Sunday 20 May 2018

পঞ্চায়েতের সন্ত্রাস



শিক্ষক রাজকুমার রায়ের মৃত্যু, রাষ্ট্র এবং আমাদের বেঁচে থাকা
জয়ন্ত ভট্টাচার্য

কত বয়স হবে ছেলেটির? মধ্য-তিরিশ। খুন-ডাকাতি-রাহাজানি-ধর্ষণ তহবিল তছরুপের কোনও অভিযোগ পুলিশের খাতায় ছিল না। পড়শিরাও জানত সদালাপী ছেলে হিসেবে। স্বভাব-চরিত্রে কোনও দাগ ছিল না বলেই ওকে পাঠানো হল গণতন্ত্রের 'বৃহত্তম উৎসব' ভোট নিতে। তাও আবার প্রিসাইডিং অফিসার করে। আপনাদের সবার এতক্ষণে 'নিউটন' সিনেমাটির কথা মনে পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। ওখানেও তো নিউটনের বৃহত্তম সংকট তৈরি হয়েছিল বৃহত্তম উৎসব পরিচালনা করতে গিয়ে। আমাদের রাজকুমারও রূপোলি পর্দার নিউটনিয় সংস্করণ। ছবিটি দেখার সময় ভাবিনি এরকম চিত্রনাট্য নিজেদের চোখের সামনে তৈরি হতে চলেছে। তো পর্দার নিউটন হাতে এসএলআর তুলে নিয়েছিল। আমাদের এখানকার 'নিউটন' রাজকুমার ওসব কিছু করেনি। স্রেফ মরে গেছে – গণতন্ত্রের উৎসবের দিনে। 

