Pages

Sunday, 7 November 2021

প্রতিভার স্বীকৃতি

ক্রিকেটার বাবরের 'বাবরনামা' 

সূর্যশেখর দাস


পাকিস্তান ক্রিকেটে প্রতিভার কোনও অভাব নেই। ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার, ইনজামাম-উল-হক এবং সইদ আনোয়ারের মতো প্রতিভাধর ক্রিকেটাররা পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করে ক্রিকেট-বিশ্বকে মুগ্ধ করেছেন। এরই মধ্যে ২৭ বছর বয়সী বাবর আজম ব্যাট হাতে  ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরিচিত কামরান আকমল এবং উমর আকমলের উনি হলেন তুতো ভাই- কামরান ভাইদের পারফরম্যান্স অনেক সময়ই যখন ভঙ্গুরতায় আক্রান্ত হয়েছে, সেখানে বাবর আজমের ব্যাটিং কলঙ্কহীন, ঝকঝকে ইস্পাতের মতোই মজবুত। 

প্রতিভার অভাব না থাকলেও পাকিস্তান ক্রিকেট যে অস্থিরতায় আক্রান্ত- এই অভিযোগ তো অনেকবার উঠেছে। তবে স্বচ্ছ জীবনবোধ এবং স্থিতধী শক্তির সার্থক উদাহরণ হলেন বাবর। ক্রিকেট পণ্ডিতরা প্রশংসা করলে উনি অযথা আবেগে ভেসে যান না। উনি জানেন, ওঁকে অনেক দূর যেতে হবে। আজকের এই টি-টোয়েন্টি প্রভাবিত সময়েও বাবর নিজের ব্যাটিং টেকনিককে অযথা ভাঙচুর করেননি! অনেকেই ভাবেন যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বেধড়ক ঠেঙিয়ে বলের চামড়া কার্যত গুটিয়ে দেওয়াটাই বোধহয় সমীচীন! অথচ বাবর নিজের টেকনিকের সঙ্গে চোখ-জুড়ানো স্ট্রোক খেলার দক্ষতার মসৃণ সামঞ্জস্য ঘটিয়ে টি-টোয়েন্টির আন্তর্জাতিক ময়দানকে মাতিয়ে দিয়েছেন। 

আইসিসি'র সদ্য প্রকাশিত টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী উনিই এক নম্বর ব্যাটার। আবার কেউ কেউ এখনই বাবরকে কোহলির সঙ্গে কার্যত এক পংক্তিতে বসিয়ে ফেলছেন। তবে এই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান বাস্তবটা বেশ ভাল বোঝেন। উনি জানেন- কোহলি ধারাবাহিকভাবে  পারফরম্যান্সের জোরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাট'এ- টেস্ট, একদিনের আন্তর্জাতিক এবং টি-টোয়েন্টি- ব্যাটিংকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। তাই ক্রিকেট মহলের একটা বড় অংশ বিরাটের অনবদ্য, অপার্থিব ব্যাটিংয়ের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়কের  সঙ্গে বাবরকে এক আসনে বসানোটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাবরের অভিজ্ঞতা ৬ বছর। সেখানে 'কিং কোহলি' আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দানে ইতিমধ্যেই ১৩টি বসন্ত কাটিয়ে ফেলেছেন! তবে বাবরের মৌলিকত্বের প্রশংসা না করে কোনও উপায় নেই। উনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। বিশেষত টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিকে ওঁর ব্যাটিং গড় যথাক্রমে প্রায় ৪৩ এবং ৫৭। আবার টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে ওঁর ব্যাটিং গড় অন্তত ৪৮। ভরা গ্যালারি কিংবা কোভিড-১৯ নামক অতিমারির ধাক্কায় ফাঁকা স্টেডিয়াম- বাবর সর্বত্রই আশ্চর্যরকম সফল। একদিনের  আন্তর্জাতিকে ১০০০, ২০০০  এবং ৩০০০ রানের মাইলস্টোন উনি কোহলির থেকেও কম ইনিংস খেলে স্পর্শ করেছেন! আবার টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে বাবর কোহলির রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে দ্রুত ১০০০ রানের ল্যান্ডমার্কে পৌঁছে নিজের  নির্ভুল স্বাক্ষর রেখেছেন। ওয়ান-ডে ক্রিকেটে ওঁর প্রথম ২৫ ইনিংসে সংগৃহীত মোট রান ১৩০৬- এটাও তো এখনও রেকর্ড! একদিনের আন্তর্জাতিকে মোট সেঞ্চুরির নিরিখে উনি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে গিয়েছেন (একদিনের আন্তর্জাতিকে এখনও পর্যন্ত মোট ১৪টি সেঞ্চুরি করেছেন, একদিনের আন্তর্জাতিকে সেঞ্চুরি তালিকায় প্রথম দু'জন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হলেন সইদ আনোয়ার- ২০ এবং  মহম্মদ ইউসুফ- ১৫)!

