Pages

Monday, 3 June 2019

২০১৯'এর নির্বাচন

অর্থনীতির সামান্য কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর নানা মত, বিশ্লেষণে বিগ মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এখন ভারাক্রান্ত। তাই আরও একটি বাড়তি বিশ্লেষণে এই ভার বাড়বে বই কমবে না। কিন্তু বলতেই হয়, এইসব রকমফের আলোচনায় যে উপাদানটি কোথাও নজরে এল না তা হল, রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোকে বিষয়টিকে দেখা। এর অর্থ, অর্থনীতির এমন কি কোনও প্রধান সড়ক বা গলিঘুঁজি ছিল যা সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল? অন্যথায়, গত দু বছরে অর্থনীতির তথাকথিত খারাপ সূচকগুলিকে বহন করেই মোদি সরকার আবার কী করে আরও বেশি জনমত নিজেদের পক্ষে নিতে পারল! এই আলোচনাটা না করলে আমরা বাস্তবতার গহীন অবস্থাটা বুঝতে হয়তো সক্ষম হব না!

প্রথমেই ধরা যাক বেকারত্বের প্রশ্নটিকে। সকলেই একমত, বেকারত্বের হার গত দু’ বছরে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। ভোটের আগে না হলেও পরে নতুন সরকারের প্রকাশিত তথ্যে তা স্পষ্ট ধরাও পড়েছে।এ নিয়ে বিরোধীরা কম হইচইও করেনি। কিন্তু তবু ভোট রণাঙ্গনে এর প্রতিফলন তেমন ভাবে পড়ল না। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এতে সকলের আশ্চর্য হওয়ারই কথা। তথ্যগুলিকে একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। উল্লেখ্য, এনএসএসও’র তথ্যে প্রকাশিত, ২০১৭-১৮ সালে সারা দেশে বেকারত্বের গড় হার ছিল ৬.১ শতাংশ যার ৭.৮ শতাংশ ও ৫.৩ শতাংশ ছিল যথাক্রমে শহর ও গ্রামীণ এলাকায়। কিন্তু শুধু এইটুকু দেখলেই হবে না। এর সঙ্গে মেলাতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্নটিকেও। নিচের টেবিলটিকে ভাল করে নিরীক্ষণ করুন:
দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি বেকারত্বের হারও তত বেশি। ২০১৭-১৮ সালে শহুরে পুরুষদের ক্ষেত্রে যাদের কোনও শিক্ষা নেই তাদের বেকারত্বের হার যেখানে ২.১ শতাংশ সেখানে মাধ্যমিক ও তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে তেমনদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ৯.২ শতাংশ। শহুরে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই হার শিক্ষা নেই এমনদের ক্ষেত্রে যেখানে ০.৮ শতাংশ সেখানে মাধ্যমিক ও তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে এমনদের ক্ষেত্রে ১৯.৮ শতাংশ। গ্রামীণ পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই চিত্র উঠে আসছে। তাহলে কি বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্তরায়? আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন। সামগ্রিক ভাবে এই জায়গাটিকে ধরতে না পারলে অর্থনীতির আজকের চেহারাটা তো বোঝা যাবেই না, উপরন্তু, তা বহু দিশাহীনতার জন্ম দেবে।

