Thursday 16 June 2016

কথোপকথনে ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন

নতুনের জন্ম?
মৈনাক মাইতি
সম্প্রতি (৯ই জুন) কলকাতার ভারত সভা হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল 'কথোপকথনে ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন: নতুনের জন্ম?' শিরোনামে একটি সেমিনারমূলক উদ্যোগ । সেমিনারটির উদ্যোক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্সি  বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী দেবর্ষি চক্রবর্তী, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে গবেষণারত বন্দনা মণ্ডল এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরে পাঠরত শ্রমণ গুহ। বন্দনা দেবর্ষী শ্রমণ ছাত্র-যুব-সামাজিক পরিসরে বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সব আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে সেগুলির সক্রিয় মুখ। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজ্যের বাইরে দেশের নানান প্রান্তের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা ১৭ জন সংগঠকের বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসজনিত অনিবার্য কারণে দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সদস্য শেইলা রশিদ এবং রামা নাগা এসে উঠতে পারেননি। ফলে, মোট ১৫ জন সংগঠক বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বর্ধমান, কলকাতা, প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, বারাসাত, সেন্ট জেভিয়ার্স, আইআইইএসটি, জেএনইউ, এইচসিইউ সহ অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকেরা। এছাড়াও নাগরিক সমাজ তথা নাগরিক আন্দোলনের নানান পরিচিত মুখ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠান শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ছাত্র শুভম কাঞ্জিলালের ম্যান্ডোলিন বাজানোর মধ্যে দিয়ে। এরপর সংগ্রামী, ব্রিটিশ-বিরোধী দলিত যোদ্ধা বীরসা মুণ্ডার প্রয়াণ দিবস এবং তরুণ দলিত গবেষক ও জাতভিত্তিক শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম শরিক রোহিথ ভেমুলার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন দেবর্ষি। তারপর একে একে বক্তব্য রাখেন পণ্ডিচেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দ্রজিত, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দেবাশিস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃষা, ইএফএলইউ'এর কুণাল, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিপু, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভম, জেএনইউ'এর ঈশান, প্রেসিডেন্সি'র গবেষক বিবস্বান, জেএনইউ'এর জিগীষা, হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্‌কন্যা, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সৌভিক, আইআইএসসি-র প্রকাশ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ক, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বর্ণেন্দু, যাদবপুর সায়েন্স-এর রাণা আবির এবং যাদবপুর আর্টসের শ্রমণ। শেষে দেবর্ষি সমস্ত বক্তব্য থেকে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সাধারণ বিষয়গুলিকে গোছ করে বক্তব্য রেখে অনুষ্ঠান শেষ করেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে যে বিষয়টি কম-বেশি সকলের বক্তব্যেই আসে তা হল - বর্তমান সময়ের দেশজোড়া ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলন শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের দৈনন্দিন বিভিন্ন ইস্যু, ক্যাম্পাস অগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে তা নয়, এর সাথে যুক্ত হচ্ছে লিঙ্গবৈষম্য মুক্ত, জাত-বর্ণের ভেদ-ভাব মুক্ত, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতামুক্ত, প্রাদেশিকতাবাদ মুক্ত, বিকল্প যৌনতার অধিকার যুক্ত ক্যাম্পাস তথা সমাজ গড়ার জন্য লড়াই; ফলত, আন্দোলন-লড়াইয়ের পরিসর আরও উন্মুক্ত ও ব্যাপ্ত হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আরও বেশি করে নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসছেন, ফলে সাধারণ সভা বা জেনারেল বডি (সংক্ষেপে জিবি) আরও বেশি বেশি করে আন্দোলনের সংগঠক হয়ে উঠছে। পরিচিত রাজনৈতিক শক্তি বা পতাকাগুলির বাইরেই মূলত আজকের আন্দোলনগুলি সাধারণ আম-পড়ুয়াদের নেতৃত্বে বিকাশ লাভ করছে, এটা একটা নতুন বিষয় - এমন মতামতও বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসে। আবার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে সচেতন অংশের ভূমিকা নিয়েও নানান ভিন্ন মতের আদানপ্রদানে জমে ওঠে 'কথোপকথন'। 'হোক কলরব'-এর পীঠস্থান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সকলের বক্তব্যেই 'হোক কলরব'-যাপন থেকে শেখা দিকগুলো উঠে আসে।  অধিকাংশ আন্দোলন সংগঠকের বক্তব্যে আন্দোলনকে দেখার প্রশ্নে তাদের অনুভূতিপ্রবণতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। প্রায় সকল বক্তার বক্তব্যেই উঠে আসে যে এই মুহূর্তে সামাজিক অন্যান্য পরিসরের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় বিপদ ফ্যাসিবাদী সঙ্ঘ পরিবার-বিজেপি নেটওয়ার্ক এবং শিক্ষার গেরুয়াকরণ প্রসঙ্গ। ফলত, বিভিন্ন আন্দোলনগুলির এই প্রশ্নে জোট বাঁধার প্রসঙ্গটিও জোর দিয়ে উত্থাপিত হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে চাওয়া আজকের ছাত্র-যুব আন্দোলনগুলির মধ্যে কথোপকথন আরও অনেক বিস্তৃত ও গভীর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলেই এবং এই উদ্যোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা নেবার কথাও উঠে আসে। দীর্ঘ সময় ধরে সভা চললেও শেষ অবধি সভাগৃহ পূর্ণ ছিল - আলোচনাসভাটির সফল হবার এটাও একটা দিক।

No comments:

Post a Comment