Pages

Tuesday, 23 April 2019

জেট এয়ারওয়েজ

স্বপ্নের উড়ান থমকে গেল

 সোমনাথ গুহ

জেট এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে গেল। স্থায়ী, অস্থায়ী মিলে প্রায় বাইশ হাজার কর্মচারির জীবন জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে গেছে, বিমান ভাড়া হু হু করে বাড়ছে, পর্যটন শিল্পকে যা ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মুক্ত অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে বিমান পরিষেবায় বেসরকারি এয়ারলাইন্সের প্রবেশ শুরু হয়। কিন্তু ইস্টওয়েস্ট, দামানিয়া বা কিংফিশার'এর মতো নামি ব্র্যান্ডও সাত আট বছরের বেশি বাজারে টিকে থাকেনি। ব্যাতিক্রম ছিল জেট। প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে ১৯৯৩ সালে চারটে লিজ করা বিমান নিয়ে জেটের যাত্রা শুরু হয় যাতে গালফ এয়ার এবং কুয়েত এয়ারওয়েজ বিনিয়োগ করে। এত দিন ধরে এর যাত্রা শুধু অক্ষুণ্ণ থেকেছে তাই নয়, ভালো পরিষেবার কারণে যাত্রীদের বাহবা পেয়েছে, বাজারে মোটামুটি সুনাম বজায় রেখেছে। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক উড়ান শুরু করে যখন ঘরোয়া বিমান শিল্পে জেটের শেয়ার সর্বাধিক। কিন্তু প্রায় এই সময় থেকেই স্পাইসজেট এবং ইন্ডিগো অভাবিত সস্তায় বিমান ভাড়া চালু করার পর জেট কড়া প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। সংকটের সেই শুরু। সাহারা এয়ারলাইন্স কিনে নিজেদের সস্তা পরিষেবা চালু করে বাজারে টিকে থাকার জন্য মরিয়া চেষ্টা করা হয়। ভাড়া-যুদ্ধে পাল্লা দেওয়া সম্ভব হয় কিন্তু তাতে ঋণের বোঝা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এবং সংকট ঘনীভূত হয়। গত কয়েক বছরে ক্ষয়ের উপসর্গগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। পরপর তিন বছর লোকসান হয়। নরেশ গয়াল সংস্থার মালিক, চেয়ারম্যান এবং মূল অংশীদার এসবিআইয়ের কাছে পুনরায় ১৫০০ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেনইতিমধ্যে ব্যাঙ্কে ৮৫০০ কোটি দেনা হয়ে গেছে। ব্যাঙ্ক শর্ত দেয় গয়াল পদত্যাগ করলে ঋণ দেওয়া হবে। গয়াল পদত্যাগ করে, ব্যাঙ্কের কাছে তাঁর ৫১ শতাংশ শেয়ার এক টাকায় বিক্রি করে এবং লন্ডনে পাড়ি দেয় রহস্যজনক ভাবে যে ব্যাঙ্ক এতদিন সংস্থাটি সংকটাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় ধার দিয়েছে, তারা এবার ঋণ দিতে অস্বীকার করে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কর্মচারিদের মাইনে বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে ১৭ এপ্রিল জেটের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। বলে রাখা ভালো, বিমান শিল্পে এই সংকট সার্বিক। স্পাইসজেট গত দুটি ত্রৈমাসিক এবং ইন্ডিগো এই প্রথম গত ত্রৈমাসিকে লোকসান করেছে।  

