কী করিতে হইবে?
কৃশাণু মিত্র
নিজেকে বামপন্থী ভাবার স্পর্ধা আমার নেই। এই পথ একই সঙ্গে তপস্যা এবং যুক্তিবোধের পথ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এর প্রয়োগের ভূমি।
'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবির অর্জুনের হাতের ছুরি আসলে বিঁধছিল জটায়ু নয়, প্রদোষ মিত্র'র মরমে। কারণ, তার ভুলেই উক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। জটায়ুকে ভুগতে হয়েছিল। প্রতিনিয়ত নিজেকে কাটাছেঁড়া করে দেখতে হবে। সদর দফতরে কামান দাগতে হবে। সদর দফতর এখানে পার্টি বা সরকার নয়, আপন সত্তা। বিদ্যাপতির লেখায়, 'তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা...' (যে সাধক তৃণ অপেক্ষা নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেন, যিনি তরুর মতো সহিষ্ণু...)। নিজেকে দাগিয়ে বিশ্লেষণ করার নাম বামপন্থা। তা না হলে তুমি রাবণ, লঙ্কার অধিকার পেলেই খসে পড়বে ছদ্মবেশ।
এখন বিপ্লব বিদ্রোহ প্রতিবাদ দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেছে-- শান্তিপূর্ণ মার্কসবাদী ও গান্ধীবাদী। প্রথম দলে থাকা মানুষজন শতধা বিভক্ত। দ্বিতীয় দল গণতন্ত্র রক্ষায় বেনারস থেকে দিল্লি হাঁটছে, এখন সংবিধান বাঁচাও, ভারত জোড়ো, ভোটার অধিকার সহ বহু আন্দোলনে সামিল। বহু বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ যুক্ত হয়েছেন দ্বিতীয় দলে। আরেক দলও সংবিধান রক্ষার্থে বিহারে হাঁটছে। তারা আপাত গণতন্ত্র প্রকাশের মাধ্যম ভোটচুরি হয়তো আটকাতে সম্ভব হবে, কিন্ত দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের হদিশ দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
শ্রম ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষজন হাঁটছেন বা বলা উচিত দৌড়চ্ছেন জোম্যাটো বা ব্লিংকিটের বাইকে, পেটের জন্য। পরিষেবা ক্ষেত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে 'আরবান কোম্পানি' বা অন্য কারও হাত ধরে। পাড়ার কলের মিস্ত্রি জয়, নিজস্ব পরিধি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। আর বড় হাউজ বা সরকারি কর্মীরা নিরলস ভাবে অলস যাপনে লজ্জাহীন। বামপন্থা এই মধ্যবিত্তদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত, এআই এসে গেছে। তলিয়ে যাবে ভুলভাল বহু কাজ। যেমন, খাটা পায়খানা থেকে মাথায় করে মাটি বইতে আসে না এখন কেউ। খাটা পায়খানাই উধাও হয়ে গেছে। আজও যদি মার্কসবাদী বীক্ষণে ধরা না পড়ে প্রকৃত পথের নতুন রূপ, তাহলে নেতৃত্বের কারণেই মার্কস এ পোড়া দেশ ছেড়ে চলে যাবেন।
যে দল মানুষের জমি, জঙ্গল, বাঁচার উপায় ধ্বংস করছে সে দলই মানুষকে কলাটা মূলোটা দিয়ে লোভাতুর, বশীভূত করছে। কোথাও লাডলি বহিন, কোথাও পাঁচ কেজি আনাজ। যারা বিরোধী তক্তে নেই, তারা টাকা দেওয়া ভালো চোখে দেখছে না অথচ নিজেদের প্রচারের সময় বলছে আমরা অনুদান বাড়িয়ে দেব। যদি অনুদান ভালো হয় তাহলে অধিষ্ঠিত দলকে সমালোচনা করলে চলবে না, কেন কতটা হলে ভালো বলতে হবে। আর যদি খারাপ হয় তাহলে বললে চলবে না যে আমরাও দেব। ভোটের রাজনীতিতে এই ঠকবাজি, দ্বিচারিতা চলছে চলবে ভাবলে বামপন্থীরা নিজেদের ঠকাবে।
রাজনীতির সামনে অন্য কোনও পথ খোলা আছে কী?
