Ekak Matra একক মাত্রা

The most popular blog of our bi-monthly magazine (একক মাত্রা) in Bangla on contemporary socio-economic and cultural issues.. মগজে দিন শান/ নয়তো মিলিয়ে যান... Also visit our online version: https://www.ekakmatra.in

Monday, 31 May 2021

'ভারত পথিক'

একবিংশ শতকের ভারত কি তাঁর নাগাল পেয়েছে?

শোভনলাল চক্রবর্তী


রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মদিনের বর্ষব্যাপী উদযাপনের সূচনা হল ২২ মে ২০২১ থেকে। রামমোহন রায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 'তিনি ছিলেন একক, তিনি ছিলেন নিন্দিত।' বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে অপরকে পথ দেখিয়েছিলেন, যে পথে হেঁটে ধর্ম ও জাতির উর্ধ্বে উঠে এক রাষ্ট্র হয়েছিল ভারত। সেই বিপদসঙ্কুল যাত্রা আজও শেষ হয়নি। 

সাধারণত ঐতিহাসিক চরিত্র আলোচনা করতে বসলে যে প্রশ্নটা প্রথমেই উঠে আসে সেটা এই যে, তিনি কি আজও প্রাসঙ্গিক? কিন্তু রামমোহনের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। সন্দেহ জাগে, একবিংশ শতকের ভারত কি এই মহামানবের নাগাল পেয়েছে? তাঁর দৃষ্টির উদারতা, চিন্তার স্বচ্ছতা, তাঁর সহজ মানবিকতা, আপসহীন নৈতিকতা এবং সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টির দ্বারা পরিচালিত তাঁর ধর্মবোধ- কতটুকু অনুসরণ করতে পেরেছে আধুনিক ভারত? নাগরিকের স্বাধীনতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে তিনি শাসকের সঙ্গে যেমন লাগাতার লড়াই করে গেছেন, আবার তেমনই সমাজের অচলায়তন ভাঙতে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। সংস্কারের এমন সার্বিক প্রচেষ্টার উদাহরণ কটাই বা আছে আমাদের সামনে? যে কোনও বড় মাপের মানুষকে বোঝবার চেষ্টাই আসলে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো, বিশেষ করে যখন ওই মানুষটির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বহু তথ্য হারিয়ে গেছে। তবু আমরা হাল ছাড়ি না। 

রামমোহনের নিজের লেখা বই, পুস্তিকা, প্রচারপত্র, তাঁর বক্তৃতার অনুলিপি ইত্যাদি মিলিয়ে যা রয়েছে, তাতেও কিন্তু মানুষটা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য নেহাত কম নয়। সেই সব তথ্যকে হাতিয়ার করে আশা করা যায়, সমাজ তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনি আর ধারণাগুলোকে অতিক্রম করে তাঁর চিন্তার গভীরতায় প্রবেশের চেষ্টা করবে। সমাজ সংস্কারের চেষ্টার পেছনে তাঁর যুক্তিগুলোকে মানুষ গ্রহণ করবে। এখানে একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। সতীদাহ প্রথা রোধে রামমোহনের যে উদ্যোগ, সে সম্পর্কে আজও আমাদের মনে ধারণাটা এই যে, কয়েকজন ধর্মান্ধ মানুষের হাত থেকে নারীদের উদ্ধার করাই ছিল রামমোহনের মহত্তম উদ্দেশ্য। এখন যখন সতীপ্রথা, কুলীনপ্রথা ঘুচে গেছে, তখন যেন রামমোহনও চলে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এই ধারণা যে কতটা ভ্রান্ত সেটা যাঁরা রামমোহন পাঠ করেছেন তাঁরা বুঝবেন। 

রামমোহন লিখে গেছেন যে, সতীদাহ এবং বহু বিবাহের মূলে রয়েছে উত্তরাধিকারের আইন ও রীতি। তাই নারীর সম্পদ বঞ্চনা যতদিন থাকবে, ততদিন চলবে রামমোহনের যুদ্ধ। আজ প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে আধুনিক আইন যুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু ক্ষমতা ও বিত্তের জোর এতটুকু কমেনি। পুরুষতন্ত্রকে নস্যাৎ করার পৌরুষ রামমোহনের মতো আর কার আছে? 'একটি যুদ্ধ চলিতেছে। তাহার এক দিকে যুক্তি, শাস্ত্র এবং সাধারণ বুদ্ধি, অপর দিকে বিত্ত, ক্ষমতা এবং পক্ষপাত'- কথাগুলো রামমোহন রায় বলেছিলেন ১৮৩১ সালে। অথচ পড়লে মনে হয়, আজও তো সেই যুদ্ধ চলছে। তিনি লন্ডনে উদারপন্থী, যুক্তিবাদী 'ইউনিটারিয়ান' খ্রিষ্টানদের সামনে এক ভাষণ দিতে গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। ওই ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে বিবেক ও বিচারের আলোকে উজ্জ্বল ধর্মবুদ্ধির জয় হবে। পরাজিত হবে রহস্য দিয়ে সত্যকে গোপন করে রাখার, মানুষকে ভুলিয়ে রাখার অপচেষ্টা। 

রামমোহনের  জন্মের ২৫০ বছর হয়ে গেল, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর হতে চলল, কিন্তু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আজও ধর্মের মহিমায় দেশবাসীকে ভুলিয়ে রেখে রাজনীতি পরিচালনা করতে চায়। ক্ষমতা, বিত্ত এবং ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আজও যুদ্ধ করতে হচ্ছে দেশের অগণিত মানুষকে। তাঁদের উপর যে অপমান, পীড়ন ও হিংসা নেমে আসছে তার বেদনা আজ থেকে বহু বছর আগে সর্বপ্রথম অনুভব করেছিলেন রামমোহন রায়। পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে শাসক, যাজক পর্যন্ত-  সমস্ত অভিমুখ থেকে তাঁর উপর অবিরাম আঘাত নেমে এসেছিল। কিন্তু তিনি নিজের লক্ষ্য নিজেই স্থির করেছিলেন এবং সেই লক্ষ্য থেকে কখনও নিজেকে বিচ্যুত করেননি। 

বিত্ত, ক্ষমতা এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়াও যে বিষয়টি নিয়ে রামমোহন রায় আজীবন লড়াই করে গেছেন তা হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ভারতের সংবাদপত্রের জন্মকালের তিনি একজন প্রাণপুরুষ এবং সংবাদের স্বাধীনতার যুদ্ধেও তিনি পথিকৃৎ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কলম ধরার ফলে এক ইংরেজ সম্পাদকের দেশ ছাড়ার হুকুম জারি হলে, রামমোহন রায় সেই হুকুমের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কাছে বিতরণের জন্য একটি পুস্তিকা পত্রে তিনি লেখেন, 'স্বৈরাচারী শাসক স্বভাবতই বাকস্বাধীনতা হরণ করিতে চাহে। কিন্তু সাম্রাজ্যের কোথায় কী ভ্রান্তি ঘটিতেছে তাহা শাসকের অগোচরে থাকিবে, যদি না ব্যক্তির মতপ্রকাশের বাধাহীন স্বাধীনতা থাকে।' আজকের ভারতে সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খুলে। বিশ্ব জুড়ে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। 

রবীন্দ্রনাথ রামমোহন রায়কে বলেছিলেন 'ভারত পথিক'। কিন্তু ভারত কি তাঁর দেখানো পথে চলছে? এই প্রশ্নের উত্তর হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। আধুনিক ভারত যদি গড়তে হয়, তবে 'ভারত পথিক'-এর পথে চলা জরুরি। সেই পথ খোঁজার এই এক আদর্শ সময়। আমরা আশা করব তাঁর ২৫০তম জন্মবার্ষিকীর উদযাপন শুধুই ফুলের মালা আর ধূপের ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে যাবে না। তাঁকে নিয়ে শুরু হবে এক বৌদ্ধিক চর্চা, যা আগামীর দিনে নতুন পথের সন্ধান দেবে অসহায় মানুষকে।


Posted by Ekak Matra at 20:04 1 comment:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Sunday, 30 May 2021

মানুষ যাবে কার দ্বারে?

'নো ভোট টু বিজেপি' কি 

মৌলিক সমস্যাগুলির দিকেও তাকাবে?

অশোকেন্দু  সেনগুপ্ত
 


'নো ভোট টু বিজেপি' নিছক কোনও সংগঠন নয়, একটা আন্দোলনের নাম। এমন আন্দোলন এপার বাংলার মানুষ দেখেনি বহুকাল, অন্তত প্রায় ১৩-১৪ বছর (সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন বিবেচনায় রেখে বলছি)। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে পথে নেমেছে, সভা করেছে নিজের নিজের হাজারও দুঃখ, অভিমান, অভিযোগ বুকে চেপে।
 
অন্যদিকে, একই সাথে এই আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের বহু রকমের সামাজিক দৃষ্টি ও  রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সীমাবদ্ধতা। আবার, সমবেত উদ্যোগ আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যে পৌঁছে দিতে পারে, সে আত্মবিশ্বাসও এই আন্দোলন ফিরিয়ে দিয়েছে। 
 
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কী? 
 
দিল্লি-পাঞ্জাব সীমান্ত অঞ্চল থেকে এসেছিলেন কিছু কৃষক নেতা। তাঁরা এবং আমরা সবাই এক সুরে বলেছি, এই অপশাসনের অবসান চাই, ফ্যাসিবাদের অবসান চাই, চাই বহুস্বর গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। এসবের জন্য চাই 'নো ভোট টু বিজেপি'। ২০১৯-র ভুল যাতে আমরা আর না করি তারই জন্য এই উদ্যোগ, কোমর বেঁধে আসরে নামা। এই উদ্যোগ মনে করিয়ে দেয় মার্টিন লুথার কিং-এর সেই আন্দোলন। কালো মানুষদের অধিকার  প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। 
 
মুশকিল বা পার্থক্যও আছে। এ তো কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার লড়াই ছিল না, এই  লড়াই ছিল সব শ্রেণির, সব পেশার, সব ধর্মের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই।
কিন্তু, এই কী শেষ? ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতেই কী শেষ হবে এমন আন্দোলন? সেই কি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য? একমাত্র লক্ষ্য? সংগঠন যা বলার বলেছিল, আমরা সাধারণ মানুষ কী তাই চেয়েছিলাম? মনে প্রশ্ন ছিল: কোথায় আমাদের পৌঁছে দেবে এই আন্দোলন? এই আন্দোলন আমাদের সমাজ জীবনে, রাষ্ট্র জীবনে স্থায়ী ছাপ ফেলবে তো? আন্দোলন শেষে আমরা সংস্কারমুক্ত হব- হব তো? সাম্প্রদায়িক ভাবনা (ধর্ম, জাতপাত) মুক্ত সমাজ পাব তো? ফ্যাসিবাদের পতনেই খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার সমস্যা মিটবে?
মনে পড়ছে মিলখা সিং ও তার চোর ধরার গল্পটা। এত জোরে দৌড়লেন তিনি, কখন যে চোরকে পার হয়ে গেছেন তা খেয়ালেই রইল না। কাল্পনিক এক অবাস্তব গল্প। 'নো ভোট টু বিজেপি' আন্দোলন যেন তারই সাম্প্রতিক সংস্করণ হয়ে উঠল। সে তো কল্পনা নয়!

প্রশ্ন উঠেছিল বিজেপি নয় তা বুঝলাম, তো কাকে দেব ভোটটা? আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের কাছে এর জবাব ছিল না এমন নয়, ছিল, তবে তা নিয়ে মতান্তর বুঝি বেশি ছিল। তাই যে যার মতো বলেছিলেন। কেউ স্পষ্ট বলেননি কিছু। কৃষক নেতারাও না। হয়তো উদ্যোক্তাদের ঘোষিত বা অঘোষিত নিষেধ ছিল। সেই সব নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয় ঘাঁটলেই বোঝা যায় কেন তারা স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। 
বাংলার রায় প্রকাশ পেতেই বোঝা গেল, মানুষ যেমন চেয়েছিলেন প্রায় তেমনটাই ঘটেছে। অন্তত এই রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে ফ্যাসিবাদের ধ্বজা। বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বহু যোজন দূরে রইল। শাসকের আসনে ফের বসল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু, কিছু ব্যথাও রইল। বিরোধী দল হয়ে দেখা দিল বিজেপি। প্রধান নয়, তারাই এই বঙ্গে হয়ে উঠল একমাত্র বিরোধী দল। সঙ্গে আইএসএফ!

কেউ কেউ খুশি হলেও সকলে খুশি হতে পারেন না এই রায়ে। তাদের কেউ কেউ জীবনানন্দীয় ভাষায় প্রশ্ন করছেন: 'এই রায় চেয়েছিলে বুঝি'। কংগ্রেস নেই, বামেরা নেই। সব বামই তো 'বাংলা সিপিএম' নয়। সব বামেতেই তো সুজন-সেলিম নেই। সব বামই তো 'আগে রাম পরে বাম' তত্ত্ব বিশ্বাস করে না। কিছু জাতীয়তাবাদী মানুষ তো কংগ্রেস দলটিকে সমর্থন করে আজও। তারাও তো ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হতে চায়। সবার ঘর শূন্য।

গণতন্ত্র থাকলে, সেখানে শাসকের যা-ইচ্ছে-তাই সামলাতে থাকে বিরোধী পক্ষ। বিরোধী পক্ষ গণতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদের পথে টেনে নিতে বাধা দেবে শাসককে। এ তো সত্য। অন্তত এই রাজ্যে যে দলগুলি প্রধান বিরোধী আসনে বসেছে গত দশকে, তারা কার্যত ব্যর্থ। সফল হবার চেষ্টাই করেনি। তারাও সুযোগ এলে হয়তো গণতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদের পথে টেনে নিতে পারে। কিন্তু যে দলকে এবার  বিরোধী আসন দিলাম তারা নিজেরাই যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। আমাদের তা অজানা ছিল না।

কী হবে? অনেকেই হতাশ। লকডাউন গরিব, অতি নিম্নবিত্তের পেটে লাথি মারে- যিনি এই কথা অতি সহজে বুঝেছিলেন, তিনি এখন আরেকবার ক্ষমতা হাতে পেয়ে অতি সহজে আমলাদের কথা শুনে রাজ্য জুড়ে কার্যত লকডাউনের ফাঁস ঝুলিয়েছেন। তাঁরও কিছু সমস্যা নিশ্চয় আছে। শ্রেণিস্বার্থ? তাও পুরো সত্য নয়। রাজ্য জুড়ে করোনার দাপট রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে যে, ক্ষমতা হাতে পেয়ে তিনি (এখন ক্ষমতার অংশ) করোনাকে বাগে আনার যুদ্ধ ত্যাগ করতে পারেন না। তার ওপর 'ইয়াস'এর তাণ্ডব।

এমন যুদ্ধ হয় নাকি যেখানে প্রাণ যাবে না কারও! কিছু ক্ষতি তো হবেই। তাই এখন তিনি ডাক দিয়েছেন, পাশে থাকুন। যারা পাশে থাকবেন না তাদের অবস্থা কী হবে? না ঘরকা, না ঘাটকা! কে জানে! অন্তত তাদের জানার উপায় থাকবে না। যেমন বুলেট জানে না সে কার প্রাণ নিতে ছুটেছে। ওদিকে, যে বা যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে নির্বাচন শেষ হলেই কৃষকের ঘরে ঘরে টাকা ঢেলে দেবে, তারাও কথা রাখেনি। তাদের অযোগ্যতা ও সংকীর্ণতায় দেখছি মৃত্যু মিছিল। দেখছি নদীতে ভেসে যায় শব, দেখছি আর অপেক্ষায় আছি সেন্ট্রাল ভিস্তার! যে টাকা তারা বিধানসভা দখলে ঢেলেছে, তার কিছুটাও যদি ঝড় সামলাতে ব্যয়িত হত তবে স্বস্তি পেত মানুষ। হায় রে মানুষ! সত্য যে তোর পাশে দাঁড়ায় না।

জানতাম না এমন তো নয়, জানতাম যে সংসদীয় রাজনীতিতে মত্ত বর্তমান দলগুলি কেউই কথা রাখে না। তবু, মানুষ- অন্তত শহরাঞ্চলের বহু মানুষ বিত্ত, ধর্ম ভুলে বা সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন ঠেকাতে, বাংলার ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতি বাঁচাতে খানিক বাধ্য হয়েই 'নোটা' নয়, 'নো ভোট টু বিজেপি' স্লোগানে ভরসা রেখেছে, বিকল্প সন্ধান করেছে। তাদের অনেকে এখন জবাব চাইছে। জবাব দিতে পারত যারা তারা অনেকেই নিরুদ্দেশ, এই ভয়ংকর করোনা-কালে বা ঝড়জলের মধ্যে তাদের খুঁজতে যাওয়ার জন্য যে বেরবে মানুষ তারই বা উপায় কী? আপনি চাইলে মিষ্টি বা গহনা কেনার জন্য বেরতে পারেন, কিন্তু কাজে বেরনোর 'হুকুম' নেই। 'পাস' চাই। গাড়ি-ঘোড়াও নেই। অতএব, একা একা খোঁজ, একা হয়ে খোঁজ। পেটে কিল মেরে বসে থাকো তোমরা যারা নগরে-বন্দরে খেটে খাও, 'ভদ্রলোকের' বাড়ির বাসন মেজে খাও বা লেদ চালাও বা গেঞ্জি কারখানায় কাজ করো বা বই-বাঁধানোর কাজ করো।
 
যে সব রাজ্য থেকে কৃষক নেতারা এসেছিলেন, সে সব রাজ্যে অন্তত বর্তমানে, বামেরা কার্যত নেই। জাতীয়তাবাদীরা আছেন বটে, তবে তাঁরা আছেন নানা দল-উপদলে ভাগ হয়ে। তাই 'নো ভোট টু বিজেপি' ভুক্তদের সাময়িক তুষ্ট করতে তাঁদের তেমন অসুবিধা হয়নি। এখানে 'নো ভোট টু বিজেপি' নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলেছেন কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে হান্নান মোল্লার উপস্থিতি নিয়ে, চুপ থেকে মেনেছেন টিকায়েতের উপস্থিতি। কিন্তু বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী দল বিজেপি (আইএসএফ'এর উপস্থিতি নামেই)- তাই বা মানা যায় কী? কে বলবে? এই তো সেদিন এক আলোচনাসভায় 'নো ভোট টু বিজেপি' আন্দোলনের এক নেতা স্পষ্ট জানালেন যে, বিধানসভায় বিরোধী দল বিজেপি হওয়ায় বা কোনও বামমনস্ক প্রতিনিধি  না থাকায় তিনি কোনও সমস্যা দেখছেন না। তবে কী মানবো যে রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে সাধারণের?
এটা এই দেশের যে কোনও সংগঠনের রীতি। তারা সবেতেই দোষ দেয় মানুষকে বা ভোটারকে। এই সংগঠনও সেই পথ ধরবে?
 
