Pages

Thursday, 25 January 2024

বঙ্গে INDIA জোট!

মাথাব্যথাটা কার?

কল্যাণ সেনগুপ্ত



এ কথা অনস্বীকার্য যে, ২০২১'এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিজেপিকে পরাজয়ের গ্লানিতে নিমজ্জিত করাতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৬'র নির্বাচনেও বিজেপি হেরেছিল তবে তার প্রতিক্রিয়া এতখানি হৃদয় বিদারক ছিল না। ২০২১'এ ছিল, মোদী শাহের ২০০ আসন জেতার লক্ষ্যে 'হা রে রে হুংকারে' মেদিনী কাঁপিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার পরেও চূড়ান্ত ভাবেই লজ্জাজনক হার। অথচ, এখন কিছু বিশিষ্ট মানুষ বিজেপি বা মোদীকে হারানোর কথা না বলে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! কিন্তু, সিপিএম-কংগ্রেসের মতো মোদী বিরোধীদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও কি প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? নাকি তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত? রাজ্যের মানুষ কিন্তু তাদের সম্মিলিত শক্তিকে স্রেফ শূন্যে নামিয়ে এনেছে। সুতরাং, এ রাজ্যে কোন মানুষজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তা কি পরিষ্কার করে বলা সম্ভব? মনে হয় না।

আসলে, যাঁরা এসব প্রশ্ন তুলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মোদী বিরোধী লড়াইটাকেই দুর্বল করছেন, তাঁরা আসলে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন 'হুইজপারিং ক্যাম্পেনিং'এর টার্গেট হতে ভয় পান এবং সযত্নে এমন এক প্রতিচ্ছবি গড়ে তুলতে চান, যাতে তাঁকে কোনওভাবেই রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে দূর-দূরান্তেও কোনও সম্পর্ক আছে বলে দাগানো না যায়। অবশ্য এটা দোষের নয়, কারণ, এমন নেতিবাচক প্রচারকে কে না ভয় পায়? এই ক্যাম্পেনাররা একসময় অতুল্য ঘোষ ও প্রফুল্ল সেনকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্টিফেন হাউজের মালিক বলে দেগে দিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীকে ডাইনি বানিয়ে দেয়াল ভরানো এবং রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফর্স ঘুষ কাণ্ডের অভিযোগে দীর্ঘকাল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিয়ে মিটিং মিছিল করেছে - 'গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়'। অথচ এরাই এখন রাজীব জায়া ও পুত্রের দাক্ষিণ্য লাভে মরীয়া হয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখছে। আবার ভবিষ্যতে মমতার সঙ্গেও সম্পর্ক এমনটাই যে হবে না, কে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারে?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, কোনও কোনও যুগ সন্ধিক্ষণে দেশকে বাঁচানোর লক্ষ্যে বড় লড়াইকালে প্রধান শত্রুকে চিহ্নিত করে সমস্ত অন্তর্বিরোধ ভুলে ছোট বড় সব শক্তিকে একজোট হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হয়; তবেই প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন শত্রুকে পরাস্ত করা সম্ভব। অতীতের সমস্ত বড় ঐতিহাসিক লড়াই এভাবেই জয়যুক্ত হয়েছে। এবারের মোদী বিরোধী লড়াইয়েও সবাই জোটবদ্ধ হয়েছে। তাহলে, এ রাজ্যে সিপিএম'এর গলায় অন্য সুর কেন? কারণ, এর পেছনে আছে তাদের নিজস্ব দলীয় এজেন্ডা- যে কোনও মূল্যে তৃণমূলকে যথাসম্ভব শক্তিহীন করে বিজেপিকে শক্তিশালী রাখা, যাতে তৃণমূল যথেষ্ট চাপে থাকে। একদিকে সিপিএম ইন্ডিয়া জোটে থেকে কেরল ও বাংলার বাইরে অন্যত্র যাতে দু-একটি আসন পাওয়া যায় সেই আশায় থাকবে, আবার অপরদিকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে বাংলায় বিজেপিকে শক্তিশালী করতে চাওয়ার মতো দ্বিচারিতা করে পার পাওয়ার চেষ্টা করবে! এ রাজ্যের মানুষ কিন্তু বোকা নন।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো অভিযোগ হচ্ছে দুর্নীতির। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতিকে সম্পূর্ণ পরিহার করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, ধোয়া তুলসিপাতা কোনও দলই নয়। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, অত্যন্ত সফল ও সম্মাননীয় জওহরলাল নেহরুর সময়কালেই দুর্নীতির অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ ওঠে ও বিভিন্ন সময়ে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। 

