Pages

Thursday, 29 February 2024

সন্দেশখালি অতঃপর (২)

খেলা শুরুর আগেই শেষ? 

সুমন সেনগুপ্ত



সম্পাদকীয় নোট: গত ১৩ ফেব্রু সন্দেশখালির ঘটনাবলী নিয়ে আমরা প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করি। গোদি মিডিয়ার কলতলার ঝগড়া নয়, বাংলা দখলের রাজনৈতিক চিত্রনাট্য অনুসারে নয়, বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি লেখেন সুমন সেনগুপ্ত (https://ekakmatra2013.blogspot.com/2024/02/blog-post_13.html)। আজ শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারের পর দরকার পড়ল আরও একটি প্রতিবেদনের।


অবশেষে গ্রেফতার হল তৃণমূলের নেতা শেখ সাজাহান। শোনা যাচ্ছে, ভোর রাতে মিনাখাঁর কাছে একটি জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ গ্রেফতার করেছে শেখ সাজাহানকে। স্বভাবতই সমস্ত মিডিয়া জুড়ে এই খবর। রেশন দুর্নীতির মামলায় ইডি যেদিন শেখ সাজাহানের বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়েছিল, সেদিন থেকেই সে খাতায়-কলমে নিখোঁজ ছিল। অবশেষে আজ গ্রেফতার হল। যদিও তার গ্রেফতারি নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ দিনেরও বেশি টালবাহানা চলেছে। হাইকোর্টের একটি নির্দেশনামার কিছু অংশে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং তা রাজ্য সরকার গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিচারপতিদ্বয় স্পষ্ট করে এক নতুন নির্দেশনামায় বলেন যে শেখ সাজাহানকে গ্রেফতারে আদালতের কোনও বাধা নেই এবং ইডি, সিবিআই বা রাজ্য পুলিশ, যে কেউ তাকে গ্রেফতার করতে পারে। এই নির্দেশের পরেই পুলিশ কোমর বেঁধে নামে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, সন্দেশখালির জনতা, বিশেষত মহিলারা যদি সর্বাত্মক ভাবে এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে না নামতেন তবে আদৌ শেখ সাজাহানের দলবল এ ভাবে উন্মোচিত হত বা ধরা পড়ত কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অবশ্যই এই জয়, সন্দেশখালির মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের জয়।

এই গ্রেফতারিতে সন্দেশখালির মানুষ খুশি হয়ে অকাল হোলিতে মেতে উঠলেও প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এখনও যে খুশি, তেমনটা নয়। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যতক্ষণ না শেখ সাজাহানকে নিজেদের হেপাজতে নিচ্ছে, ততদিন এই গ্রেফতারি নাকি গ্রেফতারিই নয়, শুধুমাত্র লোকদেখানো কিছু নিয়মতান্ত্রিকতা মাত্র। যদিও রাজ্যপাল তাঁর বক্তব্যে 'অন্ধকারের শেষে আলোর দিশা' দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি এই ইস্যুটা সহজে ছেড়ে দেবে না। ছেড়ে দিলে, তাদের পোষা গণমাধ্যমগুলোর তো সান্ধ্যকালীন কলতলার ঝগড়াই বন্ধ হয়ে যাবে!

তবে কলতলার ঝগড়া ব্যতিরেকেই শেখ সাজাহান, শিবু হাজরা কিংবা উত্তম সর্দারদের কুকীর্তির কথা জানেন না, এমন মানুষ এ রাজ্যে এখন হাতে গোনা। এই গ্রেফতারির প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য রাজনীতিতে কতটা রদবদল হয় তার দিকে যেমন চোখ থাকবে, তার থেকেও বেশি নজর থাকবে সন্দেশখালিতে শাসক দল কীভাবে নিজেদের হারানো জায়গা আবার ফিরে পায়। মার্চের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তিনিও নিশ্চিত সন্দেশখালি ও তৃণমূল নিয়ে তাঁর সমালোচনার সুর চড়াবেন। আগে শোনা যাচ্ছিল, সন্দেশখালির অত্যাচারিত মহিলাদের নাকি প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চে তোলা হতে পারে, কিন্তু পরে হয়তো সেই কর্মসূচি থেকে বিজেপি নিজেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

