Pages

Tuesday, 3 December 2024

'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম'!

ভুল করেও ভুল করার সাহস

মালবিকা মিত্র



'একজন উইলমড সাহেব মরবে, তার জায়গায় আসবে আর একজন। সে হবে আরো বেশি হিংস্র উন্মত্ত নিষ্ঠুর। মেরে মেরে কি ইংরেজ রাজত্ব শেষ হবে?' (ফেরারী ফৌজ নাটক/ উৎপল দত্ত)। এই প্রশ্নগুলো হামেশাই কমিউনিস্টরা তুলতেন আমাদের দেশের বীর সশস্ত্র বিপ্লবীদের সম্পর্কে সমালোচনার সুরে। 

শোষক শ্রেণি তার নিজের আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে একটা ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করে। সেই কাঠামোর মধ্যে পুলিশ, প্রশাসন, আইন, আদালত, ধর্ম, এমনকি উচিত অনুচিত বোধ, সবই অন্তর্ভুক্ত। আর এইসব নিয়েই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র। অতএব শোষক শ্রেণিকে আঘাত করা মানে, একজন পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে খতম করা নয়। সেটা হবে অ্যাডভেঞ্চার। দরকার এই সমগ্র কাঠামোটাকে পরিবর্তন। আমাদের দেশের সশস্ত্র বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিগুলি এই সত্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।

ছোট মাঝারি খুচরো কমিউনিস্ট নেতাকর্মীরাও সরাসরি খোলামেলা এই সমালোচনা করতেন। তারা কেবলই ব্যবস্থা, তাকে পাল্টানো, কাঠামো পরিবর্তনের বক্তৃতা দিতেন। একই সুরে তারা সুভাষচন্দ্রকে সমালোচনা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর পথ ভ্রান্ত বলতে কুন্ঠা বোধ করেননি। ফ্যাসিস্ট জাপানকে নিমন্ত্রণ করে দেশে ডেকে আনার অভিযোগ পর্যন্ত করেছেন। এমনকি জাপানের ফ্যাসিস্ট প্রধান তোজোর কুকুর, পঞ্চম বাহিনী, হিটলারের মুখপাত্র বলেও সুভাষচন্দ্রকে বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। 

আশ্চর্য লাগে, অহিংসবাদী কংগ্রেসও সশস্ত্র বিপ্লববাদকে সমর্থন করেনি। কিন্তু তারা এভাবে কঠোর সমালোচনা করেনি। বরং স্বাধীনতা দিবসে গান্ধী নেহেরু সুভাষ ছাড়াও ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, অরবিন্দ ঘোষ সমান মর্যাদায় স্থান পেয়েছেন। এইখানে এসেই ভারি বিস্ময় লাগে, আরএসএস যতটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, ততটাই তাচ্ছিল্যভরে কমিউনিস্ট পার্টি স্লোগান দিয়েছিল 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়'। ১৯৭৭ সালে সরকারে আসার পর সিপিআইএম কী করি, কী করি ভাব সহ এদিকে ওদিকে ১৫ অগস্টে জাতীয় সংহতি দিবস পালন করতে শুরু করে। কারণ, তারা পার্টি কর্মসূচির দিক থেকে তখনও ভারতের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। 

উল্লেখযোগ্য যে, ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলায় বামপন্থী আবহ বিরাজমান। সিপিআইএমের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী ঘাঁটি এই পশ্চিমবাংলা। ফলে, এখানে সাধারণভাবে একটি গান্ধী বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী, সশস্ত্র বিপ্লব বাদ বিরোধী মনোভাব আছে। বামফ্রন্টে অন্যতম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক থাকার কারণে তারা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে প্রকাশ্য মতামত প্রকাশে অনেকটাই সংযত; যদিও প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করেনি, দুঃখপ্রকাশ করেনি যে সুভাষকে পঞ্চম বাহিনী, তোজোর কুকুর ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা অন্যায় হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে এই বাংলায় একজন সোচ্চারে বলতে পারেন যে তিনি 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' হবেন না। 

কথাটায় উহ্য আছে যে, না বুঝে, অপরের উস্কানিতে, ক্ষুদিরামের মতো তরুণ প্রজন্ম বিপ্লব করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিল। দেশপ্রেম সেফ বাজে কথা। এরা কিছু নেতার দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই উক্তি সংবাদপত্রে প্রকাশের পরেও সারা বাংলা বা দেশব্যাপী সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদের প্রতি এত অবজ্ঞা অকল্পনীয়। আরও অবিশ্বাস্য যে, সমালোচনা নিন্দা তো হলই না, উল্টে 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' একটি বাগধারায় পরিণত হল। 

