভারত আবর্তিত হয়েছে পশ্চিমের আফগানিস্তান থেকে পূর্বের বর্তমানের নাগাল্যান্ডের মধ্যে। এই দুই মহাকাব্যের সময়কাল ভিন্ন, কিন্তু রামায়ণ উত্তর-দক্ষিণ ও মহাভারত পশ্চিম-পূর্ব বরাবর ওই দুই সময়কালের ভূগোল বুঝতে সহায়তা করছে। মহাকাব্যকে এই ভাবেও যে দেখা যায়, তা ভাবতে ভালো লাগে বই কী। 

লেখকের অনুসন্ধিৎসা অপরিসীম। নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লেখক ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তিনি যে প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর বইয়ে, তার মধ্যে রয়েছে, কেন এই দেশ ভারত নামে পরিচিত? কবে এক মহাপ্লাবন ভারতের উপকূল এলাকাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল? বুদ্ধদেব কেন সারনাথে তাঁর প্রথম উপদেশ দিয়েছিলেন? কীভাবে ইউরোপিয়রা এ দেশের মানচিত্র তৈরি করেছিল? লেখক নিজে অর্থনীতির কৃতি ছাত্র হলেও কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণ কেমন যেন খাপছাড়া এবং কিছু ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ মনে হয়। 

আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে হিমযুগের অবসান, উষ্ণযুগের সূচনায় হিমালয়ের হিমবাহ-গলা জলে নদীতে প্লাবন এবং সাগরের এগিয়ে এসে উপকূল তৈরি করা নিয়ে বহুদিন ধরেই দেশে বিদেশে চর্চা শুরু হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে নানা গবেষণাপত্র। কিন্তু এই বিষয়ে আলোচ্য বইটিতে লেখক তাঁর আলোচনা শুধুমাত্র পুরাকাহিনিতেই সীমাবদ্ধ রাখলেন কেন, তা বোঝা গেল না। ব্রিটিশরা এ দেশের শাসনের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর নির্ভুল মানচিত্র তৈরির কাজে হাত দেয়, সেই কাজ শুরু হয়েছিল এই বাংলা থেকে। জরিপের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেমস রেনেলকে। ১৭৬৪ থেকে ১৭৭৭ পর্যন্ত বিস্তৃত জরিপের পর ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হয় 'বেঙ্গল অ্যাটলাস'। উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় উইলিয়াম ল্যামটন ত্রিকোণমিতি জরিপের মাধ্যমে আরও বিস্তারিত ও নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করেন। ওই একই সময়ে এ দেশে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার ও রেলপথের বিস্তার শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে লেখক বিস্তৃত আলোচনা করলেও পরিবেশের উপর এই উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব অনুল্লিখিত থেকে গেছে। রেলপথ বিস্তারের পাশাপাশি কীভাবে ম্যালেরিয়া গ্রামবাংলায় মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল, বন্যার প্রকোপ বেড়েছিল, কৃষি উৎপাদন কমেছিল, সে কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই আরও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। তবে এই সব অপূর্ণতা সত্ত্বেও বইটি সযত্নে রেখে দেওয়ার মতো একটি রচনা। 

লেখকের ভাষায়, তাঁর আলোচনার বিস্তার প্রাচীন ভূ-ভাগ গন্ডোয়ানা থেকে দিল্লির উপকণ্ঠে গড়ে ওঠা উত্তর আধুনিক শহর গুরগাঁও পর্যন্ত। ভারতের ভূ-প্রকৃতির অনুসন্ধেয় ইতিহাস জানতে গেলে এই বইটি পড়তেই হবে।


5 comments:

  1. সংঘ পরিবার এখন সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা বলছে, হরপ্পা মহেঞ্জোদার নয়। সরস্বতী সবাই জানত অন্তসলীলা, মিথিকাল নদী,এরা বলছে সেটা বাস্তবে ছিল। বহু আগে তিলক বলেছিলেন আর্যরা আর্কটিক সমুদ্র অঞ্চল থেকে এসেছে তখন গোলওয়ালকার বলেছিলেন উনি ভুল কিছু বলেননি তখন আর্কটিক ভারতের মধ্যে ছিল। সুতরাং আর্যরা বাইরে থেকে আসেনি, ভারতের মানুষ। এটা ভারতীয় সভ্যতা যে অতি প্রাচীন তার প্রমান। Please refer Golwalkars We or our Nationhood Defined. সঞ্জীব সান্যাল সংঘ পরিবরের ideologue।

    ReplyDelete
  2. অল্পতে যা বোঝা যাচ্ছে রাম ও কৃষ্ণ ভক্ত অখন্ড ভারত ও বিশ্ব হিন্দু বুদ্ধিজীবী।

    ReplyDelete
  3. সঞ্জীব সান্যাল ছিলেন ডয়েশ ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা তেমন কিছু, পরে এখন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। আপাদমস্তক অতি দক্ষিণপন্থী সঙ্ঘপরিবারের একজনের ভূগোল ইতিহাস নিয়ে লেখাকে এত প্রচারের কারণ কী?

    ReplyDelete
  4. লেখাটি বিতর্কিত। তবুও প্রকাশ করা হয়েছে। যে সমস্ত লেখা এই ব্লগে প্রকাশ পায়, তার সঙ্গে যে আমরা সব সময় সহমত, তা কখনই নয়। আর বইটি যদি উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই লেখা হয়ে থাকে,তার বিষয়বস্তুকে খণ্ডনের প্রসঙ্গও নিশ্চয়ই উঠবে। ভূগোলের ইতিহাস নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়েই চর্চা হচ্ছে।

    ReplyDelete
  5. লেখক বেছে বেছে পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। সিধু জ্যাঠাকে ভুলে গেলেন নাকি। মনের দরজা জানালা খুলে রাখুন। দ্বিমত হলে আর একটা লেখা লিখুন,কমেন্ট বক্সে সীমাবদ্ধ থাকবেন না। লেখক নয়, বিষয় বৈচিত্র আমাকে আকর্ষণ করেছে তাই সবার সঙ্গে সেটা ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম,দেখলাম আপনাদের মধ্যেও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। তা ভাল। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকব।

    ReplyDelete