Pages

Friday, 23 December 2022

সারোগেসি'র নতুন আইন

গর্ভের গর্ব

অমৃতা ঘোষাল 



সারোগেসি ব্যাপারটা জনতার মধ্যে বেশ জমে উঠেছে! পাবলিক অলরেডি দেখেছে 'দুসরি দুলহন' (১৯৮৩), 'চোরি চোরি চুপকে চুপকে' (২০০১), 'ফিলহাল' (২০০২) কিংবা 'মিমি'(২০২১)। মূলত যে মুখরোচক প্রশ্নগুলো জাগে, সেগুলো হল-

• খরচা কত হয়?

• স্ত্রী ছাড়া অন্য মহিলার সঙ্গে কি পুরুষটিকে সঙ্গম করতে হবে?

• গর্ভে সন্তান বহন করা নারীটির কি সারা জীবনের দায়িত্ব নিতে হয়?

• নারীটি কি পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে মজুরের ন্যায় গর্ভ ভাড়া দেওয়ার কাজটি করে?

• সন্তানের দাবি কি এ ক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল মা করতে পারে?

• সম্পূর্ণ পদ্ধতিটিতে আইনি সমস্যা-সংকট কিছু কি হতে পারে?

• অবিবাহিত এবং অক্ষতযোনি নারী কি তাঁর গর্ভ এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে?

• পরিবারের কোনও নারী/আত্মীয়া কি এ ক্ষেত্রে বিবেচিত হতে পারেন?

• অন্য দেশের নারীর সাহায্য কি এ ক্ষেত্রে নেওয়া যেতে পারে?

• নারীটি কি ভবিষ্যতে সন্তানের মা কিংবা স্ত্রীর মর্যাদা আইনিভাবে দাবি করতে পারে?

ইত্যাদি আরও বহু প্রশ্ন এসে মানুষের মনে ভিড় করে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের আইনের যথেষ্ট পার্থক্য আছে।

প্রথমত, বাণিজ্যিক সারোগেসি চলবে না। দ্বিতীয়ত, গর্ভধারণকারী নারীর বয়স হতে হবে ২৫-৩৫ এর মধ্যে। তৃতীয়ত, সেই নির্দিষ্ট নারীটিকে সন্তানের পিতা কিংবা মাতার আত্মীয় হতে হবে। সর্বোপরি, কারা সারোগেসির আবেদন করতে পারবেন? সেই নিঃসন্তান দম্পতি যারা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বয়স হতে হবে ২৩ থেকে ৫০, আর স্বামীর বয়স হতে হবে ২৬ থেকে ৫৫'এর মধ্যে। দত্তক নেওয়া সন্তান থাকলেও কিন্তু তারা সারোগেসির সুবিধা নিতে পারবেন না। অবশ্যই গর্ভধারিণী মায়ের চিকিৎসার খরচ বহন করতে হয় সেই দম্পতিকে। সন্তানের ২৫ বছর অবধি সেই সারোগেট মাদারের পরিচয়-বিবরণ বিশদে বাবা-মায়ের নিজেদের কাছে গুছিয়ে রাখা এ ক্ষেত্রে কর্তব্য। তবে এ ক্ষেত্রে কিন্তু সন্তানকে যে কোনও পরিস্থিতিতেই গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে ওই দম্পতি। আর কোনও কারণে তাদের অকালমৃত্যু ঘটলে শিশুর দায়ভার কে নেবেন, সেটা নিয়েও স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। আর গর্ভধারণকারী মায়েরও আগে একজন সন্তান থাকা আবশ্যক।

এবার এই নিয়ম পরিবর্তনের কারণ হিসেবে একজন রাজনীতিবিদ নাকি তুলে ধরেছেন সেলিব্রিটিদের সারোগেসি-বিলাসের বৃত্তান্ত। অর্থাৎ, অর্থবান ব্যক্তিরা কেন নিজেদের সন্তান থাকলেও আবার এভাবে  সন্তান নিচ্ছেন কিংবা কেন স্বাভাবিক উপায়ে নিচ্ছেন না- সেই প্রশ্ন উঠে আসছে। তাহলে কি সেলিব্রিটিদের জন্যেই হঠাৎ নিয়মের এই পরিবর্তন? কিংবা এই যে  ফার্টিলিটি ক্লিনিকগুলোর এত রমরমা- সেটাও কি এই আইনি পরিবর্তনের একটা কারণ? একটা হীন চক্রকে থামিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা কি কোথাও রয়েছে?

