Pages

Saturday, 18 June 2016

সেজ - না

বকলমে সেজ'এর নিদান?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



খবরে প্রকাশ, ইনফোসিস ও উইপ্রো’র দীর্ঘদিনের সেজ’এর (স্পেশ্যাল ইকনমিক জোন) দাবি এবার নাকি রাজ্য সরকার মানতে চলেছে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি তরফে তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। মন্ত্রী হওয়ার পর তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ব্রাত্য বসু তথ্য প্রযুক্তির কর্ণধারদের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করে সাংবাদিকদের ভাসা ভাসা কিছু বলেছিলেন যাতে এমন একটা সম্ভাবনার কথা মনে হতে পারে। তবে সরকারি তরফে সোজাসুজি তেমন ঘোষণা না এলে খামকা মন্তব্য করা যেমন ঠিক নয়, আবার এও তো বাস্তব যে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। কারণ, খবরে এও প্রকাশ, সরকারি স্তরে এমন একটা আলোচনা চলছে যে, যেহেতু তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে জমির পরিমাণ কম তাই এই ধরনের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত হিসেবে সেজ’এর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, জমি ছোট কি বড় তা সেজ’এর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।

এখানে প্রাথমিক ভাবে দুটো সম্ভাবনা রয়েছে। এক, কর্পোরেট মিডিয়া তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের হয়ে একটা খবর এমন ভাবে নির্মাণ করছে যাতে সরকারকে প্রভাবিত করা যেতে পারে; অন্তত শর্ত সাপেক্ষে ন্যূনতম ক্ষেত্রে বকলমে অন্য নামে বা রূপে হলেও সেজ আদায় হতে পারে। অথবা, দুই, সরকারও হয়তো সেজ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে এবং ধাপে ধাপে কর্পোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকারে আনতে চাইছে। আপাতত আমরা আশঙ্কা ও কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকব।

সেজ হল দেশের এমন একটি বিশেষ অঞ্চল যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমের যে জাতীয় আইনগুলি আছে, তা কার্যকর হয় না। কর্পোরেট’রা অতি মুনাফার লোভে এমন একটি বিশেষ সুবিধা সরকারের থেকে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা জানি,  সেজ স্থাপনার ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল চীন। ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় চীনে শেনজেন, জুহাই ও শানতাও- এই তিন শহরে প্রথম সেজ গড়ে ওঠে। চীনে বিপুল পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ঢুকতে থাকে এবং সেই উৎসাহে আরও বহু শহর ও প্রদেশকে সেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৮ সাল অবধি দেখা যায়, অর্থনীতির ম্যাক্রো স্তরে (গড় বা জাতীয় হিসেবে) অর্থনীতির সূচকগুলো বাড়তে থেকেছে। বিদেশি বিনিয়োগ এলে জাতীয় আয় বাড়ে, চীনেও তাই হয়েছে। আর সেই সুবাদে একটি একনায়কতন্ত্রী দেশ হওয়াতে এবং শ্রমিকদের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন’এর অধিকার অস্বীকৃত থাকাতে সেজ অঞ্চলে শ্রমিকদের অবাধে ও অল্প মজুরিতে খাটিয়ে নেয় বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দেশিয় উদ্যোগপতিরা। বিশ্ব জুড়ে প্রতিপাদ্য হয় সস্তার চীনা পণ্য, যার গুণমান নিয়ে অবশ্য কারও কোনও ভরসা ছিল না। একদিকে বিশাল পরিমাণে কর্পোরেট বিনিয়োগ, অন্যদিকে, তথাকথিত কম্যুনিস্ট শাসিত হওয়ায় একদলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রহীন পরিসরে শ্রমিকদের বাধ্যত নিম্ন মজুরি ও বেশিক্ষণ শ্রম করিয়ে নেওয়ার সুযোগ এবং তার সঙ্গে অন্যান্য শ্রম অধিকারকে লঙ্ঘন করে বেশি মুনাফা অর্জনের প্রতিটি দেয় সুযোগকে কাজে লাগায় বিনিয়োগকারীরা। চীনা অর্থনীতিতে এক আপাত বৃদ্ধি অর্জিত হয় কিন্তু তার ভেতরটা ছিল একেবারেই ফোঁপরা। তাই, চীনে সস্তা মজুরিতে পণ্য তৈরি করে সারা বিশ্বে বেচে কর্পোরেটরা যে মুনাফা কামিয়েছে তার দিন আজ ফুরিয়েছে। কারণ, শ্রম আইন ও শ্রম অধিকার নিয়ে চীনের শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও যে লড়াই চালিয়েছেন (আইনি ও বেআইনি) তার ফলে গত কয়েক বছরে শ্রমিকদের গড় মজুরি আগের থেকে অনেকটা বেড়েছে এবং কর্পোরেটদের মুনাফাও আগের থেকে কমেছে। কর্পোরেটরা এখন নতুন নতুন সস্তা মজুরির দেশে ও সেখানে সেজ গড়ে তাদের পুঁজি নিয়ে পালাচ্ছে, ফলে, গত এক বছরে চীনে নেমে এসেছে এক ঘোরতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বহু কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে এবং শ্রমিক ছাঁটাই এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সংক্ষেপে এই হল বিশ্বে সর্ববৃহৎ সেজ অঞ্চল গড়া চীনের ইতিহাস। ভারতও চীনকে অনুসরণ করে এমন একটা পথ নিয়েছে কিন্তু তা যে তীব্র শ্রমিক শোষণ ও সস্তায় জমি হাতানোর কর্পোরেট ধান্দা ছাড়া আর কিছু দাঁড়ায়নি, তা ইতিমধ্যে বেশ স্পষ্ট। এইসব দেখেশুনেও যদি রাজ্য সরকার সত্যি সত্যি, সীমিত পরিসরে হলেও, নতুন সেজ গড়ার অনুমতি দেয় তা নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সামিল হবে বৈকি।

কলকাতা পুরসভার মেয়রের কণ্ঠে বেশ উচ্চ নিনাদে শোনা যাচ্ছে পূর্ব কলকাতার  অবশিষ্ট জলাভুমি বুজিয়ে ‘উন্নয়ন’এর সদম্ভ ঘোষণা। আবার এই ইনফোসিস ও উইপ্রো’কে সেজ গড়তে দেওয়ার কানাঘুষোও ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে রাজ্য সরকার খোলসা করে বলুক। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের আন্দোলন ‘উন্নয়ন’এর এই জনবিরোধী মিথ্যাচারকে সপাটে প্রত্যাখান করেছিল। দ্বিতীয় দফায় সরকারে এসে তৃনমূল যদি তার ইস্তাহার থেকে পদস্খলিত হয় তবে ইতিহাস কি ক্ষমা করবে?

No comments:

Post a Comment