Pages

Monday, 20 June 2016

যৌনপেশার অধিকার

চুরি নয় ডাকাতি নয়
প্রার্থিতা সেনগুপ্ত*


ফিনফিনে কাপড়ের আঁচলটা আলতোভাবে গায়ে ফেলা। ন্যুড মেক-আপ। ঠোঁটটা হাইলাইটেড ডার্ক ব্রাউন আউটলাইনে। যাতে ঈষৎ পুরু দেখায়। সামান্য ঠোঁটের ইশারায় কুপোকাৎ দীর্ঘল পুরুষটি। ঘণ্টার বিচারে টাকা ওড়াতে পুরুষটি যেন কার্পণ্য না করে। তার বিনিময়ে মেয়েটি তাকে দেবে সর্বস্ব। সন্ধ্যে নামতেই শুরু হয়ে যায় কাস্টমার ধরার পালা। মেয়েটির কাছে দীর্ঘল পুরুষটি খরিদ্দার ছাড়া আর কিছু নয়। ঘণ্টা পিছু একের পর এক খরিদ্দার। সেক্স, মস্তি। মস্তি শেষ হয় আকণ্ঠ সুধা পানে। দেহ ও সুরা উভয়েই বুঁদ খরিদ্দার।

প্রতিদিনই মেয়েটি নিংড়োয় নিজেকে। তার বিনিময়ে মেলে প্রাপ্য টাকা। সঙ্গে উপহারস্বরূপ আরও কিছু। যৌনরোগ। একের বেশি বহুজনের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করার জন্য মেয়েটির যৌনাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে যৌনরোগ। যেটি দিনের পর দিন অবহেলায় এইচআইভি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এখানেই কড়া হাতে মেয়েদের প্রতিদিন শাসন করে চলেছে এক-একটি ক্লিনিক। চোখ রাঙানি দিয়ে নয়। পরম মমতা ও ভালবাসা দিয়ে। পলাতক, অবিনাশ, রবীন্দ্রসরণি, শেঠবাগান, জোড়াবাগান, রামবাগান। বিরাট সোনাগাছিকে শাসন করছে এরা। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির তত্বাবধানে।

রাতের ফিনফিনে শাড়ির মোহিনীরা সকালে সম্পূর্ণ ভাবে অন্যরকম। এক্কেবারে গৃহিণী। রান্নাবান্না সেরে স্নান করে তৈরি আটপেড়ে শাড়িতে, নয়তো সালওয়ার কামিজে। সেইসব ক্লিনিকের পিয়ার এডুকেটরদের সঙ্গে এদের অনেকেই আসে ক্লিনিকে। শিখে নেয় যৌনরোগের হাত থেকে বাঁচতে কনডোমের সঠিক ব্যবহার। সিফিলিস ও এইচআইভি রক্তে ঢুকল কিনা তার জন্য রক্ত পরীক্ষাও করে। কারণ, সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা যে তারা বেছে নিয়েছে। দেশে তাদের সংসার আছে; যে সংসার বাবা, মা আর বোন কিংবা ছোট ভাইকে ঘিরে। আর নিত্যসঙ্গী অভাব। আছে নিজের সন্তান। তার কিছু হয়ে গেলে সন্তান যে অনাথ হয়ে যাবে। এই ভাবনাতেই তারা ক্লিনিকের সমস্ত কথা মেনে চলে। পিয়ার এডুকেটরস, আউটরিচ ওয়ার্কারস, কাউন্সেলর ও ডাক্তার এই নিয়েই গড়ে ওঠা সেই ক্লিনিক।

পেটের তাগিদে যৌন পেশায় নামা। সামাজিক কষ্ট, মানসিক কষ্ট কোন পর্যায়ে গেলে তারা বেছে নেয় এই পেশা! সর্বোপরি, তারা তো মা। রাতের মোহিনী রূপ শুধুমাত্র দিতে চেয়েছিল অর্ধাঙ্গকে। কিন্তু বিধি বাম। সেই নির্ভর করা মানুষটি তার অর্ধাঙ্গিনীর দেহ ছাড়া আর কিচ্ছু চেনেনি। মেয়েমানুষের আবার মন আছে নাকি! যত বেশি অত্যাচার তত বেশি সেক্স। সহ্য করতে না পেরে দেহকে সম্বল করেই তাদের বেশিরভাগের সোনাগাছি পাড়ি। মনকে তারা পুরুষ নামক বস্তুটির থেকে বিসর্জন দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। একতরফা মনের ভালবাসায় তারা আর মরতে চায় না। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে ‘বাবু’ নামক ‘না প্রেমিক না স্বামী’ বস্তুটির প্রতি তারা মরে। আবার অত্যাচার, মেয়েটির সমস্ত অর্জিত উপার্জন কেড়ে নেবার মতো ঘটনা ‘বাবু’ নামক বস্তুটি ঘটায়। মেয়েটি মন পেতে চেয়েছিল আর পুরুষটি দেহ। যে দেহ যখন খুশি সেই ভোগ করবে। কিন্তু মেয়েটি তো অনেক কষ্ট, অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করে সোনাগাছি এসেছে পেশা করতে। ‘বাবু’র হাত থেকে বাঁচতে তারা শরণাপন্ন হয় দুর্বারের কাছে। আসে ক্লিনিকে। দুর্বার মেয়েটির কথামতো যতটা পারে সাহায্য করে। মেয়েটি চাইলে থানা, পুলিশ পর্যন্তও যায় দুর্বার। সন্তানকে তারা মানুষ করতে চায় নিজের রোজগারে। তথাকথিত সোনাগাছির এক একটি মোহিনী অন্তরে যেন এক একজন সিঙ্গল মাদার।

দেহব্যবসা নয়। আর পাঁচটা পেশার মতো এটিকে যৌনপেশা বলতে চায় তারা। চুরি করছে না, ডাকাতি করছে না, কাউকে খুনও করছে না বরং আনন্দ দান করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাহলে এই বিনোদন পেশাটির জন্য কেন তারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে না! এইসব আইনের ঘেরাটোপকেও অতিক্রম করতে চায় তারা। পৃথিবীর অন্যতম বড় সোনাগাছি যৌনপল্লী দুর্বারের জন্যই আজ নিজের স্বাধিকারের পথে।

*কাউন্সেলর, দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি।       

No comments:

Post a Comment