এই যে আমরা 'ইয়াস'এর তাণ্ডব দেখলাম, এই তাণ্ডবকালেও কেন্দ্রের অমানবিক একদর্শিতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কারাগারে নেওয়া নিয়ে বিচারব্যবস্থার নানা প্যাঁচ-পয়জার বা মুখ্যসচিবকে নিয়ে যে টানাটানি, তাতে স্পষ্ট  যে বিজেপি রাজ্য সরকারকে স্বস্তিতে শাসন করতে দেবে না। বলবে কে? কে বোঝাবে তাদের যে সাপটা এখনও মরেনি, আহত হয়ে সে আরও শক্তিশালী মাটি খুঁজে লড়তে চায়, বিষ ঢালতে চায়। আসছে পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে নির্বাচন। সে সব রাজ্যের মানুষের কাছেও একই আবেদন 'নো ভোট টু বিজেপি' নিয়ে তাঁরা যাবেন কি? নিশ্চয় যাবেন (তাঁদের ঘোষণা তেমনই ছিল), কিন্তু সফল হবেন কী? পূর্ণ হবে কী আশা? তাও বুঝি সম্ভব হবে। বিজেপির নখ-দাঁত বিষ অস্ত্রাদি অনেক অনেক মানুষ দেখেছে, বুঝেছে। বুঝেছে মানুষটা কেবল নাটক করে, মিথ্যা বলে- দেশের কথা বা দশের কথা ভাবে না। সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য  নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো জানতে চাইবেই একদিন, কেন তোমরা রাষ্ট্রশক্তির অত্যাচার সইবে, কেন মানবে যে কেবল মোদী থেকে মুকুল রায় বা  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া আঘাত সয়ে সয়ে মানুষ সুন্দরবনে, পাহাড়ে, জঙ্গলে মনুষ্যেতর জীব হয়ে টিকে থাকবে ভোট নামের বিচিত্র উৎসবে যোগ দিতে? স্থায়ী সমাধান পাবে না?  কেন জাতপাতের সমস্যা থাকবে, কেন পাবে না সব মানুষ খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থের অধিকার, বাঁচার অধিকার, ভালবাসার অধিকার? গণতন্ত্র অবশ্যই চাই, কারণ পৃথিবীতে বারবার প্রমাণ হয়েছে যে স্বৈরতন্ত্র নয় গণতন্ত্রই মানুষকে বাঁচায়, সম্মান দেয়।
 
'নো ভোট টু বিজেপি' দেখবে না এই সমস্যাগুলি? তারা কী কেবল ভোট-রাজনীতি নিয়েই মত্ত থাকবে? মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলির দিকে তাকাবে না? মানুষের অন্তরে যে বিষ ঢুকে রয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ নেবে না 'নো ভোট টু বিজেপি' আন্দোলন? মানুষ তবে যাবে কার দ্বারে? 



Posted by Ekak Matra at 18:11 3 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Saturday, 29 May 2021

পুনরুদ্ধার সম্ভব

ইয়াসের ধাক্কায় কী আদিগঙ্গার কপাল খুলবে?

কৌস্তুভ বসু

 

বরাত জোড়ে বাঁচল কলকাতা। ইয়াসের গতিপথ একটু ডানদিকে বাঁক খেলেই কল্লোলিনীর কপাল পুড়ত। তারপরেও দেখলাম কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলে প্লাবিত। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে কলকাতার উপেক্ষিত জলপথ- বিশেষ করে শহরের লাইফলাইন হুগলি নদীর শাখা আদিগঙ্গা। 

এক সময় পূর্ব বাংলা (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবাংলার মাঝামাঝি এই প্রধান বাণিজ্য-যোগপথটিকে মেট্রো রেলের তলা থেকে পুনরুদ্ধারের দাবিতে বিস্তর আন্দোলন হয়েছে, তবে আখেরে লাভ কিছু হয়নি। অতএব, যে ঐতিহ্যবাহী নদীপথে চাঁদ সওদাগর একদিন নৌকো করে সমুদ্রে যেতেন, কিংবা বেহুলা লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে সাগরে গিয়েছিলেন, এখন সেখানে আবর্জনা-কাদায় একটা ঘটি পর্যন্ত পুরোপুরি ডোবে না। জীবন্মৃত শুয়ে আছে স্রেফ একটি নর্দমা! মজার কথা, কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রকের অধীনে ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’র অন্তর্গত ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৭ আগস্ট ২০১৭য় আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার বাবদ মোট ৩০৭.১২২ কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে। তবে এই কোটি অর্থের সৎকার কীভাবে হয়েছে বা হচ্ছে বা হবে, সে উত্তর মা গঙ্গাই জানেন। 

সোজা কথা, শহরের অন্যতম প্রধান জলপথের স্বাভাবিক গতি রোধ করে ও ভারী বর্ষণে বন্যার প্রবণতাকে উস্কে দিয়ে শহরের প্রশাসক মায় রাজনীতির অভিভাবকেরা একাধারে নিজেদের পায়ে যেমন কুড়ুল মারছেন, শহরবাসীকেও তেমন ঠেলে দিচ্ছেন চরম বিপদের মুখে। ইয়াসের ছোট্ট ধাক্কায় কী তাঁদের টনক নড়বে? 

কোথায় গেল ‘জলের মালা’  

ঘটনা হল, আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগেও, যখন সড়কপথের এত রমরমা ছিল না, তখন নদী-নালাই ছিল শহরের পরিবহন-ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আমাদের প্রজন্মের দুর্ভাগ্য, সেই সুন্দরী তিলোত্তমাকে দেখতে পেলাম না। এখনকার রাজনৈতিক অভিভাবকেরা মুখে ‘বিলাত’ নির্মাণের কথা বলেন; তবে বাস্তবে ব্রিটিশরা শহরটাকে যা দিয়ে গিয়েছে, সেটুকু ঐশ্বর্য রক্ষা করতেও এঁরা ব্যর্থ। শহরকে আঁকতে লাগে বিশ্বকর্মার চোখ, দূরদৃষ্টি আর ক্ষুরধার বুদ্ধি যা ছিল ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদদের। ভৌগোলিক ভাবে কলকাতা যে পূর্ব দিকে ঢালু, সে কথা মাথায় রেখে ওরা গোটা শহরটাকে তিনটি প্রধান জলপথে (বাগবাজার, বাগজোলা ও আদিগঙ্গা) বাঁধার পরিকল্পনা করেছিল। এই খালগুলি শহরের বর্জ্য-জল নিষ্কাশনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

সংক্ষেপে, বাগবাজার ক্যানাল সিস্টেম হুগলি নদীতে চিৎপুর লক থেকে জন্ম নিয়ে কৃষ্ণপুর খালের হাত ধরে ঘুষিঘাটার কাছে কুলটি নদীতে পড়েছে। অন্যদিকে বাগজোলা আড়িয়াদহ থেকে বেরিয়ে ঘুষিঘাটার কাছে কুলটি নদীতে মিশেছে। আর তৃতীয় আদিগঙ্গা, দইঘাট বা জিরাট ব্রিজের কাছে হেস্টিংসে হুগলি নদী থেকে বেরিয়ে খিদিরপুর, নিউ আলিপুর, টালিগঞ্জ হয়ে কুঁদঘাটের কাছে দুটো শাখায় বেঁকে একটি গড়িয়ার দিকে গিয়ে শামুকপোতায় পড়েছে ও অন্যটি ক্যাওড়াপুকুর খাল নাম নিয়ে ক্যানিং-এর দিকে গিয়ে মাতলা নদীতে মিশেছে। সব মিলিয়ে, হুগলি, কুলটি আর মাতলা নদীর মাঝে কলকাতাকে তিনটি জলপথ এমন বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে, দেখলে মনে হবে কল্লোলিনীর কন্ঠে যেন কেউ জলের মালা পরিয়ে দিয়েছে (ছবি দেখুন)। 

  ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদের হাতে আঁকা কলকাতার জলের মালার ব্লু-প্রিন্ট

নদীপথে বাণিজ্যের সুবিধের কথা মাথায় রেখে সাহেবরা এমন ভাবেই কলকাতা শহরকে সাজিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, আমাদের প্রশাসক ও রাজনীতির কারবারিরা সাহেবদের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন দূরে থাক, শহরের অকৃত্রিম সৌন্দর্যকে ধরে রাখতেও ডাহা ফেল। ঘন জনবসতি, সড়কপথে বাণিজ্যিক চাহিদা ও নগরোন্নয়নের জাঁতাকলে কালক্রমে হারিয়ে গিয়েছে তিলোত্তমার কন্ঠ-হার। এই মৃতপ্রায় খালগুলির সংস্কার কেবল কলকাতার সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করবে না, প্রবল বর্ষণে শহরকে জমা জলের হাত থেকে দিতে পারে পরম মুক্তি।

এভাবেও ফিরে আসা যায়

প্রশ্ন উঠতে পারে, মেট্রো রেলের তলা থেকে মৃত আদিগঙ্গাকে কীভাবে বাঁচানো যায়? আপাতভাবে ‘অসম্ভব’ ঠেকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্নেবেক বা এলওয়া নদী কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায় চোঙ্গিচোন নদী আশার কথাই শোনায়। কেন্নেবেক নদীর কথাই ধরুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম-কেন্দ্র মেইন রাজ্যে প্রবাহিত। মুজহেড হ্রদের মুখ থেকে জন্মে দক্ষিণ মেইন উপসাগরে মিশেছে। এর আশপাশে অনেক হেভিওয়েট শহর রয়েছে, যেমন ম্যাডিসন, অগস্টা, স্কোহেগান, ওয়াটারভিলি ইত্যাদি। ১৮৩৭ সালে মূলত নৌবহন ও শক্তি উৎপাদনের সুবিধার্থে অগস্টায় এই নদীর বুকে এডওয়ার্ড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পূর্বে এখানে নানান প্রজাতির পরিযায়ী মাছ পাওয়া যেত, যেমন আটলান্টিক স্যামন, আমেরিকান শ্যাড, অনেক ধরনের হেরিঙ, অ্যালেওয়াইফ, সর্টনোজ, আটলান্টিক স্টার্গিয়ন ইত্যাদি। বিশাল বাঁধ নির্মাণের ফলে গোটা নদীর প্রতিবেশ একেবারে বদলে যায়। পাশাপাশি এডওয়ার্ড বাঁধের সাহায্যে প্রায় ৩.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হত, যা মেইনের মোট বিদ্যুতের এক শতাংশের এক দশমাংশেরও কিছুটা কম। অতএব, এই বাঁধের ফলে লাভ বই ক্ষতিই বেশি হত। এডওয়ার্ড বাঁধ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করত ফেডেরাল এনার্জি রেগুলেটারি কমিশন (এফইআরসি) এবং পরিবেশের সুরক্ষার্থে এরা এক ফোঁটাও বিধিনিষেধ মানত না। অতএব, কেন্নেবেক নদীর প্রতিবেশ বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এডওয়ার্ড বাঁধ কেন্নেবেক নদীর গলায় একপ্রকার ফাঁস হয়ে আটকেছিল। 

১৯৯৩ সালে এফইআরসি’র বাঁধ নিয়ন্ত্রণের ছাড়পত্রের মেয়াদ ফুরোলে নদী উদ্ধারে আসরে নামে চারটি পরিবেশ সংস্থা – আমেরিকান রিভার্স, মেইনের প্রাকৃতিক সম্পদ কাউন্সিল, আটলান্টিক স্যামন ফেডারেশন এবং ট্রাউট আনলিমিটেড ও তাদের কেন্নেবেক ভ্যালি শাখা। অবশ্যই কাজটি খুব একটা সহজসিদ্ধ ছিল না। অনেক টালবাহানার পর ২৫ নভেম্বর ১৯৯৭ এফইআরসি এডওয়ার্ড বাঁধ সরিয়ে ফেলার নির্দেশ জারি করে। ১ জুলাই ১৯৯৯- বাঁধটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়। বাঁধের ভাঙনে বন্ধ নদী খেলে ওঠে। ফিরে পায় স্বাভাবিক প্রবাহ, ছন্দ। এরপর দেখা যায় ম্যাজিক। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নদীতীর সুফলা হয়ে ওঠে। ফিরে আসে অ্যালেওয়াইফ মাছের দল। দশ বছরের মধ্যে লক্ষাধিক মাছ কেন্নেবেক নদীতে বংশ বিস্তার করে। নদীটার গোটা বাস্তুতন্ত্রটাই আমুল পালটে যায়। নদীর জলের স্বাভাবিক প্রবাহে ঈগল থেকে শুরু করে বক, এমনকী কালো ভালুক প্রত্যেকে উপকৃত হয়। জলের মানও ব্যাপক উন্নত হয়। কেবল নদী নয়, নদীর সন্নিকটস্থ এলাকার চেহারাটাও পালটে যায়। নদীর সামনে প্রায় ১৭ একর জমিতে বাঁধ ও একটা টেক্সটাইল কারখানা ছিল। এখন সেখানে মুক্ত উদ্যান। এখানে গ্রীষ্মকালে কার্নিভাল হয়, প্রতি সপ্তাহে চাষীদের হাট বসে। সব মিলিয়ে এডওয়ার্ড বাঁধের বিদায়ে পুনর্জীবন লাভ করেছে কেন্নেবেক নদী।    

এলওয়া নদীর ফিরে আসার গল্পটাও আকর্ষণীয়। বাহাত্তর কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটনে অলিম্পিক পেনিনসুলায় প্রবাহিত। বিশ শতকের গোড়ায় এলওয়া নদীর উপর তৈরি হয় এলওয়া ও গ্লাইন ক্যানিয়ন বাঁধ। মূল উদ্দেশ্য, নিকটবর্তী পোর্ট এঞ্জেলেস শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের ফলে সব থেকে বিপাকে পড়ে স্যামন মাছ। ১৯৮০-র মধ্যে সমগ্র প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট অঞ্চলে স্যামনের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমতে থাকে। এছাড়াও জলের নাব্যতা কমে ও নদীর আশপাশের এলাকায় বানের জল উঠে আসে। এক কথায় জোড়া বাঁধ নির্মাণে এলওয়া নদীর গোটা বাস্তুতন্ত্রটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবর্তন আসে ১৯৯২-এ। পাশ হয় ‘এলওয়া রিভার ইকোসিস্টেম অ্যান্ড ফিসারিজ অ্যাক্ট’। এই আইনে নদীর উপর থেকে এলওয়া ও গ্লাইন ক্যানিয়ন বাঁধ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রায় দু’ দশকের পরিকল্পনার পর ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১'য় মার্কিন মুলুকের সব থেকে বড় বাঁধ ধ্বংসের কাজ শুরু হয়। এলওয়া বাঁধ ভাঙতে প্রায় ছ’ মাস লাগে। ২০১৪য় ভাঙা হয় গ্লাইন ক্যানিয়ন বাঁধ। আজকে এলওয়া নদী পুরোপুরি মুক্ত। ফিরে এসেছে হারিয়ে যাওয়া স্যামন। পোকামাকড় থেকে শুরু করে, পাখি, মাছ, এমনকী বড় স্তন্যপায়ী, প্রায় একশো তিরিশ রকম প্রজাতির জীব নির্ভর করে স্যামনের উপর। অতএব স্যামনের প্রত্যাবর্তনে এলওয়া নদীর গোটা বাস্তুতন্ত্রটাই বদলে গিয়েছে। 

