Pages

Thursday, 31 August 2023

এবার চূর্ণী ও মাথাভাঙ্গা

দূষণমুক্ত জীবন-জীবিকার খোঁজে

বিবর্তন ভট্টাচার্য



চাকদহে নাগরিক সমাজের সফল আন্দোলনের ফলে বুড়িগঙ্গা নদীর আংশিক সংস্কারের পর এবার মজে যাওয়া ও দূষিত চূর্ণী ও মাথাভাঙ্গা নদীর দিকে তাকানো যাক। আমরা বহুদিন ধরেই চূর্ণী নদীর দূষণের কথা শুনে আসছি। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এমনকি সাংবাদিকরাও বড় সংবাদপত্রে সবসময়ই চূর্ণী নদীর দূষণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ছাড়া কালো জলের কথা বলে থাকেন। আমরাও সে কথাই জেনে এসেছি এতদিন। কিন্তু ঘটনা হল, গোবিন্দপুর থেকে পাওয়াখালি পর্যন্ত মাথাভাঙা নদীর দীর্ঘ ১৯ কিলোমিটার গতিপথ সর্বপ্রথমে দূষিত হয়। অথচ, তা নিয়ে যে কেন আলোচনা হয়নি, এ কথা ভেবে বিস্মিত হই। মাথাভাঙা নদীর যে ভয়ঙ্কর দূষণ তা কিন্তু চূর্ণীতে এসে অনেকটাই কমে যায়। আসলে, শিবনিবাস পর্যন্ত চূর্ণী নদীতে গঙ্গার জোয়ার ভাটা খেলে। কিন্তু মাথাভাঙা নদীতে তা পৌঁছয় না। 

তাই মাথাভাঙা নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। এছাড়া চূর্ণী নদী ৫৩ কিমি এবং তার আশপাশে জনবসতি ও জনঘনত্ব বেশি, তাই এই দূষণ বহু আলোচিত। এছাড়াও হাইকোর্টের আইনজীবী প্রয়াত মদন লাল পুণ্যস্নান করতেন চূর্ণীতে। চূর্ণীতে কালো জলের দূষণ দেখে তিনি হাইকোর্টে একটি মামলা করেন (W.P.No. 2795 (W) of 2011, Madan Lal Vs Union of India)। 

এই মামলায় বিচারকদ্বয় জয়মাল্য বাগচী ও অরুণ মিশ্র তাঁদের রায়ে উল্লেখ করেন, 

'It is submitted that Kero and Company at Darshana in Bangladesh which manufactures sugar, wine, chemicals etc. and stores its effluents in lagoons/ reservoirs which when released into the Mathabhanga river automatically finds its way into the Churni resulting in huge quantity of loss of fish, unbearable stench in the area affecting hygiene and health of the people residing near the bank of the said river and making it unworthy of bathing and unfit for irrigation.'

তারপর থেকেই চূর্ণী দূষণ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

মাথাভাঙা নিয়ে একটা কথা চালু আছে যে, পাওয়াখালির কাছে মাথাভাঙা যেহেতু দু' ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ইছামতি অপরটি চূর্ণী- তাই মাথা ভেঙে চূর্ণী ও ইছামতির উৎপত্তি থেকে মাথাভাঙা নাম। কিন্তু এই কথাটি ঠিক নয়। মাথাভাঙা সীমান্ত নদী। মাথাভাঙা নদীর উৎপত্তি মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির উৎস থেকে আনুমানিক ১৬ কিমি পূর্ব-দক্ষিণে পদ্মা বা গঙ্গা থেকে। উৎসারিত হয়ে মাত্র ১০ কিমি পথ পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়ার কাছে মাথাভাঙা দু' ভাগে বিভক্ত হয়েছে- পূর্ব শাখা কুমার নামে এবং অন্য শাখাটি এঁকেবেঁকে বাংলাদেশের কাপাসডাঙায় গিয়ে ভৈরবকে কেটে দিয়ে দক্ষিণে নেমেছে। তারপর চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে মেমনগর ব্রিজ পেরিয়ে শ্যামপুর ও জয়নগর হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গেদের কাছে গোবিন্দপুরের BSF ক্যাম্পের পাশ দিয়ে পুনে চাঁদপুর হয়ে ১৯ কিমি বয়ে গিয়ে মাজদিয়ার কাছে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। 

ইছামতি ও চূর্ণীতে আসলে দূষণ শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শ্যামপুর বটতলা থেকে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির দূষিত জল থেকে যার সাথে দর্শনা পৌরসভার জলও রয়েছে। বাংলাদেশের দুটি গ্রাম শ্যামপুর আর জয়নগর প্রায় ১০ কিমি দূষিত। এলাকার মানুষের ধারণা, বৃটিশ আমলে এই কেরু অ্যান্ড কোম্পানি তৈরি হয়েছিল আর সারা পৃথিবীতে কেরুর মদের বিশাল চাহিদা ছিল; তাছাড়া এই দূষিত জল ছাড়লে তো নিচের দিকে যাচ্ছে, তাই ভারত কিছুটা অসুবিধায় পড়ছে! তবুও কিছুটা মানিয়ে নিয়ে চলছে এই গ্রামগুলোতে বসবাসকারী ৫/৬ হাজার মানুষ। কৃষক ও মৎস্যজীবী পরিবারের অসুবিধা বেশি হলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না।

বাংলাদেশের দিকে মাথাভাঙা'র শাখা নদী কুমার, চিত্রা, নরগঙ্গা, কপোতাক্ষ, ভৈরব প্রভৃতি। তা কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার ইনসাফনগরের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেখান থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলা থেকে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মধ্যে নদীটির প্রবাহপথে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর, মিরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা রয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৩০ কিমি, প্রস্থ ১৫০ মিটার। দর্শনার কাছে নদীর গভীরতা ১০ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ৫০০ বর্গ কিমি। এই নদীতে জোয়ার ভাটার প্রভাব নেই। সাধারণত নদীর তীর উপচে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বন্যা হয় না।

আসলে, যেখানে মাথাভাঙার উৎপত্তি হয়েছে সেই স্থানটিতে নদী অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ। অর্থাৎ, নদীর মাথা ভাঙনপ্রবণ বলে নাম হয়েছে মাথাভাঙা।  

ভারতের নদী বিজ্ঞানী কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণে বাধা দিলেও এই বাঁধের অবস্থানগত বিষয় নিয়ে উইলিয়াম উইলকস একটি সুন্দর পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাথাভাঙার উৎসস্থল নদীয়ার কাছে যদি এই বাঁধ নির্মিত হয় তাহলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেরই মঙ্গল হতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। পদ্মা থেকে জল আসা অনেকটাই প্রকৃতিগত কারণে বন্ধ হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির পরিমাণ কম হওয়াতে দুই বাংলাতেই বৃষ্টির পরিমাণ কম। তাছাড়া নদী কচুরিপানাতে ভর্তি। তার ওপর কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনির কল আর মদ কারখানার দূষিত জল সরাসরি ফেলা হয় মাথাভাঙা নদীতে।



মাথাভাঙা নদীর ১৯ কিমি আর চূর্ণীর ৫৩ কিমি মোট ৭২ কিমি নদীপাড়ের মানুষজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। জীবন-জীবিকা হারিয়ে রিক্সা টোটো অটো চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন। বহু নদী বিশেষজ্ঞ অনেক কথা বলেছেন, কেউ কেউ বহু কবিতা লিখেছেন, অনেকে গান গেয়েছেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এই কালো জলের সমস্যা দূর হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, এই আন্তঃসীমান্ত নদীর সমস্যা দূর করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। আবার অনেকে ফারাক্কার মতো আলাদা ক্যানেল কাটবার কথা বলেছেন। 



আজ আমি একটা সমাধানের পরিকল্পনা দিচ্ছি দেখুন সম্ভব কিনা।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার মধুর সম্পর্ক। তিনি যদি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন যে, তিনটি ড্রেনের জল শোধন করে ফেলার মেশিন শ্যামপুর বটতলা থেকে পরপর বসিয়ে পরিশোধিত পরিষ্কার জল মাথাভাঙা নদীতে ফেলতে হবে, তবে বাংলাদেশের গ্রাম সহ ১৫০টি গ্রামের মানুষ উপকৃত হতে পারেন। বৃটিশ আমলের এই কারখানা, তাই আধুনিকীকরণের জায়গা থেকেও তা করা সম্ভব।  অবশ্য দুই দেশের ও রাজ্যের প্রধানদের সদিচ্ছার ওপর সবটা নির্ভর করছে। বিষয়টি খুব যে কঠিন তা কিন্তু নয়। কারখানা থেকে ঢাকা ড্রেনে জল নামছে মাথাভাঙা নদীতে। তাই, এই জলশোধনের মেশিনটি শ্যামপুর বটতলা এলাকায় বসালেই সব সমস্যার সমাধান হয় এবং দুই দেশের মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারেন। এই সহজ প্রক্রিয়া যদি রাজ্যের প্রধান ও রাষ্ট্রের প্রধানগণ গ্রহণ করেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গের নদীপাড়ের প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য মাত্র ৬০ লক্ষ টাকা খরচ করলে এই মানুষজন রক্ষা পাবেন‌ সারা জীবনের জন্য।


Tuesday, 29 August 2023

কৃষিতেও গিগ শ্রমিক

'পূবে কাজে যাওয়া'

বিনয় কৃষ্ণ পাল



সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে গিগ শ্রমিক অত্যন্ত আলোচিত বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। গিগ  শ্রমিক বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাইক বা নিজস্ব যানবহনে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘড়ির কাটা ধরে ছুটে চলা আপাত স্বাধীন ডেলিভারি বয়রা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শহর-ভিত্তিক গিগ কাজের অগণিত কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং যথেষ্ট আয়ের সুযোগ-সুবিধার সাথে সাথে গ্রামীণ এলাকার কৃষকেরাও আয়ের বিকল্প উৎসের সন্ধানে প্রচুর পরিমাণে স্থানান্তরিত হতে শুরু করেছেন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এটি কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে ও ভবিষ্যতেও করবে। 