আইটিএ (ইন্টারন্যাশানাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন)'এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়ে বিমান শিল্পে লাভ চলছে। কিন্তু ভারতে ছবিটা উলটো। এর মূল কারণ নিত্য প্রয়োজনীয় খরচা। জ্বালানির দাম বিশ্ব বাজারের চেয়ে বেশি, চড়া হারে কর এবং বিমানবন্দরের খরচা, যার মধ্যে অন্যতম উড়ানসূচি ভাড়া। এছাড়া আছে প্রবল প্রতিযোগিতা, ভাড়া-যুদ্ধে অন্যদের সাথে পাল্লা দেওয়া। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, শেষ দিকে জেটকে প্রতি এক কিলোমিটার উড়ানে জনপ্রতি ৭৭ পয়সা লোকসান গুনতে হচ্ছিল। তবে বুনিয়াদী সমস্যা হচ্ছে মুক্ত অর্থনীতি এক শ্রেণি উদ্যোগপতির জন্ম দিয়েছে যাদের নিজেদের শিল্প বা ব্যবসার প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনও মূলধন নেই, অভিজ্ঞতা নেইযা আছে তা হল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ঠিক জায়গায় ঠিক লোকটিকে ঠিক সময়ে তুষ্ট রাখার ক্ষমতা। এদের চাটুকার বৃত্তির দক্ষতা রীতিমত ঈর্ষণীয়। এদের মূল উদ্দেশ্য যত কম সময়ে যত বেশি মুনাফা করা যায়। কেতাবী ভাষায় এদের বলা হয় ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট’। ‘ক্রোনি’র বাংলা অর্থ অভিদান অনুযায়ী অন্তরঙ্গ বন্ধু, বাস্তবে তা হল মোসাহেবি করে বন্ধুত্ব অর্জন করা। লাইসেন্স রাজের সময় এরা ছিল না তা নয়, কিন্তু তখন প্রতিযোগিতা ছিল না। এখন আছে এবং তাই এরা স্বল্পায়ু। কয়েক বছরের মধ্যে বুদবুদের মতো ফুলেফেঁপে ওঠে তারপর চুপসে যায়। কিন্তু ততদিনে তারা ধনকুবের হয়ে যায়।

নরেশ গয়ালের কথাই ধরা যাক। সত্তরের দশকে পাতিয়ালায় তার পরিবারের এক চিলতে একটা শাড়ির দোকান ছিল। ভাগ্য অন্বেষণে দিল্লী চলে যায়। ইরাক, জর্ডনের এয়ারলাইন্সে ছোটখাটো আধিকারিকের কাজ করে বিমান পরিষেবা সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যে কোনওভাবেই হোক ছোটখাটো একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলে বসে। মুক্ত আকাশ নীতি এবং একই সময়ে এয়ার ইন্ডিয়া সঙ্কটে পড়ায় জেটের বিমান ব্যবসায় ঢোকার পথ সুগম হয়। প্রতিযোগী অন্য বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলি কয়েক বছরের মধ্যে সংকটে পড়ে এবং ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে সরকারি নিয়ম নীতি নিজের অনুকুলে নির্ধারিত করাতে কিংবা পাল্টে দিতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তার সুবির্ধাথে বিমান শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আটকে দেওয়া হয়। এর ফলে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু গালফ এয়ার এবং কুয়েত এয়ারওয়েজ তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ায় জেটের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। এমনও শোনা যায়, এয়ার ইন্ডিয়াকে পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা গয়াল কলকাঠি নেড়ে আটকে দিয়েছে। বেসরকারি বিমান শিল্পে টাটাকে আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার হাত রয়েছে। নতুন শতকের প্রথম দশকে ইন্ডিগো, স্পাইসজেটের আগমন প্রথম অশনি সংকেত। এর পর আসে ২০০৮'এর বিশ্ব জোড়া মন্দা এবং জ্বালানির দামের বৃদ্ধি। অত্যধিক আত্মবিশ্বাসের ফলে গয়াল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাত্রী পরিষেবায় কোনও কাটছাঁট করে না। লোকসান বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সংকটের মোকাবিলায় তারই সুবিধার্থে বিদেশি বিনিয়োগ পুনরায় চালু করা হয়। আবু ধাবিতে অবস্থিত ইতিহাদ এয়ারলাইন্স জেটে বিনিয়োগ করে। কিন্তু তাতে সাময়িক ভাবে পতন রোধ করা গেলেও দীর্ঘস্থায়ী কোনও সুরাহা হয় না।  


