গতকাল ছিলে বলে আজও থাকবে?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
ফেসবুকের দিন কি গিয়াছে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে দ্রুততায় রুমালকে বিড়াল করতে পারে, সেই দ্রুততায় তার আজকের ব্যবহারকারীরা এক লহমায় কাল ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো করোনা এসে সেই গতিতে যেন জেট স্পিড জুড়েছে। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ করে এফএম ও টিভি চ্যানেলে ফেসবুকের এত বিজ্ঞাপনের হিড়িক কেন? খবরের কাগজেও এসে পড়ল বলে। তবে কি ফেসবুকের থেকে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে? যে সোশ্যাল মিডিয়ার এত পোয়াবারো, কাউকে পরোয়া করার তার কোনও প্রয়োজন পড়ে না, বরং সাবেকি মিডিয়া তার উত্থানে জবুথবু, সেই সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে কী এমন ঘটতে চলেছে যে ফেসবুকের মতো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এক গভীর জালিকাতন্ত্রের আজ এই দুর্ভোগ?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কন্দরে ও সর্বোপরি এমন এক পরিবর্তনের সমীপে যার সে অর্থে তালজ্ঞানের কোনও ঠিকঠিকানা নেই। হয়তো প্রায় সমস্ত অধুনা মনুষ্য-সৃষ্ট ক্রিয়াকর্মেরই এইই পরিণতি। অবশ্য তথ্য বলছে, এর মূল কারণ দুটি। এক, নিজের ব্যবসা বাড়াতে বিভিন্ন দেশের শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঘৃণার রাজনীতি ছড়াতে ফেসবুক পরোক্ষে সাহায্য করে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে; যে কারণে, বহু কর্পোরেট সংস্থা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া স্থগিত রেখেছে (যেমন, ইউনিলিভার, ভেরিজোন, কোকাকোলা ইত্যাদি)। ফলে, তাদের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। দুই, তরুণ প্রজন্মের এক বড় অংশ ফেসবুক থেকে সরে আসছে বিবিধ কারণে; দেখা যাচ্ছে, আমেরিকায় ১২ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহার ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে যথাক্রমে কমে ৭৯, ৬৭ হয়ে ৬২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, আওয়াজ উঠেছে, সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য নাগরিক অধিকার অডিটের। সম্প্রতি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময় ফেসবুকে ট্রাম্পের একটি ঘৃণা সম্বলিত পোস্ট (‘লুঠেরাদের গুলি করে মারো’) ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সরাতে ইতস্তত করায় এই দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
এই শতকের শুরুতে ইমেলের ব্যাপক প্রচলনের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে যে ত্বরিত যোগাযোগের নতুন ইতিবৃত্ত শুরু হয়েছিল, অনতিবিলম্বেই ‘অর্কুট’এর আগমনে তা এক সামাজিক মাধ্যমের অবয়বে তাৎক্ষণিক আদান-প্রদান, জমায়েত, মতপ্রকাশ, বন্ধুত্ব ও নতুন সংযোগের এক নব পরিসর হয়ে দাঁড়াল। আর তার কিছু পরেই ফেসবুকের আবির্ভাব, যা নতুন নতুন আঙ্গিকের প্রচলনে যোগাযোগের এক উত্তম মাধ্যম হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক পালাবদল, জনমত গড়ে তোলা ও বহু অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তা আপাতদৃশ্যে এক কার্যকরী প্ল্যাটফর্মও হয়ে উঠল। এই সময়েই, তাহিরি স্কোয়ার, শাহবাগ, দিল্লি সহ বিশ্বের বহু জায়গায় জন-আন্দোলনের ক্ষেত্রে ফেসবুক প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে আমজনতাকে