Pages

Sunday, 30 August 2020

অতিমারির মিথ্যাচার

তবলিগি জামাত ও একটি মামলার রায়
সুমন কল্যাণ মৌলিক

করোনা অতিমারি, অপরিকল্পিত লকডাউন, দেশজোড়া শ্রমজীবী মানুষের হাহাকার, অন্যদিকে বেচারামদের গল্পকথা আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির গৈরিকীকরণ– এই দমবন্ধ করা জীবনে অবশেষে কিছু তাজা হাওয়ার সন্ধান পাওয়া গেল। প্রথমটি অবশ্যই স্বনামধন্য আইনজীবী প্রশান্তভূষনের সাহসী টুইট ও মেরুদণ্ডী অবস্থান যা আমাদের প্রাণিত করছে। দ্বিতীয়টি তবলিগি জামাত মামলায় মুম্বই হাইকোর্টের ঔরঙ্গাবাদ বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতি টি ভি নালওয়াদে ও এম জি সিউলিকরের গুরুত্বপূর্ণ রায় যা বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু। এই মামলায় বিচারপতিদ্বয় ২৯ জন বিদেশি ও ৬ জন ভারতীয় তবলিগি জামাতের সদস্যদের বিরুদ্ধে করা এফআইআরগুলি শুধু খারিজই করেননি, একই সঙ্গে করোনা সংক্রমণের যে অভিযোগগুলি তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল সে সবকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে মিডিয়া ও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযুক্তদের বলির পাঁঠা বানাবার নিন্দা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায়, এপিডেমিক ডিজিস অ্যাক্ট, মহারাষ্ট্র পুলিশ অ্যাক্ট, বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ আইন ও ফরেনার্স অ্যাক্টে অভিযোগ আনা হয়েছিল।

মূল বিষয়ে প্রবেশ করার আগে আমরা লকডাউনের প্রথম পর্বের ঘটনাগুলির দিকে চোখ ফেরাই, যখন করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা ও অপরিকল্পিত লকডাউন সঞ্জাত জনবিক্ষোভকে সামাল দিতে কর্পোরেট মিডিয়া ও বিষাক্ত আইটি সেলের সাহায্যে তবলিগি জামাতের দিল্লি সম্মেলনকে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করার নীল নকশা তৈরি করা হয়। বিষয়টা প্রথমে তবলিগি জামাতের ঘটনা দিয়ে শুরু হলেও স্বাভাবিক ভাবেই এক-দু দিনের মধ্যে সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়কে 'গণশত্রু' হিসেবে দেগে দেওয়া হয়।

তবলিগি জামাতের ঘটনাটিতে উদ্যোক্তা ও দিল্লি প্রশাসনের (সমস্ত অনুমতি তারা দিয়েছিল কারণ তখন লকডাউনের কোনও গল্পই ছিল না) তরফে একটা মাত্রা পর্যন্ত দায়িত্ববোধের অভাব ছিল, এ কথা প্রমাণিত। একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে এই ধরনের বহু ধর্মীয় জমায়েতের ঘটনা সেই সময় বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরে ঘটেছিল। করোনা সংক্রমণের প্রথম ঘটনা (কেরলে) জানার পরেও আহমেদাবাদে ট্রাম্পের সভায়  কোনওরকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন, যাদের অনেকেই ছিলেন বিদেশি। কিন্তু জামাতের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় কর্পোরেট মিডিয়া ও বিজেপির আইটি সেল এক চক্রান্তের তত্ত্ব দাঁড় করায় যার আনুষ্ঠানিক নামকরণ হয় 'করোনা জেহাদ'। এই তত্ত্বের উপজীব্য হল, ভারতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবার জন্য একটি গোষ্ঠী নাকি সক্রিয়। এদের পেছনে আন্তর্জাতিক মদত রয়েছে। সেই চক্রান্তের অংশ হিসেবে ইসলামি ধর্মগুরুরা লকডাউনের নিয়মবিধি ভঙ্গ করার ফতোয়া দিয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হকার/ বিক্রেতারা নাকি তাঁদের থুতু, প্রস্রাবের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

এই তত্ত্বের বাস্তবতা প্রমাণ করতে গিয়ে শুরু হয় বিষোদ্‌গার ও ফেক নিউজের  দ্বিমুখি আক্রমণ। গবেষক সৌমেন্দ্র আইয়ার (ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট অফ পন্ডিচেরি) ও শৈবাল চক্রবর্তী (ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাট দি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স) মিডিয়া রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ২০ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল (২০২০) এই  এক মাসে ২৭১টি মিডিয়া সোর্স থেকে তবলিগি জামাত সংক্রান্ত ১১,০৭৪টি 'খবর' প্রকাশিত হয়েছে। সেই হাজার হাজার কুৎসাবাহী প্রচারের গুটিকয়েক এখানে উপস্থিত করছি:

১) ৪ এপ্রিল জনৈক শিবাংশু শুক্লা ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করেন যাতে 'জয় যোগীরাজ' শিরোনামে দেখা যায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ করোনা জেহাদিদের গুলি করছে। যেটা আসলে ছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এক পুরনো মক ড্রিলের ছবি।