আর বিজেপির দুর্নীতি বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল। প্রথমত, তারা বিরোধী দলের সেইসব নেতাদেরই নিজেদের দলে নিয়েছে যারা দুর্নীতির রাঘব-বোয়াল বলে অভিযুক্ত; দ্বিতীয়ত, বিজেপি দলে একবার ঢুকে গেলে তদন্তেরও ইতি এবং বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই কাউকেই আর পাওয়া যায় না। সিপিএম জমানায় ঐ দলের কোষাধ্যক্ষ খুন হয়ে গেলেন অথচ সেই খুনের কিনারা হল না। কেন? উত্তর নেই। একবার দুর্গাপুরের এক সভায় কয়লা মাফিয়া কালো সিং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে ত্রাণ তহবিলের জন্য কয়েক লক্ষ টাকার চেক তুলে দিলেন এবং খবরের কাগজেও সে ছবি বেরল। সে জমানাতেও কয়লা, বালি, গরু ইত্যাদি পাচার ছিল। সর্বত্র শিক্ষক নিয়োগ কি আইনানুগ ছিল? তবে সিপিএম জমানায় যেহেতু খুন, জখম, গণহত্যা, রক্তপাত, অত্যাচার ছিল এক ভয়াবহ আতঙ্কের, তাই দুর্নীতি নিয়ে বিশেষ শোরগোল ছিল না।

তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে এত শোরগোলের অন্যতম কারণ ২০২১'এ বিজেপির পরাজয়। ২০১৬'তেও সারদা, নারদা নিয়ে বেশ খানিক হৈ চৈ হয়েছিল, অনেকেই জেল খেটেছিল ও পরে জামিন পেয়ে গেছে, কিন্তু সে সব কেসের কোনও ফয়সালা হয়নি আজও। ২০১৯'এর ভোটে বিজেপি ভালো ফল করল ১৮টি আসন পেয়ে। ফলে, তখনও কোনও দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু এখন দুর্নীতিকে মূল হাতিয়ার করা হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপির প্রধান শত্রু তৃণমূলকে ঘায়েল করতেই। ফলে, বিজেপি তো বটেই, সঙ্গে অপর দুই সঙ্গী সিপিএম, কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের এজেন্সি ইডি, সিবিআই ইত্যাদি সহযোগে গোদি মিডিয়া ও বিচার ব্যবস্থার এক শক্তিশালী অংশ একযোগে এমন শোরগোল তুলতে সমর্থ হয়েছে যে মনে হবে, গোটা দেশে তৃণমূলই সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কি তাই? 'ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল' নামক একটি বিশ্বখ্যাত সংস্থার সর্বশেষ ২০১৯'এর সার্ভে রিপোর্ট বলছে, ভারতে দুর্নীতির রাজ্যওয়ারি তুলনায় ছোট-বড় ২০টি রাজ্যের মধ্যে বাংলার স্থান ১৭তম, অর্থাৎ, তালিকার বেশ নিচের দিকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দশচক্রে এ রাজ্য ভূত বনে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে যেহেতু মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল, তাই বারবার তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কারণ, সিপিএম বলছে, মমতা-মোদীর সেটিং আছে এবং তৃণমূল এমন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল যে, দুর্নীতির প্রশ্নে ভূ-ভারতে তার ধারে কাছে কেউ নেই, উপরন্তু, গণতন্ত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপির বিশেষ তফাত নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব, যতদিন সিপিএম অথবা সিপিএম-কংগ্রেস জুটি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করতে সক্ষম না হচ্ছে, ততদিন বিজেপি নিশ্চিন্তে থাক। কারণ, সিপিএম বা কংগ্রেসের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। অতএব, যাঁরা বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা কি প্রকৃতই ২০২৪'এ বিজেপির পরাজয় চান? এমন একটি প্রশ্ন কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে ওঠাটাই স্বাভাবিক।


1 comment:

  1. খুব যুক্তিপূর্ণ পোস্ট।

    ReplyDelete