Pages

Sunday, 21 June 2020

নবতর সমাজ

রাষ্ট্রের অস্তরাগ!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

যেন দুটি ক্ষমতাধারী সত্তা মুখোমুখি আজ। একটি অতি-পুরাতন, পরিচিত, চিরায়ত: রাষ্ট্র। অন্যটি নব-উত্থিত, আপাত অদৃশ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত: ভার্চুয়াল দুনিয়া। প্রথম সত্তাকে টিকে থাকতে দরকার পড়ে অস্ত্র, সেনা-পুলিশবাহিনী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কয়েদখানা, কিছু কড়া আইন, গণতন্ত্র বা স্বৈরাচার। দ্বিতীয় সত্তার প্রয়োজন তথ্য, নজরদারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সমাজ-অর্থনীতি। কিন্তু দুইয়েরই অস্তিত্বের সারসত্য: মুনাফা। এই দুই সত্তা আজ দ্বৈরথে সামিল। সম্মুখ সমর। যেন এক নব বিপ্লবের উপান্তে আমরা এসে হাজির। ফরাসি বা রুশ বিপ্লব থেকে যা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।

গত প্রায় এক দশকের এই দ্বৈরথে চিরায়ত রাষ্ট্রের ধারণা ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। দৃশ্যত, ভার্চুয়াল দুনিয়ার সামনে জাগতিক রাষ্ট্রীয় দুনিয়া কার্যত পশ্চাদপসরণ করছে। কোভিড পরিস্থিতিতে সে গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি বাঁধা পড়ছে এক প্রসারিত ভার্চুয়াল ডোরে। আরও তীব্রভাবে। এ তাবৎকালের দেশ-বিদেশের যা কিছু বাস্তব সীমানা, ক্রমেই মলিন হয়ে উঠছে।

এই পরিবর্তনের আবহ, বলা বাহুল্য, ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেই ক্রমপ্রকটমান। কিন্তু তা অচিরেই বাকী দুনিয়াকেও ছাড়বে না মোটে। পুঁজিবাদের আজ আর একটাই ধরন নেই- তার নানা স্তর, বিবিধ আঙ্গিক ও নানান রকমফের। যদি আমেরিকা, বৃটেন, ব্রাজিল, ভারত, চীন বা ফ্রান্স কিছুটা রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মোড়কে পুঁজিবাদের অনুশীলনে নিয়োজিত থেকে থাকে তবে তাদের কাছে রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা এখনও অটুট। অন্যদিকে, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড বা বেলজিয়াম হয়তো খোলামেলা পুঁজিবাদের অনুশীলনে রাষ্ট্রের অতটা কঠোরবিধি মেনে চলার পক্ষে নয়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বগ্রাসী প্রকোপে পুঁজিবাদী দুনিয়ার আরও বেশি বেশি ভার্চুয়াল-অনুশীলন তাকে (সব ধরনের পুঁজিবাদী দেশগুলিকেই) ঠেলে নিয়ে চলেছে চিরাচরিত রাষ্ট্রের দুনিয়া থেকে ভার্চুয়াল জগতের যাপনরীতিতে। তা প্রায় সব দেশেই আজ কমবেশি প্রত্যক্ষত দৃশ্যমান।

আমেরিকায় অচল হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রপ্রধানের বয়ান। ট্রাম্পকে দেখে এক অসহায় ক্লাউনের মতো লাগছে। রাস্তায় নেমে লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্মাণ করছে এক অন্যতর সমাজরীতি। সেখানে অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ ভার্চুয়াল দুনিয়ার কার্যাবলী ও প্রক্রিয়া। ট্যুইটার আজ নির্দ্বিধায় বর্ণবৈষম্যের দায়ে বাতিল করে দিচ্ছে মহামতি ট্রাম্পের পোস্ট। শহরে শহরে রাস্তায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে অতীত বর্ণবৈষম্যবাদীদের মর্মর মূর্তি। পুলিশ হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইছে জনতার ওপর তাদের বর্বরতার জন্য। ব্রাসেলস'এ রাস্তায় পুলিশের দল সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলছে হ্যান্ডকাফ- অনেক হয়েছে, আমরা বর্বরতার ইতি টানতে চাই। সিয়াটলে স্থানীয় জনতা দিনের পর দিন রাস্তা অবরোধ করে 'স্বশাসিত এলাকা'র ঘোষণা দিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা তুলে 'কমিউনিটি ব্যবস্থা' গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছে। রাজনৈতিক অর্থনীতির রশি দ্রুত হাতবদল হচ্ছে। রাষ্ট্র ও নীতিকারেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কর্মসংস্থানে জোয়ারভাটা হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া, জনতার জমায়েত, নানা ধরনের অজস্র সংগঠন হয়ে উঠছে যোগাযোগ এবং যাপনের প্ল্যাটফর্ম ও ভাষা। চিরায়ত রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, পুলিশ-সেনা, ক্ষমতার স্মারকগুলি ভেঙ্গে পড়তে পড়তে জায়গা করে দিচ্ছে নতুন প্রতীক, ভাবনা ও উত্থানকে। সেগুলি কেমন তা আরেকটি লেখায় বিস্তারিত বলা যাবে। তা গিগ অর্থনীতির নতুন গল্প যেখানে রাজনৈতিক-অর্থনীতির নতুন ভাষ্য নির্মিত হচ্ছে।