কৃষির সঙ্গে জড়িত উৎপাদকদের জন্য অতিরিক্ত আয় তৈরি করা এবং আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা যাতে ভেঙে না পড়ে তা নিশ্চিত করার জন্যই একটি গ্রামীণ গিগ অর্থনীতি গড়ে উঠছে। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে স্থানান্তরী শ্রমিকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই লেখাটি মূলত দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিম জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পূর্বের জেলা বর্ধমান, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলাগুলিতে কৃষি শ্রমিকদের স্থানান্তর নিয়ে। এই জেলাগুলির যোগাযোগে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দুটি লাইন- পুরুলিয়া-হাওড়া ও বাঁকুড়া-মসাগ্রাম (পূর্বতন BDR বা বাঁকুড়া দামোদর রেলওয়ে) এবং এই রেল লাইনের প্রায় সমান্তরালে সড়কপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। 

কৃষিতে গিগ

প্রচলিত কথায় বলা হয়ে থাকে, সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমুলক প্রকল্পের কারণে গ্রামাঞ্চলে কৃষি শ্রমিক প্রাপ্যতার সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে এই কথার ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়। গত প্রায় দু' বছর ধরেই একশো দিনের প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন ফের বাড়ছে এবং জীবিকার তাগিদে আঞ্চলিক স্তরেও ব্যাপক স্থানান্তর দেখা যাচ্ছে। 

এলাকা ভিত্তিক গিগ শ্রমিকদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম লোকাল বা প্যাসেঞ্জার ট্রেন, লোকাল বাস এবং ইঞ্জিন ভ্যানের মতো যানবাহন। রোজকার যাত্রায় তাঁরা ভাগ করে নেন নানা সুখ-দুঃখের কথা ও বেঁচে থাকার গল্প। এলাকার শ্রমিকদের কাছে এখন খুবই প্রচলিত হয়েছে ‘পূবে কাজে যাওয়া’ এই বাক্যবন্ধটি। যাতায়াত ব্যয় কমাতে এই এলাকায় রেল যোগাযোগ এই স্থানান্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঁকুড়া-মশাগ্রাম ও পুরুলিয়া-খড়গপুর রেলপথ এই পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। লোকাল বা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের অতি স্বল্প ভাড়া, দ্রুত ও সহজ যোগাযোগ এই স্থানান্তরে খুব কার্যকরী। দক্ষিণ-পূর্ব রেল এবং পূর্ব রেলের যোগাযোগের মাধ্যমে মূলত দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে মানুষ কাজের জন্য স্থানান্তর করেন, যা দৈনিক বা পাক্ষিক অথবা ঋতুকালীন নানা পর্যায়ের হয়। সাধারণভাবে লোকাল ট্রেনের ভাড়া কম হওয়ায় এই শ্রমিকেরা খুব সহজেই পশ্চিমাঞ্চলের স্টেশনগুলির পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে অত্যন্ত ভোরে বা তাঁদের সুবিধামতো সময়ে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলাগুলিতে কাজের জন্য আসেন। তুলনামূলকভাবে বেশি মজুরি হওয়ার ফলে এই শ্রমিকেরা খুব সহজেই বেশি রোজগারের আশায় আকৃষ্ট হন। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের কিছু অংশ ও ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি এলাকায় স্বল্পবৃষ্টি এবং কোনও কোনও মরসুমে খরা প্রকৃতির কারণে ঐ এলাকায় কৃষি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কাজ পাওয়া যায় না এবং তার ফলেই তারা কাজের সন্ধানে পার্শ্ববর্তী জেলা এমনকি পার্শ্ববর্তী বা সুদূর রাজ্যে পাড়ি দেন। 



সাধারণভাবে কাজের নিয়ম অনুযায়ী, একজন শ্রমিক কোনও একটি ক্ষেতে একদিনের কাজে নিযুক্ত হন। কিন্তু স্বল্প সময়ে অধিক রোজগার এবং বেরোজগারের মৌসুমগুলিতে আয়কে সুরক্ষিত রাখতে এঁরা মালিকের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজে নিযুক্ত হন এবং দেখা যায়, অনেক সময়ই তাঁরা একদিনে তিন-চারজন শ্রমিকের কাজ করে দেন এবং তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দৈনিক আয় করেন। বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমাঞ্চল থেকে বর্ধমানে এ কাজ করতে আসা অধিকাংশ কৃষি শ্রমিক দৈনিক সাতশো থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন, যেখানে নিজেদের জেলা বা এলাকায় এই কাজ করে সর্বসাকুল্যে হয়তো আয় হত পাঁচশো টাকা। ফলে, শহরের শ্রমিকেরা যেমন দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে ছুটে নিজেদের আয়কে বাড়ানোর চেষ্টা করেন, একইভাবে গ্রামীণ কৃষি শ্রমিকরাও সকাল থেকে রাত্রি অথবা এক এক মরসুমে জেলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কাজ করতে গিয়ে অধিক আয়ের চেষ্টা করেন। এঁদের এলাকাভিত্তিক কাজ ও কাজের তথ্য পেতে সাহায্য করেন কমিশন ভিত্তিক কাজ করা কিছু কন্ট্রাক্টর বা সুপারভাইজার- এরাই জমি মালিক ও কৃষি শ্রমিকদের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। অনেক ক্ষেত্রে এই কন্ট্রাক্টররাই অসুস্থতা বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সহজ সুদে বা অন্য কোনও শর্তে ঋণ দেন। 

যন্ত্রায়ন ও মহিলাদের শ্রমের স্বীকৃতি

ইতিহাস জুড়ে নারীরা কৃষি শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণ, বৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মহিলারা অস্পষ্ট শ্রমশক্তি হিসাবে টিকে থাকেন, তাদের অবদান প্রায়শই অস্বীকৃত থেকে যায়। কৃষি প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলি লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আরও প্রচেষ্টা করছে। তারা যে প্রযুক্তি-চালিত প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার করে তা প্রযুক্তি, ডিজিটাইজেশন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৃহত্তর সংখ্যক নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার সুবিধা দেয়। ফলস্বরূপ, এই উদ্যোগগুলি নারীদের সক্রিয়ভাবে কর্মশক্তিতে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করে। 

বর্তমান কৃষি ক্ষেত্রে যন্ত্রায়ন মহিলাদের কাজের ক্ষেত্র ও স্বীকৃতিকে ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। যেমন, আগে লাঙ্গল দেওয়ার কাজে মহিষ বা বলদের ব্যবহার হত এবং তা চালনা করত পুরুষ শ্রমিক। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই কৃষি ক্ষেত্রে শারীরিক শ্রমের সাপেক্ষে পুরুষ শ্রমিকের স্বীকৃতি সবচেয়ে প্রথমে আসত। কিন্তু এখন লাঙ্গল দেওয়ার কাজ ট্রাক্টর বা হারভেস্টার'এর মাধ্যমে করার ফলে কায়িক শ্রমের মাত্রা কমেছে এবং একই ধরনের কাজ নারী ও পুরুষ উভয়ই করছে। তাই এখন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিশেষত পুরুষ শ্রমিকদের চাহিদা কমে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিকের চাহিদা ও স্থানান্তর বাড়ছে। 

একদিকে সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প, অন্যদিকে কৃষি শ্রমিক হিসেবে নারীদের ব্যাপক নিযুক্তি সমাজের নিম্নস্তরে মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ফলত, জন্মহার, খাদ্যাভাস, পোশাক, মনোরঞ্জনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে মহিলাদের পছন্দ প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই, প্রত্যেক বর্ষার শুরুতে এবং শীতের শুরু ও শেষে পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি-নির্ভর এই শ্রমিকেরা মুখিয়ে থাকেন পূবে যাবেন বলে। তাই, সামগ্রিক ভাবেই পূবে যাওয়া এই মানুষগুলোর কাছে চুক্তি ভিত্তিক কর্মপ্রাপ্তি সূর্যোদয়ের মতোই এক ঘটনা যা আরেকদিকে গ্রামীণ গিগ শ্রমিকদের জন্ম দিচ্ছে।


Tuesday, 22 August 2023

ত্রিবেণীর গুজব!

ছিল পুণ্যস্নান হয়ে গেল কুম্ভমেলা

মালবিকা মিত্র



সেটা ২০১৬ সাল হবে। বাঁশবেড়িয়া হংসেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছি ঘুরতে। একে দুপুর, তায় সারাদিন ঝিরঝির  বৃষ্টি। ছাতা মাথায় ঘুরছি। হঠাৎই এক মহিলার কন্ঠ-

- জারা ইধার শুনিয়ে মাইজি। 

- হ্যাঁ বলো কী বলছ?

দেখলাম মহিলা একা নয়, তারা জনা তিন। আমার কাছে জানতে চাইল আমি শিবজীর ভক্ত কিনা। তারপর জানালো, তারা কোনও টাকাপয়সা চায় না। একটা ছোট্ট অফসেট প্রিন্ট করা বর্ণময় লিফলেট দিল। ভাবলাম, এবার নিশ্চয়ই টাকা চাইবে। না, এরপর বলল, সারাদিনের মধ্যে যখনই হোক এটা পড়বেন। বিপদে পড়লে, বিপদে না পড়লেও। মাত্র চার লাইন মন্ত্র।

- সির্ফ পড়নে মে কেয়া তকলীফ হ্যায়, হ্যায় না? 

