Wednesday 22 January 2020

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি

তথ্যের ঈশ্বর
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
লেখকের সদ্য প্রকাশিত 
'আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি' গ্রন্থ থেকে অংশবিশেষ
যখন বলছি তথ্যই আজকের মুখ্য পণ্য, তথ্যের আধারেই নির্মিত হচ্ছে আগামী চলার পথ, তখন স্বভাবতই আমরা নিজেদের যাবতীয় সমস্ত তথ্য নিয়ে জড়িয়ে আছি এক সুবিস্তৃত তথ্য-মহাসাগরে। সেখানে কতিপয় ঈশ্বর আছেন, যাদের হাতে সমস্ত তথ্য তাদের সম্ভাব্য যদৃচ্ছ আকার-প্রকার নিয়ে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ে পরিব্যাপ্ত। আপনি-আমি কেজো মানুষ, কিছু তথ্যের সন্ধানে বড়জোর গুগলের বলয় অবধি আমাদের দৌড়কিন্তু আমাদের প্রতি মুহূর্তের তথ্য, যা কিছু খুঁটিনাটি, প্রতি ক্ষণে ধরা পড়ছে যত বেশি আমরা তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি বা সময় কাটাচ্ছি সাইবার ভুবনে। এইসব তথ্য ঘিরে নির্মিত হচ্ছে আমার প্রোটো-টাইপ, আমার প্রতিচ্ছবি বা অন্তঃমূল, যেখান থেকে আমাকে মাপা হতে থাকবে একটি লক্ষ্যবস্তু হিসেবে। সেই লক্ষ্যে কখনও আমি পুরুষ্ট ক্রেতা বা সম্ভাব্য গুণের ধারক, যে গুণের আবার বাজার দর থাকতে পারে, তখন কী সৌভাগ্য, আমিও বিক্রেতা; অথবা সেই আমিই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শিকার যাকে তার পছন্দের উপাদানগুলি দিয়েই উদ্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিধায় সামিল করে নেওয়া যায়; এমনও হতে পারে, আমি পরিস্ফুট রাষ্ট্র-অনুরাগী বা উদগ্র রাষ্ট্র-বিরোধী। যাই হই না কেন, আমি নজরবন্দী।
        
তথ্যের ঈশ্বর অবশ্য জানান দেবেন যে আপনার কথা চালাচালি, আপনার কার্যক্রম এনক্রিপটেড, কেউ জানে না আপনি কী করছেন, কাকে কী বলছেন। এমনকি তিনিও নন কিন্তু তা আপাতভাবে ক্ষণিকের, যতক্ষণ ঈশ্বর ইচ্ছা করেছেন যে তিনি আপনার দিকে নজর ফেরাবেন না। কিন্তু তথ্যের ক্রম-বিশ্লেষণ যদি দাবি করে যে আপনি নজরে পড়ার যোগ্য তাহলে অ্যালগরিদমের অভিমুখ এবার আপনার উপরেই স্থিত। এইভাবে কোটি কোটি মানুষ নিমেষে নানান মাত্রায় ও অভিঘাতে ধরা পড়ছেন বিবিধ উদ্দেশ্যের পরিধিতে। তাই তথ্য, আরও তথ্য, মহা তথ্য হল এ যুগের মুখ্য উপকরণ যাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ডিপ লার্নিং নিয়ে চলেছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উদ্ভাসনে। সেই হল আজকের অর্থনীতির অভিকেন্দ্র।

