Pages

Tuesday, 30 January 2024

'মাতৃভাষা-রূপ খনি'

'মেঘনাদবধ কাব্য'

আজকের নতুন বাতিঘর

প্রবুদ্ধ বাগচী 


(২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ - ২৯ জুন ১৮৭৩) 

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে যাকে অভিহিত করা হয়, সেই 'সিপাহি বিদ্রোহ' ঘটতে তখনও দশ বছর দেরি। আর ঠিক তার একশো বছর পরেই আমরা মুক্তি পাব উপনিবেশের দমবন্ধ নাগপাশ থেকে। ইতিহাসের সেই এক অপরিচিত সন্ধিক্ষণে মাত্র তেইশ বছরের এক যুবা পাড়ি দিলেন মাদ্রাজে। পেছনে পড়ে রইল তাঁর কলকাতার উথালপাথাল দিনগুলি। হিন্দু কলেজ, মন মাতিয়ে দেওয়া ইংরেজি সাহিত্যের মাস্টারমশাইরা, প্রবল বন্ধুদলের হই-হুল্লোড়, খামখেয়ালিপনা, মদিরায় মজে থাকা বিভোর সব সকাল-বিকেল-সন্ধ্যে; আর সাহিত্যের আসঙ্গলিপ্সা। ওই যুবাকালেই তাঁর ধনী পিতা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন হিন্দু থেকে খৃস্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার জন্য। হিঁদু-বাড়ির কালেজে-পড়া-ছোঁড়া কেরেস্তান হওয়ায় কলকাতায় সে এক বিচিত্র শোরগোল।  অমন আমুদে আর অমিতব্যয়ী দিলখোলা তরুণের চোখের ওপর কিন্তু তখন অভাব আর অভাব। মাদ্রাজ তাঁকে আশ্রয় দিল। প্রথমে একটি অনাথ আশ্রমের সামান্য চাকরি, তারপর মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি স্কুলে শিক্ষকের পদ। ইতিমধ্যে আটটি ভাষা তাঁর শেখা হয়ে গেছে, তার মধ্যে আছে মাদ্রাজ প্রদেশের প্রধান ভাষা তামিল

আর এই ভাষা জানার সূত্রেই তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর আবাল্য শোনা ‘রামায়ণ' কাহিনির এক ভিন্ন ভাষ্য। একই সঙ্গে প্রেমে পড়লেন এক নীল-নয়না তন্বীর। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি সচেতনভাবে বেছে নিয়েছেন কোনও ইউরোপিয় নারীকে, ধর্ম-বর্ণ-জাত-ভাষা সব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। আর এখান থেকেই তিনি বুঝতে পারলেনরামায়ণআসলে একটা চলমান আখ্যান, তার কোনও অচল আয়তন সত্য সত্যিই নেই। কারণ, উত্তর ভারতে প্রচলিত তুলসীদাস বিরচিতরামচরিত মানস’-এ রামের যে স্বরূপ, বিন্ধ্য পর্বতের এপারে এসেই তা পাল্টে যায় অনায়াসে। কারণ, তামিল রামায়ণে নায়ক হলেন রাবণ আর রাম-লক্ষ্মণ নিতান্তই খলনায়ক, তামিল আখ্যানকাররা কোথাও তাঁদের দেবায়িত করেননি। করবেনই বা কেন? ঐতিহাসিকভাবে রামায়ণের গপ্পো আসলে দক্ষিণ ভারতের অনার্য আদিবাসীদের ওপর উত্তর ভারতীয় আর্যরাজাদের আধিপত্যের কাহিনি। এই অনার্যদের এককালে  উত্তর ভারতে তাঁদের আদি বাসভূমি থেকে উৎখাত করেছিল সেই আর্যরাই, তারই যেন ধারাবাহিকতা রামায়ণের চেনা ভাষ্যে। আমাদের পরিচিত এই তরুণটি সবদিক দিয়েইরেবেলতিনি বাংলা ভাষার বদলে ইংরেজিতে মিল্টনের মতো মহাকাব্য লিখতে চান।  আবার তাতে ব্যর্থ হয়ে আক্ষেপ করেন—  আশার ছলনায় তিনি পথ ভুল করেছেন। কিন্তু অন্যরকম একটা কিছু তাঁকে করতেই হবে, যা আগে কেউ করে দেখাননি। ওতেই তাঁর ছটফটে আর দুরন্ত সৃজনশীল মনের প্রশ্রয়। 

আকাশচুম্বী সৃজনপ্রতিভা, নিকষ আবেগ আর ভিন্ন কিছু করে দেখানোর মরিয়া তাগিদ- এই তিনের চকমকি পাথরের স্ফুলিঙ্গ থেকেই লেখা হলমেঘনাদবধ কাব্য’। তখন সেই যুবকের বয়স মাত্রই চল্লিশ থেকে তিন বছর আগে থমকে আছে। আর সেই বছরেই জোড়াসাঁকোর গলিতে পৃথিবীর আলো দেখবেন আরেক অন্যগোত্রের বাঙালি। মেঘনাদ নিধনের উপাখ্যান নিয়ে এই যে নতুন জাতের সাহিত্য, তার ছিল স্পষ্ট তিনটে দিক। বাংলা ভাষার গদ্য যখন অল্পে অল্পে বিকশিত হচ্ছে বিদ্যাসাগর প্রমুখের কলমে, তখন এই  লেখায় ঝলসে উঠল বাংলা ভাষার ব্ল্যাঙ্ক ভার্স; একই সঙ্গে স্পর্ধা দেখানো হল এইভাবে যে, মহাকাব্য কোনও অনড় প্রস্তরখণ্ড নয় যে তাকে সবসময় তার আদিরূপেই বন্দনা করতে হবে। আর, উনিশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ যখনডিরোজিয়ানদের উৎপাতে উদব্যস্ত, রামমোহন-ঈশ্বরচন্দ্রের কুসংস্কার-বিরোধী কর্মসূচিতে জেরবার, তার পাশেই অকুতোভয় এই যুবক লিখে ফেললেনসনাতনরামকাহিনির প্রতিস্পর্ধী এক আগুনে-কাব্য যেখানে ইন্দ্রজিত-জায়া সোচ্চারে বলেন, তিনি রাম নামক ভিখারিকে আদৌ ভয় পান না! অহো কী দুঃসহ স্পর্ধা! কাব্যকার জানতেন, গড়পড়তা বাঙালির ঘরে এতে ছুঁচোবাজি ঢুকে যাবে। গেলও

তবে তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। তিনি তখন প্রাণের আনন্দে লিখতে শুরু করেছেন বাংলা সনেট। কে বলেছে ‘সনেটনামক ইউরোপিয় কবিতার বিশেষ ছাঁচ কেবল ইউরোপের ভাষাতেই লেখা যায়? ওসব প্রাক-সংস্কার হেলায় তুচ্ছ করে দেওয়ার জন্যই তো তিনি সগর্বে পায়চারি করছেন বাংলা সাহিত্যের বারান্দায়। নিত্যনতুন তৈরি হচ্ছে আনকোরা সব লেখা। ইতিমধ্যে আদ্যোপান্ত প্রেমিক যুবার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটবে তাঁর প্রথম প্রণয়িনীর। তবু জীবনের সান্দ্র ছায়াপথে চলতে চলতে তাঁর কেবলই মনে হবে, এ পৃথিবীতে বিলীয়মান আত্মিক শান্তির একমাত্র শুশ্রূষা হতে পারে নারীরাই। এবং তিনি প্রেমে পড়বেন পুনর্বার। প্রেমের সঙ্গে এবার সন্তান। তার সঙ্গে ছেয়ে থাকা আর্থিক অনটন এবং সুরালিপ্সা। স্থায়ী চাকরি নেই, উপার্জন নামমাত্র— তবু বিলাসের দিকে তাঁর ঝোঁক ফিরিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু শেষ অবধি তিনি বিলেত গেলেন এবংবার অ্যাট লহিসেবে নথিভুক্তিও পেলেন। সেটা ১৮৬২। 