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সাওলে প্রবাহিত প্রায় এগারো কিলোমিটার দীর্ঘ চোঙ্গিচোন নদী যেন ফিনিক্স পাখি। এই নদী মাঝপথে হাত ধরেছে হ্যান নদীর, তারপর মিশেছে হলুদ সাগরে। ১৯৫০-৫৩-এ কোরিয়ার যুদ্ধের পর অসংখ্য মানুষ চোঙ্গিচোনের ধারে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়। এই সময় দৈনন্দিন আবর্জনা, বালি, পলি ইত্যাদি জমতে জমতে নদীটা ক্রমশ একটা নোংরা নালায় পরিণত হয়। শহরের উন্নয়নে সাওল সরকার সিদ্ধান্ত নেয় নদীর উপর রাস্তা গড়বে। পার্ক চাঙ হি’র আমলে ১৯৫৮ থেকে শুরু করে প্রায় কুড়ি বছর ধরে চোঙ্গিচোন নদীর উপর প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা ও ষোলো মিটার চওড়া রাস্তা বা হাইওয়ে তৈরি হয়। ধীরে ধীরে দক্ষিণ কোরিয়ার এই অঞ্চলটি হয়ে ওঠে শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের এক সার্থক বিজ্ঞাপন। 

২০০৩-র জুলাই মাসে সাওলের মেয়র লী মিউঙ বাক সিদ্ধান্ত নেন চোঙ্গিচোন নদী পুনরুদ্ধার করা হবে। এটি বাস্তব রূপায়ন মোটেই সহজ কাজ ছিল না, কারণ নদীটি ততদিনে মজে মরে গিয়েছিল। তবুও সাওল সরকার পিছিয়ে যায়নি। শহরের অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আনতে এবং পরিবেশবান্ধব নগর-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে মৃত নদী উদ্ধারে তারা ছিল বদ্ধপরিকর। গোটা কাজটা ঠিকঠাক দেখাশোনার জন্য সাওল মেট্রোপলিটান সরকার অনেকগুলি কমিটি গঠন করে। যেমন, গোটা প্রকল্পটি তদারকির দায়িত্ব ছিল চোঙ্গিচোন রেস্টোরেশন প্রোজেক্ট হেডকোয়ার্টারের কাঁধে। আবার নাগরিক কমিটির উপর ভার ছিল নদীর পুনরুদ্ধারের ফলে সাওল মেট্রোপলিটান সরকার ও শহরের বণিককুলের ভিতর বিবাদ মেটানো। একটা ব্যস্ত শহরের মধ্যে এত বড় প্রকল্পে কাজ করার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যানজট নিয়ন্ত্রণ। চোঙ্গিচোন রেস্টোরেশন প্রোজেক্ট হেডকোয়ার্টার এই কাজটি চমৎকার মুন্সিয়ানার সঙ্গে পালন করে। নদী উদ্ধারের পাশাপাশি শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ঐতিহাসিক সম্পদের সংরক্ষণ ছিল গোটা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই সূত্র ধরে চোঙ্গিচোন নদীকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক সেতুদ্বয় গোয়াঙটোঙ্গো ও স্যুপিয়োগো এবং হাঁটার জন্য অনেক পথ সংরক্ষণ বিশেষ গুরুত্ব পায়। সব মিলিয়ে পাক্কা দু’বছর পর ২০০৫’র সেপ্টেম্বরে নতুন জীবন নিয়ে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে চোঙ্গিচোন নদী। বেঁচে ওঠা নদীর বাস্তুতন্ত্রের খোলনলচে কেবল পালটে যায় না, সাওলের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চোঙ্গিচোন সংলগ্ন এলাকার তাপমাত্রা গড়ে প্রায় সাড়ে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। এক কথায়, একটা নদীকে কেন্দ্র করে একটা গোটা শহরের চেহারাই আমূল পালটে যায়।  

শেষ কথা

চুম্বকে কেন্নেবেক, এলওয়া কিংবা চোঙ্গিচোন নদী’র গল্প বলে, ইচ্ছে থাকলে সব সম্ভব। অতএব, মৃত আদিগঙ্গাকে এখনও বাঁচিয়ে তোলা যায়। একটা নদী কেবল একটা জলাশয় নয়, একটি শহরের ধমনী। ধমনীতে রক্ত চলাচল সহজে না হলে, যে রোগ দানা বাঁধে তাতে কেবল রক্তনালীর ক্ষতি হয় না, গোটা শরীরটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আদিগঙ্গার পুনরুদ্ধার গোটা শহরের ছবি পালটে দিতে পারে। কেবল নদীর বাস্তুতন্ত্র নয়, কলকাতা শহরের আর্থনীতিক চালচিত্র, মানুষের জীবনের মান বিপুলভাবে উন্নত হতে পারে। ইয়াসের খোঁচাকে ‘লাল সঙ্কেত’ মেনে ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদের হাতে আঁকা শহরের ব্লুপ্রিন্টকে মূলধন করে আমাদের প্রশাসকরা তাৎক্ষণিক ক্ষতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে দীর্ঘকালীন লাভের আশায় শহরের নদীপথ নিয়ে অবিলম্বে অন্য রকম ভাবুন। চাগিয়ে তুলুন জলপথে বাণিজ্যের সম্ভাবনা, বাঁচান কলকাতার প্রতিবেশ।          

ছবির সূত্র: এ কে ঘোষ। মার্চ ১৯৯৭। ক্যালকাটা এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি এন্ড অ্যাকসন প্ল্যান (সিইএমস্যাপ)।


Posted by Ekak Matra at 18:43 2 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Friday, 28 May 2021

চাওয়া-পাওয়া

জনতার মানসিকতা সরকারের কর্তব্যকর্ম

সঞ্জয় মজুমদার


'খেলা হবে' স্লোগানের ভাব বিশ্লেষণ কি শেষ হয়েছে? মনে হয় না। পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে-গলিতে, রাস্তার মোড়ে, গ্রামেগঞ্জে, শহরতলিতে, শহরে, মহানগরীতে সর্বত্র সর্বস্তরের বৈধ-অবৈধ পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য ২০২১'এর আট দফা নির্বাচনের উন্মাদনা থিতিয়ে এলেও, এই ভীষণ জনপ্রিয় আবহসঙ্গীতের ভাব-সম্প্রসারণ কিন্তু চলছেই। 

রাজভবনে শপথগ্রহণ, মন্ত্রীদের দফতর বন্টন ইত্যাদি সব বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক ক্রিয়াকলাপ যতটা সম্ভব কোভিড বিধি মেনে সম্পন্ন হওয়ার পর, আমরা ভাবছিলাম, এইবার বুঝি ভোটের রাজনীতিতে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্লান্তিহীন আকচা-আকচি কিছুটা নেপথ্যে চলে গেল। ভুল ভেবেছিলাম। একদম ভুল। প্রমাণ? প্রথমত নির্বাচন পরবর্তী অনিবার্য রাজনৈতিক হিংসা এবং দ্বিতীয়ত নারদ নারদ। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, দিল্লি, রাজভবন এবং নবান্নের বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে অনবরত ঠোক্কর খেতে থাকা, প্রতি মুহূর্তের মুঠো মুঠো নিউজ ফিডগুলো কিন্তু বৃহত্তর অর্থে ওই 'খেলা হবে' শিরোনামেই হার্ড বা সফট্ নিউজ, সম্পাদকীয় এবং বিশ্লেষণাত্মক লেখাজোখা দিয়ে কষিয়ে রান্না করে পরিবেশন করেই যাচ্ছে। কখনও সেই খেলার মধ্যমণি ভোটের রাজনীতি, তো কখনও কোভিড বা সুপার সাইক্লোন 'ইয়াস'। এর সাথে অডিও-ভিডিও, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ারও সক্রিয় অংশগ্রহণ তো আছেই। 

সচেতন ভাবেই উপরোক্ত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কোনওরকম চুলচেরা বিশ্লেষণে যাব না। বরং অন্যভাবে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করব। স্বেচ্ছায় কিছুক্ষণের জন্য রাজনীতি, অতিমারি এবং নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বাস্তবতাকে সরিয়ে রাখছি, জোরালো তিনটি প্রশ্ন নিজেকে করব বলে। তা হল, নাগরিক হিসেবে একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে আমি ঠিক কী চাই? কেনই বা চাই? এবং কতটুকু চাই? 

প্রশ্ন যখন আছে, অতএব উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করলাম‌। প্রচুর পত্রপত্রিকা, সরকারি-বেসরকারি বক্তব্য, আন্তর্জাল, বড়সড় ব্যবসায়িক সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন বেশিরভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন, প্রায় সম্পাদনাহীন সামাজিক মাধ্যমের অবিশ্রান্ত গল্পগাছায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে বুঝলাম- এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আর পরিষ্কার রাতের আকাশে তারা গোনা প্রায় একই ব্যাপার। নাগরিক চাহিদার তালিকাগুলো এক জায়গায় করে মোটামুটি যা বোঝা গেল, সকালে ঘুম থেকে ওঠা তারপর রাত্রে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবটাই একটা নির্বাচিত সরকার করে দেবে এটাই আমার এবং আমাদের চাহিদা। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে প্রশ্ন করে দেখেছি এর বিপক্ষে বলেন। যেমন, '...না না ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। একটা ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই সরকারের কাছে আমার চাওয়ার...'। এই 'ভালোভাবে' শব্দটার মধ্যেই রহস্য ঘনীভূত। 'ভালো' না 'খারাপ', 'ভাব' নাকি আড়ি, এবং তা কতদূর বিস্তৃত তার তল পাওয়া 'মুশকিলই নেহি না মুমকিন হ্যায়'।

পাবলিক বাসে উঠে চাহিদার হিসেব-নিকেশের কিছুটা টের পাওয়া যায়। যেমন, বাস চল্লিশের নীচে গড়ালে 'ড্রাইভার কি হাওয়া খেতে বেরিয়েছে, একটু টেনে চালান দাদা'। এরপর দাদা টেনে চালাতে শুরু করলেই, 'কী শুরু করেছেন আপনারা?' শুধু তাই নয়, সাদা উর্দিধারী ধরলেই তখন আবার জনতার সমবেত রাগ তেনার উপরে গিয়ে পড়ে, 'হপ্তা নেওয়ার আর সময় পেল না...।' এছাড়া, হাতে ঘড়ি পরে একটুও সময় হাতে না রেখে ভেবে নেব পাবলিক বাস আমার সময় ধরেই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, যেখানে নামাতে বলব সেখানেই থামাতে হবে, যেখানে হাত দেখাব সেখানেই তাকে দাঁড়াতে হবে (ভাবটা এমন, যেন আমার জন্যই বাসটা রাস্তায় বেরিয়েছে), একটাও পেট্রল পাম্পে বা আপৎকালীন মেরামতির জন্য না দাঁড়িয়ে সোজা গন্তব্যে যেতে হবে (অবশ্য আমি নেমে যাওয়ার পর বাসটা চলে গেল না দাঁড়িয়ে রইল, কিংবা বোমে উড়ে গেল, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই) এবং যতই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে আস্তে বা জোরে চালাও না কেন, ট্রাফিক সার্জেন্ট কখনও কোনও কেস দেবেন না। 

শেষমেশ একটা মজার জিনিস লক্ষ করেছি বহু বছরের অভিজ্ঞতায়। বাসের চালক, পরিচালক, পেট্রোল পাম্পের লোকজন এবং কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ, পাবলিক বাসের প্যাসেঞ্জারদের অন্তহীন চাহিদায় এতটুকুও বিচলিত হন না, কিংবা ভাবলেশহীন হয়ে যাবতীয় অভাব অভিযোগ কানের পাশ দিয়ে বার করে দেন। খারাপ শোনালেও, হয়তো ঠিকই করেন। কারণ এটা তাঁরা  বুঝে গেছেন, প্যাসেঞ্জার নিজেদের চাহিদা নিয়েই বাসে ওঠেন, বাস মালিক বা কর্মচারীদের চাহিদা নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তেলের দাম, যন্ত্রপাতির দাম এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচা বাড়লেও যাত্রীরা এসব নিয়ে এতটুকুও বিচলিত নন। এর উপর লকডাউন হলে তো কথাই নেই। পরিষেবা যারা দেন তাদের ভুল থাকতেই পারে, কিন্তু দিনের শেষে আমার মতোই বাস-কন্ডাক্টর একজন সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক। তাঁরও চাহিদা আছে, আমি স্বীকার করি বা নাই করি। পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং সহিষ্ণুতার পরিসর আর্থ-সামাজিক কারণেই ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, আর হচ্ছে বলেই আমরা 'জিরো টলারেন্স'-এর দিকে এগোচ্ছি। ঠিক এখানেই খেলাটা জমে উঠছে‌, কারণ, পরিষেবা প্রদানকারী এবং উপভোক্তা দুজনেই পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন, যা একটা সুস্থ সামাজিক পরিবেশের ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক।

কোভিডের দুটি পর্যায়ে লকডাউন নিয়ে বিচিত্র সব পরস্পর বিরোধী মন্তব্য কানে এসেছে। 'সব রাজ্য কত সুন্দর বুঝেশুনে লকডাউন চালু করে দিল, আর আমাদের এখানে দেখ...'। অর্থাৎ, নির্বাচনের পর লকডাউন কবে চালু করবে সরকার, তা নিয়ে রীতিমতো জ্যোতিষ চর্চা শুরু হয়ে গেল। অথচ নির্বাচন কমিশন এই অনমনীয় মনোভাব (অবশ্য এই গোয়ার্তুমির নেপথ্যে আসল চাপ কে বা কারা দিয়েছিলেন সেটা আমার কাছে এখনও প্রশ্নচিহ্ন) থেকে বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে একটু যদি সরে আসত তাহলে পশ্চিমবঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার দুটোই কমানো যেত।  যাই হোক, এরপর এই আমরাই, লকডাউন যখন চালু হয়ে গেল তখন, 'একটু তো সময় দেবে, যখন তখন লকডাউন চালু করে দেওয়া... এ আবার কী? মানুষের রুজি-রোজগারের কথা ভাববে না?...' ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করে বাজার মাত করে দিলাম। 

অপ্রতিরোধ্য রহস্যজনক কারণে প্রতিদিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের পর্দায় ফুল-বেলপাতা নিয়ে মেগা- সিরিয়াল দেখার চাহিদা, কুম্ভ স্নানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে পুণ্যার্জনের ভয়ঙ্কর নেশায় টপাটপ গঙ্গায় ডুব দেওয়ার চাহিদা,‌ এত সতর্কীকরণের পরেও স্বেচ্ছায় শতাধিক লোকের সাথে সামাজিকতার দোহাই দিয়ে অনুষ্ঠান বাড়িতে অংশগ্রহণ করার চাহিদা এবং এরকম আরও কত চাহিদা যেন একই সূত্রে গাঁথা রয়েছে যার মধ্যে 'কী? কেন? কতটা?'র কোনও সদুত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। নাগরিকদের কাছেই স্পষ্ট নয়। এই কারণেই হয়তো সরকার, প্রশাসন, আইন-আদালত এবং ওই বাসের কন্ডাক্টর ড্রাইভার সকলেই বুঝে গেছেন, পাবলিকের কথায় বেশি পাত্তা দিতে নেই। কী বলে, কী ভাবে নিজেরাই বোঝে না। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে সেখানে কয়েকশো ফুট উঁচু মূর্তি তৈরি করা, পুণ্যস্নানের ঢালাও অনুমতি দেওয়া, ধর্মগুরুদের নানান রকম অনুদান দেওয়া, জনগণের করের পয়সায় যথেচ্ছ দান-খয়রাতি করা, আবোল তাবোল কারণে বিপুল অর্থব্যয়ে নতুন নতুন সরকারি ভবন তৈরি করার খেলাটা কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে একটু হলেও সহজ হয়ে যায়। 

'আমফান' আর 'ইয়াস'- এক বছরের মাথায় দু-দুটো সুপার সাইক্লোনের দৌলতে আপামর বঙ্গবাসী কত কিছু জেনে গেল। নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় কিভাবে তৈরি হয়? আবহাওয়া দফতর তার গতিপথের নির্ণয় কীভাবে করে? তার নাক চোখ কাকে বলে? ল্যান্ডফলের মানে কী? ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমের কাজ কী? কোন কোন যন্ত্রপাতি তাঁরা ব্যবহার করেন? এবং সবশেষে ঝড়ের কাঁধে চেপে কত কোটি টাকার কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি লেনদেন হয়? সেটার চাহিদাও আজকাল সচিত্র ধারাবিবরণীতে প্রশাসনিক বৈঠকের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সাইক্লোনের উপর পরীক্ষা নিলে সবাই প্রায় একশোয় একশো পাবে। চাহিদায় কিন্তু এখানেই দাড়ি পরে না। মেগা সিরিয়ালের মতো চলতেই থাকে। কপিল মুনির আশ্রমে বুক সমান জলে ডুবে বা পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যার উপকূলে ঝড়ের সাথে সমান্তরালে উড়তে থাকা সাংবাদিকরা অক্লান্ত অমানুষিক পরিশ্রম করে, জীবন বাজি রেখে আমাদের চাহিদার জোগান দেন। এতে চ্যানেলে টিআরপিও সাংঘাতিক চড়া হয় নিঃসন্দেহে। মুখে আহা উহু করলেও, আমরা কিন্তু প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সচিত্র সংবাদ সংগ্রহ যারা করছেন, তাঁদের চ্যানেল দেখতেই বেশি ভিড় জমাই। সাংবাদিকরা আমাদের অন্তর্যামী হয়ে কলকাতার হাওয়া অফিসে, পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তাকে এই প্রশ্নও করেন, 'কেন কলকাতায় ইয়াস আছড়ে পড়ল না?' অধিকর্তা বুঝিয়ে বলেও দেন কারণটা। প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি সব মিলিয়ে পরিবেশটা এমন হয় যেন কলকাতায় ল্যান্ডফল না হওয়াটাও মারাত্মক প্রশাসনিক গাফিলতি এবং চেষ্টা করা হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব পরবর্তী সুপার সাইক্লোন অবশ্যই যেন কলকাতার বুকে আছড়ে পড়ে।

