Pages

Monday, 7 August 2023

হিন্দুত্ববাদীদের নয়া ল্যাবরেটরি?

আতঙ্কে হরিয়ানা 

শোভনলাল চক্রবর্তী



হরিয়ানার নুহ জেলায় শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পার্শ্ববর্তী গুরুগ্রাম শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকায় দিল্লিতেও সতর্কাবস্থায় আছে পুলিশ, 'জোরদার' করা হয়েছে নিরাপত্তা। গুরুগ্রাম থেকে রাজধানী দিল্লির দূরত্ব ২০ কিলোমিটারেরও কম। 

প্রথমে গুরুগ্রামের ৭০ নম্বর সেক্টরে একটি আবাসিক কমপ্লেক্সের পাশে বেশ কয়েকটি দোকান ও ঝুপড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।  বিক্ষিপ্ত ভাবে বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটার পর প্রশাসন বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করে। অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা এড়াতে কর্তৃপক্ষ পেট্রল ও ডিজেলের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করে। নাগরিকদের গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো খবরও বিশ্বাস না করার অনুরোধ জানিয়েছে তারা। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।        

এরপর দাঙ্গা বিধ্বস্ত নুহ’র পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেয় হরিয়ানা সরকার। নতুন পুলিশ সুপার রাতে দায়িত্ব নিয়ে পরের দিন সকাল থেকে শুরু করেন বুলডোজার অভিযান। জেলার তাউরা এবং সোনা এলাকায় বুলডোজার দিয়ে রাস্তার ধারে থাকা ঝুপড়িগুলি একে একে ভেঙে দেওয়া হতে থাকে। একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের খবর অনুযায়ী, তাউরা এবং সোনা মূলত মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা। এখন ওখানকার বাঙালি মুসলমানদের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে তাদের উপর জুলুমের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন হাই কোর্টের রায়ে বুলডোজার অভিযান বন্ধ হয়েছে, কিন্তু তাই বলে ওই অঞ্চলের মানুষ নিশ্চিন্ত হয়েছেন, এটা বলা যাবে না। কারণ, গুজরাটের মতোই হরিয়ানা একটা পরীক্ষাগার যেখানে ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলবে, যতক্ষণ না উপরতলা থেকে তা বন্ধের কোনও নির্দেশ আসছে। 

পুলিশ সুপারকে যখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন যে, ঝুপড়ির বাসিন্দারা কি দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন, তখন তাঁর জবাব, ‘সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ঝুপড়ির বাসিন্দাদের কারও নাম কি দাঙ্গার এফআইআর'এ আছে? পুলিশ সুপার বলেন, ‘সেটা আমরা খতিয়ে দেখব।’ অর্থাৎ, কোনও কিছু খতিয়ে না দেখে, বিনা তদন্তে, শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার জন্যই যে অভিযান তা ক্রমশ স্পষ্ট। পুলিশ সুপার উল্টে এক নতুন কাহিনী ফেঁদে বলেন যে, ঝুপড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত নাকি আগে থেকেই নেওয়া হয়েছিল, এখন তা কার্যকর করা হচ্ছে মাত্র। প্রশ্ন উঠেছে, এইসব ছেলে ভোলানো তত্ত্ব দিয়ে আর কি বেকুব বানানো যাবে? 

সোনা ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে বাদশাপুর এলাকার সেক্টর ৬৬-র হাইওয়ের পাশে ঢালু জমিতে রয়েছে একটি মাত্র দোকান। তার পিছনে শ’দেড়েক টিনের ঘর নিয়ে বাঙালি ‘বস্তি’, যেখানে ঢুকতে বা বেরতে গেলে ওই  দোকানই কার্যত প্রবেশদ্বার। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সেই প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে লাল গামছা দিয়ে মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা অল্পবয়সী সব ছেলে। হাতে মোটা লোহার রড। খোলা শুধু চোখ দু’টো, যেন জ্বলছে। তবে তারা একেবারে নিস্পন্দ। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। তারা ওরকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কেন, কারও নির্দেশের অপেক্ষায় কিনা, সে সমস্ত বোঝার মতো সাহস নেই বাঙালি বস্তির দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর। দুপুরে নিকটবর্তী বহুতলের কয়েকটি ফ্ল্যাটে কাজ সেরে ফেরার পথে দোকানের সামনে এই অপরিচিত দৃশ্য দেখে বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল ওঁদের। দৌড়ে হোঁচট খেতে খেতে ফিরে দেখেন, সবার দরজা আঁটা। যেন 'শোলে' ছবিতে গব্বরের দলবল ঢোকার ঠিক আগের রামগড় গ্রাম। পরে তাঁরা শুনতে পান যে, সকালেই নাকি ঠিকেদার এসে বলে গিয়েছিল মুরুব্বিদের ডেকে, কেউ যেন আজ চৌকাঠ না পার হয়। হলে ‘খবর’ আছে। দেড় কিলোমিটার দূরে বড় রাস্তার উপরে কাদরপুরের বাজারে ততক্ষণে প্রকাশ্য দিবালোকেই আগুন লাগানো হয়েছে। সেই ধোঁয়া এখনও কাটেনি। ফলে, এর পরে কী হবে কেউ জানে না। এই আতঙ্কের দিন-রাত ওঁরা পার করছেন বিগত চার-পাঁচ দিন ধরে। আজও থমকে আছে মালদহ-দিনাজপুর থেকে আসা এই 'মুসলিম বস্তি'।

তৃণমূলের রাজ্যসভার সদ্য নির্বাচিত প্রতিনিধি সমিরুল ইসলাম গিয়েছিলেন দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চল  পরিদর্শনে। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট জমা করেছেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে রাতে পুলিশ এসেছিল বস্তির ঘরে ঘরে। নমাজ পড়তে যেতে নিষেধ করছে তারা। ভয়ে কেউই নমাজ পড়ছেন না। কারণ, নাম ধরে, আধার কার্ড দেখে মুসলমানদের বেছে নিচ্ছে দাঙ্গাকারীরা।

রাজধানীর পাশেই এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ সরকার আশা করছে, তা ঝুঁকিতে ফেলেছে হরিয়ানার এমন পরিস্থিতি। দিল্লির 'ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ'এর ফেলো তারা কার্থা বলেন, ‘দৃষ্কৃতকারীদের লক্ষ্য উত্তর ভারতের এই বাণিজ্যিক কেন্দ্র (হরিয়ানা)। সরকারের উচিত যে কোনও মূল্যে এই রাজ্যকে রক্ষা করা।’ কিন্তু কে করবে রক্ষা, যদি রক্ষকই হয়ে ওঠে ভক্ষক। 

বেছে বেছে মুসলমান মালিকদের দোকানে আগুন লাগানো হচ্ছে। ওই অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে সারা দেশকে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ কোনও রাজনৈতিক দল দেখায়নি। সেই আদালতের হস্তক্ষেপেই শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। ক্রমশই ভারতীয় গণতন্ত্র থেকে প্রশাসন বস্তুটি উবে যাচ্ছে, তার জায়গা নিচ্ছে জঙ্গলরাজ। ফলে বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে আদালতকে। এর পরিণাম যদি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এখনও সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে আগামী দিনে সমূহ বিপদ!


No comments:

Post a Comment