কিন্তু তাঁর জীবন যে অন্যরকমভাবে বেঁচে থাকবার জন্যই নির্দিষ্ট। দেশে থাকতে তার আগেই তিনি বাজি ফেলে লিখতে শুরু করেছিলেন বাংলা নাটক। তখন বাংলা নাট্যমঞ্চ ইউরোপিয় আদর্শের ছায়ায় নবীন সাজে সজ্জিত হতে চলেছে। নাট্যগৃহগুলি দাবি করছে নতুন বাংলা নাটক। সেই দাবি মেটানো হবে কী করে ? তৈরি হলশর্মিষ্ঠানাটক এবং অচিরেই তা মঞ্চস্থ হল বেলগাছিয়ার নতুন নাট্য প্রেক্ষাগৃহে। কিছু আড়ষ্টতা তো ছিলই, কারণ, এই নাটকটিও লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষার ব্ল্যাঙ্ক ভার্সে। কেমন হবে তার অভিনয়ের ধরন? তবু তিনি উতরে গেলেন।  কিন্তু থেমে থাকার জন্য তিনি কলম তুলে নেননি। তাই এরপরেও অবিরল স্রোতের মতো নাটকের স্ফূর্ত প্রবাহ সিঞ্চিত করে চলল বাংলার নাট্যসাহিত্য-- 'পদ্মাবতী', 'একেই কি বলে সভ্যতা', 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'। শুধু কি তাই? বাংলায় লেখা নীলদর্পণযখন শাসকের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল, প্রায় দানবীয় ক্ষমতায় এক রাতের মধ্যে তিনি তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিলেন। তাঁর নিজের লেখা নাটকগুলিরও কোনও কোনওটা প্রহসন-সাহিত্যকে নিয়ে গেল তুঙ্গ এক শিল্পিত মহল্লায়। সামাজিক সংস্কারের শেকল তাঁকে কোনওদিনই বেঁধে রাখতে পারেনি, তার মূল্য তিনি চুকিয়েছেন জীবন দিয়ে। কিন্তু কলম হাতেও যে সমকালীন সমাজের তমসার সঙ্গে এমনভাবে অসিযুদ্ধ করা যায়, তার আলো জ্বালালেন তিনিই। পেশাগতভাবে তিনি তখন লালবাজার পুলিশ আদালতের অনুবাদক। ইউরোপিয় বিচারকের কাছে আইনি সওয়াল পৌঁছে দেন তাদেরই ভাষায়। এই অনুবাদকের ভূমিকা পরে তাঁকে প্রাণিত করবেইলিয়াডমহাকাব্যের তর্জমায় আর জীবদ্দশায় অসম্পূর্ণ সেই পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাবে কোন গলিপথে। 

কিন্তু বিস্ময় এটাই, যে বছরমেঘনাদবধ কাব্যবাংলা সাহিত্যকে তোলপাড় করে তুলবে, ওই একই বছর পরপর প্রকাশ পাবেতিলোত্তমা-সম্ভব’, ‘ব্রজাঙ্গনাবীরাঙ্গনাকাব্য— প্রতিভা যাকে স্পর্শ করে তাকেই সোনা করে তোলে-- বাংলা সাহিত্যের একেকটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই যুবক বিলেতে পৌঁছে মোহমুক্ত হয়েছিলেন তার আবাল্য-চর্চিত ইউরোপিয় সংস্কৃতি বিষয়ে। দেনার দায়ে জর্জরিত তিনি চলে আসেন ভার্সাই নগরে। তার পরে শুধুই অনটন, যন্ত্রণা, কষ্ট— চোখের সামনে পরিবারের অনাহার, রোগ, দারিদ্র। কোনও কোনও প্রতিভার জন্মই হয় এরকম ধূমকেতুর মতো দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য। দেশে ফেরার অর্থ ছিল না তাঁর। সহৃদয় বিদ্যাসাগর তাঁকে ফিরিয়ে আনেন কলকাতায়। জীবনের পঞ্চাশটা বসন্তও দেখে যেতে পারেননি। মেডিক্যাল কলেজের এক বিবর্ণ শয্যায় নিভে আসে তারকার আলো। শোনা যায়, শেষ শয্যায় শুয়েও তিনি নাকি অবিরল শেক্সপিয়ার আওড়াতেন। 

তারকার আলো কি অত সহজে ফুরিয়ে আসে? প্রতিটি কবিরই নতুন জন্ম হয় তাঁর শারীরিক অবসানের পর। তাঁরও। আর সময়ের একেক কালখণ্ডে ঝলসে ওঠে তাঁর লেখনির আলো। আজ যখনরামনামের প্রকান্ড এক অন্ধকার আমাদের টেনে নিতে চাইছে প্রবল নিঃসংবেদন এক যক্ষপুরীর ভিতর, তখন তাঁরমেঘনাদবধ কাব্যনতুন বাতিঘর হয়ে স্থির করে দিতে পারে আমাদের বাঁচার অভিমুখ। সামাজিক অসাম্য আর তামসিকতার ক্ষয়চিহ্নগুলিকে যখন চেনানো হচ্ছে ঐতিহ্যের ইঙ্গিত হিসেবে তখন মনে পড়ে তাঁর প্রহসনের সুতীব্র কষাঘাত, চাবুকের শপাং শপাং শব্দ। সাহিত্যের কাজ শুধু অনুসরণ নয়, কখনও কখনও প্রশ্ন করা। নতুন চোখ দিয়ে পুরনোর দিকে তাকানোটাও জেগে থাকার মতো একটা ধর্ম। মাত্র উনপঞ্চাশ বছরের পরিসীমায় এতদূর অবধি আলো জ্বালতে জ্বালতে পথ হেঁটেছেন তিনি। 

সবে তাঁর দুশো বছর হল। নক্ষত্রদের আয়ু ঢের ঢের বেশি। জীবনের উপান্তে এসে জোড়াসাঁকোর সেই আশ্চর্য বৃদ্ধ চিন দেশে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাঙালিকে তার জীবনের সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায় আবেগে যন্ত্রণায় তাঁর গান গাইতেই হবে। এতটাই জোর সে গানে। ওই অভিভাষণের একদম শেষ বাক্য ছিল: this too is the work of a revolutionist (এইটাও একটা বিপ্লবীর কাজ)। দুশো বছর পেরনো অন্যরকম বাঙালিটিও তার জীবনে ও কালির আঁচড়ে লিখে গেছেন বিপ্লবের অনন্ত ম্যানিফেস্টো। এই শহর কলকাতায় যে সব বাসায় তাঁর বিবর্ণ দিন কেটেছে তার সবটাই কালের জরায়ুতে হারিয়ে গেছে, তার পৈতৃক বসতভিটেটুকুও আজ বেহাত। তবু তাতে কিছু আসে যায় না। লোয়ার সারকুলার রোডের কবরখানায় সাড়ে তিনহাত ভূমিতে তিনি শায়িত থাকলেও তাঁর প্রোজ্জ্বল পদচারণা আজও বাংলা ভাষার অলিন্দে, ঝরোখায়। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। 

 

Sunday, 28 January 2024

পালটুরামের এত গুরুত্ব কেন!

‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

২০২২ সালের মাঝামাঝি যখন খ্যাতমান ‘পালটুরাম’ এনডিএ ছেড়ে মহাগঠবন্ধনে সামিল হয়েছিলেন, তখন তাঁকে যারা নিয়েছিলেন তাঁদের দিক থেকে কেউ প্রশ্ন তোলেননি যে, পালটুরাম আবারও যে সঙ্গ ও সঙ্গী ত্যাগ করবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে কী? অবশ্য, উল্টোদিকে দিকে সে সময় অমিত শাহ, পালটুরামের আবারও ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা আঁচ করে সদম্ভে বলেছিলেন, পালটুরামের জন্য তাঁদের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ; আবার পালটুরামও হেসে হেসে জানিয়েছিলেন, মাটিতে মিশে যাব, তবু বিজেপি’র কাছে আর যাব না। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক নেতাদের কথা যে এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিতে হয়, তা দেশের অধিকাংশ মানুষ ভালই জানেন।

কিন্তু কথাটা ঠিক সেখানে নয়। প্রশ্নটা, যে রাম মন্দিরের হুজুগ তুলে সরকারি প্রশাসন ও গোদি মিডিয়ার ব্যান্ড সহযোগে দেশ জুড়ে তুমুল শোরগোল তৈরি করা হল এই ভেবে যে, রামচন্দ্র’ই মোদিজীকে নিশ্চিন্তে ২০২৪ পার করিয়ে দেবেন, তারপরেও এত সংশয় কেন? ঘোষণা মতে তাদের তো ‘অবকী বার ৪০০ পার’ হওয়ার কথা। কিন্তু মনে সোয়াস্তি বা বিশ্বাস এত টলায়মান যে নীতিশকুমারের মতো ফুরিয়ে আসা এক অকিঞ্চিৎকর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পিছনে তারা ঝুলে পড়লেন! ২০২০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনেই বোঝা গিয়েছিল, নীতিশকুমারের দল ৪৫টি আসন জোটাতেই পারত না যদি না বিজেপি’র সঙ্গে হাত মেলাত। অর্থাৎ, অন্য কোনও দলের সাহায্য ছাড়া পালটুরামের জেডি(ইউ) বর্তমান বিহার রাজনীতিতে যে একটি প্রান্তিক শক্তি, তা বুঝেও মোদি-শাহ’রা কেন তাঁকে এত গুরুত্ব দিলেন? এই জিজ্ঞাসা থেকেই শুরু হতে পারে, ২০২৪’এর মহারণের কিছু চমকপ্রদ ইতিকথা।

তার আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত, আমরা যতই নির্বাচনী রাজনীতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি না কেন, অথবা, আমজনতাকে ‘ভেড়ুয়া’ ভেবে নিজ নিজ কুযুক্তিগুলিকে প্রশ্রয় দিই, আদপে আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র তার হাজারও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিন্তু দিনে দিনে রাজনৈতিক দলগুলির মুখের ওপর এক সপাটে চপেটাঘাতের মতো পরিপক্ক হয়ে উঠেছে এবং নেতা-মন্ত্রী-রাজনৈতিক দলসমূহের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রেখেছে। ২০১৮ সালে দেশে মোদি হাওয়া যখন আরও বেশি পাকছে, তখনই কিন্তু রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় আরোহন করেছিল। ২০১৯’এ লোকসভায় বিজেপি’র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরেও কিন্তু ২০২০ সালে বিহারে কোনওরকমে সামান্য দুটি আসন বেশি পেয়ে এনডিএ ক্ষমতা লাভ করে এবং দিল্লি বিধানসভা ও সেখানকার তিনটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ ভালমতোই পরাজিত হয়। কিছুকাল আগে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র শোচনীয় পরাজয় আরও একবার জানান দেয় যে, ইভিএমের গালগপ্পো নয়, মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-প্রতিক্রিয়াতেই এক পক্ষ জিতছে, অপর পক্ষ হারছে।