কর্মচারিরা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন যাতে সরকার হস্তক্ষেপ করে সংস্থাটিকে বাঁচায়। অর্থমন্ত্রীর সাথেও তাঁরা দেখা করেছেন। কিন্তু তাঁদেরকে কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে জেটের কিছু বিমান কর্মচারি সহ এয়ার ইন্ডিয়া এবং অন্য কিছু সংস্থা লিজে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন বিমানবন্দরের উড়ানসূচিও এই ভাবে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, এর ফলে জেটের ভাবমুর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এর বাজার দরের অবনমন ঘটবে। এই অবস্থায় স্টেট ব্যাঙ্ক নিলাম ডেকে সংস্থা হস্তান্তর করার চিন্তাভাবনা করছে। আসলে এই ক্ষুরধার প্রতিযোগিতার বাজারে ‘ক্রোনি’দের রমরমা, তাই তাদের সময়কালও সীমিত। ছাব্বিশ বছরে গয়াল ধনকুবের হয়ে গেছে। তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, অন্য কেউ তাকে স্থানান্তরিত করার জন্য তৈরি। ব্যাঙ্ক, নেতা-মন্ত্রী, প্রশাসনের যাবতীয় দাক্ষিণ্য নিয়ে নতুন আর এক গয়াল বিমান শিল্পে আবির্ভাব হতে প্রস্তুত। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এটাই দস্তুর।

Friday, 19 April 2019

ভোট ২০১৯

ভোটের বাইনারি খেলায় আর নয়!
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
 

এখন আমি কেন  জানি না একটা কথা বলতে চাই। হাবিজাবি পড়াশুনা করে শুষ্ক বুদ্ধিজীবী হওয়ার থেকে কিছু কাজ করতে চাওয়া অনেক কঠিন। যাতে সমাজের উপকার হয় এবং নিজেরও উপকার হয় - এমন কাজ। বড় ন্যারেটিভে না ভেবে ছোট ছোট ক্ষেত্রে ভাবা।

আমার মনে হয় যে মানুষটি যে কাজটা পারেন সেটাই ভালভাবে করা বা নতুন কাজ করতে গেলেও পুরনো ধারণার পাশাপাশি নতুন ধারণাগুলোকে ধারাবাহিক ভাবে গ্রহণ করা - এতেই মনে হয় অনেকটাই সুস্থ রাখা যায় নিজেকে ও নিজের চারপাশকে।

কী হবে ভোটাভুটি নিয়ে ঝগড়া, অশান্তি করে! প্রতিটি রাজনৈতিক দলই মৌলবাদ অভ্যাস করে প্রচ্ছন্ন বা প্রকট ভাবে। প্রতিটি। ভোটের জন্য। ক্ষমতায় আসার জন্য - যে কোনওরকম ভাবে। প্রতিটি ক্ষমতাবান নিজেরা নিজের মতো আখ্যান তৈরি করে ও জনমানসকে খাওয়ায়।

প্রচুর লোকসংখ্যা। বাসস্থান কম, খাবার কম, অর্থ কম, স্বাস্থ্য খারাপ ও চিকিৎসা করতে পারেন না অর্থাভাবে। বেশির ভাগ মানুষের এইরকমই প্রাপ্তি।

পুঁজিবাদ নিজের চাকচিক্যের জৌলুষে একটা জায়গায় অন্ধ। সে গোটা মানব প্রজাতিকেই এখন থ্রেট করতে চলেছে। এ ক্ষেত্রে সে একেবারে অপারগ। বনাঞ্চল, জঙ্গল, আকাশ, নদী, পাহাড় সব বেআইনিভাবে বা পুঁজিবাদের স্বার্থে তাকে 'নিয়ম' বা 'আইন' বানিয়ে নিলেও এবং তাই প্রাকৃতিক নিয়মকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে যারা পুঁজির ধারক, তারাও কেউ বাদ যাবে না।

