Pages

Tuesday, 4 June 2019

মায়ের কথা


মাতৃত্ব না  জীবিকা?
অভিষিক্তা রায়চৌধুরী 
 
একটা সম্পূর্ণ নিজের কোমল শিশু পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরছে এ স্বপ্ন কোন মানুষ না দেখে?  অথচ, সন্তানের জন্মের আগে ও পরে জীবনটা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায় মায়ের, এটাই ছিল দস্তুর।  এখন কিন্ত পাল্টাচ্ছে সময়। আমরা বন্ধুরা মজা করে বলি, আমরা জন্ম দিয়ে আর মাতৃসুধা খাইয়ে ৯০ শতাংশ দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি।  এবার পেঙ্গুইন বাবার মতো তোমরা শাবককে তা দাও। আজ্ঞে হ্যাঁ মি লর্ড, ঐ দুটি কাজ ছাড়া বাবাদের অসাধ্য কাজ কিছুই নেই,  অবশ্যই যদি সাধ থাকে তো। কোলে নিয়ে ঘুরতে বাবাদের জুড়ি মেলা ভার,  ডায়পার পাল্টানো,  চান করানো, খাওয়ানো,  আশকারা দেওয়া বা শাসন করা কোনওটার জন্য‌ই  ফিমেল অর্গ্যন লাগে না বিশ্বাস করুন। তাহলে কী ভাবছেন?  মায়েদের হাতে র‌‌ইল পেন্সিল?  একদম না!  র‌ইল আমাদের বিপুল অপরাধ বোধ।

কাঠগড়ায় মায়েরা
বাচ্চা যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান নয়  বা বাবা-মা উচ্চশিক্ষিত হ‌ওয়া সত্বেও  ছেলেমেয়েরা সেরকম ঝকঝকে রেজাল্ট করল না, সবের মূলেই একটাই কারণ- মা সময় দিতে পারেনি।  এ নিদান শুধু সমাজের নয়, পরিবারের, কর্তামশাই'এরও সব সময় নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ অপরাধ বোধ নিজের। শিশু সন্তান যখন দুঃখ করে- তোমার মতো তো সবাই কাজে যায় না, তাকে বোঝান যোগ্যতা না থাকলে তো কাজ সবাই পায় না, বা সবার বাবা তোমার বাবার মতো সোনাবাবা নয় তাই তাদের মাম্মারা কাজে যেতে পারে না, বন্দী হয়ে থাকে। ট্যুরে যেতে হলেও ঘাবড়াবার কিছু নেই, একসঙ্গে দুজন না গেলেই হল। বাবার ট্যুরে যাওয়া মেনে নিতে পারলে মায়েরটাতেও অভ্যাস হয়ে যাবে।

