Pages

Friday, 20 December 2024

অধ্যাপক বাগচীকে যেমন দেখেছি

একজন দার্শনিক ও আদর্শ শিক্ষক

বিনয় কৃষ্ণ পাল


(১৯৩৬ - ২৮ নভেম্বর ২০২৪)

আমৃত্যু মানবতাবাদী ও বামপন্থী অর্থনীতিবিদ শুধু নয়, একজন দার্শনিক, আদর্শ  শিক্ষক এবং মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী। এমফিল পড়ার সময়েই দেখেছি, এত বড় মাপের একজন মানুষ মাটির কাছাকাছি থেকে ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে শেখাতেন, তাদের সঙ্গে সতত যোগাযোগ, আত্মীয়সূচক ব্যবহার ও পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করতেন। দেখা হলে প্রথমেই, 'কেমন আছো বিনয়?', কেমব্রিজ ছেড়ে আসা এক অধ্যাপকের সাথে এক সাধারণ ছাত্রের সমস্ত মানসিক দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে দিত। 

একমুখি বই-নির্ভর পড়ানোর বদলে দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য, সিনেমা, ঘটনা, গল্পের মাধ্যমে আমাদের শেখার পরিধি বহুধা বিস্তৃত করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে IDSK'এর পড়া শেষ হলেও, ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মী ও স্যারের সাথে যোগাযোগ রাখি। ২০১৫ সালে ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জানতে পারি তিনি কিছুটা একাকিত্বের মধ্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে মাঝে মধ্যেই তিনি আমায় বাড়িতে ডাকতেন। স্যারের বাড়ির এক সহায়ক একদিন রাত্রে আমায় খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে খাবার পাতে এক খণ্ড ইলিশ মাছ তুলে দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই ইলিশ উদরস্থ করি। খেতে খেতেই এক দিকে কথা বলছি, অন্যদিকে চোখ প্লেটে পড়ে থাকা আরও দুই খণ্ড ইলিশের দিকে। স্যার বুঝতে পেরেই  বলেন, 'ওই দুটিও তোমারই জন্য!' শুনে আমার চোখে আনন্দ ফুটে ওঠে এবং উনি হাসতে হাসতে বলেন, 'বাঙালিকে মাছ এবং মূলত ইলিশ দেখে চেনা যায়!' খাওয়ানোর তৃপ্তি ও রসিকতা আমায় আপ্লুত করে, যা আজও স্মৃতিতে বয়ে নিয়ে চলেছি। একান্ত সেই আড্ডাগুলিতে আরও পরিশীলিত হয়েছে আমার অর্থনীতি, ইতিহাস ও রাজনীতির জ্ঞান। বারবার বলতেন শুম্পেটার, মার্কস, স্মিথ, অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্রনাথকে পড়তে, বুঝতে, লিখতে, 'পড়তে ও লিখতে লিখতেই হাতে লেখা আসে।' উৎসাহ দিতেন-- যা পড়ছি, সঠিক বলে ভাবছি, তা মুক্তকণ্ঠে-নির্ভয়ে বলতে। 

ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পূর্ব ভারতে সেন্টারের (কলকাতার 'সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস') মতো ঐতিহ্যশালী সমাজ বিজ্ঞান চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও IDSK তৈরি করার পিছনে আপনাদের কী চিন্তা-ভাবনা ছিল? উত্তরে বলেছিলেন, 'আমাদের সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির সমাজ বিজ্ঞানের যে চর্চা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই কম। তথ্য সংগ্রহে নানা কারচুপি, ছল-চাতুরি থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বাস্তব উঠে আসে না! IDSK তৈরি এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কোর্সের মাধ্যমে আমরা একদিকে একটি উন্নততর সমাজ গঠনে জ্ঞান চর্চা, তাত্ত্বিক সমাজ বিজ্ঞান চর্চা এবং বর্তমান সমাজের নানা জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক মানুষজন, পরিবেশ এবং সর্বোপরি মাটির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তোমরা যদি ক্রমাগত ফিল্ড ওয়ার্ক করে, যাচাইযোগ্য তথ্য ও ঘটনার মাধ্যমে একদিকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও বর্তমান সময়ের সমস্যা তুলে ধরতে পারো এবং তাদের সমস্যায় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারো, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।' গরিব কৃষকদের থেকে বহুফসলি জমি কেড়ে শিল্পায়নের বিরোধী ছিলেন অধ্যাপক বাগচী। মূলত অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও জ্ঞানের বিস্তৃত পরিসরে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। 

সদ্য কিছুদিন কলেজে পড়ানোর সুবাদে ওনাকে জানিয়েছিলাম, 'আমার কলেজগুলির অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী খুব প্রান্তিক স্তর থেকে আসা, ওদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমার তরফ থেকে অনেক সমস্যা বোধ করছি, মনে হচ্ছে ওদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছতে পারছি না।' নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করার সুবাদে তিনি আমায় কিছু পরামর্শ দেন ও IDSK লাইব্রেরি থেকে আমার হাতে একটি অসামান্য বই  তুলে দেন: The Pedagogy of The Oppressed। উন্নয়নশীল ও বিপুল বৈষম্যের দেশে শিক্ষক-শিক্ষণ, প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে ব্রাজিলিয় লেখকের কালজয়ী সৃষ্টি এই গ্রন্থ আজও আমার অবশ্যপাঠ্য। 

আমাদের অগ্রজদের থেকে শোনা, বাগচী স্যারের (একদিনের) এক নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ ছিল তাঁদের জন্য। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের তাগিদে হঠাৎ/ বিলম্বে তাঁর অফিসে হাজির। অফিস থেকে স্যারের কাছে বার্তা পাঠালে তিনি জানান, 'ওরা অপেক্ষা করুক। আমার কাছে ছাত্রছাত্রীদের সময় আগে। এখন হঠাৎ ওদের জন্য ছাত্রছাত্রীরা তার মাশুল দিতে পারে না।' ছাত্রছাত্রীদের ও তাদের সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতার এরকম নজির সত্যি বলতে আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। উদারমনস্ক, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বাগচী কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার ঘেরাটোপে জীবন তৈরিতে নিরাসক্ত ছিলেন। তাই একদিকে যেমন বেলুড় মঠের পড়া ছাড়তে বাধ্য হন, তেমনই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান IDSK'কে এক মুক্তাঙ্গন হিসেবে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। অধ্যাপক বাগচী ছাড়াও আমরা পেয়েছিলাম গবেষণা শেখার কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষক-গবেষক ও পরিমণ্ডল। 

