Sunday 25 September 2016

; (সেমিকোলন) যখন একটি আন্দোলন

জীবনে যখন অর্ধ বিরাম চাই (;)
মোনালি রায়

একজন বেলজিয়ান আর্টিস্ট বলেছিলেন, 'হাওয়ার মধ্যেই সব আকার আছে। আমরা সেগুলোকে আমাদের মতো করে ধরার চেষ্টা করি, আর সেইসব আকার গুণানুপাতে বাড়তে থাকে।'

অবসাদ এই হাওয়ার মধ্যে ভেসে থাকা আকারগুলোর মতো। চোখে দেখা যায় না, অনুভূত হয়। আর, একটু সুযোগ পেলেই দ্বিগুণ, চতুর্গুণ.... গুণানুপাতে বেড়ে যেতে থাকে।

আমরা ভারতীয়রা হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার নিয়ে তবু কিছুটা সচেতন, অবসাদ নিয়ে নই! অথচ, একদিকে ক্রমাগত একা হতে থাকা শহুরে জীবন আর অন্যদিকে ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকা মেটিরিয়ালিস্টিক টার্গেট ভেতরে ভেতরে আমাদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। অনেক এক্সপোজার, অজস্র হাতছানি কিন্তু মনের ঘরে কেউ নেই। কোনও বিশ্বাসী হাত চিরকাল আগলে রাখবে এমন আশা বা আশ্বাস নেই!

সব থেকে মুশকিল, অবসাদের কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। মন নিজে নিজে কোনও না কোনও কারণ খুঁজে নিয়ে কালো অন্ধকার তলহীন গহ্বরে কখন ঝাঁপ দিয়ে ফেলে নিজেও জানে না! হাজার হাজার অবয়বহীন কারণ - সুযোগ পেলেই আমাদের এক ভয়ংকর নিরাকার  অবসাদের গর্তে ফেলে দেয়.... যার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতেই জীবনীশক্তি শেষ! ডাক্তার দূর, নিজেকে নিজে বোঝা যায় না। ভরসাযোগ্য হাত পাওয়া যায় না! অচেতনে চলে যায় প্রাণ...  অসময়ে।

আমার এক বন্ধু ডিপ্রেশনে ভুগত জানতাম। কম বেশি আমরা সবাই ভুগি। অফিস আর বাড়িতে কাজের চাপ, টেনশন। যখনই ফোন করত,  অনর্থক বেশি কথা বলত! আমরা, ওর তথাকথিত বন্ধুরা, ভয়ে এড়িয়ে চলতাম। ওর সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছিল।  সম্প্রতি ও আত্মহত্যা করেছে। আজ ভাবি, ওর আবোলতাবোল কথাগুলো যদি একটু মন দিয়ে শুনতাম! যদি আর একটু ধৈর্য নিয়ে আমরা  ওকে বোঝার চেষ্টা করতাম! এই অকাল মৃত্যুর জন্যে নিজেকে কেমন যেন কিছুটা হলেও দায়ী মনে হয়।

একটা মৃত্যু কিছুটা হলেও আমাদের পাল্টে দিয়েছে। আমরা, পুরনো বন্ধুরা, পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছি। তবু, যতটা পারি, জুড়ে জুড়ে থাকার চেষ্টা করি। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মতো সাইটগুলোর কিছু ভাল দিক তো আছে। ইচ্ছে করলে, হাওড়া, দিল্লি, দোহা, মেরিল্যান্ড'এর ভারচুয়াল হাত একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতেই পারে, রাত দুটোয় বা বিকেল পাঁচটায়। যখন প্রয়োজন! সেমিকোলন আন্দোলন কতটা বহির্মুখি জানি না। আমরা চেষ্টা করতে পারি অন্তর্মুখি সেমিকোলন হবার... একে অন্যের প্রতি সচেতন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে।

তবু, আমাদের বাবা-মা  ভরসার জায়গা ছিল। আমার কয়েকজন বন্ধুকে  তাদের মা অথবা বাবা মারা যাবার পর চরম অবসাদে ভুগতে দেখেছি। এখনকার কচিকাঁচাদের তো সেই ভরসাও নেই। অনেক সংসার আইনত ভাঙা,  বাবা আর মায়ের দড়ি টানাটানির লড়াইয়ে ক্লান্ত অবসন্ন শৈশব। অথবা, ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়া বাবা মার পাশে নাজেহাল কৈশোর।  এদের ভরসা টেডি, টুথ ফেয়ারী, সান্তা ক্লস, ইস্টার বানি, স্যান্ড ম্যান বা জ্যাক ফ্রস্টে। এরা একা একা বড় হচ্ছে, অবসন্নতার বিরুদ্ধে এদের প্রতিদিনের লড়াই। কেন যে আমরা সচেতন নই!

আজ, আমরা প্রত্যেকে বিপন্ন। হাওয়ায় ভরে আছে নিরাকার অসুখের বীজ। নিজেদের প্রতি, একে অন্যের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতিশীল হতে কী আমরা পারি না! একটা অবসন্ন প্রাণ, আমরা একটু চেষ্টা করলে বাঁচাতেই পারি। আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে যারা আত্মহত্যাকে বেছে নেয়, সেই বিপন্ন, মানুষ আপনার বা আমার খুব কাছের। না বুঝে, হয়তো এখনও তাদের অবহেলা করছি! নীরব অবসন্নতার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ সেমিকোলনের যুদ্ধ ঘোষণার সময় এসে গেছে....

এই লেখাটা পড়তে গিয়ে যখন আপনি আপনার সময় নষ্ট করছেন, তার মধ্যে হয়তো কোনও বিপন্ন মন আপনাকেই খুঁজছে! দিনের আলোয় কোনও মিছিলে সে আপনার সাথে গলা মেলাতে পারবে না। আপনাকেই নিঃশব্দে তার অন্ধকারের ভাগ নিতে হবে।

No comments:

Post a Comment