এখানে ছোট পরিসরে বোঝার বিষয় হল, প্রযুক্তি-তাড়িত অর্থনীতি আজ প্রায় সমস্ত কাজকে মেশিন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করে এনেছে যেখানে খুব অল্প সংখ্যক বৌদ্ধিক বা দক্ষ মানব ছাড়া আর তেমন কর্মীকুলের দরকার নেই। কিন্তু অদক্ষ কাজের এলাকাগুলিতে কায়িক শ্রম করে তেমন মজুর ও কর্মীর প্রয়োজন এখনও ফুরিয়ে যায়নি, বিশেষত সেইসব এলাকাগুলি যেগুলো এখনও পশ্চাৎপদ। ভারতের মতো দেশে এই কাজের ক্ষেত্রগুলি এখনও অনেকটা পরিসর জুড়ে বিরাজমান। তাই কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষের কাজের প্রয়োজন এত সহজে ফুরোবার নয়। অবশ্য, এইসব কাজে মজুরির হারও খুব সামান্য তাই স্বল্প মজুরিতে কর্মনিয়োজনের সুযোগ এখনও দীর্ঘদিন ভারতীয় অর্থনীতিতে থেকে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এইসব প্রত্যন্ত গরিব মানুষের কাছে সামাজিক সুরক্ষা ও আয় পৌঁছে দেওয়ার নানা কার্যক্রম যা বিভিন্ন ভাবে নানান শাসক দলগুলির প্রতি গরিব মানুষের আস্থাকে কখনও কখনও বাড়িয়েছে। আর সেই সঙ্গে বর্তমান গিগ অর্থনীতির পরিসরে কাজেরও এমন অনেক ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে যা চিরায়ত অর্থে চাকরি নয়, স্বল্পস্থায়ী এমন এমন কাজ, যাকে তথ্যের আকরে ধরা এখনও পদ্ধতিগত কারণে কিছুটা দুরূহ। তাই তথ্যে যা দেখা দিচ্ছে, তা বাস্তবে হয়তো অন্য কথা বলতে চাইছে। কম শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের হার কম হলেও দেখা যাবে তাদের আয় যথাযথ নয়, যেগুলো হয়তো প্রতিবেদনে সে ভাবে আসেনি। আবার শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের হার বেশি হলেও এমনটাও সম্ভব যে তারা যে কাজগুলিতে জড়িত সেগুলোকে তাদের কর্মসংস্থান বলে মনে হচ্ছে না। বাস্তব এই যে, সংগঠিত শিল্পে কর্মসংস্থানের হার সামগ্রিক ভাবে নিম্নমুখি, কিন্তু তা দিয়ে আজকের নতুন কর্মসংস্থানের জটিলতাকে বোঝাটা দুষ্কর। এইসব সমস্যার কারণে বেকারত্বের প্রশ্নটি এবারের নির্বাচনে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়নি। উপরন্তু, বেকারত্ব দূরীকরণের দায় কার- কেন্দ্র না রাজ্যের- এ নিয়েও রয়ে গেছে নানা ধন্দ।

এর সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ জুড়ে গেছে। আজ থেকে ১০ কি ১৫ বছর আগে রাজ্যে রাজ্যে, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারেরও নানা ঘোষণায় জুড়ে থাকত বিদেশি পুঁজি, দেশি পুঁজি, বৃহৎ শিল্প স্থাপনা ইত্যাদির নানা বাগাড়ম্বর। সেইসব এখন বিদায় নিয়েছে। কারণ, অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝেছেন, বড় আধুনিক শিল্পে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাপনা খুবই সীমিত। তাই দলগুলির তরফে এইসব প্রসঙ্গ তুললেও ভবি ভুলবার নয়, তাই তার থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। এখন বরং সকলেই এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে যে কে কত জনমুখি প্রকল্প মারফত জনগণের একটা বড় অংশকে নানারকমের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছে বা তাদের আয় বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। নবীন পট্টনায়েকের কালিয়া প্রকল্প, মমতার সবুজসাথী, কন্যাশ্রী, চন্দ্রশেখর রাওয়ের প্রজাবন্ধু প্রকল্প অথবা মোদির কিষাণ যোজনা বা শৌচালয় প্রকল্প ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে কে কতটা জনগণের কাছাকাছি এসে পৌঁছতে পারছে। ফলে, মানুষও এইসব বাস্তব কার্যাবলী দিয়ে ভোটপ্রার্থীদের বিচার করছেন। বহু উড়িষ্যাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁরা লোকসভায় মোদির পক্ষে কিন্তু বিধানসভায় নবীনবাবুর দিকে। কারণ, তাঁরা রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারেরই সুবিধাগুলি পেতে চান। তার ফল ভোটেও প্রকাশ পেয়েছে।