শোষক শ্রেণির এই শোষণ যন্ত্র বা কাঠামোটার প্রকৃত চরিত্র রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করেছিলেন লেনিন তাঁর 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' রচনায়। লেনিনের দাদা (আলেকজান্ডার সলোভিয়ার) নিজে ছিলেন রাশিয়ার গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি 'জনতার ইচ্ছা'র সদস্য। তিনি রুশ জার আলেকজান্ডারকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ নাগাদ রুশ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে তিনি হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ও তাঁর ফাঁসি হয়। বালক লেনিন প্রবলভাবে জ্যেষ্ঠ বিপ্লবী ভ্রাতা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। লেনিনের দিদির লেখা থেকে জানা যায়, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ফাঁসির দিন সারা রাত লেনিনের চোখে ঘুম ছিল না। তিনি কেঁদেছিলেন এবং বিড়বিড় করে আউড়ে ছিলেন, এ পথ নয়, এ পথে নয়, আমাদের অন্য পথ খুঁজতে হবে। 

লেনিন কখনই পণ্ডিতি চালে নারোদনিক বা জনতাবাদীদের সমালোচনা ও নিন্দা করেননি। বরং তিনি এই বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, কমিটমেন্ট, ডিভোসনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। হাতের মুঠোয় প্রস্তুত রাখা প্রাণ ছাড়া কোনও বিপ্লব সম্ভব নয়। সেই আবেগ এই বিপ্লবীদের ছিল। কিন্তু তাঁদের অনুসৃত পথ যথার্থ ছিল না। তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, পথ যতই যথার্থ হোক, যদি ডিভোসন ও কমিটমেন্ট না থাকে, আবেগে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে বিপ্লব সম্পন্ন হয় না। আবেগ, রোমান্টিকতা এগুলোতে ঘাটতি পড়া খারাপ, একটু বেশি থাকলে বরং ক্ষতি নেই। এমনকি মার্কসবাদী বিপ্লবীরা এ কথা স্বীকার করেন যে, জনগণের কাছে রাষ্ট্রের স্বরূপ উদঘাটন করার পরেও এই রাষ্ট্রটাকে মানুষ আঘাত করতে সাহসী হয় না। কারণ, তার মধ্যে একটা আদিকল্প বিরাজ করে। সে সময় এই বিপ্লবীরা রাষ্ট্রকে আঘাত হেনে একটা দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান ধারণাকে ভেঙে দেয়। বলা যায়, সলতে পাকালেই হয় না, তাতে আগুন লাগাতে হয়।

শুধু তো গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী সংগঠন নয়, মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের যখন সমালোচনা করেন, সেটাও কি অপরিসীম মানবিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। তিনি এই সমাজতন্ত্রীদের 'ইউটোপিয়' আখ্যা দিয়েছিলেন। বিস্ময় লাগে, আমরা নিন্দার্থে 'ইউটোপিয়ান' শব্দটি ব্যবহার করি। কিন্তু তাঁরা অত্যন্ত সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার সাথে 'ইউটোপিয়' শব্দটিকে প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁদের মতে, পুঁজিবাদ যখন বিকাশমান, যখন তার সমগ্র বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়নি, অর্থাৎ অপরিণত, সেই অবস্থায় পুঁজিবাদের রোগগুলি নিরাময় সংক্রান্ত ধারণাটিও অপরিণত হতে বাধ্য। পুঁজিবাদের লক্ষণগুলি স্পষ্ট ছিল না, তার দাওয়াইগুলিও ঐতিহাসিকভাবেই অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদের নির্মম অমানবিক প্রকাশ দেখে এই সমস্ত মানুষের দরদী মন কেঁদে উঠেছিল। তাঁরা বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ দিয়ে রোগের নিরাময়ে পথ খুঁজেছিলেন। ফলে, সমাজতন্ত্র ছিল কাল্পনিক বা ইউটোপিয়।

জনতাবাদী'দের উদ্যোগেই ১৯০৫ সালে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটল, লেনিন জানতেন এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। তথাপি জনতার এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকেননি। যারা পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন, প্লেখানভ ও তাঁর অনুগামীরা, তাঁরা নিজেরাই এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। কার্ল মার্কসও তো সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। প্যারি কমিউনে শ্রমিকদের ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্তকে তিনি 'হতাশার মূর্খতা' বলে মেনে নিয়েও কমিউন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিনি আন্তরিকভাবে প্যারী কমিউন'এর অভ্যুত্থানের সঙ্গী হয়েছিলেন। 

আমরা মার্কসের চেয়েও মার্কসবাদী, লেনিনের চেয়েও লেনিনবাদী। তাই কত সহজে দাম্ভিকের মতো বলতে পারি, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মাস্টারদা ছিলেন ভুল। আর সেই দাম্ভিকতারই নাগরিক রূপ ও কন্ঠ বলতে পারে-- 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' হব নাকি? ভুল করেও ভুল করার সাহস নেই, তাই ঠিকটা করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

ক্ষুদিরাম বসু: ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ - ১১ অগস্ট ১৯০৮।

No comments:

Post a Comment