ইতিহাসের বিবর্তনে আধুনিকতা যা যা উন্নতি দিয়েছিল, তখন পুঁজিতন্ত্র ছিল নতুন। এখন সেই উপকারী আধুনিকতার মৃত্যু ঘটেছে। তর্কের খাতিরে, মানুষের আহার ও বাসস্থানের সংস্থান যদি হয়েও থাকে  তবুও সুন্দর স্বাস্থ্য চাইলেও আর আসবে না কারণ জল, বায়ু ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা এই আধুনিকতাকেই চ্যালেঞ্জ করছে। যে কোনও রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপরিকাঠামোতেই আর ব্যাখ্যায়িত হতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই হোক বা তথাকথিত সেই স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক  রাষ্ট্র, ব্যাপারটা একই - সবাই  ক্ষমতায় যেটা উপর থেকে নিচে, অথবা, upside down করে অন্যরকম যেন দেখানো দম্ভ-ক্ষমতার উল্টো দৃশ্য। ব্যাপারটা একই। ক্ষমতার হাতবদল।
যদিও ভিন্ন নাম দেওয়া হয় - উৎপাদনের উপকরণ আর উৎপাদিকা শক্তি এরা নাকি উপরিউক্ত দুরকম রাষ্ট্রে আলাদা আলাদা রকমের চরিত্র। আসলে সবাই আধুনিকতার প্রতিযোগী। একই এবং আসলে একই। তারপর সেইসব স্বপ্নের রাষ্ট্র হয়ে যায় বাস্তবিক ডিক্টেটরশিপ অফ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি (ব্যুরোক্রেসি)। কার নামে? ডিক্টেটরশিপ অফ দ্য প্রোলেতারিয়েত'এর নামে। আমরা আর কত যুগ একই চর্বিতচর্বণ করে যাব? আর অত বড় বড় স্প্যানে ভাববই বা কেন? কেনই বা কর্দমাক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কথা নিয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে লোফালুফি আর ঝগড়া করব? এটা তো  দাসত্বই করা।

ভোট যে পারেন যাকে মনে হয় তাকে দিন বা না দিন সেটা আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা কন্সার্নড সিটিজেন হয়ে কি সিভিল রাইটস চাইতে পারি না? আমরা ভোটের বাইনারি খেলায় না গিয়ে  নাগরিক অধিকারগুলো নিয়ে কি সরব হতে পারি না? রাজনৈতিক দলগুলো এটাই শেখায় যে গুচ্ছ গুচ্ছ গণতন্ত্র সব গচ্ছিত আছে পরিষদে বা সংসদে। কিন্তু গণতন্ত্রের অভ্যেস আসলে নাগরিকেরাই করতে পারেন, নাগরিকেরাই গণতন্ত্র, আরও উন্নত গণতন্ত্র চাইতে পারেন। আরও প্রসারিত গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে পারেন। প্রকৃত এই লড়াইয়ে কোনও দল এসে চিহ্ন দাগিয়ে সিলমোহর দিতে পারে না। চলুন, সবাই মিলে যে যার নিজের পরিসরটুকুকেই ভাবি ও সেটাই ভাবি।

Friday, 12 April 2019

ভোট নিয়ে দু-চার কথা

ভোটের বাজার
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


১)
ভোটের এই ভরা বাজারে স্বাভাবিক, বড় বড় নেতা থেকে তালপাতা সেপাই, সকলেই বেশ রসে বশে নেমে পড়েছেন। মিডিয়া থেকে বাড়ির দেয়াল, টুইটার থেকে নেতাদের ভাষণ - কলকলরবে চারপাশ বেশ অগ্নিগর্ভ। ব্যস, ওইটুকুই। খুব বৃদ্ধজনেরা ছাড়া, রাস্তাঘাটে, মেট্রোয়, লোকাল ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে কোথাও ভোট নিয়ে কেউ আলোচনাতেও নেই। যেন, ভোট দিলেই বা কী, না দিলেই বা! কেন এমন হল? ভাবুন, মশাই ভাবুন।

তবে, ক্ষমতা যতই কর্পোরেট বা ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের হাতেই থাকুক না কেন, বোঝা গেছে এও, যে জন আজ বিরোধী তিনি ক্ষমতায় গেলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ; সাধারণ সরকারি চাকরিজীবী চেয়ারে বসেই রক্তচক্ষু; দরিদ্র কৃষকের হাতে ক্ষমতা দাও তো তিনি হবেন পঞ্চায়েতের বাস্তুঘুঘু; শ্রমিকের হাতে ক্ষমতা দাও, তিনি হবেন সাগিনা মাহাতো। পঞ্চায়েত থেকে সংসদ - যেখানেই যে করে হোক যেতে পারলেই হল, গোটা জীবন গুছিয়ে গেল। এই যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বব্যাপ্ত হয়ে গেল, এই হল মোদ্দা কথা। আর ক্ষমতার সেই চাড্ডি পরে নিলেই তুমি মুটে হও কি মুচি, ষোলআনা পোয়াবারো।