সমস্যা হল, জনতার আঙুলের এই ক্ষমতার তাৎপর্যকে বিজেপি-আরএসএস’এর পাকা মাথা যতটা অনুধাবন করেছে, বিরোধী পক্ষ সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আর সে জন্যই ‘নিভে আসা’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পালটুরাম’কে খাতির করতে বিজেপি কসুরের কোনও বাকী রাখেনি। কারণ, তারা জানে, রামের লহর তৈরি করা গেলেও ভোটের বাক্সে তা রাশি রাশি ‘পদ্ম’ চিহ্ন হয়ে জমা পড়বে না, কারণ, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মাশ্রয়ী হলেও ধর্ম-পুজোপাঠ-বিশ্বাস থেকে রাজনীতি-অর্থনীতিকে আলাদা করতে জানেন। তাঁদের একটা অংশ মোদি বা বিজেপি’কে বেশি ভোট দিচ্ছেন রামের নামে নয়, দেশের বিকাশের পক্ষে মোদি ভাল কাজ করছেন, এটা ভেবে। এটা আবার বিরোধীদের একটা অংশ, যারা নিজেদের ভুলত্রুটি দেখতে পায় না, বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু ঘটনা হল, বিজেপি’র এখন পাখির চোখ মূলত ছ’টি রাজ্য (বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, দিল্লি ও পঞ্জাব) যেখানে লোকসভা নির্বাচনে তাদের অন্তত ৬০-৭০টি আসন কমে যেতে পারে বলে তারাও আশঙ্কিত এবং যদি তা হয়, তা হলে বিজেপি’র মোট আসন ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচনে ২৪০’এর নিচে নেমে যাবে। মধ্য ভারত, উত্তর ভারত ও গুজরাতে বিজেপি ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ আসন পাওয়ার স্তরে চলে গিয়েছে- গতবারের থেকে আর বেশি কিছু পাওয়ার নেই, বরং হারালে বাড়তি ক্ষতি; উপরন্তু, দক্ষিণ ভারতে তাদের প্রায়-শূন্য হাতেই ফিরতে হবে ও উত্তর-পূর্ব ভারতেও (মোট ২৫টি আসন) প্রবল ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা, অতএব, ওই ছ’টি রাজ্যেই (মোট আসন ১৭৬) বিজেপিকে কামাল করতে হবে, নয়তো ফক্কা। আর এখানেই যত ঘোঁটের উৎস।

এই ছ’টি রাজ্যের মধ্যে বিহারের গুরুত্ব সব থেকে বেশি, কারণ, ২০১৯ সালে ৪০টি আসনের মধ্যে এনডিএ ৩৯টি পেয়েছিল। তা সম্ভব হয়েছিল বিজেপি ও জেডি(ইউ) একসঙ্গে লড়ার জন্য যেখানে বিরোধী তিন শক্তি- আরজেডি-কংগ্রেস-বাম আলাদা আলাদা লড়েছিল। এবারে যেহেতু বিরোধীদের মহাগঠবন্ধন হয়েছে- যার অনেকটা সুফল বিধানসভা নির্বাচন থেকেও পাওয়া গেছে- সেখানে যদি পালটুরামের দলও ভিড়ে থাকে, তাহলে বিজেপি’র পক্ষে তা সমূহ বিপদ এবং গতবারের ৩৯টি আসন নেমে ১০’এর নিচে চলে যেতে পারে বলে প্রাথমিক অনুমান। ফলে, তড়িঘড়ি ‘অপারেশন লোটাস’এর আয়োজন। যেহেতু বিহারের সমাজ-রাজনীতিতে ছোটবড় বহু দলের ১-২ শতাংশ ভোটও নির্বাচনী ফলাফলকে এদিক-ওদিক করে দিতে পারে, তাই অকিঞ্চিৎকর ও নিভন্ত শক্তি হলেও বিজেপি পাল্টুরামকে সঙ্গে নিয়েই লড়াইয়ে ফিরে আসতে চেয়েছে। তারপর জঞ্জালের মাল জঞ্জালে ফেলে বিজেপি’ও তার হাত ধুয়ে ফেলবে কিন্তু নিজ শক্তিকে কীভাবে প্রসারিত করা যায় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই।

বাকী রইল মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, পশ্চিমবাংলা, দিল্লি ও পঞ্জাব। ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে শিবসেনা ও বিজেপি মিলে মহারাষ্ট্রে ৪৮’টার মধ্যে ৪১’টা আসনে (বিজেপি: ২৩ ও শিবসেনা: ১৮) জয়লাভ করে। এবারে শিবসেনার মূল বা আদি অংশ বিজেপি’র সঙ্গে নেই। তারা বরং কংগ্রেস-এনসিপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ। ফলে, এবারে বিজেপি’র আসন ২০’র নিচে আটকে যাবে বলে অনুমান। কর্নাটকে ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে ২৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ২৬টি এবং কংগ্রেস ও জেডি(এস) ১টি করে। তখন রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপি সরকার- সেই চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার যার বিরুদ্ধে গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘৪০% কমিশন কা সরকার’ বলে আওয়াজ ওঠে এবং ফলত শোচনীয় পরাজয়। এবার নিশ্চিত, গতবারের আসন বিজেপি তো পাবেই না, বরং ১০’এর কোটা পেরতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। পশ্চিমবঙ্গে অন্তঃকলহে দীর্ণ, সাংগঠনিক ভাবে ছন্নছাড়া ও অর্ধ-পাগল বিরোধী দলনেতা (যিনি চোখ পাকিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত শত্রুতা ভিন্ন আর কিছুই প্রকাশ করতে পারেন না) সহযোগে বিজেপি কি আদৌ ৪২টি আসনের মধ্যে ৪-৫টির বেশি পাবে? পঞ্জাবে ১৩টি আসনের মধ্যে ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে অকালি দল ও বিজেপি পেয়েছিল ২টি করে আসন, যেখানে কংগ্রেসের ছিল ৮টি ও আপ’এর ১টি। অকালি দল আর বিজেপি’র সঙ্গে নেই এবং রাজ্য নির্বাচনে আপ’এর বিপুল জয় আগামী ফলাফলকে বিরোধীদের দিকেই ঠেলবে বলে অনুমান। দিল্লিতেও ২০১৯’এ ৭’এর মধ্যে বিজেপি’র জেতা ৭টি আসন যে আর ধরে রাখা যাবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। ফলে, উল্লিখিত এই প্রতিটি রাজ্যে বিজেপি-আরএসএস’কে নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হবে, যার শুরুয়াত তারা বিহার থেকে করল। এই ঝুঁকিপূর্ণ খেলা আত্মঘাতী হবে কিনা তা সময়ই বলতে পারবে।

কিন্তু এরপরেও আরও একটি কথা থাকে।

‘ইন্ডিয়া’ নামক যে জোটটি সর্বভারতীয় স্তরে তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে তার শরিকেরা কে কতটা আন্তরিক ও দায়বদ্ধ যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের ভূমিকা বড়ই অদ্ভুত। তাদের শীর্ষ নেতা কে? মল্লিকার্জুন খাড়্গে না রাহুল গান্ধী- এ নিয়ে কোনও পরিষ্কার অবস্থান নেই। রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে একপ্রকার অবজ্ঞা করে একা লড়তে গিয়ে নিজেদের মুখ পুড়িয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলি যারা একেকটি রাজ্যে ক্ষমতায় তাদের অনেকেই নিজেদের ‘শাহেনশাহ’ বলে মনে করে। এইগুলি যে জনতার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তার ফল যে অনেক সময়ে উলটো হয়ে যায়, তা আমরা বহুবার দেখেছি। গত লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে বিজেপি’র ১৮টা আসন পাওয়া যতটা না তাদের নিজেদের কৃতিত্ব তার থেকেও বেশি ছিল রাজ্যের শাসকের প্রতি মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া।  

তবুও আশঙ্কার কথা এই, এক চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের দিকে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে ‘এক দেবতা, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক রাজা’ শাসিত দেশ হবে আমাদের ‘রামরাজ্য’। যদি সেই দিকনির্দেশকে বদলাতে হয়, তাহলে যারা বিরোধী শিবিরে দাঁড়িয়ে আপাতদৃষ্টিতে এই আগত ভয়ঙ্কর সময়কে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন, তাঁদেরও সমান ভাবে নিজেদের আচার-আচরণে, কার্যসূচিতে, জনতার সঙ্গে দৈনন্দিন সংযোগসূত্রে গণতন্ত্র, পরিষেবা, ন্যায়বিচার ও আলাপচারিতার প্রসঙ্গকে যথাসম্ভব সুনিশ্চিত করতে হবে, যার ভিত্তিতে মানুষের আস্থা তৈরি হতে পারে; তবেই অন্ধ-বিশ্বাসকে রোখা যাবে। কথায় বলে, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’। আগামী প্রতিটি দিনই তাই নিজেদের রূপান্তর ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার কঠিন লড়াই। নিছক অবিরাম তীর বর্ষণে মতান্ধতা (বা ধর্মান্ধতা) বিদ্ধ হবে না।

               

Thursday, 25 January 2024

বঙ্গে INDIA জোট!