বয়সে বৃদ্ধ হলেও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন চির কিশোর, তাই হয়তো আমাদের মতো শিক্ষানবিশদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত ক্ষেত্র সমীক্ষা ও তা থেকে পাওয়া ফলাফলের ব্যাপারে মনোযোগ সহকারে শুনতেন, আমাদের মতামতের ওপর শিশুসুলভ তর্ক করতেন এবং তাতে সত্যিই অহংবোধ বা দমিয়ে দেওয়ার লেশমাত্র থাকত না। হরিয়ানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যুক্ত হওয়ার সুবাদে দিল্লি ও গুরুগ্রাম কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ ও তাঁর ছাত্রদের যোগাযোগ দিয়েছিলেন আমায়। 

নিয়মমতো ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমার অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের কুশল নেওয়ার সময় অমিয় স্যারের অসুস্থতার কথা বললাম। উনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'খুবই অসুস্থ! সামনে গিয়ে দেখা করলেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তাই যেতে পারছি না!' ফোন রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওনার আবার বার্তা, অধ্যাপক অমিয় বাগচী নেই! আমার নতুন কাজে যোগ দেওয়া ও সেখানকার অভিজ্ঞতার বিষয়ে শুনতে আমায় কোনও এক ছুটির সকালে দেখা করতে বলেছিলেন। নভেম্বরের সন্ধ্যার মলিনতা আমার জীবনের একটি সকাল গ্রাস করল! দেশ-সমাজ জীবনের চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে আলোর দূত হয়ে আসা আমাদের প্রিয় শিক্ষক চলে গেলেন, আমরা অভিভাবকহীন হলাম! সামনে থাকল এক শোষণহীন সমাজ গঠনে তাঁর সুবিশাল কর্মজীবনে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া আলোকবর্তিকা। 

অধ্যাপক বাগচীর মৃত্যুতে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ওনার বহুধা বিস্তৃত কাজের কিছু অংশ আন্তর্জাল ও সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে। বিস্তারিত নিচের এই লিঙ্কে পাওয়া যাবে- 

https://shorturl.at/JB2jy


Wednesday, 18 December 2024

অমৃতলোকে সংশপ্তক সাধক

স্বয়ং প্রজাপতির তুল্য

অমৃতা ঘোষাল


(৯ মার্চ ১৯৫১ - ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪)

'তুই হাততালি দিলে জ়াকির হোসেন

তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন...'

(কবীর সুমন)

গায়কের এই অহেতুক স্বপ্ন গেল অস্তাচলে! অজস্ৰ শিল্পবেত্তার হৃৎস্পন্দনকে তীব্রভাবে আন্দোলিত করা সেই তবলার বোল আর বাজবে না। 'ওয়াহ তাজ' বলে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ভঙ্গিটিও আর তিনি বিনির্মিত করবেন না! তবলা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কোঁকড়া কেশগুচ্ছের হিল্লোল পুরুষ-সৌন্দর্যের গতানুগতিক মাপকাঠিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। 

ওস্তাদ আল্লাহ রাখা'র (২৯ এপ্রিল, ১৯১৯ - ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০০) সুপুত্র জ়াকির ধ্রুপদী শিল্প-সংস্কৃতির পরিসরে বেড়ে উঠেছিলেন। তবলাকে চিনেছিলেন সরস্বতীর রূপান্তর হিসেবেই। দৈনন্দিন জীবনচর্যার স্রোতের সঙ্গে গেঁথে নিয়েছিলেন তবলা-সাধনার অনুষঙ্গ। পিতা আল্লাহ রাখা'র শিক্ষা আর সহজাত অনুশীলন-ক্ষমতার প্রভাবে দক্ষ থেকে দক্ষতর হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সেই পরিণত শিল্পীর মতো তবলা বাজাতে পারতেন; আর মাত্র বারো বছর বয়সেই জীবনের প্রথম কনসার্টটি যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে করেন। বাবার সহযোগে এই উপস্থাপনাটি করে তিনি অর্জন করেন পাঁচ টাকা। মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা জ়াকিরের স্কুল-জীবন কাটে সেন্ট মাইকেলস হাই স্কুলে। এরপর মুম্বাইয়েরই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে সঙ্গীতের ওপর ডক্টরেট উপাধিও পেয়েছিলেন। 

পিতা আল্লা রাখা তাঁকে শিখিয়েছিলেন ভোরের সৌকুমার্য কীভাবে তবলার তানকে প্রভাবিত করে। তাই খুব ভোরেই তবলার সাধনা আরম্ভ হয়-- এমনটাই ছিল তাঁর অন্তরের বিশ্বাস। জ়াকিরের দুই ভাই তৌফিক কুরেশি ও ফজ়ল কুরেশিও ছিলেন তবলাবাদক। ষাটের দশকেই রীতিমতো খ্যাতির শিখরে পৌঁছতে থাকেন জ়াকির। তাঁর তবলার ভাষা শুধু সনাতন শিল্পের দর্পণ হয়ে ওঠে না, যেন বিশ্বজগতের সমস্ত ধ্বনিই ভর করে সেই ছান্দসিকের গতিময় আঙুলে। বায়া আর ডানের দ্বিরালাপে তিনতাল থেকে দাদরা কিংবা একতাল থেকে ঝাঁপতাল-- সর্বত্র ছিল সেই মায়াবী আঙুলের অবাধ গতি। তবলার ত্বকে মৃদু আঘাত করে আনতে পারেন ধাবমান অশ্বখুরের ধ্বনি, কখনও দ্রুতবেগে, কখনও বা মৃদু। রেলের  একঘেয়ে কু-ঝিকঝিক শব্দও তবলায় বিম্বিত করার ক্ষমতা রাখতেন জ়াকির। আবার সংক্ষিপ্ত মানবিক কথোপকথনকেও ফুটিয়ে তুলতেন চক্র-গৎ-বোলের বৈচিত্রে। তাঁর বাজানোর পদ্ধতিতে সম থেকে খালির মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল অজস্ৰ রেলা আর ফরমান। শুধুমাত্র বায়া বা ডুগির সাহায্যে গম্ভীর নাদ উৎপন্ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছিলেন। তাঁর বাম হাতের আঙুলের খেলায়, ধাতব আধারযুক্ত বায়ার চর্ম-পৃষ্ঠ থেকে জলদমন্দ্র ডম্বরুধ্বনি নির্গত হতে আরম্ভ করল। বিস্মিত-মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা অবিশ্বাস্য আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল যখন ডমরুর সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হল শঙ্খনাদ। ডায়ার কৃষ্ণ-চক্রে অঙ্গুলি হেলিয়ে একেবারে সমুদ্র-শঙ্খকে বাজিয়ে তুলতে সমর্থ হলেন। সৃষ্ট হল এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত! এ তো কোনও পুরাণ-ধর্মের খেলা নয়। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রকৃত শ্রোতারা অনুভব করলেন এ শিল্পী স্বয়ং প্রজাপতির তুল্য, কারণ ব্রহ্মাস্বাদ-সহোদর প্রীতি উৎপন্ন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। ষড়জ থেকে নিষাদের সুর সৃষ্টি করে এক বৈশ্বিক ঐকতান রচনা করতেন জ়াকির। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে তিনি তবলার উপস্থাপনা করেছেন প্রায় প্রথম যৌবনকাল থেকেই। 