বলার কথা এই, নির্বাচিত সরকারের কাছে, কেন্দ্র-রাজ্য যাই হোক, নাগরিক চাহিদা যদি সীমাহীন ও  অনিয়ন্ত্রিত হয়, যুক্তি-বুদ্ধি রহিত হয়, তবে সরকার ও প্রশাসনিক স্তরের গাফিলতি এবং তা ঢাকতে আরও বড় গাফিলতির জন্ম হয়। ফল কীভাবে ভোগ করতে হয়? সংবিধানের দোহাই দিয়ে আট-দফা নির্বাচন, সঞ্চিত পাপ ধুয়ে ফেলার দোহাই দিয়ে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নানান জনসমাবেশ, 'মানুষ বড় কাঁদছে'র দোহাই দিয়ে অধিকাংশ অযৌক্তিক সরকারি প্রকল্প- এইভাবে তালিকার ছায়া দীর্ঘ থেকে সুদীর্ঘ হতে থাকে। সব শেষে, আগাপাশতলা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে একনায়কতন্ত্রের নীরব কিন্তু জোরালো অধিষ্ঠানকে মনে না নিলেও মেনে নিতে হয়।


Posted by Ekak Matra at 18:24 7 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Thursday, 27 May 2021

সোশ্যাল মিডিয়ায় হামলা

গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন ও সন্ত্রাস

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

কৃষকদের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে যুদ্ধ ঘোষণা করে, সারা দেশে কোভিড পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক ও মারণঘাতী করে তুলে এবং অবশেষে পশ্চিমবঙ্গে মুখে ঝামা-ঘষা খেয়ে আরএসএস-বিজেপি এখন মরীয়া হয়ে উঠেছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সমস্ত কাজ ফেলে উত্তরপ্রদেশে ছুটে গেছেন অমিত শাহ ও যোগীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করতে- কীভাবে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি’র ভরাডুবির ড্যামেজ কন্ট্রোল আগামী বিধানসভা নির্বাচনে করা যায়। বোঝাই যাচ্ছে, উদ্ভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত বিজেপি এখন সর্বতোভাবে আরও উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে চারপাশের বিকাশমান পরিস্থিতির ওপর।

এতদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশাল দলবল নিয়ে বিজেপি’র আইটি সেল বিপুল ছড়ি ঘুরিয়েছে। মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে, অর্ধসত্য বয়ান লিখে দিকে দিকে বিভাজন ও দাঙ্গা ঘটিয়েছে, দেশের এক বড় অংশের মানুষকে কিছুদিনের জন্য হলেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে দেশের মূল শত্রু একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায় ও প্রতিবেশী পাকিস্তান। এতটাই সংঘটিত ভাবে তারা এই কর্ম করেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংগঠিত বিবেকবান মানুষজনের পক্ষে বহুল চেষ্টা সত্ত্বেও, একটা পর্যায় অবধি তা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। দিল্লিতে গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় তাদের নেতা কপিল মিশ্র ‘গোলি মারো শালে কো’ বলে দাঙ্গা ছড়িয়েও এখনও পুলিশের নাগালের বাইরে। অথচ, যারা দাঙ্গাকে ঠেকাবার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের পোস্ট করা বিভিন্ন মেসেজ ও বক্তব্যকে হাতিয়ার করে তাঁদেরই কারান্তরালে নিক্ষেপ করেছে দিল্লির পুলিশ-প্রশাসন। 

সুখের কথা, আপাতত সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সেই দাপট গেছে। সারা দেশ জুড়ে যে গণজাগরণ শুরু হয়েছে, তার উত্তাপে এখন বিজেপি ও তাদের সরকারের (প্রধানমন্ত্রী সহ) নিভু নিভু অবস্থা। এই বিপর্যয়ের আঁচ সোশ্যাল মিডিয়াতেও এসে পড়েছে। যে ভাবে দেশ জুড়ে ও বিজেপি শাসিত রাজ্যে মতামত প্রকাশের ওপর জুলুম নামিয়ে আনা হচ্ছে, সেই একই পথে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার ওপরও তা নামিয়ে আনতে চাইছে। কারণ, সেখানে তাদের সেই পুরনো আধিপত্য আর নেই যে! তাদের আইটি সেল এখন বানপ্রস্থের পথে। তাই একমাত্র হাতিয়ার দেশদ্রোহিতার আইন, যার অজুহাতে যে কোনও বক্তা ও বক্তব্যকেই অপরাধের প্রকোষ্ঠে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আর তা করতে গেলে জানতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কী বলছে, লিখছে, কে কোথায় জনমত নির্মাণ করছে। যাকে বলে, ফেলতে হবে শকুনের দৃষ্টি! কিন্তু প্রযুক্তির বলয়ে অত গভীর ও নিখুঁত দৃষ্টি তো ফেলা যায় না, যদি না সোশ্যাল মিডিয়ার কারবারীরা সহযোগিতা করে অথবা তাদের আইনত বাধ্য করা যায়। আর এবার সে কাজটি করতেই দলবল নিয়ে, আইনের কবচ-মাদুলি পরে, মন্ত্রী-সান্ত্রী-পুলিশের ভয় দেখিয়ে ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’।

শুরু হয়েছিল বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের একটি কু-কাজ দিয়ে। যেখানে কংগ্রেসের লেটার হেড’কে নকল করে ও তাতে একটি সাজানো ‘টুলকিট’ লিপিবদ্ধ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছিল, যা দেখে মনে হতে পারে, কংগ্রেস কতকগুলি অপপ্রচারের আঙ্গিক গড়ে তুলে দলবদ্ধ ভাবে বিজেপি সরকারকে অপদস্থ করতে চাইছে। সে ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এসব মিথ্যা এবং নকলনবিশি করে ছড়ানো হয়েছে। ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ বিচার করে দেখে যে উক্ত ‘টুলকিট’টি সত্যিই নকল। অতএব, সম্বিত পাত্র ছবি সহ ‘টুলকিট’এর যে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে বাজার গরম করতে চেয়েছিলেন, তার গায়ে ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ বলে একটি ছাপ্পা মেরে দেয়। এতেই আইটি সেলের মাথা একেবারে গরম হয়ে যায়। বিজেপি’র পক্ষ থেকে প্রথমে হুমকি দেওয়া হয় ওই ছাপ্পাটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য। তাজ্জব কি বাত! যেখানে সম্বিত পাত্রের উচিত ছিল ধরা পড়ে যাওয়া নকল পোস্টটি সরিয়ে দেওয়া, সেখানে তারা উল্টে ট্যুইটার’কে হুমকি দিতে থাকে ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ ছাপ্পাটি সরিয়ে দেওয়ার জন্য। ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ তাতে রাজী না হওয়ায় দিল্লি পুলিশ ট্যুইটারের দিল্লিস্থ অফিসে রেইড করে এবং ভয় দেখায়।

এই ঘটনার পাশাপাশি আরও একটি স্রোত বইছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি (ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইন্স অ্যান্ড মিডিয়া এথিকস কোড) রুলস’ নামক একটি নোটিফিকেশন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির উদ্দেশ্যে জারি করে যেখানে প্রতিটি এমনতর সংস্থাকে এই নতুন রুলস (যা ২৬ মে ২০২১ থেকে কার্যকরী হয়েছে) মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রুলস মোতাবেক প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাকে একজন করে চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার, রেসিডেন্ট গ্রিভান্স অফিসার ও নোডাল কন্টাক্ট পার্সন নিযুক্ত করতে হবে। এই অফিসারদের কাজ হল, সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট যে কোনও আপত্তিকর পোস্টের প্রথম উৎস কোথা থেকে, তা ৭২ ঘন্টার মধ্যে জানাতে হবে। অর্থাৎ, সরকার যদি মনে করে ভাইরাল হয়ে যাওয়া কোনও পোস্ট (অথবা সরকারের নজরে আসা কোনও পোস্ট) দেশের আইনশৃঙ্খলা ও জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে হানিকর, তাহলে সেই পোস্টের জনকের হদিশ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম (যেখানে পোস্ট হয়েছে) চিহ্নিত করে সরকারকে জানাবে। উপরন্তু, এতদিন আইন মোতাবেক, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কোনও ‘আপত্তিকর’ পোস্টের দায় বর্তাতো যিনি পোস্ট করেছেন তাঁর ওপর; সোরগোল উঠলে বা নিজেদের বিচারে আপত্তিকর মনে হলে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বড়জোর সেই পোস্টটিকে সরিয়ে দিত এবং প্রয়োজনে প্রেরকের ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি করত। কিন্তু এবারে, যে কোনও পোস্টের দায় শুধু যিনি পোস্ট করছেন তাঁর ওপরই বর্তাবে না, যে প্ল্যাটফর্মে তিনি পোস্ট করেছেন তাদেরও দায়ভাগ থাকবে। চাইলে আইন মোতাবেক সরকার সম দায়ে সেই প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসআপ, ট্যুইটার- এখন পর্যন্ত কেউই সরকারি নির্দেশ মাফিক উক্ত অফিসারদের নিযুক্ত করেনি। শোনা যাচ্ছে, ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম হয়তো আপাত ভাবে তাদের কর্মীদের মধ্য থেকেই এই পদগুলিতে কাউকে নিয়োজিত করবে। কিন্তু এই নির্দেশকে তারা ভালো ভাবে নেয়নি। কারণ, এই ত্রি-অফিসার নিয়োগের মাধ্যমে সরকার চাইছে তাদের প্ল্যাটফর্মে দেয় কোনও পোস্ট যদি সরকারের কাছে ‘আপত্তিকর’ মনে হয়, তাহলে সরাসরি সেই অফিসারদেরই দায়বদ্ধ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হতেই পারে, প্রধানমন্ত্রীর কোনও নীতিকে সমালোচনা করে কোনও একাডেমিক পোস্টকেও সরকার ‘আপত্তিকর’ চিহ্নিত করে যিনি পোস্ট করলেন তাঁকে এবং কেন তা পোস্ট করতে দেওয়া হয়েছে সেই অজুহাতে প্ল্যাটফর্মের অফিসারদের জেলে পুরে দিল। নিঃসন্দেহে, মতামত প্রকাশের ওপর এ এক চরম আঘাত। এতদিন চলটা ছিল, যারা সাহসী তাঁরা সরকারি দমন-পীড়নের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই নিজেদের মতামত জাহির করতেন। এবার সেই কোপটা এসে পড়ছে যেখানে পোস্ট হচ্ছে তাদেরও ওপর, অথচ সে মতামতের দায় তাদের নয়। আসলে, এইভাবে ভয় দেখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে কাবু করে রাখা যাতে তারা তথাকথিত ‘আপত্তিকর’ পোস্টগুলিকে অঙ্কুরেই মুছে দেয়। এই অনুশীলনে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিও ‘বুঝে যাবে’ যে ‘আপত্তিকর’ পোস্ট কোনগুলি ও কারা করেন। জনমতকে নৃশংস ভাবে পিষ্ট করার এ হল আধুনিক ফ্যাসিবাদী কৌশল।

কিন্তু ভবি কি অত সহজে ভুলবে? ইতিমধ্যেই ট্যুইটার এই মারাত্মক আইনি বিধানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে সওয়াল করতে শুরু করেছে। তারা ‘ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল’ ও ‘ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরাম’এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে অবশ্যই আন্তর্জাতিক স্তরে হৈ-হট্টগোল শুরু হবে। কারণ, সরকারের এই পদক্ষেপ গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার সামিল। কোনও সাংবাদিক তদন্তমূলক সংবাদ নির্মাণে ভীত হয়ে পড়বেন। তিনি শুধু ভীত হবেন না, সে সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও প্ল্যাটফর্মেও হয়তো প্রকাশ পাবে না। কারণ, সে সংবাদের প্রথম উৎস তিনিই এবং তা যদি সরকারের চোখে ‘আপত্তিকর’ মনে হয় তাহলে তিনি তো দোষী সাব্যস্ত হবেনই, উপরন্তু, সে সংবাদ প্রকাশের জন্য প্ল্যাটফর্মেরও গলা কাটা যাবে। বলাই বাহুল্য, এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। কংগ্রেস নেতা অভিষেক সিঙ্ঘভী জানিয়েছেন, এ হল সম্পূর্ণ সেনসরশিপ, সম্পূর্ণ চিন্তা-নিয়ন্ত্রক এবং সম্পূর্ণত সোশ্যাল মিডিয়াকে সন্ত্রস্ত করার প্রয়াস।

সরকারের এই বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে হোয়াটসআপ দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেছে। তারা জানিয়েছে, এই বিধানের ফলে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে। কারণ, হোয়াটসআপ ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ রীতি মেনে চলে যেখানে প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া পাঠানো মেসেজে কী আছে তা কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়, এমনকি তারা নিজেরাও জানে না। যদি সরকারি বিধানকে মানতে হয় তাহলে এই ‘এন্ড এনক্রিপশন’এর রীতিকে ভেঙে ফেলতে হবে (না হলে কোনও পোস্ট বা মেসেজের প্রথম উৎসকে জানা সম্ভব নয়) যা গোপনীয়তার পক্ষে ভয়ানক বিপজ্জনক ও তাদের সংস্থারও রীতিবিরুদ্ধ। আদালতে তারা এই নতুন বিধানের ৪(২) ধারাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে বাধ্য করা হয়েছে মেসেজের উৎস খুঁজে বের করতে, যা বর্তমান ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’এর প্রযুক্তি রীতিতে আদৌ সম্ভব নয়। তারা এও বলেছে, এই নববিধান ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ও ২১ ধারাকে লঙঘন করছে এবং তা কার্যকরী হলে দেশের ৪০ কোটি হোয়াটসআপ ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রীয় সরকার হোয়াটসআপ’এর দায়ের করা এই মামলাকে বলেছে ‘একটি অমান্যকর কাজ’। বুঝে দেখুন, আদালতে সাংবিধানিক ও আইনি সুরক্ষা নেওয়ার চেষ্টাকেও তারা বরদাস্ত করতে রাজী নয়। তথ্যমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, গোপনীয়তার অধিকারকেও ‘যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণের’ অধীনে থাকতে হবে। কী কাণ্ড! সেই যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে একমাত্র দিল্লির শাহেনশাহদের হাতে।

আমরা জানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানে ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার সর্বগ্রাসী অস্তিত্বে আজ সোশ্যাল মিডিয়া এক অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে সমাজে বিরাজমান। তাকে অস্বীকার করে কার সাধ্য! আর এই সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল দুনিয়া একযোগে এক নবতর রাষ্ট্র হিসেবে সারা বিশ্ব জুড়েই আত্মপ্রকাশ করছে। সাবেকি রাষ্ট্রের কর্ণধার যারা, যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প’এর মতো অতি-প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে এই সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বৈরথ সুবিদিত। তাঁকে ট্যুইটার চিরকালের জন্য বহিষ্কার করেছে। একই ভাবে এ দেশেও ট্রাম্প-অনুরাগী ক্ষমতা-উন্মত্ত মোদি-শাহ জুটি সোশ্যাল মিডিয়ার এই আপেক্ষিক স্বাধীন পরিসরকে মেনে নিতে রাজী নন। তাই, ট্রাম্পের মতোই তাঁরাও সোশ্যাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধে নামতে চাইছেন। কিন্তু তাঁরা কি শেষমেশ পেরে উঠবেন? যদিও এ কথাটা বলতে কোনও কুন্ঠা নেই যে, সোশ্যাল মিডিয়াগুলি নানা সময়ে দেশে দেশে শাসকদের সঙ্গে নানারকম অসৎ আঁতাতে সামিল হয়ে নিজেদের ব্যবসার স্ফীতির কথাই ভেবেছে। তা সত্ত্বেও আপেক্ষিক অর্থে সাবেকি রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই প্ল্যাটফর্মগুলি জনমত গঠনের এক অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, তাও বাস্তব সত্য। অতএব, সোশ্যাল মিডিয়াকে তার সীমাবদ্ধতা সমেতই আমাদের মেনে নিতে হবে। তাদের গাফিলতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকতে হবে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই গোপনীয়তার অধিকারকে লঙ্ঘন করতে দেওয়া যাবে না- সে বিপদ রাষ্ট্রের দিক থেকেই আসুক অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার তরফে। কারণ, আমরা জানি, এইসব সোশ্যাল মিডিয়াগুলি ব্যবহারকারীদের তথ্য নিয়ে গোপনে আরেক দফা বাণিজ্য করে। তা নিয়ে সারা বিশ্ব জুড়েই আওয়াজ ও আলোড়নও যথেষ্ট শক্তিশালী।