মাথাব্যথাটা কার?

কল্যাণ সেনগুপ্ত



এ কথা অনস্বীকার্য যে, ২০২১'এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিজেপিকে পরাজয়ের গ্লানিতে নিমজ্জিত করাতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৬'র নির্বাচনেও বিজেপি হেরেছিল তবে তার প্রতিক্রিয়া এতখানি হৃদয় বিদারক ছিল না। ২০২১'এ ছিল, মোদী শাহের ২০০ আসন জেতার লক্ষ্যে 'হা রে রে হুংকারে' মেদিনী কাঁপিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার পরেও চূড়ান্ত ভাবেই লজ্জাজনক হার। অথচ, এখন কিছু বিশিষ্ট মানুষ বিজেপি বা মোদীকে হারানোর কথা না বলে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! কিন্তু, সিপিএম-কংগ্রেসের মতো মোদী বিরোধীদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও কি প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? নাকি তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত? রাজ্যের মানুষ কিন্তু তাদের সম্মিলিত শক্তিকে স্রেফ শূন্যে নামিয়ে এনেছে। সুতরাং, এ রাজ্যে কোন মানুষজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তা কি পরিষ্কার করে বলা সম্ভব? মনে হয় না।

আসলে, যাঁরা এসব প্রশ্ন তুলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মোদী বিরোধী লড়াইটাকেই দুর্বল করছেন, তাঁরা আসলে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন 'হুইজপারিং ক্যাম্পেনিং'এর টার্গেট হতে ভয় পান এবং সযত্নে এমন এক প্রতিচ্ছবি গড়ে তুলতে চান, যাতে তাঁকে কোনওভাবেই রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে দূর-দূরান্তেও কোনও সম্পর্ক আছে বলে দাগানো না যায়। অবশ্য এটা দোষের নয়, কারণ, এমন নেতিবাচক প্রচারকে কে না ভয় পায়? এই ক্যাম্পেনাররা একসময় অতুল্য ঘোষ ও প্রফুল্ল সেনকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্টিফেন হাউজের মালিক বলে দেগে দিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীকে ডাইনি বানিয়ে দেয়াল ভরানো এবং রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফর্স ঘুষ কাণ্ডের অভিযোগে দীর্ঘকাল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিয়ে মিটিং মিছিল করেছে - 'গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়'। অথচ এরাই এখন রাজীব জায়া ও পুত্রের দাক্ষিণ্য লাভে মরীয়া হয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখছে। আবার ভবিষ্যতে মমতার সঙ্গেও সম্পর্ক এমনটাই যে হবে না, কে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারে?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, কোনও কোনও যুগ সন্ধিক্ষণে দেশকে বাঁচানোর লক্ষ্যে বড় লড়াইকালে প্রধান শত্রুকে চিহ্নিত করে সমস্ত অন্তর্বিরোধ ভুলে ছোট বড় সব শক্তিকে একজোট হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হয়; তবেই প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন শত্রুকে পরাস্ত করা সম্ভব। অতীতের সমস্ত বড় ঐতিহাসিক লড়াই এভাবেই জয়যুক্ত হয়েছে। এবারের মোদী বিরোধী লড়াইয়েও সবাই জোটবদ্ধ হয়েছে। তাহলে, এ রাজ্যে সিপিএম'এর গলায় অন্য সুর কেন? কারণ, এর পেছনে আছে তাদের নিজস্ব দলীয় এজেন্ডা- যে কোনও মূল্যে তৃণমূলকে যথাসম্ভব শক্তিহীন করে বিজেপিকে শক্তিশালী রাখা, যাতে তৃণমূল যথেষ্ট চাপে থাকে। একদিকে সিপিএম ইন্ডিয়া জোটে থেকে কেরল ও বাংলার বাইরে অন্যত্র যাতে দু-একটি আসন পাওয়া যায় সেই আশায় থাকবে, আবার অপরদিকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে বাংলায় বিজেপিকে শক্তিশালী করতে চাওয়ার মতো দ্বিচারিতা করে পার পাওয়ার চেষ্টা করবে! এ রাজ্যের মানুষ কিন্তু বোকা নন।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো অভিযোগ হচ্ছে দুর্নীতির। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতিকে সম্পূর্ণ পরিহার করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, ধোয়া তুলসিপাতা কোনও দলই নয়। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, অত্যন্ত সফল ও সম্মাননীয় জওহরলাল নেহরুর সময়কালেই দুর্নীতির অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ ওঠে ও বিভিন্ন সময়ে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। 

আর বিজেপির দুর্নীতি বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল। প্রথমত, তারা বিরোধী দলের সেইসব নেতাদেরই নিজেদের দলে নিয়েছে যারা দুর্নীতির রাঘব-বোয়াল বলে অভিযুক্ত; দ্বিতীয়ত, বিজেপি দলে একবার ঢুকে গেলে তদন্তেরও ইতি এবং বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই কাউকেই আর পাওয়া যায় না। সিপিএম জমানায় ঐ দলের কোষাধ্যক্ষ খুন হয়ে গেলেন অথচ সেই খুনের কিনারা হল না। কেন? উত্তর নেই। একবার দুর্গাপুরের এক সভায় কয়লা মাফিয়া কালো সিং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে ত্রাণ তহবিলের জন্য কয়েক লক্ষ টাকার চেক তুলে দিলেন এবং খবরের কাগজেও সে ছবি বেরল। সে জমানাতেও কয়লা, বালি, গরু ইত্যাদি পাচার ছিল। সর্বত্র শিক্ষক নিয়োগ কি আইনানুগ ছিল? তবে সিপিএম জমানায় যেহেতু খুন, জখম, গণহত্যা, রক্তপাত, অত্যাচার ছিল এক ভয়াবহ আতঙ্কের, তাই দুর্নীতি নিয়ে বিশেষ শোরগোল ছিল না।

তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে এত শোরগোলের অন্যতম কারণ ২০২১'এ বিজেপির পরাজয়। ২০১৬'তেও সারদা, নারদা নিয়ে বেশ খানিক হৈ চৈ হয়েছিল, অনেকেই জেল খেটেছিল ও পরে জামিন পেয়ে গেছে, কিন্তু সে সব কেসের কোনও ফয়সালা হয়নি আজও। ২০১৯'এর ভোটে বিজেপি ভালো ফল করল ১৮টি আসন পেয়ে। ফলে, তখনও কোনও দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু এখন দুর্নীতিকে মূল হাতিয়ার করা হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপির প্রধান শত্রু তৃণমূলকে ঘায়েল করতেই। ফলে, বিজেপি তো বটেই, সঙ্গে অপর দুই সঙ্গী সিপিএম, কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের এজেন্সি ইডি, সিবিআই ইত্যাদি সহযোগে গোদি মিডিয়া ও বিচার ব্যবস্থার এক শক্তিশালী অংশ একযোগে এমন শোরগোল তুলতে সমর্থ হয়েছে যে মনে হবে, গোটা দেশে তৃণমূলই সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কি তাই? 'ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল' নামক একটি বিশ্বখ্যাত সংস্থার সর্বশেষ ২০১৯'এর সার্ভে রিপোর্ট বলছে, ভারতে দুর্নীতির রাজ্যওয়ারি তুলনায় ছোট-বড় ২০টি রাজ্যের মধ্যে বাংলার স্থান ১৭তম, অর্থাৎ, তালিকার বেশ নিচের দিকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দশচক্রে এ রাজ্য ভূত বনে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে যেহেতু মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল, তাই বারবার তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কারণ, সিপিএম বলছে, মমতা-মোদীর সেটিং আছে এবং তৃণমূল এমন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল যে, দুর্নীতির প্রশ্নে ভূ-ভারতে তার ধারে কাছে কেউ নেই, উপরন্তু, গণতন্ত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপির বিশেষ তফাত নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব, যতদিন সিপিএম অথবা সিপিএম-কংগ্রেস জুটি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করতে সক্ষম না হচ্ছে, ততদিন বিজেপি নিশ্চিন্তে থাক। কারণ, সিপিএম বা কংগ্রেসের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। অতএব, যাঁরা বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা কি প্রকৃতই ২০২৪'এ বিজেপির পরাজয় চান? এমন একটি প্রশ্ন কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে ওঠাটাই স্বাভাবিক।


Thursday, 18 January 2024

রামের নামে বজ্জাতি!

