Tuesday 28 April 2020

শিক্ষার হাল

কোভিড১৯ শিক্ষার সমস্যাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে
সঞ্জয় মজুমদার
করোনা সন্ত্রাসের তৃতীয় পর্যায়, লকডাউন ৩.০, আমাদের দেশে কড়া নাড়ছে। এর মানে ২৫শে মার্চ ২০২০ থেকে শুরু করে গোটা এপ্রিল মাস, তারপর মে মাস, এবং জুন মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জমায়েত করে পড়াশোনা করা, মানে ক্লাসরুম লেকচার বলতে যা বোঝায়, সম্পূর্ণ বন্ধ। অর্থাৎ, মার্চ মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে জুন ২০২০'র প্রথমার্ধ- পরিষ্কার তিন মাস প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান পদ্ধতি স্তব্ধ। বারো মাসে তিন মাস, মানে একটা গোটা শিক্ষাবর্ষের এক-চতুর্থাংশ হাতের বাইরে চলে গেল এবং তা দুই-চতুর্থাংশে যে পৌঁছবে না, এমন আশ্বাসবাণী অতি বড় দুঃসাহসীও এই অবস্থায় শোনাবেন না।

সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে মুকুল বা মন্টেসরি থেকে আরম্ভ করে অতি উচ্চ-গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সর্বস্তরেই এই তিন থেকে চার মাসের অপূরণীয় ক্ষতির অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন পরবর্তী শিক্ষাবর্ষগুলোতে পড়বেই। তিন থেকে চার মাস পড়াশোনা বন্ধ মানে মূল কার্যকরী সময়টাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা জানেন, এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। কোনওভাবেই একে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতর কী পদক্ষেপ নেবেন বা সিদ্ধান্তের কথা শোনাবেন, তার জন্য দেশব্যাপী সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ইতিউতি অনেক কিছুই শোনা যাচ্ছে। পরীক্ষা হতেও পারে নাও হতে পারে। হলে কেমন ভাবে হতে পারে, না হলেই বা ফল প্রকাশ কীভাবে হতে পারে, এইসব। পর্বত প্রমাণ চাপ যে দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে, এটা একপ্রকার নিশ্চিত সবার কাছে। কিন্তু কিছু করারও নেই। মানুষ আগে প্রাণে বাঁচবে তারপর তো পড়াশোনা। কিন্তু আলোচনার গণ্ডি শহর ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় আটকে রাখলে শিকড় ছেড়ে গাছের মাথায় জল দেওয়ার মতো হবে। আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই, সত্যান্বেষী হতে হলে শহর ছেড়ে গ্রাম-ভারতের চৌহদ্দিতে ঢুকতেই হবে।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বা উদ্ভূত পরিস্থিতি ২০১৯-এর নভেম্বরে চীন থেকে শুরু হলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই অবস্থা পৃথিবী জুড়ে চলবে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে আমাদের সময় লাগবে। কিন্তু শুধু  *CO* rona *VI* rus- *19* বা সংক্ষেপে COVID-19 এর উপর ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব পরিস্থিতির দায় চাপিয়ে দিলে প্রকৃত সমস্যাগুলোকে বোঝা যাবে না। COVID-19 পূর্ববর্তী গ্রাম-ভারতের দিকে একটু তাকালে অনেক কিছু চোখে পড়বে, যার মধ্যে অন্যতম মধ্যপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া বা স্কুল ড্রপ-আউটের সমস্যা এবং বলা ভালো প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে পৌঁছতেই না পারা। এই বিষয়ে 'একক মাত্রা'র 'একাকিত্ব' সংখ্যায় কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলাম উপযুক্ত তথ্য সমেত। যখন করোনাকে ঘিরে ইদানীংকালে আমাদের দেশে, সব কিছুর সাথে পড়াশোনা রসাতলে গেল বলে রব উঠেছে, তখন আবার এই প্রসঙ্গের অবতারণা করতেই হল।