আসলে ছন্দকেও একটি বিশিষ্ট ভাষার গুরুত্ব দিতেন জ়াকির। তাই ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় বাদ্যের স্পন্দনকে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ আর অনুভব করতেন সম্যক নিষ্ঠার সঙ্গে। মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ কিংবা কাঞ্জিরার সঙ্গে তবলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছেন সৎ শিল্পী হওয়ার অঙ্গীকারেই। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের ঊর্মিমুখরতাকে তুলে ধরেছিলেন তাঁর তবলা-নিঃসৃত স্রোতে। পত্রী সতীশ কুমারের মৃদঙ্গ আর জ়াকিরের তবলার বোল যেন এক শাশ্বত গীতিকাব্য গড়ে তুলেছিল। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাকেশ চৌরাসিয়ার বাঁশি উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল জ়াকিরের তবলার আলিঙ্গনে। ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদের প্রতিটি তারে গেঁথে গিয়েছিল জ়াকিরের তবলার অভিঘাত। প্রণম্য কত্থকশিল্পী পণ্ডিত বিরজু মহারাজের পদবিভঙ্গ আর নৃত্যমুদ্রা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল জ়াকিরেরই তবলার ঝঙ্কারে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমালাপসিক্ত সংক্ষিপ্ত আখ্যানকেও বোল-মাধুর্যে আভাসিত করার প্রত্যয় ছিল তাঁর। মটকা বা হাঁড়ি, শ্রীখোল কিংবা ডাফলির ছন্দযতিকেও আয়ত্ত করে তবলার অনিবার্যতাকে দুনিয়ার খাস-দরবারে তুলে ধরেছিলেন জ়াকির। ওস্তাদ রশিদ খান থেকে গজ়ল-শিল্পী অনুপ জলোটার সঙ্গে দুর্দান্ত যুগলবন্দী রচনা করেছেন। সানাই-বীণার মতো অভিজাত বাদ্যের সমান্তরালে লোকায়ত বাদ্যের চলিষ্ণুতাকেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

১৯৭০'এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন জ়াকির। ১৯৭৯ সালে প্রায় সাত বছরেরও বেশি তাঁরই ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা কত্থক নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক আনতোনিয়া মিনেকোলাকে বিয়ে করেছিলেন। এই প্রতিভায় দীপ্যমান দম্পতির দুই কন্যা-- আনিসা কুরেশি ও ইসাবেলা কুরেশি। তাঁরা যথাক্রমে চলচ্চিত্র নির্মাতা-প্রযোজক এবং নৃত্যশিল্পী। সম্ভবত জ়াকির-আনতোনিয়ার প্রেমবিবাহ ঘটার পথটি জাতিগত আর সামাজিক কারণে বিশেষ সুগম ছিল না বলেই গোপনে পরিণয়-পর্বটি মিটেছিল। 

নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই তবলাবাদক ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ গিটারিস্ট জন ম্যাকলফ্লিন-এর সঙ্গে মিলে 'শক্তি' ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যান্ডটি ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের দুরূহ তাল ও জ্যাজ়-সঙ্গীতের ইম্প্রোভাইজেশনের এক অভিনব সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। তাঁর সঙ্গে ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্য, যেমন, বিখ্যাত বেহালাবাদক এল শঙ্কর এবং ঘটম-শিল্পী টিএইচ 'ভিক্কু' বিনায়করাম লয় আর সুরের এক অপূর্ব সমন্বয় তৈরি করেন। সত্তরের দশকে 'শক্তি' ব্যান্ডের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 'Shakti with John McLaughlin' (১৯৭৬), 'A Handful of Beauty' (১৯৭৬), 'Natural Elements' (১৯৭৭)। এক দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৭ সালে 'শক্তি' পুনরায় গঠিত হয় 'Remember Shakti' নামে। এই নতুনভাবে সেজে ওঠা ব্যান্ডের সঙ্গে যোগ দেন ম্যান্ডোলিন শিল্পী শ্রীনিবাস এবং কাঞ্জিরা-শিল্পী ভি সেলভগণেশ। ব্যান্ডের এই নতুন পর্বেও জ়াকির হুসেন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মধ্যে ফিউশন সঙ্গীতের আবেদন বৃদ্ধি করেন। ২০২৩ সালে 'শক্তি' ৪৬ বছর পর তাদের প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম 'This Moment' প্রকাশ করে। ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এই অ্যালবামটি ২০২৪ সালের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে Best Global Music Album বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। বর্তমানে এই ‘শক্তি’ ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী শঙ্কর মহাদেবন। 

পুরস্কার-প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও জ়াকিরের প্রাপ্তিযোগ শিখরস্পর্শী। ১৯৮৮, ২০০২ ও ২০২৩ সালে যথাক্রমে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ আর পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। একাধিকবার গ্র্যামি-পুরস্কার অর্জন করেছেন:

• ১৯৯২: 'Planet Drum' অ্যালবামের জন্য,  মিকি হার্টের সঙ্গে;

• ২০০৯: 'Global Drum Project' অ্যালবামের জন্য, যেখানে তিনি মিকি হার্ট, সিকিরু আদিপোজু এবং জিওভানি হিদালগোর সঙ্গে কাজ করেছিলেন;

• ২০২৪: ৬৬তম বার্ষিক গ্র্যামি পুরস্কারে তিনি তিনটি পুরস্কার লাভ করেন তাঁর 'Pashto' (বেলা ফ্লেক, এডগার মেয়ার এবং রাকেশ চৌরাসিয়া সহ), 'As We Speak' এবং 'This Moment' ('শক্তি' ব্যান্ডের সঙ্গে)-এর জন্য।