রামচন্দ্র যখন রাজনীতির গুটি

সোমনাথ গুহ



সংবাদপত্র পড়লে ও গোদি মিডিয়া দেখলে মনে হবে, সারা দেশ রাম-জ্বরে থরহরি কম্পমান। মনে হবে, আমরা যেন কোনও গণতন্ত্রে নয়, ধর্মতন্ত্র বা থিওক্রেসিতে বসবাস করছি। জানা যাচ্ছে, অযোধ্যার রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপচার পালনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশেষ ব্রত পালন শুরু করে দিয়েছেন। ধর্ম আর রাজনীতি একেবারে হাত ধরাধরি করে চলছে, যেন একে অন্যের পরিপূরক; আরও সঠিক ভাবে বললে, হিন্দুত্বের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনীতির অনুশীলন চলছে। 

সংঘ পরিবার কিন্তু এ নিয়ে কোনও রাখঢাক করছে না। শুরু থেকেই অযোধ্যার রামমন্দির তাঁদের কাছে একটা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ২২ তারিখে ঘরে ঘরে 'রাম জ্যোতি' প্রজ্জ্বলন করে দীপাবলী উদযাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশ সরকার ১৪ থেকে ২২ জানুয়ারি রাম ভজন এবং সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত করার জন্য সমস্ত জেলা কর্তৃপক্ষ এবং গ্রামের সরপঞ্চদের নির্দেশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ২২ তারিখ সরকারি কর্মচারীদের জন্য অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে। বছরের প্রথম পনের দিনে প্রধানমন্ত্রী রামরাজ্যের তথাকথিত সুশাসনের বার্তা নিয়ে এমন তিনটি রাজ্যে সফর করেছেন (অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা) এবং মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়েছেন, যেখানে ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দলের প্রাপ্তি ছিল শূন্য। দক্ষিণের এই তিনটি রাজ্যে নির্বাচনে খাতা খোলাকে তিনি পাখির চোখ করেছেন। এমনও শোনা যাচ্ছে যে সেই লক্ষ্যে তিনি এখানের কোনও এক কেন্দ্র থেকে নিজে প্রার্থী হতে পারেন। অযোধ্যায় রামমন্দিরের চূড়ায় গেরুয়া পতপত করে উড়ছে, দেশ জুড়ে নির্বাচনের ডঙ্কাও বাজতে শুরু করেছে। 

২০১৩ সালের অগস্ট-সেপ্টেম্বরে মুজাফফরনগর দাঙ্গা হয়েছিল। ওই একই সময়ে ইন্দোর, শিলচর, জম্মু, নওদাতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে জুন মাসে নীতিশ কুমার এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিহারে ছটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কয়েক মাস বাদে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মোট আসন সংখ্যা ১১৬ থেকে লাফিয়ে ২৮২ হয়, শুধু উত্তরপ্রদেশেই এক লাফে ১০ থেকে বেড়ে হয় ৭১। ২০১৯'এর ফেব্রুয়ারিতে, লোকসভা নির্বাচনের মাত্র দু' মাস আগে পুলওয়ামাতে চল্লিশ জন জওয়ান আত্মঘাতী হানায় নিহত হন। জানুয়ারি মাসের ওপিনিয়ন পোল অনুযায়ী বিজেপির আসন সংখ্যা দেখাচ্ছিল ২২৫-২৫২, কংগ্রেসের ১৪৭-১৬৭। নির্বাচনে বিজেপি ৩০৩ আসন পেয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হয়, কংগ্রেস পায় সর্বসাকুল্যে ৫২। নিন্দুকেরা বলেন, ২০১৩'র দাঙ্গা এবং পুলওয়ামার ঘটনা বিজেপিকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে সাহায্য করেছিল, এমনকি সেইসব ঘটনায় নাকি কিছু কারসাজিও ছিল! 

বত্রিশ বছর আগের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। সবার ধারণা ছিল যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণে মেরুকরণের ফলে বিজেপি ১৯৯৩'র নির্বাচনে অনায়াসে ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ওই নির্বাচনে বিজেপির আসন কমে ২২১ থেকে ১৭৭ হয়েছিল। মুলায়ম সিং যাদব- যাঁকে সংঘ পরিবার করসেবকদের নৈরাজ্য রোখবার জন্য ‘মোল্লা মুলায়ম’ আখ্যা দিয়েছিল- তিনিই কিন্তু কম সিট পেয়েও মায়াবতীর সাথে জোট করে লখনউয়ের মসনদে আসীন হয়েছিলেন।    

তবে নিশ্চিত ভাবেই আজকের বিজেপি তিন দশক আগের বাজপেয়ী-আদবানির পার্টির চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তি-কেন্দ্রিক এবং সেই কারণেই হয়তো আরও সংগঠিত, আবেগ বা ভক্তি-উদ্রেককারী, মনোনিবেশিত বা ফোকাসড্‌। প্রশ্ন হল, অযোধ্যার রামমন্দিরকে ঘিরে তৈরি করা আবেগ, তথাকথিত জনজাগরণ কি বিজেপিকে আবার ক্ষমতায় আসীন হতে সাহায্য করবে? পক্ষে বিপক্ষের যুক্তিগুলো যাচাই করে দেখা যেতে পারে। 

এটা সর্বজনবিদিত যে চারজন শঙ্করাচার্য বিভিন্ন কারণে মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না। বিজেপির আইটি সেল যথারীতি এঁদের কংগ্রেস সমর্থক, মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল ইত্যাদি গালমন্দ করেছে। এই সন্তদের বিরোধিতা মূলত ধর্মীয় কারণে, যা ২২ তারিখের পরে ধামাচাপা পড়ে যাবে এবং নির্বাচনে হয়তো সেভাবে কোনও প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, সংঘ পরিবারের মধ্যে সন্তর্পণে ও প্রায় অজান্তে একটি চরমপন্থী অংশ গড়ে উঠেছে যারা খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং মোহন ভাগবতকে নরম হিন্দুত্ব অনুশীলন করার জন্য অভিযুক্ত করছে। তারা ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ শ্লোগানে বিশ্বাস করে না, পসমিন্দা মুসলমানদের কাছে টানার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে না। মোহন ভাগবত যখন বলেন, ভারতে মুসলিমরা সুরক্ষিত বা সংরক্ষণ আরও ২০০ বছর চালু থাকা উচিত, কারণ, নিম্নবর্ণের মানুষেরা ২০০০ বছর ধরে নিপীড়িত হয়েছেন, তখন তারা তা সমর্থন করে না। তারা রামমন্দির গড়ে তোলার জন্য মুসলিমদের থেকে কোনও ধরনের সাহায্য নেওয়ারও চরম বিরোধী। আগামী দিনে এদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা জরুরি। 

বিজেপির পক্ষে আছে ২০১৯ এবং ২০২৩ সালে নটি রাজ্যের নির্বাচনী পাটিগণিত। ২০১৯'এ এগারোটি রাজ্যে প্রায় একাধিপত্যের কারণে তারা ২০৮টি আসনে জিতেছিল। গত বছরে নটি বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর-পূর্বের সহযোগী দলগুলির সাথে তারা সাতটি রাজ্যে হেলায় জয়লাভ করেছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে একমাত্র কর্নাটকে তাদের আসন সংখ্যা ২৫ থেকে কমে ১০-১৫তে নেমে আসতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পশ্চিমবাংলা, বিহার এবং মহারাষ্ট্র, যেখানে ২০১৯'এ তারা ৭৬টি আসন পেয়েছিল। এখানে যদি তাদের আটকে দেওয়া যায় তাহলে বিজেপি বৃহত্তম দল হলেও তাদের ২২৫-২৩০ এর মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব।  

এছাড়া বিজেপির পক্ষে আছে ‘মোদী গ্যারান্টি’ নামে জনকল্যাণকর প্রতিশ্রুতির এক তালিকা, যা কয়েক মাস আগেও প্রধানমন্ত্রী নিজেই রেউড়ি বলে ব্যঙ্গ করতেন। কর্নাটকে কংগ্রেসের গ্যারান্টির ঠেলায় তিনি নিজেই এখন জনকল্যাণমূলক, অনেকের মতে 'দান-খয়রাতির' রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন। শুধুমাত্র অযোধ্যার উন্নয়নের জন্য ১৫,০০০ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই বরাদ্দ হয়ে গেছে। পিভিটিজি'দের (পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ) জন্য আবাস যোজনার প্রথম কিস্তি ৫৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। জনজাতিদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু করার ফলে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের নির্বাচনে বিজেপি উপকৃত হয়েছে। এ তো শুরু মাত্র। আসন্ন বাজেটে নিশ্চিত ভাবেই আরও অনেক রেউড়ি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। এছাড়া শাসক দল হওয়ার সুবাদে তাদের হাতে অনেক লুকানো তাস আছে। মথুরার শাহী ইদ্গাহ ও জ্ঞানব্যাপী মসজিদ নিয়ে আদালতে বিবাদ প্রায় রোজ খবরে আসছে। যানবাহন চলাচলে অসুবিধার অজুহাত তুলে দিল্লির ঐতিহ্যশালী সুনেহরি বাগ মসজিদকে স্থানান্তরিত করার চক্রান্ত চলছে। রাতারাতি এগুলো ইস্যু হয়ে যেতে পারে। কাশ্মীরে কোনও জঙ্গি আক্রমণও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব করে আবার শাসক দলের পক্ষে একটা উগ্র ধর্মীয় অথবা জাতীয়তাবাদী হাওয়া তৈরি করার চেষ্টা হতে পারে। 