মুখ্যমন্ত্রী পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজয় ঘোষণার দিন জানিয়েছেন রাজকুমার আত্মহত্যা করেছে। ট্রেনের ড্রাইভার পরের স্টেশনে এসে রিপোর্ট করেছে কেউ একজন ট্রেনে কাটা পড়েছে। তাইতে জানা গেছে রাজকুমার আত্মহত্যা করেছে। একটু বিস্মিত হতে হয় যে ওর বুথ থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে এসে ও আত্মহত্যার জন্য ঠিক ওই ট্রেনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকল? রায়গঞ্জ-কাটিহার লুপলাইনে সারাদিনে তিনটে ট্রেন বলে? এ তো সাইকিয়াট্রির আত্মহত্যার ঝোঁকের কোনও যুক্তি দিয়েই ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এর আগে যতদূর জানা গেছে হয়তো 'মানসিক অসুস্থতার' কারণেই ওর বুথে ভোটের সমস্ত কাগজপত্র নেবার জন্য যখন সশস্ত্র বহিরাগতরা প্রবেশ করে তখন রাজকুমার বাধা দিয়েছিল। নিতে দেয়নি। কি জানি, হয়তো এর সাথে ওর 'আত্মহত্যা'র কোনও সম্পর্ক থাকতেও পারে!
এবার আমার ঘটনা পরম্পরা দেখি একবার।
শিক্ষক রাজকুমার রায় ১৪ মে ইটাহার ব্লকের সোনারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছিলেন সন্ধ্যা আটটা নাগাদ বুথের বাইরে এসে তাঁর স্ত্রীকে ফোনে বলেন, ভোট শেষ হতে ১০টা-১১টা হবে (ওরই ফোন ছিল তো?) তারপর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
তাঁর শিক্ষক সহকর্মীরা খবর পেয়ে রাতে ইটাহার ব্লকে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁদের কোনও তৎপরতা বা দায়বদ্ধতা দেখা যায়নি। অবশেষে পরের দিন সকালে মিসিং ডায়েরি করা হয়।
তারপর তাঁর ছিন্নভিন্ন দেহ রায়গঞ্জ স্টেশন থেকে দেড় কিমি পূর্বে রেল লাইনের উপর থেকে উদ্ধার করা হয়। তাঁর সংসারে এক ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা মা। একজন প্রধান শিক্ষককে তার প্রিয়তম সহকর্মীর ছিন্নভিন্ন লাশ তুলতে হচ্ছে। এর থেকে চাকুরি জীবনের আর কোনও ভয়াবহ দৃশ্য হতে পারে না
রাজকুমারের এই মৃত্যু অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল।
১। একজন নির্বাচনী অফিসার ভোট কেন্দ্র থেকে অপহৃত হল অথচ নির্বাচন কমিশনের উদ্ধার করার কোনও তাগিদ নেই কেন?
২। গণতন্ত্র রক্ষা করার দায় কি শুধুই শিক্ষকদের? একজনও নেতা বা মন্ত্রীর গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি। অদ্ভুত!
৩। জীবনরক্ষার অধিকার আগে না ভোট করার অধিকার আগে?
৪। নির্বাচন কমিশন ভোটকর্মীদের জীবন রক্ষা করার ক্ষমতা না থাকলে নির্বাচন করছে কেন? এবং আরও অনেক
আজকে স্কুল শিক্ষকরা এই প্রশ্ন তুলেছেন। এ-প্রশ্ন সমস্ত সরকারি কর্মচারী, ব্যাঙ্ক কর্মচারী ও যাঁদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ভোট করানো হয় তাঁদের সবার। তবে প্রশ্ন তুলেই তাঁরা থেমে থাকেননি। প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমারের হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন ভোটকর্মীরা, তাঁরা কাউন্টিং ট্রেনিং বয়কট করেছেন। রায়গঞ্জের ঘড়িমোড়ে জমায়েত হয়েছেন কয়েক’শ শিক্ষক তথা ভোটকর্মী। এদের জমায়েত রায়গঞ্জের মানুষ বিস্কুট জল সরবরাহ করেছে। এমনকি রাতে খিচুড়ি রান্না করার পরিকল্পনাও ছিল। যদিও তার প্রয়োজন পড়েনি। জেলাশাসক বেশি রাতে অর্ডার দিয়েছেন এই শিক্ষকদের গণনাকেন্দ্রে না পাঠানোর জন্য। আবার উত্তেজনার মুহূর্তে এসডিও-কে হেনস্থা করার মতো অবাঞ্ছিত ঘটনাও ঘটেছে।
নিরাপত্তা নেই আজ কারও। সরকারের হাসপাতালে যখন ডাক্তার মার খান গুণ্ডা আর দালালদের হাতে তখন প্রশাসন নির্বিকার। আর যখন সরকারের কর্মযজ্ঞ ভোটে শিক্ষক মারা পড়েন রাজ্যের ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে তখন প্রশাসন নড়ে বসবে এমন আশা করা যায় না
সমস্ত ভোটকর্মী রাস্তায় নামুন। 'পথে এবার নামো সাথি, পথেই হবে এ পথ চেনা'... সেই অতিপরিচিত লাইনগুলো। শিক্ষকেরা সংহত হয়েছেন। অন্যান্য সংগঠনের মানুষেরাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সংহতি মিছিল করছেন।