লিফলেটটা ব্যাগে রাখলাম। খানিকটা সময় কাটিয়ে গেলাম দেবানন্দপুরে, লাহিড়ী বাবার আশ্রমে। ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যেন একই ওষুধ, একই কোম্পানির এমআর ডাক্তারের কাছে ডেমো দিচ্ছেন। এরপরই বিষয়টা আমাকে ভাবালো। 

প্রথমত, মহিলাদের দিয়ে মহিলাদের অ্যাপ্রোচ করা। একজন পুরুষকে আপনি যত সহজে এড়াতে পারবেন, একজন মহিলাকে পারবেন না। আর একজন মহিলার মাধ্যমে আপনি একটি গৃহের অন্তঃপুরে একটা লিফলেট পৌঁছে দিলেন। একটু লক্ষ করবেন, একজন মহিলা পথে পাওয়া একটা লিফলেট যত্ন করে ব্যাগে রাখে, ঘরে এসেও সেটা টেবিলে, টিভি বা ফ্রিজের উপর চাপা দিয়ে রাখে। ফেলার হলে ৫/৭ দিন পরে ফেলে। এই কদিনে বাড়িতে অনেকে ওটা খুলবে, দেখবে। ওতেই আসল কাজ সাঙ্গ। 

দ্বিতীয়ত, পুরো একভাবে এক বয়ানে ডেমো, এটা সংগঠিত প্রয়াস ছাড়া হতে পারে না। নিশ্চিত করে বলা যায়, একটা কোনও কেন্দ্রীয় কর্মশালার বয়ান। অ্যামওয়ে, টুপারওয়্যার, অরিফ্লেম, মোদিকেয়ার যেমন করে থাকে। 

তৃতীয়ত, অত ভালো বর্ণময় লিফলেট খুব বৃহদায়তন সংখ্যক ছাপাতে হবে। না হলে সেটা ব্যয়বহুল হবে। আমি নিশ্চিত ওটা কেন্দ্রীয় ভাবে ছাপানো হয়েছে। 

চতুর্থত, আরও অনেক দিন পর কোন্নগরে ভাগওয়া ঝান্ডার একটি মিছিলে 'রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ' (আরএসএস) ব্যানারে ওই একই লিফলেট বিলি হচ্ছিল। ফলে, আমার ধারণা আরও দৃঢ় হল। এটা একটা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ফসল। 

এখন তো ২০১৮-১৯'এর পর থেকে দেখছি, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাতে, হর হর মহাদেব, ভোলা রে ভোলা- একটানা একঘেঁয়ে সুরে অষ্টপ্রহর মাইকে বাজছে। মহিলারা একদল ছাড়ল তো শিশু-কিশোরীর দল ধরল। জানেন, শিবরাত্রি ছিল গৃহের উৎসব। গৃহের অভ্যন্তরে ২/৩ বাড়ির মেয়ে বৌ'রা একত্রিত হয়ে রাত্রি জাগত। বড় জোর পরস্পর তিনটি সিনেমা দেখে রাত জাগত। পাড়া তো দূরস্থান, বাড়ির অন্য কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত না। এখন আমার পাশের পাড়ায় মাইকের গম্ভীর শব্দ গর্জন তুলে সারা রাত ধরে জগঝম্প মিউজিকের সঙ্গে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, কুস্তি-ক্যারাটে চলে। আর থাকে আবগারি বিভাগের আশীর্বাদ পুষ্ট অঢেল পানীয়। 

এতদিন এই অনুষ্ঠান ছিল হিন্দি ভাষী অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। হঠাৎই অর্থের বান ডাকল। শিব মন্দির তৈরি হল নতুন নতুন। সাবেক শিববাড়ি, শিবতলা, বাবার থান, ষন্ডেশ্বর মন্দির, আঞ্চলিক বিশ্বাস স্থলও প্রাচীন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হল। নতুন শিবের মন্দিরগুলি পাথর টাইলস শোভিত, কাশী-বারাণসী স্টাইলের সাজে পান্ডা পূজারী আর শব্দ তাণ্ডব। নিত্য আছে ভোগের আয়োজন। আর ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? বেআইনি চোলাই মদের কারবারি, আমাদের সকলের চেনা, রাতারাতি মন্দিরের পূজারী। অফিস ফেরত যাত্রী, কলেজ ফেরত ছাত্রী, সবাই দাঁড়িয়ে ভক্তি গদগদ হয়ে প্রণাম ও তারপর ভোগ গ্রহণ। 

একদা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'এর সাংবাদিক, আমার পরিচিত, আমার কাছে সব শুনে বলল, এই রাজ্যের আরএসএস নেতার মুখে শোনা, রামের প্রভাব এই রাজ্যে অচল না হলেও যৎসামান্য। যারা বিজেপি পার্টি কর্মী তারা মাথামোটা'র মতো জয় শ্রীরাম বলছে বটে, বাংলায় এটা সাড়া পাবে না। উল্টোই ফল হবে। বরং শিব-পার্বতী এখানে ঘরের মেয়ে জামাই। অন্তঃপুরে তাদের স্থান। তাই আরএসএস চায় শিব ও কৃষ্ণকে বাংলায় আইকন করতে। কীর্তন দলগুলো ও কীর্তন সংগঠক দুইই এদের লক্ষ্য। বাঙালি শবযাত্রায় বলে, হরি বোল। সাক্ষাৎ সম্বোধনে বলে হরেকৃষ্ণ, জয় রাধে, জয়গুরু, শুভযাত্রা কামনায় বলে দুর্গা দুর্গা। 

ওই সাংবাদিকই বলল, দেখবেন স্থানীয় তৃণমূল দল ও প্রশাসন এগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে তারাই এগুলোর হাল ধরেছে, নেতৃত্বে আছে। বিজেপি সুবিধা করতে পারছে না। তৃণমূল এই কৌশল নিয়ে ভোটের অঙ্কে অনেকাংশে সফল। উৎসব সবার, এই মনোভাব। কিন্তু আরএসএস চায় উৎসব নয়, ধর্ম। আরএসএস'এর এই আদর্শের ক্ষেত্রকে আঘাত দেবার ক্ষমতা তৃণমূলের জনপ্রিয় কর্মসূচির দ্বারা সম্ভব হবে কি? 


হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া পৌরসভা। সেখানে ত্রিবেণীতে ২/৩ বছর ধরে কুম্ভমেলা আয়োজন হচ্ছে। পৌর প্রশাসনের একটা দায়িত্ব থাকেই। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু মেলা কমিটি, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৃণমূলের পৌরপ্রধান, উপ পৌরপ্রধান ও সপ্তগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক ঐতিহ্যবাহী কুম্ভমেলা আরও ভালো করে পরিচালনা, স্থায়ী মেলা প্রাঙ্গণ নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি আমেরিকা প্রবাসী কাঞ্চন ব্যানার্জীকে তার সক্রিয় উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানান। প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করছি। কিন্তু সমান্তরাল ভাবে দল কি মানুষকে সজাগ সতর্ক করেছিল? নাকি তৃণমূল দলও মেলার অভিন্ন অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। এই কথাগুলো কেন উঠছে সেটা বলি। 

বর্ষীয়ান আরএসএস মুখপাত্র মোহিত রায় এই ত্রিবেণী কুম্ভমেলাকে মহিমান্বিত করে বলেছেন, '703 years ago, Zafar Khan Ghazi converted Tribeni’s Vishnu temple into a mosque. The Kumbho bathing and the fair stopped from that time. After 1319, the fair is going to resume this year.' (On 12 February 2022, a day before the inauguration, a Facebook post from the page of the BJP-backed platform Paschimbanger Jonyo)। আরএসএস মেলার শুরু থেকেই মন্দির-মসজিদ প্রসঙ্গ তুলছে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে। তাই শুরু থেকেই তৃণমূলকে দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। অন্যথায় তৃণমূল কর্মীরা বিপথগামী হবে।

মাস্টার প্ল্যানটা ভাবুন একবার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে (২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) ত্রিবেণীতে এই বিশেষ উদ্যোগকে সার্টিফিকেট দিলেন। সেই সঙ্গে উৎসবের মধ্যে বিষ প্রয়োগ করলেন, 'But do you know why it is so special? It is special, since this practice has been revived after 700 years,' said Modi. '... unfortunately this festival which used to take place in Tribeni, Bengal, was stopped 700 years ago. It should have been started after independence, but that too could not happen.' দেশ মুসলমান, খৃস্টানদের অধীনতা মুক্ত হবার পরেও সত্তর বছর স্বাধীনতা পায়নি। মোদিজী এসে স্বাধীনতা দিলেন (হিন্দুদের)। 'অযোধ্যা সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়/ কাশি মথুরা বাকি হ্যায়।' শুধু কাশি মথুরা নয়, সারা দেশে, বিশেষ করে অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে মন্দির-মসজিদ ইস্যু অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এই ইস্যু বিজেপি রাজনীতির প্রাণরেখা। সিপিএম ও কংগ্রেস প্রধান কেরলেও আরএসএস সক্রিয়। 

The Hindu right-wing effort to ‘revive’ Hindu festivals, whether fictitious or real, near sites where Hindu temples were allegedly razed, is playing out in states beyond West Bengal. For instance, in Left-ruled Kerala, a festival was ‘revived’ in Muslim-majority Malappuram district after an alleged break of 250 years. 

সত্যতা থাকুক না থাকুক, তথ্য প্রমাণ না থাকুক, প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দাও। কান প্রস্তুত থাকলে ঠিক ধরা পড়বে কানে। গুজবের তাত্ত্বিক ভিত্তি এটাই। কানাডার গবেষক অ্যালান মরিনিস বাংলার পুজো-পার্বণ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন ত্রিবেণীর প্রাচীন ঘাটের কথা। মকর সংক্রান্তির দিনে এখানে পুণ্য স্নানের কথা উল্লেখ করেছেন, যা এখনও সব গঙ্গার ঘাটে হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্জনের ব্যাখ্যায় পুণ্য স্নান হয়ে গেল কুম্ভমেলা। গবেষক মরিনিস 'দ্য টেলিগ্রাফ' (১৮ মে ২০২৩) পত্রিকায় 'মন কি বাত'এ প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সংঘের ঢক্কানিনাদে তা চাপা পড়ে যায়, যাবেই। 

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসার বহর বেড়ে গেছে, লাভ হচ্ছে। তৃণমূল নেতা প্রশাসক ভাবছেন, জাতীয় পর্যটন মানচিত্রে ত্রিবেণী স্থায়ী মর্যাদা লাভ করবে। মেলা কমিটির কেউ কেউ ভাবছেন, এই তালে কিছু কামিয়ে নেওয়া যাবে'খন। রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী। অন্তর্যামী হাসে আরও শত শত রাম মন্দির, কর সেবক, মসজিদের ধ্বংস ও তান্ডবের স্বপ্ন দেখে। ত্রিবেণী ঘাটের মাত্র কয়েক মিটার দূরত্বে জাফর খান গাজীর দরগা, সম্ভবত বাংলার প্রাচীনতম দরগা। তৃণমূলের ছোট নেতাদের কথায়, আমরা না থাকলে মন্দির-মসজিদ গোলমালটা লাগানোর খেলায় ওয়াক-ওভার দেওয়া হবে। বরং আমরা থাকলে সেই খেলাটা সহজ হবে না। ওরা যত ধর্মকে প্রাধান্য দেবে, আমরা ততই উৎসব, মেলাকে প্রাধান্য দেব। হিন্দু কুম্ভমেলা ও গাজী বাবার দরগার পাশাপাশি সহাবস্থান- এটাই বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে প্রচার করা যাবে। এছাড়া বিকল্প কী বলুন। এই ফর্মূলা তো ২০২১'এ বিজেপিকে আটকাতে পারল। 