হাজারও দুর্বলতা নিয়েও বিজেপির বিপক্ষে আছে ইন্ডিয়া জোট। সম্প্রতি আসন বন্টন নিয়ে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। আপ দিল্লি এবং পাঞ্জাবে কংগ্রেসকে যথাক্রমে তিনটি ও ছটি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে। পরিবর্তে তারা গুজরাট ও গোয়ায় একটি করে ও হরিয়ানায় তিনটি আসন চেয়েছে। বিহারে পুনরায় মহাগাঠবন্ধন হবে, মহারাষ্ট্র এমনকি বাংলাতেও ইন্ডিয়া জোট কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কর্নাটকের ভোটে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। আশা করা যায়, মণিপুর থেকে মুম্বাই যাত্রাও একই ভাবে জোটের পক্ষে একটা অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করবে। এছাড়া 'রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি’, ‘ভারতীয় ট্রাইবাল পার্টি’ ইত্যাদি ছোট ছোট দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে মধ্য ভারতে বিজেপিকে মোকাবিলা করা সম্ভব। 

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার ঘটনা ভারতের রাজনীতিতে একটা মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ধর্মীয়করণ বা আরও সঠিক ভাবে বললে হিন্দুত্বায়ন ঘটেছে। এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলার কথাটা একটা 'অপশব্দ' হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। জহরলাল নেহরু রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে সোমনাথ মন্দিরে উপস্থিত না থাকতে বলে ঠিকই করেছিলেন, মন্দিরের প্রধান যজমান হওয়া কোনও প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়। এক সময়ের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি এখন নিজেদের সেক্যুলার বলতে দ্বিধা বোধ করে। তারা হীনম্মন্যতায় ভুগছে। রামমন্দির সম্পর্কে তারা প্রায় সবাই রক্ষণাত্মক, এমনকি কম্যুনিস্ট নেতাও দৃপ্ত কোনও উত্তর দিতে পারছেন না, আত্মা-পরমাত্মা বলে খেই হারিয়ে ফেলছেন। 

নিশ্চয়ই রাম, রামচন্দ্র, মর্যাদা পুরুষোত্তম আমাদের প্রিয় মহাকাব্যের এক প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, কিন্তু কঠোর কঠিন, বাস্তব রাজনীতির ময়দানে তিনি অপ্রাসঙ্গিক। সংঘ পরিবার ২২ জানুয়ারিকে হিন্দু রাষ্ট্রের উদ্ঘাটনের দিন হিসাবে, ভারতের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দিন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। এর বিপরীতে বহু বাম ও গণতান্ত্রিক দল ও গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে ‘গণতন্ত্র জিতবেই’ শ্লোগান তুলেছে। একই দিনে কলকাতায় অমর্ত্য সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী মহাসম্মেলন।  আমাদের জোর গলায় রাজনীতিকে হিন্দুত্ব-মুক্ত ও ধর্ম-মুক্ত করার দাবি তুলতে হবে, হিন্দু রাষ্ট্রের বিপরীতে সংবিধানের প্রস্তাব মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে।


Saturday, 13 January 2024

শেষ 'মোহিকান'দের একজন

‘উনকা স্বর মে খোদা কা তাসির হ্যায়’

অম্লান চক্রবর্তী


(১ জুলাই ১৯৬৮ - ৯ জানুয়ারি ২০২৪)


৯ জানুয়ারি কোনও অজানা কারণেই দিন শুরু করেছিলাম উস্তাদের গলায় 'ভাটিয়ার' শুনে। শীতের সকালে কুয়াশায় মিশে যাওয়া ভাটিয়ারের কোমল ঋষভ তখন সদ্য জেগে ওঠা রূপসীর মেখে যাওয়া সিঁদুরের মতো কামনার জন্ম দিচ্ছে। আর রশিদ খানের গলা যেন গভীর প্রেমে সেই কোমল ঋষভকেই বারবার আদর করে চলেছে। ঠিক যেমন আদর করে মেঘ মল্লারে বিরহিনীর ভাব স্পর্শ করতেন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে স্বর ও সুরের ‘টেকনিকালিটি’র সঙ্গে প্রয়োজন হয় ভাব-আবেগ-আবেশের। নবরসকে আধারিত করতে পারে একমাত্র কন্ঠ। উস্তাদ রশিদ খানের কন্ঠে ছিল সেই আধার। 

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আমি নিছকই এক শ্রোতা। কলাকৌশলগত শিক্ষা আমার নেই। ফলত আমার পছন্দ শুধুমাত্র শ্রবণের উপর নির্ভরশীল। কর্ণকুহর দিয়ে প্রবেশ করে যে সুর আমার মনকে আনন্দ দেয়, আমার কাছে তা-ই সুন্দর এবং নান্দনিক। সঙ্গীতকে আমি রেকর্ডের থেকে ‘লাইভ’ শুনতে বেশি পছন্দ করি। উস্তাদ আমির খান বা উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান মঞ্চে শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। ডোভার লেন, কলামন্দির বা উত্তরপাড়ায় বসে পুরুষ কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে শুনেছি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত রাজন মিশ্র ও পণ্ডিত সাজন মিশ্রের গান। পণ্ডিত যশরাজের গানও লাইভ শুনেছি। তবে সমসাময়িক গাইয়েদের মধ্যে আমাকে বিহ্বল করতে পেরেছিলেন কেবল উস্তাদ রশিদ খান।

রশিদ খানের গান প্রথম সামনে থেকে শোনার সৌভাগ্য হয় বছর চৌদ্দ আগে। পুরনো নজরুল মঞ্চে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে 'মেঘ মল্লার' দিয়ে শুরু করে 'দেশ' গেয়ে শেষ করেছিলেন। আমাকে মুগ্ধ করেছিল ওঁর গলার আবেশ। সুর এবং স্বর যেন গভীর সংরাগে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। আর তেমন উদাত্ত কন্ঠস্বর! তারপর বহু ডোভার লেন, কলামন্দির পার হয়েছে। বহু অনুষ্ঠানের মন্তাজ স্মৃতিতে রয়েছে। কত অনুষ্ঠানের সাল-তারিখও মনে নেই। কিন্তু গানগুলি মনে আছে। 

মনে পড়ছে ২০১৮ সালের ডোভার লেন। শুরুতেই 'গোরখ কল্যাণ' ধরলেন বিলম্বিত লয়ে। সেই রেশ কাটার মধ্যেই শ্রোতাদের অনুরোধে তাঁর বিখ্যাত গান ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গাইলেন। মনে পড়ছে, ২০২১ সালে অতিমারি'র পরবর্তী ডোভার লেনের রাত। শেষ রাতে এলেন তিনি। রাগ 'যোগ' দিয়ে শুরু করলেন। অনুপম কায়দায় দুটি গান্ধার নিয়েই ওস্তাদী করলেন রশিদজী। এই রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই অন্য একটি রাগ (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) ছুঁয়ে তিনি শুরু করলেন সোহিনী। মনে হচ্ছিল, ভোরের শান্ত চরাচরে উস্তাদজীর কন্ঠ জন্ম দিচ্ছে এক নারীমূর্তির। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন সেই অবয়বে। তারপর সেই চিন্ময়ীর মধ্যে যৌবনের উন্মেষ ঘটাচ্ছেন তিনি। সূক্ষ্ম মীড়ের কাজগুলি যেন সেই নারীর অভিমান, মুড়কির কাজগুলি সেই নারীর কামনা। রশিদজী তান করছেন, আমরা শুনছি সেই নারীর শীৎকার। যতদূর মনে পড়ে, একবার শেষ রাতে উস্তাদ রশিদ খান একটি ঠুমরী গাইলেন ‘আজ রাধা বৃজ চলে’। অনুষ্ঠান শেষে আমরা বহু শ্রোতা কেমন যেন অবশ হয়ে গিয়েছিলাম।

গলায় সুর এবং স্বর হয়তো আসে অনুশীলন ও তালিম থেকে। কিন্তু এই আবেগ আসে কোথা থেকে? গায়কের সরলতা? নাকি, বহু বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয় জন্ম দেয় সেই আবেগের? আর এই আবেগের জন্যই তিনি নন্দিত এবং প্রশংসিত। খেয়াল করলে দেখা যায়, উস্তাদ রশিদ খানের অগ্রজরা বরাবর ওঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিশোর বয়সে তাঁর প্রথম দিকের অনুষ্ঠানে শ্রোতা ও সহশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদূষী গিরীজা দেবী, বিদূষী দীপালী নাগ। জহুরিদের চোখ চিনে নিয়েছিল সেই বিস্ময় বালককে। খবরে পড়লাম, উস্তাদ আমজাদ আলি খান ওঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘উনকা স্বর মে খোদা কা তাসির হ্যায়।’ হয়তো সে কারণেই পরমেশ্বর তাঁর জন্য কোল পেতে দিলেন। আমাদের জীবন আরও রিক্ত হল।

আপাতত মাঝবয়সে পৌঁছে আর কান্না পায় না। ‘তাহাদের কথা’ ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী যেমন নির্বিকার হয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উত্তর দেন সশব্দ বাতকর্মে, আমরাও তাই হয়ে গিয়েছি। নিজের মতো বেঁচে থাকার রসদ বলতে বই, গান আর সিনেমা। শীতকালে বিহান বেলার আলো এসে পড়ত রশিদজীর বোল‌তানে। কখনও বা কালবৈশাখীর মতো সপাট তান উড়িয়ে নিয়ে যেত আমাদের। বিকেলে যখন খবর পেলাম হোয়াট্‌সঅ্যাপে, সূর্য তখন পশ্চিম পাড়ায়। এমন সময়েই তো কলামন্দির বা সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে স্টেজে উঠবেন রশিদ খান। ইমন বা শুদ্ধ সারং দিয়ে শুরু করবেন। তারপর একটা কিরওয়ানি বা মূলতানী গাইবেন। শেষ পাতে থাকবে খানদানি দরবার-ই-কানাড়া। 

হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের জগতে পুরুষ কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে শেষ ‘মোহিকান’দের একজন ছিলেন উস্তাদ রশিদ খান। ছাপ্পান্ন কি যাওয়ার বয়স হল? পরমেশ্বর, তোমার কাছে তো উস্তাদ আমির খান, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, পণ্ডিত কুমার গন্ধর্ব সহ সঙ্গীতের রথী-মহারথীরা আছেন, রশিদ খানকে আর কিছুদিন এই মরা সময়ে আমাদের বাঁচার জন্য রাখা যেত না?