এছাড়াও ১৯৯৯ সালে পেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এন্ডোউমেন্ট ফর দ্য আর্টস (NEA) দ্বারা প্রদত্ত ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপ। ২০২২'এ তাঁর প্রাপ্তি জাপানের ইনামোরি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত কিওটো পুরস্কার। এছাড়াও তাঁর সম্মাননার ঝুলিতে রয়েছে সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার (১৯৯০), কালিদাস সম্মান (২০০৬), মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত এলএলডি ডিগ্রি (২০২২), সান ফ্রান্সিসকো জ্যাজ় সেন্টার কর্তৃক প্রদত্ত লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৭) প্রভৃতি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে হোয়াইট হাউসে আন্তর্জাতিক জ্যাজ় দিবসের গ্লোবাল কনসার্টে পারফর্ম করতে আমন্ত্রণ জানান। এই অনুষ্ঠানটি ৩০ এপ্রিল ২০১৬-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী সুরসাধক মানুষ জ্যাজ় সঙ্গীতের প্রভাব আত্মস্থ করে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। সেখানে ওস্তাদ জ়াকির হুসেনের অংশগ্রহণ ছিল একটি বিশেষ পাওনা, কারণ প্রথমবারের মতো কোনও ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হোয়াইট হাউসে পারফর্ম করলেন, যা ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনকেও কূটনৈতিকভাবে দৃঢ় করেছিল। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের তাবড়-তাবড় সঙ্গীতশিল্পীরা অংশ নেন এবং জ়াকির হুসেনের উপস্থাপনা আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনায় এক অনন্য ও চিরন্তন স্থান তৈরি করে। 

অভিনয়ের ক্ষেত্রেও চমকপ্রদভাবে কিছুটা পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন জ়াকির হুসেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সাজ' (SAAZ) চলচ্চিত্রে শাবানা আজমির প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তাঁর ফিল্ম-কেরিয়ারে মোট ১২টি ছবি চোখে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শশী কাপুরের 'হিট অ্যান্ড ডাস্ট' ছিল অন্যতম। এছাড়াও তিনি 'দ্য পারফেক্ট মার্ডার' (১৯৮৮), 'থান্ডুভিটেন এনাই' (১৯৯১, তামিল), 'মিস বিটিস চিলড্রেন' (১৯৯২), 'জ়াকির অ্যান্ড হিজ় ফ্রেন্ডস' (১৯৯৮) এবং 'টর' (২০১৮) চলচ্চিত্রে তাঁর মনকাড়া উপস্থিতি ছিল। চলচ্চিত্র-নির্মাতা দেব প্যাটেলও তাঁর সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত 'মাঙ্কি-ম্যান' (২০২৪) সিনেমায় জ়াকির হুসেনের তবলা বাজানোর দৃশ্য তুলে ধরেন। স্মর্তব্য যে, ১৯৯৪-এ ভারতীয় পত্রিকা 'জেন্টলম্যান'-এ 'সেক্সিয়েস্ট ম্যান' হিসেবে বিপুল ভোট পেয়ে অমিতাভ বচ্চনকেও হারিয়ে দেন জ়াকির।

সাঙ্গীতিক দুনিয়ার সংশপ্তক এই কালজয়ী শিল্প-অধীশ্বর ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হয়ে সান ফ্রান্সিসকোয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই অপূরণীয় বেদনা সর্বজনীন হয়ে ছড়িয়ে গেল দেশ-দেশান্তরে, তবলার বোলে যেন বেজে উঠল বিশ্বনাথ কবিরাজের 'সাহিত্যদর্পণ'এর অমোঘ সেই পঙক্তিটি: 'পরস্য ন পরস্যেতি, মমেতি ন মমেতি চ'...।


Tuesday, 17 December 2024

অতুল সুভাষ বিচার পাবেন?

গণহত্যা মঞ্চের পর্দা সরালেন অতুল সুভাষ

নন্দিনী ভট্টাচার্য



এ বছর আমরা পেরিয়ে এলাম আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের ২৫ বছর, যা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সাল থেকে। এ এক সালতামামির সময়, যে আমরা কতটুকু এগোলাম। আন্দোলনে কী পেলাম-- এই ভাবনা সঠিক নয়; কী দিতে পারলাম বা কতটুকু সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম, এমন ভাবনাই আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেয়। 

এই পঁচিশ বছর পূর্তিতে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা যা আমার এই লড়াইয়ের (যার বয়স এবার ৮ হল) সময়কালে দেখিনি এমন নয়, তবে তা নিয়ে সারা দেশকে এত কথা বলতে শুনিনি: এক পুরুষের আত্মহত্যা। 'পুরুষ' মানুষ তো! লিঙ্গ অন্য হলে এতক্ষণে 'দেশে দেশে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে' এটা নিশ্চিত বলতে পারতাম। মানুষটির নাম অতুল সুভাষ। তিনি চলে গেছেন। বলা উচিত নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। পেছনে রেখে গেছেন এক ২৪ পাতার 'সুইসাইড নোট' ও একটি দেড় ঘণ্টার ভিডিও। এগুলোতেই নাড়া পড়েছে অনেকের, এতদিনের জেগে ঘুমোনো বিভিন্ন চিন্তাভাবনার গোড়ায়।

২০১৯ সালে বিয়ে হয় অতুল সুভাষ মোদী ও নিকিতা সিংহানিয়ার। কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় অতুল সুভাষের উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। টাকার চাপ। এতে নিকিতার মা/ ভাই/ কাকা সবাই যুক্ত ছিলেন। এরপর অতুল ও নিকিতা'র সন্তান হয়। ধীরে ধীরে সে শিশু হয়ে ওঠে Emotional Blackmailing'এর হাতিয়ার। অতুল ও নিকিতা ইতিমধ্যে আলাদাও থাকতে শুরু করেছেন। সন্তানকে দেখতেও দেওয়া হত না অতুলকে (এটি বহু পুরুষের সঙ্গেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে)। ক্রমশ মানসিক/ অর্থনৈতিক নানা চাপে এক নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরপর ৯ই  ডিসেম্বর ২০২৪, আত্মহত্যা করেন অতুল। বেঙ্গালুরুর নিজের বাড়িতে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঘর থেকে একটা প্ল্যাকার্ডও পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিল 'বিচার এখনও বাকি আছে'। আগেই লিখেছি তাঁর ২৪ পাতা সুইসাইড নোট ও দেড় ঘণ্টার ভিডিও'র কথা। ছেলের উদ্দেশ্যে লিখে যাওয়া অতুলের চিঠিটি আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি প্রত্যেক পুরুষের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। এই আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অতুল সুভাষের ভাই থানায় এফআইআর দায়ের করেছিলেন নিকিতা সিংঘানিয়া এবং তাঁর বাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে। 