আরও কিছু কি ছিল না বিকল্প! একটি বিকল্প হতে পারত শ্রেণি পরিচিতি নির্ভর বামপন্থী আদর্শ। কিন্তু সেই আদর্শের রাজনীতি সরকারি বামেদের কল্যাণে লুপ্ত প্রায়। শ্রেণি আন্দোলনের তরলীকরণ বা বলা ভালো অশুদ্ধিকরণ বহু আগেই সম্পন্ন। তাই আজ অন্য একটি বিকল্প হতে পারে নেহেরু যুগের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ। কংগ্রেস বহুদিন যাবৎ নরম হিন্দুত্বের পথ অনুসরণ করেছে, রাজীব গান্ধী থেকে মনমোহন সিং অবধি। নরম গরম হিন্দুত্বের পিচে বিজেপি অনেক বেশি সাবলীল। আজ রাহুল গান্ধী যখন 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র দ্বিতীয় পর্ব শুরু করতে চলেছেন, নফরত'এর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে প্যায়ার- ইনসানিয়াৎ'এর সওদার কথা আনছেন, কর্নাটকে বজরং দল নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন, আশা করা যায় আদর্শের জমিতে লড়াই আসন্ন। বাংলা-বাঙালিয়ানা দিয়ে তো সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে লড়াই করা যাবে না। তবে আমি বিশ্বাস করি, তামিল ওড়িয়া বাঙালি মারাঠি ঝাড়খণ্ডি অস্মিতা ও পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয় ইনসানিয়াৎ'এর সংশ্লেষণের প্রয়াস নিশ্চিত ভাবে সহনশীলতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ রক্ষার কার্যকর পথের দিশা দেখাতে পারে।


Monday, 14 August 2023

কোটা: 'শিক্ষা'র বিভীষিকা

কোচিং মাফিয়ার হত্যাপ্রকল্প

পার্থ প্রতিম রায়



রাজস্থানের কোটা শহর কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। গত এগারো দিনে তিনজন এবং এই বছরে ইতিমধ্যেই উনিশজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়ার নামীদামী কলেজে ভর্তির প্রতিযোগিতায় সফল হতে গেলে রাজস্থানের কোটা শহরের কোনও একটি কোচিং, বা নিদেনপক্ষে ওইসব কোচিং'এর পড়ানোর পদ্ধতি মেনে চলে, এমন কোনও কোচিং'এ নাকি ভর্তি হতেই হবে, নইলে জীবনে ‘সফল’ হওয়া যাবে না– এই ধরনের চিন্তা এখন শৈশব থেকেই ছাত্রছাত্রী ও তাদের বাবা মায়েদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। কে গেঁথে দেয়? শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারিকরণের যে সংস্কৃতি তিলে তিলে গড়ে তোলা হচ্ছে- টাকা খরচ করতে পারলে দেশি বিদেশি ডিগ্রি অর্জন, বেশি মাইনের চাকরি ইত্যাদি সহজেই হাতের মুঠোয় চলে আসে- এইসব চিন্তা দিয়ে চালিত সংস্কৃতিই গেঁথে দেওয়ার কাজটা করে। আর এই সংস্কৃতি তৈরির কাজটা করে সরকারি নীতি ও আচরণ। শৈশব ও কৈশোরের সৃজনশীল ও কল্পনাশ্রয়ী মন এভাবে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে, তা বুঝতে গেলে শিক্ষা-অর্থনীতি-সমাজ সংক্রান্ত একটি সামগ্রিক আলোচনার প্রয়োজন। সেই সামগ্রিক আলোচনায় না গিয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করা যাক। 

এক সময় মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষার কারণে লেখাপড়া করত ও যে প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানার্জনের সুযোগ বেশি সেখানে ভর্তি হতে চাইত। লেখাপড়ার পর কী চাকরি পাওয়া যাবে, তা নিয়ে চিন্তা কম ছিল। মধ্যমেধার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চাকরির ভাবনা বেশি কাজ করত। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে চাকুরিজীবী মানুষ তৈরি করতে চেয়েছিল, তাই সেটাই আমাদের অধিকাংশের মনে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে আজও স্থায়ী হয়ে আছে। এখন সব ধরনের ছাত্রছাত্রী ও তাদের বাবা মায়েদের অধিকাংশই লেখাপড়াকে শুধু রোজগার পাবার লাইসেন্স হিসেবে দেখেন।  ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হলে ভালো রোজগার হবে, তাই এই বিষয়গুলি পড়ার ভালো কলেজে ভর্তির জন্য শৈশবের সব আনন্দ বিসর্জন দিতেও এরা প্রস্তুত। 

ভালো কলেজ, যেমন আইআইটি, এনআইটি ইত্যাদিতে ভর্তি হবার পরীক্ষার প্রশ্ন খুব কঠিন, তাই ছোটবেলা থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে; আর এই প্রস্তুতি স্কুলের পড়া দিয়ে হবে না, কোচিং'এর ব্যবস্থা করতে হবে, তা সে যত অল্প বয়স থেকেই বা যত বেশি টাকাই খরচ হোক না কেন– এ ভাবে ভাবেন না এমন অভিভাবক বিরল। অথচ, এটা কেউ ভেবে দেখেন না যে, প্রশ্নপত্র সোজা বা কঠিন হবার সাথে ভর্তির প্রতিযোগিতা কঠিন হবার কোনও সম্পর্ক নেই। আইআইটি গুলিতে সব মিলিয়ে ৬০০০ জনের মতো ভর্তি হতে পারে, আর ভর্তির পরীক্ষা দেয় অন্তত দশ লাখ। তাহলে ভর্তি হতে পারার সম্ভাবনা কত হল? প্রতি ১০০০ জনে মাত্র ৬ জন। তাহলে আমাদের কি এটা বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে যে, বাকি ৯৯৪ জনের ফিজিক্স, অঙ্ক  কেমিস্ট্রির সেই জ্ঞান নেই যা ইঞ্জিনিয়ারিং'এর পড়া শুরু করতে প্রয়োজন। এটা তো কখনই কোনও যুক্তিতেই গ্রাহ্য হতে পারে না। অতএব, প্রশ্নপত্র কঠিন হোক বা সহজ, ভর্তি হতে পারার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা আপাদমস্তক রাশিবিজ্ঞানের সম্ভাব্যতার ব্যাপার। মেধার সাথে এর কোনও যোগ নেই।

ধরা যাক, আমাকে কয়েন টস করতে বলা হল। আমি কি বলতে পারব, হেড না টেল পড়বে? পারব না, কারণ এটা সম্ভাব্যতার প্রশ্ন। এই ঘটনার সম্ভাব্যতা ০.৫, অর্থাৎ ১০০০ বার টস করলে ৫০০ বার হেড পড়ার সম্ভাবনা। আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে আইআইটি'তে ভর্তি হতে পারার সম্ভাবনা ০.০০৬, অর্থাৎ ১০০০ জনের মধ্যে ৬ জনের সুযোগ পাবার সম্ভাবনা। এবার কেউ যদি বলে যে তোমাকে টস করে হেড-ই ফেলতে হবে, তার জন্য তোমাকে কোচিং দেওয়া হবে, আমরা কি সেটাকে সম্ভব বলে মেনে নেব? নেব না, কারণ আমাদের সাধারণ বুদ্ধি বলে যে এটা সম্ভব নয়। কোনও ট্রেনিং'ই এমন ভাবে টস করতে শেখাতে পারে না যাতে হেড পড়বেই। তাহলে আমরা এটা কী করে মেনে নিই যে এমন কোচিং সম্ভব যাতে আইআইটি'তে ভর্তির পরীক্ষায় সফল হবার ট্রেনিং পাওয়া যায়, যে সাফল্যের সম্ভাব্যতা ০.০০৬, টস করলে হেড পরার সম্ভাব্যতার তুলনায় প্রায় ১০০০ ভাগ কম! অথচ চারপাশে তাকালেই দেখছি, শিক্ষিত বাবা মায়েরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য নিজেদের সন্তানের শৈশব ও কৈশোরের স্বাভাবিক মেধা ও অনুসন্ধিৎসাকে লক্ষ লক্ষ টাকা কোচিং'এ ভর্তির মাধ্যমে খরচ করে নষ্ট করে চলেছেন।

শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মনে হাজারও প্রশ্নের জন্ম হয়, হাজারও স্বপ্নের ভাঙাগড়া চলে, আর এভাবেই গড়ে উঠতে থাকে ব্যক্তিত্ব, যা আরও বেশি প্রশ্ন করে, আরও বেশি স্বাধীন ভাবে ভাবতে চায়। লেখাপড়ার বিষয়গুলি, যেমন, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান– এই স্বাধীন চিন্তার যাত্রাপথে সাহস, যুক্তি আর স্বপ্নের জোগান দিয়ে চলে। এই স্বপ্ন, যুক্তি আর সাহসে ভর করেই ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেয়, ভালো অথবা খারাপ ফল করে, আর নতুন স্বপ্ন আর সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু কখনও ‘ব্যর্থ’ হয় না। কোচিং নির্ভর আজকের শিক্ষাব্যবস্থা এই গড়ে উঠতে থাকা ব্যক্তিত্বকে শিকলে বেঁধে ধ্বংস করতে চায়। 

রাজস্থানের কোটা শহরে কোচিং'এর এমন এক যাঁতাকল তৈরি হয়েছে যা ছাত্রদের চিন্তাশীল ও স্বপ্নসন্ধানী মানুষ থেকে যন্ত্রে পরিণত করে। যে যন্ত্র ভাবে না, প্রশ্ন করে না, স্বপ্ন দেখে না, শুধু মুখস্থ করে আর নির্দেশ পালন করে। গাদা গাদা প্রশ্ন আর তার উত্তর মনে রাখা যার কাজ। কিশোর মন স্বাভাবিক ভাবেই এটা মেনে নিতে পারে না, তার মনের ভেতরে তোলপাড় চলতে থাকে। যে অনুসন্ধিৎসু মন একঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে কোচিং'এ এসেছিল, সে যখন শিখতে চায়, প্রশ্ন করতে চায়, ঠিক তখনই তাকে অক্ষম, দুর্বল, নির্বোধ বলে দেগে দিতে থাকে এই ব্যবস্থা। বাবা মায়ের আশা আর টাকা- দুটোই নষ্ট হচ্ছে যেন তারই অক্ষমতার জন্য। কিশোর মন এছাড়া আর কিছু যখন ভেবে পায় না, তখনই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এ এক পরিকল্পিত হত্যা যোজনা– যা কিশোর মন পুরোপুরি গড়ে ওঠার আগেই তাকে বোঝাতে চায় যে সে ব্যর্থ কারণ সে অক্ষম। এই কোচিং ব্যবস্থা এক মাফিয়াতন্ত্রের জন্ম দেয়, যে তন্ত্রে স্কুল, কলেজ, সরকার ও সর্বোপরি সমাজ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন সেই সব গৃহ-শিক্ষকেরা, যাঁরা স্কুলের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের কৌতূহল মেটাতেন, সমস্যার সমাধান করতেন, স্বপ্ন দেখাতেন, আর যাঁদের সান্নিধ্যে ছাত্রছাত্রীরা পেত সেই আশ্রয় যা কৈশোরকালে সব থেকে বেশি প্রয়োজন।

