Pages

Tuesday, 2 September 2025

হায় জাভেদ! তোমার দিন গিয়াছে!

জাভেদ'জীকে শুনতে চাই

আবু সঈদ আহমেদ



খবরে প্রকাশ, কলকাতায় বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ উর্দু একাদেমি'র তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ১ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কলকাতার কলামন্দিরের কলাকুঞ্জ প্রেক্ষাগৃহে। অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল: হিন্দি সিনেমায় উর্দু।

প্রথম কথা, পশ্চিমবঙ্গে এত কিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সরকারি খরচে কেন 'হিন্দি সিনেমায় উর্দু' বিষয়ক অনুষ্ঠান করতে হবে তা আমার বোধগম্য হয়নি।

দ্বিতীয় কথা, জাভেদ আখতার এখানে সরকারি আতিথ্যে এসে কী বলতেন জানি না। তবে এই মওকায় আমার নিজের কিছু কথা একটু শুনিয়ে দিতে চাই। বহুদিন পর্যন্ত উর্দু শব্দ ও ভঙ্গিমা বলিউডি হিন্দি সিনেমার আত্মা ছিল। আজ তা 'ইশ্ক‌ সুভানাল্লা' বা 'তুঝ মে রব দিখতা হ্যায়' কিংবা 'সাজদা, প্যায়ার কা সাজদা' জাতীয় প্রেমের গানেই সীমাবদ্ধ। বাকি অংশে উর্দুকে ঝেঁটিয়ে দূর করে হিন্দি ভাষার শুদ্ধিকরণ হয়েছে, ‘জরুরত’, ‘ওয়াক্ত’এর বদলে 'আবশ্যকতা', ‘স্যম্যয়’ এসেছে। যেরকমটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিতদের হাত ধরে বাংলা ভাষার ‘ফোর্ট উইলিয়ামীকরণ’ হয়েছিল। 

সেলিম-জাভেদ জুটির অনবদ্য চিত্রনাট্য 'শোলে' যে 'তাজিরাত-এ-হিন্দ'এর মাধ্যমে গব্বর সিং'এর ৩০ বছর কারাবাসের শাস্তি শুনিয়েছিল, কালের চক্রে সেই ‘তাজিরাত-এ-হিন্দ’এর বদলে ‘ভারতীর ন্যায় সংহিতা’ এসেছে। জাভেদ আখতারের বাসস্থান যে রাজ্যে, সেখানে এসব বলার সুযোগ পাবেন না সেটা বলাই বাহুল্য। তাই হয়তো এখানে এসে এই দুঃখের বয়ান রাখতেন। তবে এসব আমার অনুমান মাত্র।

তৃতীয় কথা, এবার আসা যাক যে সব সংগঠনগুলি এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেছে তাদের প্রসঙ্গে। প্রথম সংগঠন 'জমিয়তে উলেমা'র ব্যাপারে অনেকেই শুনেছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুফতি কিফায়াতুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ, মাহমুদ হাসান মাদানী বা হুসাইন আহমাদ মাদানীর মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা এই সংগঠন থেকেই এসেছেন। এই সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার কর্ণধারের এক পত্রাঘাতে নাকি উর্দু একাডেমির উদ্যোক্তারা পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছেন বলে শোনা গেছে। কয়েকদিন আগে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরাই গরু ব্যবসায়ী নিগ্রহে কোক-অভেন থানায় গিয়ে গুজব না ছড়ানো আর শান্তিরক্ষার বার্তা দিয়ে ভিডিও করেছিলেন। কিন্তু ঠিক এমন কী ঘটল, যে জমিয়তের দেশ-বিদেশের নেতারা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসেন, সেই জমিয়তে জাভেদ আখতারকে নিয়ে এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে একেবারে পত্রাঘাত করে বসল! আরও কৌতূহল হয়, যখন ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে অনিয়ম হয়, একের পর এক যোগ্য প্রার্থীকে ভুগতে হয়,  কিংবা গঙ্গা ভাঙন চলে, তখন ওনারা এরকম জবরদস্ত পত্রাঘাত করেছেন কী? নিদেনপক্ষে সেই সংগঠনের স্মরণীয়-বরণীয় মানুষেরা আজ যে বিস্মৃতির কবলে চলে গেছেন, তা নিয়েও কিছু করেছেন কিনা জানা যায়নি। করে থাকলেও তাতে যে অভীষ্ট ফল লাভ হয়নি তা বাস্তব পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