বিশ্ব অর্থনীতির শৃঙখলে বাঁধা আমাদের দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিও এই পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে সরে থাকতে পারবে না। তার ইঙ্গিত ও সূত্র যথেষ্ট প্রকটিত। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্য সরকার তাদের কোষাগার উন্মুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে। কেন্দ্রীয় সরকারও পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। বহু স্বর, বহু দলের টানাপোড়েনে কেন্দ্রে-রাজ্যে বা স্থানীয় ক্ষমতায় আরোহন নিয়ে এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আবহ তৈরি হয়েছে। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার সর্বব্যাপ্ত উপস্থিতি এক বর্ণময় ও জটিল জনমত গড়ে ওঠার পরিসরকে বাস্তবায়িত করেছে। ফেক ও রিয়েল নিউজের দড়ি টানাটানিতে মানুষের বোধ ও অনুভূতিগুলি আরও প্রখর হয়ে উঠছে। এই আলোআঁধারি উন্মেষে জনমত কখন কোনদিকে যাবে তার আভাস পাওয়ার সম্ভাবনা রাজনৈতিক দলগুলির কাছে তাই আজ আরও বেশি কঠিন। অতএব, তাদের তরফে আরও জনমুখি ও হুঁশিয়ার হওয়া এখন বাধ্যবাধকতা। এছাড়া তাদের আর কোনও উপায়ও নেই।

তবে নিজেদের জনমুখিতাকে সাব্যস্ত করতে রাষ্ট্রবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, রাষ্ট্রের উগ্র ধ্বজা তুলে ও বর্ণ-জাতি-ধর্মগত ঘৃণা ছড়িয়ে কিছুদিন অবধি হয়তো সচল থাকবে। কিন্তু সে রাজনীতিরও পতন সমাগত। কারণ, ভার্চুয়াল দুনিয়ার বিশ্ব পরিসরে তথ্য সম্ভার ও অর্থনৈতিক লেনদেনই মুখ্য কার্যক্রম; তা যে উপায়েই হোক না কেন: বিনোদন, শিক্ষা, নজরদারি, বিক্রিবাট্টা, সোশ্যাল মিডিয়া, যোগাযোগ, স্ব-উদ্যোগ আর যা যা কিছু। আর এই ভার্চুয়াল দুনিয়াকে চালিত করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে অ্যালগরিদম তার কোনও একক প্রভু নেই। এ কোটি কোটি দেবতার নিত্য প্রয়াসের ফল, যে দেবতারা জন্ম নিচ্ছেন আবার বিলুপ্তও হচ্ছেন আমার-আপনার ঘরে, প্রায় প্রতি মুহূর্তে। এই নবতর আঙ্গিকে যে নতুন সমাজের উত্থান তার গতিপ্রকৃতি কোনদিকে তাই এখন দেখার। কিন্তু পুরনো রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নির্বাণকাল যে সমাগত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই 'মিথ্যা অস্ত্রশস্ত্র ধরে' যুদ্ধ এখন ক্রমেই এক অলীক স্বপ্নবিলাস মাত্র।

1 comment:

  1. ভাল লেখা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর দুনিয়া জে বদলে দেবে চিরায়াত রাষ্ট্রের ধারণা তাতে কোনো সন্ধেহ নেই।

    ReplyDelete