ভারতীয় রাজনীতি এখন এই পাকেচক্রে বেশ জটিল হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলই, তারা যখন শাসক, তখন তাদের ভাষা, শাসনক্রম হরেদরে এক। আবার তারা যখন বিরোধী, তখন বিগলিত করুণায় জাহ্নবী। তাই ডান-বামের কার্যসূচিও আর বিভেদরেখা খুঁজে পায় না।

এখন এক আছেন মধুসূদন জনগণ। মেলাবেন তিনি মেলাবেন।


২)
আপনি নেতা, তাই কোন দলে আসলে আছেন কেউ জানে না। এই মুহূর্তে আপনি 'ক' দলে তো আগামী পরশু নিশ্চিত 'খ' দলে। অথবা আবার ঘুরে সেই 'ক' দলেই নচেৎ 'গ' দলে। এই ঘোরাঘুরি, আসা-যাওয়া সবটাই নির্ভর করছে আপনার চাওয়া-পাওয়ার ওপর (দেহাতি ভাষায়, কামাইয়ের ওপর)। আর দল বদলে কথা ও ভাষণেরও কোনও পরিবর্তন দরকার পড়ে না, শুধু খেয়াল রাখতে হয় ঘাড়ের দু পাশে  ঝোলানো কাপড়টি যেন যথাযথ রঙ ও প্রতীক সম্বলিত হয়।

তাহলে আর আমাদের মতো হাড় হাভাতেদের দল ও পছন্দ নিয়ে এত মাথাব্যথা কীসের? আপনি নেতা অথবা ভোটপ্রার্থী, শুধু জয়টুকুই তো চাই আপনার! আপনারও দল নেই, শুধু জেতাটুকু ছাড়া। আমাদেরও নেই, বোতামের ওপর একটি তর্জনীর চাপ ছাড়া। সবুর করুন কাকা! তবে তো মেওয়া ফলবে!!

৩)

বহুদিন মিডিয়া আমাদের গিলিয়েছে 'ভোটব্যাঙ্ক' কথাটি। যেন, সকল ভোটারই নির্দিষ্ট ঘরে স্থিত হয়ে আছেন, আর তার এদিক সেদিক হলেই শোনা যাবে, 'অমুকের ভোটগুলি সব তমুকের দিকে চলে গেল'। অথবা, 'এবার যদি এনাদের ভোট তেনাদের সঙ্গে একজোট হয় তাহলে ওনাদের জেতা মুশকিল'। বুঝুন কাণ্ড! যেন দুই, তিন কি চার সেট ভোটার আছেন, তাদের এ ঘর ও ঘর করিয়ে দিলেই ভোটের খেলা শেষ!

সত্যিই কি গোমুখ্যু জনতা জনার্দন? নাকি, আমার মতের সঙ্গে না মিললেই জনতা অবোধ!

৪)
গত এক-দেড় দশক আগেও রাজ্যে রাজ্যে শাসকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, কে কত সুবিধা উজাড় করে দিয়ে তবে শিল্পপতিদের (বিনিয়োগ) নিজ নিজ রাজ্যে আনতে পারে। বিনিময়ে 'হাত ঘোরালে নাড়ু'টা ছিল কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি। ফাঁকিটা ধরা পড়ে গেছে। তাই এখন আর সে কথা বলে না কেউ! এখন সম্ভাব্য প্রতিযোগী শাসকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি, কে কত প্রকল্পের মধ্য দিয়ে গরিবদের সক্ষম করতে পারে। নচেৎ ভোটের বাজারে ফক্কা। এই দর কষাকষির দড়ির খুঁটটা এখন বেশ হাড়-হাভাতেদের হাতে। কিছু করো তো ভোট নাও, নয়তো যাও। অতএব, নেতাদের প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্প ঘোষণার বন্যা। ফলত, যা কিছু রটে (প্রতিশ্রুতি) তা কিছু তো বটে (রূপায়ণ)।