ভারতবর্ষের মতো দেশে অর্থের বিনিময়ে যে বহু নারী গর্ভ ভাড়া দিতে সম্মত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেইসব নারীর প্রকৃত শারীরিক, মানসিক কিংবা সামাজিক ভবিষ্যৎ কী হবে? এই নিয়ম আসার আগে যারা নির্দিষ্টভাবেই সারোগেট মাদার হতেন, তাদের পরিবারও কি সেই ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল? অর্থ উপার্জনের এক অন্যতম পন্থা দেখে অনেক নারীই ঋতুবন্ধের আগে অবধি এই পথটি বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু গর্ভধারণ কিংবা মা হওয়া বিষয়টা অন্তত কোনও জীবিকা হতে পারে না। তাই এই নতুন নিয়ম আসার পর বহু  ফার্টিলিটি ক্লিনিক-ব্যবসায়ীর মাথায় হাত পড়ল। পাচার হয়ে আসা নারীদের দিয়েও এই ব্যবসা করানো আরম্ভ হয়েছিল, তা-ও কিছুটা ধুঁকতে থাকে।

আরেকটি সমস্যা আরও মারাত্মক! ধরা যাক, স্ক্যান পদ্ধতিতে ধরা পড়ল ভ্রূণের গঠনগত ত্রুটি, তখন সন্তান গ্রহণে অনেকেই অস্বীকার করেন। আবার সন্তানের লিঙ্গ নিয়েও কিছু ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন ওঠে। তখন কিন্তু ভ্রূণহত্যাও ঘটে যায়। আবার সন্তান জন্মানোর পরেও কখনও তাকে পরিত্যক্ত, কখনও বা মৃত অবস্থায় মেলে। কিংবা কখনও বা বেঁচে থাকলে সেই শিশুই কোনও নিকৃষ্টমানের অনাথ আশ্রমে চালান হয়ে যায়। আবার কখনও বা দেখা যায়, জন্ম নেওয়া সন্তানটি  আগ্রহী দম্পতির মনের মতো না হলে তারা ক্লিনিক কিংবা ওই নারীর থেকে ক্ষতিপূরণও দাবি করছেন।

এবার বর্তমান নিয়মে কী কী সমস্যা দেখা যেতে পারে, তা নিয়ে একটু ভাবা যাক। আগ্রহী দম্পতির নিকটাত্মীয়, যার বয়স ২৫ থেকে ৩৫, বিবাহিত এবং অন্তত ১ সন্তানের মা ও আর্থিক আনুকূল্য কিংবা অনুগ্রহ (চিকিৎসা বাদে) ছাড়াই এগিয়ে আসবেন- এরকম কাউকে পাওয়া বিশেষ সুলভ নয়। আর মানুষের মননগতি সর্বদা এক পথে হাঁটে না। পরিবারের সেই আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্কের রসায়ন সর্বদা মধুর না-ও থাকতে পারে। কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এই ব্যাপারে তীব্র আপত্তিও থাকতে পারে। সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয় হচ্ছে, সিঙ্গল পেরেন্টও কিন্তু এ ক্ষেত্রে সারোগেসির সুবিধা নিতে পারবেন না। অথচ এ দেশে একা মা কিংবা একা বাবাদের যথেষ্ট অস্তিত্ব আছে। আবার দত্তক সন্তান থাকলেও সারোগেসির সুবিধা নেওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন, এ দেশে কি আদৌ দত্তক গ্রহণের ব্যাপারে সম্যকভাবে প্রচার ঘটে? দত্তক বিষয়টিকে যদি প্রতিটি মানুষ যথাযথ শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন, তাহলে তো সারোগেসির প্রয়োজনই পড়ত না।

তাই, আগে বিবেচনা করে দেখতে হবে, আমরা সন্তানের স্বরূপ বলতে ঠিক কী বুঝি! গর্ভ আর সন্তান সমার্থক নয়। গর্ভধারণ আর সুস্থ সন্তান জন্মের গ্যারান্টি প্রদান- দু'টো এক বিষয় নয়। দাম্পত্য মানেই সন্তানের জন্যে হাহাকার নয়। দত্তক শিশু মানেই জলের তোড়ে ভেসে আসা অনাথ মাত্রও নয়। ফার্টিলিটি ক্লিনিক মানেই  সন্তান উৎপাদনের কারখানা নয়। আর, সারোগেসি মানেই সস্তায় ভারতবর্ষের দরিদ্র নারীকে কিনে নেওয়া নয়। দম্পতির সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই পূর্ণ হোক, কিন্তু তা লোভ-রিপুর গ্রাস থেকে চিরতরে মুক্তি পাক।


No comments:

Post a Comment