কথা হল, আমাদের শীর্ষ আদালতের নয় সদস্যের বেঞ্চ ২০১৭ সালে এক ঐতিহাসিক রায়ে গোপনীয়তার অধিকারকে সংবিধানের ২১ ধারার অধীনে এক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রখ্যাত প্রযুক্তি-সংক্রান্ত আইনবিদ মিশি চৌধুরি’র মতে, ভারত সরকারের এই নতুন আইটি রুলস’এর প্রণয়ন পুরোপুরি সংবিধান বিরোধী। এর আসল উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক; দিল্লিতে ট্যুইটার অফিসে হানা দিয়ে সরকার তার নজির রেখেছে। মানুষের কণ্ঠরোধ করার শাসকের এই নতুন কৌশলের বিরুদ্ধে জনমত আরও তীব্র হয়ে উঠুক। আশা করি, দিল্লি আদালত সংবিধানের মৌলিক সত্তাকে প্রাণপণে রক্ষার চেষ্টা করবে। মিথ্যাচার, হুমকি ও অমিত মালব্য’র আইটি সেল চুলোয় যাক।          


Posted by Ekak Matra at 16:39 7 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Wednesday, 26 May 2021

শ্রমের ভূমিকা

ভারতের বাম-শক্তি কতটা প্রাসঙ্গিক

অনির্বাণ কারক


পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হল এই যে, বামেরা কোনও আসন পায়নি এবং মোট ভোটের ৪.৭ শতাংশ পেয়েছে। এই নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ নিশ্চয়ই বিশ্লেষকরা খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হল, আজকের ভারতীয় বাম দলগুলির রাজনীতিতে 'মার্কসবাদ' বা 'মার্কসবাদী' তত্ত্বের অবস্থান কী? ভোটের প্রচারে বাম জোট টিএমসির অপশাসন এবং বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার বিপদগুলির উপর জোর এবং নির্বাচিত হলে গরিব ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে এর কোনওটির জন্যই মার্কসবাদের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, ডানপন্থী জনপ্রিয়তার এক ব্র্যান্ড ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গে 'pro-poor' তকমাটা এখন টিএমসি-র একচেটিয়া হয়ে গেছে বললে খুব ভুল বলা হবে না।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রচার থেকে যদি কিছু ধারণা করা যায়, তবে এটা বলতেই হয় যে ভারতীয় রাজনীতিতে পুঁজিবাদ থেকে উৎক্রমণের স্বপ্নের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা তা নিয়ে গুরুতর চিন্তাভাবনা বাম দলগুলো আর খুব একটা করে না। এ থেকে দুটি সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে: ১) বামেরাও স্বীকার করে নিয়েছে যে পুঁজিবাদকে অতিক্রম করা যায় না এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের দ্বারা নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যেই রাষ্ট্র-পরিচালিত কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই; অথবা ২) বামেরা তাত্ত্বিক অসহায়ত্ব দ্বারা জর্জরিত।

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেই চিরাচরিত মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চিরাচরিত মার্কসবাদ সর্বদা একজন 'শ্রমিক'এর পরিচয় শুধু 'শ্রমিক' হিসাবেই দেখে এসেছে। এটা ভাবেনি যে মানুষ হিসাবে শ্রমিকদের পরিচয় তাদের 'শ্রমিক'এর পরিচয়কে ছাড়িয়ে যায়। 'কাজ' এবং 'শ্রম' কোনও ব্যক্তির পরিচয়কে ধরে রাখা এবং তাদের জীবনে 'অর্থ' সরবরাহ করার একমাত্র উপাদান হতে পারে না। অর্থবহুল উপাদানের মধ্যে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা, বর্ণচেতনা, সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব এবং আরও অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। 

প্রচলিত মার্কসবাদ সচেতনতাকে কেবল 'এপিফোনোমেনার' ভূমিকা দেয় এবং অর্থনীতির যে মৌলিক কাঠামো, তার প্রভাবমাত্র বলে ধরে। তদুপরি, ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যে, উৎপাদনের পদ্ধতিতে বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্য কোনও পরিবর্তন এলেও নিপীড়িতদের মধ্যে সচেতনতার রূপগুলিতে কোনও পরিবর্তন আসেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান দুর্দশা সর্বহারাদের বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। বরং, ফ্যাসিবাদ এবং তার ভয়ঙ্কর পরিণাম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সাম্প্রতিক কালে, আমাদের দেশে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের নানান পরিবর্তনের ফলে যে সংকট আমরা দেখেছি, তার ফলে 'শ্রেণি' চেতনার কোনও পুনরুত্থান হয়নি। বরং, আমরা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চরম জনপ্রিয়তা প্রত্যক্ষ করছি এবং মানুষের মধ্যে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা লক্ষ করছি। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, ধর্মকে 'জনগণের আফিম' বলার আগে মার্কস আরও বলেছিলেন যে এটি 'নিপীড়িতদের দীর্ঘশ্বাস' এবং 'হৃদয়হীন বিশ্বের হৃদয়'।

মার্কসবাদের প্রচলিত মডেলে এই জাতীয় 'বৈপরীত্য' বোঝার কোনও উপাদান নেই। স্ট্যালিনবাদীরা সর্বদা বলেন যে জনগণের চেতনা সময়ের সাপেক্ষে 'পিছিয়ে' থাকলে, 'পার্টি'কে (যে কোনও আশ্চর্য উপায়ে 'সত্য' টা জানে) রাজনীতিতে 'ভ্যানগার্ড' হিসাবে কাজ করতে হবে। এই ধরনের ব্যাখ্যা অবশ্যই লোভনীয়, কিন্তু অপর্যাপ্ত। এই যুক্তি স্বীকার করার অর্থ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বদলে আধিপত্যবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ভারতে বামপন্থীরা চেতনা গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের দ্বারা শুরু করা 'clientism' (অর্থাৎ, কিছু পাইয়ে দিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য আদায় করা) টিএমসি অব্যাহত রেখেছে এবং তাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

মার্কসের বিকল্প-পাঠ

১৯৬০-এর দশক থেকে জার্মান ভাষার স্কলারশিপে মার্কসের একটি বিকল্প পাঠের প্রচলন শুরু হয়। মার্কস তাঁর লেখা 'Grundrisse' বইটির মেথড অফ পলিটিকাল ইকনমি বলে একটি বিভাগে বলেছিলেন, পণ্য, মূল্য, পুঁজি সবেরই অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ দুটি রূপ আছে; এগুলি মানুষের মাথায় যা চলছে এবং পাশাপাশি বাস্তবে যা হচ্ছে দুটোই বুঝতে সাহায্য করে। এগুলি সংকীর্ণ অর্থনৈতিক 'বিষয়' নয় বরং পুঁজিবাদী সমাজের 'অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্য' এবং পাশাপাশি এই সমাজের সত্তার 'রূপ' বা 'অবয়ব' তুলে ধরে।

মূল্য-তত্ত্ব শুরু হয় পণ্যের দ্বৈত রূপ দিয়ে। পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য এবং মূল্য উভয়ই থাকে। সুতরাং, পুঁজিবাদে শ্রমেরও একটি 'দ্বৈত চরিত্র' রয়েছে: 'মূর্ত শ্রম' (যা 'ব্যবহারিক মূল্য' গঠন করে) এবং 'বিমূর্ত শ্রম' (যা মূল্য গঠন করে)। 'মূর্ত শ্রম' বলতে বোঝায় সেই শ্রম যা মানুষ এবং প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যস্থতা করে। এই ধরনের শ্রম প্রত্যেক সমাজেই থাকে, কারণ এটি একটি প্রয়োজনীয়তা। 'বিমূর্ত শ্রম' ইঙ্গিত দেয় যে, পুঁজিবাদে শ্রমের একটি অনন্য সামাজিক মাত্রা রয়েছে যা শ্রমসাধ্য কার্যকলাপের অন্তর্নিহিত নয়, এটি সামাজিক আন্তঃনির্ভরতার একটি নতুন, বিমূর্ত রূপের প্রতীক। কেবল পুঁজিবাদেই শ্রম সামাজিক সম্পর্কের মৌলিক গঠনের অঙ্গীভূত হয়ে ওঠে। অন্যান্য সকল সমাজে জাতি, দাসত্ব, পরিবার এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের মতো আরও পরোক্ষ সম্পর্কের মাধ্যমে মানব শ্রম সংগঠিত হয়।

মার্কসের 'মুল্য তত্ত্বের' উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা নয় যে সর্বদা এবং সর্বত্র 'মূর্ত-শ্রম'ই সম্পদের একমাত্র উৎস। বরং, মার্কস 'মুল্য'কে বিশ্লেষণ করেছেন এক ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট ধরনের সম্পদ হিসাবে, যা পুঁজিবাদে শ্রমের ঐতিহাসিকতা এবং তার বিমূর্ত মধ্যস্থতাকারীর অনন্য ভূমিকার সঙ্গে জড়িত। 'মূল্য' সম্পদের একটি নির্দিষ্ট রূপ, কিন্তু এটিকে অবশ্যই 'বৈষয়িক সম্পদ' থেকে আলাদা করা উচিত। পরেরটি উৎপাদিত পণ্যের 'পরিমাণ' দ্বারা মাপ করা যায় এবং এটি শ্রম ছাড়াও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, সামাজিক সংগঠন এবং প্রাকৃতিক অবস্থার মতো নানা জিনিসের উপরও নির্ভর করে। কিন্তু, মার্কসের মতে, 'মূল্য' এককভাবে 'শ্রম-সময়'এর ব্যয় দ্বারা গঠিত হয়। পুঁজিবাদে এই শ্রম-সময়ই বৈষয়িক সম্পদ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

পুঁজিবাদের অধীনে সম্পত্তির সামাজিক রূপ হিসাবে 'মূল্য' যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনে সরাসরি শ্রম-সময় কমানোর চেষ্টা করে। এর ফলে, পুঁজিবাদীরা 'উদ্বৃত্ত মূল্য' আরও বেশি করে নিষ্কাশন করতে পারে। কিন্তু এই যান্ত্রিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে 'মূল্য' এবং 'বৈষয়িক সম্পদের' মধ্যে সমানুপাতিক সম্পর্কের বিচ্যুতি ঘটতে শুরু করে। ক্রমবর্ধমান ভাবে আরও বেশি 'বৈষয়িক সম্পদ' প্রতি ঘন্টায় উৎপাদিত হয়, কিন্তু একই ধরনের 'শ্রম-সময়' প্রতি ঘন্টায় একই পরিমাণ 'মূল্য' উৎপাদন করে। এই কারণেই, পুঁজিবাদ যত দীর্ঘমেয়াদী হয়, ততই 'মোট' মূল্যের (এবং তাই উপলব্ধ উদ্বৃত্ত মূল্য) পরিমাণ কমতে থাকার একটা প্রবণতা দেখা যায়, কারণ, ক্রমাগত যান্ত্রিকীকরণের ফলে বৈষয়িক সম্পদ উৎপাদনের জন্য 'জীবিত শ্রম'-এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ কমে যায়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সমাজের উৎপাদনশীলতা যত বাড়ে, 'মূল্য' ততই উৎপাদিকা শক্তির সামাজিক সম্পদ উৎপাদনের ক্ষমতার নিরিখে 'সময়ের প্রেক্ষিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ' হয়ে ওঠে, কারণ, উৎপাদনশীলতা তখন আর শুধু বিমূর্ত শ্রমের উপর নির্ভর করে না। এই পরিস্থিতি তৈরি হয় মূল্য দ্বারা গঠিত সমাজের নিজস্ব তাগিদেই। অন্য কথায় বলা যায় যে, পুঁজিবাদ এমন একটি সমাজের সম্ভাবনা তৈরি করে যেখানে অনেক সর্বহারাদের পরিশ্রম আর কিছু লোকের সমৃদ্ধির জন্য পূর্বশর্ত থাকে না। তবে, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে উপলব্ধি করা যায় না, কারণ জমে থাকা মানবীয় শ্রম-ক্ষমতাগুলি পুঁজি হিসাবে, কিন্তু উৎপাদিকা শক্তি থেকে 'বিচ্ছিন্ন' অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মূল্য-তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে, বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় শ্রমের উত্থানকে একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত হিসাবে দেখা উচিত, যেখানে প্রলেতারীয় শ্রমিকের সংখ্যা প্রচলিত মার্কসবাদের ধারণা অনুযায়ী বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে হ্রাস পায়। প্রচলিত মার্কসবাদে  বর্তমান 'জীবিত-শ্রম'কে পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির উৎস বলে ধরা হয়। কিন্তু মার্কস তার মূল্য-তত্ত্ব দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে মুক্তির উৎস আসলে 'অতীতের শ্রম'।

'মূল্য'র বৃদ্ধি না হওয়ার ফলে উদ্বৃত্ত-মূল্যকে একই অবস্থানে রাখার জন্য, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমাদের আরও দ্রুত দৌড়তে হয় বা বেশি কাজ করতে হয়, যাকে পোস্টোন 'ট্রেডমিল গতিশীলতা' বলে অভিহিত করেছেন। অতএব, ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং বিমূর্ত এই সামাজিক আধিপত্য হচ্ছে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। মার্কসের লেখায় পুঁজির সংজ্ঞা হল 'স্ব-ক্রমবর্ধমান মূল্য' । পুঁজির কোনও স্থির রূপ নেই, নিজের চক্রাবর্ত পথের বিভিন্ন মুহুর্তে পুঁজি কখনও অর্থ (money) এবং কখনও পণ্য রূপে উপস্থিত হয়। পুঁজি হল মূল্যের স্ব-প্রসারণের একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। পুঁজি শুধু অন্ধের মতো উৎপাদন ও ভোগ এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের বৃহৎ আকারের কালচক্র তৈরি করে চলে। সুতরাং, চিরাচরিত মার্কসবাদ অনুসারে 'পুঁজিবাদীদের' সাথে 'পুঁজি'কে গুলিয়ে ফেলা চূড়ান্ত ভুল। কারণ, পুঁজিবাদীরা কেবল পুঁজির বিমূর্ত গতিশীলতার 'মানবরূপ' মাত্র। পুঁজিবাদীরাও পুঁজির অত্যাচার থেকে মুক্ত নয়।  

তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য

মূল্য-তত্ত্ব দ্বারা বর্ণিত পুঁজিবাদের যে স্বকীয় দীর্ঘকালীন প্রবণতাগুলি– যেমন, এই ব্যবস্থার বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক সংকটের পুনরাবৃত্তি, পুঁজির সংহতি এবং কেন্দ্রীকরণ এবং ধারাবাহিকভাবে যান্ত্রিকীকরণের ফলে অপ্রয়োজনীয় শ্রমের উত্থান– এ সবই বৈশ্বিক স্তরে কাজ করে এবং গত দুই শতাব্দী ধরে করে চলেছে। যান্ত্রিকীকরণের দিকে প্রবণতা সব সময়ই চালু ছিল, ফলে মার্কসীয় অর্থে 'প্রলেতারিয়ান' শ্রমজীবীদের সংখ্যা আর বৃদ্ধি হচ্ছে না। যেমন, ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে প্রয়াত অর্থনীতিবিদ কল্যাণ সান্যাল বলেছিলেন যে, এমন একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এখন ভারতে তৈরি হচ্ছে যাদের প্রচলিত মার্কসবাদী অর্থে 'reserve army of labor' বলা চলে না কারণ তাদের কখনওই পুঁজিবাদী সেক্টরে নিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই জনগোষ্ঠীকে পুঁজি পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে এবং তৈরি হয়েছে একটি 'কর্মচ্যুতদদের বর্জ্যভূমি'। সারা পৃথিবীতে যখন বেকারত্বের সমস্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে, তখন এটা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন যে, পুঁজিবাদ নিজেকে বিশ্ব-অর্থনীতিতে একটি ব্যবহারিক সত্য হিসাবেই স্থাপন করেছে। পুঁজিবাদ মানব-ইতিহাসে এই প্রথম উদিত হল এমন বিমূর্ত ধারণার কোনও কারণ নেই। পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির যে-কোনও রাজনৈতিক উপায় খুঁজতে গেলে এই সত্যকে স্বীকার করতেই হবে।

মূল্য-তত্ত্ব শ্রমকে সমগ্র মানবজীবনের 'অস্তিত্ববাদী সত্য' বা ইতিহাস-নিরপেক্ষ 'মূল বিষয়' হিসাবে দেখে না। সুতরাং, জাতিসত্তা, বর্ণ, লিঙ্গ বা যৌনতার উপর ভিত্তি করা রাজনীতির চেয়ে 'শ্রেণি ভিত্তিক' রাজনীতিটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিনা সে বিষয়ে ভাবনার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষে, মূল্য-তত্ত্ব সামাজিক রূপান্তরের সম্ভাবনার শর্তগুলি বর্ণনা করার দিকে বেশি মনোনিবেশ করে। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে উৎক্রমণের লক্ষ্যে শুধুমাত্র 'শ্রমিক' পরিচিতির মানুষের জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভাবনাকে ছাপিয়ে যেতে হবে। সামাজিক স্তরের অপরাপর পরিচিতির মানুষের (জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ ইত্যাদি) রাজনৈতিক পরিসরে ক্ষমতায়ন, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মান্যতা দেয় না, সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে।