পাকিস্তান দলের ব্যাটিং লাইন-আপ মানে অনেক সময়ই যেন 'বুম-অর-বাস্ট' (boom-or-bust); অর্থাৎ, ধারাবাহিকতার অভাব বার বার প্রকট হয়ে ওঠে। ২০১৯-এর বিশ্বকাপে পাকিস্তান সেমিফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল-  তার অন্যতম প্রধান কারণ পাক ব্যাটিং লাইন-আপ অনেক ক্ষেত্রে  ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। তাই এই হঠাৎ-ভঙ্গুর পাকিস্তান ব্যাটিং লাইন-আপে বাবর আজমের মতো একজন ব্যাটসম্যান খুব দরকার ছিল; যাঁর মস্তিষ্ক বরফের মতো ঠান্ডা। যিনি অযথা নিজের সুদৃঢ় টেকনিকের 'ব্যবচ্ছেদ' না করেই বড় শট খেলতে পারেন- চমৎকার 'ইম্প্রোভাইজ' করতে পারেন, অবশ্যই খেলতে পারেন লম্বা ইনিংস যাতে নিজের দলই উপকৃত হয়। ওঁর মসৃণ ব্যাটিং দেখলে মনে হয় উনি যেন কার্যত ঘুমের মধ্যেই কভার ড্রাইভ বা স্কোয়ার কাট নিখুঁত ভাবে খেলতে পারেন! যাঁর সাবলীল ছক্কা মারা দেখে একজন ধারাভাষ্যকার বলে ফেলেন, 'এ নাইফ থ্রু বাটার'!

যেহেতু বাবর প্রবল চাপের মুখেও অবিচল থেকে নিজের সেরাটুকু দিতে পারেন এবং সতীর্থদের কাছে পথপ্রদর্শক হিসেবে অবতীর্ণ হন, তাই পাক-নির্বাচকমণ্ডলী ওঁকেই অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাবরের অধিনায়কত্বে পাকিস্তান কার্যকরী এবং ঝলমলে ক্রিকেট খেলছে। আবার  প্রাক্তন অস্ট্রেলিয় অধিনায়ক রিকি পন্টিং ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে বাবরের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার যাবতীয় মালমশলা মজুত রয়েছে।

অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং উচ্চাভিলাষী মির্জা জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতীয় ইতিহাসের পর্যালোচনা মুঘল সাম্রাজ্যকে বাদ দিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। মুঘল সম্রাট বাবরের  আত্মজীবনী 'বাবরনামা' ওনাকে এক বিশেষ গরিমা দান করেছিল। প্রবল পরিশ্রমী এবং বাস্তবের পটভূমিতে নির্মিত উচ্চাশার সার্থক প্রতিভূ পাকিস্তানের বাবর ইতিমধ্যেই ব্যাট হাতে নিজস্ব 'বাবরনামা' লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। সম্রাট বাবরের মধ্যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা ছিল- যে নেতৃত্ব মুঘলদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সম্রাট বাবরের মতো পাকিস্তানের বাবরের ব্যাটিং এবং নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের শিখর কি স্পর্শ করতে পারবে? এর যথার্থ উত্তর একমাত্র সময়ই দিতে পারবে।

আর একটা কথা। যে সব ভারতীয়রা ক্রিকেট খেলা ভালবাসেন তাঁরা ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আক্রমের ক্রিকেটার হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বকে অভিবাদন জানিয়েছেন। এই কুর্নিশ জানানোর ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের জটিল কূটনৈতিক সম্পর্ক গুরুত্ব পায়নি। তাই ক্রিকেটার বাবর আজমকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের জটিল আবর্তের দৃষ্টিকোণটা এড়িয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।


1 comment:

  1. জাহির আব্বাস, হানিফ মহম্মদ, আসিফ ইকবাল, মহসীন খানের খেলা দেখিনি। তবে রামিজ রাজা, মুদসসর নজর, মিঁয়াদাদ, ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রাম,ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার,ইজাজ আহমেদ, আব্দুল কাদের, সেলিম মালিক, সেলিম ইউসুফ, সাকলেইন মোস্তাক, মোস্তাক আহমেদ,ইনজামাম, সৈয়দ আনোয়ার, আকিভ জাভেদ প্রমুখ গোছা গোছা ক্রিকেট প্রতিভার ভক্ত আমি। সবাই জানতো। তারপর পাক ক্রিকেট রাজনীতি আর্থিক দুর্নীতির অন্ধ গলিতে পথ হারালো। আমার আগ্রহও তলানিতে। ভালই হলো। থাকলেও তা প্রকাশ করা যেতো না। সূর্য শেখর দাসের সাহসী বিশ্লেষণ আশা জাগালো।
    ২০১৭চাম্পিয়নস ট্রফি, আর ২০২১ একটি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দুবারই ভারত বাবর রিজওয়ানের সামনে, মহম্মদ আমের, শাহিন আফ্রিদির সামনে ধরাশায়ী।
    প্রতিবেশিকে বয়কট করবো,ক্রীড়া সংস্কৃতি সবের মধ্যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক দেখবো। তার শক্তি দুর্বলতা জানবো না। এই নীতির হাতে গরম ফল।

    ReplyDelete