অতুল আগে থেকেই নিকিতার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সন্তানের হেফাজত নিয়ে আইনি জটিলতায় জড়িয়েছিলেন। তাঁর নিজের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর আদালতে এই মামলা চলছিল। পুলিশ জানিয়েছে যে নিকিতার কারণেই অতুল মানসিক কষ্টে ছিলেন। এমনকী এই মামলা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ৩ কোটি টাকার দাবিও জানিয়েছিল নিকিতার পরিবার। তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক বিচারক। তাঁর সম্পর্কেও FIR করা হয়েছে। ছেলেকে দেখার জন্য অতুলের কাছ থেকে ৩০ লক্ষ টাকাও চেয়েছিলেন নিকিতা, জানিয়েছে পুলিশ।

আমাদের (পুরুষ অধিকার কর্মীদের) সম্পর্কে যাঁরা এতকাল মনে করেছেন শুধুই Limelight পাওয়া বা নারী-পুরুষের সংসার ভেঙে দেওয়া বা নারীকে ছোট করে দেখাবার জন্য এই কাজটি করে চলেছি, তাঁরা হয়তো (?) সামান্য হলেও বুঝতে পারছেন যে তাঁরা ঠিক ছিলেন না (অবশ্যই যদি অতুলের ঘটনাটি জানেন, তবেই)। অতুলের নোটটি পড়লে বা ভিডিওটি শুনলে আপনারা জানতে পারবেন কী অমানুষিক মানসিক নির্যাতনের (হয়তো শারীরিকও) মধ্যে একজন পুরুষকেও যেতে হয়। কিন্তু বলার বা শোনার কেউ থাকে না। তাই উনি এইভাবে সারা দেশকে শুনিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার একনায়কতন্ত্রও কি এর জন্য দায়ী নয়? এঁরা মধ্যস্থতা করতে আসেন ৩ কোটি টাকা আদায় বা সন্তানকে দেখার বিনিময়ে ৩০ লক্ষ টাকা দেবার অন্যায় আবদারে সীলমোহর দেবার জন্য! এ দেশ জুড়ে বহু নিরপরাধ/ নিরীহ/ সাধারণ বা অসাধারণ, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পুরুষের মানসিক ও শারীরিক গণহত্যার যে মঞ্চ অনেকদিন ধরে তৈরি হয়েছে, সেই মঞ্চের পর্দা তুলে দিয়ে গেলেন অতুল নিজের জীবন স্বহস্তে বলি দিয়ে।

একটি জরুরি বিষয় মনে রাখতে হবে। বিশেষত যাঁরা পুরুষ অধিকার আন্দোলন নিয়ে সামান্যতমও আগ্রহী তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভারতবর্ষের পুরুষ অধিকার আন্দোলন এখন থেকে স্পষ্টতই দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি ভাগ অতুল সুভাষ'এর মৃত্যু পূর্ববর্তী, অন্যটি তাঁর মৃত্যু পরবর্তী। উনি দেখালেন, 'এভাবেও চলে যাওয়া যায়', আর আমাদের দিশা দেখিয়ে গেলেন এক নতুন লড়াই শুরুর; না থামার লড়াইয়ের। ওঁনার এই মৃত্যু যেন বৃথা না যায়, তা দেখার দায় আমাদের সবার। আশার কথা, গত ১৪ ডিসেম্বর এই বাংলা ও দেশের অন্যত্র বহু জায়গায় 'Reclaim the Night' আওয়াজ তুলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু সাধারণ মানুষ অতুল সুভাষের বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলেন। আজ এ কথা সকলেই বুঝছেন যে, আইনি সুযোগ নিয়ে ও মিথ্যা অপবাদে নিছক পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষদের নির্বিবাদে অপদস্থ, হেনস্থা ও হত্যা করার যে প্রবণতা বিশেষত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিরুদ্ধে সদলবলে আওয়াজ তোলার সময় এসে গেছে।

আসলে পুরুষ মানুষ তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই 'হয় রক্ষক, নয়তো ভক্ষক'-- এই দুই তকমাতেই আটকে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার কিন্তু পুরুষমানুষ। তাঁর অসহায়তা বা চোখের জল দুই বড় করুণা ও লজ্জার। তাই আজ এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে, নয়তো আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র, প্রেমিক কাউকে হয়তো এই আইনি সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করা যাবে না। কাল বা পরশু সে হয়তো থাবা বসাবে আমার বা আপনার ঘরে!

যে দেশে পশু পাখির জন্য মন্ত্রণালয় আছে, পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, সে দেশে একটি পুরুষ কমিশন'এর দাবি এখন অত্যন্ত একটি ন্যায্য দাবি। আসুন, সবাই সে জন্য সওয়াল শুরু করি। নতুন করে শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথা বলা।

(নন্দিনী ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট, অল বেঙ্গল মেনস ফোরাম: +917003624865/ +919903318148)


Tuesday, 10 December 2024

এই বৈঠক জরুরি ছিল

দু’ দেশের সম্পর্কে জনগণই চালিকাশক্তি

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



গত এক মাসে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনমন ও কিছু নেতিবাচক টানাপোড়েনের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রীর ৯ ডিসেম্বর ঢাকা সফর, সে দেশের সরকারের সঙ্গে তাঁর আলোচনা ও পরবর্তীতে আশাপ্রদ বিবৃতি প্রদানে মনে হতে পারে যে বহমান চাপা উত্তেজনার এবার কিছুটা অবসান হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দুই দেশের আলোচনায় কোনও তিক্ততা উঠে আসেনি, দুই তরফেই কিছু উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে মাত্র (যার হয়তো কিছু ভিত্তিও আছে) এবং দু’ পক্ষই মার্জিত ও বন্ধুসলুভ বিবৃতি দিয়ে প্রতিবেশিসুলভ আচরণ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে এই বৈঠক আগামী দিনের পক্ষে ইতিবাচক।

কিন্তু এ দেশের গোদি মিডিয়া দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশ যেন একেবারে উচ্ছন্নে চলে গেছে, সেখানে সংখ্যালঘুরা ভীষণ ভাবে অত্যাচারিত ও বিপন্ন এবং প্রতিনিয়ত গণ্ডগোল ও সংঘর্ষ লেগে রয়েছে। কেউ কেউ বললেন, ‘এবিসি নিরানন্দ’ টিভি চ্যানেল খুললে বোঝাই যাচ্ছে না যে তাদের দফতর কলকাতা না ঢাকায় অবস্থিত; সারাদিন, সারাক্ষণ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রুদালি চলেছে। ‘ঢিপাবলিক’ চ্যানেল তো ঢিল ছুঁড়েই ব্যবসা করে, তাদের বাংলাদেশ নিয়ে চিল-চীৎকার যে কহতব্য নয়, তা বলাই বাহুল্য। আর সেই তালেই নেচেকুঁদে এ রাজ্যের বিরোধী নেতা পেট্রাপোল সীমান্তে গিয়ে দু-দেশের ব্যবসা বন্ধের হম্বিতম্বি করে (যদিও প্রায় স্বভাবিক গতিতেই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য পরিবহন চলেছে), তারপর রণে বঙ্গ দিয়ে এখন হাঁক পেড়েছে যে ‘শেখ হাসিনাই বাংলদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী’। অথচ তারই দল পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে গিয়ে বৈঠক করে এলেন হাসিনার জমানার বিরুদ্ধে জনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যারা ইতিমধ্যে হাসিনাকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। তাহলে কি পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এক ‘অবৈধ’ সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে ফিরলেন? বিরোধী নেতা অধিকারীবাবুর বক্তব্য কি সে ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিরোধী? এই বক্তব্যের জন্য দল বা সরকার কি তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে?