মার্কস বলেছিলেন যে 'বিচ্ছিন্ন-শ্রম'-এর মাধ্যমেই মানুষ উৎপাদিত পণ্য এবং উৎপাদনের উপকরণের উপর এমন ব্যক্তির আধিপত্য তৈরি করে যে নিজেই সেই পণ্য উৎপাদন করে না। 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' তাই আসলে বিচ্ছিন্ন-শ্রমের একটি অনিবার্য পরিণাম। অন্য কথায়, 'শ্রেণি' তৈরি হয় সামাজিক অনুশীলন দ্বারা, আবার এই অনুশীলনই বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা থেকে শ্রেণির উদ্ভব হয় না। মার্কসের সমালোচনা সামাজিক চর্চা থেকেই কিভাবে 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' এবং মানব শ্রমের মধ্যে বিরোধিতা তৈরি হচ্ছে তা দেখানোর চেষ্টা করে।

সাম্প্রতিক-কালে আমরা যে অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক টালমাটাল দেখেছি, তা থেকে বলা যায় যে মার্কসবাদের মৃত্যুর খবর অত্যন্ত অতিরঞ্জিত হয়েছে। তবে সমালোচনামূলক একটি মার্কসীয় রাজনীতি বর্তমানের জন্য পুনরায় কল্পনা করা যায় কিনা তা নির্ভর করে পরম্পরাগত বাম দলগুলি তাদের নিজস্ব অনুশীলনে মার্কসীয় তত্ত্বের তাৎপর্য পুনর্বিবেচনা করতে রাজি হয় কিনা তার উপর।

 

Posted by Ekak Matra at 19:01 1 comment:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Tuesday, 25 May 2021

প্রলয়ের মুখে

বিপন্ন কলকাতা ও সুন্দরবন

সোমনাথ গুহ


এক বছর আগে এই মে মাসে আমফান যখন তার রুদ্র রূপ নিয়ে কলকাতার দোরগোড়ায়, তখন সুদূর আমেরিকাতে বসে স্বনামধন্য সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ শহরে তাঁর প্রিয়জনদের নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে টুইট করেন: 

'ঠিক এই মুহুর্তে কলকাতায় আমার পারিবারিক বাড়ি ঘূর্ণিঝড় আমফানের চোখে অবস্থিত। ল্যান্ডলাইন এখনও কাজ করছে। ঝড় আরও তীব্র হচ্ছে এবং এই সময়ে নিজের আপনজনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মন অস্থির হয়ে উঠছে।'

লেখক তাঁর এক বিদেশি বৈজ্ঞানিক বন্ধুর মাধ্যমে এই সাইক্লোনের দাপট সম্পর্কে কয়েক দিন আগে থেকেই অবহিত ছিলেন। তিনি কলকাতায় তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের সতর্ক করেন। তিনি বলেন, দু-একজনের মনোভাব ছিল ‘ও দেখা যাবে’ ধরনের। আসলে বেশির ভাগ বাঙালির ধারণা হচ্ছে যে ঝড়গুলো হয় ওড়িশা নয় বাংলাদেশের দিকে চলে যায়। 

বঙ্গোপসাগর ঐতিহাসিক ভাবে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, পৃথিবীর ইতিহাসের অতি প্রবল ৩৫টি সাইক্লোনের মধ্যে ২৬টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। সাইক্লোন থেকে মৃত্যুর ৪২ শতাংশ হয়েছে বাংলাদেশে, ২৭ শতাংশ ভারতবর্ষে। অতীতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, যাতে আজকের ওড়িশা এবং বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা বহুবার ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত হয়েছে। পরবর্তীকালেও এই অঞ্চলের যে কোনও শক্তিশালী ঝড় এই দুটি রাজ্য এবং দেশকে একই সাথে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ১৭৩৭'এর বেঙ্গল সাইক্লোন ভারতবর্ষের ইতিহাসে রেকর্ডভুক্ত সবচেয়ে মারাত্মক ঝড় হিসাবে গণ্য হয়। তিন লক্ষ মানুষ মারা যান, ২০,০০০ জাহাজ ধ্বংস হয়। আরেকটি মারণঘাতি ঝঞ্ঝা ছিল ১৮৬৪'র 'ক্যালকাটা সাইক্লোন' যাতে ষাট হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। খেজুরি আর হিজলির বন্দর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। 

ইদানীংকালের অন্যতম ধ্বংসাত্মক ঝড় হচ্ছে ১৯৯৯'র ওড়িশা সাইক্লোন, যদিও এটি পশ্চিমবাংলাকে সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। মৃতের কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। মনে করা হয়, সংখ্যাটা ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০। এই সুপার সাইক্লোনের পর ওড়িশা সরকার তাদের বিপর্যয় মোকাবিলার সিস্টেম ঢেলে সাজায় যা এখন বিশ্বে অন্যতম সেরা বলে গণ্য করা হয়। ২০০২'এর নভেম্বর মাসের ঝড় ১০০ কিমি বেগে সাগরে ভূমি স্পর্শ করে, পশ্চিমবাংলায় ১৩৭ জন মারা যান।

তারপরে ২০০৯'এ আসে বহুকথিত আয়লা যা বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গকে ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পশ্চিমবাংলায় ৪৫ জন মারা যান, যার মধ্যে ১৮ জন কলকাতায়। পরবর্তীকালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা রাজ্যে ১,৭৫,০০০ বাড়ি ধ্বংস হয় এবং আরও ২,৭০,০০০ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ স্থানান্তরিত হয়। যেটা আরও ক্ষতিকারক ছিল, বহু নদীবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জল ঢুকে কৃষিজমি লবণাক্ত করে দেয়। হিসাব অনুযায়ী, ৫০,০০০ হেক্টর জমি নষ্ট হয়ে যায় এবং বহু কৃষিজীবী মানুষ তাঁদের বংশানুক্রমিক জীবিকা ছেড়ে শহরে মুটেমজুরের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। 

পরের দশ বছরে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ভুত ঝড় মূলত নিরীহ ছিল। এটা লক্ষ্যণীয় যে, তারপর ২০১৯ থেকে গত দু' বছরে অন্তত চারটে শক্তিশালী সাইক্লোন বাংলা, ওড়িশা, বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছে। ২০১৯'এর এপ্রিল মাসের ‘ফণী’ মূলত ওড়িশায় আঘাত হানে, ৬৪ জন মারা যান। ওড়িশা লাগোয়া বাংলার কিছু জেলাতেও এর প্রভাব পড়ে। ঐ বছরই নভেম্বরের নয় তারিখে সাইক্লোন ‘বুলবুল’ ১৩৭ কিমি বেগে পশ্চিমবাংলায় আছড়ে পড়ে। প্রায় পাঁচ লক্ষ বাড়ি ধ্বংস হয় এবং প্রচুর জমি নষ্ট হয়। এর পাঁচ মাসের মধ্যে ১৯৯৯'র ওড়িশার সুপার সাইক্লোনের পর আরও একটি সুপার সাইক্লোন ‘আমফান’ ১৫৫ কিমি বেগে বকখালির কাছে ভূমি ছোঁয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আয়লার থেকেও ভয়ানক ছিল আমফান। অন্তত ৮৬ জন মারা যান। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রের জল সুন্দরবনের অন্তত ১৫ কিমি অবধি ভিতর ঢুকে যায়। ৮৮,০০০ হেক্টর ধান এবং ২,০০,০০০ হেক্টর আনাজ ও তিল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঝড় সরাসরি কলকাতায় আঘাত করে, ১৫ জন মারা যান। প্রায় ৫০০০ বিদ্যুতের খুঁটি, কেবল লাইন উপড়ে যাওয়ার কারণে প্রায় ৭২ ঘণ্টা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে বিদ্যুৎ, জল, মোবাইলের কানেকশন ছাড়া থাকতে হয়। 

আগামীকাল দুপুর নাগাদ ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ১৫৫-১৬৫ কিমি গতিতে বালেশ্বরে আছড়ে পড়বে। আবহাওয়া বিজ্ঞান অনেক আধুনিক হয়ে যাওয়ার কারণে এখন কয়েক দিন আগে থেকেই ঝড়ের গতি এবং গতিপথ আন্দাজ করা যায়। এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা সীমিত রাখা যায়, যদিও বারবার প্রচুর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং শস্য ও জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ এত ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে কেন? দু' বছরে চারটি এবং প্রতিটি যথেষ্ট শক্তিশালী। মনে করা হয়, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সমুদ্রের জলের উপরি স্তরের তাপ বৃদ্ধির কারণে সাইক্লোন সৃষ্টি হয়। এর ফলে সমুদ্রের নিকটবর্তী শহর সংকটাপন্ন হয়। যেমন, সুন্দরবন সমুদ্র ও কলকাতার মধ্যে বাফার হিসাবে কাজ করে। প্রলয়ের মূল ঝাপটাটা এই বনাঞ্চল আটকে দেয়। এতে সুন্দরবনের ভূমি ক্ষয় হয়, নোনা জল কৃষিজমিতে ঢুকে লবণাক্ত করে দেয়। মানুষ কৃষিকাজ ছাড়তে বাধ্য হয়, গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় করে। এর দুটি কুফল: 

এক, সুন্দরবনের পাড় ধীরে ধীরে ধসে যেতে থাকে যা সুন্দরবন এবং  শহর উভয়ের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। 

দুই, ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হতে থাকে, মানুষ নিঃস্ব হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় করে এবং দিনে দিনে শহরের জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে। জনসংখ্যা প্রবল বৃদ্ধির কারণে তথাকথিত উন্নয়ন লাগামছাড়া হয়ে যায়। ভোগবাদী জীবনযাপনের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যাপক হারে মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স, জিম, অত্যাধুনিক স্পা, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি নির্মিত হয়। পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতলে শহর ছেয়ে যায়। পানীয় জলের প্রয়োজনে বেলাগাম ভূ-জল নিষ্কাশন হয়, শহরের ভূ-জলের স্তর ধীরে ধীরে নামতে থাকে। 

শহর কলকাতা জলাভূমি ও পলিমাটির ওপর স্থাপিত। এর ভিত সূচনাকাল থেকেই নরম ও ঠুনকো। শহরটিকে বাঁচানোর জন্য আর একটি প্রাকৃতিক বাফার হচ্ছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। শহরকে কল্লোলিনী করার তাগিদে সেই ষাটের দশক থেকে এই জলাভূমিতে বৈধ-অবৈধ নির্মাণ চলছে। পুরো সল্ট লেক উপনগরী বিভিন্ন লেক, জলা, বিল বুজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। সেটির ভিতও পলকা ও ঠুনকো। ইএম বাইপাস জলাভূমি এবং শহরের আরও সর্বনাশ করেছে। প্রথম কথা, তা জলাভূমিকে আরও সংকুচিত করেছে। দ্বিতীয়ত, শহরের বৃষ্টির জল আগে যেমন প্রাকৃতিক উপায়ে জলাভূমিতে গিয়ে পড়ত, তা এখন আর সম্ভব হয় না। কারণ, এই রাস্তা একটা বাঁধের মতো হয়ে গিয়ে সেটাকে আটকে দেয়। শহর হয়ে গিয়েছে একটা গামলার মতো, যেখানে অতিরিক্ত জল রুদ্ধ পয়ঃপ্রণালি এবং বাইপাসের কারণে বেরোনোর জায়গা পায় না, যার ফলে অল্প বৃষ্টিতেই শহর হয়ে পড়ে জলমগ্ন। 

পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বিপন্ন- এটা বারবার পরিবেশবিদরা বলছেন, কিন্তু তবুও নিত্য নতুন প্রকল্পের শেষ নেই। চিংড়িঘাটা থেকে নিউ টাউন একটি ফ্লাইওভারের পরিকল্পনা গত তিন বছর ধরে চলছে যাতে নাকি মাত্র ১০-১২ কাঠা জলাভূমির জমি ব্যবহৃত হবে। কোর্ট কাছারি করে আপাতত সেটাকে আটকানো গেছে। আসলে বিপদ যে দোরগোড়ায়, এটাকে কেউ আমল দিচ্ছে না বা উপলব্ধি করছে না। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটলেই হল। বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংস্থা কিন্তু বিপদ ঘন্টা বাজিয়েই যাচ্ছে। ‘ক্লাইমেট সেন্টার’ নামক একটি সংস্থা বলছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ নাগাদ মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই এবং সুরাটের প্রায় পুরোটাই জলমগ্ন হয়ে পড়বে কিংবা নিয়মিত সেখানে বন্যা হবে। আর একটি সংস্থা বলছে, এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই এই চারটি শহর ছাড়াও নিউ ইয়র্ক, মিয়ামি এবং জাকার্তা পুরোপুরি ডুবে যাবে। 

বলাই বাহুল্য, বিশ্ব উষ্ণায়ন কমবে যদি কার্বন নির্গতকরণ কমে। এর জন্য প্যারিস চুক্তি হয়েছে। কিন্তু যে সব দেশ কার্বন নির্গতকরণের জন্য সবচেয়ে দায়ী তারাই সেই চুক্তি মানছে না। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে। ওখানে নতুন কোনও প্রকল্প করা যাবে না। বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত তুফান উঠবে। অমিতাভ ঘোষ বলছেন, সেই প্রাচীন কাল থেকে ঝড়বৃষ্টি আমাদের লোককথা, সাহিত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মঙ্গলকাব্যে তো প্রলয়ের ছড়াছড়ি; চাঁদ সওদাগরকে ব্যাতিব্যস্ত রাখার জন্য মনসা দেবী একটার পর একটা ঝড় সৃষ্টি করেন। পরিবেশ ব্যাপারটা মারাত্মক কিছু নয়, আবার নিরীহও কিছু নয়। সেটা তার নিজের গতিতে চলে। প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করা আমাদের বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনে উন্নয়নের ধুয়ো তুলে শিল্প গড়া চলবে না, পর্যটনের ধুয়ো তুলে হোটেল, রিসর্ট গড়া বন্ধ করতে হবে।    


Posted by Ekak Matra at 19:49 3 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Sunday, 23 May 2021

মনুষ্য-সৃষ্ট?

কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি

শোভনলাল চক্রবর্তী


করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে গত ১৫ মাসে আলোচনা নেহাত কম হয়নি। ভাইরোলজিস্ট, বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক, চিকিৎসক থেকে শুরু করে বহু সাধারণ মানুষ এই ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মত দিয়েছেন। সেই সব মত নানা মাধ্যমে আমরা দেখেছি বা পড়েছি। বিভিন্ন মতের মধ্যে পাওয়া গেছে প্রধানত তিনটি মতের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। প্রথমত, এই ভাইরাস প্রাকৃতিক। প্রকৃতির এ এক নিদারুণ প্রতিশোধ, মানুষের প্রকৃতির প্রতি অবহেলার যোগ্য জবাব। দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাস কোনও এক পরীক্ষার ভুলত্রুটির কারণে নেহাতই দুর্ঘটনাবশত ল্যাবরেটরির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তৃতীয়ত, এই ভাইরাস একটি জীব-বৈজ্ঞানিক অস্ত্র , যার সাহায্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা হ্রাস করা হবে এবং এটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্রের অংশ, যার সাহায্যে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করা হবে 'ওয়ান ওয়ার্ল্ড, ওয়ান অর্ডার'। 

এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয় তা হল, যখন সাধারণ মানুষের সামনে কোনও ঘটনা ঘটার একাধিক ব্যাখ্যা থাকে তখন প্রবৃত্তিবশত মানুষ সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যাটিকে মেনে নেয়। এর একটি বৈজ্ঞানিক পরিভাষা আছে তাকে বলে 'Occum's razor' (ওখামের নরুণ)। এ ক্ষেত্রে মানুষ যে ব্যাখ্যাটি মেনে নিয়েছিলেন, সেটি হল বাদুড় থেকে ভাইরাসটি উহানের ওয়েট মার্কেটের কোনও প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় সংক্রমণটি জুওনটিক, অর্থাৎ প্রাণী থেকে মানব দেহে সংক্রমিত। 

মানুষের মনে এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছিল একাধিক কারণে। যার প্রথমটি হল, করোনা-১৯ ছড়িয়ে পড়ার শুরুতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর পক্ষে যে আধিকারিক ও চিকিৎসক দল চিনের উহানে গিয়ে এই ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালান, তাঁদের ক্লিন চিট। তাঁরা চিনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে ভাইরাসটি সম্পর্কে চিন যে বিশ্ববাসীকে আগাম সতর্ক করেছে এবং ভাইরাসটি যাতে উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার জন্য তাঁরা যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে এবং এর জন্য তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। প্রসঙ্গত এটা জানিয়ে রাখা দরকার যে, উহানে অবস্থিত উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি থেকেই এই ভাইরাসটির উৎপত্তি- এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে চিন এবং হু দুই তরফই প্রবলভাবে আপত্তি জানায়, যে যার নিজের মতো করে। 

