Tuesday 14 March 2017

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন



সোজাসাপ্টা দু’ চার কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 

এ এক ভারী অদ্ভুত খেলা। নির্বাচনে পছন্দের দল জিতলে (যত অল্প ব্যবধানেই জিতুক না কেন) সমস্বরে বলা হয়, জনগণ জনবিরোধী শক্তিকে পরাস্ত করেছে। আর হেরে গেলে, তখন শতকরা হিসেব চলে, আসলে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে তো জিতল ওরা, সংখ্যাগুরু মানুষই তো ওদের বিরুদ্ধে। তাই কোনও ফলেই সকলে সন্তুষ্ট নয় কখনও।

এখন প্রশ্ন হল, ধারাবাহিক ভাবে কোনও দলের পক্ষে বা বিপক্ষে আছেন এমন লোকের সংখ্যা কত? অর্থাৎ, একটি দলের প্রতি কমিটেড বা একটি দলের প্রতি বিদ্বেষী – এমন মানুষের সংখ্যা একটা সময়পর্বে (ধরুন দশ কি পনের বছরে) কতটা স্থির থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব জটিল। দেখা গেছে, ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ অবধি সারা দেশেই কংগ্রেস একচেটিয়া ভাবে বারবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। আবার ১৯৭৭ থেকে ২০১১ ও ১৯৫২ থেকে ১৯৮২ – যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশে শাসকের বদল হয়নি। তেমনই গত ১৫ বছর ধরে গুজরাতে একই শাসক দল ক্ষমতায় রয়েছে। আবার অন্য অনেক প্রদেশে বা জাতীয় স্তরে প্রতি বছরই হয় এ দল নয় সে দল ক্ষমতায় পালাবদল ঘটিয়েছে। এখন এই ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ছিটকে যাওয়ার পিছনে অবশ্যই নির্দিষ্ট কারণ আছে। উল্লেখ্য, গত এক-দু’ দশকে এই বদলের হার আরও দ্রুতগামী হয়েছে।

‘রোটি কাপড়া অউর মকান’ – এই ছিল আশির দশক পর্যন্ত নির্বাচনের মূল মুদ্দা। নির্বাচনের ময়দানে বা মাঠেঘাটে ময়দানে দারিদ্র্য, বেকারি, সমাজতন্ত্র এই নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলি নানা লড়াইয়ে মেতেছে, বড় বড় গণ-আন্দোলন বা এমনকি সশস্ত্র লড়াইও সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নতুন নতুন দলেরও উত্থান হয়েছে এবং নানান রাজ্যে পালাবদল ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ক্ষমতায় আসা এমনই এক নতুন নজির ছিল নিঃসন্দেহে। জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘সর্বাত্মক বিপ্লব’এর ডাকও ছিল এই গোটা অনুশীলনপর্বের একটি অনুষঙ্গ। আশির দশকের মাঝামাঝি ও শেষ থেকে এই অনুশীলনের মোড়টা ঘুরতে থাকে। রাজীব গান্ধী সরকার কর্তৃক পরিত্যক্ত বাবরি মসজিদের গর্ভগৃহের তালা খুলে দেওয়া ও শাহবানু মামলায় হেরে গিয়ে সংসদে সংখ্যার জোরে আইন বদল এবং মণ্ডল কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়া – মূলত এই তিনটি ঘটনা ভারতীয় রাজনীতির গতিপথটাকেই অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। জাতপাত ও সংখ্যালঘুদের কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনীতির মার্গ আত্মপ্রকাশ করে। রামমন্দির-বাবরি মসজিদ ইস্যু ও জাতপাতের বিষয় হয়ে ওঠে জাতীয় রাজনীতির মূল অনুঘটক। আর একে ভর করেই রাজনীতির মূল প্রাঙ্গণে উঠে আসে বিজেপি, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল ধরনের দলগুলি। এর পরের ঘটনাগুলি আমরা জানি।