উল্লেখ্য, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে এও বলেছেন যে, দু’ দেশের সম্পর্কে জনগণই চালিকাশক্তি এবং অতীতের মতো ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ক গণ-কেন্দ্রিক ও গণমুখি ভিত্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকবে। অর্থাৎ, দু’ দেশেই সরকারি ক্ষমতায় যখন যেই আসুক না কেন, উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কে কোনও বাধা পড়ার কথা নয়। ফলত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের উপদেষ্টা মহঃ তৌহিদ হোসেন ভারতের মাটিতে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা’র বসবাস সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পেরেছেন, কারণ, তা প্রকারান্তরে সে দেশ থেকে পলাতক এক রাজনৈতিক নেত্রীকে আশ্রয় দেওয়ার সামিল এবং প্রত্যার্পণের নীতিতে তাঁকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোই দস্তুর। বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সরকারি স্তরে নানা ধরনের কূটনৈতিক আদানপ্রদান ও বার্তালাপ থাকবে, বাণিজ্যরীতি ও যাওয়া-আসারও বিধিব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু, মানুষে মানুষে যদি বিশ্বাস ও আস্থার সূত্রটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার থেকে বেশি বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় ধুরন্ধর মৌলবাদী শক্তিসমূহ। আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এই উপমহাদেশে ঘনায়মান পটভূমিতে তেমনই কিছু ইঙ্গিত যেন স্পষ্ট।

৫ অগস্ট যেদিন শেখ হাসিনা গণ অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তি ও বিস্ফোরণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, সেদিন থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটেছে তা একান্তই সে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেই সব ঘটনাবলীর দিকে সারা বিশ্বের নজর ছিল। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নজর ছিল আরও নিবিড়; বিশেষত একই ভাষা-সংস্কৃতির কারণে পশ্চিমবাংলার মানুষেরা আরও কড়া নজর রেখেছেন। ভারত-বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্র গঠনে যেহেতু দু’ জায়গাতেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থান ও অংশীদারিত্বের প্রশ্নটি একটা কমন ফ্যাক্টর, যার স্পর্শকাতরতা আজও কমবেশি থেকে গেছে, তাই খুব স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে হাসিনা পরবর্তী আমলে এই বিষয়টি কতটা হানিকর হল বা হল না, তা নিয়ে তীব্র কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা থাকবে। চূড়ান্ত গণ অভ্যুত্থানের পর কিছু কিছু সংখ্যালঘু মানুষের ওপরে যে আক্রমণ নেমে আসেনি তাও নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে আওয়ামী লিগ’এর সমর্থক হিসেবে বহুজনের ওপর নির্যাতন হয়েছে যারা হিন্দু (তারা হিন্দু বলে তাদের ওপর আক্রমণ হয়নি)। যদিও আওয়ামী লিগের মুসলমান কর্মীরাও বহু জায়গায় আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হিন্দু সদস্য বা সমর্থকের ওপর আক্রমণকে কোনও কোনও মহল থেকে ‘হিন্দুদের ওপর আক্রমণ’ বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যদিচ, এই ধরনের রাজনৈতিক হামলাও নিন্দনীয়, কিন্তু সেই অজুহাতে তাকে সাম্প্রদায়িক মোড়ক দেওয়াটা ভয়ঙ্করজনক ভাবে কুৎসিত। অবশ্য, এ ব্যতিরেকে বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু এবং কিছু মন্দির-মাজারে সংখ্যালঘু বলেই আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু তা তত ব্যাপক নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর এই ধরনের ঘটনা ক্রমেই কমে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্র-যুবদের পাহারাদারিতে তা আরও প্রশমিত হয়। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইস্কনের জনৈক সাধু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে (যদিও বাংলাদেশ ইস্কন এই সাধুকে বেশ কিছুদিন আগেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগে তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে বলে প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানায়) গ্রেফতারির পর যেন নতুন করে এক হৈচৈ শুরু হয়।

চট্টগ্রামে বাঙালি-পাহাড়ী একটা বিবাদ চলছিল। তার উপর সেখানকার সংখ্যালঘু জোটের মানুষজনও সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল-মিটিং করছিলেন। অভিযোগ, এই মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভের সময় চিন্ময় দাস ও তাঁর কিছু সহযোগী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেন এবং একটি গেরুয়া পতাকা তার ওপর টাঙিয়ে দেন। এই অভিযোগে চিন্ময় দাস ও তাঁর কতিপয় সঙ্গীকে পুলিশ ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করে। আদালত চত্বরে চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে জনবিক্ষোভের রোষে সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনা গোটা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। চিন্ময় দাসের গ্রেফতারির প্রতিবাদে কলকাতা ইস্কন থেকে নিন্দামূলক বিবৃতি দেওয়া হয় এবং বিবিধ হিন্দু সংগঠন কলকাতা ও অন্যত্র মিছিল বের করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রতিবাদ জানান, বিজেপি ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ অভিযোগ তুলে সর্বশক্তি দিয়ে হৈ-হট্টগোল শুরু করে দেয়। আর ঠিক এই সময় থেকেই ‘এবিসি নিরানন্দ’ ও ‘ঢিপাবলিক’ টিভি আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবেদন’ নিয়ে। তবে, তাদের তরফে সব সময় যে তেমন তথ্যনিষ্ঠ খবর বা ভিডিও প্রচার করা গেছে তা নয়, কিছু পুরনো ও ফেক ভিডিও দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে। কারণ, খানিক অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে, বাংলাদেশে গত দু-তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ তেমন ব্যাপক ভাবে কিছু হয়ইনি।