যে কাল্পনিক উজ্জ্বল জীবনের হাতছানি এই হত্যাপ্রকল্পের চালিকাশক্তি এবার তার দিকে তাকানো যাক।  তথ্য হল- 

১) আইআইটি থেকে ডিগ্রি পাওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের ২৫ শতাংশ ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ থেকে কোনও চাকরি পায় না; 

২) মাত্র ১০ শতাংশ মোটা মাইনের চাকরি পায়; 

৩) আর বাকিরা এমন মাইনের চাকরি পায় যা অন্য যে কেউ আইআইটি'তে না পড়েই পেয়েছে। 

এক তথাকথিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের টানে ছুটতে ছুটতে আমাদের ছেলেমেয়েরা হারিয়ে চলেছে তাদের সৃজনশীল মন, বাবা মায়েরা হারাচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন, অলীক স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবার ভয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে কোমল মন। আর অন্যদিকে সীমাহীন সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠছে কোচিং মাফিয়া। 

২০০৫ সালে প্রকাশিত জাতীয় পাঠ্যক্রম কাঠামো যা অধ্যাপক যশ পাল রিপোর্ট নামে বেশি পরিচিত, সেখানে এই কোচিংতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল ও এর সাথে লড়াই করার জন্য পড়ানোর পদ্ধতি ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি, কোচিং মাফিয়ার শক্তি বেড়েছে। আর আজ যখন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ একই সংস্কারের কথা বলে, কোচিং'এর রমরমা কমানোর কথা বলে, তখন বোঝা যায় এই সমস্যা কতটা গভীর। তবে এই সমস্যার সমাধানে সরকার যে উদ্যোগ নেবে না তা বোঝা যায় যখন এই কোচিং ব্যবসার পৃষ্ঠপোষককে লোকসভার স্পিকারের আসনে দেখতে পাই। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের সম্মিলিত উপলব্ধি ও গণআন্দোলনই এই ব্যবস্থাকে পরাস্ত করার একমাত্র পথ।


Sunday, 13 August 2023

‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও’

দুটি দৃশ্যপট বলছে, পালাও পালাও

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

‘শিক্ষা জগৎ’ নিয়ে কথা বলার আমার কোনও ‘হক’ নেই। কারণ, আমার সঙ্গে সে জগতের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনও যোগাযোগ নেই; আমি নিতান্তই ছাপোষা এক কর্মজীবী নাগরিক, যার চারপাশ নিয়ে সামান্য কিছু কৌতূহল আছে মাত্র, যেমন আর পাঁচজনের থাকে। আর সেই সুবাদে মাঝেসাঝে কিছু লিখে ফেলা, যেমন মাঝি-মাল্লারা নৌকো বাইতে বাইতে গান করেন, অথবা শহুরে-গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষেরা নিজ নিজ কাজের ফাঁকে কেউ কেউ এটা-সেটা বলেন বা লেখেন।

তবুও এক সহ-নাগরিক, যে তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি- যখন সে কারও পাকা ধানে মই দেয়নি, কারও সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি, কাউকে কটু কথা পর্যন্ত বলেনি, এক নতুন শিক্ষা প্রাঙ্গণে সে এসে পৌঁছেছে মাত্র- তাকে ঠাণ্ডা মাথায় সেখানেই হত্যা, সে তো শুধু শিক্ষা জগতের বিষয় আর থাকে না, তার বাপ-মা, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহ-নাগরিক সহ সকলেরই এক মর্মন্তুদ আর্তনাদ হয়ে ওঠে।

এই মুহূর্তে আর্তনাদ ছাড়া আর অন্য কিছু প্রকাশেরও নেই। শুধু, থেকে থেকে দুটি দৃশ্যকল্প মনের মধ্যে গুমরে উঠছে। তাড়া করছে। বলছে, পালাও, পালাও। আমি পালাচ্ছি, কিন্তু সেই দৃশ্যপট আমার পিছু ছাড়ছে না। আমিও কি স্বপ্নদীপের মতো আতঙ্কে কোনও উচ্চতল থেকে ভূপতিত হব? নাকি, আমাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে খাদের গভীরের ওই পাথরের ওপর?  

দৃশ্য:

অউসভিৎজ নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প

মাথায় কদম ছাঁটের চুল, হাতের মুঠোয় যা ধরা যায় না, দাঁড়ি-গোঁফ ছাঁটা, স্ট্রাইপড পাজামা পরে কোঠরাগত চোখ নিয়ে হাজারে হাজারে বন্দী অউসভিৎজের বন্দী শিবিরের স্বল্প চত্বরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। সূর্যাস্তের আগেই তাঁদের ফিরে যেতে হবে বন্দীশালায় প্রতিজনের জন্য বরাদ্দ চার বাই চার ফিটের পরিসরে। পরে একে একে তাঁদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, অথবা, সামান্য এদিক-ওদিক মনে হলেই বুকে গুলি বিদ্ধ হবে। তাঁরা কেউ ইহুদী, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ গণতন্ত্রী, কেউ বা যুদ্ধবন্দী। তাঁদের সারিবদ্ধ ‘সাবধান’ ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে গুনতি চলে, অথবা দেখে নেওয়া হয়, কারও চোখে কোনও সংশয় বা প্রতিস্পর্ধার ঝিলিক মাত্র আছে কিনা!

হের হিটলার!!

স্বপ্নদীপের আমি সহ-নাগরিক। খুব ভয়ে ভয়ে নিবেদন করি, এই যে বছরের পর বছর নবাগতদের এক অংশের (হোস্টেল নিবাসী) মধ্যে দেখা যাচ্ছে, একই কায়দায় কদম ছাঁটে তাদের চুল-ছাঁটা, তা কি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কারও নজরে পড়েনি? কেউ কি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেসও করেননি যে, এইভাবে বহুজনের কেন চুল-ছাঁটা! খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজ অথবা বন্ধুদের জমায়েত ফেলেও কেন তাদের সূর্যাস্তের আগে (সন্ধ্যা ৬টা) হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে? রাষ্ট্রের ভেতরে আরও এক রাষ্ট্র? কাদের হুকুম? সে হুকুম না মানলে কী হয়?

দৃশ্য:

তোতা-কাহিনী

‘এক-যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে।

রাজা বলিলেন, ‘এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়'।

মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও'।

অতএব, শিক্ষার আয়োজন। ইউরোপ ও পরবর্তীকালে ভারত সহ তাদের অন্যান্য উপনিবেশে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে এক-একটি প্রশস্ত ঘরে সারি সারি বেঞ্চ পেতে ব্ল্যাকবোর্ডে চক-ডাস্টার সহযোগে শিক্ষকের পড়ানোর যে পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল, তার সঙ্গে সাযুজ্য ছিল সে সময়ের ম্যানচেস্টার ও অন্যত্র গড়ে উঠতে থাকা শিল্প সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর। কাজের সময় কোনও কথা নয় (ক্লাস চলাকালীনও তাই), নির্দেশিত কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পারদর্শিতা অর্জন (শিক্ষকের নির্দেশে মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে পরীক্ষায় সাফল্য), কাজের ক্ষেত্রে কঠিন-কঠোর শৃঙ্খলা (ক্লাসরুমেও ছাত্রদের বিধিবদ্ধ অবস্থান) ইত্যাদি ইত্যাদি কারখানার যে নিয়মমালা চালু ছিল, তারই আদলে সর্বজনীন ‘শিক্ষা’র আয়োজন। যাতে, লিখতে-পড়তে পারে এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ শ্রমিক ও কাজের লোক পাওয়া যায়। অর্থাৎ, উদ্দেশ্যটাই ছিল, শিল্প ও তার আনুষঙ্গিক কাজের জন্য উপযুক্ত শ্রমবাহিনীর জোগান দেওয়া।

পরে সে ‘শিক্ষাব্যবস্থা’র প্রভূত বিবর্তন হয়েছে। আমরা দক্ষতার আরও উচ্চশিখরে পৌঁছেছি। কেরানি, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক, লেখক, প্রযুক্তিবিদ, আমলা, নলেজ-ওয়ার্কার, তথ্য প্রযুক্তির কর্মী এমনতর বহুবিধ প্রয়োজনীয় বিদ্যা-অর্জিত, দক্ষ শ্রমবাহিনীর জোগান পেয়েছি ও পাচ্ছি। সাধারণ ভাবে এ ছিল নেহাতই উপযুক্ত শ্রমের এক নির্মাণ-প্রক্রিয়া, যারা নিয়োজনের ভিত্তিতে নানাবিধ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এক যাপনচিত্র গড়ে তুলেছিলেন। এর সঙ্গে পেশাগত দক্ষতার সম্পর্ক আছে। মানবিকতা অথবা মানব গুণ অর্জনের কোনও সম্পর্ক আছে কী? নিছক কেরিয়ার গড়তে, ভালো চাকরি পেতে, ভাল রোজগার ও আয়েসি জীবনযাপনের উদ্দেশ্যেই তো এইসব বিদ্যা অর্জন। যে শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থোপার্জনই জীবনের মোক্ষ, তাকে কি ‘শিক্ষা’ নামে অভিহিত করা যায়? অবশ্য, এক অর্থে তা শিক্ষা, কারণ, শিখে তবে তো অর্থোপার্জন। কিন্তু ‘শিক্ষা’ বলতে যে মানবিকতা, মহত্ব ও গরিমা আরোপ করা হয়, তা কি এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অর্জিত হয়? যেন তেন প্রকারেণ অর্থ উপার্জনই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে মানবিক গুণের সঙ্গে কি তার সখ্যভাব থাকে? একবার এক পণ্ডিতকে এও বলতে শুনেছি, স্বামী বিবেকানন্দ তো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় খুব গড় মাপের নম্বর পেয়েছিলেন। তাহলে তিনি কি অর্ধশিক্ষিত ছিলেন?