আরেকটি সংগঠন 'ওয়াহিয়াইন ফাউন্ডেশন'এর ব্যাপারে বিশেষ জানা নেই। একটি ওয়েবসাইটে দেখলাম তারা বিভিন্ন রকমের কোর্স করায়। তা তারা আরও বৃহত্তর জনগণের মধ্যে তাদের এলেম বিতরণ করুন, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি। সংবাদে প্রকাশ, তাদের হয়ে মুফতি শামাইল নাদভি সাহেব জানিয়েছেন, তাঁরা নাকি জাভেদ'জীকে ব্যক্তি হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তাঁর কিছু কথা সম্প্রদায়কে আঘাত করেছে, এ জন্য সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা উচিত নয়। তা বেশ, তবে একটি প্রশ্ন। অন্তত ওয়েবসাইট থেকে যেটা জানা যাচ্ছে, তাঁদের দফতরটি যে অঞ্চলে সেখানে এখন বিধায়ক রাজ্যের শাসক দলের বাবুল সুপ্রিয়, যিনি কেন্দ্রের শাসক দলে থাকার সময় এই একই সম্প্রদায়কে আঘাত করে অনেক কিছুই করেছেন। তার ওপর নির্বাচনের সময় একটি বেসুরো গান সম্প্রচার করে বাঙালির কৃষ্টিতে এক চিরকালীন বিভীষিকা তৈরি করে রেখেছেন। এ হেন সুপ্রিয়বাবু তাঁদের এলাকার বিধায়ক হওয়াতে তাঁরা কতটা আহত বা আদৌ কিছু আঘাত পেয়েছেন কিনা, আমার জানতে বিশেষ আগ্রহ হচ্ছে।

চতুর্থ কথাটি বহু পুরনো। বারবার নানা দিক থেকে বহু বিতর্ক হয়, আবার নতুন করে বলতে হয়। অনুষ্ঠানের বিরোধীদের তরফ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, জাভেদ আখতারের ব্যক্তিগত বিশ্বাস অর্থাৎ নাস্তিকতার জন্য উর্দু একাডেমিতে তাঁর অনুষ্ঠান করা উচিত নয়। এর মানে, প্রকারান্তরে, উর্দুকে মুসলমানের ভাষা, এমনকি ‘মুসলমানের একমাত্র ভাষা’ বলে চালিয়ে দেওয়া হল, যা পাকিস্তানের স্বৈরশাসক থেকে দক্ষিণবঙ্গের বাবুসমাজ প্রত্যেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করে গেছে। আমাকে কলকাতায় এসে বহুবার শুনতে হয়েছে, 'মুসলমান? আমি তো ভাবছিলাম বাঙালি!' যা, ছোটবেলায় যেখানে বড় হয়েছি সেখানে আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। অনেকে আমার নাম শুনে ভাঙাচোরা হিন্দি দিয়েই বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে চেয়েছেন। এঁরা ভুলে যান, ১৯৫২'র রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর ১৯৫৪'র ভোটে হেরে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ 'মারী চুক্তি' অনুযায়ী বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মেনে নেওয়ায় 'উর্দুই মুসলমানের একমাত্র ভাষা' তত্ত্বটির চিরকালীন সমাধি হয়ে গেছে।

জাভেদ আখতারকে ছেড়ে এবার উর্দু সাহিত্যের অন্যান্য কবিদের দিকে যদি দেখা যায়, যাঁদের মধ্যে মির্জা গালিবের মতো বিশ্বনন্দিত কবিরাও আছেন, তাঁদের লেখনিতে যে ভাবব্যঞ্জনা ফুটে উঠত তাতে শরাবঢালা চ্যাংড়া শাকি আর কষকে বাঁধা জুলফের ইস্কের যত ছড়াছড়ি, তা দেখে উলেমারা যুগ যুগ ধরে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ে গেছেন। কিন্তু সাহিত্য-অনুরাগীদের কাছে সে সব রচনার কোনও সমাদর কমেনি। অন্যদিকে নাস্তালিক হরফে লেখা উর্দুতেই দিব্যি স্বচ্ছন্দ ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী ভগৎ সিং থেকে গান্ধীবাদী কৈলাসনাথ কাটজু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রত্যেকেই নিজেদের কাজে উর্দুর ব্যবহার করেছেন। 

জাভেদজী তাঁর বক্তব্যে কী বলতেন জানি না, তবে মনে করিয়ে দিতে চাই, বলিউডে 'ফিরাক গোরখপুরী' নাম নিয়ে কলমের জাদু দেখিয়েছেন রঘুপতি সহায়। আজও 'হুমা কানপুরি' ছদ্মনামে শ্রোতাদের 'মস্ত্‌' করে দিচ্ছেন কবি হৃদয়েশ নারায়ণ শুক্লা। যাঁরা জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিলের প্রতিবাদ করেছেন, সেই মুদার পাথারেয়া, রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা, অভয় ফাদনীস প্রমুখের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস উর্দু প্রেমে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

