Wednesday 2 October 2019

গান্ধী

স্বরাজ আমার জন্ম অধিকার
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এই মানুষটি বিচিত্র পরিসরে অবিচল হেঁটেছেন। এমন কোনও বিষয় নেই যার ওপর তিনি তাঁর মতামত জ্ঞাপন করেননি। তাঁকে কেউ ভয়ঙ্কর আপসকামী, ধনীদের অনুগ্রহপ্রার্থী ইত্যাদি ভূষণ আরোপ করেছেন, কেউ বা তাঁকে যুগপুরুষ, মহাত্মা, দুর্বলতম মানুষের পথপ্রদর্শক আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সর্বদাই বিতর্কিত, বহু আলোচিত ও দ্বন্দ্ব-কীর্ণ। আজও পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমাদৃত।

এ সবই আমরা জানি। তাঁকে নিয়ে খুব বেশি কিছু নতুন করে বলারও নেই। তিনি একেক অস্তিত্বে একেকজনের কাছে এখনও সবাক। তিনি বহুরূপে, বহু অর্থে, নানান ব্যাপ্তিতে মূর্ত। তাঁকে আপন বোধের মাধুরীতে বোঝা যায়, ধরা যায় না। এ হেন বহুগামী, বিস্তৃত চরাচরে ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের সুতোটি কোথায় বাঁধা তবে? সেও এক রূপকল্পনা।

তাঁর মূল অভিঘাতটি বোধহয় 'স্বরাজ'। আপন রাজ। সে রাজের অধিষ্ঠান কোথায়? নিজের অন্তর্লোকে, গভীর চৈতন্যে। এ তাবৎকালের সমস্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করে 'স্বরাজ' ছিল তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞান। শাসক যেই হোক, স্বরাজের বীক্ষা বলে, আমার অধিকারে, পরিসরে হস্তক্ষেপ এলে আমি প্রতিরোধ করব - প্যাসিভ রেজিসটেন্স। যার মূর্ত প্রকাশ: অসহযোগিতা। আর সেই আন্দোলনেই অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, অসহযোগিতা তখনই সফল হতে পারে যদি তাতে সামিল হয় জনসাধারণের বিপুল অংশ। মানুষের এই বিশাল সমাগমই গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। তাঁর স্বরাজ চিন্তা এই বয়ানের ওপরেই দাঁড়িয়ে।

লবণ আইন অমান্যে সবরমতী আশ্রম থেকে ৩৮৮ কিলোমিটারের পথ ডান্ডির উদ্দেশ্যে যেদিন তিনি হেঁটে রওনা দিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাত্র ৭৮ জন সত্যাগ্রহী। ভারতের বড়লাট এ খবর শুনে খুব স্বস্তিতে ছিলেন যে গান্ধীর এই 'পাগলামো'তে তিনি অন্তত কিছুদিন শান্তিতে ঘুমতে পারবেন। ২৮ দিন পায়ে হেঁটে তিনি যখন ডান্ডি পৌঁছলেন তখন অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষ তাঁর পেছনে সমবেত হয়েছেন। এই সমাগমই রাজনৈতিক বার্তা। স্বরাজ তখন ব্যক্তি স্তর থেকে সামাজিক স্তরে ব্যাপ্ত। বলাই বাহুল্য, বড়লাটের নিশ্চিদ্র নিদ্রার দিবাস্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।

তিনিও জানতেন, তিনি যখন থাকবেন না তখন কী থাকবে। তা আজ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। একদিকে লোভ, লালসা, তঞ্চকতার দাসত্ব, অন্যদিকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া খেটে-খাওয়া মানুষের দঙ্গল - এই দুই পৃথিবীর মধ্যেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে স্বরাজ। ইতিহাসকে উলটো করে পেশ করেছিলেন তিনি - যদি তুমি সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষটি নিজেকে সর্বাগ্রে স্বরাজের আসনে বসাতে পার তাহলে শাসক আর পেরে উঠবে না তোমার সঙ্গে। এইভাবেই অসহায়, পীড়িত মানুষের ভাবনায় ও কর্মে স্বরাজ এলেই বৃহত্তর রাজনৈতিক,  সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রাঙ্গণেও স্বরাজ তখন বাধ্যত আসবে।

এই অসম সাহসী চিন্তককে সার্ধশতবর্ষের বিনীত প্রণাম। তিনি দৃশ্যত ইউটোপিয় কিন্তু চিন্তায় সদর্থক।তিনি আপাত ক্ষণিকে দুর্বল কিন্তু  চিরঅবধ্য। তিনি কার্যত বিস্মৃত কিন্তু নিয়ত চলমান ভূখণ্ডের প্রতি পল-অনুপলে।

No comments:

Post a Comment