Pages

Friday, 12 April 2019

ভোট নিয়ে দু-চার কথা

ভোটের বাজার
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


১)
ভোটের এই ভরা বাজারে স্বাভাবিক, বড় বড় নেতা থেকে তালপাতা সেপাই, সকলেই বেশ রসে বশে নেমে পড়েছেন। মিডিয়া থেকে বাড়ির দেয়াল, টুইটার থেকে নেতাদের ভাষণ - কলকলরবে চারপাশ বেশ অগ্নিগর্ভ। ব্যস, ওইটুকুই। খুব বৃদ্ধজনেরা ছাড়া, রাস্তাঘাটে, মেট্রোয়, লোকাল ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে কোথাও ভোট নিয়ে কেউ আলোচনাতেও নেই। যেন, ভোট দিলেই বা কী, না দিলেই বা! কেন এমন হল? ভাবুন, মশাই ভাবুন।

তবে, ক্ষমতা যতই কর্পোরেট বা ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের হাতেই থাকুক না কেন, বোঝা গেছে এও, যে জন আজ বিরোধী তিনি ক্ষমতায় গেলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ; সাধারণ সরকারি চাকরিজীবী চেয়ারে বসেই রক্তচক্ষু; দরিদ্র কৃষকের হাতে ক্ষমতা দাও তো তিনি হবেন পঞ্চায়েতের বাস্তুঘুঘু; শ্রমিকের হাতে ক্ষমতা দাও, তিনি হবেন সাগিনা মাহাতো। পঞ্চায়েত থেকে সংসদ - যেখানেই যে করে হোক যেতে পারলেই হল, গোটা জীবন গুছিয়ে গেল। এই যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বব্যাপ্ত হয়ে গেল, এই হল মোদ্দা কথা। আর ক্ষমতার সেই চাড্ডি পরে নিলেই তুমি মুটে হও কি মুচি, ষোলআনা পোয়াবারো।

ভারতীয় রাজনীতি এখন এই পাকেচক্রে বেশ জটিল হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলই, তারা যখন শাসক, তখন তাদের ভাষা, শাসনক্রম হরেদরে এক। আবার তারা যখন বিরোধী, তখন বিগলিত করুণায় জাহ্নবী। তাই ডান-বামের কার্যসূচিও আর বিভেদরেখা খুঁজে পায় না।

এখন এক আছেন মধুসূদন জনগণ। মেলাবেন তিনি মেলাবেন।


২)
আপনি নেতা, তাই কোন দলে আসলে আছেন কেউ জানে না। এই মুহূর্তে আপনি 'ক' দলে তো আগামী পরশু নিশ্চিত 'খ' দলে। অথবা আবার ঘুরে সেই 'ক' দলেই নচেৎ 'গ' দলে। এই ঘোরাঘুরি, আসা-যাওয়া সবটাই নির্ভর করছে আপনার চাওয়া-পাওয়ার ওপর (দেহাতি ভাষায়, কামাইয়ের ওপর)। আর দল বদলে কথা ও ভাষণেরও কোনও পরিবর্তন দরকার পড়ে না, শুধু খেয়াল রাখতে হয় ঘাড়ের দু পাশে  ঝোলানো কাপড়টি যেন যথাযথ রঙ ও প্রতীক সম্বলিত হয়।

তাহলে আর আমাদের মতো হাড় হাভাতেদের দল ও পছন্দ নিয়ে এত মাথাব্যথা কীসের? আপনি নেতা অথবা ভোটপ্রার্থী, শুধু জয়টুকুই তো চাই আপনার! আপনারও দল নেই, শুধু জেতাটুকু ছাড়া। আমাদেরও নেই, বোতামের ওপর একটি তর্জনীর চাপ ছাড়া। সবুর করুন কাকা! তবে তো মেওয়া ফলবে!!

৩)

বহুদিন মিডিয়া আমাদের গিলিয়েছে 'ভোটব্যাঙ্ক' কথাটি। যেন, সকল ভোটারই নির্দিষ্ট ঘরে স্থিত হয়ে আছেন, আর তার এদিক সেদিক হলেই শোনা যাবে, 'অমুকের ভোটগুলি সব তমুকের দিকে চলে গেল'। অথবা, 'এবার যদি এনাদের ভোট তেনাদের সঙ্গে একজোট হয় তাহলে ওনাদের জেতা মুশকিল'। বুঝুন কাণ্ড! যেন দুই, তিন কি চার সেট ভোটার আছেন, তাদের এ ঘর ও ঘর করিয়ে দিলেই ভোটের খেলা শেষ!

সত্যিই কি গোমুখ্যু জনতা জনার্দন? নাকি, আমার মতের সঙ্গে না মিললেই জনতা অবোধ!

