Pages

Tuesday, 31 December 2019

বর্ষবরণ

নতুন বছরে চিন্তাশুদ্ধি প্রয়োজন
সঞ্জয় মজুমদার
দেশ তথা বিশ্বের উন্নতি, অগ্রগতি, কোনওটার সাথেই লটারি পাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। নেই কোন জাদুকরী বিদ্যা। যাঁরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, রাজনৈতিকভাবে, আমরা আমাদের ভালো-মন্দের সবটুকুই তাঁদের ইচ্ছাশক্তির উপর ফেলে রেখেছি। ধর্মের আফিম, অবাধ উশৃঙ্খলতা, আর যুদ্ধের নেশায় বুঁদ অধিকাংশ বিশ্ববাসী, সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলতে বসেছে।  পাড়ার মুদির দোকানে ফোনের সিম-কার্ডের মতো বন্দুকের কার্তুজ পেলেও অবাক হব না। ঝাঁ-চকচকে শপিং মল থেকে মাসকাবারি বাজারের সাথে একটা দুটো স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, অত্যাধুনিক বন্দুক, আর গোটা কয়েক হ্যান্ড গ্রেনেড কিনে আনার দিন এসে গেছে। আন্তর্জাতিক সমরাস্ত্র ব্যবসায়ীরা আহ্লাদে আটখানা হবেন নিশ্চয়ই।

আমরা-ওরা নির্ভর রাজনৈতিক শক্তি কায়েম করে, নির্ভরতা দেওয়ার তুলনায় আতঙ্কিত করে রাখতে পারলে মুনাফা বেশি জোটে। ক্ষমতাও কুক্ষিগত হয়, আর হয় পৃথিবী জোড়া পরিবারতন্ত্রের বিষবৃক্ষের সমাহার। অথচ ইতিহাসের পাতা উল্টে মগজাস্ত্র খাটালে বোঝা যাবে, নেতা-মন্ত্রী ইত্যাদি লোকগুলো একটা সময়ে দেশের সাধারণ নাগরিকই ছিলেন। সাদাকালো, ভালোমন্দ মিশিয়ে দীর্ঘ লড়াই এবং আত্মত্যাগের পর নেতৃত্বের জায়গায় নিজেদের নিয়ে এসেছেন। একইভাবে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে থেকেও কেউ কখনও নেতৃত্বে আসতে পারেন এবং পরিস্থিতি যা তাতে রাজনীতিতে অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের মিশ্রণ খুব দরকার। ইচ্ছে থাকলে উপায়ও হয়ে যায়। শরীরের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড মিলে, বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস টেনে এনে, দূষিত রক্ত বিশুদ্ধ করে, সুস্থ্ সবল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে চালু রাখে। শোধিত বীজ না হলে গাছও বাঁচে না। ঠিক তেমনই সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক লড়াই করে উপরের দিকে উঠে আসে। পরে আরও অর্থ বা ক্ষমতার সীমাহীন লোভে রাজনৈতিক মঞ্চকে আঁকড়ে ধরে। ফল?  দূষিত রক্ত। কাজেই সমাজের শারীরবৃত্তীয় চক্র ঠিক রাখতে গেলে বিশুদ্ধ বাতাসের মতো, নতুন প্রজন্মের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।  নাগরিক সমাজের ভেতর থেকেই নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে উঠে আসার প্রয়োজন আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে অর্থনৈতিক শক্তি আর প্রযুক্তিই শেষ কথা বলবে। এটাই আগামীর বাস্তব। প্লাস্টিকের মতো অসুস্থ রাজনীতিকে চিহ্নিত করে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে। এ কাজ সরকার করে দেবে না। নাগরিকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে, যার প্রাথমিক এবং আবশ্যিক শর্ত সততা, একাগ্রতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, উপস্থিত বুদ্ধি, একতা আর সংগঠন শক্তি। সাহস আর ইচ্ছে থাকলেই 'নেতা-নাগরিক-নেতা'র দুষ্ট চক্রটা  'নাগরিক-নেতা-নাগরিক'এর পুষ্ট চক্রে পরিবর্তন করা যায়।

নেতৃত্ব কি শুধু রাজনৈতিক হয়? সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, এটা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই বুঝেও বলছি, বাকি ক্ষেত্রগুলো, যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য-উদ্যোগ, শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ক্রীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন 'স্কুল-অফ্ থটস্'এর মঞ্চ থেকেও নেতৃত্ব আসুক। নেতৃত্বের জন্ম হোক। ঘড়ির কাঁটা বলছে, পৃথিবীর তাবড় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শেষ পর্যন্ত কালজয়ী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী। ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সংবিধান, পুলিশ-প্রশাসন, সেনাবাহিনী আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করা, দাপট দেখানো, এটাই কি ক্ষমতা? হয়তো অনেকটাই। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। ভাবার সময় এসেছে। একটা বছর চলে গিয়ে আরেকটা বছর আসছে। ২০২০'তে আমরা হাতে চাঁদ পাব কিনা সেটা নির্ভর করবে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের উপর নয়, সবরকম সামাজিক ক্রিয়াকলাপে নাগরিকদের আরও বেশি অংশগ্রহণের উপর।

আর নাগরিকত্ব? এই বছর এবং বিগত বছরগুলিতে শরণার্থী, অনুপ্রবেশকারী কিংবা নাগরিক ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে চলা বাক-বিতন্ডা, তর্ক-বিতর্ক, প্রতিবাদ-মিটিং-মিছিল থেকে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট, শুধু একটা আইন প্রণয়ন করার চেষ্টা করে নাগরিকত্বের সীমারেখা টানা মুশকিল। এই বিষয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তার অভাব থেকে গেছে। বাড়ির ছাদ-পাঁচিল-কার্নিশ দখল নিয়ে কাক-শালিক-চড়ুইদের আকাশসীমা দখল করার লড়াই, এপাড়া-ওপাড়া মিলিয়ে এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে, রাস্তার কুকুর-বেড়ালদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেও নাগরিকত্ব হারানোর ভয় লুকিয়ে থাকে। এক বছর হয়ে গেলে ভাড়াটেও বাড়িওয়ালার কাছে চিরস্থায়ী নাগরিকত্বের আর্জি পেশ করেন। এগুলো সবই খুব স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রত্যাশা।  নাগরিকত্বের বিচারটা শুধু মানুষের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয় এটা গোটা জীবজগতেই ছড়িয়ে আছে। সময়ের হাত ধরে একটু দীর্ঘকালীন সময় কোনও স্থানে বসবাস নাগরিকত্বের আশা জাগায়। আবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে একটা-না-একটা আইন মেরেকেটে করতেই হয়। এ বছরের অনেকটাই খাঁটি ভারতীয়ত্বের অগ্নিপরীক্ষার চাপে-তাপে কেটে গেল।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৯'এর রাত বারোটা পেরতে বেশি দেরি নেই। স্কুল-কলেজ-হোস্টেল, অফিস এমনকি পুলিশ আর সেনাবাহিনীতেও প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া কৃষকের আত্মহত্যা এখন সাধারণ ঘটনা। 'নিউ-ইয়ার-রেজোলিউশন' খায় না গায়ে মাখে বুঝিনা, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হবে কিনা ভবিষ্যৎ বলবে কিন্তু নাগরিক হিসেবে নিজেদের চিন্তাভাবনার আশু সংশোধন প্রয়োজন এটা স্পষ্ট।

Wednesday, 18 December 2019

দেশ ধুঁকছে!


অর্থনীতির বেহাল দশা!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


জানা গেল, জুলাই-সেপ্টেম্বর ’১৯-এর ত্রৈমাসিকে আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে। আর এই ক্রমপতন পর পর তিন ত্রৈমাসিক জুড়ে। ঠিক তার দু’ দিন পরেই প্রকাশ পেল এই তথ্যটিও যে, নভেম্বরে জিএসটি সংগ্রহ বেড়েছে ৬ শতাংশ। এই দুটি তথ্য পাশাপাশি রাখলে ধন্দে পড়তে হয়। কারণ, জিডিপি বৃদ্ধির হার যদি পড়ে আসে, এবং পরপর ত্রৈমাসিকগুলিতে ধারাবাহিক পড়তে থাকে, তাহলে সাব্যস্ত হয় যে অর্থনীতিতে বিকাশের হার শ্লথ হয়ে পড়েছে, যার অর্থ শিল্প সহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই সংকোচন চলছে যাকে মন্দাভাব বলা যায়। তাহলে জিএসটি সংগ্রহ বাড়ল কীভাবে? জিএসটি সংগ্রহের সঙ্গে তো পণ্য বিক্রির সরাসরি যোগ। তাহলে কি গত উৎসব মরশুমে বিক্রিবাটা কিছুটা বাড়ল! আর তার প্রতিফলন আমরা অক্টোবর-ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে দেখতে পাব? অবশ্য যদি না ডিসেম্বরে পণ্য বিক্রি আবার যথেষ্ট পড়ে যায়। সে ইঙ্গিতও অবশ্য মিলছে! তা ১৭ ডিসেম্বরে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইন্ডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস-এর শীর্ষ আধিকারিকদের প্রতি রাজস্ব সচিব ভূষণ পাণ্ডের মরীয়া নির্দেশেই স্পষ্ট। পাণ্ডে সাহেব পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন, আগামী চার মাসে (মার্চ ২০২০-র মধ্যে) যে করে হোক ৪.৫৫ লক্ষ কোটি টাকা জিএসটি সংগ্রহ করতেই হবে; কারণ, ভাঁড়ে মা ভবানী এবং কর সংগ্রহের পরিমাণ এই আর্থিক বছরে এখন পর্যন্ত মোটের ওপর একেবারেই আশাপ্রদ নয়।

এইসব নানাবিধ চুলচেরা আলোচনায় গত কয়েক মাস জুড়ে ভারতীয় অর্থনীতির বিচার একপ্রকার অগ্নিগর্ভ। এক পক্ষ যদি বলছেন, দেশ এক গভীর মন্দায় নিমজ্জিত তো আরেক পক্ষ উপেক্ষার সুরে জানাচ্ছেন, অপেক্ষা করুন সবুরে মেওয়া ফলে, যেটুকু নিম্নভাব তা আন্তর্জাতিক শ্লথতার কারণেই। এইসব ছাপিয়ে একটু খোলা মনে ভাবনাগুলোকে বরং সাজানো যাক।

প্রথমত, এটা বাস্তব যে বাজারে যথেচ্ছ নগদের জোগান হ্রাস পেয়েছে। আর যেহেতু আমাদের অর্থনীতির সিংহভাগ ক্রয়-ব্যয় নগদেই হয়, মায় বেতন পর্যন্ত, তাই নগদের জোগান কমে গেলে তা চাহিদার ক্ষেত্রে ঘাটতি তো তৈরি করবেই। কিন্তু সমস্যা এতটা সরল নয় বোধহয়। বুঝতে হবে, এতাবৎকাল নগদের কারবার এ দেশে দু’ ভাবে হয়ে এসেছে: এক, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যা মাইনেপত্র, কেনাকাটা, বিক্রিবাটার মধ্য দিয়ে প্রবহমান; দুই, কালো টাকার মাধ্যমে যা সমান্তরাল ভাবে এক বড় পরিমাণে নির্বাহ হয়েছে। এই দুটি পরিসরই গত কয়েক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রথম ক্ষেত্রে (অসংগঠিত) আঘাতটা পড়েছে গরিব মানুষের ওপর, বিশেষত বিমুদ্রাকরণের পর্যায়ে ও তৎপরবর্তী তার ক্রমপ্রসারিত প্রভাবের ফলে। এর সঙ্গে জিএসটি-র তড়িঘড়ি প্রয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্রম ডিজিটাইলেজশন বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে যার সঙ্গে দ্বিতীয় ক্ষেত্রটির (কালো টাকার জগৎ) এক যোগসূত্র রয়েছে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মন্দাভাবের শুরু গাড়ি ও নির্মাণ শিল্পে চাহিদার অবনমন দিয়ে যা পরে অন্যান্য শিল্পেও প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত ছিল কৃষি ক্ষেত্রে এক দুর্দশার চিত্র। এই গাড়ি ও নির্মাণ শিল্প কিন্তু অনেকটাই চালিত হত কালো টাকা উৎসারিত চাহিদা থেকে যা মোটেই অর্থনীতির সোজা পথের বাহক নয়। দু-চার বছর অন্তর নগদ টাকা ফেলে পুরনো গাড়ি বদলে নতুন গাড়ি কেনা, একই পরিবারে দু-তিনটি অবধি গাড়ি রাখা, বিভিন্ন শহরে নগদে যথেচ্ছ জমি-ফ্ল্যাট কিনে ফেলা- এসবই ছিল কালো টাকার অফুরন্ত জোগান থেকে যা আবার নিচের তলায় চুইয়ে পড়ে চাহিদার এক বাড়বাড়ন্ত তৈরি করেছিল। বিমুদ্রাকরণ, কেনাবেচার ডিজিটাইলেজেশন ও নগদ লেনদেনে বিধিনিষেধ এবং জিএসটি’র তড়িৎ প্রয়োগ- এই ত্রয়ের অভিঘাতে অর্থনীতিতে নগদে টান পড়ল ২০১৭ সাল থেকে সৃষ্ট এই নগদের কমতি ও তার ব্যবহারের ঝুঁকি ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে ঝিমুনি নিয়ে এল। একদিকে তৈরি হল কর্মসংকোচন, অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে লেনদেনের কমতি।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে কেউ বলতেই পারেন, যা অত্যন্ত সংগত'ও বটে যে কালো টাকা দিয়ে নগদ অর্থনীতি চলবে, এ তো আর সাব্যস্ত হতে পারে না। বরং, এই সংশোধনটা তো জরুরিই ছিল। অবশ্যই। কিন্তু তারপরেও পালটা প্রশ্ন রাখা যায় এই যে, তার অর্থ এও নয় যে সাময়িক ভাবে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে এর জন্য গভীর ও লম্বা নিদ্রায় চলে যেতে হবে। এই সংশোধনের জন্যই তাহলে দরকার ছিল, এমন কিছু উদ্ভাবন যা অর্থনীতিকে তার চলার পথে সবল রাখতে পারে। কিন্তু সে পথে কেন্দ্রীয় সরকার হাঁটল না। সে দীর্ঘকাল এই ঝিমুনি অবস্থাটাকেই চলতে দিল যেখানে নতুন করে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা ধীরে ধীরে বিলীন হল। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে ও এক ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় কর্পোরেট কর কমিয়ে সরকার ভাবল যে এতেই কেল্লা ফতে হবে। হালে নির্মাণ শিল্পের জন্য একগুচ্ছ রিলিফ এনেও ভাবা হল কিছু ‘গতি’ বোধহয় দেওয়া গেল। আশ্চর্যের বিষয়, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদদের এই সামান্য বিবেচনাটুকু কাজ করল না যে সমস্যাটা জোগানের নয়, বরং অধিক পরিমাণে চাহিদার। চাহিদাই যদি না থাকে তাহলে কর্পোরেট কর কমিয়ে তাদের সুবিধা বা উৎসাহ বাড়িয়ে লাভটা কী! কারণ, বিনিয়োগ তখনই বাড়তে পারে যখন বাজারে তা বিক্রির সম্ভাবনা থাকে। বোঝাই যাচ্ছে, হিন্দুত্বের খোয়াবে ও গোমূত্রের মায়ায়, ইদানীং এনআরসি’র নেশায়, অর্থ মন্ত্রকের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়েছে। বহুজনে বারবার এই পরামর্শও দিলেন যে চাহিদা বাড়াতে আয়করের হার কমানো থেকে শুরু করে গরিবের হাতে আরও অর্থ প্রসারের প্রকল্প নেওয়া অতীব জরুরি। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!

দ্বিতীয়ত, গত কয়েক মাসে শিল্প উৎপাদনের সূচক নেমে আসা হোক কি মুদ্রাস্ফীতির উর্ধ্বগতি, বিশেষত খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি (এই নভেম্বরে খাদ্যের পাইকারি ও খুচরো মূল্যস্ফীতির হার যথাক্রমে ১১.১ ও ১০ শতাংশে উঠেছে), অর্থনীতিতে আরও তীব্র সংকটের বার্তা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আগামী ত্রৈমাসিকে (জানু-মার্চ’২০) বৃদ্ধির হার আরও পড়ে গিয়ে ৪.৩ শতাংশে পৌঁছনোর কথা বলে কারও কারও অনুমানএরই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির আগ্রাসনে সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে চাকরির সংকোচন ও পাশাপাশি স্বল্পস্থায়ী, চুক্তি-ভিত্তিক নিতান্তই সামান্য বেতনে কর্মসংস্থানই হয়ে উঠছে এ দেশেও যাপনের নিত্য স্বাভাবিক। শুধু সামান্য বেতনই নয়, প্ল্যাটফর্ম ও শেয়ার-অ্যাপ বিশিষ্ট অর্থনীতির দৌলতে আয়ের পথ হয়ে পড়ছে মূলত ইন্সেনটিভ-নির্ভর অধিক-সময় ব্যয়ে অতিরিক্ত রোজগারের পথ। এই পরিস্থিতি সমাজ জুড়ে তৈরি করছে অত্যন্ত কম-আয় নির্ভর এক বিশাল কর্মীবাহিনী যাদের পক্ষে ন্যূনতম মানে জীবন নির্বাহ করা রীতিমতো দুষ্কর। এই ক্রমশ বাড়তে থাকা এক বিপুল স্বল্প আয়ের কর্মীবাহিনী সামগ্রিক ভাবে চলমান বৈষম্যের অর্থনীতিকেই আরও মজবুত করছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

তৃতীয়ত, এক চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ বোধহীন যান্ত্রিক আমলাতন্ত্র অর্থনীতি ও সমাজ জীবনকে আরও পঙ্কিল করে তুলেছে। সরকারের যেন সদাই এক আতঙ্ক ভাব– এই বুঝি তাদের তথ্য, যুক্তি, কাজকম্ম বড়বেশি প্রশ্ন ও সংশয়ের মুখে পড়ে গেল। এই নিয়ে তারা সর্বদাই এক অতি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেনঅনেকটা ঠাকুর ঘরে কলা চোরের মতো অবস্থা! এর ছাপ অর্থনীতিতেও পড়ছে। যে কারণে, গতানুগতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সরকার বা তাদের মন্ত্রীরা কোনও পদক্ষেপই নিতে পারেন না। উপরন্তু, মাথার ওপর বসে আছে পিএমও অফিস, যার অঙ্গুলি হেলন ছাড়া মন্ত্রী বা আমলাদের ঘরে এক পলক বাতাসও বয় না। এই চরম সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে গোটা সরকার ডুবে গেছে। যদি আরএসএস দফতর থেকে প্রধানমন্ত্রী মারফত কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বার্তা আসে তবেই সে কাজে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা আমলারা হাত দিতে পারেন। অর্থনীতির চলাচল তো অমন নির্দেশ মেনে হয় নাতাই থমকে থাকা, স্থবিরতা।

চতুর্থত, দেশের রফতানির হালও অত্যন্ত খারাপ। বিশ্বের বাজারে একটা মন্দা ভাব আছে বটে, কিন্তু রফতানিতে আমাদের খারাপ করার কারণ আমলাতান্ত্রিক জট ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে নানা প্রকার বাধাবিপত্তি। বিশেষত ডিজিটাল পদ্ধতির বাধ্যবাধকতা অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোগপতিদের কাজের গতিতে প্রচুর অসুবিধার সৃষ্টি করছে। এর অন্যতম কারণ হল, এই ডিজিটাল ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত অপারদর্শী, অচল ও কাজের গতিতে বাধাস্বরূপ। সরকারের মূল লক্ষ্য, সংখ্যাতথ্য দিয়ে কাগজেকলমে প্রাপ্তির কোটা পূর্ণ দেখানো; যে ভাবেই হোক, জল মিশিয়েও। এইসব গোঁজামিলের ব্যস্ততায় কাজের কাজ আরও হ্রাস পেয়েছে, তার ওপর অর্থনীতিতে মন্দাভাব, ফলে, রফতানির পরিমাণ আরও কমেছে ও আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি হরেদরে নভেম্বর (২০১৯)’এ এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.১ বিলিয়ন ডলারে। এমতাবস্থায়, রফতানি না বাড়লে অর্থনীতিতে গতি আসা অসম্ভব।

তাহলে কি সরকারের অবিলম্বে উচিত নিজেদের খরচ বাড়িয়ে অর্থনীতিতে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটানো? কিন্তু ইতিমধ্যেই রাজকোষের বিপুল ঘাটতির সম্ভাবনা প্রবল ভাবে উঁকি দিয়েছে। এখনই সরকারি কোষাগারে রাশ না টানলে এই আর্থিক বছর শেষে (২০১৯-২০) ঘাটতির পরিমাণ জিডিপি’র ৫ থেকে ৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, যার ফলাফল মারাত্মক হবে। অবিলম্বে আয়কর হ্রাস করে ও দরিদ্র মানুষদের মধ্যে অর্থের প্রবাহ বাড়িয়ে চাহিদার উর্ধ্বগতি সৃষ্টি না করতে পারলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার অন্য কোনও রাস্তা নেই। রাজকোষ ঘাটতি কমাতে ইতিমধ্যে সরকার কতকগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বিক্রি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ হল দায়ে পড়ে গৃহস্থের ঘটিবাটি বেচে দেওয়ার সামিল। এ অবশ্যই যুক্তিগ্রাহ্য পথ নয়। বরং সরকারের উচিত, সরকারি খরচ বাড়িয়ে বাজারকে চাঙ্গা করা এবং ফলস্বরূপ সরকারি কোষাগারে যে ঘাটতি তৈরি হবে তা কর্পোরেটের মুনাফার ওপর সারচার্জ বসিয়ে আদায় করে নেওয়া। সরকারের যদি বাজারকে চাঙ্গা করার দায়িত্ব থাকে তাহলে সে বাজার থেকে প্রাপ্ত মুনাফার খানিক অংশও কর্পোরেটদের সরকারের ঘরে জমা করা উচিত।

এ হয়তো আপাত এক ব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী পথটি হল- আমাদের মতো দেশে স্বউদ্যোগের ব্যাপক প্রসার ও সচলতার আয়োজন করা। প্রযুক্তির আগ্রাসনে সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরির সম্ভাবনা সারা বিশ্ব জুড়েই ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। আজ ইন্টারনেট ও বিশ্ব-অর্থনীতির মেলবন্ধনের ফলে স্ব-কর্মোদ্যোগের এক নতুন প্রবাহ তৈরি হয়েছে। ছোট ছোট উদ্যোগপতিদের কর্মোদ্যোগে প্রণোদনা ও তাকে বাজারের শৃঙ্খলায় বুনে দেওয়াটাই আসল কাজ। সে কাজ যদি সরকার যথাযথ ভাবে করতে পারে তাহলে অর্থনীতি তার আপন গতিতেই বিকাশ লাভ করবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, নির্দিষ্ট এক পুঁজির অঙ্কের মালিকানা অবধি (ধরা যাক বছরে টার্নওভার ৫ কোটি টাকা) সামান্য এককালীন কিছু অর্থ আদায় ছাড়া এইসব স্বউদ্যোগীদের আর কোনও ভাবে সরকার থেকে বিব্রত করা কাম্য নয়এদের নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে কাজ করার সুযোগটুকু দিতে হবে। আর সমাজ-অর্থনীতিতে থাকতে হবে ইনোভেশন বা সৃজনক্ষমতার অবাধ পরিসর। এই ছোট অর্থনীতির ছোট রথ যদি নিজস্ব গতিতে চলতে শুরু করে, তাহলেই আগামী দিনে আমাদের দেশের অর্থনীতির চেহারা অনেকটা বদলে যাবে। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে জাপান ও চীন কতকটা এই পথেই এগিয়েছে। কিন্তু কথায় বলে, উল্টা বুঝলি রাম! 
    

Monday, 16 December 2019

বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে...


মানুষের শান্তিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে এনএরসি/সিএএ বিদায় নিক
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


খুব দ্রুত পাস করিয়ে নেওয়া হল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। রাতারাতি রাষ্ট্রপতিও সই দিয়ে দিলেন। আর আগেই দিল্লির শাহ হুমকি দিয়ে রেখেছেন, সারা দেশে এনআরসি হবে। দুয়ে দুয়ে খুব সহজেই মেলানোর নিকৃষ্ট প্রবৃত্তিটিও অতএব স্পষ্ট হল।

১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে ২০১৯’এর সংশোধনী মারফত তাহলে কী কী যোগ হল? মূলত তিনটি উপাদান। এক, ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে হলে আগে এ দেশে ১১ বছর থাকার যে ন্যূনতম বিধিটি ছিল তাকে কমিয়ে অন্তত ৫ বছর করা হল। দুই, আগে কোনও দেশের কথা নির্দিষ্ট ভাবে বলা ছিল না, এবারে তিনটি দেশ– আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ– বিশেষ উল্লেখ ও গুরুত্ব পেল। তিন, বলা হল, এই তিন দেশ থেকে ‘অত্যাচারিত সংখ্যালঘু’রা (হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও পারসি) আমাদের দেশে এসে অন্তত পাঁচ বছর বসবাস করলে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী হবেন।

বেশ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা এক, তিনটি দেশ থেকে আগত ছটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম উচ্চকিত ভাবে ঘোষণা দিয়ে তাদের পাঁচ’ বছর বসবাসেই নাগরিকত্ব পাওয়ার যে অধিকারটির জানান দেওয়া হল, তার পেছনে আসলে আরও এক অনুচ্চারিত উচ্চনাদ ছিল। তা হল, মুসলমানদের বাদ দেওয়া। এই মুসলমানদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি খুব উচ্চৈস্বরে শোনানোটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য; আর তা করা হল সংশোধনীতে এক কঠোর নিরুচ্চারিত উৎপাটনের মধ্য দিয়েই। সমস্যা দুই, দীর্ঘদিন ধরে অসমে বসবাসকারী শরণার্থী ও স্থানীয় জনজাতিদের মধ্যে এক স্থায়ী সংঘর্ষের বাতাবরণও তৈরি করা হল। এর থেকে নিষ্কৃতির আপাতত আর কোনও পথই রইল না।

ফলত, যারা এই ব্যতিক্রম নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়বেন, তাঁদের দিকে এরপরেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হবে- যে তিন দেশের কথা বলা হয়েছে সেগুলো তো সব মুসলমান অধ্যুষিত দেশ, সেখানে কীভাবে মুসলমানদের অত্যাচারিত সংখ্যালঘু হয়ে দেশ ছাড়ার প্রসঙ্গ উঠছে? বেশ। যদি তাই হবে, তাহলে এ দেশে উচ্চবর্ণের হাতে দলিত নির্যাতনের এত এত ঘটনা ঘটে কেন আর সে কারণে দলিতদের জন্য আলাদা আইন ও রক্ষাকবচই বা কেন? দলিত ও উচ্চবর্ণ উভয়েই তো হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। তার মানে, একটি ধর্মের মধ্যেও নানারকমের বিভাজন ও গোষ্ঠী থাকতে পারে ও সে ধর্মেও এক অংশের দ্বারা অপর অংশের নিপীড়ন চলতেই পারে। তেমনই মুসলমানদের মধ্যেও নানান বিভাজন ও পক্ষ আছে যারা তাদের প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন ও অত্যাচার করে। এই কারণেই আহমেদিয়া ও সুফি সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা তাদেরই অপর পক্ষের দ্বারা যথেষ্ট নিপীড়িত হয়ে ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে বিপন্ন জীবন যাপন করেন। সে ক্ষেত্রে এই অত্যাচারিত গোষ্ঠীটির প্রতি সংশোধনী আইনে বেয়াদপি করা হয়েছে। তারা ব্যাপক অর্থে মুসলমান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে, অত্যাচারিত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের উপেক্ষা করে এক চরম বৈষম্যের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর নাস্তিক মনোভাবাপন্ন মানুষ যারা তাদের নাস্তিক অবস্থানের কারণেও অত্যাচারিত হন, অথচ তাদের জন্যও রইল না কোনও বিধিব্যবস্থা। এইসব অযাচিত প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে এই আইনের হয়ে যারা ওকালতি করছেন, তারা বড়জোর বলে দিচ্ছেন যে পুরনো আইনে যেভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা সে ভাবেই তারা তা পাবেন। কেন বাপু? তুমি অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য যে সুবিধা দিলে সেই সুবিধা কেন এনারাও পাবেন না? এই প্রশ্নই সারা দেশকে উত্তাল করে তুলেছে।

এ তো গেল একটা ছবি। কিন্তু আরও একটি ভিন্ন ছবি এর সঙ্গে জুড়ে আছে। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির তরফে বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বিজেপি সরকার কোনও ভ্রূক্ষেপ না করেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটিকে আইনে পরিণত করেছে। এই রাজ্যগুলিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। কারণ, এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে আছে নাগরিক পঞ্জীর বিষয়টি। ১৯৫১ সাল থেকে অসম ও পরে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে নাগরিক পঞ্জীর রূপায়ন একটি প্রবল দাবি ও সমস্যা। পরে গত শতকের ৮০-র দশকে অসমে উত্তাল ‘বঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলনে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আসু ও আন্দোলনকারীদের একটি চুক্তি হয় যেখানে স্পষ্টতই বলা ছিল, ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালকে কাট-অফ ডেট করে নাগরিক পঞ্জীতে ভারতীয় নাগরিকদের নাম নথিভুক্ত করা হবে ও উক্ত তারিখের পরে আসা ‘বিদেশি’দের অসম ত্যাগ করতে হবে। বুঝতে হবে, ১৯৪৭-এর দেশভাগ (যা সাধারণ জনের ওপর সম্পূর্ণত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি সিদ্ধান্ত ছিল) ও ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধ, যার ফলে ওপার বাংলা থেকে কয়েক লক্ষ শরণার্থী ও উদ্বাস্তু এ দেশে নিরুপায় হয়ে প্রবেশ করেন যার ফলে অসম, ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে অসম্ভব এক জনস্ফীতি হয় যা মূলত জনজাতি অধ্যুষিত এইসব এলাকায় ছোট ছোট জাতিসত্তাগুলির পরিচয়, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভূত সমস্যা তৈরি করে। এঁদের পক্ষে অনেকটা তা নিজ ভূমে পরবাসীর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেমন, দেখা যাচ্ছে, ১৯৩৫ সালে ত্রিপুরায় যেখানে মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ ছিল তিপরা বা তিপরি ও অন্যান্য উপজাতি, সেখানে ১৯৯১ সালেই তাদের অনুপাত নেমে এসেছে ৩৫ শতাংশে। ফলে, নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ায় এইসব রাজ্যে যে অ-মুসলমান শরণার্থীরা আছেন তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে গেলে স্থানীয় জনজাতি অধিবাসীদের কাছে তা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা হবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। যদিও ইতিমধ্যে এমন বহু শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন বলেই এনআরসি চালু করাটা আবার তাঁদের অন্যতম দাবি। এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের বলে অমুসলমানদের ক্ষেত্রে নাগরিক পঞ্জীর আর কোনও তাৎপর্যই থাকছে না। এই অবস্থাটি তাঁদের কাছে বিজেপির তরফে বিশ্বাসঘাতকতা স্বরূপ মনে হয়েছে এবং তাঁরা এক দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে সামিল হয়েছেন।


এই গোটা পরিপ্রেক্ষিতে এবার আমাদের বুঝতে হবে এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জীর রহস্যটিকে। প্রথমেই স্পষ্ট করে নেওয়া যাক, এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জীতে নাম নথিভুক্ত করার বিষয়টি ১৯৫১ সালে শুধুমাত্র অসমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল এবং সেখান থেকেই প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে যে এত বড় জনস্রোত ঢোকে তা সত্ত্বেও কিন্তু এ রাজ্যে নাগরিক পঞ্জীর প্রসঙ্গ ওঠেনি। কারণ, নানা ভাবে এ রাজ্যের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে উৎখাত হয়ে আসা বাঙালিদের এক করুণাঘন সখ্য বজায় ছিল ও দুই বাংলার চিরন্তন জাতিগত শিকড়ের মধ্যে তা অন্তর্লীন ছিল। কিন্তু অসমের ক্ষেত্রে তা ভিন্নরূপ ছিল। বিশেষত, জনজাতি এলাকাগুলিতে জনস্ফীতির এই চাপকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ের পর উভয় জাতির ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, অর্থনীতিগত ও যাপনরীতিগত ফারাকগুলি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সত্যকে মান্যতা দিতে হবে। উচিত ছিল, সরকারের তরফে, বিশেষত কেন্দ্রের তরফে অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওপর জনস্ফীতির চাপকে লঘু করতে শরণার্থীদের একটা অংশকে সারা ভারতে উপযুক্ত ভাবে বসবাস ও উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র কেউ নজর দেয়নি, উপরন্তু, এই সমস্যাটিকে পুষে রেখে তাকে আজ অগ্নিবলয়ে পরিণত করেছে। উপায়ন্তর না দেখে, এই বাড়তে থাকা সমস্যাকে অসমের আন্দোলনকারীরা নাগরিক পঞ্জীর মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছেন এইভাবে যে ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালের পর অসমে প্রবেশকারী সমস্ত ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘শরণার্থী’দের (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) চিহ্নিত করে অন্তত অসমের বাইরে ঠেলে দেওয়া।

কিন্তু এর সঙ্গে সারা দেশে নাগরিক পঞ্জী চালু করার কোনও প্রয়োজন বা বিধি কোথাও ছিল না। এইখানে এসেই সমস্যাটি আরও ঘোরালো হল ও বিজেপি’র আসল এজেন্ডাটি ঝুলির বাইরে বেরিয়ে এল। তা হল এই, সারা দেশে নাগরিক পঞ্জী করে মুসলমান জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে অ-নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা। তা কীভাবে? যেমন অসমে হয়েছে। অসমে নাগরিক পঞ্জীতে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেছে যার মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষ হিন্দু ও প্রায় ৬ লক্ষ মুসলমান। এঁদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে বহু ভারতীয় নাগরিক আছেন যারা নির্দিষ্ট কাগজপত্র দেখাতে না পেরে নাগরিক পঞ্জীতে নিজেদের নাম তুলতে পারেননি। ফলে, তাঁরা অনাগরিক বা ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। কিন্তু নাগরিক বিলের বদান্যতায় হিন্দু ও অন্যান্য সমস্ত অনাগরিকেরা বা তথাকথিত বাংলাদেশিরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন (২০১৫ সালের আগে এ দেশে প্রবেশ করে থাকলে ও অন্তত পাঁচ বছর বাস করেছেন বললেই হবে, কোনও কাগজপত্রও লাগবে না), মুসলমানেরা বাদে। এইটিই ছিল এই আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য। নাগরিক পঞ্জীতে বাদ যাওয়া সমস্ত ধরনের মুসলমানেরা (ভারতীয় নাগরিক কি বাংলাদেশি) ভারতীয় সমাজে অপাংক্তেয় হিসেবে গণ্য হবেন। এঁদের স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে এবং যতদিন বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে ততদিন এঁরা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের তকমা পরে থাকবেন।

তবুও সংশয়বাদীরা প্রশ্ন তোলেন। যেমন, তাহলে এই আইনের বলে না হয় মুসলমানদের ব্রাত্য করা হল, কিন্তু যে হিন্দু ও অন্যান্য অ-মুসলমানেরা নাগরিকত্ব অর্জনের অধিকার পেলেন সেটা তো কম কথা নয়। বাধ্যত শরণার্থী হয়ে আসা এই মানুষগুলির দুর্ভোগের তো অবসান হল! বন্ধু, কথাটা গোলগোল করে দেখলে এক অর্থে সত্য। কিন্তু তথ্য কী বলছে? ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে যে যুগ্ম সংসদীয় কমিটি হয়েছিল তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে জানতে চেয়েছিল, দেশে নাগরিকত্ব পায়নি উক্ত তিন দেশ থেকে আসা এমন শরণার্থীর প্রকৃত সংখ্যা কত! ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অধিকর্তা উল্লিখিত সংসদীয় কমিটির কাছে জানিয়েছিল যে প্রকৃত সংখ্যাটা হল ৩১,৩১৩ যার মধ্যে ২৫ হাজারের মতো ছিলেন হিন্দু। যে ‘লক্ষ লক্ষ’ শরণার্থী বা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলা হয়, তাঁরা যে কোনও ভাবে হোক এতদিনে পাসপোর্ট কি ভোটার কার্ড আদায় করে ইতিমধ্যেই প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের নাগরিক হিসেবে বিরাজমান। এই তথ্যটাও ইন্টেলিজেন্স অধিকর্তারই দেওয়া। তাহলে এই আইনটা কি শুধুমাত্র ওই ৩১ হাজার মানুষের জন্যই আনা হল? এ তো ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির অবস্থা! ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৩১ হাজারকে কি দূরবীন দিয়েও দেখা যাবে?

তাহলে হাতে রইল কী? হাতে রইল ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ! ফলাফল: বিভাজন ও হিন্দু ভোটের অধিক ভাগ। সমস্ত দেশে নাগরিক পঞ্জীতে নথিভুক্তিকরণের অস্ত্র চালিয়ে ধরা হবে কাগজপত্র নেই এমন ভারতীয় নাগরিকদের। তাদের মধ্য থেকে আলাদা করা হবে মুসলমান নাগরিকদের। ডিটেনশন ক্যাম্প হবে তাদের পরবর্তী আস্তানা। কারণ, তথ্য এও বলছে, ২০১১ সালের পর থেকে কার্যত বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে শরণার্থী বা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা একেবারেই আর নেই। কারণ, বাংলাদেশ এখন অর্থনীতির ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। তাদের জাতীয় বৃদ্ধির হার ভারতবর্ষের থেকে অনেক বেশি। ভারতে যেখানে বর্তমান ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে সেখানে বাংলাদেশে গড় বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের আশেপাশে। আর শেখ হাসিনার সরকারও সে দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় অনেক দরদী। এমনকি তাঁর সরকার ভিটেমাটি ছেড়ে এ দেশে চলে আসা শরণার্থীদের কাছে আবেদনও করেছেন বাংলাদেশে এসে নিজেদের বাপ-ঠাকুর্দার জমির আইনসম্মত দাবি জানাতে। উপরন্তু, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আব্দুল মোমেন স্পষ্টতই জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নাগরিকেরা যদি ভারতে বেআইনি ভাবে বসবাস করে থাকেন তাহলে তার তালিকা ভারত সরকার দিক। বাংলাদেশ সরকার সেই মানুষগুলিকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজী। উলটে তিনি বরং এই অভিযোগ এনেছেন যে বাংলাদেশের উন্নতির ফলে এখন ভারত থেকে বহু মানুষ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন।
তাই, বদলে যাওয়া সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আমাদের আজ অবস্থান নিতে হবে। পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চাগিয়ে তোলার কোনও অবকাশই নেই। তবুও স্তিমিত হয়ে আসা সীমান্ত পারাপার, অর্থনীতির স্বপ্ন সোপানে আগামী দিনের উন্মীলনে ব্যস্ত আধুনিক প্রজন্মের রক্তের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে অনুপস্থিত বিভাজনের কল্পিত বিষ। সমস্ত মানুষকে আজ ঐক্যের পরিচয় দিতে হবে। তা বিপুল, বিশাল গণ জমায়েতের মধ্য দিয়ে। হিংসাত্মক আন্দোলন করে বিভাজনের বীজকে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। তাই একই সঙ্গে আওয়াজ রাখতে হবে: CAA প্রত্যাহার কর+NRC বন্ধ করো+উত্তর-পূর্বের শরণার্থীদের দায় শুধু সেই রাজ্যগুলির নয়, সমস্ত দেশকে নিতে হবে।

Wednesday, 11 December 2019

জীবনের পক্ষে

গ্রেট ওয়ার্ক গ্রেটা
ইন্দিরা ব্যানার্জী
'ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা' - দূরদর্শী কবির কলমে তারুণ্যের জয়গান। যখনই অন্যায়-আক্রোশ-অসহিষ্ণুতা তখনই আগামী প্রজন্মের প্রতিরোধ। সে স্বাধীনতা-শিক্ষা-ভাষা বা পরিবেশ যে কোনও ক্ষেত্রেই সাবলীল। গরম রক্তের উর্জায় পরিবর্তিত হতে বাধ্য হয়েছে যা কিছু গতানুগতিক।

এমনই কোন বাধায় হার না মানা 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে' মতে বিশ্বাসী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সুইডেনের স্টকহোম নিবাসী গ্রেটা থুনবার্গ। যে মাত্র ষোল বছর বয়সেই বিশ্বের কাছে পরিবেশ সচেতনতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে আত্মদীপ্তিতে।

ইউরোপের সুইডেন নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশ। যেখানে জুন-জুলাই মাসে ২০-২৫ সেন্টিগ্রেড এবং জানুয়ারি ফ্রেবুয়ারিতে মাইনাসে উষ্ণতা থাকে। কিন্তু ২০১৮ সালটি নাসার বিজ্ঞানীদের মতে, সুইডেনের উষ্ণতম বছর। সে বছরেই ক্রমাগত দাবানল, খরা, উষ্ণপ্রবাহ গড় তাপমাত্রাকে বাড়িয়েছে এবং এ রকম চলতেই থাকলে ২০৮০ সালের মধ্যে গড় উষ্ণতার সাত ডিগ্রি বৃদ্ধি নিশ্চিত। এমন সব ভবিষ্যৎবাণী ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল স্টকহোমের ক্লাস নাইনে পাঠরতা গ্রেটার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ পরিবেশের জন্য সে বেছে নিল 'স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট'এর মতো কর্মসূচি।

গ্রেটার চলার পথ মসৃণ ছিল না। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে একটানা তিন সপ্তাহ স্কুল বয়কট করে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার আর্জি নিয়ে ঠায় বসে ছিল গ্রেটা। শুধু তাই নয়, জনমত জোগাতে লিফলেট বিলি করছিল ছোট ছোট হাত। প্রথমে তার স্কুলের সহপাঠীরাও তাকে সাথ দেয় নি কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই মিডিয়ার দৌলতে গ্রেটার আন্দোলন এবং প্রতিবাদের ভাষা জনপ্রিয়তা পায়।

এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন, জার্মানি-বেলজিয়াম-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া-জাপান-বাংলাদেশ সহ মোট ১০৫টি দেশের ১৬৫৯টি স্থানে পরিবেশ রক্ষার জন্য কমিউনিটি গড়ে ওঠে। যারা 'ফ্রাইডে ফর ফিউচার' কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে।

এ প্রসঙ্গে খাইবার প্রদেশ নিবাসী মালালা প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়। মালালা যেমন সবার জন্য শিক্ষা প্রসঙ্গে বলে 'একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই আর একটি কলম দুনিয়া বদলে দিতে পারে। শিক্ষাই একমাত্র সমাধান।' তেমনি গ্রেটা জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রিন হাউস গ্যাস নিষ্কাষণ কমানোর পক্ষে নিজের মতামত দিতে গিয়ে বলে, 'আমি এখন জলবায়ুর ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের পক্ষে।'

২০১৫ সালে ১৯৫টি দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদন কমানোর জন্য প্যারিস চুক্তি হয় যা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাতে ইউরোপের অনেক দেশ বাতিল করে। গ্রেটা এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে। গ্রিন হাউস গ্যাস সংক্রান্ত বিষয়ে সে বলে, 'যদি নিষ্কাষণ থামাতে হয় তাহলে তা থামাতেই হবে। আমার কাছে বিষয়টা সাদা-কালো। টিঁকে থাকাই যখন বিষয়, তখন ধূসরতার কোনও জায়গা নেই।'

জলবায়ুর সাম্য রক্ষায় গ্রেটার এই আন্দোলন ও বিশ্ববাসীর কাছে এর গ্রহণযোগ্যতার জন্য ২০১৯-এর মে মাসে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ তাকে নিয়ে। শিরোনাম 'নেক্সট  জেনারেশন লিডার'। পরিবেশ বাঁচাতে গ্রেটার ভূমিকা ও তার প্রভাব 'গ্রেটা থুনবার্গ এফেক্ট' নামে পরিচিত।

'ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব' - লক্ষ্যে অবিচল গ্রেটা ব্যক্তিগত জীবনে কার্বন ফুট প্রিন্ট কমানো, মাংস ভক্ষণ না করা, প্লেনে সফর বাতিল করে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে নিজের ভূমিকা পালন করেছে। জাতি সংঘে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে তার দৃঢ় ঘোষণা 'বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে, পরিবেশকে না বাঁচিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কেবল ফাঁকা রূপকথা'।'

সত্যিই স্থিতিশীল উন্নয়নে পা মেলাতে গ্রেটার মতো আবেগী কিন্তু সাহসী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের প্রশ্নই আসে না।

Thursday, 7 November 2019

ধর্মের কল...

ধর্ম ও রাজনীতি
একটি আলোচনা
সম্পাদনা ও সংকলন: উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
যারা ধর্ম মানেন তাঁদের উচিত কুসংস্কার থেকে যথার্থ ধর্মকে আলাদা করা - এমন কথা অনেকেই বলেন।
তাদেরকে বলা উচিত - একটু কথাটা ব্যাখ্যা করতে পারেন ? দেখুন, মানুষ নানান প্রকার। কোনও মডেলে ফেলে কিছুই ছোঁয়া যায় না মানুষকে। আইনস্টাইন নিজেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, শোনা যায়। আজ আমি যে ব্যাপারে যুক্তিবাদী, সেই আমিই হয়তো অন্য ব্যাপারেই অযৌক্তিক - করা উচিত নয় বলেও অনেকেই আমরা সজ্ঞানে হয়তো সেটাই করি, অনেক কাজই এমনি করি। এখন কোনও ব্যাপারকে বিচার যখন করব শুধু সেইটুকু পরিসরে নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে আমি কি উক্ত ব্যাপারটিতে নির্মোহ? এটাকেই হয়তো সততা বলা হয়।

কুসংস্কার কী, আর ধর্মই বা কী। দুটো কি সমানুপাতিক? নাকি, অসম্পর্কিত? মানে, কী হওয়া উচিত। আবার একজন মানুষ দু' জায়গায় দুরকম আচরণ করে। তার অবস্থান কিরকম সেইটাকে ধরেই এটা হয়। ধরা যাক, কেউ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখেন না। এটাও একটা ধর্ম। কিন্তু তিনি যখন ধর্ম ও কুসংস্কার নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন তখন বলবেন, 'ধর্মকে কুসংস্কারের ভিতরে যোগ করা উচিত নয়।' এই আপনিই একজন নাস্তিক হয়ে যখন ঘরোয়া ভাবে আপনারই ধারণার কাছাকাছি মানুষদের নিয়ে বৈঠক করছেন, তখন আপনার অনুধাবন, ধর্মীয় সংস্কারই কুসংস্কারের জন্ম দেয়। মানুষ কুসংস্কারকে সরাতে সম্পূর্ণ পারবেই না যতদিন ধর্ম থাকবে। এটাই প্যারাডক্স, এটাই ডাইকোটমি। অতএব, আলোচনাটা খুব ভারী, গম্ভীর।

আমার মনে হয়, কেউ যে ভাবে চলে জীবনে স্বস্তি পান, ছন্দ খুঁজে পান, নিজেকে এবং অন্যকে বোঝার মরমী মনের অধিকারী হতে পারেন, তাই তার ধর্ম। এসব সহজে অর্জন করা যায় না। ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে আসতে পারে, নাও আসতে পারে। ব্যক্তি বিশেষের ওপর তা নির্ভর করে। বুদ্ধদেব ঈশ্বরের কথা বলেননি। অষ্টমার্গের কথা বলেছেন--Right Thinking,  Right Word, Right Action, Right Profession ইত্যাদির কথা যে বলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। পরার্থে কাজ করলে মন প্রসারিত হয়। এটাও ধর্ম। ধর্মের নানা রূপ। মনকে প্রসারিত করে কারও ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারাটাও মানব ধর্ম। নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা। এসব নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া যত বিস্তার লাভ করে ততই নিজের অবস্থানে সামঞ্জস্য আনা যায়। সংঘাতকে অনেকটা এড়ানো যায়। নিজের পথটা ঠিক চিনতে হয়। সকলেই এক পথের পথিক হন না। আমাদের আচরণে ফুটে ওঠে আমরা যথার্থ ধার্মিক কিনা। সমাজের সর্বতো কল্যানের পথের সন্ধানই ধর্মের লক্ষ্য। ঠিকই। ধর্মের নির্যাস এটাই। ছিলও এটাই, হয়ও এটাই। কিন্তু সংস্কার, আধার, রিচ্যুয়ালগুলো ধর্মের সাথে ঐতিহাসিক ভাবে মিশে গেছে। ফলে, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পরা মানে ইসলাম ধর্ম বা দেবদেবী পুজো দেওয়া বা মারা যাবার পর দাহ করা বা কবর দেওয়া, তা সবই বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন চিহ্ন। এভাবেই আচার বা সংস্কৃতি বা ব্যবহারগুলোই এখন ধর্মের রূপ নিয়ে বসে আছে। কাজেই নিজেকে ও অন্যকে মরমী মনের বোঝাটা তার এখন যেন মূল যে ধর্মের কথা এটা বা এই ধারণাটাই অন্তরীণ হয়ে গেছে। তার মানে, এই যে ধর্মের অর্থের যে পরিবর্তন ঘটল তা কিন্তু ঐতিহাসিক বা বাস্তব।

এবারে আসি রাজনীতিতে। ধর্মকে ধরেই শাসনকার্য শুরু হয়ে যায়। তাই রাষ্ট্র, ধর্ম ও শাসন ব্যবস্থা মিলেমিশে থাকে। কিন্তু এই ধর্ম হল চিহ্নের। তার মানে রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ধর্মের সার্বিকতা ত্যাগ করে খোলস বানিয়ে দিল ধর্মের সংস্কৃতি ও আচারের আইডেন্টিটি'তে। বিজ্ঞানের প্রগতির পথে ধর্ম প্রতিবন্ধক, এমন একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। কথাটার সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণও আছে। গ্যালিলিওকে ধর্মযাজকদের হাতে নিগ্রহ স্বীকার করতে হয়েছিল। জীব হিসেবে মানুষের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে ডারউইনের মত খৃষ্টধর্ম সহজে মানতে চায়নি। নতুন সত্যের পথে কুসংস্কার বারবারই বাধা হয়েছে। এসবই স্বীকার্য। তবু ধর্মের প্রতিবন্ধকতাকে খুব বড় করে দেখাবার আগে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের অন্য দিকটার প্রতিও একটু নজর দেওয়া উচিত। মধ্যযুগের শেষভাগে বিজ্ঞান চর্চা ইউরোপে নতুন করে শুরু হয় ধর্মের ছায়াতে;  ধর্ম প্রতিষ্ঠানের ধার ঘেঁষে নতুন প্রয়াস বেড়ে ওঠে। চার্চের আওতা থেকেই খ্রিস্টিয় তের শতকের রোজার বেকন গণিত ও জ্যোতিষ, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র বিষয়ে অধ্যয়ন গবেষণার মহত্ব ঘোষণা করেন। সেই থেকে আজ অবধি বহু বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন অর্থে ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধার্মিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন ঈশ্বরের নিজের হাতে লেখা বই, তাই এর সূত্রোদ্ধার মহৎ কাজ, এমনই ভাবতেন আস্তিক বিজ্ঞানীরা।

ধর্মকে কেন্দ্র করেই বহু কুসংস্কার জমে ওঠে। বিজ্ঞানের প্রগতির পথে তারা বাধা হয়। সে বাধা অতিক্রম করেও বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। আর কুসংস্কার ছাড়িয়েও ধর্মের বাণীর কিছু অর্থ হয়তো অবশিষ্ট থাকে। হয়তো এটা বিবেচ্য যে তা থাকে কিনা। তার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গ চলে আসে স্বাভাবিকভাবেই। বিজ্ঞানের প্রগতি অন্ধবিশ্বাসে বাধা পেয়েছে, এটাই ধর্মান্ধতার একমাত্র বিপদ নয়। তার চেয়েও বড় বিপদ দেখা দিয়েছে অন্য পথে। ধর্মান্ধতার তিক্ততম ফল সাম্প্রদায়িক বিরোধ। যেমন, ষোড়শ শতকে জার্মানি ছিল শিল্পে-বাণিজ্যে-সংস্কৃতিতে ইউরোপের অগ্রগণ্য দেশগুলির অন্যতম। তদানীন্তন ইংল্যান্ডের তুলনায় জার্মানিকেই অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশ বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন। অথচ, আরও এক শতাব্দী পরে জার্মানি ইউরোপের একটি পিছিয়ে পড়া দেশ হয়ে গেল। এর প্রধান কারণটি কী? সতের শতকে খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তাক্ত সংগ্রামের ক্ষমতার লড়াই। তারই সাংঘাতিক পরিণতি হিসেবে জার্মানি বহুকালের জন্য কি রাজনীতিতে, কি অর্থনীতিতে, কি সংস্কৃতিতে, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এর বিষময় ফল পৃথিবীকে বিশ শতক পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে। সতের শতকে অবশ্য শুধু জার্মানিতেই নয়, ইউরোপের অধিকাংশ দেশেরই সমাজজীবনে সাম্প্রদায়িক বিরোধে আলোড়ন হয়, আর বহু দেশই এর ফলে অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তাই, বহু রক্তক্ষয়ের ভিতর দিয়ে একটা কথা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পরধর্মসহিষ্ণুতা ছাড়া সুস্থ সমাজজীবন সম্ভব নয়। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। কথাটা আর এক ভাবে ধরা যাক। শোনা যায় নাকি মানুষ বাস্তব স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। স্বার্থসিদ্ধির কিন্তু দুটো পথ আছে। একটাকে বলা যায় বিরোধ অথবা দস্যুবৃত্তির পথ অর্থাৎ অপরের ক্ষতিসাধন করে নিজের লাভ, অন্যটি সহযোগিতার পথ অর্থাৎ সহযোগিতায় সকলের উন্নতি। বিরোধ ও সহযোগিতার মধ্যে কোন পথটি  মানুষ বেছে নেবে তা শুধু বাস্তব অবস্থা দিয়েই নির্ধারিত হয় না, ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মানসিকতার উপরেও নির্ভর করে। সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিতে যখন আমরা উন্মত্ত হয়ে উঠি তখন বিরোধের পথকেই একমাত্র পথ বলে মনে হয়। হিন্দু আমি ভাবি মুসলমান নিধন করেই আমার জয় সম্ভব; মুসলমান আমি ভাবি হিন্দুকে বধ করে আমার জয়। হিন্দু মুসলমানের ভিতরে যে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থসিদ্ধির আরও একটা পথ খোলা আছে সাময়িকভাবে হলেও সে কথাটা আমরা বিস্মৃত হই; ফলে দেশ বিভক্ত হয়। বেড়ার ওপারে যে আমারই ভাই-বোন সে অপর হয়ে যায়। কে সেই বেড়া দেয় ? আর তার কুফল ভোগ করে কারা?

Wednesday, 6 November 2019

ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফেলিস

ঘচাং ফু্
সঞ্জয় মজুমদার
তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের আজ প্রয়াণ দিবস। ১৯৭০এ মাত্র ৫২ বছর বয়সে আজকের দিনে, কলকাতায়, তাঁর অমৃতলোকে যাত্রা। অমর হয়ে আছেন অনেক কিছুর মধ্যে, অনেক অবিস্মরনীয় চরিত্রের মধ্যে। যেমন ভজহরি মুখোপাধ্যায়, স্বর্ণেন্দু সেন, কুশলকুমার মিত্র, কমলেশ্বর বন্দোপাধ্যায়, এমন অনেকে। এই অব্দি একটু রহস্য করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এবার একটু ঝেড়ে কাশি। ভজহরি মুখোপাধ্যায় (আসল নাম প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ১৯৪৬এ মধ্য কলকাতার গলির গলি তস্য গলির ভিতর একটি বাড়ির মালিক, ২০ নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিট) আসলে গুলবাজ, রকবাজ বাঙালির আদর্শ, আমাদের এক ও অদ্বিতীয় 'ডি-লা-গ্র্যান্ডি-মেফিস্টোফিলিস', নয় নয় করে ছয় ফুট উচ্চতার, মৈনাক পর্বতের মত নাকের মালিক, টেনিদা। আর বাকি তিনজন হলেন 'ইয়াক্ ইয়াক্', মানে, স্বর্ণেন্দু সেন (সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করা, ঢাকাইয়া, 'হ হ আমাগো একটা মতলব আছিল' হাবুল), কুশলকুমার মিত্র (হতচ্ছাড়া, চিরকালের বিশ্বাসঘাতক, স্কলারশিপ আর ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা ক্যাবলা), আর কমলেশ্বর বন্দোপাধ্যায় (পেটরোগা প্যালারাম বাঁড়ুজ্জে, নিত্যি প্যলাজ্বরে ভোগে, পটলডাঙায় থাকে, পটল দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোল খায়, আর দু'পা হাঁটতে গেলেই তার পেটের পিলে খটখট  করে জানান দেয়। যদিও টেনিদা মাঝেমাঝেই এক চড়ে তার নাক নাসিকে আর কান কানপুরে পাঠাবার হুমকি দিয়ে ঠিক রাখে)।
যাগ্গে, এত ভণিতার পরে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যে আসলে আমাদের প্রাণের সাহিত্যিক, বরিশালের বাঙালি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, এটা বলতে গেলে জনগণ আমাকে চ্যঙদোলা করে চায়নায় ছুঁড়ে ফেলবে, বিশ্বাসঘাতকও বলতে পারে। তা বলুকগে। এটুকু রহস্য না করলে, 'খট্টাঙ্গ ও পলান্ন', 'মৎস্য-পুরাণ', 'ন্যাংচাদার হাহাকার', 'টেনিদা আর ইয়েতি', 'একাদশীর রাঁচি যাত্রা', 'দি গ্রেট ছাঁটাই', 'হনোলুলুর মাকুদা', 'টিকটিকির ল্যাজ', 'ব্রহ্মবিকাশের দন্তবিকাশ', 'চামচিকে আর টিকিট চেকার', 'ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন', 'কুট্টি মামার দন্ত-কাহিনী', 'একটি ফুটবল ম্যাচ', 'দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা', 'প্রভাতসঙ্গীত', 'সাংঘাতিক', 'কাক-কাহিনী', 'বেয়ারিং ছাঁট', 'হালখাতার খাওয়াদাওয়া', 'ঘুটেপাড়ার সেই ম্যাচ', 'কাঁকড়াবিছে', 'ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি', 'পরের উপকার করিও না', 'ঢাউস', 'তত্ত্বাবধান মানে-জীবে প্রেম', 'ভজ গৌরাঙ্গ কথা', 'ক্যামোফ্লেজ', 'দশাননচরিত', 'নিদারুণ প্রতিশোধ', 'কুট্টিমামার হাতের কাজ', 'চেঙ্গিস আর হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা', 'দশাননচরিত', 'পেশোয়ার কী আমির', 'টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক', 'ঝাউ বাংলোর রহস্য', 'কম্বল নিরুদ্দেশ', আর 'চারমূর্তি'র অমর স্রষ্টা এবং তাঁর প্রজন্মরোহিত অমরসৃষ্টিকে উপভোগ করা যায়? বোঝা যায়? বাঙালির '...দাদা' সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রকবাজির প্রাণপুরুষ, তুলনাহীন গুলবাজির প্রাণভোমরা প্রবাদপ্রতিম সব প্রবচনের জনক 'টেনিদা', সেই কবে থেকে আড্ডাপ্রিয় ভোজনরসিক  বাঙালীর অপ্রতিরোধ্য 'দাদাগিরি'র সফল নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন।

ব্যক্তিগত পড়াশোনায়, শিক্ষকতায় আর সাহিত্যচর্চায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যেন সরস্বতীর বরপুত্র। যেমন রূপবান তেমন গুণবান। সাহিত্যের বহুধা বিস্তৃত অঙ্গনে, যেমন, কিশোর সাহিত্য, ছোটগল্প ও উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটিকা ইত্যাদি বিবিধ শাখায় মানুষটির ছিল অবাধ বিচরণ। নিজে হাসতে পারা সহজ কথা নয়, হাসাতে পারা আরোই নয়। মধ্য কলকাতার গলি, তস্য গলির বাড়ির বৈঠকখানায়, দোতলার ছাতে, বাড়িওয়ালার সাথে সপরিবারে, ঘন্টার পর ঘন্টা, বাঙালির প্রিয় আলুকাবলি, ঘুগনি, ফুচকা, মুড়ি-চপ-সিঙ্গাড়া, দই-মিষ্টি, কুলফি-বরফ এবং অবশ্যই চা সহযোগে (যদিও টেনিদা খেতে খেতে খাট পালঙ্ক কাপ প্লেট ডিস্ সবই প্রায় চিবিয়ে খাওয়ার ক্ষমতা রাখতো) ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, আর আড্ডার নাভিপদ্ম থেকে উঠে আসা কালজয়ী সব সৃষ্টি, আর তাদের হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরানো কিংবদন্তি কীর্তিকলাপ, চির-স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর লেখনীর মধ্যে সাহিত্যরস যেন অফুরন্ত। জোর করে কাতুকুতু দিয়ে নয়, কারো বিচারবুদ্ধিকে ব্যঙ্গ করে নয়, তীব্র, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে রুচিসম্মত হাস্যরসের বিস্ফোরণ।

টেনিদার নাম শোনেননি, অথবা টেনিদার একটাও কাহিনী পড়েননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে বের করার থেকে খড়ের গাদায় পিন খোঁজা অনেক সোজা। বাড়ির রোয়াকে বসে নির্ভেজাল আড্ডা, চুটিয়ে খাওয়া-দাওয়া, ফুটবল ক্রিকেট খেলে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া, মানে যেটা হলো গিয়ে বাঙালির ডিএনএ কনফিগারেশন। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কেউ করতেও চাইবে না। আজকের সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও টেনিদার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি। এখানেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় স্রষ্টা হিসেবে কালোত্তীর্ণ। বন্ধুবান্ধব যখন একজায়গায় একসাথে আড্ডা আর গুলতানি মারব, একে অপরকে চোখে না দেখলে, হাত পা আর চোখের ভাষা না পড়লে, কি করে সেটা সম্ভব? সোজা উত্তর, 'অসম্ভব'। অজস্র প্রতীকী চিহ্নের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় পছন্দ-অপছন্দ, অবাক হওয়া, ভালোবাসা, রেগে যাওয়া, দুঃখ পাওয়া, কান্না পাওয়া, এমন কত কী জানানো যায়, নতুন কিছু ভাবনা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করা যায়, ভাগ করে নেওয়া যায়, এমনকী ভিডিও কল আর কনফারেন্স কলে ভার্চুয়ালি এক জায়গায় আসাও যায়, কিন্তু বাঙালির নির্ভেজাল আড্ডা? সেটাতো করা যায় না। এইখানেই মার্ক জুকারবার্গের থেকে আমাদের ঘরের মানুষ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় শত সহস্রযোজন এগিয়ে। নারায়ণবাবু আজ বেঁচে থাকলে, জুকেরবার্গকে কুড়ি নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিটে নেমন্তন্ন করতেন নিশ্চিত। সঙ্গে মুড়ি, আলু-কাবলি, চপ, আর চা। ক্লাস টেন-এ, মনুমেন্টের মত বছরের-পর-বছর দাঁড়িয়ে থাকা টেনিদার পাল্লায় পড়ে দু-সেকেন্ডে ফেসবুকের লালবাতি জ্বলে যেত। একটু কি জাত্যাভিমান প্রকাশ পেল আমার? নিশ্চয়ই। পেয়েছে বৈকি। হাজারবার পেয়েছে। আর আমি তাতে একটুও লজ্জিত নই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিলক্ষণ বুঝেছিলেন বাঙালির মনের কথা। অত কর্মসংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে বাঙালিকে দমানো যাবে না। আড্ডার বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে ভরে নিয়ে হৃদপিন্ডের রক্তকে বিশুদ্ধ করতেই হবে, নাহলে ঘটি পাড়ায় বাঙাল সংস্কৃতির মিশেলে তৈরি বাঙালির জাত যাবে। আর তাছাড়া আড্ডা শুধু বাঙালির একার সংস্কৃতি নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে আড্ডাপ্রিয় বহু জাতি-উপজাতি পাওয়া যাবে, যাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি যুগের পর যুগ বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাল্লায় পড়ে সবারই একটু আধটু আসন টলেছে, চলনে-বলনে গ্লোবাল গ্লোবাল ভাব এসেছে, কিন্তু মোটের উপর মাটির শিকড় মাটিতেই আছে।

মরুকগে এসব কথা এখন। চাঁটি মেরে চাটগাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়তে ফিরে আসি। টেনিদার গল্প ছাড়াও বেশ কিছু অন্যধারার উপন্যাসও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে, যেমন কিনা, 'উপনিবেশ-১', 'উপনিবেশ-২', 'উপনিবেশ-৩' (১৯৪৪-১৯৪৭), 'মহানন্দা', 'নিশিযাপন', 'বিদূষক', 'ভাটিয়ালি', 'সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী'(১৯৪৪), 'মন্দ্রমুখর'(১৯৪৫), 'শিলালিপি'(১৯৪৯), 'লালমাটি', 'কৃষ্ণপক্ষ'(১৯৫১), 'বৈতালিক'(১৯৫৫), 'অসিধারা(১৯৫৭), ইত্যাদি। 'শনিবারের চিঠি'র নিয়মিত লেখক ছিলেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তাঁর বিদ্রুপাত্মক লেখা 'সুনন্দর জার্নাল' পাঠককুলের কাছে এক অবিস্মরণীয় সম্পদ। নাটকেও হাত পাকিয়েছেন, যেমন, 'আগন্তুক', 'ভাড়াটে চাই', 'ভীম বধ', ইত্যাদি। যৎসামান্য হলেও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, এবং গ্রামোফোন রেকর্ডের গানও সাফল্যের সাথে রচনা করেছেন। ছোট গল্পের মধ্যে গল্পসংগ্রহ 'সাপের মাথায় মনি', 'ট্রফি' (১৯৪৯), 'বিতংস', 'ভাটিয়ালি'(১৯৫৭), 'দূঃশাসন', 'জন্মান্তর', 'ঘূর্ণি' 'ছায়াতরি', 'আলেয়ার রাত', 'টোপ' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চেনাজানা পুরস্কার বলতে ১৯৬৪তে আনন্দ পুরস্কার জুটেছিল।

আদ্যোপান্ত নির্ভেজাল বাঙালি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছাত্র জীবনেও ছিলেন অত্যুজ্জ্বল। দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, তারপর স্নাতক স্তরে (ডিস্টিংশনসহ উত্তীর্ণ) বি.এম  কলেজ বরিশাল (১৯৩৮) হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিষ্ঠান। মাস্টার্স-এ(১৯৪১) অসামান্য ফলাফলের জন্য ব্রহ্মময়ী স্বর্ণপদক প্রাপ্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই 'বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প'র উপর গবেষণার ফলস্বরূপ তাঁকে ডি.ফিল-এ সম্মানিত করা হয়। সাহিত্যপ্রেমীরা তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়টি প্রবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন, যেমন, 'সাহিত্যে ছোটগল্প', 'ছোটগল্পের সীমারেখা', 'বাংলা গল্পবিচিত্রা' এইসব। বরিশালে, স্নাতক স্তরে পড়াশোনার সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশকে। এটা তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

শিক্ষক জীবনও ছিল গৌরবজনক। জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজ(১৯৪২-১৯৪৫), আর কলকাতার সিটি কলেজে (১৯৪৫-১৯৫৫) দীর্ঘকাল অধ্যাপনার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৬ থেকে শিক্ষকতা শুরু। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গাঙ্গুলীর স্মৃতিচারণায় তাঁদের প্রিয় এই মাস্টারমশাই কেমন মানুষ ছিলেন, সেসব না হয় আরেকদিন খোঁজখবর করে জানা যাবে।

আসলে উপরের কয়েকটি অনুচ্ছেদে মানুষটার পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি আর কাজকর্মের গৌরবজনক দিকটা তুলে ধরা বাঞ্ছনীয় ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে, পড়াশোনায় তুখোড়, এই স্রষ্টার হাতেই গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন 'টেনিদা' চরিত্রের জন্ম। এ এক লক্ষণীয় এবং চমকপ্রদ বৈপরীত্য। দীর্ঘায়িত জীবন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল না, সেটা তাঁর জন্ম মৃত্যুর তারিখ (১৯১৮-১৯৭০) দেখলেই বোঝা যায়। সংক্ষিপ্ত জীবনের গণ্ডিতেই আশেপাশের সাধারণ কিছু মনুষ্য চরিত্র আর ঘটনাকে সঙ্গী করে, কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, তাঁর অমর সাহিত্যসৃষ্টি বাঙালির মননে দীর্ঘকালীন, এমনকী বলা যেতেই পারে, চিরস্থায়ী আলোকপাত করে গেছে। ভরদুপুরে মরুভূমিতে অথবা একরাত কোন শ্মশানে বা গোরস্থানে আমাকে যদি থাকতে বলা হয়, তবে আমি একটা শর্তে রাজী হতে পারি, সঙ্গে যেন 'যোগ-সর্পর হাঁঁড়ি' আর চুটকিতে ভূতের ভয় উড়িয়ে দেওয়া আর খাটের তলায় বসে ওয়াচ্ করতে থাকা 'টেনিদা' থাকে।

Tuesday, 22 October 2019

এক সাধারণের জবানিতে অভিজিৎ


তিনি থাকুন তাঁর মতোই
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
আমরা যারা নিতান্তই পিএনপিসি করা, সবজান্তা শিরোমণি, অকালপক্ক, খাপ পঞ্চায়েত বসানোয় ওস্তাদ, কুচুটে বাঙালি, তারা সক্কলেই অন্তত একটা ব্যাপারে খুব পাকা মস্তিষ্ক: পুরে দেওয়া। যেমন, জেলে পুরে দেওয়াটা বেশ আমোদের। কিন্তু সে ক্ষমতা তো আবার আমার-আপনার নেই। পুলিশ তেমন ‘নিন্দেমন্দ’ কাউকে যদি জেলে পুরে দেয় তো আমাদের ভারী উৎসাহ। কিন্তু বাকী ‘পুরে দেওয়া’গুলোতে আমরা বেশ সিদ্ধহস্ত। কেউ যদি কম কথা বলে, তাকে আমরা দেমাকির ঘরে পুরে দিই, কেউ যদি একটু বেশি এগিয়ে এসে কারও সাহায্যে লাগে তো তাকে ‘নির্ঘাৎ ধান্দাবাজি’র খোপে ফেলতে আমাদের কালবিলম্ব হয় না, কেউ যদি ‘সর্বজন-স্বীকৃত’র বাইরে অবস্থান করে সে নিশ্চিত পাগল অথবা সন্দেহজনক। আর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মতামতকে সর্বাগ্রে পার্টির খোপে পুরে দিতে আমরা আরও তৎপর। সাধে কি আর রবীন্দ্রনাথ, তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পর কলকাতা থেকে ট্রেন ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে সংবর্ধনা দিতে আসা তাঁর নিন্দুকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আজ আমাকে দেয় আপনাদের সম্মাননা আমি ওষ্ঠ অবধি তুলতে পারি মাত্র, তাকে পান করার শক্তি আমার নেই।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তির পর দেখা গেল একশ্রেণি বাঙালির সেই চির অভ্যেস আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেন তাঁদের নোবেল প্রাপ্তির আগে যতটা বাঙালি সমাজে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, অভিজিৎ তা একেবারেই নন। হঠাৎ করে এমন এক প্রায়-অজানা বাঙালি নামের সঙ্গে নোবেল ঘোষণা জড়িয়ে যেতেই প্রাথমিক হতচকিত হয়ে পড়া একটা হল বটে কিন্তু বাঙালি যেহেতু বড় সেয়ানা তাই জানে, হাতের মুঠোয় গুগল থাকতে ‘ফলস খাওয়াটা’ অত অস্বস্তির কিছু নয়। নিমেষে সকলে জেনে গেলেন, অভিজিৎ কাহারে কয় আর তার কত ও কী কী প্রকার। ব্যস। শুরু হয়ে গেল পুরে দেওয়ার খেলা। এক পক্ষ তাকে পুরে দিলেন বিজেপি বিরোধী শিবিরে, প্রায়-বামপন্থী সার্টিফিকেটও জুটে গেল তাঁর তো অপর পক্ষ সেটাই সত্য ধরে নিয়ে তাঁর ‘ন্যায়’ নীতিকে জনগণ প্রত্যাখান করেছে ও তিনি দুইবার বিবাহিত, উপরন্তু তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশি, অতএব প্রকারান্তরে নীতিভ্রষ্ট, নিদেনপক্ষে কংগ্রেসি বা বামপন্থী খোপে ফেললেন তাঁকে। কেউ কেউ আবার এক কাঠি ওপরে উঠে নিজেদের বিজ্ঞতার জানান দিতে এমনও বললেন যে দারিদ্রই তাঁকে মহার্ঘ করেছে।

এবার যেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে অভিজিতের সাক্ষাৎ হল, বয়ানটি হয়ে যেতে শুরু করল উলটো। এবার আরেক দফা হতভম্ব হয়ে পড়ার পালা। যারা তাঁকে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিলেন তাঁরা এবার হয়ে পড়লেন তাঁর গুণগ্রাহী এবং ভারতীয় অর্থনীতি পরিকল্পনায় তাঁর সাহায্য নেওয়ার কথাও ঘোষণা দিয়ে দিলেন। আর সেই প্রথম পক্ষ যারা তাঁর দারিদ্র দূরীকরণ কর্মযোগে বৈপ্লবিক সম্ভাবনা দেখছিলেন ও মোদি বিরোধী এক প্রবল প্রতিপক্ষকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হয় খানিক চুপ করলেন বা আসলে তো তিনি পুঁজিবাদের পক্ষেই কাজ করছেন এইসব যা হোক আমতা আমতা করে বলে আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেন। আর এসবের ফাঁকেই অভিজিৎ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি একজন আপাদমস্তক পেশাদার এবং যে কোনও দল বা সংস্থা তাঁর মতামত চাইলে তা তিনি দিতে রাজী। বিপ্লব ও হিন্দুত্ব দুইই সাঙ্গ হল, নটে গাছটিও মুড়লো।

এবার তিনি নিশ্চিন্তে চলাচল করুন, স্বাধীন মতে কাজ করুন এবং যা মনে করেন তাইই লিখুন, বলুন। বিমুদ্রাকরণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বা ভারতীয় অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সম্পর্কে বললেই তিনি যেমন কংগ্রেসি বা বামপন্থী হয়ে যান না, তেমনই আমলাতন্ত্রকে মোদি সবক শিখিয়ে ভালই করছেন বললেও তিনি বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী হয়ে যান না। তিনি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নতুন ভাবে কাজ করছেন, সে কাজের ভালমন্দ আছে, তিনি তাঁর বহুমূল্য কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কলকাতার ছেলে, আমাদের ঢঙে চলেন, বলেন, বাঙালিয়ানায় পুরোদস্তুর, আমাদের গর্বের কথা। তাঁর কাজে অনেক মানুষের উপকারও হয়েছে, হচ্ছে, সেও বড় কথা। তাঁর কাজের সমালোচনাও গড়ে উঠবে, তাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁকে স্রেফ আপনাদের খেয়ালে গড়া রাজনীতির খোপে পুরে দেবেন না। কারণ, আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির ভুবনে অমন সাদা-কালোয় গড়া কোনও নির্দিষ্ট খোপও কিছু নেই।