Wednesday, 10 January 2024

'আবার নিঃশ্বাস নিতে পারছি'

বাইশ বছরের মরণপণ লড়াই

সোমা ঘোষ বিশ্বাস



প্রায় ২২ বছর পর ন্যায়বিচার পেলেন বিলকিস বানো। ২০২২ সালের ১৫ অগস্ট বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ জনের সবাইকে শাস্তির মেয়াদ ফুরনোর আগে মুক্তি দেয় গুজরাত সরকার। দোষীদের এই মুক্তিকে সুপ্রিম কোর্টে বিলকিস চ্যালেঞ্জ জানান। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, গুজরাত সরকারের এই সিদ্ধান্ত বেআইনি। এই অপরাধীদের আবার জেলে যেতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, গুজরাত সরকারের এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ারই নেই। মাননীয় বিচারপতি বি ভি নাগরত্না ও উজ্জ্বল ভূঁইয়ার সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে।

সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বিলকিস বানো তার আইনজীবীর মাধ্যমে গণমাধ্যমে এক বিবৃতি প্রকাশ করে জানান, 'আজ সত্যিই আমার জন্য একটি নতুন বছর। আমার চোখে আজ আনন্দের অশ্রু। দেড় বছর পর আজ প্রথমবারের মতো হেসেছি, আমি এখন স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারি। আমি আমার সন্তানদের জড়িয়ে ধরেছি। যেন পাহাড় সম পাথরের বোঝা আমার বুক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আমি আবার নিঃশ্বাস নিতে পারছি। দেখে মনে হচ্ছে আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানাই, আমার সন্তান এবং সর্বত্র নারীদের জন্য সমান ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারার জন্য।'

সকলেই আজ অবহিত, ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার সময় বিলকিস বানোর পরিবারের ওপর সশস্ত্র দাঙ্গাবাজরা হামলা চালিয়ে বিলকিসের তিন বছরের মেয়ে সহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা এবং পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২১ বছর বয়সী বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করে। এই ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশ অফিসাররা তাঁর মামলা নথিভুক্ত করতে বারবার অস্বীকার করে, প্রমাণের অভাবের অজুহাত দেখায় এবং যদি তিনি বিষয়টি নিয়ে চাপাচাপি করেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। বিধ্বস্ত বিলকিস এরপরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে যান এবং ২০০৩ সালে ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই'কে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়।

জানা যায়, ঘটনার বেশ কয়েক দিন পরে বিলকিসের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সমূহ হারিয়ে গিয়েছিল। কোনও এফআইআর দায়ের করা হয়নি, পুলিশ প্রাথমিক ভাবে এফআইআর দায়ের করতে অস্বীকার করে এবং যখন তা করেছিল তখন ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ বাদ দিয়েছিল। এর মধ্যেও সিবিআই তদন্ত সম্পূর্ণ করে পুলিশ অফিসার ও ডাক্তার সহ ১৯ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে, যাদের মধ্যে যারা অপরাধটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারাও ছিল। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের একটি আদালতে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৭ সালে মুম্বাইয়ের আদালত ১১ জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে।

এই উত্তাল সময়ে বিলকিস বানো অভিযুক্তদের থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার বীভৎস বাস্তবতার মুখোমুখি হন। প্রাণসংশয়ের আশঙ্কায় তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। পরিস্থিতির গুরুত্ব স্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটিকে গুজরাতের আদালত থেকে মহারাষ্ট্রের আদালতে স্থানান্তরিত করে। এই স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তকে নিশ্চিত করেছে।

কিন্তু, এত সবকিছুর পরেও গত বছরের ১৫ অগস্ট গুজরাত সরকার যখন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ওই অপরাধীদের শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে তাদের মুক্তির কথা ঘোষণা করে, তখন সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, জেলের প্রাচীরের বাইরে ওই অপরাধীরা যখন মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসে, তাদের ফুলের মালা পরিয়ে ও কপালে তিলক কেটে হিন্দুত্ববাদীরা যে জয়ল্লোস প্রকাশ করেছিল, তা দেখে কেঁপে উঠেছিল হৃদয়ের অন্তঃস্থল। কথায় কথায় যিনি সব বিষয়ে ট্যুইট করেন, সেই প্রধানমন্ত্রী মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। গোদি মিডিয়াও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। গোদি মিডিয়া ও প্রধানমন্ত্রীর সেই একই আচরণ আবারও দেখা গেল সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের ক্ষেত্রেও। এই ঐতিহাসিক রায়ের পরে গোদি মিডিয়াকে দেখা গেল এ বিষয়ে কোনও 'রা না কেটে ক্যামেরার ফোকাসকে রাম মন্দিরের উপর স্থানান্তরিত করতে ও প্রধানমন্ত্রী আবারও মৌনব্রত নিলেন।

কিন্তু শেষে একটা কথা বলার থাকে। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি আছেন যারা 'অনুকূল রায়' না পেলে বিচারব্যবস্থাকে দুষতে থাকেন ও গালি পাড়েন। আবার 'অনুকূল রায়' এসে গেলে দু' হাত তুলে প্রশস্তি গাইতে থাকেন। যে কোনও মামলায় তথ্য, আইনের ধারা ও সওয়ালের ওপর যেহেতু মামলার গতিবিধি নির্ভর করে, তাই সাধারণ বুদ্ধিতে যা মনে হয় তা মামলার রায়ের সঙ্গে সবসময় নাও মিলতে পারে। আর না মিললেই বিচারপতিদের ব্যক্তিগত আক্রমণ ও 'আমাদের বিচারব্যবস্থা বিক্রি হয়ে গেছে' এমন হাল্কা মন্তব্য করা হয় যা কোনও কাজের কথা নয়। এই দোষ শাসক ও বিরোধী, দু' পক্ষেরই আছে। মনে হয়, সার্বিক ভাবে আমাদের দেশের উচ্চন্যায়ালয়ের প্রতি আস্থা রাখার এখনও যথেষ্ট কারণ আছে। কোনও ব্যবস্থাপনাই একশো শতাংশ নির্ভুল বা যথাযথ হয় না।


Friday, 5 January 2024

'দেবতা নাই ঘরে'

ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশিকা...

শ্রেয়া ঘোষ



'তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে

করছে চাষা চাষ-

পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,

খাটছে বারো মাস।'

(গীতাঞ্জলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।)

২২শে জানুয়ারির মতো একেবারে সাদামাটা একটা তারিখও যে এমত হৈ চৈ লাগিয়ে দিতে পারে, ভাবিনি কদাপি। জানুয়ারির তেইশ তারিখের আগের দিন বাইশে সচরাচর তেমনই হয়ে থাকে। তাই তেইশের কিছু প্রস্তুতি কয়েকদিন আগে থেকেই -  কদম কদম বঢ়ায়ে যা, পরদিন দুপুর বারোটায় বাজাবার জন্যে শাঁখ-টাখ গুছিয়ে রাখা, স্কুলের বিশেষ দিনের পোশাক সাদা জামা, লাল বেল্ট। তেইশে জানুয়ারি বরাবরই বিশেষ। মৃত্যুহীন বীর, নেতাজীর শুধু জন্মদিন - তেইশে জানুয়ারি।

ব্যাপারটা পাল্টে গেল। ২২শে জানুয়ারি ফুলে ফেঁপে সর্বত্র বিরাজমান ভয়ঙ্কর একটা অনুশাসনের মতো আমাদের চেপে ধরল। রাম, মানে রামচন্দ্র আমাদের জীবনে ওতপ্রোত। এস ওয়াজেদ আলির সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। 'রামায়ণ'  আমাদের অতি প্রিয় গ্রন্থ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, যেমন বলা আছে মাধ্যমিকের 'ভারতবর্ষ' প্রবন্ধের বারবার আন্ডারলাইন করা অংশে। যুগ যুগ ধরে আমরা সেই বাক্যের ব্যাখ্যা লিখে আসছি। আমাকে ধরলে চারটি প্রজন্ম ধরে বহমান ট্র্যাডিশন তো নিজের চোখেই দেখা। প্রায় অক্ষর পরিচিতিহীন আমার পিতামহী কোন যাদুবলে পাতার পর পাতা রামায়ণ পড়েই যেতেন। তবে আমরা বাঙালিরা এই গ্রন্থকে সাহিত্য হিসেবেই দেখেছি বেশি। রামচন্দ্র এক মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আমরা ঝেড়ে সমালোচনা করেছি সেই চরিত্রের। অন্তঃস্বত্ত্বা সীতার দুঃখে যত কাতর হয়েছি, এই চরিত্রের কাপুরুষতা তত আমাদের ক্রুদ্ধ করেছে। 'মেঘনাদবধ কাব্য'কে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ। আমরা রামায়ণ ফেলে পড়তে বসেছি সীতায়ন।