কেন, যে পথ গান্ধীবাদীরা দেখাতে পারল সেই পথ মার্কসবাদীরা দেখাতে পারল কই? এখানেই লুকিয়ে আছে সমাজে আজ বামপন্থীদের অনাদরের মূল কারণ। গান্ধীবাদ আজ পথ দেখাচ্ছে সকল অবউন্নয়ন বিকাশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে। তাদের মোক্ষ নয় রাজ্যপাট। তাদের লক্ষ্য গণতন্ত্র। আর রাজ্যে একদা ক্ষমতায় থাকা বাম দল আজও টাটা'র ন্যানো (যে ন্যানোই আজ উঠে গেছে) নিয়ে হা-হুতাশ করে যাচ্ছে। এই অটোমেশন, এআই'এর যুগে বৃহৎ কারখানা কোনও সমাধান নয়, তা বুঝতে হবে। আজ বড় কারখানায় কর্মসংস্থান অতীব সীমিত। অতীতে প্রযুক্তিকে ফিরিয়ে দিয়ে আমরা ভুল করেছি, এই সত্য যত তাড়াতাড়ি মানা যায় ততই ভালো। আমাদের দেশে মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথ হল তক্তে বসার কৌশল। যারা জীবন বাজি রেখে বন্দুক সহযোগে নেমেছিলেন, তারা বিলুপ্তপ্রায়। অন্যরা ভোট সহযোগে মোক্ষ লাভে ক্ষমতায় পৌঁছনোর আশে বসে।
কিন্তু তারপর?
ভারতবর্ষে বর্তমানে ফ্যাসিস্ট শক্তি কায়েম হয়ে গণতন্ত্রের অপলাপ ঘটিয়ে যা খুশি করে যাচ্ছে। একইভাবে রাজ্যে স্বৈরাচারী শক্তি বিকশিত হচ্ছে, কারও কিছু বলার নেই। বামপন্থীরা সরকারে এলেও একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। ইতিহাসের শিক্ষা তেমনই।
তাহলে বামপন্থা কি কফিনে?
আপাতত টুকিটাকি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে কীভাবে এরা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারে:
এক) এক কেন্দ্রীয় দফতরের সরকারি ইউনিয়ন, যাদের গায়ে বামপন্থার তকমা লাগানো আছে, তারা একটি মিটিং করছে। ওয়ার্কশপে মাল যাতায়াত করার রাস্তায় ওপর দিয়ে ইলেকট্রিকের তার গেছে, বক্তব্য রাখছেন যিনি তাঁর স্ট্যান্ড মাইক্রোফোনে। লোডেড লরি আটকে আছে, নেতা নড়বেন না জায়গা ছেড়ে। কেউ কেউ অনুরোধ করল। গবুচন্দ্র কমরেডরা বলল, মিটিং শেষ হলে গাড়ি বের হবে। মানুষ যখন নিজে ক্ষমতার প্রতিভূ হয় তখন ভবিতব্য লেখা হয়ে যায়।
দুই) ইংরেজি তুলে দেওয়া হল, আবার চালু হল। কেন? মধ্যবিত্ত পোলাপান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। শ্রেণি সমঝোতার প্রকৃষ্ট উদাহরণে সাফার করল তারা, যাদের কোনওকালে ইংরেজি লাগবে না কোনও প্রয়োজনে। গণতন্ত্রকে আঘাত করা বামপন্থী মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের চেতনায় মাখো-মাখো। এই সুযোগে গড়ে উঠল ছাতারে পাখির মতো হাজারও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, যেখানে না আছে যোগ্য শিক্ষাব্রতী না পরিকাঠামো। কিউবা তৃতীয় বিশ্ব থেকে ডাক্তারি পড়ুয়া নিত এবং ছয় মাসে স্প্যানিশ শিখিয়ে ওই ভাষায় শিক্ষা দিত। যার দরকার সে শিখে নেবে, এই সত্যই পরম।
তিন) যে কোনও গণতান্ত্রিক নির্মাণকে নস্যাৎ করে দিতে মুহূর্ত সময় নেয়নি। মরিচঝাঁপি যার প্রমাণ।