তাই সর্বত্রই দল, উপদল, নতুন দল, এ জোট, সে জোট। কিছু রাজ্য বাদ দিলে এখন অধিকাংশ জায়গাতেই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জাতীয় দলের লড়াই। কোথাও আবার আঞ্চলিক দল বনাম আঞ্চলিক দল। দল বদল ও নতুন দলের উত্থান এখন হররোজের চালচিত্র। জাতীয় দলও আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে জোট না করলে অধিকাংশ জায়গাতেই পঙ্গু। রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপই পালটে গেছে আমূল।

শাসকদের ওপর চাপ মানে একদম পিছিয়ে পড়া মানুষটার সামান্য হলেও প্রাপ্তি। তাই, চাপ সৃষ্টি করুন, মশাই, চাপ সৃষ্টি করুন।

৫)
প্রথম দফার নির্বাচন ফুরলো। দেশের জনগণকে আনপড়, অশিক্ষিত, বোকা এসব ভাবার কোনও কারণ নেই। তাঁরা ভোটের অনুশীলনে যোগ-বিয়োগ করে একটা গড় ফল দাঁড় করান। দেখা গেছে, তাতে মোটের ওপর মন্দের ভালই হয়। কারণ, কোন দল বর্তমান শাসক, আর কোন দল শাসক হবার অভিলাষী - এই দুইয়ের টানাপোড়েনে একটা গড় ফলাফল তৈরি করে দেন আমজনতা। শাসকেরা ক্ষমতায় গিয়ে কেউই ছেড়ে কথা বলে না, তাই তাদের যতটা পঙ্গু করে শাসক বানানো যায় তেমন একটা কসরতই আমজনতা বেশ সুকৌশলে সেরে ফেলেন। তবুও কি নিস্তার আছে? নৈব নৈব চ।

পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিধানসভা, লোকসভা ইত্যাকার নানাবিধ নির্বাচনে প্রায় প্রতি বছরই দলগুলির একে তাকে এদিক সেদিক ঠেলে ঠুসে দেন নির্বাচকরা। এইটুকুই সোয়াস্তি। আর সেই ঠেলাঠেলিতে আমজনতারও প্রাপ্তি ঘটে। কখনও সার্বিক ভাবে কখনও বা ব্যক্তিগত ভাবেও। এই ব্যক্তিগত প্রাপ্তি আবার আমজনতার একটা অংশকে শাসকের মতোই গড়ে নেয় স্বভাব-চরিত্র সহ। তাই নির্বাচনগুলি নিছকই দেওয়া-নেওয়ার খেলা। জনতা বেশ আমোদের সঙ্গেই এতে অংশ নেন। আর সে আমোদে এখন 'নোটা' হয়েছে এক বাড়তি উৎসাহ।

তবে শাসকের তরফে খুব বেয়াদপি হলে পথে নেমে জনতা শাসককে সবকও শেখান, প্রয়োজনে সশস্ত্র অভিমুখেও জবাব দেন। তাই এই ক্ষেত্রটি কোনও বাগিচার পুষ্প প্রদর্শনী নয় মোটেও, বরং দরিদ্র, দরিদ্রতর, দরিদ্রতম মানুষের সঙ্গে শাসকের এক বরাবরের হিসেব মেলানোর জমি। শাসক আবার রাজ্যে রাজ্যে ভিন্ন। তাই কেন্দ্রের শাসক ও রাজ্যের শাসক যদি দুই ভিন্ন দলের হয় আর ভোটটা যদি হয় কেন্দ্রের শাসক নির্বাচনের তাহলে সে হিসেব কাক্কেশ্বর কুচকুচের হিসেবের থেকেও আরও জটিল হয়ে যায়। এবার কী হবে, বোঝা যাবে ২৩ মে।


এর মধ্যেই এসে গেছে ১৩ এপ্রিল ২০১৯। জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তস্নাত দিনের শতবর্ষ। আজও নির্লজ্জ UK এর জন্য ক্ষমা চাইতে অপারগ। জালিয়ানওয়ালাবাগের শত সহস্র মানুষের স্মৃতি বুকে নিয়ে আমাদের মতো আমজনতাকে আজও তাই প্রহর জেগেই শাসককে নানান কিসিমে যুঝে যেতে হবে। ভোটের বাজারে সেই আমাদের কষ্টসাধ্য সোয়াস্তি।

১২/০৪/২০১৯