রামায়ণের নানা রকমফের আছে দেশে বিদেশে; যেমন বহু রূপকথার, বহু লোককথার। কিন্তু রামায়ণের এই একটি রূপকেই কালে কালে প্রতিষ্ঠিত করা হল। পৌরাণিক এই গল্পের অন্যতর পাঠগুলিকে অদৃশ্য করার প্রক্রিয়া সক্রিয় বহু যুগ ধরে। হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস আহত হবার মারাত্মক ভাইরাসের দাপটে পৌরাণিক এই গল্পের অন্য রূপগুলি প্রায় লুপ্ত হল।  উত্তর ভারতের হিন্দি বলয় বিশেষ করে এই একটি ফর্মের প্রতি অত্যধিক পক্ষপাত লালন করতে করতে কল্পনাকে ইতিহাসে পর্যবসিত করে ফেলল। আর তার ফল কী হল দেখতেও পেলাম।  

অথচ আমরা

মনের সুখেই ছিলাম নিজেদের মতো। কৃত্তিবাস বিরচিত রামায়ণে লক্ষ্মীমূর্তি হেন সীতাদেবীকে বাম দিকে বসিয়ে, সোনার ছাতা, চামর, যোড়হাতে (কৃত্তিবাসী বানান বিধিমতে) পবননন্দন সহ রামচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগেই আলাপ হয়েছে বেশ মাই-ডিয়ার টাইপের রামের, যে বলছে - কাল রাত্তিরে আমি একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখেছি। দেখলুম কি, রাবণ ব্যাটা একটা লম্বা তালগাছে চড়ছে। চড়তে চড়তে হঠাৎ পা পিছলে একেবারে পপাত চ, মমাত চ।

ববাবর জেনে এসেছি রাম না হতেই রামায়ণ। লোক ঠকানো ধাঁধাঁয় জব্দ করতে ছিল- রামেরা চার ভাই'এর ইংরেজি অনুবাদ জিগ্যেস করা। কাজেই এমত ধারণাই মাথায় মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসেছিল যে মহাকাব্য থেকে বেরিয়ে এসে চরিত্রটি একা খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না। আমাদের মাতৃভাষায় 'রামচন্দ্র' তেমন একটা সম্মানের সম্বোধনও নয়। রামশালিক মানে বক জাতীয় পক্ষীবিশেষ। রামছাগল, রামধোলাই, রামধাক্কা, আর... আর...  রামগরুড়ের ছানা। তবে রামকে ভূতেরা ভয় পায়। তাই রাম নাম জপলে ভূতেরা পালায় - আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি!

এসব কিন্তু একান্ত আমার ছ্যাবলামি নয় একেবারেই। সংসদ বাঙ্গালা অভিধান অনুসারে রামায়ণ হল বাল্মীকি কর্তৃক রচিত দশরথপুত্র রামের জীবনী বিষয়ক মহাকাব্য। আর রাম শব্দের পাশে ড্যাশ দিয়ে লেখা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। দ্বিতীয় স্থানে রামঃ। আরে রামঃ রামঃ, কি অনাসৃষ্টি। ওদিকে আরেক কবি সুকুমার রায় লিখে বসলেন, 'আরে ছি ছি! রাম রাম! ব'লো না হে ব'লো না-/ চলেছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা।' ভাগ্যিস মরণোত্তর শাস্তি বিধানের উপায় নাই।

ক্রমে

আদি কবি বাল্মীকি রচিত কাব্যের নায়ক ও তার বন্ধু স্বজনকে দেবত্বে মহিমান্বিত করা হল। রামচন্দ্রের একটি বার্থডে'ও সূচিত হল ও জাঁকজমকে সেদিনটি পালনের ধারা তৈরি হল। আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, এই ধারা বাংলার জল হাওয়ায় সুবিধে করতে পারবে না। তাই তেমন মাথা ঘামাইনি। যে যার মতো উৎসব পালন করুক আমাদের এই নানা সংস্কৃতির ভূখণ্ডে। কিন্তু হিসেব অত সোজা রইল না। রামের নামের আগে 'শ্রী' যুক্ত হল আর জয়ধ্বনি দ্রুত হুঙ্কার আর আক্রমণে বদলে গেল।

এসব আমাদের জানা। অসংখ্য বার আলোচিত। সহজিয়া আনন্দের রেশটুকু উধাও হয়ে গেল। আমাদের খোলামেলা যাপনের দরজা জানলা বন্ধ হয়ে দম আটকানোর মতো একটা অবস্থা। উৎসব, পুজোপালার মূল সুরটাই গেল কেটে। আমাদের পুজো মানে বাসন্তী শাড়িতে সেজে ভুলভাল মন্ত্রে সরস্বতী পুজো। কালীপুজোয় নিরামিষ পাঁঠার মাংসের সাংঘাতিক স্বাদ, আমাদের দেবী মায়ের নিরামিষ রোচে না, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মদ্যপান ও মাতলামি নিয়ে দুর্দান্ত সব রসিকতা। আমাদের লোকগানে শিব আর্শির সম্মুখে গিয়া অ্যালবার্ট কাটিবে। একটা হাল্কা মজার সুর আমাদের পুজোপাঠে সব সময়ে। যুগাবতার মহাপুরুষ ভক্তের মদ্যপানে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমাদের কবি অক্লেশে বলেন, 'এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।' আমাদের ধর্মাচরণ আমাদের নিজস্ব রুচি আর সংস্কৃতি মেনে। কিন্তু সেই আবহ পাল্টে যাচ্ছে বিপজ্জনক ভাবে। চিত্ত হেথা ভয়শূন্য থাকছে না, জ্ঞান মুক্ত রাখার উপায় সব হারিয়ে যাচ্ছে, হৃদয়ের উৎসমুখ হতে কোনও বাক্য আর উচ্ছ্বসিয়া ওঠে না।

আমাদের এই অজস্র মন্দির, মসজিদ, মঠ, গির্জা, সিনাগগের দেশে কেন একটা মন্দির তৈরির জন্যে এত উন্মাদনা? আমরা গাছকে পুজো করি, কোনও পাথরে দেবত্ব আরোপ করি, নদীর জলে ভেসে আসা কাঠের খণ্ডকে নানা উপচারে সাজিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করি। সেখানে আক্রোশের এত জগঝম্প কেন?

বাইশ তারিখে

ঘর বারান্দায় প্রদীপ (রামজ্যোতি) জ্বালতে হবে, দীপাবলী উদযাপন করতে হবে, আরও কী কী সব... একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশিকা এল আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। হিন্দি বলয়ের সদৃশ ধর্মপালন গোটা দেশে প্রচলনের এই তৎপরতা আজ অবধি আমাদের দেখা ছিল না। ধর্ম পালন করা বা না করা, পালন করলেও তার আয়োজন-বিধি, উপচার, মূর্তি পুজোয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাস সব একটি এবং কেবলমাত্র একটি নিয়ম মতেই হতে হবে! দূরে তাকিও নাকো, ঘাড় বাঁকিও নাকো। সব নিজস্বতা জলাঞ্জলি দিয়ে এক ছাঁচ থেকে বেরিয়ে আসবে যত মানুষ।

রামলালা বিরাজমান

শিশু রামচন্দ্র এই মন্দিরের বিগ্রহাসনে অধিষ্ঠিত হবেন। ছোট্ট রামলালা সুপ্রিম কোর্টে মামলা জিতে গিয়ে এই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন। তাই মন্দির। তাই দেশসুদ্ধ মানুষকে এই আনন্দানুষ্ঠানে সামিল হতে হবে। 

আর তখনই অন্য কোনও শহরে রাস্তায় রঙিন চক দিয়ে প্রায় উলঙ্গ কোনও রামলালা কোনও বিগ্রহের ছবি আঁকবে। দুর্বাদলশ্যম তার গায়ের রং, নীল পদ্মের মতো চোখ, রাঙা চরণ। আঁকবে তীরধনুক, রথ, লম্বা লেজওয়ালা হনুমান। সেদিন হয়তো দু' চারটে টাকা, কয়েন বেশিই পড়বে ছবির পাশে রাখা টিনের কৌটোটায়। জিগ্যেস কর যদি, এই, কোথায় রে তোর ঘর? থাকিস কোথায় তুই? সে বলবে, এই তো, এই রাস্তাতেই থাকি।

কেউ কোনওদিন যেন আমাদের বলেনি, 

'অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে

কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,

নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে

দেবতা নাই ঘরে।'