প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল জাতপাত ও ধর্মীয় ইস্যুগুলিকে তাদের নিজেদের মতো করে কাজে লাগিয়েছে এবং যে যেমন যখন পেরেছে ভোটের ময়দানে তার ফায়দা তুলেছে। ২০০২ সালে গুজরাতে দাঙ্গা এরকমই এক নৃশংস ঘটনা যার ফায়দা বিজেপি ষোলআনা নিজের ঘরে তুলেছে। একইভাবে ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেস দেশের বহু জায়গায় শিখদের হত্যা করেছে ও এক নৃশংস জাত্যাভিমানকে উসকে দিয়ে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ফায়দা উঠিয়েছে। বিজেপি যদি হিন্দু উগ্রবাদকে নিজেদের কাজ লাগিয়ে থাকে তো অন্য দলগুলি ইসলামি উগ্রবাদ বা জাতপাতের বিভাজনকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ও বিহার হয়ে ওঠে ধর্মীয় ও জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতির জঘন্যতম উর্বর ক্ষেত্র। পরিচিত মাফিয়া ডনরা তাদের বাহুবল ও অস্ত্রের জোরে একেকটি পার্টিকে ধরে ব্যাপক হারে বিধায়ক ও সাংসদ হতে শুরু করে। অর্থ, কালো টাকা ও সরকারি কোষাগারকে লুঠ করে প্রায় সারা দেশ জুড়েই গণতন্ত্রের নামে রাহাজানি ও মোচ্ছব এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়। এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও গণরোষও বাড়তে থাকে। পাশাপাশি, দুর্নীতি এক ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। দিল্লি সহ কিছু কিছু রাজ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পথে নেমে ব্যাপক মানুষ তাদের ক্ষোভের জানান দেয়। এই সার্বিক অবস্থায়, রাজনৈতিক দলগুলির তীব্র খেয়োখেয়ির মধ্যে, জাতপাত ও ধর্মকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত বাদানুবাদ ও খুন-খারাপির মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ চাইছিলেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে। দৈনন্দিন রুটি-রুজির সমস্যা, সরকারি অলিন্দে তীব্র দুর্নীতির মুখে হেনস্থা  হওয়া ও প্রায় সর্বত্র ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে গরিবদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও হানাহানি - এই পঙ্কিল রাজনীতির আবর্ত থেকে নিজেদের বের করে আনার এক দুর্দমনীয় বাসনা সাধারণ মানুষকে পেয়ে বসেছিল। সাম্প্রতিক কালে তাই, যেখানেই রুটি-রুজির সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কোনও দল কিছু বলতে বা করতে চেয়েছে সেখানেই আমজনতা তাদের ওপর আস্থা রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতার রাজনীতিতে তেমনই ডাক ছিল, বিহারে নীতিশজীও তাই বলেছেন, দিল্লিতে কেজরিওয়ালও সেই পথ ধরেই এগিয়েছেন। মানুষ এই রাজনীতিতে সায় দিয়েছেন।

অর্থাৎ, ‘রোটি কাপড়া অউর মকান’এর রাজনীতিই চাইছে আবার মূল কেন্দ্র হতে। বিজেপি আপাতত এই রাজনীতিকেই মূল করে এগোতে চাইছে। ক্লান্ত উত্তরপ্রদেশবাসী জাতপাত ও ধর্মের ক্লিশে রাজনীতি থেকে মুক্তি চেয়েছেন। জাতপাত, লিঙ্গ, ধর্ম নির্বিশেষে তারা বিজেপিকে এবার উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সক্ষমতাই যে অন্যান্য বিভেদ থেকে মুক্তির অনেকটা সহায়ক তা মানুষ জানেন। বিজেপি যদি ধর্মের জিগির তুলে এই আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিহত করতে চায় তবে তার পতন আবারও সুনিশ্চিত। কারণ, অন্যান্য দলের মতোই বিজেপিও ধর্মকে কাজে লাগাতে সিদ্ধহস্ত। মানুষের চাপ ও আকাঙ্ক্ষা এবং ভোটে বদলে দেবার সক্ষমতা মানুষকে কিছুটা হলেও পরিসর দিয়েছে নিজেদের চারপাশটাকে আংশিক পালটাতে। আর নির্বাচন যেহেতু এখন বছরওয়ারি মোচ্ছব তাই অশ্বের লাগাম কিছুটা হলেও জনতার হাতে। অবশ্য, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় কিছুই হয় না, একে ভেঙ্গে ফেলতে হবে (ফেলে কী হবে কে জানে) - এই মত পোষণকারীরা দিনে দিনেই সংখ্যালঘুতর হচ্ছেন, তাই তাদের কথার তেমন প্রতিধ্বনি আর জনতার মধ্যে ওঠে না। নানা ভাবে শাসকের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দাবি আদায়ে আগামী দিনে জনতা শাসকের লাগামটা আরও বেশি করে নিজেদের হাতে নিতে পারবে বলেই মনে হয়।        

2 comments:

  1. Rational thinking, indeed interesting. The new trend is phenomenal, there lies a lot scope of political research on this new breed of political culture.

    ReplyDelete
  2. খুব স্কেচি একটা চিত্র, অনেকটাই অস্পষ্ট। শুধুই জাতপাতের ইস্যুতে ভোট হয়নি মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ রূপায়নের চেষ্টার পর। আর দেশের সামগ্রিক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখ বাদে এমন একটি মন্তব্য অনেকার্থেই বাতিল হয়ে যায়। মণ্ডলের সঙ্গে কমণ্ডলের বিরোধ কি লেখগ হিন্দুত্বের স্বার্থে এড়িয়ে গেলেন? হয়তো জমানা সেই দিকে বলে তিনিও ঘুরছেন। অতিবামদেরই দেখছি গেরুয়া ধারণ করতে নয়তো সবুজবাদী হতে।

    ReplyDelete