শিক্ষা ও বিদ্যা অর্জনের ফারাকটিকে না বুঝলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সাফল্যের ওপর একচেটিয়া মহিমা আরোপ করে আসলে দক্ষতা অর্জনকেই শিক্ষার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এখানেই বিপদটা লুকিয়ে আছে। উচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত কোনও জনকে আমরা নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হতে দেখলে ভাবি, উনি এত ‘শিক্ষিত’ হয়েও কেন এমন অমানবিক কাজ করলেন। আসলে তো তিনি দক্ষতা অর্জনের দৌড়ে উচ্চস্তরের সাফল্য পেয়েছেন! সম্ভবত, তার সঙ্গে ‘শিক্ষার’ তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। আর সে কারণেই, যে চাষী বা মুটে মজুরের তেমন কোনও সার্টিফিকেট বা ডিগ্রি নেই, তার মধ্যে আমরা শিক্ষার পরিব্যাপ্তিকে খুঁজে পাই না। তিনি মানুষ ভাল হলেও, তাঁর ডিগ্রি না থাকায় তিনি হয়ে যান ‘অশিক্ষিত’ বা ‘মূর্খ’।

আজকের সোশ্যাল মিডিয়া ‘শিক্ষা’ ও ‘বিদ্যা’র এই তফাত’টাকে আরও প্রকট করেছে। তা এই অর্থে, কাউকে প্রকাশ্যে লিঞ্চিং করতে হলে, তার ‘লাইফ হেল’ করে দিতে হলে, দেখা যায়, নানা স্তরীয় বিদ্বান মানুষেরাই সব থেকে কুৎসিত লাঞ্ছনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় করেন। মাইকেল জে স্যান্ডেল তাঁর ‘The Tyranny of Merit’ গ্রন্থে বিদ্বান ও মেধাজীবীদের নিপীড়নের এমত বিভিন্ন কাহিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।

১৭ বছর বয়সী স্বপ্নদীপ ছিল মফস্বলের এক সরল মনের ছেলে। একরাশ স্বপ্ন ও বিস্ময় ভরা চোখে সে প্রবেশ করেছিল এক এলিট প্রতিষ্ঠানের গর্ভগৃহে। তাকে কারা মারল? কিছু ‘শিক্ষিত’ ছেলে? ‘শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠান? মেধার আত্মগর্বী নিষ্ঠুরতা?

‘রাজা পাখিটিকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।

বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণ হাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।’

 

Thursday, 10 August 2023

অমৃতকালের লজ্জা

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর প্রবল আঘাত

সোমেন চক্রবর্তী



সংসদের দুই কক্ষে পাস হয়ে গেল দিল্লি সার্ভিসেস বিল ২০২৩। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র বনাম রাজ্যের ক্ষমতা নিয়ে আমাদের দেশে কম দড়ি টানাটানি হয়নি। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের বিবর্তন একটি দেশের অঙ্গ রাজ্যগুলিকে অনেক বেশি স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ দেওয়ার কথাই বলে। অতএব, ইতিহাসের কিছু রেফারেন্স টেনে আমরা শুরু করতে পারি। 

রাষ্ট্রই সবচেয়ে শক্তিশালী হবে নাকি তা হবে আরও অনেক শক্তিধর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরই এক প্রতিনিধি মাত্র- এই নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে বিতর্কের সূচনা। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হ্যারল্ড লাস্কি রাষ্ট্রকে কখনই একমেবোদ্বিতীয়ম প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি  দেননি। এর বিপরীতে সমসাময়িক সময়ে ইতালির তৎকালীন সর্বাধিনায়ক মুসোলিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের আগে বা পরে কিছু হয় না; রাষ্ট্রই সর্বশক্তিমান।

এই বিতর্কের প্রায় এক দশক আগে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হলে নব্য সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় সংবিধান রচিত হয়। এক অভাবনীয় নিয়মকানুনে ঠাঁসা সেই সংবিধান। যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোয় সব প্রদেশকে সেখানে দেওয়া হয়েছে স্বনিয়ন্ত্রণ বা স্বাধীনতার অধিকার; যেখানে রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে কোনও প্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করতে পারে। এমনতর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনও প্রদেশ বেরিয়ে তো যায়ইনি বরং বেঁধে বেঁধে থেকে এক পরাক্রমশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল কয়েক দশক ধরে। অতুলনীয় সেই যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোয় চিড় ধরল যখন জোসেফ স্তালিন প্রাদেশিক শাসনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করতে বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। ছাইচাপা আগুনের বহিঃপ্রকাশে কয়েক দশক লাগল বটে, তবে তা যখন নিজেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপে সামনে নিয়ে এল, তার প্রবল পরাক্রম কেন্দ্রানুগ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অচিরেই ভেঙেচুরে তছনছ করে দিল।

উল্টোদিকে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শিখিয়ে ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বন্টন করেই দেশ গড়ে তুলতে হবে। আমেরিকার তেরোটি প্রদেশ সেদিন যূথবদ্ধ হয়ে ‘United States of America’র জন্ম দিয়েছিল। প্রদেশগুলি সেখানে অত্যন্ত রকম স্বাধীন আবার পাশাপাশি ছিল শক্তিশালী মার্কিন রাষ্ট্র। অনেক বেশি প্রাদেশিক স্বশাসন এবং যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তুলে এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম হয় সদ্য স্বাধীন আমেরিকায়। গত আড়াইশো বছর ধরে সেই যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা কিন্তু নিজের জায়গায় আজও সমাসীন হয়ে রয়েছে।

দিল্লি রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার যে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ বেশ কয়েক বছর হল শুরু হয়েছে, তাতে ইতিহাসের এই উদাহরণগুলি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। দিল্লি চিরকাল কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ছিল না। স্বাধীনতার পরেও বহু বছর তা ছিল একটি প্রদেশ। পরে তা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয় এবং ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাকে পুনরায় প্রাদেশিক শাসনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার দিল্লি প্রদেশকে কতটা ক্ষমতা দেবে তা ঠিক না করতে পেরে তাকে বস্তুত একটি বিকলাঙ্গ প্রদেশে পরিণত করে। আইনের দৃষ্টিতে দেখতে তাকে প্রদেশের মতো হলেও সে আসলে একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। যেন এক সোনার পাথরবাটি। আজকের কেন্দ্রীয় সরকার সেই অসম্পূর্ণ আইনি ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ফলত দিল্লিকে ব্যবহারিক ভাবে এখন একটি নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা শাসিত কেয়ার-টেকার সরকারে পরিণত করেছে।

বলাই বাহুল্য, দিল্লি সার্ভিসেস বিল, ২০২৩ (রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর গেজেট নোটিফিকেশন দ্বারা আইনে পরিণতি পাবে) সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের আওতার বাইরে রেখে দিয়েছে। কোন আমলা কোন পদে আসীন হবে বা সেখানে কতদিন থাকবে তা এখন ঠিক করবে কেন্দ্র সরকার। অন্যদিকে জনগণকে সেবা ও সুশাসন দেবার দায়িত্বে থাকবে একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকার। আবার শাসনের ব্যাপারে যদিও মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিতে দায়বদ্ধ কিন্তু সে সব খণ্ডন করে দেবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা উপ-রাজ্যপালের হাতেই থাকবে। একেই কি বলে কিম্ভূতকিমাকার?

১৬০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজ চিন্তাবিদ থমাস হবস বলেছিলেন যে, সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা দিলে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে, তাই ক্ষমতা সর্বশক্তিমান রাজার কাছে গচ্ছিত রাখা প্রয়োজন। তার প্রায় দুশো বছর পরে আরেক ইংরেজ উদারনীতিবাদী জন স্টুয়ার্ট মিল উপনিবেশের 'অশিক্ষিত' মানুষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিপন্থী ছিলেন, কারণ তারা গণতন্ত্রকেই নাকি রক্ষা করতে পারবে না। সমাজ কিন্তু তারপর আরও প্রায় দেড়শো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু শাসকের দুশ্চিন্তা এবং জনগণ সম্পর্কে তাদের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখনও বহু যোজন দূরে। দিল্লি সার্ভিসেস বিল ২০২৩ তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে সমস্ত পদক্ষেপ কিন্তু এখনও পর্যন্ত আইনানুগ। তবে তা সংবিধানের বিপক্ষে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব সর্বোচ্চ আদালতের। ২০০৭ সালের বিখ্যাত Koelho মামলায় নির্ধারিত হয়ে গেছে যে, সংসদ কৃত আইন সংবিধানের মূল ভিত্তিকে লঙ্ঘন করছে কিনা তা নির্ধারণ করবে দেশের উচ্চতম আদালত |

এই বিল মোতাবেক, বর্তমানে দিল্লির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত প্রাদেশিক আইনসভা কোনও আইন পাশ বা নীতি নির্ধারণ করলে অথবা কোনও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও উপ-রাজ্যপাল তাতে সম্মতি দিলে তবেই তা প্রণয়ন যোগ্য হবে; এবং সরকারি আমলারা সে ব্যাপারে অনুগ্রহ করে সহায়তা করলে তবেই সেই সব আইন, নীতি বা কর্মসূচি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। আমলাদের উপর যেহেতু প্রাদেশিক সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না, তাই তাদের বাধ্য করারও কোনও রাস্তা বাস্তবত থাকছে না। তাদের কাজের বাৎসরিক মূল্যায়নের ব্যাপারে  প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা শুধু খাতাকলমে থাকবে মাত্র। সেই আমলারা কবে, কতদিন ছুটিতে থাকবে তাও বস্তুত ঠিক করবে কেন্দ্র সরকার। 

(বর্তমান এই বিলটি ২০২৩'এর মে মাসে জারি করা একটি অধ্যাদেশের আইনি রূপান্তর মাত্র। যেহেতু তা নিয়ে সেই সময়ে 'একক মাত্রা'র পডকাস্টে বিস্তারিত বলেছিলাম, তাই ওই অধ্যাদেশ বা বর্তমান বিল নিয়ে নতুন করে আর বলছি না। উৎসাহী পাঠকেরা এই লিঙ্কে তা শুনে নিতে পারেন: https://www.ekakmatra.in/delhi-govt-ordinance/ )