আমার কর্মরতা মা আমার মাতৃত্ব ইনিংস শুরু হবার পর অমোঘ টিপস দিয়েছিল- সারাদিন বাড়ি থাকিস না বলে বাচ্চাকে ঘুষ দেবার জন্য হাতে করে জিনিস নিয়ে ঢুকবি না।  সমস্ত দিন আমোদপ্রমোদ করতে যাই না আমরা।  কাজ করতে যাই।  আমার বেতনটা না হলে বাড়িতে হা‌ঁড়ি চড়ত কিনা, অথবা সেই বেতনটার জোরে একটা অজানা দেশ অদেখা থেকে গেলেই কি সুখের ভা‌ঁড়ারে কম পড়ত কিনা এসব প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন। কলার তুলে বলো- ‌ জাতীয় আয়ে আমার অবদান আছে। আপনারা তো এক্ষুণি হৈ হৈ করে বলবেন হোমমেকারদের কি অবদান নেই সেটার স্বীকৃতি নেই বলে? আমি বলব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ছদ্মবেশে লুকনো  বেকারত্ব‌ও আছে।  আমাদের দেশের নিরিখে নিরক্ষর পা‌ঁচুর মা যে রান্নাটা করতে পারেন আপনি এমএ/ এমএসসি বা ল' পাশ করে সেই রান্নাগুলোই যদি বারো মাস তিরিশ দিন করেন তাহলে কি আপনার কুড়ি বছরের রক্ত জল করা অধীত বিদ্যার সঠিক প্রয়োগ হল? বাচ্চার পছন্দের টিফিনটায় মায়ের হাতের ছোঁয়া রোজ না দেওয়া গেলেও সপ্তাহের শেষে তো দেওয়াই যায়, ঠিক যেমন দেখে দেওয়া যায় তার লেখা প্রশ্নের উত্তর বা কষা অঙ্কগুলো দিনের শেষেও। আর শুধু আপনার শিশু সন্তানকে পড়ানোর জন্য তো এর অর্ধেক পড়াশুনো জানলেও হত।  কটা বাড়িতে থাকা মাই বা তার সন্তানকে আইআইটি বা অনার্স কোর্সের জন্য  পড়াতে পারেন? তার জন্য তো সেই টিউশন, কারণ, ততদিনে বাবা মা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুলে যায় তাদের উচ্চশিক্ষার সিলেবাস।

আরে দা‌ঁড়ান, দা‌ঁড়ান। তাহলে কি বলছেন ছোট্ট থেকেই টিউশন দিতে হবে? কারণ , আমাদের দেশে যেখানে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত এত খারাপ সেখানে বাড়িতে না পড়ালে চলবে কী করে? আর বাচ্চাটাকে পড়াতে গেলে অন্তত সন্ধের মধ্যে তো ফিরতে হবে? আচ্ছা, আপনি না ফিরতে পারলে দেখুন তো বাচ্চার বাবা ফিরতে পারে কিনা তার ঘুম পাবার আগেই হোম ওয়ার্কটা করিয়ে দেওয়ার জন্য?  হ্যাঁ হ্যাঁ মানছি ঠিক সময়ে অফিস থেকে বেরলে প্রমোশনটা একটু দেরি করে হবে, কিন্তু গিন্নিকে চাকরি ছাড়তে হলে যে মাইনেটা বন্ধ হয়ে যাবে তার থেকে বেশি ক্ষতি তো আর হবে না? অর্থাৎ, হিসেবটা করার সময় যুগল লাভের কথাটা ভুলে যাবেন না। অতএব, এখানেও অর্থনীতি। আর ই‌ঁদুর দৌড়ের প্রসঙ্গ তুললে বলি, পার্টনারশিপ ফার্ম চালাচ্ছেন,  অ্যাসেট দুজনের, দায়ভার একজনের কখনও হয়? 

সময়ের পদানত আমরা
এই পর্যন্ত পড়েই আপনি হতাশ,  কারণ ঠিক সময়ে বাড়ি না ফেরাটা আপনাদের দুজনের কারুর‌ই চয়েস নয়, বর‌ং মজবুরি।  হয় দুজনেই কর্পোরেট দাস যেখানে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরলে চাকরিটা চলেও যেতে পারে, ওয়র্ক ফ্রম হোম ইউটোপিয়ান ধারণা,  যাতায়াত আর যানজটে পাক্কা চার ঘন্টা কাটিয়ে ফেরেন যখন, তখন আপনি জীবন্ত লাশ; বা আপনারা ডাক্তার বা উকিল যাদের আসল প্র্যাকটিসের সময় ঐ সন্ধেবেলাই, অথবা আপনি প্রফেসর যাকে পরের দিনের ক্লাসের প্রস্তুতি নিতে হবে তাদের বলি- এত চিন্তা কীসের? আপনি তো স্বয়ম্ভূ নন। আপনাদের বাবা মা যারা আপনাদের শিক্ষার বনিয়াদটা শক্তপোক্ত করেছেন তারা কি পারেন না তাদের উত্তর-প্রজন্মকে নিয়ে একটু পড়াতে বা পার্কে নিয়ে গিয়ে দাদু ঠাকুমার অ্যাসোসিয়েশন বানিয়ে নিতে? আর যদি আপনাদের এক পিস ভাই বা বোন থাকে আর থাকে তাদের ছেলে মেয়ে, গরমের বা শীতের ছুটিতে থাকুক না এ ওর বাড়ি।  ভালবাসায় ভরে থাক কাকা পিসি মামা মাসির। আর যৌথ পরিবার বা নিদেনপক্ষে এক পাড়ায় থাকা গেলে তো কথাই নেই।