চিনে যে চক্ষু বিশারদ প্রথম সবাইকে ই-মেল করে জানান যে একটি অজানা ভাইরাসের প্রকোপে উহানে প্রচুর মানুষ শ্বাসকষ্ট জনিত অসুখে ভুগছেন এবং মারা যাচ্ছেন, তাঁকে পত্রপাট জেলে বন্দি করা হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তবে ওই ই-মেল প্রকাশ্যে আশায় চিন বাধ্য হয় করোনা-১৯ ভাইরাসের কথা স্বীকার করতে। সেই সময় হু পৃথিবীর ভাইরোলজিস্টদের অনুরোধ করে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে। সেই অনুরোধ লুফে নেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাইরোলজিস্ট পিটার ডেসড্যাগ। তিনিই উদ্যোগী হয়ে পৃথিবীর সব বড় বড় ভাইরোলজিস্টকে যুক্ত করে একটি চিঠির বয়ান তৈরি করেন এবং সেই চিঠি ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে প্রকাশিত হয় ল্যানসেট পত্রিকায়। সেখানে স্পষ্ট ভাবে জানানো হয় যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিক এবং জুওনটিক। এর সঙ্গে উহানের ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজিকে যুক্ত করে দেখার কোনও কারণ নেই। 

এর ঠিক পরেই ১৭ মার্চ ২০২০ তারিখে আমেরিকার আর এক বিখ্যাত ইমিউনোলজিস্ট ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসন ও তাঁর সহ-গবেষকদের লেখা একটি চিঠি প্রকাশিত হয় নেচার পত্রিকায়, যেখানে তাঁরা স্পষ্ট করে জানান যে কোভিড-১৯-এর গঠনতন্ত্রই প্রমাণ করে যে এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরিজাত হতেই পারে না। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মনে প্রাকৃতিক ভাইরাস তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা পায়। 

এরপর আসতে শুরু করে হু-এর নানাবিধ সতর্ক বার্তা, যা অনেক সময় ছিল স্ববিরোধী। তবে বিজ্ঞান তো এই ভাবেই এগোয়, ভুল করতে করতে সে নিজেকে শোধরায়। কিছুকাল পরে এল করোনা বায়ুবাহিত তার প্রমাণ, বিজ্ঞানী জেনেথ টুথেচ্চি সেই কাজ করলেন। হু এরপরই মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করে। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বাধ সাধল কয়েক সপ্তাহ আগে বিজ্ঞানের একেবারে ওপরের দিকে যারা ওপরে, এমন একটি পত্রিকা 'বুলেটিন অফ দ্য এটমিক সায়েনটিস্ট' পত্রিকায় নিকোলাস ওয়েড-এর একটি দীর্ঘ প্রায় রহস্য উপন্যাস-সম করোনা-১৯ সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ। নিকোলাস ওয়েড ২০১২ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস'এর বিজ্ঞান সম্পাদক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শেষ করেন। তাঁকে সারা বিশ্ব চেনে বিজ্ঞান সাংবাদিকতার জনক হিসাবে। বর্তমানে নিকোলাসের বয়স ৮০, তিনি লেখেন খুব কম, কিন্তু যখন লেখেন তখন সারা বিশ্ব গোগ্রাসে গিলে ফেলে তাঁর লেখা। সাম্প্রতিক প্রবন্ধটিতে তিনি যে শুধু করোনার উৎস সন্ধান করেছেন তাইই নয়, প্রায় পাকা গোয়েন্দার মতো জোড়া দিয়েছেন করোনা সংক্রান্ত জিগ-স পাজেলের বিভিন্ন অংশগুলি, যেগুলি জোড়া লাগিয়ে পাওয়া সম্ভব একটি স্পষ্ট ধারণা। 

নিকোলাস শুরুতেই একটি সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, আজ যখন বিজ্ঞান এতটা অগ্রসর হয়েছে, তখন কোন প্রাণী থেকে কোভিড মানব দেহে সংক্রমিত হল, সেই প্রাণীটিকে আজ ১৫ মাস পরেও খুঁজে পাওয়া গেল না কেন? সার্স-১'এর ক্ষেত্রে ৪ মাসের মধ্যেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে বাদুড় থেকে সিভেট জাতীয় এক বন্য প্রাণী (যা দেখতে বেড়ালের চেয়ে একটু বড় এবং চিনেরা সিভেটের মাংস খান) থেকে এই সংক্রমণ মানুষের শরীরে এসেছে। মার্সের ক্ষেত্রে ৯ মাসের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল যে বাদুড় থেকে উটের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি মানুষকে সংক্রমিত করেছে। কিন্তু কোভিডের ক্ষেত্রে প্রাণীটি কী? এরপর তিনি লিখেছেন যে কারা এই প্রচার করছেন যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিক? পিটার ডেসড্যাগ? (একটু স্মরণ করাই, ইনিই সেই যিনি দলবদ্ধ ভাবে ল্যানসেট'এ পত্র পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিক) যিনি আমেরিকার ইকো হেলথ আলাইন্স-এর প্রেসিডেন্ট, যাঁদের অর্থে চলে উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি। এতেই থেমে থাকেননি নিকোলাস, তিনি ডেসড্যাগের ২০১৯-এর ৯ ডিসেম্বরের একটি সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করেছেন যেখানে ডেসড্যাগ বলেছেন যে তাঁরা উহানে করোনা ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছেন। যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে, এই ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় তৈরি ভাইরাস কতটা বিপদজনক, তখন ডেসড্যাগ এক লম্বা বক্তব্য পেশ করেন যার মূল প্রতিপাদ্য দুটি। এক, মানুষকে যদি প্রকৃতিকে জয় করতে হয় তবে একটু রিস্ক তো নিতেই হবে। দুই, যাঁরা অর্থ জোগাচ্ছেন তাঁদের একটা চাহিদা থাকে। এই ভাইরাসটি তাঁদের সার্সের কোনও দ্বিতীয় ঢেউ এলে সাহায্য করবে সবার আগে ভ্যাকসিন তৈরি করতে। আজ যদি প্রমাণিত হয় ওই ল্যাবরেটরি থেকেই করোনা ছড়িয়েছে তবে সেটা ডেসড্যাগ'এর জন্য মোটেই সুখের হবে না। স্পষ্টতই ডেসড্যাগ'এর স্বার্থ ছিল করোনা প্রাকৃতিক এটা প্রমাণ করার। 

ডেসড্যাগ'এর পর নিকোলাস লিখেছেন এন্ডারসনকে নিয়ে, যে এন্ডারসন নেচার পত্রিকায় করোনার গঠনতন্ত্রের উল্লেখ করে বলেছিলেন যে করোনা প্রাকৃতিক। এন্ডারসনের যুক্তি ছিল দুটি: প্রথমত, মানুষ যদি তৈরি করত এই ভাইরাস তবে ওই ভাইরাসের যে তীরের মুখ (স্পাইক) তার মাপ আর কোষের মধ্যে যে খাঁজে এই তীরের মুখ ঢুকছে তার মাপ এক হত। কিন্তু সেই মাপ আলাদা। দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাস আরএনএ ভাইরাস, যা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় ল্যাবরেটরিতে তৈরি সম্ভব নয়, ডিএনএ হলে তাও হতে পারত। এই দুটি যুক্তিকেই নির্মমভাবে খণ্ডন করেছেন নিকোলাস। তিনি লিখেছেন, এন্ডারসন প্রভাবশালী বিজ্ঞানী, তাঁর কাজের ও মুখের দিকে টাকার থলে নিয়ে তাকিয়ে থাকেন ফার্মা কোম্পানিরা। এন্ডারসন একজন বিজ্ঞান মাফিয়া। তাই  তিনি ভাবছেন, তিনি যা বোঝাবেন, তাঁর বশংবদরা তাতেই সায় দেবেন। তা হয়তো দিতে পারেন তাঁরা, কিন্তু বিজ্ঞানের কোনও দায় নেই এন্ডারসনকে মেনে নেওয়ার। নিকোলাস পাল্টা লিখেছেন মানুষের তৈরি বলেই খাঁজের মাপের অমিল রয়েছে। কারণ, প্রতিসাম্য (সিমেট্রি) প্রকৃতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এছাড়া এই তীরের মুখে যে দুটি প্রোটিন আছে এস- ১ এবং এস- ২, তারা গিয়ে যে খাঁজে (ফুরিন ক্লিভেজ) পড়ে কোষের পর্দা ছিঁড়ে ফেলে সেই প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা হয়ে গিয়েছে ১৯৯২ সালে এবং ফুরিন ক্লিভেজ প্রাকৃতিক ভাইরাসে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং, নতুন বা অজানা কিছুই নয়। দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে (আরএনএ-ডিএনএ) নিকোলাস লিখেছেন যে এন্ডারসন ডাহা মিথ্যা বলছেন। তিনি সব জানেন, জেনেশুনে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। 

এরপর যা লিখেছেন নিকোলাস তা বিস্ফোরক। তিনি লিখেছেন, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে হল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত পরীক্ষা করা হয়। আর আজ আরএনএ'কে ডিএনএ বা উল্টোটা করা কাট-পেস্ট প্রযুক্তিতে ছেলেখেলা। এই যে সারা দুনিয়া জুড়ে কোভিডের জন্য রিয়েল টাইম পিসিআর পরীক্ষা হচ্ছে সেখানে নাক এবং গলা থেকে আরএনএ সংগ্রহ করে এনজাইমের মধ্যে ডিএনএ-তে রূপান্তর করে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় এনে দেখা হয় আরএন-এর পরিমাণ। বিগত বছরগুলোতে ১৯১৮-এর ফ্লু নিয়ে বা পোলিও ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষায় এই আরএনএ- ডিএনএ রূপান্তর করা হয়েছে। নিকোলাস আবেদন করেছেন, বিজ্ঞানীরা অতঃপর মানুষকে ভুল বোঝানো বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে দেখুন যে উহানে, যেখানে এই ভাইরাসের নতুন রূপ নিয়ে পরীক্ষা চলছিল, সেরকম একটি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার (স্টেজ ফোর) ল্যাবরেটরি থেকে ভাইরাস বাইরে এল কী করে। 

নিকোলাস যে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় একটি বোমা ফেলেছেন, তা বলাই বাহুল্য। এখন অনেকেই বলছেন, তাঁরা ডেসড্যাগ বা এন্ডারসনকে চটাতে চাননি। তাই তাঁরা সব জেনেও মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, কারণ, ওই দুজনের হাতে প্রচুর প্রজেক্ট, প্রচুর গ্রান্ট। যাঁরা মুখ খুলেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন করোনা বায়ুবাহিত প্রমাণ করেছিলেন যিনি, সেই জেনেথ টুথেচ্চি। তিনি একাধিক টুইটে জানিয়েছেন, এক্ষুনি এই বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে কাজ শুরু হোক। মুখ খুলেছেন চিনের সেই মহিলা বিজ্ঞানী হি জেঙ লি যাঁকে 'ব্যাড লেডি' বলে তকমা মেরে দিয়েছে সারা দুনিয়া। তিনি কার্যত নিকোলাসের সঙ্গে সহমত হয়ে জানিয়েছেন, কারুর ক্ষতি করার জন্য তিনি কিছু করেননি। নিকোলাসের সঙ্গে একশো শতাংশ সহমত হয়েছেন ১৯৭৫ সালের চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্যালটেকের ডেভিড ব্যলটিমোর। তিনি লিখেছেন, নিকোলাস একটি যুগান্তকারী কাজ করেছেন। তিনি করোনা ভাইরাসের উপর থেকে তুলে দিলেন প্রযুক্তি ও গোপনীয়তার পর্দা। তিনি নিশ্চিতরূপে জানিয়েছেন যে ভাইরাসের ভাইরাল সিকোয়েন্স-এ ফুরিন ক্লিভেজ-এর উপস্থিতি প্রমাণ করে যে করোনা-১৯ প্রকৃতির তৈরি নয়, কোনও ল্যাবরেটরিতে তৈরি। 

ডেভিড নব্বই দশকের গোড়ায় ভারতে এসেছিলেন। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, আগামী দিনের পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে জীববিজ্ঞান, তাঁর সেই ভবিষ্যৎবাণী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমরা।

তথ্যসূত্র: বুলেটিন অফ দ্য এটমিক সায়েন্টিস্ট, নেচার ও সায়েন্স পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা।


Posted by Ekak Matra at 19:01 3 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Saturday, 22 May 2021

'বাম' কাহারে কয়!

... যারে তুমি পর ভাবো সে কি বাম হয়

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

(এ কথা আজ অনস্বীকার্য যে, গত দু-এক দশকে রাজনৈতিক-অর্থনীতির আমূল পরিবর্তনকে সম্যক ভাবে বুঝে উঠতে না পারার কারণেই বাম রাজনীতির পুরনো ও সাবেকি ধারা ক্রমশই ম্লান ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাই, গত দু-আড়াই শতকের বাম রাজনীতির মহাতল্লাটে ঢুঁ মেরে লেখক চেষ্টা করেছেন আজকের সময়ের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছতে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বামেদের নিদারুণ শক্তিহ্রাসের মূল উৎসটিকে সেই আলোকেই তিনি ধরতে চেয়েছেন। 'বামপন্থার সেকাল একাল: তুমি কি কেবলই ছবি!' শীর্ষক একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে তিনি গোটা চিত্রপটটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যা 'বিবক্ষিত'র ব্লগে (https://bibokshitowebzine.blogspot.com/2021/05/blog-post_22.html?m=1) প্রকাশ পেয়েছে। সেই নিবন্ধটির একটি ছোট গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তকে আলোচনা করা হয়েছে, তা নিচে প্রকাশ করা হল।)  

 

২০০৬ সালের ২৫ মে টাটার এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে সরকারি আধিকারিকরা যখন চুপিসারে দুপুরবেলা সিঙ্গুরে জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন খবর পেয়ে কৃষক রমণীরা হাতে ঝাঁটা-খুন্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসে সে দলকে তাড়িয়েছিলেন। সে খবর চাউড় হতেই অসুস্থ জ্যোতি বসু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওখানে কৃষক সভাকে না জানিয়ে টাটার দল গেল কেন? প্রশ্নটি খুবই অর্থপূর্ণ। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, একটি বামপন্থী দলের স্থানীয় কৃষক সংগঠনের অজান্তেই কৃষিজমি সম্পর্কে নতুন কোনও প্রস্তাবের রূপরেখা কেন ভাবা হয়েছিল? এই মত স্পষ্টতই, একটি বামপন্থী দলের স্বাভাবিক গণভিত্তি যে কৃষক সমাজ, তার গুরুত্বের কথা অনুধাবন করতে বলে। কিন্তু পুঁজিবাদের মায়ামোহে তদানীন্তন বামফ্রন্টের নেতারা এতটাই মশগুল যে নিজ পার্টির শ্রেণি ভিত্তি বা কর্তব্যকর্ম তাঁরা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। এর পরের ঘটনাবলী আমরা জানি।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সারা রাজ্য জুড়ে এক তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে আন্দোলনের ভাষা তাঁরা পড়ে উঠতে পারেননি। বিরোধী দলনেত্রী তাঁর সংসদীয় রাজনীতির কারুকৌশলে অচিরেই এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকায় চলে আসেন এবং ২০১১ সালের নির্বাচনের রায়ে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘকালীন সরকারের পতন ঘটে। বামফ্রন্ট বহির্ভূত অন্যান্য বামপন্থী শক্তি এই আন্দোলনে থাকলেও তাদের নানা ধরনের জড়তা ও মতান্ধ চিন্তাভাবনা থাকার ফলে তারা এই আন্দোলনের দায়ভাগকে শেষাবধি বহন করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের এক অবিমৃশ্যকারী আচরণ।

মুশকিল হল, বামফ্রন্ট বা সিপিএমের তরফে এই বিচ্যুতিটা তারা আজও বুঝে উঠে পারল না। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের প্রার্থী সিঙ্গুরে গিয়ে ‘শিল্পের শিলন্যাস’ করে এলেন। আর ভোটের ফলাফলে আবারও তাদের ভরাডুবি হল। সচ্ছল মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে বামপন্থাকে দেখার যে ভয়ঙ্কর পরিণাম, তা তাদের কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে হল। তবুও তাদের হুঁশ নেই। শ্রেণি আন্দোলন থেকে বিচ্যুত তাদের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব নিঃশব্দে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে ফেলেছেন যে! তাঁরা ভাবলেন, একরের পর একর জমি পেয়ে কর্পোরেটরা এসে সুবোধ বালকের মতো শিল্প গড়ে তুলবে আর সেই শিল্পে রাজ্যের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে! কী বিপদ! সাধারণ খবর রাখা একজন সচেতন মানুষও জানেন যে, প্রথমত, সস্তায় জমি পেয়ে কর্পোরেটরা যে সেখানে শিল্প গড়ে তুলবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই (এ হল বিগ মিডিয়া নির্মিত একটি মিথ); দ্বিতীয়ত, যদিও বা সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে তা হবে এতটাই অত্যাধুনিক যে সেখানে খুব সীমিত সংখ্যক দক্ষ বেকারেরই কর্মসংস্থান হতে পারে; আর তৃতীয়ত, সব থেকে মূল্যবান কথাটি হল (যা আমাদের শীর্ষ আদালতও তুলে ধরেছে) যে, উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মচ্যুতি হবে, তা নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থেকে অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ, নতুন শিল্প, সহায়ক-শিল্প মিলিয়ে সর্বমোট যারা কাজ পাবেন তাঁদের থেকে যারা কাজ হারাবেন তাঁদের সংখ্যাটা পরিমাণে অত্যাধিক।