বর্তমান আইনের আরেকটি বিপজ্জনক দিক হল যে, এই আইনের বিভিন্ন ধারা যদি পরবর্তীকালে পর্যাপ্ত মনে না হয় এবং কেন্দ্র সরকার যদি মনে করে আরও নতুন কিছু নির্দেশ বা নিয়মাবলী জারি করা দরকার, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। বকলমে, যদি কেন্দ্র সরকারের মনে হয় যে এই আইনকে এড়িয়ে গিয়ে দিল্লির সরকার কোনও কর্মসূচি বা অন্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তবে তা আটকাতে যে কোনও পদক্ষেপ তারা নিতে পারবে। বস্তুত, প্রাদেশিক সরকারের প্রায় কিছুই আর স্বাধীনভাবে করবার সুযোগ থাকছে না। অতএব, এই অভিনব যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে- হয় নর্বাচিত সরকারকে কেন্দ্রের পদলেহন করে টিকে থাকতে হবে, নয় পদত্যাগ করে জন আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হবে। 

উল্লেখ্য, এই আইনের সঙ্গে লাগোয়া 'উদ্দেশ্য ও কারণ' নামক শীর্ষকের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, দিল্লি সম্পর্কিত যে কোনও সিদ্ধান্ত শুধু দিল্লিবাসী নয় বরং তা গোটা দেশকে প্রভাবিত করে এবং তা দেশের সম্মান, ভাবমূর্তি, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গর্বকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার ক্ষতিকারক প্রতিফলন হতে পারে এবং সেই কারণেই নাকি কেন্দ্রের এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এও বলা হয়েছে যে, দেশের রাজধানী হবার কারণে দিল্লির একটি বিশেষ অবস্থান ও বিশেষত্ব রয়েছে, সে কারণে দিল্লিতে সুশাসন সুনিশ্চিত করা জরুরি। আর সে জন্যই নাকি সংবিধান কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে রাষ্ট্রপতির এক্তিয়ারে রাখবার ব্যবস্থা রেখেছে।   

প্রশ্ন হল, যে প্রশাসনিক জটিলতা বা দ্বিমত আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন, তাকেই যখন আইনের প্যাঁচে বেঁধে রাখবার প্রয়াস চলে তখন তা আর শুধুমাত্র আইনি বিষয় থাকে না। তার পিছনে গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অবশ্যই নিহিত আছে। 

দিল্লি সার্ভিসেস বিলের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখবার লড়াই। কারণ, এই বিলকে অনুসরণ করে ভবিষ্যতে বাকী রাজ্যগুলির ওপরেও নিয়ন্ত্রণের কড়া দাওয়াই নেমে আসতে পারে। ইতিমধ্যেই বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালের দৃশ্যমান অতি-সক্রিয়তা হয়তো এই পরিকল্পনারই অঙ্গ। তবে, কেন্দ্রীকরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর লড়াইয়ে শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থারই জয় হবে। রাষ্ট্র নির্মাণের ইতিহাস বারবার এই সত্যকে প্রমাণিত করেছে। এ লড়াইকে সফল করতে নাগরিক সমাজকে এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতেই হবে। এখনই তো ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনর্গঠনের সময়। রাস্তা নিশ্চয়ই খুবই কঠিন তবুও আশাতেই তো বেঁচে থাকে চাষা।


Monday, 7 August 2023

হিন্দুত্ববাদীদের নয়া ল্যাবরেটরি?

আতঙ্কে হরিয়ানা 

শোভনলাল চক্রবর্তী



হরিয়ানার নুহ জেলায় শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পার্শ্ববর্তী গুরুগ্রাম শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকায় দিল্লিতেও সতর্কাবস্থায় আছে পুলিশ, 'জোরদার' করা হয়েছে নিরাপত্তা। গুরুগ্রাম থেকে রাজধানী দিল্লির দূরত্ব ২০ কিলোমিটারেরও কম। 

প্রথমে গুরুগ্রামের ৭০ নম্বর সেক্টরে একটি আবাসিক কমপ্লেক্সের পাশে বেশ কয়েকটি দোকান ও ঝুপড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।  বিক্ষিপ্ত ভাবে বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটার পর প্রশাসন বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করে। অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা এড়াতে কর্তৃপক্ষ পেট্রল ও ডিজেলের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করে। নাগরিকদের গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো খবরও বিশ্বাস না করার অনুরোধ জানিয়েছে তারা। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।        

এরপর দাঙ্গা বিধ্বস্ত নুহ’র পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেয় হরিয়ানা সরকার। নতুন পুলিশ সুপার রাতে দায়িত্ব নিয়ে পরের দিন সকাল থেকে শুরু করেন বুলডোজার অভিযান। জেলার তাউরা এবং সোনা এলাকায় বুলডোজার দিয়ে রাস্তার ধারে থাকা ঝুপড়িগুলি একে একে ভেঙে দেওয়া হতে থাকে। একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের খবর অনুযায়ী, তাউরা এবং সোনা মূলত মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা। এখন ওখানকার বাঙালি মুসলমানদের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে তাদের উপর জুলুমের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন হাই কোর্টের রায়ে বুলডোজার অভিযান বন্ধ হয়েছে, কিন্তু তাই বলে ওই অঞ্চলের মানুষ নিশ্চিন্ত হয়েছেন, এটা বলা যাবে না। কারণ, গুজরাটের মতোই হরিয়ানা একটা পরীক্ষাগার যেখানে ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলবে, যতক্ষণ না উপরতলা থেকে তা বন্ধের কোনও নির্দেশ আসছে। 

পুলিশ সুপারকে যখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন যে, ঝুপড়ির বাসিন্দারা কি দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন, তখন তাঁর জবাব, ‘সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ঝুপড়ির বাসিন্দাদের কারও নাম কি দাঙ্গার এফআইআর'এ আছে? পুলিশ সুপার বলেন, ‘সেটা আমরা খতিয়ে দেখব।’ অর্থাৎ, কোনও কিছু খতিয়ে না দেখে, বিনা তদন্তে, শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার জন্যই যে অভিযান তা ক্রমশ স্পষ্ট। পুলিশ সুপার উল্টে এক নতুন কাহিনী ফেঁদে বলেন যে, ঝুপড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত নাকি আগে থেকেই নেওয়া হয়েছিল, এখন তা কার্যকর করা হচ্ছে মাত্র। প্রশ্ন উঠেছে, এইসব ছেলে ভোলানো তত্ত্ব দিয়ে আর কি বেকুব বানানো যাবে? 

সোনা ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে বাদশাপুর এলাকার সেক্টর ৬৬-র হাইওয়ের পাশে ঢালু জমিতে রয়েছে একটি মাত্র দোকান। তার পিছনে শ’দেড়েক টিনের ঘর নিয়ে বাঙালি ‘বস্তি’, যেখানে ঢুকতে বা বেরতে গেলে ওই  দোকানই কার্যত প্রবেশদ্বার। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সেই প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে লাল গামছা দিয়ে মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা অল্পবয়সী সব ছেলে। হাতে মোটা লোহার রড। খোলা শুধু চোখ দু’টো, যেন জ্বলছে। তবে তারা একেবারে নিস্পন্দ। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। তারা ওরকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কেন, কারও নির্দেশের অপেক্ষায় কিনা, সে সমস্ত বোঝার মতো সাহস নেই বাঙালি বস্তির দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর। দুপুরে নিকটবর্তী বহুতলের কয়েকটি ফ্ল্যাটে কাজ সেরে ফেরার পথে দোকানের সামনে এই অপরিচিত দৃশ্য দেখে বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল ওঁদের। দৌড়ে হোঁচট খেতে খেতে ফিরে দেখেন, সবার দরজা আঁটা। যেন 'শোলে' ছবিতে গব্বরের দলবল ঢোকার ঠিক আগের রামগড় গ্রাম। পরে তাঁরা শুনতে পান যে, সকালেই নাকি ঠিকেদার এসে বলে গিয়েছিল মুরুব্বিদের ডেকে, কেউ যেন আজ চৌকাঠ না পার হয়। হলে ‘খবর’ আছে। দেড় কিলোমিটার দূরে বড় রাস্তার উপরে কাদরপুরের বাজারে ততক্ষণে প্রকাশ্য দিবালোকেই আগুন লাগানো হয়েছে। সেই ধোঁয়া এখনও কাটেনি। ফলে, এর পরে কী হবে কেউ জানে না। এই আতঙ্কের দিন-রাত ওঁরা পার করছেন বিগত চার-পাঁচ দিন ধরে। আজও থমকে আছে মালদহ-দিনাজপুর থেকে আসা এই 'মুসলিম বস্তি'।

তৃণমূলের রাজ্যসভার সদ্য নির্বাচিত প্রতিনিধি সমিরুল ইসলাম গিয়েছিলেন দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চল  পরিদর্শনে। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট জমা করেছেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে রাতে পুলিশ এসেছিল বস্তির ঘরে ঘরে। নমাজ পড়তে যেতে নিষেধ করছে তারা। ভয়ে কেউই নমাজ পড়ছেন না। কারণ, নাম ধরে, আধার কার্ড দেখে মুসলমানদের বেছে নিচ্ছে দাঙ্গাকারীরা।

রাজধানীর পাশেই এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ সরকার আশা করছে, তা ঝুঁকিতে ফেলেছে হরিয়ানার এমন পরিস্থিতি। দিল্লির 'ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ'এর ফেলো তারা কার্থা বলেন, ‘দৃষ্কৃতকারীদের লক্ষ্য উত্তর ভারতের এই বাণিজ্যিক কেন্দ্র (হরিয়ানা)। সরকারের উচিত যে কোনও মূল্যে এই রাজ্যকে রক্ষা করা।’ কিন্তু কে করবে রক্ষা, যদি রক্ষকই হয়ে ওঠে ভক্ষক। 

বেছে বেছে মুসলমান মালিকদের দোকানে আগুন লাগানো হচ্ছে। ওই অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে সারা দেশকে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ কোনও রাজনৈতিক দল দেখায়নি। সেই আদালতের হস্তক্ষেপেই শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। ক্রমশই ভারতীয় গণতন্ত্র থেকে প্রশাসন বস্তুটি উবে যাচ্ছে, তার জায়গা নিচ্ছে জঙ্গলরাজ। ফলে বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে আদালতকে। এর পরিণাম যদি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এখনও সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে আগামী দিনে সমূহ বিপদ!


