গণহত্যা মঞ্চের পর্দা সরালেন অতুল সুভাষ
নন্দিনী ভট্টাচার্য
এ বছর আমরা পেরিয়ে এলাম আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের ২৫ বছর, যা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সাল থেকে। এ এক সালতামামির সময়, যে আমরা কতটুকু এগোলাম। আন্দোলনে কী পেলাম-- এই ভাবনা সঠিক নয়; কী দিতে পারলাম বা কতটুকু সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম, এমন ভাবনাই আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেয়।
এই পঁচিশ বছর পূর্তিতে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা যা আমার এই লড়াইয়ের (যার বয়স এবার ৮ হল) সময়কালে দেখিনি এমন নয়, তবে তা নিয়ে সারা দেশকে এত কথা বলতে শুনিনি: এক পুরুষের আত্মহত্যা। 'পুরুষ' মানুষ তো! লিঙ্গ অন্য হলে এতক্ষণে 'দেশে দেশে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে' এটা নিশ্চিত বলতে পারতাম। মানুষটির নাম অতুল সুভাষ। তিনি চলে গেছেন। বলা উচিত নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। পেছনে রেখে গেছেন এক ২৪ পাতার 'সুইসাইড নোট' ও একটি দেড় ঘণ্টার ভিডিও। এগুলোতেই নাড়া পড়েছে অনেকের, এতদিনের জেগে ঘুমোনো বিভিন্ন চিন্তাভাবনার গোড়ায়।
২০১৯ সালে বিয়ে হয় অতুল সুভাষ মোদী ও নিকিতা সিংহানিয়ার। কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় অতুল সুভাষের উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। টাকার চাপ। এতে নিকিতার মা/ ভাই/ কাকা সবাই যুক্ত ছিলেন। এরপর অতুল ও নিকিতা'র সন্তান হয়। ধীরে ধীরে সে শিশু হয়ে ওঠে Emotional Blackmailing'এর হাতিয়ার। অতুল ও নিকিতা ইতিমধ্যে আলাদাও থাকতে শুরু করেছেন। সন্তানকে দেখতেও দেওয়া হত না অতুলকে (এটি বহু পুরুষের সঙ্গেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে)। ক্রমশ মানসিক/ অর্থনৈতিক নানা চাপে এক নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরপর ৯ই ডিসেম্বর ২০২৪, আত্মহত্যা করেন অতুল। বেঙ্গালুরুর নিজের বাড়িতে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঘর থেকে একটা প্ল্যাকার্ডও পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিল 'বিচার এখনও বাকি আছে'। আগেই লিখেছি তাঁর ২৪ পাতা সুইসাইড নোট ও দেড় ঘণ্টার ভিডিও'র কথা। ছেলের উদ্দেশ্যে লিখে যাওয়া অতুলের চিঠিটি আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি প্রত্যেক পুরুষের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। এই আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অতুল সুভাষের ভাই থানায় এফআইআর দায়ের করেছিলেন নিকিতা সিংঘানিয়া এবং তাঁর বাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে।
অতুল আগে থেকেই নিকিতার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সন্তানের হেফাজত নিয়ে আইনি জটিলতায় জড়িয়েছিলেন। তাঁর নিজের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর আদালতে এই মামলা চলছিল। পুলিশ জানিয়েছে যে নিকিতার কারণেই অতুল মানসিক কষ্টে ছিলেন। এমনকী এই মামলা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ৩ কোটি টাকার দাবিও জানিয়েছিল নিকিতার পরিবার। তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক বিচারক। তাঁর সম্পর্কেও FIR করা হয়েছে। ছেলেকে দেখার জন্য অতুলের কাছ থেকে ৩০ লক্ষ টাকাও চেয়েছিলেন নিকিতা, জানিয়েছে পুলিশ।