নতুন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেও দেখা গেল। তখনও বহু রাষ্ট্র শাসকেরা বুঝতে পারছেন না, যে এমন এক সামাজিক মাধ্যমের ওপর ভর করে মানুষ নিজেদের মধ্যে নিবিড়-নিপুণ এক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যে তা পুরনো, সাবেকি বিগ মিডিয়া বা তাদের অন্যান্য নজরদারির ব্যবস্থাপনা দিয়ে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। যখন তাঁরা বুঝতে পারবেন তখন তার এক আলাদা মোড় নেওয়ার পালা। কিন্তু গোড়ায়, এই বুঝতে না পারার কারণেই ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ শব্দটি বহুজনের কাছে এতটাই নিকটবর্তী হয়ে পড়ল যে সাবেকি মিডিয়া তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বেশি করে হারাল এবং ফেসবুকের সেই দাপটের কাছে ‘অর্কুট’ও পিছিয়ে পড়ে শেষাবধি বন্ধই হয়ে গেল। পাশাপাশি, এই যোগাযোগ ব্যবস্থাও হতে চাইল আরও নিবিড়, আরও কাছের, আরও সহজ ও আরও প্রণিধানযোগ্য।
যোগাযোগ মাধ্যমের এই পরিসরে ২০০৯ সালে ইয়াহু’র প্রাক্তন দুই কর্মী ব্রায়ান অ্যাক্টন ও জা কৌম তৈরি করলেন মোবাইল ভিত্তিক এমন এক মেসেঞ্জার ব্যবস্থা যা খুব সহজেই পরস্পরের মধ্যে লিপি, ভয়েস ও ছবির সরাসরি যোগাযোগের এক মাধ্যম হয়ে উঠল। খুব চালু সরস ভঙ্গিতে এই মেসেঞ্জারের তাঁরা নাম দিলেন ‘হোয়াটসঅ্যাপ’। তখনও স্মার্ট ফোন সেভাবে বাজারে না আসায় তা মূলত অ্যাপেল’এর আইফোনে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু ২০১২ সালের ডিসেম্বর অন্তে এসে দেখা গেল, হার্ডওয়ার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত বিকাশে বিশ্বব্যাপী স্মার্ট ফোন এসে পড়েছে ও প্রায় ১০০ কোটি মানুষের হাতে তা পৌঁছেও গেছে। ফেসবুক এই যোগাযোগ মাধ্যমের বিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ‘হোয়াটসঅ্যাপ’কে কিনে নিল। কারণ, তারা জানত, আগামী দিনে ফেসবুকের থেকেও আরও উন্নত, নিবিড়, সহজ কোনও যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য মানুষ উন্মুখ হবে। আর এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে কোটি কোটি মানুষ আবদ্ধ ও ব্যস্ত হয়ে পড়ায়, খুব স্বাভাবিক যে তাদের দেয় ও তাদের থেকে আহরিত তথ্যগুলি নিয়ে এক তথ্য ব্যবসার দিগন্তও খুলে যাবে। এসে পড়বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডাটা অ্যানালিটিক্স’এর মহা দুনিয়া। তথ্য কেনাবেচা ও তথ্যের জায়গিরদারিই হয়ে উঠবে মুখ্য পন্থা। এর পরের যাত্রাপথ আমাদের অনেকেরই জানা, যখন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও শাসকেরাও ঢুকে পড়বে সোশ্যাল মিডিয়ার এইসব চত্বরে তাদের নিজ প্রচারের রকমারি নিয়ে, সর্বোপরি গাঁটছড়া বাঁধবে এদের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে, নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য নেবে এদেরই প্রযুক্তির। আর এইসব টানাপড়েনেই, নিত্য উত্থানপতনের গড়িমসিতে সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন নতুন সত্তার উদ্ভব হবে ও কখনও কোনও সন্ধিক্ষণে এক সত্তা হারিয়ে গিয়ে জায়গা করে দেবে নতুনতর কোনও উদ্ভাবনকে।