২) বান্দ্রা স্টেশনে ট্রেন ছাড়বে এই খবর পেয়ে মুম্বইয়ের পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার তাগিদে জমায়েত হন। সেই জমায়েতকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালায়। এবিপি নিউজ খবর করে যে পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে গণ্ডগোলের প্ররোচনা দেওয়া হয়। যদিও পরে খোদ এবিপি নিউজের অ্যাঙ্কর রুবিয়া লিয়াকত চ্যানেলের ফেসবুক লাইভে খবর প্রচারকদের মিথ্যাবাদী আখ্যা দেন। মুম্বই পুলিশ পরে বিবৃতি দিয়ে বান্দ্রার ঘটনায় ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খারিজ করে।

৩) ২ এপ্রিল 'নমো অলওয়েজ' ফেসবুক পেজে একটা ভিডিও পোস্ট করা হয় যাতে দেখা যায় একজন মুসলিম ভেন্ডার খাবারে থুতু দিচ্ছেন। যা আসলে ২০১৮ সালের একটা পুরনো ভিডিওকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে।

৪) ২৮ এপ্রিল জনৈক ঋষি রাজপুত হিন্দি চ্যানেল 'নিউজ নেশন'এর একটা খবরের শিরোনাম পোস্ট করে যাতে লেখা ছিল রাজস্থানের ঝালওয়ারে ১০০ জন নার্স পদত্যাগ করেছেন। ঋষির বক্তব্য ছিল, ঐ হাসপাতালে থাকা তবলিগি জামাতের সদস্যরা খাবারে বিরিয়ানি না পেয়ে নার্সদের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে। খবরটা নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়, পরে দেখা যায় ব‍্যাপারটা অন‍্য। নার্সরা আসলে খুব কম বেতন ও পিপিই না পাওয়ার কারণে পদত্যাগ করেছেন।

৫) এপ্রিল মাসের গোড়া থেকে  বিভিন্ন ছবি ও ক্লিপিংস সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে যার মূল বক্তব্য কোথাও মুসলমানরা লকডাউন বিধিকে অমান্য করে নামাজ পড়ছে, কোথাও তারা বাজারে জমায়েত হচ্ছে। প্রত্যেকটি ভিডিও যে পুরনো তা পরে ফাঁস হয়ে যায়।

এই বিষাক্ত প্রচারের ফল হয় মারাত্মক। প্রকাশ্যে মুসলিম হকার, ভেন্ডারদের বয়কট ও নিগ্রহ করা হতে থাকে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির একজন প্রতিনিধি বাজারে সবজি বিক্রেতাদের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার হুমকি দেন। সমস্ত সাংবিধানিক রীতিনীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করে। হটস্পটগুলির নামকরণ মসজিদের নামে করা হয়। ভারতে করোনাকে সেই সময় যে ভাবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয় তাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয় যে কোভিড রোগীকে ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে ভাগ করা অন্যায়।

এই প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের রায়ে উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এখানে তুলে ধরছি:

ক) একটি রাজনৈতিক সরকার অতিমারি বা বিপর্যয়ের সময় তবলিগি জামাতের সদস্যদের বলির পাঁঠা করার চেষ্টা করেছে। এই বিদেশিদের পরিকল্পিত ভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও সংক্রমণের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি ধোপে টেঁকে না। সরকারের ভুল পদক্ষেপের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া ও তা সংশোধন করার সময় এসেছে।

খ) দিল্লি মারকাজে যে বিদেশিরা এসেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। একটা চেষ্টা হয়েছে এটা প্রমাণ করার যে এই বিদেশিরাই ভারতে কোভিড সংক্রমণের জন্য দায়ী।

গ)  সমস্ত সাক্ষ্য ও তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে 'বিদেশি ও ভারতীয় মুসলমানরা নানান ভাবে কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে' এমন অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। এই ধারণাটা পরিকল্পিত ভাবে তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল।

ঘ) আদালতের কাছে যে সমস্ত তথ্য উপস্থিত করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে সরকার শুধু বিদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে, অন্য ধর্মের বিদেশিদের বিরুদ্ধে কোন‌ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঙ) মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরকারের এই শাস্তিদানের কারণ হিসাবে মহামান্য বিচারপতিরা দেশ জোড়া এনআরসি ও সিএএ বিরোধী আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রশ্নটি তুলে এনেছেন। প্রসঙ্গত  উল্লেখযোগ্য, হাইকোর্টের এই বেঞ্চই ২০২০ সালের ফ্রেবুয়ারি মাসে অন্য একটি মামলার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনকারীদের কখনই দেশদ্রোহী বলা যায় না।

এই রায়ের ফলে তবলিগি জামাতের সদস্য বিদেশি নাগরিকরা হয়তো দ্রুত বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু তাতে মূল সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। আজ এ কথা পরিষ্কার যে করোনা অতিমারির সময় নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সংক্রমণের জন্য দেগে দেওয়া এক পরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ। সেই চক্রান্তের হোতাদের শাস্তির দাবি আমরা তুলব না? প্রশ্ন করব না সরকারের বিভেদকারী নীতিকে? আমরা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হই তাহলে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারীদের শাস্তির দাবি আমাদের করতেই হবে, এবং তা এখনই।
 

2 comments:

  1. বিভিন্ন ভাবে, একটি ভারতীয় সম্প্রদায়কে বলির পাঁঠা বানানোর চক্রান্তকারীদের শাস্তির দাবি জানাই।
    প্রবন্ধটি সময়োচিত। এবং তথ্য নির্ভর। লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. besh bhalo lekha.

    ReplyDelete