আমাদের (পুরুষ অধিকার কর্মীদের) সম্পর্কে যাঁরা এতকাল মনে করেছেন শুধুই Limelight পাওয়া বা নারী-পুরুষের সংসার ভেঙে দেওয়া বা নারীকে ছোট করে দেখাবার জন্য এই কাজটি করে চলেছি, তাঁরা হয়তো (?) সামান্য হলেও বুঝতে পারছেন যে তাঁরা ঠিক ছিলেন না (অবশ্যই যদি অতুলের ঘটনাটি জানেন, তবেই)। অতুলের নোটটি পড়লে বা ভিডিওটি শুনলে আপনারা জানতে পারবেন কী অমানুষিক মানসিক নির্যাতনের (হয়তো শারীরিকও) মধ্যে একজন পুরুষকেও যেতে হয়। কিন্তু বলার বা শোনার কেউ থাকে না। তাই উনি এইভাবে সারা দেশকে শুনিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার একনায়কতন্ত্রও কি এর জন্য দায়ী নয়? এঁরা মধ্যস্থতা করতে আসেন ৩ কোটি টাকা আদায় বা সন্তানকে দেখার বিনিময়ে ৩০ লক্ষ টাকা দেবার অন্যায় আবদারে সীলমোহর দেবার জন্য! এ দেশ জুড়ে বহু নিরপরাধ/ নিরীহ/ সাধারণ বা অসাধারণ, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পুরুষের মানসিক ও শারীরিক গণহত্যার যে মঞ্চ অনেকদিন ধরে তৈরি হয়েছে, সেই মঞ্চের পর্দা তুলে দিয়ে গেলেন অতুল নিজের জীবন স্বহস্তে বলি দিয়ে।
একটি জরুরি বিষয় মনে রাখতে হবে। বিশেষত যাঁরা পুরুষ অধিকার আন্দোলন নিয়ে সামান্যতমও আগ্রহী তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভারতবর্ষের পুরুষ অধিকার আন্দোলন এখন থেকে স্পষ্টতই দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি ভাগ অতুল সুভাষ'এর মৃত্যু পূর্ববর্তী, অন্যটি তাঁর মৃত্যু পরবর্তী। উনি দেখালেন, 'এভাবেও চলে যাওয়া যায়', আর আমাদের দিশা দেখিয়ে গেলেন এক নতুন লড়াই শুরুর; না থামার লড়াইয়ের। ওঁনার এই মৃত্যু যেন বৃথা না যায়, তা দেখার দায় আমাদের সবার। আশার কথা, গত ১৪ ডিসেম্বর এই বাংলা ও দেশের অন্যত্র বহু জায়গায় 'Reclaim the Night' আওয়াজ তুলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু সাধারণ মানুষ অতুল সুভাষের বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলেন। আজ এ কথা সকলেই বুঝছেন যে, আইনি সুযোগ নিয়ে ও মিথ্যা অপবাদে নিছক পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষদের নির্বিবাদে অপদস্থ, হেনস্থা ও হত্যা করার যে প্রবণতা বিশেষত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিরুদ্ধে সদলবলে আওয়াজ তোলার সময় এসে গেছে।
আসলে পুরুষ মানুষ তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই 'হয় রক্ষক, নয়তো ভক্ষক'-- এই দুই তকমাতেই আটকে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার কিন্তু পুরুষমানুষ। তাঁর অসহায়তা বা চোখের জল দুই বড় করুণা ও লজ্জার। তাই আজ এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে, নয়তো আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র, প্রেমিক কাউকে হয়তো এই আইনি সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করা যাবে না। কাল বা পরশু সে হয়তো থাবা বসাবে আমার বা আপনার ঘরে!