আত্মীকরণ না হওয়া এবং অজ্ঞানতার কারণেও নতুন পথের সন্ধান করার সাহস নেই বামপন্থীদের। দক্ষিণ আমেরিকার বহু উদাহরণ আমরা কাজে লাগাতে পারি। পাথরপ্রতিমাতেও আমাদের সেরকম অভিজ্ঞতা আছে। ব্রাজিলে অগস্ট বোয়াল (এক নাট্য ব্যক্তিত্ব) প্রসিডেন্ট লুলা'র সময় কাউন্সিলর ছিলেন। তাঁর নিজস্ব নির্বাচনী কেন্দ্রে তিনি আঞ্চলিক আইন প্রণয়ন করেছিলেন গণতন্ত্রকে জোরদার করতে। আসলে গণতন্ত্র ছাড়া এই সময়ে কোনও রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয়। কিছুদিন আগে শ্যামল মুখার্জি, পথসেনা দলের এক সৈনিক-সেনাপতি যখন লিখলেন, বুদ্ধবাবু কীভাবে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আদান-প্রদানে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি জোর করে কিছু করেননি। বুদ্ধিজীবীরা তাকে মান্যতা দিয়েছিলেন। আমি প্রতিপ্রশ্ন রেখেছিলাম, এই আলোচনা জমি অধিগ্রহণের আগে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেন করা হয়নি? আসলে বুদ্ধিজীবী বুদ্ধদেব অপর এক ক্ষমতার সমর্থন ও মান্যতা চেয়েছিলেন। সেখানে সাধারণ মানুষ গৌণ। বুদ্ধিজীবীদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল কিন্তু শ্রমজীবীদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কেন রেফারেন্ডাম নেওয়া হয়নি? কেন জমির মালিককে তার ভালো কীসে জানতে চাওয়া হল না? গণতন্ত্রের ঠিকাদার কেবলমাত্র মানুষই হতে পারে, কোনও রাজনৈতিক দল নয়। বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার অর্থ হবে মানুষের দাবি, মানুষের মতামতকে মূল্য দেওয়া। 'সর্বহারার একনায়কত্ব' আজ গণতন্ত্র বিরোধী। উল্টোদিকের দলগুলিকে ভোটাররা ভোট দেবে, অনুদান নেবে, কখনও যুদ্ধের কখনও ধর্মের বড়ি খেয়ে।
তাহলে শূন্য থেকে শুরু করা যাবে কীভাবে?
১.০) অবশ্যই বিচার ব্যবস্থার দোরে দোরে ঘুরে ও তাদের নজরে পড়ে নয়। সরাসরি কাজে নেমে পড়ার মাধ্যমে। করোনার সময় যে ভাবে কাজ শুরু করা গিয়েছিল। মুশকিলটা অবশ্য এখানেও। করোনার সময় শুধুমাত্র 'রেড ভলেন্টিয়ার্স' কাজ করেনি। কাজ করেছিল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সাধারণ সমাজ বন্ধু। যাদের কাজটাই উদ্দেশ্য ছিল, তক্তের খুড়োর কল তাদের সামনে ছিল না। বালি অঞ্চলে নির্ভীক সংগঠনের পল্টু করোনার সময় কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে। কাজ শেষ হয় না, পুরুলিয়াতে চলেছে পল্টুর নামে পাঠশালা। অথচ শ্রমজীবী ক্যান্টিন শুরু হল আর সেই ক্যান্টিনের দায়ভার গেল কন্ট্রাকটরের কাছে। ব্যাস, প্রায় সব ক্যান্টিনের আঁচই নিবু নিবু। অর্থাৎ, দলে একজনও শ্রমিক নেতা নেই যিনি এই কাজে নিজে হাত লাগিয়ে পরিচালনা করতে পারেন, অথচ আমি বলছি আমার পার্টি শ্রমিক কৃষকের প্রতিভূ। একটু খোঁজ নিলে জানা যাবে, সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে কীভাবে কত ক্ষেত্র রাজনৈতিক দর্শনকে শিরোধার্য করে অরাজনৈতিক