৪)
গত এক-দেড় দশক আগেও রাজ্যে রাজ্যে শাসকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, কে কত সুবিধা উজাড় করে দিয়ে তবে শিল্পপতিদের (বিনিয়োগ) নিজ নিজ রাজ্যে আনতে পারে। বিনিময়ে 'হাত ঘোরালে নাড়ু'টা ছিল কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি। ফাঁকিটা ধরা পড়ে গেছে। তাই এখন আর সে কথা বলে না কেউ! এখন সম্ভাব্য প্রতিযোগী শাসকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি, কে কত প্রকল্পের মধ্য দিয়ে গরিবদের সক্ষম করতে পারে। নচেৎ ভোটের বাজারে ফক্কা। এই দর কষাকষির দড়ির খুঁটটা এখন বেশ হাড়-হাভাতেদের হাতে। কিছু করো তো ভোট নাও, নয়তো যাও। অতএব, নেতাদের প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্প ঘোষণার বন্যা। ফলত, যা কিছু রটে (প্রতিশ্রুতি) তা কিছু তো বটে (রূপায়ণ)।

তাই সর্বত্রই দল, উপদল, নতুন দল, এ জোট, সে জোট। কিছু রাজ্য বাদ দিলে এখন অধিকাংশ জায়গাতেই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জাতীয় দলের লড়াই। কোথাও আবার আঞ্চলিক দল বনাম আঞ্চলিক দল। দল বদল ও নতুন দলের উত্থান এখন হররোজের চালচিত্র। জাতীয় দলও আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে জোট না করলে অধিকাংশ জায়গাতেই পঙ্গু। রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপই পালটে গেছে আমূল।

শাসকদের ওপর চাপ মানে একদম পিছিয়ে পড়া মানুষটার সামান্য হলেও প্রাপ্তি। তাই, চাপ সৃষ্টি করুন, মশাই, চাপ সৃষ্টি করুন।

৫)
প্রথম দফার নির্বাচন ফুরলো। দেশের জনগণকে আনপড়, অশিক্ষিত, বোকা এসব ভাবার কোনও কারণ নেই। তাঁরা ভোটের অনুশীলনে যোগ-বিয়োগ করে একটা গড় ফল দাঁড় করান। দেখা গেছে, তাতে মোটের ওপর মন্দের ভালই হয়। কারণ, কোন দল বর্তমান শাসক, আর কোন দল শাসক হবার অভিলাষী - এই দুইয়ের টানাপোড়েনে একটা গড় ফলাফল তৈরি করে দেন আমজনতা। শাসকেরা ক্ষমতায় গিয়ে কেউই ছেড়ে কথা বলে না, তাই তাদের যতটা পঙ্গু করে শাসক বানানো যায় তেমন একটা কসরতই আমজনতা বেশ সুকৌশলে সেরে ফেলেন। তবুও কি নিস্তার আছে? নৈব নৈব চ।

পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিধানসভা, লোকসভা ইত্যাকার নানাবিধ নির্বাচনে প্রায় প্রতি বছরই দলগুলির একে তাকে এদিক সেদিক ঠেলে ঠুসে দেন নির্বাচকরা। এইটুকুই সোয়াস্তি। আর সেই ঠেলাঠেলিতে আমজনতারও প্রাপ্তি ঘটে। কখনও সার্বিক ভাবে কখনও বা ব্যক্তিগত ভাবেও। এই ব্যক্তিগত প্রাপ্তি আবার আমজনতার একটা অংশকে শাসকের মতোই গড়ে নেয় স্বভাব-চরিত্র সহ। তাই নির্বাচনগুলি নিছকই দেওয়া-নেওয়ার খেলা। জনতা বেশ আমোদের সঙ্গেই এতে অংশ নেন। আর সে আমোদে এখন 'নোটা' হয়েছে এক বাড়তি উৎসাহ।

তবে শাসকের তরফে খুব বেয়াদপি হলে পথে নেমে জনতা শাসককে সবকও শেখান, প্রয়োজনে সশস্ত্র অভিমুখেও জবাব দেন। তাই এই ক্ষেত্রটি কোনও বাগিচার পুষ্প প্রদর্শনী নয় মোটেও, বরং দরিদ্র, দরিদ্রতর, দরিদ্রতম মানুষের সঙ্গে শাসকের এক বরাবরের হিসেব মেলানোর জমি। শাসক আবার রাজ্যে রাজ্যে ভিন্ন। তাই কেন্দ্রের শাসক ও রাজ্যের শাসক যদি দুই ভিন্ন দলের হয় আর ভোটটা যদি হয় কেন্দ্রের শাসক নির্বাচনের তাহলে সে হিসেব কাক্কেশ্বর কুচকুচের হিসেবের থেকেও আরও জটিল হয়ে যায়। এবার কী হবে, বোঝা যাবে ২৩ মে।


এর মধ্যেই এসে গেছে ১৩ এপ্রিল ২০১৯। জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তস্নাত দিনের শতবর্ষ। আজও নির্লজ্জ UK এর জন্য ক্ষমা চাইতে অপারগ। জালিয়ানওয়ালাবাগের শত সহস্র মানুষের স্মৃতি বুকে নিয়ে আমাদের মতো আমজনতাকে আজও তাই প্রহর জেগেই শাসককে নানান কিসিমে যুঝে যেতে হবে। ভোটের বাজারে সেই আমাদের কষ্টসাধ্য সোয়াস্তি।

১২/০৪/২০১৯



1 comment: