Pages

Wednesday, 6 November 2019

ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফেলিস

ঘচাং ফু্
সঞ্জয় মজুমদার
তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের আজ প্রয়াণ দিবস। ১৯৭০এ মাত্র ৫২ বছর বয়সে আজকের দিনে, কলকাতায়, তাঁর অমৃতলোকে যাত্রা। অমর হয়ে আছেন অনেক কিছুর মধ্যে, অনেক অবিস্মরনীয় চরিত্রের মধ্যে। যেমন ভজহরি মুখোপাধ্যায়, স্বর্ণেন্দু সেন, কুশলকুমার মিত্র, কমলেশ্বর বন্দোপাধ্যায়, এমন অনেকে। এই অব্দি একটু রহস্য করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এবার একটু ঝেড়ে কাশি। ভজহরি মুখোপাধ্যায় (আসল নাম প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ১৯৪৬এ মধ্য কলকাতার গলির গলি তস্য গলির ভিতর একটি বাড়ির মালিক, ২০ নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিট) আসলে গুলবাজ, রকবাজ বাঙালির আদর্শ, আমাদের এক ও অদ্বিতীয় 'ডি-লা-গ্র্যান্ডি-মেফিস্টোফিলিস', নয় নয় করে ছয় ফুট উচ্চতার, মৈনাক পর্বতের মত নাকের মালিক, টেনিদা। আর বাকি তিনজন হলেন 'ইয়াক্ ইয়াক্', মানে, স্বর্ণেন্দু সেন (সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করা, ঢাকাইয়া, 'হ হ আমাগো একটা মতলব আছিল' হাবুল), কুশলকুমার মিত্র (হতচ্ছাড়া, চিরকালের বিশ্বাসঘাতক, স্কলারশিপ আর ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা ক্যাবলা), আর কমলেশ্বর বন্দোপাধ্যায় (পেটরোগা প্যালারাম বাঁড়ুজ্জে, নিত্যি প্যলাজ্বরে ভোগে, পটলডাঙায় থাকে, পটল দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোল খায়, আর দু'পা হাঁটতে গেলেই তার পেটের পিলে খটখট  করে জানান দেয়। যদিও টেনিদা মাঝেমাঝেই এক চড়ে তার নাক নাসিকে আর কান কানপুরে পাঠাবার হুমকি দিয়ে ঠিক রাখে)।
যাগ্গে, এত ভণিতার পরে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যে আসলে আমাদের প্রাণের সাহিত্যিক, বরিশালের বাঙালি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, এটা বলতে গেলে জনগণ আমাকে চ্যঙদোলা করে চায়নায় ছুঁড়ে ফেলবে, বিশ্বাসঘাতকও বলতে পারে। তা বলুকগে। এটুকু রহস্য না করলে, 'খট্টাঙ্গ ও পলান্ন', 'মৎস্য-পুরাণ', 'ন্যাংচাদার হাহাকার', 'টেনিদা আর ইয়েতি', 'একাদশীর রাঁচি যাত্রা', 'দি গ্রেট ছাঁটাই', 'হনোলুলুর মাকুদা', 'টিকটিকির ল্যাজ', 'ব্রহ্মবিকাশের দন্তবিকাশ', 'চামচিকে আর টিকিট চেকার', 'ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন', 'কুট্টি মামার দন্ত-কাহিনী', 'একটি ফুটবল ম্যাচ', 'দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা', 'প্রভাতসঙ্গীত', 'সাংঘাতিক', 'কাক-কাহিনী', 'বেয়ারিং ছাঁট', 'হালখাতার খাওয়াদাওয়া', 'ঘুটেপাড়ার সেই ম্যাচ', 'কাঁকড়াবিছে', 'ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি', 'পরের উপকার করিও না', 'ঢাউস', 'তত্ত্বাবধান মানে-জীবে প্রেম', 'ভজ গৌরাঙ্গ কথা', 'ক্যামোফ্লেজ', 'দশাননচরিত', 'নিদারুণ প্রতিশোধ', 'কুট্টিমামার হাতের কাজ', 'চেঙ্গিস আর হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা', 'দশাননচরিত', 'পেশোয়ার কী আমির', 'টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক', 'ঝাউ বাংলোর রহস্য', 'কম্বল নিরুদ্দেশ', আর 'চারমূর্তি'র অমর স্রষ্টা এবং তাঁর প্রজন্মরোহিত অমরসৃষ্টিকে উপভোগ করা যায়? বোঝা যায়? বাঙালির '...দাদা' সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রকবাজির প্রাণপুরুষ, তুলনাহীন গুলবাজির প্রাণভোমরা প্রবাদপ্রতিম সব প্রবচনের জনক 'টেনিদা', সেই কবে থেকে আড্ডাপ্রিয় ভোজনরসিক  বাঙালীর অপ্রতিরোধ্য 'দাদাগিরি'র সফল নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন।

ব্যক্তিগত পড়াশোনায়, শিক্ষকতায় আর সাহিত্যচর্চায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যেন সরস্বতীর বরপুত্র। যেমন রূপবান তেমন গুণবান। সাহিত্যের বহুধা বিস্তৃত অঙ্গনে, যেমন, কিশোর সাহিত্য, ছোটগল্প ও উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটিকা ইত্যাদি বিবিধ শাখায় মানুষটির ছিল অবাধ বিচরণ। নিজে হাসতে পারা সহজ কথা নয়, হাসাতে পারা আরোই নয়। মধ্য কলকাতার গলি, তস্য গলির বাড়ির বৈঠকখানায়, দোতলার ছাতে, বাড়িওয়ালার সাথে সপরিবারে, ঘন্টার পর ঘন্টা, বাঙালির প্রিয় আলুকাবলি, ঘুগনি, ফুচকা, মুড়ি-চপ-সিঙ্গাড়া, দই-মিষ্টি, কুলফি-বরফ এবং অবশ্যই চা সহযোগে (যদিও টেনিদা খেতে খেতে খাট পালঙ্ক কাপ প্লেট ডিস্ সবই প্রায় চিবিয়ে খাওয়ার ক্ষমতা রাখতো) ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, আর আড্ডার নাভিপদ্ম থেকে উঠে আসা কালজয়ী সব সৃষ্টি, আর তাদের হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরানো কিংবদন্তি কীর্তিকলাপ, চির-স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর লেখনীর মধ্যে সাহিত্যরস যেন অফুরন্ত। জোর করে কাতুকুতু দিয়ে নয়, কারো বিচারবুদ্ধিকে ব্যঙ্গ করে নয়, তীব্র, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে রুচিসম্মত হাস্যরসের বিস্ফোরণ।

টেনিদার নাম শোনেননি, অথবা টেনিদার একটাও কাহিনী পড়েননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে বের করার থেকে খড়ের গাদায় পিন খোঁজা অনেক সোজা। বাড়ির রোয়াকে বসে নির্ভেজাল আড্ডা, চুটিয়ে খাওয়া-দাওয়া, ফুটবল ক্রিকেট খেলে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া, মানে যেটা হলো গিয়ে বাঙালির ডিএনএ কনফিগারেশন। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কেউ করতেও চাইবে না। আজকের সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও টেনিদার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি। এখানেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় স্রষ্টা হিসেবে কালোত্তীর্ণ। বন্ধুবান্ধব যখন একজায়গায় একসাথে আড্ডা আর গুলতানি মারব, একে অপরকে চোখে না দেখলে, হাত পা আর চোখের ভাষা না পড়লে, কি করে সেটা সম্ভব? সোজা উত্তর, 'অসম্ভব'। অজস্র প্রতীকী চিহ্নের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় পছন্দ-অপছন্দ, অবাক হওয়া, ভালোবাসা, রেগে যাওয়া, দুঃখ পাওয়া, কান্না পাওয়া, এমন কত কী জানানো যায়, নতুন কিছু ভাবনা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করা যায়, ভাগ করে নেওয়া যায়, এমনকী ভিডিও কল আর কনফারেন্স কলে ভার্চুয়ালি এক জায়গায় আসাও যায়, কিন্তু বাঙালির নির্ভেজাল আড্ডা? সেটাতো করা যায় না। এইখানেই মার্ক জুকারবার্গের থেকে আমাদের ঘরের মানুষ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় শত সহস্রযোজন এগিয়ে। নারায়ণবাবু আজ বেঁচে থাকলে, জুকেরবার্গকে কুড়ি নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিটে নেমন্তন্ন করতেন নিশ্চিত। সঙ্গে মুড়ি, আলু-কাবলি, চপ, আর চা। ক্লাস টেন-এ, মনুমেন্টের মত বছরের-পর-বছর দাঁড়িয়ে থাকা টেনিদার পাল্লায় পড়ে দু-সেকেন্ডে ফেসবুকের লালবাতি জ্বলে যেত। একটু কি জাত্যাভিমান প্রকাশ পেল আমার? নিশ্চয়ই। পেয়েছে বৈকি। হাজারবার পেয়েছে। আর আমি তাতে একটুও লজ্জিত নই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিলক্ষণ বুঝেছিলেন বাঙালির মনের কথা। অত কর্মসংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে বাঙালিকে দমানো যাবে না। আড্ডার বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে ভরে নিয়ে হৃদপিন্ডের রক্তকে বিশুদ্ধ করতেই হবে, নাহলে ঘটি পাড়ায় বাঙাল সংস্কৃতির মিশেলে তৈরি বাঙালির জাত যাবে। আর তাছাড়া আড্ডা শুধু বাঙালির একার সংস্কৃতি নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে আড্ডাপ্রিয় বহু জাতি-উপজাতি পাওয়া যাবে, যাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি যুগের পর যুগ বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাল্লায় পড়ে সবারই একটু আধটু আসন টলেছে, চলনে-বলনে গ্লোবাল গ্লোবাল ভাব এসেছে, কিন্তু মোটের উপর মাটির শিকড় মাটিতেই আছে।

মরুকগে এসব কথা এখন। চাঁটি মেরে চাটগাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়তে ফিরে আসি। টেনিদার গল্প ছাড়াও বেশ কিছু অন্যধারার উপন্যাসও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে, যেমন কিনা, 'উপনিবেশ-১', 'উপনিবেশ-২', 'উপনিবেশ-৩' (১৯৪৪-১৯৪৭), 'মহানন্দা', 'নিশিযাপন', 'বিদূষক', 'ভাটিয়ালি', 'সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী'(১৯৪৪), 'মন্দ্রমুখর'(১৯৪৫), 'শিলালিপি'(১৯৪৯), 'লালমাটি', 'কৃষ্ণপক্ষ'(১৯৫১), 'বৈতালিক'(১৯৫৫), 'অসিধারা(১৯৫৭), ইত্যাদি। 'শনিবারের চিঠি'র নিয়মিত লেখক ছিলেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তাঁর বিদ্রুপাত্মক লেখা 'সুনন্দর জার্নাল' পাঠককুলের কাছে এক অবিস্মরণীয় সম্পদ। নাটকেও হাত পাকিয়েছেন, যেমন, 'আগন্তুক', 'ভাড়াটে চাই', 'ভীম বধ', ইত্যাদি। যৎসামান্য হলেও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, এবং গ্রামোফোন রেকর্ডের গানও সাফল্যের সাথে রচনা করেছেন। ছোট গল্পের মধ্যে গল্পসংগ্রহ 'সাপের মাথায় মনি', 'ট্রফি' (১৯৪৯), 'বিতংস', 'ভাটিয়ালি'(১৯৫৭), 'দূঃশাসন', 'জন্মান্তর', 'ঘূর্ণি' 'ছায়াতরি', 'আলেয়ার রাত', 'টোপ' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চেনাজানা পুরস্কার বলতে ১৯৬৪তে আনন্দ পুরস্কার জুটেছিল।

আদ্যোপান্ত নির্ভেজাল বাঙালি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছাত্র জীবনেও ছিলেন অত্যুজ্জ্বল। দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, তারপর স্নাতক স্তরে (ডিস্টিংশনসহ উত্তীর্ণ) বি.এম  কলেজ বরিশাল (১৯৩৮) হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিষ্ঠান। মাস্টার্স-এ(১৯৪১) অসামান্য ফলাফলের জন্য ব্রহ্মময়ী স্বর্ণপদক প্রাপ্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই 'বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প'র উপর গবেষণার ফলস্বরূপ তাঁকে ডি.ফিল-এ সম্মানিত করা হয়। সাহিত্যপ্রেমীরা তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়টি প্রবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন, যেমন, 'সাহিত্যে ছোটগল্প', 'ছোটগল্পের সীমারেখা', 'বাংলা গল্পবিচিত্রা' এইসব। বরিশালে, স্নাতক স্তরে পড়াশোনার সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশকে। এটা তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

শিক্ষক জীবনও ছিল গৌরবজনক। জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজ(১৯৪২-১৯৪৫), আর কলকাতার সিটি কলেজে (১৯৪৫-১৯৫৫) দীর্ঘকাল অধ্যাপনার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৬ থেকে শিক্ষকতা শুরু। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গাঙ্গুলীর স্মৃতিচারণায় তাঁদের প্রিয় এই মাস্টারমশাই কেমন মানুষ ছিলেন, সেসব না হয় আরেকদিন খোঁজখবর করে জানা যাবে।

আসলে উপরের কয়েকটি অনুচ্ছেদে মানুষটার পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি আর কাজকর্মের গৌরবজনক দিকটা তুলে ধরা বাঞ্ছনীয় ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে, পড়াশোনায় তুখোড়, এই স্রষ্টার হাতেই গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন 'টেনিদা' চরিত্রের জন্ম। এ এক লক্ষণীয় এবং চমকপ্রদ বৈপরীত্য। দীর্ঘায়িত জীবন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল না, সেটা তাঁর জন্ম মৃত্যুর তারিখ (১৯১৮-১৯৭০) দেখলেই বোঝা যায়। সংক্ষিপ্ত জীবনের গণ্ডিতেই আশেপাশের সাধারণ কিছু মনুষ্য চরিত্র আর ঘটনাকে সঙ্গী করে, কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, তাঁর অমর সাহিত্যসৃষ্টি বাঙালির মননে দীর্ঘকালীন, এমনকী বলা যেতেই পারে, চিরস্থায়ী আলোকপাত করে গেছে। ভরদুপুরে মরুভূমিতে অথবা একরাত কোন শ্মশানে বা গোরস্থানে আমাকে যদি থাকতে বলা হয়, তবে আমি একটা শর্তে রাজী হতে পারি, সঙ্গে যেন 'যোগ-সর্পর হাঁঁড়ি' আর চুটকিতে ভূতের ভয় উড়িয়ে দেওয়া আর খাটের তলায় বসে ওয়াচ্ করতে থাকা 'টেনিদা' থাকে।

2 comments:

  1. so excellent discussion on a famous and popular author who was both a distinguished scholar and sweet writer for young. His serious writings were equally worth mentioning . More and more discussions and analyses are necessary to enrich our Bengali literature . Congratulations to the author

    ReplyDelete
  2. In my childhood and even now Narayan Ganguly is my favourite author. It is unfortunate that the present generation is not fully aware of him.. Silalipi and Lalmati are the two books both of which in its content and form surpasses many novels. What a beautiful representation of the characters and the environment. I still search for another Ranjan. /Suchibrata

    ReplyDelete