তবে আজ এই গ্রেফতারির পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় স্তরের মুখপাত্রেরা যে অভিযোগ করেছেন, তা নিয়েও কথা বলতে হয়। তাঁদের বক্তব্য, সাজাহানকে গ্রেফতারির সময়ে যে ধারাগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো অত্যন্ত লঘু, এমনকি মহিলাদের ওপর অত্যাচারের কথাও নাকি সেই ধারায় নেই। যদিও তা একেবারেই নয়। বেশ কয়েকটি জামিন-অযোগ্য ধারা এই মামলায় যুক্ত হয়েছে এবং প্রথম সওয়ালেই বসিরহাট আদালত অভিযুক্তকে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজত দিয়েছে। ওই নেতাদের দাবি, যদি এই গ্রেফতারির সঙ্গে রেশন দুর্নীতি এবং টাকা নয়ছয়ের বিষয় যুক্ত থাকে, তাহলে পুলিশের উচিত অবিলম্বে সাজাহানকে ইডির হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু ইডি, সিবিআই বা যে কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা যদি তদন্ত করে, তাহলে কি সন্দেশখালির অত্যাচারিত মানুষ সুরাহা পাবেন? নাকি ঐ তদন্তকারী সংস্থার হাতে তদন্ত তুলে দেওয়া গেলে ন্যারেটিভ বা আখ্যান তৈরি করতে সুবিধা হয় বিকিয়ে যাওয়া গণমাধ্যমগুলোর? সকালের কাগজে বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন তৈরি না করা গেলে তো আর তদন্ত হয় না! 

এমনিতেই সন্দেশখালিতে অত্যাচারীর ভূমিকায় শেখ সাজাহানের সঙ্গে শিবু হাজরা কিংবা উত্তম সর্দারদের নাম উঠে আসায় ‘হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের’ আখ্যান খুব একটা দাঁড় করানো যায়নি। এরপরে যদি ইডি, সিবিআই'ও না হয়, তাহলে তো গল্পটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে, তখন তো আর গণতন্ত্রের স্বঘোষিত দ্বাররক্ষকদের আর কোনও কাজই থাকবে না। সান্ধ্যকালীন কলতলার ঝগড়া না হলে তো টিআরপি পড়ে যাবে; তাই যে করে হোক এই তদন্ত ইডির হাতে দেওয়ার জন্য বিজেপি চাপ সৃষ্টি করেই যাবে। কারণ, বিজেপি জানে, ইডি'র হেফাজতে নিয়ে এলে শেখ সাজাহানকে এমনভাবে বিনা বিচারে আটকে রাখা যাবে যাতে শেষত আগামী লোকসভা নির্বাচনে ফায়দা তোলা যায়। 

শেখ সাজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দাররা যে তৃণমূলের সংগঠন এবং অর্থকরী সামলায় তা এখন সবাই বোঝে। সে কারণেই তাদের যদি ইডি'র মামলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়, তাহলে একদিকে সান্ধ্য টিভি'তে কলতলার ঝগড়া এবং তা থেকে রোজ নতুন নতুন আখ্যান তৈরি করা যাবে এবং অন্যদিকে তৃণমূলকে সাংগঠনিক ভাবেও ধাক্কা দেওয়া যাবে। কেউ ইডির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নও তুলবে না, তাদের সাফল্য নিয়েও কথা উঠবে না। কেন দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে প্রায়-সমস্ত প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রীদের এক বড় অংশকে আটকে রাখা হয়েছে, এই কথাও কেউ তোলার সাহস পাবে না। অন্যদিকে কৃষক আন্দোলনে কৃষকদের ওপর গুলি চালানোর কথাও আলোচনা হবে না, ইভিএম নিয়ে যে কথা উঠছে, সে কথাও আড়ালে চলে যাবে। 