পঞ্চম কথা, জাভেদ আখতার যে ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে এসেছেন সেই ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে থাকেন। সেগুলো সব সময় সবার কাছে যে সমাদরে গৃহীত হয় না, তা আপনারা তাঁর অনুষ্ঠান নিয়ে এই সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝে থাকবেন। তবে জাভেদ আখতার, শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দীন শাহ প্রমুখ কিংবদন্তী অভিনেতারা সর্বভারতীয় বিনোদন জগতে যে প্রগতিশীল বলয় তৈরি করেছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব আজ কতটা তা নিয়ে ওনারা কী ভাবেন তা জানা যায়নি। হয়তো ঘনিষ্ঠ মহলে কিছু বলে থাকবেন। এসব নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা তাঁর আপামর অনুরাগীদের সঙ্গেও ভাগ করে নিন, এটাই  গুজারিশ রইল।

ষষ্ঠ কথা, এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগে ভারতীয় ভাষা পরিষদ ভবনে হজরত মহম্মদ(সঃ)'এর ওপর একটি অনুষ্ঠান রহস্যময় কারণে শেষ মুহুর্তে বাতিল হয়ে যায়। আরও রহস্যময়  ভাবে তা নিয়ে মিডিয়াতে কোনও হইচই হয়নি। কদিন আগে আবার ধর্নার অনুমতি বাতিলের জেরে এক বিধায়ক সহ ৯৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শোনা যায়, একবার উৎপল দত্ত তাঁর নাটকের শো বাতিল হয়ে যাওয়ার পর বলেছিলেন, 'যে নাটকটা আপনারা দেখতে এসেছিলেন, তা বিনামূল্যেই দেখে নিলেন।' গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যদি এরকম অনুষ্ঠান আর কর্মসূচি বাতিলের নাটক চলতে থাকে তাহলে মানুষ তামাশা দেখার জন্য জলসাঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবেন আর অভিনেতা-টেকনিশিয়ানদের পেট চালাতে শ্যুটিং'এর সেট ছেড়ে তামাশা দেখতে আসা ভিড়ের মধ্যেই বাদাম বেচতে হবে।

ঘটনা প্রসঙ্গে জাভেদজী জানিয়েছেন, তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সংগঠনের কাছ থেকেই ঘৃণা পেয়ে থাকেন। হিন্দু সংগঠনগুলো তাঁকে পাকিস্তান চলে যেতে বলে। সম্প্রতি তিনি লাহোর গিয়ে সমাদরই পেয়েছিলেন বলে জানি। বিভিন্ন ছবিতে দেখেছি, পাকিস্তানের বড় বড় তারকারা তাঁর পায়ের কাছে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর বাণী অবগাহন করছেন। এরকম দৃশ্য কলকাতায় দেখতে পাওয়া গেল না। বরং কলকাতায় এসে হেনস্থা হয়েছেন অনেক শিল্পী ও খেলোয়াড়। এই তালিকাটা একটু বাড়ল।

আশা রাখি, জাভেদ আখতারকে শীঘ্রই আবার রাজ্য সরকারের তরফ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। উর্দু একাডেমি'র মতো ছোটখাটো নয়, 'ধনধান্যে'র মতো বড় কোনও সভাগৃহে তাঁকে বলতে দেওয়া হবে। সেখানে আমরা তন্ময় হয়ে শুনব, কীভাবে গুরু দত্তের সময়ের বলিউডে বাঙালি শিল্পী থেকে বাঙালি কৃষ্টির কদর হত, আর এখন বাঙালি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর নামও বিকৃত করা হয়; তাঁর কর্মমন্দির বলিউডের এই যাত্রাপথকে তিনি কীভাবে দেখেন।


5 comments:

  1. সঠিক কথা বলেছেন। মৌলবাদীদের বাঙালি চিনবে কবে? তসলিমাকে বাংলা ছাড়া কারা করেছিল সব মনে আছে।

    ReplyDelete
  2. মুসলিম মৌলবাদের কাছে যে এই সরকার বিকিয়ে গেছে, এটা তারই প্রমাণ। তা সে যতো জোর করেই বা পৈতে পরার মত দূর্গা-অঙ্গন হোক না কেন।

    ReplyDelete
  3. শিল্প কৃষ্টি ভাষার চেয়ে বড় ভোট। আর কিসে ভোট কমতে পারে তার আন্দাজ বা নাগাল পেতে এরা যা খুশি করতে পারে। কাল হয়ত জন্তু জানোয়ারেরও হিন্দু, মুসলমান খোঁজা হবে। দেশের বৈচিত্র ভুলে এরা বিচিত্র দেশ গঠন করতে চায় যেখানে ভোট আর নোটের সমান মূল্য।

    ReplyDelete
  4. https://www.facebook.com/share/p/1PhMXVKbsQ/

    ReplyDelete
  5. সোমা চ্যাটার্জি3 September 2025 at 12:01

    বাহঃ ভাল লিখেছেন, কলকাতা বাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর চেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছে, এবং এটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিচ্ছে আস্তে আস্তে.. সরকার এটার দায়িত্ব না নিলে কিছু করার নেই আমাদের

    ReplyDelete