এও মনে করে দেখুন, সিঙ্গুরে যে জমিটি নিয়ে এত লড়াই, সেই জমির উল্টোদিকে (হাইওয়ের ওপারে) সমপরিমাণ ঈষৎ নিচু একটি প্রায়-পরিত্যক্ত জমি ছিল, যে জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় মানুষজনের কোনও আপত্তিও ছিল না, সেখানে টাটাদের প্রস্তাবিত শিল্প গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কেন? কারণ, জমিটি যেহেতু অল্প নিচু ছিল, তাই সেখানে কিছু পরিমাণে মাটি ফেলে ভরাট করার দায় পড়েছিল তাদের ওপর। টাটারা সেই সামান্য ব্যয়টুকুও করতে রাজী ছিল না মুনাফার কিয়দংশে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে ভেবে। আর বামফ্রন্ট সরকার এমন নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেটদের পক্ষে দাঁড়াল যে, তারা টাটার সামান্য ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধিকে পর্যন্ত কৃষক ও বর্গাদারদের জীবনযাপন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার থেকেও বড় করে দেখল।

শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সোচ্চার প্রতিধ্বনি হয়ে যে বামপন্থী দলগুলির উত্থান ও বিকাশ, সেই তারাই এইভাবে হাতে লাল পতাকা নিয়ে ও মার্কসবাদের নাম করে প্রকারান্তরে শ্রমিক-কৃষকের বিপক্ষে গিয়ে রাজনীতির অতল জলে ডুবে গেল। অন্যদিকে, ভারতের প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের থেকে নিজেদের আলাদা করে যে আঞ্চলিক নতুন দলটি রাজ্যে ১৯৯৮ সালে তৈরি হয়, তারাই কৃষকদের স্বার্থে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও অন্যত্র কঠিন লড়াই চালিয়ে এক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হল। অথচ, এই দলের তেমন কোনও ঘোষিত মতাদর্শ নেই। দু’ দফায় সরকার চালিয়ে তৃতীয় বারের জন্যও তারা নির্বাচিত হল বেশ প্রবল সংখ্যাধিক্য নিয়ে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, তৃণমূল সরকারের কোনও ব্যর্থতা বা অসাফল্য ছিল না। অবশ্যই ছিল। কিন্তু এমন একটা আস্থা তারা রাজ্যের মানুষের থেকে আদায় করতে পেরেছে যে এক বড় সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেছেন, অন্য সব দলের থেকে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের পাশে তৃণমূল সরকার আছে। দুর্ভাগ্যের হলেও বাস্তবতা এই যে, পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা দলের মতোই তৃণমূলও নিজ দলীয় ক্ষমতা জাহির করতে পিছপা হয়নি, স্থানীয় স্তরে আগের জমানাগুলোর মতোই অনেক জায়গাতেই গায়ের জোর দেখিয়েছে। দুর্নীতিও কম করেনি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাতাবরণ তারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যার ভিত্তিতে মানুষ তাদের অপকর্মগুলিকে সার্বিক বিচারে কম গ্রাহ্য করে সুকর্মের ভিত্তিতে তাদের ওপরে আস্থা রেখেছে। উপরন্তু, এবারের নির্বাচনে বিজেপি নামক এমন এক ফ্যাসিবাদী শক্তি এ রাজ্যের নির্বাচনে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার বিরোধিতায় তৃণমূলও এক অটল লড়াইয়ের স্বাক্ষর রেখেছিল, তা দেখে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ওপর কুণ্ঠাহীন আস্থা জ্ঞাপন করেছে। 

এই যে নবতর এক সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগের কাণ্ডারী তারা হতে পেরেছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক আস্থাভাজন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠতে পেরেছে, বহু প্রকল্প ও জনমুখি অনুশীলনের দ্বারা প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে কল্যাণমূলক কার্যধারাগুলিকে পৌঁছে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলেছে। দেখে মনে হবে, তারা বোধহয় কোনও বাম মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে তাদের অগ্রাধিকার পিছিয়ে পড়ে মানুষদের প্রতি। লক্ষণীয়, ঘোষিত ভাবে তারা কোনও মতাদর্শের অনুসারী নয়। বামপন্থীদের যে দাবিগুলি চারপাশে বারবার উচ্চারিত হতে শোনা যায়, তারা সেইগুলিকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করে। হতে পারে তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, হতে পারে তা নির্বাচনে জেতার জন্য। এতে সমস্যা কোথায়? বরং, এ তো বেশ ভাল ব্যাপার যে, সংসদীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে ও বহু ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর সে কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত ও উদার করা অতীব জরুরি। আর এইভাবেই তো চাপে পড়ে সংসদীয় গণতন্ত্র উত্তরোত্তর আরও বৈধতা পায় ও মানুষের আস্থা অর্জনে বেশি বেশি করে সক্ষম হয়ে ওঠে। আর যতই তা হয়, সাবেকি ও সনাতন বামপন্থীরা যেন পিছিয়ে পড়তে থাকে। দেখা যায়, নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তি সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করে বামপন্থার কর্মসূচিগুলিকেই আরও উন্নত স্তরে ধারণ করে। সে অর্থে বলাই যায়, এ রাজ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার দৌড়ে তৃণমূলিরা সাবেকি বামপন্থীদের একেবারে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এ এক অভিনব প্যারাডক্স। 

বামপন্থাকে অন্তঃস্থ করেই সংসদীয় গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যেন আরও সবল হয়ে উঠছে। অথচ সেখানে বামপন্থী নামধারীদের কোনও ঠাই নেই। কারণ, তারা চিন্তা-চেতনা ও কর্মে পড়ে আছে কয়েক দশক পিছনে। আর সে জন্যই আজ এই একুশ শতকের বিশের দশকের গোড়ায় এসে আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশধারা কোন পানে এগোচ্ছে আর সংকটের সূত্রগুলি কোথায় আবর্তিত হচ্ছে ও সুপ্ত আছে, তা বোঝার আদৌ কোনও এলেম তাদের নেই। কারণ, বহুদিন হল তারা রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চাকে সমূলে বিসর্জন দিয়েছে। বামপন্থী নামধারী যাদের বলি (কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাসীদেরও সে তালিকায় ফেলে) তাদের আজকের সংকট ঠিক এইখানটাতেই (তবে অবশ্যই অন্য কিছু বামপন্থী শক্তি নতুন ভাবে এগিয়ে আসছে)। অথচ যারা বামপন্থী নামধারী নয়, তারা ঘোর বাস্তবে বেমালুম ধাক্কাটাক্কা খেয়ে বামপন্থীদের সম্ভাব্য ইস্যুগুলিকে নিয়েই বেশ এগিয়ে পড়েছে। এই ‘ধাক্কাটা’ ওই তথাকথিত ‘অ-বাম’পন্থীদের আরও গায়ে লাগে কারণ, সংসদীয় রাজনীতিই তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। তাদের পক্ষে তা বেশ আয়াসসাধ্যও, কারণ তাদের অত মতাদর্শের পিছুটান নেই। তাই বলি, নামে কী বা আসে যায়!

এই যে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি সম্পর্কে সাবেকি বামপন্থীদের অজ্ঞতা, তার আলোকেই নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে এখন তাঁরা সামাজিক ন্যায়-প্রকল্পগুলিকে ‘ভিক্ষার ঝুলি’ হিসেবে বক্রোক্তি করছেন। কারণ, তাঁরা জানেন না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে যে বহু কথিত ‘গিগ অর্থনীতি’র জমানা শুরু হয়েছে, সেখানে স্থায়ী ও যথেষ্ট কর্মসংস্থানের কোনও আয়োজন নেই। আধুনিক যন্ত্র এখন আয়েসেই বহু মানুষের কায়িক ও মানসিক শ্রম দুইই বেশ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম। অতএব, আগামী দিনে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্রমেই আরও সংকুচিত হবে। যে কারণে, ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর আলোচনা এখন কান পাতলেই সর্বত্র শোনা যায়। অর্থাৎ, বহু সংখ্যক মানুষের হাতে টানা কাজ থাকবে না, প্রযুক্তি ও তার আনুষঙ্গিক দক্ষতা বহুল পরিমাণে খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকবে, কাজের বাজারে এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হবে। তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে সমাজকল্যাণ মূলক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা শত গুনে বেড়ে যাবে। তাই, ‘ভিক্ষার ঝুলি’ বলে সেইসব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে অবজ্ঞা করাটা আসলে অজ্ঞতার দিকচিহ্ন। শিল্প স্থাপনা ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির যে বড়াই সাবেকি বামপন্থীরা করে থাকে তা অশ্বডিম্ব বৈ আর কিছু নয়। কারণ, সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানা শিল্প আর কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্য প্রবণতা নয়, যা কিছু নতুন গড়ে উঠছে তা সব মেঘের আড়ালে (ক্লাউড প্রযুক্তি)। এই নতুন ভার্চুয়াল শিল্পে বিশেষ ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু কাজের অধিকাংশ পরিসরটা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। এই সামগ্রিক উত্থানটাকে কি বামপন্থীরা বুঝতে পারছেন? বিপদটা সেখানেই।

তাহলে কি বলব যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বাধ্যত ক্রমেই বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠছে? অর্থাৎ, নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির অভিসারে তা কি আরও কল্যাণমূলক অবস্থান গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার বিষয়। এর উত্তর এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে কিছু হয় না। আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্প, বোলসোনারো, এর্ডোগান, নরেন্দ্র মোদির মতো চরম দক্ষিণপন্থী ও মতান্ধ শক্তিকেও নির্বাচনের ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসতে দেখছি। তা নিয়ে এ লেখায় বিশেষ কিছু বলার নেই। বরং বলা যাক- যারে তুমি বাম দেখ সে কি বাম নয়/ যারে তুমি পর ভাবো সে কি বাম হয়’। অতএব, এ এক জটিল ধাঁধাঁ।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই লেখায় শেষ কথাটি হল, যারা নামে ও কাজে বামপন্থী বলে নিজেদের মনে করেন (নানাবিধ কমিউনিস্ট সহ) তাদের আজ সময় হয়েছে একুশ শতকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সম্পূর্ণত নতুন উত্থানকে সম্যক অনুধাবন করে তাকে এমন ভাবে উপলব্ধি করা যাতে একটি যথার্থ সমাজ বদলের (পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে) কার্যসূচি আবারও নির্মাণ করা যায়। বলাই বাহুল্য, পুঁজিবাদ তার নিজ জোরেই টিকে থাকছে, দরকার পড়লে সে বামপন্থাকেই যতটা সম্ভব আত্মসাৎ করছে, আর সেই সুবাদে নামধারী বামপন্থীদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির কালবেলায় পুঁজিবাদকে অতিক্রমণের মহামন্ত্র নামধারী বামপন্থীদের এখনও জানা নেই, কারণ, তারা রাজনীতির এক গোলকধাঁধায় আপাতত বাঁধা পড়ে আছে।

 

Posted by Ekak Matra at 20:21 6 comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest
Newer Posts Older Posts Home
Subscribe to: Posts (Atom)

Blog Archive

  • ►  2025 (42)
    • ►  June (5)
    • ►  May (6)
    • ►  April (11)
    • ►  March (8)
    • ►  February (6)
    • ►  January (6)
  • ►  2024 (75)
    • ►  December (5)
    • ►  November (6)
    • ►  October (4)
    • ►  September (11)
    • ►  August (8)
    • ►  July (6)
    • ►  June (6)
    • ►  May (3)
    • ►  April (7)
    • ►  March (4)
    • ►  February (8)
    • ►  January (7)
  • ►  2023 (68)
    • ►  December (6)
    • ►  November (4)
    • ►  October (9)
    • ►  September (4)
    • ►  August (8)
    • ►  July (6)
    • ►  June (5)
    • ►  May (7)
    • ►  April (6)
    • ►  March (3)
    • ►  February (6)
    • ►  January (4)
  • ►  2022 (78)
    • ►  December (2)
    • ►  November (3)
    • ►  October (7)
    • ►  September (7)
    • ►  August (7)
    • ►  July (5)
    • ►  June (8)
    • ►  May (9)
    • ►  April (5)
    • ►  March (12)
    • ►  February (7)
    • ►  January (6)
  • ▼  2021 (195)
    • ►  December (9)
    • ►  November (13)
    • ►  October (11)
    • ►  September (19)
    • ►  August (20)
    • ►  July (16)
    • ►  June (21)
    • ▼  May (28)
      • 'ভারত পথিক'
      • মানুষ যাবে কার দ্বারে?
      • পুনরুদ্ধার সম্ভব
      • চাওয়া-পাওয়া
      • সোশ্যাল মিডিয়ায় হামলা
      • শ্রমের ভূমিকা
      • প্রলয়ের মুখে
      • মনুষ্য-সৃষ্ট?
      • 'বাম' কাহারে কয়!
      • 'বিশ্বসাথে যোগে যেথা বিহারো'
      • প্রতিহিংসার রাজনীতি
      • প্রকৃতির প্রতিশোধ?
      • নৈরাজ্য সৃষ্টিই উদ্দেশ্য
      • কোভিডের সুযোগে বন্দী হত্যা?
      • মেরুকরণের রাজনীতি পিছু হঠছে
      • হন্তারক
      • সেন্ট্রাল ভিস্তার বিলাসিতায়!
      • কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই
      • আগডুম বাগডুম
      • বাংলার জয়
      • মউত কা সওদাগর!
      • 'মন কি বাত'
      • অমিত চৌধুরী স্মরণে
      • প্রকৃত বিরোধী কই?
      • Was It Obvious?
      • বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ?
      • বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি
      • আমাদের যাপন
    • ►  April (21)
    • ►  March (9)
    • ►  February (12)
    • ►  January (16)
  • ►  2020 (113)
    • ►  December (6)
    • ►  November (7)
    • ►  October (8)
    • ►  September (10)
    • ►  August (14)
    • ►  July (8)
    • ►  June (14)
    • ►  May (20)
    • ►  April (14)
    • ►  March (3)
    • ►  February (1)
    • ►  January (8)
  • ►  2019 (27)
    • ►  December (4)
    • ►  November (2)
    • ►  October (4)
    • ►  September (1)
    • ►  August (2)
    • ►  July (5)
    • ►  June (3)
    • ►  April (3)
    • ►  January (3)
  • ►  2018 (18)
    • ►  December (2)
    • ►  August (2)
    • ►  July (2)
    • ►  June (3)
    • ►  May (3)
    • ►  April (2)
    • ►  March (1)
    • ►  February (1)
    • ►  January (2)
  • ►  2017 (27)
    • ►  December (1)
    • ►  November (4)
    • ►  October (1)
    • ►  September (4)
    • ►  August (4)
    • ►  July (2)
    • ►  June (2)
    • ►  May (1)
    • ►  April (2)
    • ►  March (5)
    • ►  February (1)
  • ►  2016 (56)
    • ►  December (3)
    • ►  November (8)
    • ►  October (4)
    • ►  September (6)
    • ►  August (6)
    • ►  July (2)
    • ►  June (6)
    • ►  May (2)
    • ►  April (2)
    • ►  March (6)
    • ►  February (4)
    • ►  January (7)
  • ►  2015 (62)
    • ►  December (4)
    • ►  November (3)
    • ►  October (7)
    • ►  September (4)
    • ►  August (4)
    • ►  July (4)
    • ►  June (5)
    • ►  May (4)
    • ►  April (1)
    • ►  March (7)
    • ►  February (8)
    • ►  January (11)
  • ►  2014 (63)
    • ►  December (5)
    • ►  November (4)
    • ►  October (6)
    • ►  September (12)
    • ►  August (7)
    • ►  July (8)
    • ►  June (4)
    • ►  May (3)
    • ►  April (4)
    • ►  March (1)
    • ►  February (4)
    • ►  January (5)
  • ►  2013 (23)
    • ►  December (5)
    • ►  November (7)
    • ►  October (4)
    • ►  September (7)

Contributors

  • Byango Me
  • Ekak Matra
  • অরুণাভ বিশ্বাস

Popular Posts

  • তর্কপটু ভাঙড়
  • কাদের খেলা?
  • Dr Manu Kothari passes away
  • কালো টাকার রহস্য
  • এক সাধারণের জবানিতে অভিজিৎ
  • কাশ্মীর নিয়ে দু-চার কথা
  • ধর্মের কল...
  • জলাতঙ্ক
  • ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফেলিস
  • বাংলাদেশঃ রাস্তা বন্ধ

Pages

  • Home
Picture Window theme. Powered by Blogger.