কিন্ত যদি আপনি থাকেন দূর প্রদেশে যেখানে না আছে ক্রেশ না পাওয়া যায় কাজের লোক, বাবা মাও থাকেন দূরে,  তাহলে দেখুন না, দুজনে দুটো শিফট নিতে পারেন কি না, অথবা বাড়িতেই খুলতে পারেন কিনা আপনার নিজস্ব অফিস, নিদেনপক্ষে বাড়ি থেকেই দিন অনলাইন বা এমন টিউশন যখন আপনার জীবনের বন্ধুটি বাড়ি ফিরে এসে ক্ষুদে দস্যিটার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। মোট কথা, বুদ্ধি আর দক্ষতার গোড়ায় জল দিয়ে বাড়িয়ে তুলুন আমাদের হিউম্যান ক্যাপিটাল।  যেন পরে আফশোস করে বলতে না হয়, ‌'আহা, এমন মানবজমিন র‌‌ইল পতিত,  আবাদ করলে ফলত সোনা , মন রে কৃষি কাজ জান না'। আর হয়ে উঠুন শুধু স্নেহময়ী নয় ধীময়ী সুপারমম।

3 comments:

  1. জীবনযুদ্ধে সামনে থেকে লড়াইয়ের মুখোমুখী হয়েও সন্তানকে অবহেলা না করে তাকে প্রকৃত মানুষ করার এক সফল মায়ের অবদান তাকে মহীয়সী মায়ের সম্মান এনে দেয়। সংসারকে অবহেলা না করেও নিজের সাহিত্য চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার বহু উদাহরণ আমাদের সামনে বিদ্যমান‌। চাকরী সাহিত্যচর্চা পাশাপাশি সংসারের নিত্য চাহিদা মিটিয়ে সন্তান কে উপযুক্ত মানুষ করার শ্লাঘা তুই দাবি করতেই পারিস। গরীয়সী মায়ের গর্ব করার যোগ্যতা তোর নিজের অর্জিত।সুখে থাক।সুখে রাখ। জয়তু ভবঃ।

    ReplyDelete
  2. খুব কঠিন বিষয়। ব্যাপারটা কিছুই না মানসিকতার বদল,কিছুটা ভাগ্য। সবার ছেলেমেয়েই মানুষ হয়। আমার তো মনে হয় প্রবলেম সন্তান মানুষ করায় নয়, আজ আমার যে স্থিতি,আমি ভাবি আজ আমি কাজে গেলে, হাই প্রোফাইল হলে এই দুটো মানুষকে কে দেখতো? হ্যাঁ,বয়সে এসে বাবা মা রা যে আবার সন্তান তুল্য হয়ে যান। সে সময় একটা বড় ডিউটি থাকে সবার। এক একটা অসুখ এমন সেখানে কিন্তু পয়সা দিয়ে আয়া রাখলেই হয় না। একটু কাছে থাকা, সহানুভূতি বেশি জরুরি। তুই কাকিমাকে দিয়ে বুঝবি সেটা। কত মা বাবা শুধু কাজের লোকের ভরসায় প্যারালাইজড জীবন কাটাচ্ছেন। এগুলো নিজের জীবন দিয়ে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। তাই যে টা দরকার সবার শরীর ফিট রাখাটা।

    ReplyDelete