এরপরেও বলব নিহত রাজকুমার রায় শিক্ষক ছিলেন, সুতরাং আর কোনও পেশার মানুষ না এলেও আপনারা শিক্ষক সমাজ আপানাদের সংহতিতে নিষ্ঠাবান থাকুনসমাজের শ্রদ্ধা অর্জিত হবে নিশ্চয়ই। আশা করা যায় পরে অন্য পেশার মানুষ পাশে দাঁড়াবেন। শিক্ষক সমাজ সম্প্রতি তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্র হরণকারী বাইশ দফা 'হিটলারী' কালা কানুনের মতো বিষয়েও আপনারা মূলত নিরুচ্চার ছিলেন। আজ আপনারা সোচ্চার এবং সক্রিয় হয়েছেন। রায়গঞ্জের পাশে সংহতি জ্ঞাপন করেছেন পুরুলিয়া থেকে জলপাইগুড়ির বিভিন্ন স্তরের শিক্ষসমাজ ও মানুষ।
আমরা জানি আপনাদের দুজন সাথীকে ইতিমধ্যেই আটক করেছে। তারা পুলিশের হেফাজতে। তা সত্ত্বেও আপনারা এখনও অটুট আছেন। সেলাম!
এসবের পরেও আমরা শিক্ষক সমাজকেই দায়িত্ব পালনের কথা বলছি, কারণ তাঁরাই আজ সবচেয়ে বড় সংগঠিত 'শ্রমিক শ্রেণী'- আপনাদের শক্তি আপনারা জানেন না। নিজের ঘুমিয়ে-থাকা আগ্নেয়গিরির উৎসমুখ খুলে দিলে এই অনুগ্রহলেহীদের সাধ্য নেই কিছু করে! আজ দেড় বছর ধরে ডাক্তারদের মতো আপাত-সুবিধাবাদীরা যদি বারবার রাস্তায় নামতে পারেন, আপনাদের কিসের এত ভয়! অন্য পেশার মানুষদেরও সমর্থন পাবেন আপনারা। আপনারা কোনও অন্যায় করেননি। আপনারা ন্যায়বিচারের পক্ষে আছেন।
চলুন, সবাই মিলে এই মারণতন্ত্রকে প্রতিহত করি !!

4 comments:

  1. প্রধান শিক্ষক সইদুর বাবু যে লড়াই লড়ছেন।তার পরেও যদি শিক্ষক সমাজ নিউটন হবার ন্যুনতম চেষ্টা না করে তাহলে
    এ কোন সকাল।সিনেমার নিউটনের থেকে আমাদের বিপন্নতা অনেকগুন বেশি।

    ReplyDelete
  2. নিউ ওল্ড কোনও টনের ব্যাপার না। ১৯৭২কে হারিয়ে দেওয়ার উদগ্র উল্লাস আর অন্ধ ক্ষমতালিপ্সার বলি রাজকুমার। এক রাজকুমারের মৃত্যু সিঙুরের আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। আরেক রাজকুমারের মৃত্যু সেই পথই দেখাচ্ছে।

    ReplyDelete
  3. শুধু শিক্ষক সমাজ কেন, সর্বস্তরের সরকারি/আধা সরকারি কর্মচারী দের নিজের নিরাপত্তার লড়াই এটা । মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এর হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করা যেতে পারে কি ?

    ReplyDelete
  4. জয়ন্তবাবু, আপনার লেখাটি অত্যন্ত ভাল । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি নির্বাচনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা আর মানুষ থাকেন না । ঘাড়ের ওপর কমিশন এর নিঃশ্বাস পড়ায় তারা দানব হয়ে যান । ২০১১ বিধানসভা ভোটের সময় চন্দননগরের মহকুমা শাসকের অফিসে দেখেছিলাম একজন বয়স্ক ও অসুস্থ শিক্ষক যিনি স্ত্রীর সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না তিনি মহকুমা শাসকের কাছে তাকে নির্বাচনের কাজে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন নিয়ে এসেছিলেন, ভয়ে তিনি ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। কিন্তু মহকুমা শাসক তাকে অব্যাহতি দেননি । সেদিনই মনে হয়েছিল, এই মানুষটিকে তো আসলে বধ্যভূমিতে পাঠানো হচ্ছে ! ভদ্রলোকের কী হয়েছিল জানি না । আবার ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের সময় হাওড়া সদর এর মহকুমা শাসক স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর অন্যায্য কাজে আপত্তি জানিয়েছিলেন বলে তার ওপর এমন মানসিক চাপ তৈরি করা হয় যে ভোট চলাকালীন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন । ভোট মিটে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি বদলি হয়ে যান ।

    ReplyDelete