পেট্রাপোল সীমান্তে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে আছেন এই ছবি তুলতে যে সংখ্যালঘুরা সব দলে দলে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছে। সে সব ছবি তো পাওয়া যায়ইনি বরং যে দু-একজন বাসে করে কোনও কাজে ভারতীয় সীমান্তে সবে এসে পৌঁছেছেন, তাঁরাও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে খুব কিছু বিপদ বা আক্রমণের কথা শোনাতে পারেননি; সাংবাদিকদের চোখা চোখা প্রশ্নের সামনে পড়ে, ‘হ্যাঁ, আশঙ্কা তো একটা আছে’, এই ধরনের অস্পষ্ট কিছু মন্তব্য করে পালিয়ে বেঁচেছেন। সম্ভবত আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্রে তেমন কোনও সংখ্যালঘু নিপীড়নের হদিশ পায়নি, ফলে, তারা তড়িঘড়ি পররাষ্ট্র সচিবকে সে দেশে পাঠিয়ে আসলে গোদি মিডিয়ার উন্মাদ আচরণকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। শোনা যাচ্ছে, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রী নাকি এ কথাও বলেছেন যে, মিডিয়া কী বলছে তাতে সরকারের কোনও হাত নেই। অনুমান করি, নিপীড়নের তেমন কোনও বিস্তৃত তথ্য থাকলে তা পররাষ্ট্র সচিব নিশ্চয়ই পেশ করতেন।

অথচ, আমাদের দেশে মণিপুর পুড়ছে। সম্বল জ্বলছে (ইতিমধ্যেই সেখানে পাঁচজন সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে)। উত্তরপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাতে গিয়ে প্রকাশ্যে বলছেন, এখানে থাকতে হলে হিন্দুবাদীদের কথা শুনেই চলতে হবে। একে একে সব মসজিদের তলা থেকেই নাকি পাওয়া যাচ্ছে শিবলিঙ্গ বা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে আবার মন্দির পুনরুদ্ধারের রাজনীতিই মুখ্য হবে। তাই, আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে নিশানা তাক করতে পারি, তাহলে এ দেশের নিপীড়নের ছবিগুলিকে বেমালুম হাওয়া করে দেওয়া যেতে পারে-- রাজনৈতিক কৌশলটাকে এমন করারই চেষ্টা চলেছে। কিন্তু সমস্যা হল, আজকাল মানুষ আর শুধু টিভি দেখে না, তার সামনে এখন খবর ও বিশ্লেষণের সহস্র সূত্র। উপরন্তু, তারা নিজেরাও এখন বিশ্লেষক ও পাহারাদার। অতএব, মিথ্যা খবর ও গুজব ছড়িয়ে কেল্লা ফতে করা খুবই শক্ত।

মুখ্য কথাটা হল, যদি দেশের সরকার বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে রামধনু সমাজের ন্যায্যতাকে মান্যতা দেয়, তাহলে বিপথগামী বা নাশক শক্তি চেষ্টা করলেও খুব বেশি দূর সফল হতে পারে না। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে যে অন্যায় ঘটনাগুলি ঘটেছে বা ঘটছে, মালুম হচ্ছে, বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে সেগুলিকে প্রতিরোধ করার। তার মানে অবশ্য এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে এই সরকারে সকলেই উদার মনোভাবাপন্ন মানুষ। লড়াইটা চলছে, চলবে। কিন্তু আমাদের দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সরকার সামগ্রিক ভাবে কতটা আন্তরিক? নাকি, তারা ইন্ধনদাতাও? এখানেও লড়াইটা চলছে, চলবে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়তই শান্তি ও সম্প্রীতি বিরাজ করুক। স্ব স্ব সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাক। প্রতিবেশিসুলভ আত্মীয়তা বজায় থাকুক।               


Tuesday, 3 December 2024

'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম'!

ভুল করেও ভুল করার সাহস

মালবিকা মিত্র



'একজন উইলমড সাহেব মরবে, তার জায়গায় আসবে আর একজন। সে হবে আরো বেশি হিংস্র উন্মত্ত নিষ্ঠুর। মেরে মেরে কি ইংরেজ রাজত্ব শেষ হবে?' (ফেরারী ফৌজ নাটক/ উৎপল দত্ত)। এই প্রশ্নগুলো হামেশাই কমিউনিস্টরা তুলতেন আমাদের দেশের বীর সশস্ত্র বিপ্লবীদের সম্পর্কে সমালোচনার সুরে। 

শোষক শ্রেণি তার নিজের আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে একটা ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করে। সেই কাঠামোর মধ্যে পুলিশ, প্রশাসন, আইন, আদালত, ধর্ম, এমনকি উচিত অনুচিত বোধ, সবই অন্তর্ভুক্ত। আর এইসব নিয়েই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র। অতএব শোষক শ্রেণিকে আঘাত করা মানে, একজন পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে খতম করা নয়। সেটা হবে অ্যাডভেঞ্চার। দরকার এই সমগ্র কাঠামোটাকে পরিবর্তন। আমাদের দেশের সশস্ত্র বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিগুলি এই সত্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।

ছোট মাঝারি খুচরো কমিউনিস্ট নেতাকর্মীরাও সরাসরি খোলামেলা এই সমালোচনা করতেন। তারা কেবলই ব্যবস্থা, তাকে পাল্টানো, কাঠামো পরিবর্তনের বক্তৃতা দিতেন। একই সুরে তারা সুভাষচন্দ্রকে সমালোচনা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর পথ ভ্রান্ত বলতে কুন্ঠা বোধ করেননি। ফ্যাসিস্ট জাপানকে নিমন্ত্রণ করে দেশে ডেকে আনার অভিযোগ পর্যন্ত করেছেন। এমনকি জাপানের ফ্যাসিস্ট প্রধান তোজোর কুকুর, পঞ্চম বাহিনী, হিটলারের মুখপাত্র বলেও সুভাষচন্দ্রকে বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। 

আশ্চর্য লাগে, অহিংসবাদী কংগ্রেসও সশস্ত্র বিপ্লববাদকে সমর্থন করেনি। কিন্তু তারা এভাবে কঠোর সমালোচনা করেনি। বরং স্বাধীনতা দিবসে গান্ধী নেহেরু সুভাষ ছাড়াও ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, অরবিন্দ ঘোষ সমান মর্যাদায় স্থান পেয়েছেন। এইখানে এসেই ভারি বিস্ময় লাগে, আরএসএস যতটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, ততটাই তাচ্ছিল্যভরে কমিউনিস্ট পার্টি স্লোগান দিয়েছিল 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়'। ১৯৭৭ সালে সরকারে আসার পর সিপিআইএম কী করি, কী করি ভাব সহ এদিকে ওদিকে ১৫ অগস্টে জাতীয় সংহতি দিবস পালন করতে শুরু করে। কারণ, তারা পার্টি কর্মসূচির দিক থেকে তখনও ভারতের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। 