তার সঙ্গেই করোনা পরিস্থিতির আচম্বিত আগমন, অতএব, এই গোটা প্রক্রিয়াটাকেই একইসঙ্গে নৈরাজ্য ও দ্রুতলয়ের পরিবর্তনের অভিসারী করে তুলেছে। কারণ, ভার্চুয়াল ভুবনের বাধ্যত ব্যবহার অযাচিত ভাবে বদলে দিচ্ছে অনেক কিছুই। ঘরবন্দী মানুষের ভার্চুয়াল কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি যোগাযোগেরও নতুন আঙ্গিক তৈরি হয়েছে। এসে গেছে গুগল মিট বা জুম ধরনের অ্যাপ যা কর্মক্ষেত্রেই শুধুমাত্র নয়, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সমন্বয়ের জন্যও অতীব জরুরি ও কার্যকরী আজ। সেই সঙ্গে ইন্সটাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ’এর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে (যদিও এই দুটি ফেসবুকেরই সংস্থা)। statista.com’এর বিশ্লেষণ বলছে, সারা বিশ্বে ই-কমার্স’এর বৃদ্ধি ২০১৯ সালে যা ছিল ৩৬২.২ বিলিয়ন ডলার, তা ২০২৪ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৬৭৩ বিলিয়ন ডলারে (৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি)। একই সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, ভিডিও অ্যাপ জুম’এর ফেব্রু-এপ্রিল ২০২০ ত্রৈমাসিক অর্ধে যেখানে আয় ছিল ৩২৮ মিলিয়ন ডলার তা মে-জুলাই ২০২০ অর্ধে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬৪ মিলিয়ন ডলারে (দ্বিগুণেরও বেশি)। নিঃসন্দেহে করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ, আপিস-আদালত বন্ধ থাকাতেই এই বৃদ্ধি। কিন্তু এর তাৎপর্য অন্যত্র। তা হল, আগে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার ব্যবহার বহুলাংশেই ছিল পেশা ও কর্মভিত্তিক এবং পাশাপাশি অবসর বিনোদনের উপায়, সেখানে তা আজ জীবনের নিত্যসঙ্গী। বাজার-হাট, সামাজিক দায়দায়িত্ব, বন্ধুকৃত্য, খোঁজখবর রাখা (খবরের কাগজ পড়াও যখন বন্ধ-প্রায়) ইত্যাকার সব কিছুর জন্যই এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়া।
প্রয়োজনীয়তা ও জীবনশৈলীর এই ‘নতুন স্বাভাবিকত্ব’ স্বভাবতই কিছু পুরনো ভার্চুয়াল অভ্যেসকে অচল ও অলস করে দেবে। ফেসবুক সে অর্থে আজ অনেকটাই পিছিয়ে পড়া। তাই প্রাসঙ্গিক থাকতেই তার বেপরোয়া হয়ে ওঠা- শাসকের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে ও তাদের সঙ্গ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচল রাখা ও প্রসারিত করা। তবে তারাও হয়তো বুঝছে, এইসব ত্যাঁদড়ামি করে সাময়িক কিছু লাভালাভ হতে পারে, স্থিতাবস্থা রেখে দিলে লম্বা দৌড়ে বরং তাদের পিছিয়েই পড়তে হবে। তাই, বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের ইমেজকে শানিয়ে নিতেই তারা আসরে হাজির, উপরন্তু, এফএম চ্যানেলে সঞ্চালকের আলোচনাতেও নিজেদের তুলে ধরতে ও নিজ গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা দিতে বিনিয়োগে দরাজ। মুকেশ অম্বানির জিও’র সঙ্গে ‘হোয়াটসঅ্যাপ’এর গাঁটছড়া বেঁধে দিয়ে ফেসবুকের এ দেশে এখন বহু পরিকল্পনা। সেদিক থেকে তার উচাটনও অনেক বেশি। এখন দেখার, এই দুর্দমনীয় সময়ের আবহে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন অভিষেকে ফেসবুক শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তবে তাদের পুরনো কারবারটি যে তেমন চলছে না, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
এটাও খেয়াল করার বিষয় যে মূল্ধারার মিডিয়াতে ফেসবুকের কুকর্ম প্রকাশ হয়েছে। সেই খবরের ওপর মানুষ এখনও বিশ্বাস করছেন। সামাজিক মিডিয়া এখানে কিন্তু মূল্ধারার মিডিয়াকে টপকে যায়নি। গেলে ফেসবুক এত উঠে পড়ে লাগত না। বরং এটাও বেশ আশ্চর্যের যে ফেসবুক নিয়ে বিতর্ক মাত্রই দু তিন সপ্তাহের বিষয়। সংসদীয় কমিটি তাঁদের ডেকে পাঠাল মাত্র দু তিনদিন আগে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই জনমন বিরূপ।
ReplyDelete