National Family Health Survey-3 (NFHS-3)-র তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা লাভের আশায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ১৪ শতাংশ শিশু কখনও বিদ্যালয়ের সীমানায় আসতেই পারে না এবং ১১ শতাংশ বিভিন্ন কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তার মানে ২৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি স্তরে পর্যায়ভিত্তিক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা এখনও জানা নেই। এই শিশুরা সরকারের খাতায় চিরস্থায়ী অশিক্ষিত হিসেবেই রয়ে যাচ্ছে, যাবেও। আর যে ৭৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার বৃত্তে আসতে পারল, তাদেরই বা কার্যকরী শিক্ষা বা ন্যূনতম বিদ্যা বর্তমান পরিকাঠামোয় কতটুকু অর্জন হচ্ছে, যা কিনা পরবর্তীকালে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কাজে আসতে পারে, সরকারি স্তরে তারও কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। হলে হবে, না হলে না হবে- এইরকম একটা ভয়ঙ্কর নীতিতেই দেশ চলেছে। অনিবার্য ফলস্বরূপ, ২০০০ সালের মধ্যে Universal Primary Education (UPE)-র যে স্বপ্ন সরকারি স্তরে দেখানো হয়েছিল, তা স্বপ্নই রয়ে গেল। এরপর রাষ্ট্রপুঞ্জ'এর স্পষ্ট নির্দেশিকা ছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ ছেলেমেয়েকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ, ১০০ শতাংশই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি সম্পূর্ণ করবে, যা কিনা সরকারি হিসেবে অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। আরও পাঁচ বছর পেরিয়ে আজ ২০২০ সালের এপ্রিল মাস চলছে। আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক যে তথ্য ও বিষয়গুলো এতক্ষণ সামনে আনার চেষ্টা করলাম,  সে সব কিন্তু করোনা অতিমারী-র অনেক আগের। জনস্বাস্থ্য, অতিমারী কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি কোনও অজুহাতেই এই সার্বিক ব্যর্থতাকে আড়াল করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে দূরেই সরিয়ে রাখলাম, যার হিসেব পরে কখনও হবে।

অতিমারী-র প্রকোপে আজ পৃথিবী দিশেহারা। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন তার বাইরে অবশ্যই নয়। যে আলোচনা চলছিল তার কারণগুলো একটু দেখে নেওয়া দরকার। কেন ৬-১৬ বছরের ২৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রার্থী প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডিতে ঢুকতে পারছে না বা পারছিল না? 'পারছিল না' এই শব্দবন্ধনী ব্যবহার করলাম জেনে-বুঝেই। কারণ, পৃথিবীটা এখন করোনা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী পর্যায়ে ভাগ হয়ে গেছে। যাই হোক, মোটা দাগে, প্রথাগত ও প্রথাবিহীন শিক্ষাক্ষেত্রে স্কুল ড্রপ-আউটের কারণগুলো ছিল এইরকম:

১) বাবা-মায়ের শিক্ষাস্তর;
২) পারিবারিক আয়;
৩) পারিবারিক পরিস্থিতি;
৪) সামাজিক অবস্থান;
৫) ধর্মীয় গোঁড়ামি;
৬) লিঙ্গ বৈষম্য;
৭) বিদ্যালয়ের দৈন্যদশা;
৮) পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের অনুপস্থিতি;
৯) গুটিকয়েক শিক্ষকের উপরে পড়ানো ছাড়াও ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক কাজের চাপ;
১০) দারিদ্র্য ও অপুষ্টি।

খুঁজলে আরও অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ নিশ্চয়ই বেরবে কিন্তু সে সব নিয়ে আলোচনার আপাতত দরকার নেই। বলার বিষয় এটাই, এই সমস্যাগুলো করোনা অতিমারীর আগেও ছিল এখনও আছে এবং করোনা পরবর্তী সময়ে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে সময়োপযোগী যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে। কারণ, করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গ্রামে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মহীনতা ও বেরোজগারির ঢেউ আর্থিক বৈষম্যকে অবধারিত বাড়িয়ে তুলবে। ফলস্বরূপ, উপরে উল্লেখিত ঐ ২৫ শতাংশের পরিমাণ আরও বাড়বে। বিপুল পরিমাণ মানবসম্পদ আমরা হারাব।

এই ব্লগে আগের একটি লেখায়, লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। পরিস্থিতি প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তনের ঢেউতে বেসামাল হচ্ছে। পরবর্তী আলোচনায় গ্রাম-ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা সহ অন্যান্য বিষয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োগকে বাস্তব পরিস্থিতিতে বিচার করে আলোচনার চেষ্টা করব।

No comments:

Post a Comment