উল্লেখযোগ্য যে, ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলায় বামপন্থী আবহ বিরাজমান। সিপিআইএমের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী ঘাঁটি এই পশ্চিমবাংলা। ফলে, এখানে সাধারণভাবে একটি গান্ধী বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী, সশস্ত্র বিপ্লব বাদ বিরোধী মনোভাব আছে। বামফ্রন্টে অন্যতম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক থাকার কারণে তারা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে প্রকাশ্য মতামত প্রকাশে অনেকটাই সংযত; যদিও প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করেনি, দুঃখপ্রকাশ করেনি যে সুভাষকে পঞ্চম বাহিনী, তোজোর কুকুর ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা অন্যায় হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে এই বাংলায় একজন সোচ্চারে বলতে পারেন যে তিনি 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' হবেন না। 

কথাটায় উহ্য আছে যে, না বুঝে, অপরের উস্কানিতে, ক্ষুদিরামের মতো তরুণ প্রজন্ম বিপ্লব করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিল। দেশপ্রেম সেফ বাজে কথা। এরা কিছু নেতার দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই উক্তি সংবাদপত্রে প্রকাশের পরেও সারা বাংলা বা দেশব্যাপী সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদের প্রতি এত অবজ্ঞা অকল্পনীয়। আরও অবিশ্বাস্য যে, সমালোচনা নিন্দা তো হলই না, উল্টে 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' একটি বাগধারায় পরিণত হল। 

শোষক শ্রেণির এই শোষণ যন্ত্র বা কাঠামোটার প্রকৃত চরিত্র রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করেছিলেন লেনিন তাঁর 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' রচনায়। লেনিনের দাদা (আলেকজান্ডার সলোভিয়ার) নিজে ছিলেন রাশিয়ার গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি 'জনতার ইচ্ছা'র সদস্য। তিনি রুশ জার আলেকজান্ডারকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ নাগাদ রুশ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে তিনি হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ও তাঁর ফাঁসি হয়। বালক লেনিন প্রবলভাবে জ্যেষ্ঠ বিপ্লবী ভ্রাতা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। লেনিনের দিদির লেখা থেকে জানা যায়, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ফাঁসির দিন সারা রাত লেনিনের চোখে ঘুম ছিল না। তিনি কেঁদেছিলেন এবং বিড়বিড় করে আউড়ে ছিলেন, এ পথ নয়, এ পথে নয়, আমাদের অন্য পথ খুঁজতে হবে। 

লেনিন কখনই পণ্ডিতি চালে নারোদনিক বা জনতাবাদীদের সমালোচনা ও নিন্দা করেননি। বরং তিনি এই বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, কমিটমেন্ট, ডিভোসনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। হাতের মুঠোয় প্রস্তুত রাখা প্রাণ ছাড়া কোনও বিপ্লব সম্ভব নয়। সেই আবেগ এই বিপ্লবীদের ছিল। কিন্তু তাঁদের অনুসৃত পথ যথার্থ ছিল না। তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, পথ যতই যথার্থ হোক, যদি ডিভোসন ও কমিটমেন্ট না থাকে, আবেগে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে বিপ্লব সম্পন্ন হয় না। আবেগ, রোমান্টিকতা এগুলোতে ঘাটতি পড়া খারাপ, একটু বেশি থাকলে বরং ক্ষতি নেই। এমনকি মার্কসবাদী বিপ্লবীরা এ কথা স্বীকার করেন যে, জনগণের কাছে রাষ্ট্রের স্বরূপ উদঘাটন করার পরেও এই রাষ্ট্রটাকে মানুষ আঘাত করতে সাহসী হয় না। কারণ, তার মধ্যে একটা আদিকল্প বিরাজ করে। সে সময় এই বিপ্লবীরা রাষ্ট্রকে আঘাত হেনে একটা দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান ধারণাকে ভেঙে দেয়। বলা যায়, সলতে পাকালেই হয় না, তাতে আগুন লাগাতে হয়।

শুধু তো গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী সংগঠন নয়, মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের যখন সমালোচনা করেন, সেটাও কি অপরিসীম মানবিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। তিনি এই সমাজতন্ত্রীদের 'ইউটোপিয়' আখ্যা দিয়েছিলেন। বিস্ময় লাগে, আমরা নিন্দার্থে 'ইউটোপিয়ান' শব্দটি ব্যবহার করি। কিন্তু তাঁরা অত্যন্ত সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার সাথে 'ইউটোপিয়' শব্দটিকে প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁদের মতে, পুঁজিবাদ যখন বিকাশমান, যখন তার সমগ্র বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়নি, অর্থাৎ অপরিণত, সেই অবস্থায় পুঁজিবাদের রোগগুলি নিরাময় সংক্রান্ত ধারণাটিও অপরিণত হতে বাধ্য। পুঁজিবাদের লক্ষণগুলি স্পষ্ট ছিল না, তার দাওয়াইগুলিও ঐতিহাসিকভাবেই অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদের নির্মম অমানবিক প্রকাশ দেখে এই সমস্ত মানুষের দরদী মন কেঁদে উঠেছিল। তাঁরা বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ দিয়ে রোগের নিরাময়ে পথ খুঁজেছিলেন। ফলে, সমাজতন্ত্র ছিল কাল্পনিক বা ইউটোপিয়।

জনতাবাদী'দের উদ্যোগেই ১৯০৫ সালে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটল, লেনিন জানতেন এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। তথাপি জনতার এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকেননি। যারা পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন, প্লেখানভ ও তাঁর অনুগামীরা, তাঁরা নিজেরাই এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। কার্ল মার্কসও তো সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। প্যারি কমিউনে শ্রমিকদের ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্তকে তিনি 'হতাশার মূর্খতা' বলে মেনে নিয়েও কমিউন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিনি আন্তরিকভাবে প্যারী কমিউন'এর অভ্যুত্থানের সঙ্গী হয়েছিলেন। 

আমরা মার্কসের চেয়েও মার্কসবাদী, লেনিনের চেয়েও লেনিনবাদী। তাই কত সহজে দাম্ভিকের মতো বলতে পারি, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মাস্টারদা ছিলেন ভুল। আর সেই দাম্ভিকতারই নাগরিক রূপ ও কন্ঠ বলতে পারে-- 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' হব নাকি? ভুল করেও ভুল করার সাহস নেই, তাই ঠিকটা করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

ক্ষুদিরাম বসু: ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ - ১১ অগস্ট ১৯০৮।