যে দেশে পশু পাখির জন্য মন্ত্রণালয় আছে, পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, সে দেশে একটি পুরুষ কমিশন'এর দাবি এখন অত্যন্ত একটি ন্যায্য দাবি। আসুন, সবাই সে জন্য সওয়াল শুরু করি। নতুন করে শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথা বলা।
(নন্দিনী ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট, অল বেঙ্গল মেনস ফোরাম: +917003624865/ +919903318148)
নন্দিনীদি দীর্ঘদিন ধরে পুরুষ অধিকার আন্দোলন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, কথা বলে যাচ্ছেন । এক্ষেত্রেও তাইই দেখা গেল । খুব ভালো খেলা । নন্দিনী এবং এককমাত্রাকে ধন্যবাদ । 🙏🏼💟😊♂️
ReplyDeleteনন্দিনী নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে, কথা বলছে। রাষ্ট্রও তাই দেখা গেল। খুব ভালো লেখা। নন্দিনী এবং একমাত্রাকে ধন্যবাদ। 🙏🏼💟😊♂️
ReplyDeleteউত্তর মুছুন
প্রয়োজনীয় ও দুর্দান্ত লেখা।
ReplyDeleteএ সময়ে অতি প্রয়োজনীয় লেখা। অত্যাচারও নিপীড়নের আরেক দিক।
ReplyDeleteসবার ঘরে দাদা, ভাই, বাবা আছেন। আপনার সেই আপনজনের জীবন আজকের নীরিখে কতটা সুরক্ষিত; ... জানুন।
ReplyDelete✊️✊️✊️✊️✊️✊️✊️
ReplyDeleteEr ageo paribarik ebong anyanyo samajik khetre bahu purush nari kendrik sin , samajik manosikota etyadi jonnyo khun hoechen, suicide korechen, arthik loksan samne porechen. Amader deshe ei samossa ekta baro issue. Desher politicians purushder just use koren r nari toshon basto. Women centric law ek bissl sangkhyok nari o tader poribarer purushder kache searthosidhhir hatiar hoe dareache. Jehetu purushadhikar kormi ei gender biased pratibad koren ti tader udesye netibachok prachar chalano hoi, jar nekkarjanok prakash R J Kar movement samai mohilara korechen. Kintu ei mohilader poribar keu kono bandhu jakhon mohilader hate blackmailing hon takhon dibbi purushadhikar kormi kotha tader mone pore. Jaihok ei larai cholche r cholbeo. Aj Asansole amra purushadhikar kormi ekta chotto street corner protest korchi. Lorai cholche r cholbeo.
ReplyDeleteউগ্রপন্থা ও আইনি সন্ত্রাসবাদ এটাই যেন এখন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে! ন্যায় অন্যায়ের ও মানবিকতার পরিভাষা বদলে গেছে! অদ্ভুত দুঃসময়! নন্দিনী ম্যাডামকে স্যালুট বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থেকে উদভ্রান্ত পরিবারগুলোর পাশে থেকে সাহস ও সহায়তা জোগানোর জন্য 🙏
ReplyDeleteখুব সময়োপযোগী লেখা এবং সবথেকে বড় কথা সব মানুষের ভাবার সময় এসে গেছে। যেকোনো লড়াইতে কিন্তু সৈনিক খুব দরকার
ReplyDeleteNisandhe kalopojogi lekha.... Nandinidi-r onuprerona-e amra sobai moner harano jor nea nijeder judhho chalea jachhi.... Sobar mangal kamona kori...
ReplyDeleteদুর্দান্ত, অসাধারণ একটি লেখা। বর্তমান সমাজের আপামর নিপীড়িত পুরুষগণ এবং তাদের পরিবারের অত্যাচারিত সদস্যদের অতি প্রিয় দিদি নন্দিনী ভট্টাচার্য এবং পুরুষ-অধিকার আন্দোলন - এই দুটি যেন অবিচ্ছেদ্য, সমার্থক। সকলের কাছে প্রার্থনা ও অনুরোধ করি - সমাজ মাধ্যমে ও সকল স্থানে এই অনন্য, সমাজ-সুধারক ও জাগ্রতকারী লেখাটি পোস্ট করুন। সমাজ সচেতনতায় আপনার যে কিঞ্চিৎ দায়ভার রয়েছে তা ভুলে যাবেন না। নিজের কর্তব্য পালন করুন।
ReplyDeleteজয় পুরুষের জয়!
এখন সেই তথাকথিত নারী বাদীদের কোন বক্তব্য দেখছিনা ।তাঁরা কি শীতঘুমে?
ReplyDeletedhanyabad apnake amon ek pese bichar babosthar birudhhe lorai chaliye jawar jonno.. deri na kore bodol korar ei tai asol somoy
ReplyDeleteলিঙ্গ নিরপেক্ষ আইন চাই ও পুরুষ কমিশন চাই।
ReplyDelete