জায়গা থেকে উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছে। তার নির্যাস নিতে আমরা ব্যর্থ। আমরা দল হিসেবে কোনও লাগাতার নির্মাণের সঙ্গী হচ্ছি না। শংকর গুহ নিয়োগী একটি দর্শনের জন্ম দিয়ে গেছেন: 'সংঘর্ষ এবং নির্মাণ'। অথচ কোনও বামপন্থী দল এই দর্শনকে বুকে টেনে নিতে পারল না। অর্ধ শতাব্দী ধরে এই দর্শনের ফলিত রূপ দল্লি-রাজহারায় শহিদ হাসপাতালের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে বেঁচে আছে। সেই মডেলের নির্যাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করে চলেছে বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি; যারা শ্রমকেই পুঁজি ধরে পাঞ্জা কষে চলেছে ক্রোনি পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে।
শুরু হবে কীভাবে? ধরাধাম আজ ক্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্যে। দল বেঁধে বাজার দোকানে অহিংস প্রচার চলুক। দরকার মতো চাঁদা তুলে ডিগ্রেডেবল মেটিরিয়ালে অভ্যস্ত হোক মানুষ। এই ইন্ডাস্ট্রি বিকাশ লাভ করুক। রাসায়নিক সার, কীটনাশকহীন চাষ হবে, ক্ষেত্র প্রস্তত আছে। শুধু চাই রাজনৈতিক ইচ্ছা।
২.০) গণতন্ত্রের প্রহরী হিসেবে থাকব, সরকারে যাব না। সরকারি দল চাইবে মদত। নির্বিকার পূজারী হব প্রকৃতির। অধিকারের দাবি সামনে আনব। লক্ষ থাকবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। আইনানুগ কাজ না হলে প্রতিবাদ করব। যে মানুষ কাঁদছে তার পাশে দাঁড়াব। মানুষ হয়তো একদিন দাবি করবে, ক্ষমতায় এসো। তোমাদের চাই আমরা।
৩.০) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাই অভিনিবেশ। ইউরোপের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, ভাবনাতেও আমাদের দেশিয় বামপন্থীরা কত পিছিয়ে। সেখানে ডাক্তারের ছেলের ডাক্তার হওয়ার মানসিক চাপ নেই, স্বচ্ছন্দে সে সেলসম্যান হয়ে রোজগার করে বেহালা কিনে বাজায়। হয়তো কেউ সরকারি অনুদান নিয়ে বেঁচে আছে আর মনের মতো কাজ করছে। এই পরিস্থিতি-কাল এখানেও আসবে। কারণ, এআই কর্মহীন করে দেবে মানুষকে। কেরানি নেই, ওপিডিতে ডাক্তার লাগছে না, আদালতে বিচার হবে অতীত জাজমেন্টের ভিত্তিতে। ব্রিজ ডিজাইন করবে এআই। যখন প্রযুক্তি উদ্বৃত্ত দেবে তখন রাষ্ট্রীয় অনুদানকে কে হ্যাটা করবে? তখন দাবি উঠবে অনুূদান বাড়ানোর। তখন মূল্যায়ন হবে, কোন্ মানুষকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে হচ্ছে, তাকে দিতে হবে বেশি অনুদান। চাষের কাজ আধুনিক পদ্ধতিতে হবে সমবায় করে। তখন কৃষি ক্ষেত্রে শ্রম দেওয়া মানুষকে দিতে হবে বেশি অনুদান। নজরদারি চলবে সব ক্ষেত্রে। বামপন্থীরা ছাড়া কে করবে এই নজরদারি? আর অনুদানের সমবন্টন চাই কর্ম অনুযায়ী, 'ফসলের সমবন্টনের' প্রকৃত রূপ হয়ে । কারণ, সরকারকে ফসলের জোগান দিতে হবে তার জনগণকে।
বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই।