Pages

Sunday, 26 January 2020

সীমানা ছাড়িয়ে

দুই বাংলার মিলনমেলা
সঞ্জয় মজুমদার
২৪ জানুয়ারি ২০২০ ইন্দুমতি সভাগৃহে দুই বাংলার মিলনমেলা, কবিতার ছন্দে

জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা নয়, অনেকগুলো মতি খসে পড়ল ৯ই মাঘ ১৪২৬-এর  সন্ধ্যায় যাদবপুরে, টেগোর সোসাইটি কলকাতা ও বাহার মিউজিকের যৌথ প্রযোজনায়, কবিতার রাখিবন্ধনে, দুই বাংলার যুগলবন্দীতে। অনিন্দ্যদার ঐকান্তিক ইচ্ছায়, 'একক মাত্রা'র পক্ষ থেকে আমি আর অরুণাভ কুড়িয়েও নিয়েছি সেইসব মণিমুক্ত, যতটা পেরেছি। শ্রদ্ধেয় পঙ্কজ সাহা এবং আমাদের কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ বিধান চন্দ্র পালের স্মরণীয় উপস্থাপনায় ২৪ জানুয়ারি অমাবস্যার সন্ধ্যায় ইন্দুমতি সভাগৃহে যেন মতির ছড়াছড়ি।

সাহিত্যচিন্তায়, মননে, লেখনিতে, পরিবেশনায় কবি ও আবৃত্তিকার, সমাজসেবী এবং পরিবেশকর্মী বিধান চন্দ্র পালের অনস্বীকার্য প্রতিভার সার্থক স্ফুরণ হল এই শীতের সাঁঝবেলায়। কবিতায় দুই বাংলার মেলবন্ধনকে কেন্দ্র করে, মঞ্চে উপবিষ্ট দুই বাংলার বিদগ্ধজনেদের বিশ্লেষণাত্মক বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের জন্য গাঁথা ছিল বিধানবাবুর মন ছুঁয়ে যাওয়া একগুচ্ছ কবিতার মালা, যা পূর্ণতা পেল, আরও উপভোগ্য হয়ে উঠল সভায় উপস্থিত এক ঝাঁক সম্ভাবনাময় আবৃত্তিকারের  অনবদ্য বাচনভঙ্গিতে। কবি তাঁর মনের এবং ভাবের গর্ভজাত আবেগের যথাযথ পরিস্ফুটনের শব্দ খুঁজে চয়ন করেন, আর আবৃত্তিকার, বাচিকশিল্পী শ্রুতিমাধ্যমে ছন্দবদ্ধ শব্দমালাকে সঠিক অনুপাতের স্বরক্ষেপে শ্রোতার মননে কবিতার অন্তর্নিহিত বোধের জন্ম দেন। বিধান চন্দ্র পালের স্বরচিত 'নারীকাব্য' এবং 'আবার জেগে উঠবে মানুষ' শিরোনামের দুইটি কমপ্যাক্ট ডিস্কে বন্দী চল্লিশটি কবিতার শ্রুতিসঙ্কলনে ঠিক এই চিন্তারই অনুশীলন করা হয়েছে।

দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ সাহা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার অবকাশ নেই। তবে, তাঁর কবিসত্তার পুনঃপ্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এই অনুষ্ঠানে, সৌম্যেন অধিকারী ও সংযুক্তা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ও পঙ্কজ সাহার কবিতা নিয়ে 'মানুষকে মানুষের কথা বলতে দাও' শীর্ষক কমপ্যাক্ট ডিস্কের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৭৫-এর ৯ অগাস্ট কলকাতা দূরদর্শনের জন্মলগ্ন থেকে এই মানুষটি আপামর বাঙালির অত্যন্ত পরিচিত মুখ। দুই বাংলার সংস্কৃতিক মেলবন্ধনের নিরলস প্রচেষ্টায় পঙ্কজ সাহার অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই মঞ্চেও তার ব্যতিক্রম হল না। কিছু অনিবার্য কারণবশত, বিলম্বিত লয়ে চলতে থাকলেও অনুষ্ঠান সঞ্চালনার সহজাত এবং স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমা ছিল অটুট, প্রয়োজনীয় গাম্ভীর্য আর গভীরতায় পূর্ণ।

অনুষ্ঠানের স্বাগত ভাষণটি ছিল পঙ্কজ সাহার সুদীর্ঘ বর্ণময় কর্মজীবনের অমূল্য রতনে পূর্ণ, যার উজ্জ্বলতমটি অবশ্যই বাংলা ভাষাকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের অন্তহীন আবেগ আর আপসহীন সংগ্রাম, ২১ ফেব্রুয়ারি যার সোনার ফসল। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য ওপার বাংলার মানুষের অবিস্মরণীয় ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা, গর্বের ঘটনা, আর সেই গর্বের প্রতিফলিত আলোকে আমরা এপার বাংলার মানুষেরাও নিঃসংকোচে আলোকিত। জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতি, কূটনীতি, দেশকালের সীমানা সমস্ত কিছু ছাপিয়ে একটা ভাষা কীভাবে সুদৃঢ় একতার বন্ধন হতে পারে, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

স্বাগত ভাষণের আর একটি পর্যায়ে পঙ্কজ সাহা তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিচারণায় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আঙিনায় বহু গুণী ও বিদগ্ধ মানুষের সান্নিধ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে যেমন আছেন শম্ভু মিত্র, বিষ্ণু দে তেমনি, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো উজ্জল জ্যোতিষ্কদের আনাগোনা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আইসিসিআর-এর অধিকর্তা গৌতম দে মহাশয়। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনধারার মেলবন্ধন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক তাঁর বক্তব্যে উঠে এল। পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রায় সব ধরনের ঘটনাবলীর ধারাবাহিক তথ্য পূর্ববঙ্গের নাগরিকদের কাছে নিয়মিত পৌঁছলেও বিপরীত স্রোত কিন্তু খুবই অনিয়মিত। ওপার বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগতি এবং ধারাবাহিকতার  বেশিরভাগ তথ্য পশ্চিমবাংলার মানুষজনের কাছে পৌঁছয় না। এটা সত্যিই আঘাত পাওয়ার মতো বিষয়। বাংলাদেশের সংবেদনশীল মানুষজনের কাছে এ এক যুক্তিযুক্ত অভিমান। মূল সমস্যার জায়গাগুলো অবশ্যই প্রশাসনিক গেরোয় আটকে আছে। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়, তবে নিশ্চিতভাবেই দুই দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নিয়মিত আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে পরিপন্থী, সেটা স্পষ্ট। কারণ প্রযুক্তির বিশ্বায়নের যুগে যোগাযোগ কোনও সমস্যাই নয়।

কথা প্রসঙ্গে তিনি দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্র বা কোন সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের নিয়ম-নীতির অসুবিধার কথা উল্লেখ করেন। এটা যত দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারব আমরা, ততই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। তবে, দুই দেশের প্রশাসনিক স্তরের উপরেই সব দায় গৌতম দে চাপিয়েছেন এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। এপার বাংলার মানুষের কষ্টদায়ক উদাসীনতাও এর কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রশাসনিক সমাধান এবং প্রযুক্তি তখনই কাজে আসবে যখন মানুষ থাকে ভেতর থেকে চাইবে। মঞ্চে উপবিষ্ট জামাল হোসেন এবং নান্টু রায় মহাশয়ও দুই বাংলার নিয়মিত সাংস্কৃতিক যোগাযোগের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শ্রদ্ধেয় জামাল ভাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

অশীতিপর গোলাম মুরশিদের জীবন ও কাজকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। ১৯৮২তে বাংলা আকাদেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপককই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। পুরস্কারের সঙ্কীর্ণতায় গোলাম মুরশিদকে ধরা যায় না। সুদীর্ঘ সময় ধরে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বহুধা বিস্তৃত কাজকর্মের মাধ্যমে তিনি নিজেই আজ একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লেখার মধ্যে অবশ্যই বলতে হবে- 'কালাপানির হাতছানি: বিলেতে বাঙালির ইতিহাস', 'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস', 'বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান', 'কালান্তরে বাংলা গদ্য', 'The Reluctant Debutante', 'Lured by Hope', 'The Heart of the Rebel Poet', ইত্যাদির কথা। বয়স যে একটা সংখ্যা মাত্র, তা তাঁকে সামনাসামনি না দেখলে, তাঁর কথা না শুনলে, চিন্তাভাবনায় জারিত না হলে বিশ্বাস করা কঠিন।  সংক্ষিপ্ত ভাষণে বিধান চন্দ্র পালের এই শুভ উদ্যোগের যথাযথ প্রসংশা করেন এবং ভবিষ্যতেও এই ভাবনাচিন্তা এবং কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা দুই বাংলাতেই জারি থাকবে সেই আশাও রাখেন।

গদ্যপদ্য, আবৃত্তি, বাচিক শিল্প, দুই বাংলার মেলবন্ধন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে আমরা যখন ভাবাবেগে আবিষ্ট ঠিক তখনই প্রখ্যাত লেখক, সাহিত্য সমালোচক, এবং অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর ভাষণের সারাংশ যেন ভরা আদালতে, বাস্তববোধের হাতুড়ি ঠুকে, অর্ডার অর্ডার বলে উঠল। ১৯৪০ থেকে ২০২০ অবধি, ইতিহাসের স্রোত বেয়ে, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মেরুকরণের আতস কাঁচের নীচে দুই বাংলার কবি সাহিত্যিকদের ভাবনাচিন্তা ও প্রতিক্রিয়ার যথার্থ কারণ অনুসন্ধান করলেন বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে। শিল্পসৃষ্টি, তা সে যে মাধ্যমেই হোক না কেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ভিতের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে, প্রভাবিত হয়- এই সত্যটুকু স্বল্প সময়ে, সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।

সভার শেষ পর্বে আমরা পেলাম অধ্যাপক ও গবেষক পিনাকেশ সরকারকে। পিনাকেশবাবুর বলার ধরন, গলার স্বর অতি সুন্দর। কবিতা তাঁর গবেষণার অন্যতম স্থান। কবি ও কবিতার চলন-বলনকে বিভিন্ন সময়ের আঙ্গিকে ধরার চেষ্টা করলেন। কবিতা বলার ধরনে অকারণ নাটকীয়তার, অকারণ আরোপিত আবেগের, দৃষ্টি-আকর্ষণীয় ভঙ্গিমার তিনি বিরোধী। কবিতার মূল সুর থেকে শ্রোতাদের তা বিভ্রান্ত করে। আবৃত্তিকারের সহজ-সরল ভঙ্গিমা, নিয়ন্ত্রিত আবেগের এবং স্বরক্ষেপের পক্ষেই সওয়াল করলেন। আবৃত্তিকে শিল্প হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পিনাকেশ সরকারের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ উঠতি বাচিক শিল্পীদের যথেষ্ট ভাবাবে এবং অনুপ্রেরণা জোগাবে বলেই বিশ্বাস। শুধু বক্তব্যেই তিনি থেমে থাকেননি। তাঁর গম্ভীর ও শ্রুতিমধুর কন্ঠে উচ্চারিত পঙ্কজ সাহার একটি কবিতা দিয়েই অনুষ্ঠানের মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়।

অনুষ্ঠান পরিচালনায় পঙ্কজ সাহার সাথে ওপার বাংলার ডালিয়া দাসের স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাঞ্জল সহযোগিতা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। ডালিয়া দাস নিজেও একজন দক্ষ বাচিক শিল্পী। আবৃত্তিকারদের মধ্যে আরও যাঁরা বিধান চন্দ্র পালের কবিতা পাঠের মাধ্যমে শ্রোতাদের আনন্দ দিলেন- সর্বাণী রায় চৌধুরী, সুজয় রায় চৌধুরী, শ্রীজা চন্দ, দীপক সেনগুপ্ত, তাপস চৌধুরী, শিখা বিশ্বাস, রত্না দাশগুপ্ত, জয়ন্ত ঘোষ, অভিরূপা ভাদুড়ি, রৌহিন বন্দোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও 'একা নই' নামে শনিবারের বৈঠকের একটি বিশেষ প্রকাশনাও আত্মপ্রকাশ করল আজকের অনুষ্ঠানে যার সম্পাদক বিধান চন্দ্র পাল, বিশেষ উপদেষ্টা পঙ্কজ সাহা এবং প্রকাশক ইনস্টিটিউট অফ অডিও ভিসুয়াল।

অনুষ্ঠানে বা সভায় অংশগ্রহণ শুধুমাত্র কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার নেপথ্যে দীর্ঘসময়ের লালিত-পালিত চিন্তাভাবনার প্রকাশ থাকে। দুই বাংলার বিশেষ কিছু মানুষের উদ্যোগে, অক্লান্ত পরিশ্রমে, ২৪শে জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবারের সন্ধ্যায় শুধুই যে দুই বাংলার কবিতার রাখিবন্ধন হল তাই নয়, বিগত ষোল সতেরো বছর ধরে 'একক মাত্রা'র আড্ডায় সংকীর্ণ রাজনীতির সীমানাকে নস্যাৎ করে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে দুই বাংলার চিন্তাভাবনার জগৎকে কাছাকাছি রাখার, পাশাপাশি রাখার, বেঁধে-বেঁধে রাখার ভবিষ্যতের অঙ্গীকার আরও জোরদার হল। ২০১৯-এর 'একক মাত্রা'র জুলাই মাসের 'ফিরে দেখা' সংখ্যায় বিধান চন্দ্র পাল মহাশয়ের প্রচ্ছদ নিবন্ধ এই 'নিরবচ্ছিন্ন পথচলা'রই স্মারক। একক মাত্রার 'বাঙালির আত্মপরিচয়', 'গ্রামবাংলা', 'উত্তরবঙ্গের কথা',  'আঞ্চলিকতার বহুরূপ', 'অন্য রবীন্দ্রনাথ', 'সীমান্ত দেশ' সংখ্যাগুলিতে দুই বাংলাকে অভিন্নহৃদয় হিসেবে তুলে ধরার সৎ প্রচেষ্টা অবশ্যই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

1 comment:

  1. খুব সুন্দর লিখেছেন। পড়ে ভাল লাগলো।

    ReplyDelete