Wednesday, 2 August 2023

ঘৃণার রাজনীতি

মণিপুর থেকে গুরুগ্রাম

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 


জয়পুর-মুম্বাই এক্সপ্রেসে আরপিএফ কনস্টেবল চেতন সিং প্রথমে তার উর্ধ্বতন সহকর্মীকে হত্যা করে তারপর ঠাণ্ডা মাথায় চার-পাঁচটি কোচের মধ্য দিয়ে বন্দুক হাতে হাঁটতে হাঁটতে আরও তিনজন যাত্রীকে বেছে বেছে গুলি করে খুন করল। চেতনকে গ্রেফতার করার পর বাহিনী সাফাই দিল, সে মানসিক ভাবে অসুস্থ। অথচ, সেই অসুস্থ সেনার হাতে বাহিনী অস্ত্র তুলে দিয়ে তাকে ডিউটিতে পাঠাতে কসুর করেনি। উপরন্তু, বেছে বেছে শুধুমাত্র মুসলমানদের চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করতেও ‘মানসিক ভাবে অসুস্থ’ চেতনের কোনও সমস্যা হয়নি। এমনকি খুন করে মোদি ও যোগীর নামে জয়ধ্বনি দিতেও সে কিছুমাত্র দ্বিধা করেনি। পরন্তু, সেই উল্লাসকে ভিডিও বন্দী করতে উপস্থিত সহযাত্রীদের নির্দেশ দিতেও তার কোথাও ছন্দপতন হয়নি। যেহেতু, বিনা প্ররোচনায় ঠাণ্ডা মাথায় যে কোনও নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে পারার মানসিকতাটাই অসুস্থতা, সে কারণেই সম্ভবত চেতনকে তুরন্ত ‘অসুস্থ’ বলে দেগে দিয়ে তাঁকে বাঁচানোর ছকটিও অতীব পরিষ্কার।

অনতিপরেই হরিয়ানার বজরঙ্গী নেতা ও পুলিশের খাতায় নথিবদ্ধ খুনে মনু মানেসর’এর নেতৃত্বে কয়েকশো লোক গত ৩১ জুলাই লাঠি, বন্দুক ও তলোয়ার হাতে ‘ব্রিজমণ্ডল জলাভিষেক যাত্রা’ নাম দিয়ে উত্তেজক শ্লোগান দিতে দিতে ঢুকে পড়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নুহ অঞ্চলে। তার আগে এই যাত্রা নিয়ে নানান প্ররোচনামূলক ভিডিও মনু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে এক বিষাক্ত আবহ তৈরি করে ফেলেছে। নুহ ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও খুন-খারাপি। সে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গুরুগ্রাম থেকে পালওয়াল ও ফরিদাবাদেও। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, দুজন হোমগার্ড সহ মোট ছ’জন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে এলাকা বিশেষে জারি হয়েছে কার্ফু ও ১৪৪ ধারা।

কে এই মনু মানেসর? হরিয়ানার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অনিল ভিজ প্রকাশ্যে যাকে বলেন, wanted criminal, রাজস্থানে যার নামে দুটি খুনের মামলা রয়েছে, বজরং দল ও গোরক্ষক সমিতির ঘোষিত নেতা, যার আহ্বানেই মিছিল ও তারপর মারদাঙ্গা। হরিয়ানা সরকার তাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ, সে প্রকাশ্যে মানেসর অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। গরু চুরির অভিযোগে সে রাজস্থানে জুনাইদ ও নাসির নামে দুই ব্যক্তিকে খুন করে আপাতত ‘ফেরার’; নুহ অঞ্চলে গোরক্ষক বাহিনীর তোলাবাজির পাণ্ডা।

হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর এক বাক্যে ঘোষণা দিয়েছেন, সমস্ত ঘটনাগুলিই ‘পূর্ব-পরিকল্পিত’ এবং ‘এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশভাক’। এবার আপলোগ সব ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’। মণিপুরের চলমান রক্তস্নাত জাতি দাঙ্গা থেকে চলন্ত ট্রেনে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে বেছে বেছে হত্যা ও তারপরেই নুহ’এ অস্ত্র হাতে মিছিল করে উন্মত্ততা- সবটাই কী ভীষণ ভাবে পরিকল্পিত। অথচ, নুহ’এ যে হিংসাত্মক গণ্ডগোল হতে পারে, তার আগাম খবর কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ অন্তত দিন সাতেক আগে প্রশাসনকে জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ঘটনা ঘটেছে এবং খট্টর’এর মতানুযায়ী পরিকল্পনা মাফিকই ঘটেছে। প্রশ্ন হল, এই পরিকল্পনাটা কার? বৃহৎ ষড়যন্ত্রটাই বা কী? দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রিয় শব্দ ‘ক্রোনোলজি’ বলছে, মণিপুর থেকে গুরুগ্রাম যেন এক তারে বাঁধা; তারপর অন্যত্র- এ যেন এক ক্রোনোলজিকাল প্রবাহ! এখন বইতে থাকবে দেশ জুড়ে। কারণ, ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচন। কেউ কেউ বলছেন পুলওয়ামা ২.০ ভার্সানের জন্য অপেক্ষার আর দেরি নেই। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকও আমাদের আরও বড় পরিকল্পনামাফিক বিপর্যয়ের জন্য দিন গুনতে বলেছেন। কারণ, তিনি পুলওয়ামার ঘটনাবলীর সময়ে রাজ্যপাল হিসেবে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।

সাধে কি আর বিরোধী পক্ষের বেঙ্গালুরু বৈঠকের দিনই তড়িঘড়ি দিল্লিতে ৩৮টা দলকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে তুলে এনে এনডিএ’এর তামাশা জমায়েত দেখাতে হয়? যখন, যে এনডিএ’র শেষ বৈঠক কস্মিনকালে কবে হয়েছিল তা কারও স্মরণেই নেই! এই অস্বাভাবিক আচরণ কি কোনও আশঙ্কা ও ভয় থেকে? কীসের ভয়? ক্ষমতা হারানোর ভয়? যিনি গর্ব ভরে সংসদে বুক চাপড়ে বলেছিলেন, ‘এক একেলা কিতনো পর ভারী পড় রহা হ্যায়’, তিনি হঠাৎ বিরোধীদের ২৬’এর পালটা ৩৮’এর খেলায় কেন মাতলেন? পরিকল্পনার সূত্রপাত কি এখান থেকেই? দিল্লির পৌর নির্বাচন এবং হিমাচল প্রদেশ ও কর্নাটকে অভাবনীয় পরাজয়ের পর দাম্ভিক বিশ্বগুরুর কি এখন একা পড়ে যাওয়ার ভয় ধরেছে? পাঁচ রাজ্যে আগত বিধানসভা নির্বাচন ও পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই কি নানান ছক তৈরির প্রয়াস?

জাতিতে-জাতিতে অথবা ধর্মে-ধর্মে বিভাজনের রাজনীতি হল সেই সহজ পন্থা যা উভয় পক্ষের ব্যাপক অংশের জনতাকে খুব সহজেই ক্ষেপে উঠতে প্রলুব্ধ করতে পারে। আর সেই উন্মত্ততার বাহনে চড়ে যে ক্ষমতালাভ, তা যেহেতু সহজলভ্য কিন্তু ভঙ্গুর, অতএব অসম্ভব নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাকে ফ্যাসিবাদই বলি বা উন্মত্ত নিপীড়ন- তা সমাজের বুকে লালন করে সুতীব্র ঘৃণা ও হিংসার এক ধারাবাহিক প্রদাহ। কারণ, এগুলিই তার টিকে থাকার ভিত্তিভূমি। এই রাজনৈতিক মানসিকতা থেকেই জয়পুর-মুম্বাই এক্সপ্রেস হয়ে ওঠে মিনি ‘অউসভিৎস (Auschwitz) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’, যেখানে চাইলেই কাউকে নিমেষে হত্যা করা যায়। হত্যাকাণ্ড যেন এক রোজকার প্রাতঃকৃত্য মাত্র!

এই খুল্লাম খুল্লা রাজনীতি যে অবাধে চলবে, আজও তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন পুলিশের থেকে কোনও অনুমতি ব্যতিরেকেই দিল্লির বিভিন্ন অঞ্চল ও বদরপুর সীমান্তের জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখল বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লেঠেল বাহিনীর ‘স্বেচ্ছাসেবকেরা’। এ আর কিছুই নয়, একদিকে সমাজের বুকে হিমশীতল ভয়কে জারিত করা, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মনের গহনে প্রতিহিংসার আগুনকে উস্কে দেওয়া। এইভাবেই এক ‘নব্য রাজনৈতিক হিন্দুয়ানা’র বয়ান তৈরি করা, যেখানে অ-হিন্দুরা সেই রাজনীতির অধীন হবে এবং হিন্দুরাও মনে করবে, এইই হল যথার্থ হিন্দুত্ব; যদি তা না হয়, অথবা, কেউ তাকে অস্বীকার করে, তবে তাদের জন্য থাকবে আধুনিকতম চলমান ‘অউসভিৎস’- হাটে-বাজারে, রাস্তাঘাটে, মহল্লায় মহল্লায়, ঘরের ভিতরে অনায়াসে ঢুকে পড়ে সবক শেখানোর হাড়-হিম করা সব কারুকৌশল!

আজ বিকেলে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী খট্টর পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, প্রত্যেক নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এত স্পষ্ট বাচন আগে কখনও কারও থেকে শোনা গেছে কী? আইটি সেল প্রধান অমিত মালব্যও আসরে নেমে একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, যা ঘটেছে সবই নুহ’এর কংগ্রেস এমএলএ’র কারসাজীতেই।

অতএব বলাই বাহুল্য, শীর্ষ আদালত যখন যথার্থ ভাবেই মণিপুরের সরকারকে তুলোধোনা করে বলে যে, আইন-শৃঙ্খলা বলে সে রাজ্যে আর কিছু নেই, সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে, তখন জয়পুর-মুম্বাই এক্সপ্রেস ও হরিয়ানার ঘটনা এই পর্যবেক্ষণ থেকে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম বলে আর মনে হয় না। ডাবল ইঞ্জিন যে কত ভয়ানক হতে পারে, এ সব তারই 'টুকরে টুকরে' নিদর্শন!