তৃণমূলও অত্যন্ত সুচতুরভাবে এই গোটা বিষয়টা সামলানোর চেষ্টা করেছে এবং আগামীতেও করার চেষ্টা করবে। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে আপাতত এই গ্রেফতারির পরে শেখ সাজাহানকে যে ১০ দিনের পুলিশি হেফাজত চাওয়া হয়েছে, তাও অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। ইতিমধ্যেই তৃণমূল দল তাকে ৬ বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছে। মোদীজী যতই তাঁর জনসভায় গর্জন করুন না কেন, বেশি কিছু আপাতত আর বলতে পারবেন না। এরপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো নিজে সন্দেশখালি যাবেন মানুষের ক্ষোভ বুঝতে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই গোটা বিষয়টা হয়তো থিতিয়ে যাবে এবং নির্বাচনের দামামা বেজে উঠবে। মানুষের নজর অন্যদিকে ঘুরে যাবে। আক্ষরিক অর্থেই খেলা শুরুর আগেই খেলা শেষ। 

তবে যে অপ্রিয় কথাগুলো এ ক্ষেত্রে না বললেই নয়, সেগুলো আমাদের মতো নাগরিক সমাজের মানুষদের বলেই যেতে হবে। যে বিজেপি নারী নির্যাতন নিয়ে এত চিন্তিত দেখাতে চাইছে, তাদের কি কোনও নৈতিক জায়গা আছে এ নিয়ে কথা বলার? যে উত্তরপ্রদেশ, যে মণিপুর, যে হরিয়ানা যে মধ্যপ্রদেশে তাদের ডবল ইঞ্জিন সরকার আছে, সেই রাজ্যে নারী নির্যাতন হলে সেখানকার সরকার কি অভিযুক্তদের শাস্তির জন্যে সোচ্চার হয়, নাকি তারা ধর্ষক বা হেনস্থাকারীদের পক্ষে দাঁড়ায়? উন্নাও, হাথরাস কিংবা মণিপুরের ঘটনায় কতবার প্রধানমন্ত্রী সেই জায়গায় ছুটে গেছেন, কতবার তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দেশের সেরা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থাকারীদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন? এখানে এসে বাংলার মহিলাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলা আর প্রকৃতপক্ষে ব্রিজভুষণ শরণ সিং'দের নতুন সংসদ ভবনে পাশে বসানো কি একই সঙ্গে চলতে পারে? অবশ্য, সন্দেশখালিতে যে অভিযোগগুলি জমা পড়েছে তা মূলত জমি দখল, বকেয়া পাওনা, জমির লিজ নিয়ে পয়সা না দেওয়া, জোরজুলুম এইসব। নারী নির্যাতনের অভিযোগ দুটি কি তিনটি।

সর্বোপরি, এ প্রশ্নটাও তুলতে হবে, কেন বার বার গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও গণ-আন্দোলনের কর্মীদের সন্দেশখালি ঘটনায় গ্রেফতার করা হচ্ছে? আজই একজন সাংবাদিকের বাড়িতে পুলিশ চড়াও হয়েছিল বলে খবর ও দু-তিনজন গণ-আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সন্দেশখালির গণপ্রতিবাদকে মান্যতা দিলে এ কাজ ঘোরতর অন্যায়। তবে এটাও খুব আশ্চর্যের ঘটনা, বিভিন্ন গণমাধ্যম যখন সাংবাদিকদের গ্রেফতারির ব্যাপারে সোচ্চার তখন তারা আবার অন্য একটি গণমাধ্যমের এক সম্পাদককে ইডি মাসের পর মাস গ্রেফতার করে রাখলেও সে ব্যাপারে একেবারে নীরব। এই বিচ্ছিন্নতাই গণতন্ত্রের পরিসরকে ক্ষুণ্ণ করে। আশাকরি, সন্দেশখালি এক নতুন সংহতির শিক্ষা দেবে।

  

1 comment:

  1. শেখ শাজাহানের সঙ্গে এক বিরোধী নেতার মুখের খুব মিল রয়েছে।কিভাবে কে জানে

    ReplyDelete