এই নির্বাচনে হিন্দুত্বর ইস্যু একটা স্তরে কাজ করেছে ঠিকই কিন্তু সামগ্রিক ভাবে নয়। কেন্দ্রীয় অনেক প্রকল্পের সুবিধা সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রাজ্যে পেয়েছেন। যেমন, জনধন যোজনা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, মুদ্রা ঋণ, শৌচালয়– এইসব প্রকল্পের সুবিধা অনেকে পেয়েছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সমস্যাগুলি। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে জোরালো হয়েছিল নিচের স্তরে সরকারি প্রকল্প নিয়ে শাসক দলের দুর্নীতি ও দাদাগিরি যা গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশকে তৃণমূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু উড়িষ্যা বা তেলেঙ্গানায় রাজ্য পার্টিগুলিকে এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি, যে কারণে তাদের ফল অনেক আশাব্যঞ্জক হয়েছে। তবে সবটাই আপতকালীন একটা পর্যায় মাত্র। এক বছর পর কোথাকার জল কোথায় গড়াবে তা দেখার আছে। যেমন, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ৩-৪ মাস আগেই বিধানসভায় বিজেপি পরাজিত হয়েও লোকসভায় আশাতীত ফল করেছে।

এর সঙ্গে মজার ব্যাপার যেটি হয়েছে, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের হতবাক অবস্থাটি। তাঁরা খুব বিশ্লেষণ-টিশ্লেষণ করে নানা তত্ত্ব আউড়ে যা দেখালেন তা এক্কেবারে ফক্কা। সমাজের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে যাঁদের কোনও সঙ্গ নেই, কিছু বই পড়ে ও সেমিনার করে তাঁদের বর্গ নির্মাণের যে অনুশীলন, তা এবারে একেবারে মাঠে মারা গেছে। তাঁদের ইন্ডিয়া আর আসলি ভারত যে দুই প্রান্তের দুই ভিন্ন পরিসর, তা এবারে একেবারে হাতেকলমে ধরা দিয়েছে।

মোদ্দা যেটুকু বুঝেছি, দেশের মানুষ গরিব হতে পারেন, ‘অশিক্ষিত’ও, কিন্তু বেশ সমঝদার ও সেয়ানা। তাঁরা দ্বন্দ্বরত শাসকের দুর্বলতাগুলি ঠিক ধরে ফেলেছেন এবং যেখানে যাকে ঘা দেওয়ার দিয়েছেন। সবটাই যে ঠিকঠাক দিতে পেরেছেন তা নয় কিন্তু তাঁদের সে এলেম আছে, সে প্রমাণ তাঁরা রেখেছেন। সর্বোপরি, তাঁরা সুদূরপ্রসারী চিন্তারও অধিকারী। আজ তাঁরা যাঁদের ক্ষমতায় এনেছেন, কাল যে তাঁদের প্রতি আস্থা থাকবে তেমন কথাও তাঁরা দেননি। তা আরও বোঝা গেল, কর্নাটকে বিজেপিকে লোকসভায় প্রচুর আসন দিয়েও ছ’ দিন পরেই স্থানীয় নির্বাচনে তাদের হাত থেকে বহুলাংশে তা কেড়ে নেওয়ার মধ্যেই। তাই সবটা মিলিয়ে, এ দেশের সংসদীয় রাজনীতি বেশ জমে উঠেছে। দেওয়াল লিখন হল: বেশি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে।        

3 comments:

  1. Thoughtful analysis. Liked it much.

    ReplyDelete
  2. Excellent... দারুণ হয়েছে। তবে আমি একটা কথা যোগ করতে চাইব। মানুষ কিন্তু এখন প্রত্যেকটি ভোটের নিজস্বতা কে চিহ্নিত করতে পারছে এবং সেই কারণেই তারা শাসকদের অবহেলার জবাব যেমন দিচ্ছে তেমনই আবার জাতীয় ও রাজ‍্য স্তরের শ্রেণীবিন্যাস ও করছে। যে কারণে বিধান সভা নির্বাচনগুলিতে প্রাদেশিক দলগুলি প্রাধান্য পেলেও লোকসভায় তারা জাতীয় দলগুলিকেই বিবেচনার মধ্যে রেখেছে। এটা কিন্তু একধরনের paradigm shift. বিশেষত, গত তিরিশ বছর (১৯৮৯-২০১৯) ধরে জাতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলির যে গুরুত্ব ছিল মনে হয় সেই ঝোঁক বদলাতে শুরু করেছে। আমার মনে হয় এটাও একধরনের বিশ্বায়ন (glocalization not globalization)-এর ফল।

    ReplyDelete
  3. কর্ণাটকে ছ দিন পর কি ভোট হয়েছিল ? কি রেজাল্ট হয়েছে?

    ReplyDelete