অতীত থেকে এ এক নির্মম ছেদ। বস্তুগত পণ্য উৎপাদনেই অর্থনীতির এ তাবৎ ব্যস্ততা ছিল। খাদ্যসামগ্রী, কৃষিজ পণ্য, নানান ব্যবহারযোগ্য শিল্প পণ্য ও তাকে ঘিরে আনুষঙ্গিক পরিষেবার মধ্যেই তা চক্রাকারে ঘুরত। যদিও বা পরিষেবা ক্ষেত্র অনেকটা বড় ব্যাপ্তিতে ধরা দিল কিন্তু তা সততই ছিল বস্তুগত উৎপাদনের পরিপূরক হিসেবে। যেমন, ব্যাঙ্কিং বা বীমা শিল্প অথবা শেয়ার বাজার কিংবা পরিবহনআর এই পরিষেবা ক্ষেত্রকে আরও যথাযথ, দ্রুত ও নিখুঁত করতেই এসেছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। সেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপরে ভর করেই আজকের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যেখানে মূল কেন্দ্রাভিগ বিন্দুটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে তথ্য ও তার আদিগন্ত ধারণ ও বিশ্লেষণ। অতএব, এই তথ্যকে ঘিরেই আজকের উৎপাদন ও বাণিজ্যের নবতর আঙ্গিক পরিব্যাপ্ত তথ্যের সাহায্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার চিন্তন, কার্যসমূহ ও নির্দেশাবলী নির্মাণ করে নিচ্ছে। ক্লাউড কম্পিউটিং হোক কি ইন্টারনেট অফ থিংস, রোবট বা ডিজিটাল অ্যাসিস্টেন্ট- এরা প্রত্যেকেই তথ্যের মহাআকরে নির্মিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিবিধ প্রয়োগ। অযূত তথ্য ও তার নিত্য মন্থন- তার ওপরেই দাঁড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তথ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাড়া অর্থনীতির অবয়বটিই আজ বন্ধ্যা। অতএব, গোটা অর্থনৈতিক বিশ্বের ঈশ্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে কতিপয় তথ্য কারবারী ভার্চুয়াল কর্পোরেট। তাদের নির্মিত ডিপ লার্নিং’এর প্রয়োগ ছাড়া আজ বাণিজ্য দুনিয়ায় এক মুহূর্তও টিকে থাকা সম্ভব নয়। এরা হল সেই সুবিখ্যাত কোম্পানিগুলিই– অ্যাপেল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, আইবিএম, ইন্টেল, সেলসফোর্স, অঙ্কি প্রভৃতি। এদের বাদ দিয়ে আলাদা করে অর্থনীতির অন্য কোনও গতিপথ আপাতত নেই।  

ইতিমধ্যেই গুগল হয়ে উঠেছে এমন এক আধা-বিচারসভার মতো যারা কোনটা ব্যক্তিগত তথ্য আর কোনটা নয় তার বিচারের যেন স্বতঃঅধিকারীএরা স্বীকারও করেছে, এদের কাছে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণে ৩০ লক্ষেরও বেশি লিঙ্ক মুছে দেওয়ার অনুরোধ এলেও তার মাত্র ৪৫ শতাংশ তারা কার্যকরী করেছে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিসের সাম্প্রতিক রায়ও কিছুটা তাদের পক্ষে গেছে। গুগল ও অন্যান্য ইন্টারনেট সার্চ থেকে স্পর্শকাতর সমস্ত ব্যক্তিগত লিঙ্কগুলি বিশ্বব্যাপী মুছে দেওয়ার জন্য ফ্রান্স সহ কিছু দেশ যে দাবি করেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপিয়ান কোর্ট জানিয়েছে, ইউরোপের সীমানাতেই এই বিধি কার্যকর হবে কিন্তু বিশ্বের অন্যত্র নয়। হয়তো সারা বিশ্ব জুড়ে এ নিয়ে ঝড় উঠতে পারে ও দেখার আছে অন্যান্য দেশগুলি এ বিষয়ে কী অবস্থান নেয়। 

বোঝাই যাচ্ছে, ব্যক্তিগত তথ্যের ওপরে এইসব ভার্চুয়াল কর্পোরেটদের যে দখলদারি তা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিসরে এক অচিন্তনীয় পরিবর্তনের দিশারী। এ যেন মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে দুই রাষ্ট্রের অবর্ণনীয় সংঘাত। একদিকে দেশ, সরকার, সেনা, আইন নিয়ে চিরায়ত রাষ্ট্র, অন্যদিকে তথ্য, নজরদারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অন্তরালে অগম্য কারিগরি কৌশল নিয়ে ভার্চুয়াল কর্পোরেটদের নবতর রাষ্ট্র তাই, বিশ্ব জুড়ে আর্থিক বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে যে কলরব উঠেছে তার কারণগুলিও বেশ স্পষ্ট। কারণ, নব নির্মিত এই নতুন রাষ্ট্রের হাতেই এখন মুনাফা ও সম্পদের সিংহভাগ। যদি এমনটা হয় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌলতে কিছু অগ্রণী শিল্প গোটা অর্থনীতির শরীরটাকেই নিজেদের সপক্ষে প্রায় আমূল বদলে দিতে সক্ষম তাহলে চিরায়ত দেশ, রাষ্ট্র, সরকারেরও তেমন বিশেষ কিছু করার থাকে না, সম্ভাব্য সংকট এড়াতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার করা ছাড়া। এমত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর কথা আজকাল বেশ আলোচিত ও প্রয়োগ-ভাবনাতেও কোথাও কোথাও দৃশ্যমান।

No comments:

Post a Comment